পাহাড়ি জনপদে অস্ত্রের মুখে অপহরণ : ৩ জনের মরদেহ উদ্ধার

কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার দমদমিয়া পাহাড়ি এলাকা থেকে গতকাল অপহরণের শিকার তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশ বলছে, গত ২৮ এপ্রিল তথা ২৫ দিন আগে পাত্রী দেখতে এসে অপহরণের শিকার হয়েছিলেন তারা। পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, এই তিন বন্ধু পাত্রী দেখে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে ফিরে যাচ্ছিলেন। অটোরিকশা থামিয়ে পথ থেকে তাদের অপহরণ করে গহীন জঙ্গলে নিয়ে যায় দৃর্বৃত্তরা।

কক্সবাজারের সীমান্ত উপজেলা টেকনাফের পাহাড়ি এলাকায় ধারাবাহিকভাবে এমন অস্ত্রমুখে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। কোন অবস্থায় অপহরণের ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, গত ৬ মাসে টেকনাফের পাহাড়ি এলাকা থেকে প্রায় ৭৫ জনকে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রোহিঙ্গা রয়েছে ৪০ জন। অপহরণের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত ৩৫ জন মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন বলে ভুক্তভোগীদের পরিবার সূত্রে জানা গেছে।

এরই ধারাবাহিকতায় টেকনাফের গহীন পাহাড়ে অপহরণকারীর আস্তানায় গতকাল পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা অভিযান চালিয়ে অর্ধগলিত ৩ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে। এ ঘটনায় অপহরণে জড়িত একজনকে আটক করা হয়েছে। গতকাল বিকেল সাড়ে ৫টায় শুরু হওয়া এ অভিযান চলে রাত ৮টা পর্যন্ত।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম। তিনি জানিয়েছেন, টেকনাফের দমদমিয়া এলাকার গহীন পাহাড়ে অপহরণকারীর আস্তানায় র‌্যাব ও পুলিশ যৌথভাবে এ অভিযান চালায়। অভিযানস্থল গহীন পাহাড় থেকে অর্ধগলিত ৩ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে।

র‌্যাব-১৫ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন জানিয়েছেন, মরদেহ ৩টি টেকনাফ গিয়ে গত ২৮ এপ্রিল অপহৃত ৩ যুবকের বলে দাবি করছেন স্বজনরা। স্বজনদের দাবি সঠিক হলে মরদেহ ৩টি কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার জালালাবাদ সওদাগর পাড়া এলাকার মোহাম্মদ ইউছুপ, চৌফলদন্ডী ইউনিয়নের জমির উদ্দিন রুবেল, কক্সবাজার শহরের নুনিয়াছড়া এলাকার ইমরান এর। এরা তিনজনই বন্ধু।

র‌্যাব-১৫ এর অধিনায়ক আরও জানান, ২৮ এপ্রিল টেকনাফে গেলে তাদের সিএনজি গাড়ি থামিয়ে একদল অপহরণকারী পাহাড়ের গহীন জঙ্গলে নিয়ে যায়। পরে তাদের ছেড়ে দিতে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে নির্যাতনের ভিডিও পাঠানো হয়। ঘটনার পর থেকে পরিবারের সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকটি সংস্থায় যোগাযোগ রক্ষা করে। কিন্তু গহীন জঙ্গল এবং অপহরণকারীরা বার বার স্থান পরিবর্তন করায় তাদের উদ্ধার এবং জড়িত কাউকে আটক করা যায়নি। পরে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ঘটনায় জড়িত একজনকে আটক করেছে র‌্যাব। পরে তার স্বীকারোক্তি মতে ঘটনাস্থলে পৌঁছে তিন মরদেহের সন্ধান পাওয়া যায়।

টেকনাফ থানার ওসি মো. আবদুল হালিম বলেন, আটক ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে টেকনাফের গভীর জঙ্গলে অভিযান চালানো হয়। এ সময় ৩ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে মর্গে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। অভিযানে একজনকে আটক করা হলেও তার নাম পরিচয় তিনি জানাতে পারেননি।

স্থানীয়রা জানান, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার বছরখানিকের মধ্যে অপহরণকারী চক্র বেড়ে যায়। আশ্রিত রোহিঙ্গারা উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন পাহাড়ের ঢালেফালে অবস্থান নিয়ে এ অপহরণ কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। এখন অপহরণকারী চক্রের হাতে রয়েছে অস্ত্র। তারা রোহিঙ্গা শিবির কেন্দ্রিক জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্য। তাদের সঙ্গে রয়েছে স্থানীয় কিছু যুবক। তাদের সহযোগিতায় ধারাবাহিক এ অপহরণ চলছে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানও অব্যাহত রয়েছে।

ভুক্তভোগীরা জানান, সকাল সন্ধ্যায় জমিতে কাজ করার সময়, ভোরে মসজিদে যাওয়ার পথে, সন্ধ্যা নামলে পাহাড়ি জনপদগুলো যেনো অন্যরকম পরিবেশ তৈরি হয়। মুখোশ পরা দুর্বৃত্তের দল অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সাধারণ মানুষকে অপহরণ করে গহীন পাহাড়ে নিয়ে যায়। পরে স্বজনদের ফোনে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে বলা হয় বিষয়টি কাউকে না জানাতে। তাদের দেয়া সময়ের মধ্যে মুক্তিপণ দিয়ে আক্রান্তদের ছেড়ে দেয়া হয়। আবার মুক্তিপণ দিতে বিলম্ব হলে তাদের ওপর চলে পাশবিক নির্যাতন। সর্বশেষ অপহরণের শিকার কক্সবাজার সদরের ৩ যুবকের মরদেহ উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এভাবেই চলছে কক্সবাজারের টেকনাফের পাহাড়ি জনগণের জীবনযাত্রা।

অপহরণের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত ৩৫ জনকে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়েছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। গত রোববার সকালে টেকনাফ বাহারছড়ায় ৩ বন্ধু মিলে এক বন্ধুর জন্য পাত্রী দেখতে যান। যাওয়ার পথে অপহরণকারীদের হাতে আটকে পড়ে ওই ৩ বন্ধু। পরে মুক্তিপণ দাবি করা হয় ৩০ লাখ টাকা। অবশেষে মুক্তিপণ না দেয়ায় দীর্ঘ ২৫ দিন পর গতকাল বিকেলে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর আগে পানের বরজে কাজ করার সময় স্কুল ছাত্রসহ দুইজন অপহরণের শিকার হয়েছে। এ সময় আরও দুইজনকে কুপিয়েছে অপহরণকারীরা।

অপহরণের শিকার দুজন হলেন- ৬ নং ওয়ার্ডের জাহাজ পুরার বাসিন্দা বাছা মিয়ার ছেলে রহিম উদ্দিন (৩২) ও মো. সরোয়ারের ছেলে মো. রিদুয়ান (১৯)। তারা সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা। আর আহতরা হলেন- একই এলাকার বাসিন্দা দুই সহোদর আবদুল আমিন (২৫) ও আবদুল্লাহ (১৭)।

এদিকে, গত ১ মে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের জাহাজপুরা পাহাড় থেকে অপহৃত ২ জনকে উদ্ধার করেছিল বলে জানান টেকনাফ থানার ওসি আবদুল হালিম।

পুলিশ বলছে, অপহরণকারীদের ধরতে কাজ করছে তারা। এর আগে গেল ১৬ মার্চ সকালে জাহাজপুরা এলাকা থেকে কলেজ শিক্ষার্থী গিয়াস উদ্দিন (১৭), রশিদ আলম (২৬), জানে আলম, (৪৫), জাফর আলম (৪০), জাফরুল ইসলাম (৩০), ফজল করিম (৩০) ও আরিফ উল্লাহ (৩০) অপহরণের শিকার হন। ১৯ মার্চ জাদিমুড়ার জুম্মা পাহাড়ি এলাকা থেকে অপহরণের শিকার হন মোহাম্মদ ছৈয়দ। ২৪ মার্চ রহমত উল্লাহ নামে আরেকজন অপহরণের শিকার হন। ২ মার্চ অপহরণের শিকার হন ৪ মার্চ ৭০ হাজার টাকায় মুক্তিপণে ফিরে আসেন টেকনাফ বাহারছড়ার মারিশবনিয়া এলাকা থেকে প্রবাসী হোসন আলীর ছেলে মো. সালমান (৫) এবং মো. আলীর ছেলে উবাইদুল্লাহ (১৩)।

গত ২৪ এপ্রিল দুপুরে হ্নীলা দমদমিয়া ন্যাচার পার্কে ঘুরতে গিয়ে শিবিরের সি-ব্লকের বাসিন্দা হাবিবুর রহমানের ছেলে মো. বেলাল (১৩), মোহাম্মদ ইলিয়াসের ছেলে নূর কামাল (১২), মো. উবায়দুল্লাহর ছেলে নূর আরাফাত (১২), বি ব্লকের মো. রফিকের ছেলে ওসমান (১৪) এবং ডি ব্লকের মাহাত আমিনের ছেলে নুর কামাল (১৫) অপহরণের শিকার হন। তারা ২৮ এপ্রিল মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসেন।

গত ২৮ জানুয়ারি বাহারছড়া ইউনিয়নের চৌকিদারপাড়া এলাকা থেকে অপহরণ হন নুরুল আমিনের ছেলে রহমত উল্লাহ (২৫) ও আলী আকবর এর ছেলে আবদুল হাফিজ।

গত ৯ জানুয়ারি উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের লেচুয়াপ্রাং এলাকা থেকে অপহরণের শিকার আবুল হোসেনের ছেলে আবদুস সালাম, গুরা মিয়ার ছেলে আবদুর রহমান, রাজা মিয়ার ছেলে মুহিব উল্লাহ ও রাজা মিয়ার ছেলে আবদুল হাকিম। স্থানীয়দের দেয়া তথ্যমতে, এসব অপহরণের সঙ্গে স্থানীয় অপরাধীরা জড়িত।

বিভিন্ন সূত্রমতে জানা গেছে, টেকনাফ বাহারছড়ার জাহাজপুরা, হ্নীলা ইউনিয়নের রঙ্গীখালী এবং হোয়াইক্যং ইউনিয়নে বারবার অপহরণের ঘটনা ঘটছে। কখনো স্থানীয় আবার কখনো রোহিঙ্গারা অপহরণের শিকার হচ্ছে। অনেকে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে এলেও অনেকে আর ফিরে আসেননি। এসব এলাকার কিছু চিহ্নিত অপরাধী ও জনপ্রতিনিধি এ অপরাধের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রয়েছে।

বাহারছড়া ইউনিয়নের ইউপি সদস্য হুমায়ুন ও রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা শুনতে পেয়েছি, আমাদের মহিলা ইউপি সদস্য এবং ৬ নং ওয়ার্ড চৌকিদার ইসহাক অপহরণ চক্রের সঙ্গে জড়িত। আমরা বারংবার অভিযোগ করার পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এ অবস্থায় চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছি।

তারা আরও বলেন, এর আগে চৌকিদার ইসহাক অপহরণের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগ করেছেন। কিন্তু ইউপি সদস্য মুবিনা আক্তারকে আটক করা হয়নি। তাদের আটক করা গেলে অপহরণের সঠিক তথ্য বেরিয়ে আসবে বলেও তারা মনে করছেন। তবে ফোন রিসিভ না করায় মুবিনা আক্তারের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

অন্যদিকে হ্নীলা ইউনিয়নের রঙ্গীখালী এলাকার শাহ আলম গ্রুপের মো. ইউনুস এর ছেলে ইয়াসিন আরাফাত, দিল মোহাম্মদের ছেলে সাদেক এবং বাইদুল প্রকাশ উদুল্লাহ অপহরণের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু তাদের অবস্থান পাহাড়ি এলাকায় হওয়ায় তাদের সহজে গ্রেপ্তার করতে পারছে না পুলিশ। সম্প্রতি গ্রুপ প্রধান শাহ আলম পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন। রয়েছে গিয়াস উদ্দিন গ্রুপ নামে আরও একটি গ্রুপ। সম্প্রতি অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন গিয়াস উদ্দিন। স্থানীয় এ চক্রের সঙ্গে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের যোগাযোগ রয়েছে বলে দাবি স্থানীয়দের। গত ৬ মাসে এসব ইউনিয়ন থেকে কৃষক ও ছাত্রসহ ৬২ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩৪ জন স্থানীয় বাসিন্দা, বাকি ২৮ জন রোহিঙ্গা।

এ বিষয়ে বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক মশিউর রহমান বলেন, জাহাপুরা পাহাড়ি এলাকায় কিছু বসতি আছে। তারা পানের বরজ, সুপারি, সবজি বাগান করে। বাগান পরিচর্যার জন্য গেলে অপহরণের শিকার হন।

তিনি আরও বলেন, এ অপহরণ কাণ্ডে স্থানীয় কিছু চক্র জড়িত আছে বলে আমরা শুনেছি। তাদের চিহ্নিত করার পাশাপাশি অভিযোগের তদন্ত করা হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ভুক্তভোগী কেউ সহজে পুলিশকে তথ্য দিতে চায় না।

হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মো. আলী বলেন, গত কয়েক মাসে আমার এলাকা থেকে অন্তত ২০ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। রঙ্গীখালী এলাকায় কিছু অপরাধী রয়েছে। তাদের সঙ্গে রোহিঙ্গাও জড়িত। এসব অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা গেলে অপহরণসহ সব ধরনের অপরাধ কমে আসবে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও কঠোর হতে হবে।

টেকনাফ থানার ওসি আবদুল হালিম বলেন, যেহেতু এলাকাগুলো দুর্গম, তাই কৃষকদের আমরা বলেছিলাম, তারা যেন পাহাড়ি এলাকায় সংঘবদ্ধ থাকে। কিন্তু তারা বিষয়টি আমলে না নিয়ে যে যার মতো কাজে যায়। আর সুযোগ বুঝে তাদের অপহরণ করে অপরাধীরা। এতে আমদেরও বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। তারপরও আমাদের সীমাবদ্ধতার মাঝে অপহরণকারীদের চিহ্নিত করে কীভাবে অপরাধ নির্মূল করা যায় তা নিয়ে আমরা কাজ করছি।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম বলেন, অপরাধীদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আমরা সব তথ্য-উপাত্ত নিয়ে খুব শীঘ্রই পাহাড়ে অভিযান পরিচালনা করবো। তবে দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় কাজ করা আমাদের জন্য দুরূহ হয়ে পড়ছে।

বৃহস্পতিবার, ২৫ মে ২০২৩ , ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০, ০৫ জিলক্বদ শাওয়াল ১৪৪৪

পাহাড়ি জনপদে অস্ত্রের মুখে অপহরণ : ৩ জনের মরদেহ উদ্ধার

জেলা বার্তা পরিবেশক, কক্সবাজার

image

কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার দমদমিয়া পাহাড়ি এলাকা থেকে গতকাল অপহরণের শিকার তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশ বলছে, গত ২৮ এপ্রিল তথা ২৫ দিন আগে পাত্রী দেখতে এসে অপহরণের শিকার হয়েছিলেন তারা। পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, এই তিন বন্ধু পাত্রী দেখে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে ফিরে যাচ্ছিলেন। অটোরিকশা থামিয়ে পথ থেকে তাদের অপহরণ করে গহীন জঙ্গলে নিয়ে যায় দৃর্বৃত্তরা।

কক্সবাজারের সীমান্ত উপজেলা টেকনাফের পাহাড়ি এলাকায় ধারাবাহিকভাবে এমন অস্ত্রমুখে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। কোন অবস্থায় অপহরণের ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, গত ৬ মাসে টেকনাফের পাহাড়ি এলাকা থেকে প্রায় ৭৫ জনকে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রোহিঙ্গা রয়েছে ৪০ জন। অপহরণের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত ৩৫ জন মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন বলে ভুক্তভোগীদের পরিবার সূত্রে জানা গেছে।

এরই ধারাবাহিকতায় টেকনাফের গহীন পাহাড়ে অপহরণকারীর আস্তানায় গতকাল পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা অভিযান চালিয়ে অর্ধগলিত ৩ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে। এ ঘটনায় অপহরণে জড়িত একজনকে আটক করা হয়েছে। গতকাল বিকেল সাড়ে ৫টায় শুরু হওয়া এ অভিযান চলে রাত ৮টা পর্যন্ত।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম। তিনি জানিয়েছেন, টেকনাফের দমদমিয়া এলাকার গহীন পাহাড়ে অপহরণকারীর আস্তানায় র‌্যাব ও পুলিশ যৌথভাবে এ অভিযান চালায়। অভিযানস্থল গহীন পাহাড় থেকে অর্ধগলিত ৩ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে।

র‌্যাব-১৫ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন জানিয়েছেন, মরদেহ ৩টি টেকনাফ গিয়ে গত ২৮ এপ্রিল অপহৃত ৩ যুবকের বলে দাবি করছেন স্বজনরা। স্বজনদের দাবি সঠিক হলে মরদেহ ৩টি কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার জালালাবাদ সওদাগর পাড়া এলাকার মোহাম্মদ ইউছুপ, চৌফলদন্ডী ইউনিয়নের জমির উদ্দিন রুবেল, কক্সবাজার শহরের নুনিয়াছড়া এলাকার ইমরান এর। এরা তিনজনই বন্ধু।

র‌্যাব-১৫ এর অধিনায়ক আরও জানান, ২৮ এপ্রিল টেকনাফে গেলে তাদের সিএনজি গাড়ি থামিয়ে একদল অপহরণকারী পাহাড়ের গহীন জঙ্গলে নিয়ে যায়। পরে তাদের ছেড়ে দিতে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে নির্যাতনের ভিডিও পাঠানো হয়। ঘটনার পর থেকে পরিবারের সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকটি সংস্থায় যোগাযোগ রক্ষা করে। কিন্তু গহীন জঙ্গল এবং অপহরণকারীরা বার বার স্থান পরিবর্তন করায় তাদের উদ্ধার এবং জড়িত কাউকে আটক করা যায়নি। পরে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ঘটনায় জড়িত একজনকে আটক করেছে র‌্যাব। পরে তার স্বীকারোক্তি মতে ঘটনাস্থলে পৌঁছে তিন মরদেহের সন্ধান পাওয়া যায়।

টেকনাফ থানার ওসি মো. আবদুল হালিম বলেন, আটক ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে টেকনাফের গভীর জঙ্গলে অভিযান চালানো হয়। এ সময় ৩ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে মর্গে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। অভিযানে একজনকে আটক করা হলেও তার নাম পরিচয় তিনি জানাতে পারেননি।

স্থানীয়রা জানান, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার বছরখানিকের মধ্যে অপহরণকারী চক্র বেড়ে যায়। আশ্রিত রোহিঙ্গারা উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন পাহাড়ের ঢালেফালে অবস্থান নিয়ে এ অপহরণ কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। এখন অপহরণকারী চক্রের হাতে রয়েছে অস্ত্র। তারা রোহিঙ্গা শিবির কেন্দ্রিক জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্য। তাদের সঙ্গে রয়েছে স্থানীয় কিছু যুবক। তাদের সহযোগিতায় ধারাবাহিক এ অপহরণ চলছে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানও অব্যাহত রয়েছে।

ভুক্তভোগীরা জানান, সকাল সন্ধ্যায় জমিতে কাজ করার সময়, ভোরে মসজিদে যাওয়ার পথে, সন্ধ্যা নামলে পাহাড়ি জনপদগুলো যেনো অন্যরকম পরিবেশ তৈরি হয়। মুখোশ পরা দুর্বৃত্তের দল অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সাধারণ মানুষকে অপহরণ করে গহীন পাহাড়ে নিয়ে যায়। পরে স্বজনদের ফোনে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে বলা হয় বিষয়টি কাউকে না জানাতে। তাদের দেয়া সময়ের মধ্যে মুক্তিপণ দিয়ে আক্রান্তদের ছেড়ে দেয়া হয়। আবার মুক্তিপণ দিতে বিলম্ব হলে তাদের ওপর চলে পাশবিক নির্যাতন। সর্বশেষ অপহরণের শিকার কক্সবাজার সদরের ৩ যুবকের মরদেহ উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এভাবেই চলছে কক্সবাজারের টেকনাফের পাহাড়ি জনগণের জীবনযাত্রা।

অপহরণের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত ৩৫ জনকে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়েছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। গত রোববার সকালে টেকনাফ বাহারছড়ায় ৩ বন্ধু মিলে এক বন্ধুর জন্য পাত্রী দেখতে যান। যাওয়ার পথে অপহরণকারীদের হাতে আটকে পড়ে ওই ৩ বন্ধু। পরে মুক্তিপণ দাবি করা হয় ৩০ লাখ টাকা। অবশেষে মুক্তিপণ না দেয়ায় দীর্ঘ ২৫ দিন পর গতকাল বিকেলে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর আগে পানের বরজে কাজ করার সময় স্কুল ছাত্রসহ দুইজন অপহরণের শিকার হয়েছে। এ সময় আরও দুইজনকে কুপিয়েছে অপহরণকারীরা।

অপহরণের শিকার দুজন হলেন- ৬ নং ওয়ার্ডের জাহাজ পুরার বাসিন্দা বাছা মিয়ার ছেলে রহিম উদ্দিন (৩২) ও মো. সরোয়ারের ছেলে মো. রিদুয়ান (১৯)। তারা সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা। আর আহতরা হলেন- একই এলাকার বাসিন্দা দুই সহোদর আবদুল আমিন (২৫) ও আবদুল্লাহ (১৭)।

এদিকে, গত ১ মে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের জাহাজপুরা পাহাড় থেকে অপহৃত ২ জনকে উদ্ধার করেছিল বলে জানান টেকনাফ থানার ওসি আবদুল হালিম।

পুলিশ বলছে, অপহরণকারীদের ধরতে কাজ করছে তারা। এর আগে গেল ১৬ মার্চ সকালে জাহাজপুরা এলাকা থেকে কলেজ শিক্ষার্থী গিয়াস উদ্দিন (১৭), রশিদ আলম (২৬), জানে আলম, (৪৫), জাফর আলম (৪০), জাফরুল ইসলাম (৩০), ফজল করিম (৩০) ও আরিফ উল্লাহ (৩০) অপহরণের শিকার হন। ১৯ মার্চ জাদিমুড়ার জুম্মা পাহাড়ি এলাকা থেকে অপহরণের শিকার হন মোহাম্মদ ছৈয়দ। ২৪ মার্চ রহমত উল্লাহ নামে আরেকজন অপহরণের শিকার হন। ২ মার্চ অপহরণের শিকার হন ৪ মার্চ ৭০ হাজার টাকায় মুক্তিপণে ফিরে আসেন টেকনাফ বাহারছড়ার মারিশবনিয়া এলাকা থেকে প্রবাসী হোসন আলীর ছেলে মো. সালমান (৫) এবং মো. আলীর ছেলে উবাইদুল্লাহ (১৩)।

গত ২৪ এপ্রিল দুপুরে হ্নীলা দমদমিয়া ন্যাচার পার্কে ঘুরতে গিয়ে শিবিরের সি-ব্লকের বাসিন্দা হাবিবুর রহমানের ছেলে মো. বেলাল (১৩), মোহাম্মদ ইলিয়াসের ছেলে নূর কামাল (১২), মো. উবায়দুল্লাহর ছেলে নূর আরাফাত (১২), বি ব্লকের মো. রফিকের ছেলে ওসমান (১৪) এবং ডি ব্লকের মাহাত আমিনের ছেলে নুর কামাল (১৫) অপহরণের শিকার হন। তারা ২৮ এপ্রিল মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসেন।

গত ২৮ জানুয়ারি বাহারছড়া ইউনিয়নের চৌকিদারপাড়া এলাকা থেকে অপহরণ হন নুরুল আমিনের ছেলে রহমত উল্লাহ (২৫) ও আলী আকবর এর ছেলে আবদুল হাফিজ।

গত ৯ জানুয়ারি উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের লেচুয়াপ্রাং এলাকা থেকে অপহরণের শিকার আবুল হোসেনের ছেলে আবদুস সালাম, গুরা মিয়ার ছেলে আবদুর রহমান, রাজা মিয়ার ছেলে মুহিব উল্লাহ ও রাজা মিয়ার ছেলে আবদুল হাকিম। স্থানীয়দের দেয়া তথ্যমতে, এসব অপহরণের সঙ্গে স্থানীয় অপরাধীরা জড়িত।

বিভিন্ন সূত্রমতে জানা গেছে, টেকনাফ বাহারছড়ার জাহাজপুরা, হ্নীলা ইউনিয়নের রঙ্গীখালী এবং হোয়াইক্যং ইউনিয়নে বারবার অপহরণের ঘটনা ঘটছে। কখনো স্থানীয় আবার কখনো রোহিঙ্গারা অপহরণের শিকার হচ্ছে। অনেকে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে এলেও অনেকে আর ফিরে আসেননি। এসব এলাকার কিছু চিহ্নিত অপরাধী ও জনপ্রতিনিধি এ অপরাধের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রয়েছে।

বাহারছড়া ইউনিয়নের ইউপি সদস্য হুমায়ুন ও রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা শুনতে পেয়েছি, আমাদের মহিলা ইউপি সদস্য এবং ৬ নং ওয়ার্ড চৌকিদার ইসহাক অপহরণ চক্রের সঙ্গে জড়িত। আমরা বারংবার অভিযোগ করার পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এ অবস্থায় চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছি।

তারা আরও বলেন, এর আগে চৌকিদার ইসহাক অপহরণের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগ করেছেন। কিন্তু ইউপি সদস্য মুবিনা আক্তারকে আটক করা হয়নি। তাদের আটক করা গেলে অপহরণের সঠিক তথ্য বেরিয়ে আসবে বলেও তারা মনে করছেন। তবে ফোন রিসিভ না করায় মুবিনা আক্তারের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

অন্যদিকে হ্নীলা ইউনিয়নের রঙ্গীখালী এলাকার শাহ আলম গ্রুপের মো. ইউনুস এর ছেলে ইয়াসিন আরাফাত, দিল মোহাম্মদের ছেলে সাদেক এবং বাইদুল প্রকাশ উদুল্লাহ অপহরণের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু তাদের অবস্থান পাহাড়ি এলাকায় হওয়ায় তাদের সহজে গ্রেপ্তার করতে পারছে না পুলিশ। সম্প্রতি গ্রুপ প্রধান শাহ আলম পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন। রয়েছে গিয়াস উদ্দিন গ্রুপ নামে আরও একটি গ্রুপ। সম্প্রতি অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন গিয়াস উদ্দিন। স্থানীয় এ চক্রের সঙ্গে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের যোগাযোগ রয়েছে বলে দাবি স্থানীয়দের। গত ৬ মাসে এসব ইউনিয়ন থেকে কৃষক ও ছাত্রসহ ৬২ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩৪ জন স্থানীয় বাসিন্দা, বাকি ২৮ জন রোহিঙ্গা।

এ বিষয়ে বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক মশিউর রহমান বলেন, জাহাপুরা পাহাড়ি এলাকায় কিছু বসতি আছে। তারা পানের বরজ, সুপারি, সবজি বাগান করে। বাগান পরিচর্যার জন্য গেলে অপহরণের শিকার হন।

তিনি আরও বলেন, এ অপহরণ কাণ্ডে স্থানীয় কিছু চক্র জড়িত আছে বলে আমরা শুনেছি। তাদের চিহ্নিত করার পাশাপাশি অভিযোগের তদন্ত করা হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ভুক্তভোগী কেউ সহজে পুলিশকে তথ্য দিতে চায় না।

হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মো. আলী বলেন, গত কয়েক মাসে আমার এলাকা থেকে অন্তত ২০ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। রঙ্গীখালী এলাকায় কিছু অপরাধী রয়েছে। তাদের সঙ্গে রোহিঙ্গাও জড়িত। এসব অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা গেলে অপহরণসহ সব ধরনের অপরাধ কমে আসবে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও কঠোর হতে হবে।

টেকনাফ থানার ওসি আবদুল হালিম বলেন, যেহেতু এলাকাগুলো দুর্গম, তাই কৃষকদের আমরা বলেছিলাম, তারা যেন পাহাড়ি এলাকায় সংঘবদ্ধ থাকে। কিন্তু তারা বিষয়টি আমলে না নিয়ে যে যার মতো কাজে যায়। আর সুযোগ বুঝে তাদের অপহরণ করে অপরাধীরা। এতে আমদেরও বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। তারপরও আমাদের সীমাবদ্ধতার মাঝে অপহরণকারীদের চিহ্নিত করে কীভাবে অপরাধ নির্মূল করা যায় তা নিয়ে আমরা কাজ করছি।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম বলেন, অপরাধীদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আমরা সব তথ্য-উপাত্ত নিয়ে খুব শীঘ্রই পাহাড়ে অভিযান পরিচালনা করবো। তবে দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় কাজ করা আমাদের জন্য দুরূহ হয়ে পড়ছে।