জাতীয় কবির জন্মদিন আজ

আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ সাম্যের কবি, বিরহ-বেদনার কবি, বিদ্রোহের কবি, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৪তম জন্মদিন। একাধারে প্রেমিক ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম উপন্যাস, নাটক, সংগীত আর দর্শনেও ছিলেন অনবদ্য। তার উপস্থিতি বর্ণাঢ্য করেছে বাংলা সাহিত্যকে। কণ্ঠশিল্পী, অভিনেতা, সম্পাদক পরিচয়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অভিমানী এ মানুষ হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছিলেন নিপীড়িত-অসহায়ের আর্তি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার কবিতা কোটি তরুণের রক্তে জ্বালায় স্ফুলিঙ্গ। এমনই একজন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ইংরেজি বছরের ২৫ মে নানা আয়োজনে পালিত হয় প্রিয় কবি নজরুলের জন্মদিন।

ক্ষণজন্মা এ প্রতিভার জন্ম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (ইংরেজি সাল অনুযায়ী ২৫ মে ১৮৯৯ সাল) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে। তার বাবার নাম কাজী ফকির আহমেদ, মা জাহেদা খাতুন। দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় দুঃখ-দারিদ্র্য ছিল তার নিত্যসঙ্গী। তার ডাকনাম ছিল দুখু মিয়া।

বাবার অকাল মৃত্যুতে পরিবারের ভরণপোষণের জন্য তিনি শিশু বয়সেই মক্তবে শিক্ষকতা, হাজি পালোয়ানের মাজারে খাদেম এবং মসজিদের মুয়াজ্জিনের কাজ করেছেন, যা পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যে ইসলামী ঐতিহ্যের সার্থক ব্যবহারে এ সম্পৃক্ততা খুব ফলপ্রসূ হয়েছে।

শৈশব-কৈশোর-তারুণ্যে জীবনের পরতে পরতে সংগ্রাম করেছেন কবি। জড়িয়েছিলেন নানা পেশায়। ১৯১৭ সালে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। অংশ নেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও।

তৎকালীন প্রভাবশালী কবি-সাহিত্যিকদের সংস্পর্শে আসেন তিনি। ১৯২২ সালে প্রকাশ করেন ধূমকেতু পত্রিকা। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার জন্য নজরুলকে দেয়া হয় এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।

নজরুল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তার লেখনী ধূমকেতুর মতো আঘাত হেনে জাগিয়ে দিয়েছিল ভারতবাসীকে। নজরুল তার কবিতা, গান, উপন্যাসসহ অন্যান্য লেখনী ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পরাধীন ভারতে বিশেষ করে অবিভক্ত বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্য ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বলিষ্ঠ ও সোচ্চার কণ্ঠ ছিলেন। সে কারণে ইংরেজ সরকার তার গ্রন্থ ও রচনা বাজেয়াপ্ত করে এবং কারাদণ্ড দেয়। কারাগারেও বিদ্রোহী নজরুল টানা ৪০ দিন অনশন করে বিদেশি সরকারের জেল-জুলুমের প্রতিবাদ করেছিলেন।

মাত্র ২২ বছর ব্যপ্তির লেখক জীবনে তিনি রচনা করেছেন প্রায় ৩ হাজার গান, অসংখ্য কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘বিদ্রোহী কবি’ এবং আধুনিক বাংলা গানের ‘বুলবুল’ নামে খ্যাত কাজী নজরুল ইসলাম বিশ শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকে উপমহাদেশের অবিভক্ত বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

তার কবিতা ‘চ্ল চল্ চল’ বাংলাদেশের রণসংগীত। দ্রোহ, প্রেম, মানবতা কবির রচনাকে করেছে চিরন্তন, নিয়ে গেছে গণমানুষের কাছাকাছি। কবিতায় বলেছেন, ‘গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান...’। কবির এমন অজস্র রচনা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর বাঙালিদের দিয়েছে শক্তি ও প্রেরণা। এখনও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে, সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগ্রামে তার রচনা আমাদের গভীরভাবে উদ্দীপ্ত করে।

সাহিত্যের পাশাপাশি সংগীত ও চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন নজরুল। নিজের পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘ধ্রুব’তে অভিনয়ও করেন তিনি। তাই শুধু কবি পরিচয়েই আবদ্ধ নন নজরুল।

নজরুল চির প্রেমের কবি। তিনি যৌবনের দূত। তিনি প্রেম নিয়েছিলেন, প্রেম চেয়েছিলেন। মূলত তিনি বিদ্রোহী, কিন্তু তার প্রেমিক রূপটিও প্রবাদপ্রতিম। তাই মানুষটি অনায়াসেই বলতে পারেন ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আপনায়।’ পৃথিবীতে এমন কম মানুষই আছেন যিনি প্রেমের টানে রক্তের সম্পর্কে অস্বীকার করে পথে বেরিয়ে পরতে পারেন।

বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা।

তিনি বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগ-রাগিনী সৃষ্টি করে বাংলা সংগীত জগতকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। তার কবিতা, গান ও সাহিত্য কর্ম বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ লেখক। তার লেখনী জাতীয় জীবনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তার কবিতা ও গান মানুষকে যুগে যুগে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয় এবং জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা দেয়। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাংলাদেশে তার বসবাসের ব্যবস্থা করেন। ধানমন্ডিতে কবির জন্য একটি বাড়ি বরাদ্দ দেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশেই ছিলেন। তার জীবনকাল ৭৭ বছর হলেও ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর দীর্ঘ ৩৪ বছর ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি অসহনীয় নির্বাক জীবন কাটান।

১৯৭৬ সালের শোকের মাসেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (সাবেক পিজি হাসপাতাল) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন নজরুল। কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। এখানেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৪তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি একক বক্তৃতা, নজরুল পুরস্কার প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

এছাড়া গতকাল বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে কর্মসূচির অংশ হিসেবে প্রথম দিনের আয়োজনে নজরুলসংগীত-চর্চা ও প্রসারে সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রখ্যাত শিল্পী শাহীন সামাদ-কে বাংলা একাডেমি প্রবর্তিত নজরুল পুরস্কার-২০২৩-এ ভূষিত করা হয়। শিল্পীর হাতে নজরুল পুরস্কারের সম্মাননাপত্র, ক্রেস্ট এবং পুরস্কারের অর্থমূল্য দুই লাখ টাকার চেক তুলে দেন বাংলা একাডেমির সভাপতি এবং মহাপরিচালক।

বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা।

‘অগ্নিবীণার শতবর্ষ : বঙ্গবন্ধুর চেতনায় শাণিতরূপ’ এই প্রতিপাদ্যে নজরুলবিষয়ক একক বক্তৃতা প্রদান করেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

পরে, সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করেন বাচিকশিল্পী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, ড. শাহাদাৎ হোসেন নিপু এবং রুবিনা আজাদ। নজরুলগীতি পরিবেশন করেন শিল্পী ইয়াসমিন মুশতারী এবং রাহাত আরা গীতি।

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, নজরুল এবং বঙ্গবন্ধু বাংলা, বাঙালি এবং বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য সত্তার নাম। তাদের সারাজীবনের সংগ্রামের মূল প্রতিপাদ্য এবং গন্তব্য ছিল বাংলার খেটে খাওয়া, দুখী মানুষের সার্বিক মুক্তি এবং সমৃদ্ধি।

দিবসটি উদ্যাপন উপলক্ষে কর্মসূচিতে রয়েছে, সকাল ৮টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন জাতীয় কবির সমাধিতে বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। এছাড়া বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে স্থাপিত নজরুল প্রতিকৃতিতেও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হবে।

এর আগে অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কনিষ্ঠ পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীর প্রয়াণে এবং বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী স্মরণেÑ তাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

image
আরও খবর
আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু হবে : প্রধানমন্ত্রী
নিশ্চয়ই এটাতে বিএনপির ‘মৌন সম্মতি’ আছে : কাদের
শেখ তাপসের বক্তব্য প্রধান বিচারপতির নজরে আনলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল
দুই মন্ত্রণালয়ের দুই প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ছে
সিলেট : মেয়র পদে ১১ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন
রাজশাহী : বহিষ্কারের হুমকিতেও আটকাতে পারল না বিএনপির ২০ নেতাকর্মীকে
খুলনা : খালেক ও মধুর ভোট নিজের টাকায়, ধার-দানে আউয়াল ও সাব্বিরের
বরিশাল : ৩২ কাউন্সিলর প্রার্থী অর্ধশতাধিক মামলায় অভিযুক্ত
আ’লীগ ‘বিএনপি নিশ্চিহ্নে’ ঝাঁপিয়ে পড়েছে : রিজভী
উপকূল, হাওর, চরাঞ্চলসহ প্রতিকূল এলাকাগুলোতে এখনও জাতীয় গড়ের চেয়ে দারিদ্র্য বেশি
প্রথম বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট থেকে ইন্টারনেট সংযোগ

বৃহস্পতিবার, ২৫ মে ২০২৩ , ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০, ০৫ জিলক্বদ শাওয়াল ১৪৪৪

জাতীয় কবির জন্মদিন আজ

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ সাম্যের কবি, বিরহ-বেদনার কবি, বিদ্রোহের কবি, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৪তম জন্মদিন। একাধারে প্রেমিক ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম উপন্যাস, নাটক, সংগীত আর দর্শনেও ছিলেন অনবদ্য। তার উপস্থিতি বর্ণাঢ্য করেছে বাংলা সাহিত্যকে। কণ্ঠশিল্পী, অভিনেতা, সম্পাদক পরিচয়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অভিমানী এ মানুষ হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছিলেন নিপীড়িত-অসহায়ের আর্তি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার কবিতা কোটি তরুণের রক্তে জ্বালায় স্ফুলিঙ্গ। এমনই একজন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ইংরেজি বছরের ২৫ মে নানা আয়োজনে পালিত হয় প্রিয় কবি নজরুলের জন্মদিন।

ক্ষণজন্মা এ প্রতিভার জন্ম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (ইংরেজি সাল অনুযায়ী ২৫ মে ১৮৯৯ সাল) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে। তার বাবার নাম কাজী ফকির আহমেদ, মা জাহেদা খাতুন। দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় দুঃখ-দারিদ্র্য ছিল তার নিত্যসঙ্গী। তার ডাকনাম ছিল দুখু মিয়া।

বাবার অকাল মৃত্যুতে পরিবারের ভরণপোষণের জন্য তিনি শিশু বয়সেই মক্তবে শিক্ষকতা, হাজি পালোয়ানের মাজারে খাদেম এবং মসজিদের মুয়াজ্জিনের কাজ করেছেন, যা পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যে ইসলামী ঐতিহ্যের সার্থক ব্যবহারে এ সম্পৃক্ততা খুব ফলপ্রসূ হয়েছে।

শৈশব-কৈশোর-তারুণ্যে জীবনের পরতে পরতে সংগ্রাম করেছেন কবি। জড়িয়েছিলেন নানা পেশায়। ১৯১৭ সালে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। অংশ নেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও।

তৎকালীন প্রভাবশালী কবি-সাহিত্যিকদের সংস্পর্শে আসেন তিনি। ১৯২২ সালে প্রকাশ করেন ধূমকেতু পত্রিকা। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার জন্য নজরুলকে দেয়া হয় এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।

নজরুল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তার লেখনী ধূমকেতুর মতো আঘাত হেনে জাগিয়ে দিয়েছিল ভারতবাসীকে। নজরুল তার কবিতা, গান, উপন্যাসসহ অন্যান্য লেখনী ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পরাধীন ভারতে বিশেষ করে অবিভক্ত বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্য ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বলিষ্ঠ ও সোচ্চার কণ্ঠ ছিলেন। সে কারণে ইংরেজ সরকার তার গ্রন্থ ও রচনা বাজেয়াপ্ত করে এবং কারাদণ্ড দেয়। কারাগারেও বিদ্রোহী নজরুল টানা ৪০ দিন অনশন করে বিদেশি সরকারের জেল-জুলুমের প্রতিবাদ করেছিলেন।

মাত্র ২২ বছর ব্যপ্তির লেখক জীবনে তিনি রচনা করেছেন প্রায় ৩ হাজার গান, অসংখ্য কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘বিদ্রোহী কবি’ এবং আধুনিক বাংলা গানের ‘বুলবুল’ নামে খ্যাত কাজী নজরুল ইসলাম বিশ শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকে উপমহাদেশের অবিভক্ত বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

তার কবিতা ‘চ্ল চল্ চল’ বাংলাদেশের রণসংগীত। দ্রোহ, প্রেম, মানবতা কবির রচনাকে করেছে চিরন্তন, নিয়ে গেছে গণমানুষের কাছাকাছি। কবিতায় বলেছেন, ‘গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান...’। কবির এমন অজস্র রচনা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর বাঙালিদের দিয়েছে শক্তি ও প্রেরণা। এখনও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে, সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগ্রামে তার রচনা আমাদের গভীরভাবে উদ্দীপ্ত করে।

সাহিত্যের পাশাপাশি সংগীত ও চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন নজরুল। নিজের পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘ধ্রুব’তে অভিনয়ও করেন তিনি। তাই শুধু কবি পরিচয়েই আবদ্ধ নন নজরুল।

নজরুল চির প্রেমের কবি। তিনি যৌবনের দূত। তিনি প্রেম নিয়েছিলেন, প্রেম চেয়েছিলেন। মূলত তিনি বিদ্রোহী, কিন্তু তার প্রেমিক রূপটিও প্রবাদপ্রতিম। তাই মানুষটি অনায়াসেই বলতে পারেন ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আপনায়।’ পৃথিবীতে এমন কম মানুষই আছেন যিনি প্রেমের টানে রক্তের সম্পর্কে অস্বীকার করে পথে বেরিয়ে পরতে পারেন।

বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা।

তিনি বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগ-রাগিনী সৃষ্টি করে বাংলা সংগীত জগতকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। তার কবিতা, গান ও সাহিত্য কর্ম বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ লেখক। তার লেখনী জাতীয় জীবনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তার কবিতা ও গান মানুষকে যুগে যুগে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয় এবং জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা দেয়। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাংলাদেশে তার বসবাসের ব্যবস্থা করেন। ধানমন্ডিতে কবির জন্য একটি বাড়ি বরাদ্দ দেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশেই ছিলেন। তার জীবনকাল ৭৭ বছর হলেও ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর দীর্ঘ ৩৪ বছর ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি অসহনীয় নির্বাক জীবন কাটান।

১৯৭৬ সালের শোকের মাসেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (সাবেক পিজি হাসপাতাল) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন নজরুল। কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। এখানেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৪তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি একক বক্তৃতা, নজরুল পুরস্কার প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

এছাড়া গতকাল বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে কর্মসূচির অংশ হিসেবে প্রথম দিনের আয়োজনে নজরুলসংগীত-চর্চা ও প্রসারে সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রখ্যাত শিল্পী শাহীন সামাদ-কে বাংলা একাডেমি প্রবর্তিত নজরুল পুরস্কার-২০২৩-এ ভূষিত করা হয়। শিল্পীর হাতে নজরুল পুরস্কারের সম্মাননাপত্র, ক্রেস্ট এবং পুরস্কারের অর্থমূল্য দুই লাখ টাকার চেক তুলে দেন বাংলা একাডেমির সভাপতি এবং মহাপরিচালক।

বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা।

‘অগ্নিবীণার শতবর্ষ : বঙ্গবন্ধুর চেতনায় শাণিতরূপ’ এই প্রতিপাদ্যে নজরুলবিষয়ক একক বক্তৃতা প্রদান করেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এ এফ এম হায়াতুল্লাহ।

পরে, সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করেন বাচিকশিল্পী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, ড. শাহাদাৎ হোসেন নিপু এবং রুবিনা আজাদ। নজরুলগীতি পরিবেশন করেন শিল্পী ইয়াসমিন মুশতারী এবং রাহাত আরা গীতি।

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, নজরুল এবং বঙ্গবন্ধু বাংলা, বাঙালি এবং বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য সত্তার নাম। তাদের সারাজীবনের সংগ্রামের মূল প্রতিপাদ্য এবং গন্তব্য ছিল বাংলার খেটে খাওয়া, দুখী মানুষের সার্বিক মুক্তি এবং সমৃদ্ধি।

দিবসটি উদ্যাপন উপলক্ষে কর্মসূচিতে রয়েছে, সকাল ৮টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন জাতীয় কবির সমাধিতে বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। এছাড়া বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে স্থাপিত নজরুল প্রতিকৃতিতেও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হবে।

এর আগে অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কনিষ্ঠ পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীর প্রয়াণে এবং বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী স্মরণেÑ তাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।