বাজার পরিস্থিতি ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে বাজেট ও জীবনযাত্রার সম্পর্ক অতিনিবিড় এবং বাস্তব। একটি পরিবার কিভাবে তাদের দৈনন্দিন জীবনকে নির্বাহ করবে তা নির্ভর করে তাদের আয়, চাহিদা এবং দ্রব্যমূল্যের ওপর। প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের মূল্য যখন সহনীয় পর্যায়ে এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে তখন তাদের জীবন কাটে স্বস্তিতে। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যখন সাধারণ মানুষের আর্থিক সঙ্গতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে যায় তখন দরিদ্র এবং অতিদরিদ্র পরিবারে চলে অর্ধাহার, অনাহার এবং পারিবারিক অশান্তি। তাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে একদিকে জনজীবনে নেমে আসে কষ্টের কালোছায়া। অন্যদিকে মুনাফাখোরি, কালোবাজারিদের কারণে দেশে বিরাজ করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি।

নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব যদি যথাযথ কর্তৃপক্ষ ঠিকমতো বাজার ব্যবস্থাপনার দিকে নজরদারি জারি রাখে। মধ্যস্বত্বভোগীদের মুনাফাখোরি মানসিকতা বদলাতে হবে। তাদের মুনাফাবাজির তৎপরতায় উৎসাহ দেয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। দাম চড়িয়ে দিলে ভোক্তাদেরও সচেতন হয়ে ভোগের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে। উৎপাদন, আমদানি ও বাজারে সরবরাহে সমন্বয় ঘটাতে হবে।

নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর বিষয়টি আজ নতুন নয়। এতে জনজীবন যে বিপর্যস্ত হয়, কেউ বুঝতে চায় না। অসৎ ব্যবসায়ী, কালোবাজারি ও মুনাফালোভীদের কারণে এসব ঘটে। এজন্য সরকারের সদিচ্ছা ও মনিটরিং ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে সারা বছর। পণ্য বাজারে সরকারের নজরদারি ও সামাজিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে। নিয়মিত মনিটর করতে হবে এবং ভ্রাম্যমাণ আদালত বসাতে হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখন রাজনীতির অপপ্রয়োগ ও বাড়াবাড়ি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আর রাজনীতিকরা নিজেদের সুবিধার জন্য রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন। সাধারণ মানুষের কথা তারা ভাবেন বলে মনে হয় না। তারা প্রয়োজনে পুলিশকেও ধমকান। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়েও এ দেশে রাজনীতি হয়। পণ্য ক্রয়ে কেন শুধু ভারতকে বেছে নিতে হবে? আরো তো দেশ আছে, তাদের কাছ থেকেও কেনা যায়। তা তো করা হয় না। এজন্য সরকারের মনিটরিং সেল ও ভ্রাম্যমাণ প্রশাসনিক বাহিনী দরকার বলে মনে করি।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ বহুবিধ, অপরিকল্পনাও দায়ী। কোন সময় কোন দ্রব্য বা পণ্য বেশি পরিমাণে প্রয়োজন হয় এবং কোন সময় আমাদের উৎপাদন কম থাকে বা ব্যবহার বেড়ে যায়, তা কিন্তু জানা আছে সবার। বাজারে অস্থিরতা তৈরির জন্য আবার কিছু মানুষ অপেক্ষায় থাকে। এর আগে দেখা গেছে, যখন ভারত বলল, তারা পেঁয়াজ রপ্তানি করতে পারবে না তখনই একেবারে ১০০ টাকার ওপরে উঠে গেল পেঁয়াজের দাম। মিয়ানমার থেকেও পেঁয়াজ সময়মতো এলো না। সংকট তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু মানুষ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পণ্য আটকে দেয় এবং দ্বিগুণেরও বেশি দামে বিক্রি করে।

সরকারি মজুদের পরিমাণ এবং বেসরকারি মজুদের পরিমাণ দুটিই সরকারের জানা থাকতে হবে। আমদানি নির্ভরতাও কমিয়ে আনা দরকার। চাহিদা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে নিত্যপণ্যের দাম নাগালে রাখা সম্ভব হবে। শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষের ওপর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এ ক্রমবর্ধমান চাপ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোধ করা প্রয়োজন। এজন্য দেশের কালোবাজারি, কৃত্রিম সংকটের জন্য মজুদদারি ও চোরাচালানী রোধ করতে হবে সবার আগে। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হতে হবে আরো কঠোর ও দায়িত্বশীল। গ্রামীণ পর্যায়ে কৃষকদের ঋণদানসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে; যাতে তারা সহজে পণ্য বাজারজাত করতে পারে এবং ন্যায্যমূল্যে উৎপাদিত পণ্য বিক্রয় করতে পারে। সরকারকে প্রতিটি পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিতে হবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এতে দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার আয়ত্বে থাকবে।

সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার চেষ্টা চালালেও কিছু মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের জন্য তা বারবার হোঁচট খাচ্ছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের লোকজনের গাফিলতির কথা শোনা যায়। আবার নিয়মিত মনিটরিংয়ের অভাবের কথাও জানা যায়। ফলে দায়ী ব্যবসায়ীরা যেমন পার পেয়ে যান, তেমনি আবার একই ধরনের অপকর্মে যুক্ত হয়ে পড়েন। বিভিন্ন ধর্মীয় বা সামাজিক উৎসবের সময় একশ্রেণীর ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার জন্য মরিয়া হয়ে যান। তাদের কাছে ধর্মীয় নির্দেশনা বা জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার বিষয়টি গৌণ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যেন অসহায়।

কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিভাগ একটু দূরদর্শী ও সতর্ক হলে অসাধু ব্যবসায়ীদের এ সবাই অপকর্ম থেকে জনগণ রক্ষা পেতে পারে। আর বিক্রেতারা যদি ক্রেতার দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতেন তাহলে হয়ত লাগামহীনভাবে মূল্যবৃদ্ধি করতেন না। দাম বৃদ্ধির এই হার স্থানভেদে পার্থক্য থাকলেও নির্দিষ্ট কিছু দ্রব্যের মূল্য সবক্ষেত্রে একই হারে বেড়ে থাকে। ক্রেতা সাধারণের তখন অধিক মূল্যে পণ্য কেনা ছাড়া কোন পথ থাকে না। অবশ্য টিসিবি কয়েকটি পণ্য স্বল্পমূল্যে ভোক্তা সাধারণের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ঊর্ধ্বগতি রোধ করার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া দরকার। প্রথমত, সরকারের সদিচ্ছা ও বাস্তব পরিকল্পনা। দ্বিতীয়ত, পণ্যসামগ্রীর চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার ব্যবস্থা করা। এ জন্য দেশে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে হবে। দেশের উৎপাদন ব্যবস্থার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পণ্যবাজারের ওপর সরকারের সজাগ দৃষ্টি রাখা দরকার, যেন অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি করে খুশিমতো জিনিসপত্রের দাম বাড়াতে না পারেন। রাজনৈতিক সহনশীলতা ও সমঝোতা সৃষ্টি করে এ সমস্যা লাঘব করা দরকার। চোরাচালান ও চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। বাজার নিয়মিত পরিদর্শন করতে হবে। দুর্নীতির লাগামহীন ঘোড়াকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।

সরকারকে কঠোর হাতে অতিলোভী অসাধু এসব ব্যবসায়ীকে দমন করতে হবে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যতালিকা টাঙানো এবং নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রয় করা হচ্ছে কিনা, সেটি পর্যবেক্ষণের জন্য সব বাজারে দ্রব্যমূল্য মনিটরিং কমিটি গঠনের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার ও ব্যবসায়ীদের সদিচ্ছাই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করে দেশের সাধারণ মানুষের আরও একটু সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা প্রদানে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে সক্ষম।

মুনাফালোভী, কালোবাজারি ব্যবসায়ী শ্রেণী, ঘুষখোর কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করতে হবে। পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে আনতে হবে। তাহলেই দ্রব্যের মূল্য হ্রাস পাবে। জনমনে হতাশা, ক্ষোভ দূর হয়ে শান্তি ফিরিয়ে আসবে। বাজারে পণ্যের মূল্য নির্ধারণে ভারসাম্য বজায় রাখার মাধ্যমে জনমানসের চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করতে হবে। আর সরকার এ ব্যাপারে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। নিশ্চিত করা হবে সাধারণ ও নিম্নআয়ের মানুষের ভালোভাবে বেঁচে থাকার নিরাপত্তা।

নিত্যপণ্যের উর্ধ্বগতি ও নতুন বছরের বাজেট ঘোষণা কতটা গণমুখী হবে, আর গণমুখী হলেও তাতে সাধারণ ও খেটে খাওয়া মানুষের বেঁচে থাকার মতো কোন নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবেলার ব্যবস্থা থাকছে কিনা? এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে দুটি মতের ধারা প্রাধান্য পেয়ে থাকে- এক গ্রুপের অভিমত হচ্ছে এ বাজেটে মানুষের অসহায়ত্ব ও হাহাকার বাড়াবে; অন্যদিকে সুবিধাভোগী শ্রেণীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ইস্যুর সৃষ্টি হবে।

পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিভিন্ন মহলে পারস্পরিক অবিশ্বাস, স্বার্থপরতা, লোভ-লালসা, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, বাজার অর্থনীতি মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে বাজেট এবং বাজার নিত্যপণ্যের মূল্য কতটা নিয়ন্ত্রণে থাকবে সেগুলো সাধারণ মানুষকে খুব ভাবাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি বিশ্ববাজারকে অনেকটাই অস্থিতিশীল করে তুলেছে। কাজেই বাংলাদেশের প্রস্তাবিত বাজেটে আমাদের নিত্যপণ্যের যে ঊর্ধ্বগতি তার লাগাম টেনে ধরবে কি?

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাজার ও বাজেট বাস্তবায়নের মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান জরুরি। অন্যথায় আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থা যে ইঙ্গিত দিচ্ছে তাতে মনে হয় আগামী বাজেট বাস্তবায়ন খুবই চ্যালেঞ্জমুখী হবে। দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান ও ক্ষুদ্র ব্যবসার উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা ছাড়া মানুষের জীবন মানের কোন পরিবর্তন আসবে না; বরং বেঁচে থাকাই একটি চ্যালেঞ্জের বিষয় হবে। তবে বাজেট যেভাবেই প্রণীত হোক না কেন তাকে গণমুখী করা তথা সমাজের সব শ্রেণী ও মানুষের স্বার্থে আঘাতহানিকর প্রকল্পসমূহের ব্যয় নির্বাহে আমাদের খুবই সজাগ থাকতে হবে। প্রয়োজনে এ জাতীয় প্রকল্পকে বাদ দিয়ে হলেও সাধারণ স্বার্থের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে বাজেট ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাকে খুবই নজরে আনতে হবে। বিশ্ব মুদ্রাস্ফীতি, মূল্যস্ফীতি, বাজার নিয়ন্ত্রণসহ সব স্টেকহোল্ডারদের নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে কার্যকর ব্যবস্থায় অবতীর্ণ হতে হবে।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক,

বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

বৃহস্পতিবার, ২৫ মে ২০২৩ , ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০, ০৫ জিলক্বদ শাওয়াল ১৪৪৪

বাজার পরিস্থিতি ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে বাজেট ও জীবনযাত্রার সম্পর্ক অতিনিবিড় এবং বাস্তব। একটি পরিবার কিভাবে তাদের দৈনন্দিন জীবনকে নির্বাহ করবে তা নির্ভর করে তাদের আয়, চাহিদা এবং দ্রব্যমূল্যের ওপর। প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের মূল্য যখন সহনীয় পর্যায়ে এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে তখন তাদের জীবন কাটে স্বস্তিতে। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যখন সাধারণ মানুষের আর্থিক সঙ্গতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে যায় তখন দরিদ্র এবং অতিদরিদ্র পরিবারে চলে অর্ধাহার, অনাহার এবং পারিবারিক অশান্তি। তাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে একদিকে জনজীবনে নেমে আসে কষ্টের কালোছায়া। অন্যদিকে মুনাফাখোরি, কালোবাজারিদের কারণে দেশে বিরাজ করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি।

নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব যদি যথাযথ কর্তৃপক্ষ ঠিকমতো বাজার ব্যবস্থাপনার দিকে নজরদারি জারি রাখে। মধ্যস্বত্বভোগীদের মুনাফাখোরি মানসিকতা বদলাতে হবে। তাদের মুনাফাবাজির তৎপরতায় উৎসাহ দেয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। দাম চড়িয়ে দিলে ভোক্তাদেরও সচেতন হয়ে ভোগের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে। উৎপাদন, আমদানি ও বাজারে সরবরাহে সমন্বয় ঘটাতে হবে।

নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর বিষয়টি আজ নতুন নয়। এতে জনজীবন যে বিপর্যস্ত হয়, কেউ বুঝতে চায় না। অসৎ ব্যবসায়ী, কালোবাজারি ও মুনাফালোভীদের কারণে এসব ঘটে। এজন্য সরকারের সদিচ্ছা ও মনিটরিং ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে সারা বছর। পণ্য বাজারে সরকারের নজরদারি ও সামাজিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে। নিয়মিত মনিটর করতে হবে এবং ভ্রাম্যমাণ আদালত বসাতে হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখন রাজনীতির অপপ্রয়োগ ও বাড়াবাড়ি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আর রাজনীতিকরা নিজেদের সুবিধার জন্য রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন। সাধারণ মানুষের কথা তারা ভাবেন বলে মনে হয় না। তারা প্রয়োজনে পুলিশকেও ধমকান। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়েও এ দেশে রাজনীতি হয়। পণ্য ক্রয়ে কেন শুধু ভারতকে বেছে নিতে হবে? আরো তো দেশ আছে, তাদের কাছ থেকেও কেনা যায়। তা তো করা হয় না। এজন্য সরকারের মনিটরিং সেল ও ভ্রাম্যমাণ প্রশাসনিক বাহিনী দরকার বলে মনে করি।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ বহুবিধ, অপরিকল্পনাও দায়ী। কোন সময় কোন দ্রব্য বা পণ্য বেশি পরিমাণে প্রয়োজন হয় এবং কোন সময় আমাদের উৎপাদন কম থাকে বা ব্যবহার বেড়ে যায়, তা কিন্তু জানা আছে সবার। বাজারে অস্থিরতা তৈরির জন্য আবার কিছু মানুষ অপেক্ষায় থাকে। এর আগে দেখা গেছে, যখন ভারত বলল, তারা পেঁয়াজ রপ্তানি করতে পারবে না তখনই একেবারে ১০০ টাকার ওপরে উঠে গেল পেঁয়াজের দাম। মিয়ানমার থেকেও পেঁয়াজ সময়মতো এলো না। সংকট তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু মানুষ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পণ্য আটকে দেয় এবং দ্বিগুণেরও বেশি দামে বিক্রি করে।

সরকারি মজুদের পরিমাণ এবং বেসরকারি মজুদের পরিমাণ দুটিই সরকারের জানা থাকতে হবে। আমদানি নির্ভরতাও কমিয়ে আনা দরকার। চাহিদা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে নিত্যপণ্যের দাম নাগালে রাখা সম্ভব হবে। শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষের ওপর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এ ক্রমবর্ধমান চাপ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোধ করা প্রয়োজন। এজন্য দেশের কালোবাজারি, কৃত্রিম সংকটের জন্য মজুদদারি ও চোরাচালানী রোধ করতে হবে সবার আগে। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হতে হবে আরো কঠোর ও দায়িত্বশীল। গ্রামীণ পর্যায়ে কৃষকদের ঋণদানসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে; যাতে তারা সহজে পণ্য বাজারজাত করতে পারে এবং ন্যায্যমূল্যে উৎপাদিত পণ্য বিক্রয় করতে পারে। সরকারকে প্রতিটি পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিতে হবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এতে দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার আয়ত্বে থাকবে।

সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার চেষ্টা চালালেও কিছু মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের জন্য তা বারবার হোঁচট খাচ্ছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের লোকজনের গাফিলতির কথা শোনা যায়। আবার নিয়মিত মনিটরিংয়ের অভাবের কথাও জানা যায়। ফলে দায়ী ব্যবসায়ীরা যেমন পার পেয়ে যান, তেমনি আবার একই ধরনের অপকর্মে যুক্ত হয়ে পড়েন। বিভিন্ন ধর্মীয় বা সামাজিক উৎসবের সময় একশ্রেণীর ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার জন্য মরিয়া হয়ে যান। তাদের কাছে ধর্মীয় নির্দেশনা বা জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার বিষয়টি গৌণ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যেন অসহায়।

কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিভাগ একটু দূরদর্শী ও সতর্ক হলে অসাধু ব্যবসায়ীদের এ সবাই অপকর্ম থেকে জনগণ রক্ষা পেতে পারে। আর বিক্রেতারা যদি ক্রেতার দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতেন তাহলে হয়ত লাগামহীনভাবে মূল্যবৃদ্ধি করতেন না। দাম বৃদ্ধির এই হার স্থানভেদে পার্থক্য থাকলেও নির্দিষ্ট কিছু দ্রব্যের মূল্য সবক্ষেত্রে একই হারে বেড়ে থাকে। ক্রেতা সাধারণের তখন অধিক মূল্যে পণ্য কেনা ছাড়া কোন পথ থাকে না। অবশ্য টিসিবি কয়েকটি পণ্য স্বল্পমূল্যে ভোক্তা সাধারণের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ঊর্ধ্বগতি রোধ করার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া দরকার। প্রথমত, সরকারের সদিচ্ছা ও বাস্তব পরিকল্পনা। দ্বিতীয়ত, পণ্যসামগ্রীর চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার ব্যবস্থা করা। এ জন্য দেশে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে হবে। দেশের উৎপাদন ব্যবস্থার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পণ্যবাজারের ওপর সরকারের সজাগ দৃষ্টি রাখা দরকার, যেন অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি করে খুশিমতো জিনিসপত্রের দাম বাড়াতে না পারেন। রাজনৈতিক সহনশীলতা ও সমঝোতা সৃষ্টি করে এ সমস্যা লাঘব করা দরকার। চোরাচালান ও চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। বাজার নিয়মিত পরিদর্শন করতে হবে। দুর্নীতির লাগামহীন ঘোড়াকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।

সরকারকে কঠোর হাতে অতিলোভী অসাধু এসব ব্যবসায়ীকে দমন করতে হবে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যতালিকা টাঙানো এবং নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রয় করা হচ্ছে কিনা, সেটি পর্যবেক্ষণের জন্য সব বাজারে দ্রব্যমূল্য মনিটরিং কমিটি গঠনের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার ও ব্যবসায়ীদের সদিচ্ছাই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করে দেশের সাধারণ মানুষের আরও একটু সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা প্রদানে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে সক্ষম।

মুনাফালোভী, কালোবাজারি ব্যবসায়ী শ্রেণী, ঘুষখোর কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করতে হবে। পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে আনতে হবে। তাহলেই দ্রব্যের মূল্য হ্রাস পাবে। জনমনে হতাশা, ক্ষোভ দূর হয়ে শান্তি ফিরিয়ে আসবে। বাজারে পণ্যের মূল্য নির্ধারণে ভারসাম্য বজায় রাখার মাধ্যমে জনমানসের চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করতে হবে। আর সরকার এ ব্যাপারে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। নিশ্চিত করা হবে সাধারণ ও নিম্নআয়ের মানুষের ভালোভাবে বেঁচে থাকার নিরাপত্তা।

নিত্যপণ্যের উর্ধ্বগতি ও নতুন বছরের বাজেট ঘোষণা কতটা গণমুখী হবে, আর গণমুখী হলেও তাতে সাধারণ ও খেটে খাওয়া মানুষের বেঁচে থাকার মতো কোন নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবেলার ব্যবস্থা থাকছে কিনা? এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে দুটি মতের ধারা প্রাধান্য পেয়ে থাকে- এক গ্রুপের অভিমত হচ্ছে এ বাজেটে মানুষের অসহায়ত্ব ও হাহাকার বাড়াবে; অন্যদিকে সুবিধাভোগী শ্রেণীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ইস্যুর সৃষ্টি হবে।

পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিভিন্ন মহলে পারস্পরিক অবিশ্বাস, স্বার্থপরতা, লোভ-লালসা, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, বাজার অর্থনীতি মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে বাজেট এবং বাজার নিত্যপণ্যের মূল্য কতটা নিয়ন্ত্রণে থাকবে সেগুলো সাধারণ মানুষকে খুব ভাবাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি বিশ্ববাজারকে অনেকটাই অস্থিতিশীল করে তুলেছে। কাজেই বাংলাদেশের প্রস্তাবিত বাজেটে আমাদের নিত্যপণ্যের যে ঊর্ধ্বগতি তার লাগাম টেনে ধরবে কি?

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাজার ও বাজেট বাস্তবায়নের মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান জরুরি। অন্যথায় আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থা যে ইঙ্গিত দিচ্ছে তাতে মনে হয় আগামী বাজেট বাস্তবায়ন খুবই চ্যালেঞ্জমুখী হবে। দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান ও ক্ষুদ্র ব্যবসার উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা ছাড়া মানুষের জীবন মানের কোন পরিবর্তন আসবে না; বরং বেঁচে থাকাই একটি চ্যালেঞ্জের বিষয় হবে। তবে বাজেট যেভাবেই প্রণীত হোক না কেন তাকে গণমুখী করা তথা সমাজের সব শ্রেণী ও মানুষের স্বার্থে আঘাতহানিকর প্রকল্পসমূহের ব্যয় নির্বাহে আমাদের খুবই সজাগ থাকতে হবে। প্রয়োজনে এ জাতীয় প্রকল্পকে বাদ দিয়ে হলেও সাধারণ স্বার্থের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে বাজেট ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাকে খুবই নজরে আনতে হবে। বিশ্ব মুদ্রাস্ফীতি, মূল্যস্ফীতি, বাজার নিয়ন্ত্রণসহ সব স্টেকহোল্ডারদের নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে কার্যকর ব্যবস্থায় অবতীর্ণ হতে হবে।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক,

বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]