হাঁড়িভাঙা আম বাজারে আসার আগেই কয়েকটি দেশে ৫০ কোটি টাকার অগ্রিম রপ্তানির অর্ডার পেয়েছে চাষিরা

দেশে উৎপাদিত একমাত্র আঁশবিহীন প্রচণ্ড সুস্বাদু রংপুরের হাঁড়িভাঙ্গা আম দেশে উৎপাদিত সব আমের সেরা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। এবার গাছে আম পুষ্ট হওয়ার আগেই মধ্যপ্রাচ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশে ৫০ কোটি টাকার আম রপ্তানির অর্ডার পেয়েছে আমের বাগান মালিকরা এবং আরও অর্ডার পাওয়ার আশা করছেন তারা।

কৃষি বিভাগ বলেছে চলতি জুন মাসের ২০ তারিখে পুরোপুরি হাঁড়িভাঙ্গা আম বাজারে আসবে। কেননা এই আম পুরোপুরি পুষ্ট হতে সময় লাগে। সে কারণে অনেকটা দেরিতেই আসছে সুস্বাদু হাঁড়িভাঙ্গা আম।

গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের কাছে হাঁড়িভাঙ্গা আম উপহার হিসেবে পাঠানোর কারণে এর পরিচিতি দেশ ছাপিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এর চাহিদাও বেড়েছে।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক ওবায়দুর রহমান জানিয়েছেন এবার রংপুরে ১ হাজার ৯শ’ ৫ হেক্টর জমিতে হাঁড়িভাঙ্গা আম চাষ করা হয়েছে। যা গত বছরের চেয়ে ৪০ হেক্টর বেশি। আমের ফলন এবার গতবারের চেয়ে ভালো হওয়ায় প্রায় ৩৫ হাজার মেট্রিকটন আম উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। উৎপাদিত আমের বিক্রি এবার তিনশ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

হাঁড়িভাঙ্গা আমের জন্মের ইতিহাস :

রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার পদাগঞ্জ এলাকায় হাঁড়িভাঙ্গা আম প্রথম উৎপাদন করে কৃষক সালাম। সম্পুর্ণ আঁশমুক্ত ভীষণ সুস্বাদু হওয়ায় এ আমের চাহিদা এখন দেশ ছাপিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন বদরগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের গোপালপুর , পদাগঞ্জ কুতুবপুর ইউনিয়নের নাগেরহাট সর্দ্দারপাড়া সদর উপজেলার সদ্যপুষ্করনী ইউনিয়নের কাঁটাবাড়ি পার্শ্বে মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের সবগুলো গ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় বানিজ্যিক ভিত্তিতে হাঁড়িভাঙ্গা আমের বাগান গড়ে উঠেছে। মূলত লালমাটি এলাকায় হাঁড়িভাঙ্গা আমের চাষ হয় আর লালমাটির আম ভীষণ সুস্বাদু। গত বছর আমচাষিরা আমের দাম ভালো পাওয়ায় আরও নতুন নতুন আম বাগান গড়ে তুলেছেন এলাকার সাধারণ মানুষ। এবার হাঁড়িভাঙ্গা আমের ফলনও হয়েছে তুলনামুলক ভালো। তবে ক্ষুদ্র চাষিদের অভিযোগ তারা ন্যায্য মূল্য পায় না। যদি আম সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা থাকত তাহলে তারা আরও বেশি লাভবান হতেন। বড় বড় ব্যবসায়ীরা আগাম টাকা দিয়ে আমের বাগান কিনে নেয়ায় তারা লাভবান হচ্ছেন বেশি বলে আমচাষিদের অভিযোগ। তারপরেও হাঁড়িভাঙ্গা আম বদরগঞ্জ ও মিঠাপুকুর উপজেলার ৭০টি গ্রামের মানুষের ভাগ্যের চাকা খুলে দিয়েছে। এই আম চাষ করে তারা এখন পুরোপুরি স্বাবলম্বী।

রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার পদাগঞ্জ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে সারি সারি আমের বাগান এমনকি প্রতিটি বাড়িতে ১০ থেকে ১৫টি কোন কোন বাড়িতে তার চেয়ে বেশি হাঁড়িভাঙ্গা আমের গাছ। সবগুলো গাছের আম পাকা শুরু হয়ে গেছে বলে আমচাষিরা জানায়। ওই এলাকার আমচাষি শরীফুল ইসলাম, আফছার আলী , মোমেনা বেগমসহ অনেকেই জানায় মাত্র ৮/১০ বছর আগেও এসব এলাকা ছিল চরম দারিদ্র্যপীড়িত। মানুষ তিন বেলা তো দূরের কথা এক বেলাও খাবার জোটাতে পারত না। এলাকার মাটি লাল হওয়ায় এখানে বছরে একবার ধান উৎপাদন হয়। বাকি ৮ মাস পতিত পড়ে থাকে জমি। কিন্তু হাঁড়িভাঙ্গা আম তাদের ভাগ্যের চাকা বদলে দিয়েছে। এখন ধানের বদলে ওই জমিতে আমের বাগান গড়ে তুলেছেন তারা। বছরে আম বিক্রি করে তাদের সংসারে এখন সচ্ছলতা ফিরে এসেছে। কিন্তু যাদের জমি নেই সেই সব ভূমিহীন পরিবারগুলো তাদের বাস্তুভিটাতেই হাঁড়িভাঙ্গা আম গাছ লাগিয়ে উৎপাদিত আম বিক্রি করে ভালোভাবেই জীবনযাপন করছেন। আমচাষিদের সবার একটাই দাবি আম সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হোক।

এদিকে হাঁড়িভাঙ্গা আমের সবচেয়ে বড় বাগান মালিক সোলায়মান আলী জানান ঢাকা থেকে বেশ কয়েকজন আড়তদার ব্যবসায়ী এবার অগ্রিম টাকা দিয়ে বুকিং করছেন। তার মতো আরও অন্তত ৬০টি বাগান মালিকদের সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়েছে। আপাতত ৫০ কোটি টাকার অর্ডার মিলেছে এটা ১শ’ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। একই কথা বলেন আমচাষি মনিরুল ইসলাম, আফজাল হোসেনসহ অনেকে।

এদিকে আমচাষিরা বলছেন গত দু বছর করোনা মহামারীর কারণে তারা ন্যায্য মূল্য পাননি। এবার ফলন ভালো হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে তারা লাভবান হবেন।

জেলা প্রশাসক চিত্র লেখা নাজনীন জানিয়েছেন সরাসরি বাগান থেকে যাতে আম কিনতে পারে সেজন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা আমের পাইকারদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। টাকা লেনদেনের জন্য বিভিন্ন ব্যাংকের বুথ খোলা হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি বাড়ানো হবে। এদিকে আম দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য নামকরা কুরিয়ার সার্ভিসগুলো পদাগঞ্জ এলাকায় বিশেষ অফিস স্থাপন করছেন । তারা বাগান থেকে আম সরাসরি গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য বিশেষ গাড়ির ব্যবস্থা করেছেন।

তবে কৃষি বিশেষজ্ঞ ওবায়দুর রহমান জানিয়েছেন হাঁড়িভাঙ্গা আম সব জাতের আমের চেয়ে একটু দেরিতে পুষ্ট হয়। সে কারণে ২০ জুনের পর থেকে আম কেনার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। আমচাষিরাও আনুষ্ঠানিকভাবে ওই তারিখ থেকে আম পাড়া শুরু করবেন। কারণ তখন পুরোপরি পুষ্ট হবে তখন স্বাদও পাবে ভোক্তারা।

শনিবার, ১০ জুন ২০২৩ , ২৭ জৈষ্ঠ্য ১৪৩০, ২০ জিলক্বদ ১৪৪৪

হাঁড়িভাঙা আম বাজারে আসার আগেই কয়েকটি দেশে ৫০ কোটি টাকার অগ্রিম রপ্তানির অর্ডার পেয়েছে চাষিরা

লিয়াকত আলী বাদল রংপুর

image

দেশে উৎপাদিত একমাত্র আঁশবিহীন প্রচণ্ড সুস্বাদু রংপুরের হাঁড়িভাঙ্গা আম দেশে উৎপাদিত সব আমের সেরা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। এবার গাছে আম পুষ্ট হওয়ার আগেই মধ্যপ্রাচ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশে ৫০ কোটি টাকার আম রপ্তানির অর্ডার পেয়েছে আমের বাগান মালিকরা এবং আরও অর্ডার পাওয়ার আশা করছেন তারা।

কৃষি বিভাগ বলেছে চলতি জুন মাসের ২০ তারিখে পুরোপুরি হাঁড়িভাঙ্গা আম বাজারে আসবে। কেননা এই আম পুরোপুরি পুষ্ট হতে সময় লাগে। সে কারণে অনেকটা দেরিতেই আসছে সুস্বাদু হাঁড়িভাঙ্গা আম।

গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের কাছে হাঁড়িভাঙ্গা আম উপহার হিসেবে পাঠানোর কারণে এর পরিচিতি দেশ ছাপিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এর চাহিদাও বেড়েছে।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক ওবায়দুর রহমান জানিয়েছেন এবার রংপুরে ১ হাজার ৯শ’ ৫ হেক্টর জমিতে হাঁড়িভাঙ্গা আম চাষ করা হয়েছে। যা গত বছরের চেয়ে ৪০ হেক্টর বেশি। আমের ফলন এবার গতবারের চেয়ে ভালো হওয়ায় প্রায় ৩৫ হাজার মেট্রিকটন আম উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। উৎপাদিত আমের বিক্রি এবার তিনশ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

হাঁড়িভাঙ্গা আমের জন্মের ইতিহাস :

রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার পদাগঞ্জ এলাকায় হাঁড়িভাঙ্গা আম প্রথম উৎপাদন করে কৃষক সালাম। সম্পুর্ণ আঁশমুক্ত ভীষণ সুস্বাদু হওয়ায় এ আমের চাহিদা এখন দেশ ছাপিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন বদরগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের গোপালপুর , পদাগঞ্জ কুতুবপুর ইউনিয়নের নাগেরহাট সর্দ্দারপাড়া সদর উপজেলার সদ্যপুষ্করনী ইউনিয়নের কাঁটাবাড়ি পার্শ্বে মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের সবগুলো গ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় বানিজ্যিক ভিত্তিতে হাঁড়িভাঙ্গা আমের বাগান গড়ে উঠেছে। মূলত লালমাটি এলাকায় হাঁড়িভাঙ্গা আমের চাষ হয় আর লালমাটির আম ভীষণ সুস্বাদু। গত বছর আমচাষিরা আমের দাম ভালো পাওয়ায় আরও নতুন নতুন আম বাগান গড়ে তুলেছেন এলাকার সাধারণ মানুষ। এবার হাঁড়িভাঙ্গা আমের ফলনও হয়েছে তুলনামুলক ভালো। তবে ক্ষুদ্র চাষিদের অভিযোগ তারা ন্যায্য মূল্য পায় না। যদি আম সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা থাকত তাহলে তারা আরও বেশি লাভবান হতেন। বড় বড় ব্যবসায়ীরা আগাম টাকা দিয়ে আমের বাগান কিনে নেয়ায় তারা লাভবান হচ্ছেন বেশি বলে আমচাষিদের অভিযোগ। তারপরেও হাঁড়িভাঙ্গা আম বদরগঞ্জ ও মিঠাপুকুর উপজেলার ৭০টি গ্রামের মানুষের ভাগ্যের চাকা খুলে দিয়েছে। এই আম চাষ করে তারা এখন পুরোপুরি স্বাবলম্বী।

রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার পদাগঞ্জ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে সারি সারি আমের বাগান এমনকি প্রতিটি বাড়িতে ১০ থেকে ১৫টি কোন কোন বাড়িতে তার চেয়ে বেশি হাঁড়িভাঙ্গা আমের গাছ। সবগুলো গাছের আম পাকা শুরু হয়ে গেছে বলে আমচাষিরা জানায়। ওই এলাকার আমচাষি শরীফুল ইসলাম, আফছার আলী , মোমেনা বেগমসহ অনেকেই জানায় মাত্র ৮/১০ বছর আগেও এসব এলাকা ছিল চরম দারিদ্র্যপীড়িত। মানুষ তিন বেলা তো দূরের কথা এক বেলাও খাবার জোটাতে পারত না। এলাকার মাটি লাল হওয়ায় এখানে বছরে একবার ধান উৎপাদন হয়। বাকি ৮ মাস পতিত পড়ে থাকে জমি। কিন্তু হাঁড়িভাঙ্গা আম তাদের ভাগ্যের চাকা বদলে দিয়েছে। এখন ধানের বদলে ওই জমিতে আমের বাগান গড়ে তুলেছেন তারা। বছরে আম বিক্রি করে তাদের সংসারে এখন সচ্ছলতা ফিরে এসেছে। কিন্তু যাদের জমি নেই সেই সব ভূমিহীন পরিবারগুলো তাদের বাস্তুভিটাতেই হাঁড়িভাঙ্গা আম গাছ লাগিয়ে উৎপাদিত আম বিক্রি করে ভালোভাবেই জীবনযাপন করছেন। আমচাষিদের সবার একটাই দাবি আম সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হোক।

এদিকে হাঁড়িভাঙ্গা আমের সবচেয়ে বড় বাগান মালিক সোলায়মান আলী জানান ঢাকা থেকে বেশ কয়েকজন আড়তদার ব্যবসায়ী এবার অগ্রিম টাকা দিয়ে বুকিং করছেন। তার মতো আরও অন্তত ৬০টি বাগান মালিকদের সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়েছে। আপাতত ৫০ কোটি টাকার অর্ডার মিলেছে এটা ১শ’ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। একই কথা বলেন আমচাষি মনিরুল ইসলাম, আফজাল হোসেনসহ অনেকে।

এদিকে আমচাষিরা বলছেন গত দু বছর করোনা মহামারীর কারণে তারা ন্যায্য মূল্য পাননি। এবার ফলন ভালো হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে তারা লাভবান হবেন।

জেলা প্রশাসক চিত্র লেখা নাজনীন জানিয়েছেন সরাসরি বাগান থেকে যাতে আম কিনতে পারে সেজন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা আমের পাইকারদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। টাকা লেনদেনের জন্য বিভিন্ন ব্যাংকের বুথ খোলা হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি বাড়ানো হবে। এদিকে আম দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য নামকরা কুরিয়ার সার্ভিসগুলো পদাগঞ্জ এলাকায় বিশেষ অফিস স্থাপন করছেন । তারা বাগান থেকে আম সরাসরি গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য বিশেষ গাড়ির ব্যবস্থা করেছেন।

তবে কৃষি বিশেষজ্ঞ ওবায়দুর রহমান জানিয়েছেন হাঁড়িভাঙ্গা আম সব জাতের আমের চেয়ে একটু দেরিতে পুষ্ট হয়। সে কারণে ২০ জুনের পর থেকে আম কেনার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। আমচাষিরাও আনুষ্ঠানিকভাবে ওই তারিখ থেকে আম পাড়া শুরু করবেন। কারণ তখন পুরোপরি পুষ্ট হবে তখন স্বাদও পাবে ভোক্তারা।