হাতি ও মানুষের সংঘাত বাড়ল কেন?

পাভেল পার্থ

বনের হাতি ধরে অন্যায় বাণিজ্যের বিরুদ্ধে পৃথিবীতে প্রথম লড়াই করেছে বাংলাদেশের হাজংরা। ইতিহাসে যা হাতিখদা বিরোধী আন্দোলন (১৮৪০-১৮৪৫) নামে পরিচিত। সম্রাট আকবরের সময় সুসং রাজা হাজংদের বাধ্য করাতেন বনের হাতি ধরে দেয়ার জন্য। এজন্য হাজংদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খেদা তৈরি করে বনের হাতি তাড়িয়ে এনে খেদায় আটকে ধরতে হতো। হাজংরা এ অন্যায় প্রথাকে বলেন ‘হাতিবেগার’। হয়তো এখান থেকেই বাংলায় ‘বেগার’ বা ‘বেগারখাটা’ প্রত্যয়টি চালু হয়েছে।

এভাবে হাতিবেগারে গিয়ে প্রাণ যেত অনেকের। বনের হাতি এভাবে অন্যায়ভাবে ধরে বাণিজ্য করার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন হাজং নারী-পুরুষেরা। এ আন্দোলনে প্রথম শহীদ হন হাজং নেতা মনা রায়। হাজংদের কাছে হাতি এক পবিত্র প্রাণী।

নেত্রকোনার কলমাকান্দার লেংগুরা ইউনিয়নের একটি ছোট্ট গ্রাম চৈতানগর। আগে একটি কেবলমাত্র হাজংদেরই গ্রাম ছিল। কিন্তু টংকআন্দোলনের পর থেকে এই গ্রাম বহিরাগত বাঙালিরাও দখল করে নেয়। ১৩৩৫ বাংলায় এ গ্রামেই জন্ম গঙ্গাধর হাজংয়ের। পেশায় কৃষক গঙ্গাধর ছিলেন ঐতিহাসিক টংক আন্দোলনের একজন সাহসী সৈনিক। তার দাদু জংগল হাজং ছিলেন হাতিখেদা আন্দোলনের একজন নির্ভীক যোদ্ধা। ২০১৩ সালের ৫ মে সন্ধ্যারাতে গঙ্গাধর হাজং তার উঠানে আলো-আঁধারির ভেতর হাতির কিভাবে জন্ম হলো তা নিয়ে একটি হাজং কাহিনী শোনান।

এক গ্রামে বাস করতো মাসহ দুই ভাইবোন। খুব সকালে মা চলে যেত ধানের ক্ষেতে রোয়া লাগাতে। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতো। বর্ষার সময় তারা খুব একটা বাড়ির বাইরে যেতে পারতো না। ঘরে বসেই এটা সেটা দিয়ে খেলা করতো। একদিন তারা ধান ভানার ঢেঁকির মতো সাজতে চাইলো। চাল ঝাড়ার কুলা দিয়ে কান বানাল, চালুনি দিয়ে চারটি পা বানাল। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ছোট লেজ আর একটা শুড়। এভাবেই তারা খেলতে লাগলো। ভাইবোনের এ কান্ড দেখে দেবতারা তাদের সত্যিকারের হাতি বানিয়ে দেন। হাতি হয়ে ভাইবোন কাছের পাহাড়ে চলে যেত আর সারাদিন পাহাড় ঘুরে এটা সেটা খেয়ে বিকালে বাড়ি ফিরতো। দেবতারা সন্ধ্যার আগেই আবার তাদের মানুষ করে দিতেন। আস্তে আস্তে তারা দিনের বেলা হাতি হতে থাকলো আর দূরের পথে না গিয়ে বাড়ির কাছের কলাবাগান খেয়ে ফেললো। বাড়ির উঠানে পায়খানা করলো। সন্ধ্যায় তাদের মা বাড়ি উঠানে বিশাল বিশাল দলা দলা পায়খানা দেখে অবাক হলো। তারপর দিন মা সন্ধ্যার আগেই দুপুর বেলা বাড়ি চলে আসলো। ততক্ষণে হাতি হয়ে দুইভাইবোন বাড়ির কলাবাগানে ঢুকেছে। মায়ের শব্দ পেয়েই তারা দৌড়ে এলো; কিন্তু দেবতারা আর তাদের মানুষ করলেন না। বিশাল দুই জীব দেখে মা ভয় পেলেন, কিন্তু বিশাল জীব দুটি তাদের মার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলো হাতিরা তারই সন্তান। তারপর হাতিগুলো আবার পাহাড়ে চলে গেলো। মানুষ থেকে হাতির জন্ম হয়েছে বলেই হাতি মানুষের কথা বুঝতে পারে।

শুধু হাজং নয়, বৃহত্তর ময়মনসিংহ, সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনপদে হাতি খুব পবিত্র প্রাণী। হাতির নামে এসব অঞ্চলে বহু স্থাননাম গড়ে ওঠেছে। নেত্রকোণার দূর্গাপুরের মেনকীফান্দার কাছে পাহাড়িটিলার ভেতর একটি জায়গার নাম ‘মংমাগেত্তক’। মান্দিকুসুকে (আচিক ভাষায়) মংমা মানে হাতি। একবার এক বুনো হাতির গলা আটকে গিয়েছিল টিলার খাঁজে। সেই থেকে এই নাম। শেরপুরের ঝিনাইগাতী নালিতাবাড়ীর বহু সীমান্তগ্রামের নাম কোচ আদিবাসীরা হাতির নামে রেখেছেন। হাতিবেড় কিংবা হাতিপাগাড়। কিন্তু নেত্রকোণা, শেরপুর, জামালপুর সীমান্তে হাতি ও মানুষের সহ¯্র বছরের সংহতি প্রতিনিয়ত চুরমার হচ্ছে। গণমাধ্যমে আমরা কিছু খবর দেখতে পাই যেখানে শুধুমাত্র হাতির আক্রমণ কিংবা হাতির মৃত্যুকেই প্রকাশ করা হয়। কিন্তু কেন হাতির এই ঐতিহাসিক বিচরণ অঞ্চল বদলে গেল এসব নিয়ে কোনো বিশ্লেষণ থাকে না।

দুনিয়ায় প্রথম হাতি বাঁচানোর জন্য প্রাণ দেয়া এই বাংলাদেশে এশিয় হাতিরা কেমন আছে? হয় হাতিরা খুন হচ্ছে কিংবা হাতিদের বন্দি করে নির্দয় দাসবাণিজ্য চালু আছে। এর ভেতর সবচে বেশি হাতির মৃত্যু ঘটে সীমান্ত অঞ্চলে বিদ্যুতের পেতে রাখা ফাঁদে জড়িয়ে। ২০২৩ সনের ৬ মে শেরপুরের ঝিনাইগাতীর বাঁকাকুড়া ঢাকাইয়া মোড় থেকে এক বুনো হাতির লাশ উদ্ধার করে বনবিভাগের রাংটিয়া রেঞ্জ অফিস। বনবিভাগের হিসাবে শেরপুর জেলায় ২০১৪ সন থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২৬টি হাতির মৃত্যু হয়েছে, যার বেশিরভাগই বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে। ময়মনসিংহ বিভাগের চার জেলার সীমান্তবর্তী গ্রামে ২০১৪ থেকে ২০২৩ এর মে পর্যন্ত প্রায় ৩৫ জন মানুষ মারা গেছেন হাতির ‘আক্রমণে’ এবং মানুষও পিটিয়ে খুন করেছে ২৯টি হাতি। ২০১২ সালের ৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার ধান ক্ষেত থেকে হাতির এক লাশ উদ্ধার করে বনবিভাগ। ২০১৯ সালে বাঁশখালীতে বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে দুটি হাতি মারা যায়। কক্সবাজারে হাতি চলাচলের রাস্তাকে দখল করে রোহিঙ্গা ক্যাম্প করা হয়েছে। মানুষই জোর করে হাতি ও মানুষের ভেতর দ্বন্দ্ব উসকে দিয়েছে। এ কারণে ২০১৯ সালে ১৩ জন রোহিঙ্গার এবং ২০২০ সালে খুন হয় পাঁচ হাতি।

হাতি হত্যার পাশাপাশি হাতিকে বন্দী করে জোর করে পাহাড়ি এলাকায় গাছ টানানোর মত নির্দয় বাহাদুরি এখনো চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের কিছু এলাকায় কাঠব্যবসায়ীরা টিকিয়ে রেখেছেন। বান্দরবানের লামার সরই ইউনিয়নের লেমুপালং মৌজার ১৩টি ¤্রাে পাড়ার পাড়াবনসহ পাহাড়ি জংগলের গাছ কেটে হাতি দিয়ে টেনে প্রশ্নহীনভাবে বাণিজ্য করছেন চট্টগ্রামের লোহাগড়ার মোরশেদ গং। এ নিয়ে প্রবাতে ৩ মে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, ‘ইউসুফ বাহাদুর নামের’ হাতিটি দিয়ে কাটা গাছ টানানো হয়। হাতিটির মালিক সিলেটের মোমেন কোম্পানি। দৈনিক চারবার এবং সপ্তাহে পাঁচ দিন হাতিকে গাছ টানতে বাধ্য করানো হয়। হাতির মালিক পান দিনে সাড়ে চার হাজার টাকা। এসব বন্দী হাতির শরীরভর্তি দাগ ও ক্ষত, ক্লান্ত রুগ্ণশরীর বারবার লুটিয়ে পড়ে। কিন্তু কেউ বন্দী হাতির মুক্তির জন্য কথা বলে না।

হাতির জীবন বাঁচাতে জীবন দেয়া এই দেশে কেন আজ মানুষ ও হাতিতে দ্বন্দ্ব-সংঘাত তৈরি হলো এ নিয়ে এখনো কোনো পাবলিক আলাপচারিতা গড়ে ওঠেনি। হাতি বা মানুষ কারোর জীবনের নিরাপত্তাই নিশ্চিত করতে পারেনি রাষ্ট্র। বনবিভাগ কিংবা কিছু উন্নয়নপ্রকল্প কেবলমাত্র হাতি তাড়ানোর জন্য কিছু সাময়িক কর্মসূচি গ্রহণ করছে। কিন্তু একটিবারও প্রশ্ন করছে না হাতির বিচরণ অঞ্চল থেকে কেন হাতিকে তাড়াতে হবে? তাহলে হাতির এই বিচরণ অঞ্চল বদলে গেল কেন এবং কিভাবে? সীমান্তবর্তী অঞ্চলের করুণ সামাজিক ইতিহাসের ভেতরই লুকিয়ে আছে সমকালের সীমান্তে হাতি ও মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়ার কাহিনী। সীমান্তবর্তী এ অঞ্চল মূলত মান্দি (গারো), কোচ, হাজং, বানাই, হদি, লেঙাম আদিবাসীদের আদি বসতি অঞ্চল।

কিন্তু দেশভাগের পর এ অঞ্চলে রাজনৈতিকভাবে জনমিতির বিন্যাস বদলে ফেলা হয়। শেরপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী আদিবাসী গ্রাম থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা হয় এবং তাদের জায়গাজমি জবরদখল করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৬২ সালের দাঙ্গায় এ অঞ্চল আদিবাসীশূন্য হয়ে পড়ে। ঐতিহাসিক পেগামারী-পানিহাটা গণহত্যা তখনই ঘটে। ধীরে ধীরে দেশের নানা অঞ্চল থেকে বাঙালিরা এই অঞ্চলে অভিবাসিত হতে থাকেন এবং এমনকি উত্তর-পূর্ব ভারতে বাঙালি খেদাও আন্দোলনের ফলে আসাম থেকে উদ্বাস্তু বাঙালিদের বহু মানুষ এই এলাকা জবরদখল করে আবাস গড়ে তুলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় আবারো আদিবাসীরা বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েন। সামগ্রিকভাবে এ সীমান্ত অঞ্চলে জনমিতির বিন্যাস এবং বসতি স্থাপনের ইতিহাসে এক প্রবল পরিবর্তন ঘটে। বহিরাগত বাঙালির নয়াবসতি এবং সংস্কৃতি ভিন্ন হওয়ায় স্থানীয় পাহাড়-জঙ্গল এবং বন্যপ্রাণীরা সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক পাল্টাতে থাকে। আগে এই অঞ্চলটি আদিবাসীরা থাকায় এখানে জনসংখ্যা কম ছিল, মানুষের বসতি কম ছিল এবং জংগল ও পাহাড়ের অংশ বেশ ছিল।

বহিরাগত বাঙালিদের মাধ্যমে পাহাড়-জঙ্গলের প্রায় সবকিছুই ধ্বংস হয়ে পড়ে এবং হাতিসহ বণ্যপ্রাণীর বিচরণঅঞ্চল কমতে থাকে। ঐতিহাসিকভাবে হাতির এ বিচরণ অঞ্চল জবরদখল করেই মূলত মানুষের এ নয়াবসতি গড়ে ওঠে। হাতির সঙ্গে আদিবাসী সংস্কৃতির ধর্মীয়-মনস্তাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক যে সম্পর্ক ছিল তা গরিষ্ঠভাগ বাঙালির নেই। নয়াবসতিস্থাপনকারী বাঙালিদের কাছে হাতি তাই ক্রমান্বয়ে ‘শত্রু’ এবং ‘প্রতিপক্ষ’ হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে। শুরু হয় ‘হাতি ও মানুষের’ নির্দয় দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। আজ পাহাড় ও বনে হাতির খাবার নেই, হাতির বিচরণস্থল ঝুঁকিপূর্ণ করেছে মানুষের বাণিজ্যিক লোভ। তাই হাতিরা হামলে পড়তে বাধ্য হচ্ছে সীমান্ত জনপদে। সাবাড় করছে ধানজমিন, ফলের বাগান ও বসতবাড়ি। হাতির সঙ্গে মানুষের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক এবং মনস্তাত্ত্বিক জাগরণ শক্তিশালী না করলে কোনোভাবেই সীমান্তঅঞ্চলে হাতিহত্যা বন্ধ করা সম্ভব নয়। এটি শুধু সাময়িক হাতিকে তাড়ানোর কোনো বিষয় নয়, এর জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং সর্বস্তরের সামাজিক ও পরিবেশগত শিক্ষা।

[লেখক : গবেষক]

শনিবার, ১০ জুন ২০২৩ , ২৭ জৈষ্ঠ্য ১৪৩০, ২০ জিলক্বদ ১৪৪৪

হাতি ও মানুষের সংঘাত বাড়ল কেন?

পাভেল পার্থ

image

বনের হাতি ধরে অন্যায় বাণিজ্যের বিরুদ্ধে পৃথিবীতে প্রথম লড়াই করেছে বাংলাদেশের হাজংরা। ইতিহাসে যা হাতিখদা বিরোধী আন্দোলন (১৮৪০-১৮৪৫) নামে পরিচিত। সম্রাট আকবরের সময় সুসং রাজা হাজংদের বাধ্য করাতেন বনের হাতি ধরে দেয়ার জন্য। এজন্য হাজংদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খেদা তৈরি করে বনের হাতি তাড়িয়ে এনে খেদায় আটকে ধরতে হতো। হাজংরা এ অন্যায় প্রথাকে বলেন ‘হাতিবেগার’। হয়তো এখান থেকেই বাংলায় ‘বেগার’ বা ‘বেগারখাটা’ প্রত্যয়টি চালু হয়েছে।

এভাবে হাতিবেগারে গিয়ে প্রাণ যেত অনেকের। বনের হাতি এভাবে অন্যায়ভাবে ধরে বাণিজ্য করার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন হাজং নারী-পুরুষেরা। এ আন্দোলনে প্রথম শহীদ হন হাজং নেতা মনা রায়। হাজংদের কাছে হাতি এক পবিত্র প্রাণী।

নেত্রকোনার কলমাকান্দার লেংগুরা ইউনিয়নের একটি ছোট্ট গ্রাম চৈতানগর। আগে একটি কেবলমাত্র হাজংদেরই গ্রাম ছিল। কিন্তু টংকআন্দোলনের পর থেকে এই গ্রাম বহিরাগত বাঙালিরাও দখল করে নেয়। ১৩৩৫ বাংলায় এ গ্রামেই জন্ম গঙ্গাধর হাজংয়ের। পেশায় কৃষক গঙ্গাধর ছিলেন ঐতিহাসিক টংক আন্দোলনের একজন সাহসী সৈনিক। তার দাদু জংগল হাজং ছিলেন হাতিখেদা আন্দোলনের একজন নির্ভীক যোদ্ধা। ২০১৩ সালের ৫ মে সন্ধ্যারাতে গঙ্গাধর হাজং তার উঠানে আলো-আঁধারির ভেতর হাতির কিভাবে জন্ম হলো তা নিয়ে একটি হাজং কাহিনী শোনান।

এক গ্রামে বাস করতো মাসহ দুই ভাইবোন। খুব সকালে মা চলে যেত ধানের ক্ষেতে রোয়া লাগাতে। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতো। বর্ষার সময় তারা খুব একটা বাড়ির বাইরে যেতে পারতো না। ঘরে বসেই এটা সেটা দিয়ে খেলা করতো। একদিন তারা ধান ভানার ঢেঁকির মতো সাজতে চাইলো। চাল ঝাড়ার কুলা দিয়ে কান বানাল, চালুনি দিয়ে চারটি পা বানাল। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ছোট লেজ আর একটা শুড়। এভাবেই তারা খেলতে লাগলো। ভাইবোনের এ কান্ড দেখে দেবতারা তাদের সত্যিকারের হাতি বানিয়ে দেন। হাতি হয়ে ভাইবোন কাছের পাহাড়ে চলে যেত আর সারাদিন পাহাড় ঘুরে এটা সেটা খেয়ে বিকালে বাড়ি ফিরতো। দেবতারা সন্ধ্যার আগেই আবার তাদের মানুষ করে দিতেন। আস্তে আস্তে তারা দিনের বেলা হাতি হতে থাকলো আর দূরের পথে না গিয়ে বাড়ির কাছের কলাবাগান খেয়ে ফেললো। বাড়ির উঠানে পায়খানা করলো। সন্ধ্যায় তাদের মা বাড়ি উঠানে বিশাল বিশাল দলা দলা পায়খানা দেখে অবাক হলো। তারপর দিন মা সন্ধ্যার আগেই দুপুর বেলা বাড়ি চলে আসলো। ততক্ষণে হাতি হয়ে দুইভাইবোন বাড়ির কলাবাগানে ঢুকেছে। মায়ের শব্দ পেয়েই তারা দৌড়ে এলো; কিন্তু দেবতারা আর তাদের মানুষ করলেন না। বিশাল দুই জীব দেখে মা ভয় পেলেন, কিন্তু বিশাল জীব দুটি তাদের মার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলো হাতিরা তারই সন্তান। তারপর হাতিগুলো আবার পাহাড়ে চলে গেলো। মানুষ থেকে হাতির জন্ম হয়েছে বলেই হাতি মানুষের কথা বুঝতে পারে।

শুধু হাজং নয়, বৃহত্তর ময়মনসিংহ, সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনপদে হাতি খুব পবিত্র প্রাণী। হাতির নামে এসব অঞ্চলে বহু স্থাননাম গড়ে ওঠেছে। নেত্রকোণার দূর্গাপুরের মেনকীফান্দার কাছে পাহাড়িটিলার ভেতর একটি জায়গার নাম ‘মংমাগেত্তক’। মান্দিকুসুকে (আচিক ভাষায়) মংমা মানে হাতি। একবার এক বুনো হাতির গলা আটকে গিয়েছিল টিলার খাঁজে। সেই থেকে এই নাম। শেরপুরের ঝিনাইগাতী নালিতাবাড়ীর বহু সীমান্তগ্রামের নাম কোচ আদিবাসীরা হাতির নামে রেখেছেন। হাতিবেড় কিংবা হাতিপাগাড়। কিন্তু নেত্রকোণা, শেরপুর, জামালপুর সীমান্তে হাতি ও মানুষের সহ¯্র বছরের সংহতি প্রতিনিয়ত চুরমার হচ্ছে। গণমাধ্যমে আমরা কিছু খবর দেখতে পাই যেখানে শুধুমাত্র হাতির আক্রমণ কিংবা হাতির মৃত্যুকেই প্রকাশ করা হয়। কিন্তু কেন হাতির এই ঐতিহাসিক বিচরণ অঞ্চল বদলে গেল এসব নিয়ে কোনো বিশ্লেষণ থাকে না।

দুনিয়ায় প্রথম হাতি বাঁচানোর জন্য প্রাণ দেয়া এই বাংলাদেশে এশিয় হাতিরা কেমন আছে? হয় হাতিরা খুন হচ্ছে কিংবা হাতিদের বন্দি করে নির্দয় দাসবাণিজ্য চালু আছে। এর ভেতর সবচে বেশি হাতির মৃত্যু ঘটে সীমান্ত অঞ্চলে বিদ্যুতের পেতে রাখা ফাঁদে জড়িয়ে। ২০২৩ সনের ৬ মে শেরপুরের ঝিনাইগাতীর বাঁকাকুড়া ঢাকাইয়া মোড় থেকে এক বুনো হাতির লাশ উদ্ধার করে বনবিভাগের রাংটিয়া রেঞ্জ অফিস। বনবিভাগের হিসাবে শেরপুর জেলায় ২০১৪ সন থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২৬টি হাতির মৃত্যু হয়েছে, যার বেশিরভাগই বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে। ময়মনসিংহ বিভাগের চার জেলার সীমান্তবর্তী গ্রামে ২০১৪ থেকে ২০২৩ এর মে পর্যন্ত প্রায় ৩৫ জন মানুষ মারা গেছেন হাতির ‘আক্রমণে’ এবং মানুষও পিটিয়ে খুন করেছে ২৯টি হাতি। ২০১২ সালের ৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার ধান ক্ষেত থেকে হাতির এক লাশ উদ্ধার করে বনবিভাগ। ২০১৯ সালে বাঁশখালীতে বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে দুটি হাতি মারা যায়। কক্সবাজারে হাতি চলাচলের রাস্তাকে দখল করে রোহিঙ্গা ক্যাম্প করা হয়েছে। মানুষই জোর করে হাতি ও মানুষের ভেতর দ্বন্দ্ব উসকে দিয়েছে। এ কারণে ২০১৯ সালে ১৩ জন রোহিঙ্গার এবং ২০২০ সালে খুন হয় পাঁচ হাতি।

হাতি হত্যার পাশাপাশি হাতিকে বন্দী করে জোর করে পাহাড়ি এলাকায় গাছ টানানোর মত নির্দয় বাহাদুরি এখনো চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের কিছু এলাকায় কাঠব্যবসায়ীরা টিকিয়ে রেখেছেন। বান্দরবানের লামার সরই ইউনিয়নের লেমুপালং মৌজার ১৩টি ¤্রাে পাড়ার পাড়াবনসহ পাহাড়ি জংগলের গাছ কেটে হাতি দিয়ে টেনে প্রশ্নহীনভাবে বাণিজ্য করছেন চট্টগ্রামের লোহাগড়ার মোরশেদ গং। এ নিয়ে প্রবাতে ৩ মে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, ‘ইউসুফ বাহাদুর নামের’ হাতিটি দিয়ে কাটা গাছ টানানো হয়। হাতিটির মালিক সিলেটের মোমেন কোম্পানি। দৈনিক চারবার এবং সপ্তাহে পাঁচ দিন হাতিকে গাছ টানতে বাধ্য করানো হয়। হাতির মালিক পান দিনে সাড়ে চার হাজার টাকা। এসব বন্দী হাতির শরীরভর্তি দাগ ও ক্ষত, ক্লান্ত রুগ্ণশরীর বারবার লুটিয়ে পড়ে। কিন্তু কেউ বন্দী হাতির মুক্তির জন্য কথা বলে না।

হাতির জীবন বাঁচাতে জীবন দেয়া এই দেশে কেন আজ মানুষ ও হাতিতে দ্বন্দ্ব-সংঘাত তৈরি হলো এ নিয়ে এখনো কোনো পাবলিক আলাপচারিতা গড়ে ওঠেনি। হাতি বা মানুষ কারোর জীবনের নিরাপত্তাই নিশ্চিত করতে পারেনি রাষ্ট্র। বনবিভাগ কিংবা কিছু উন্নয়নপ্রকল্প কেবলমাত্র হাতি তাড়ানোর জন্য কিছু সাময়িক কর্মসূচি গ্রহণ করছে। কিন্তু একটিবারও প্রশ্ন করছে না হাতির বিচরণ অঞ্চল থেকে কেন হাতিকে তাড়াতে হবে? তাহলে হাতির এই বিচরণ অঞ্চল বদলে গেল কেন এবং কিভাবে? সীমান্তবর্তী অঞ্চলের করুণ সামাজিক ইতিহাসের ভেতরই লুকিয়ে আছে সমকালের সীমান্তে হাতি ও মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়ার কাহিনী। সীমান্তবর্তী এ অঞ্চল মূলত মান্দি (গারো), কোচ, হাজং, বানাই, হদি, লেঙাম আদিবাসীদের আদি বসতি অঞ্চল।

কিন্তু দেশভাগের পর এ অঞ্চলে রাজনৈতিকভাবে জনমিতির বিন্যাস বদলে ফেলা হয়। শেরপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী আদিবাসী গ্রাম থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা হয় এবং তাদের জায়গাজমি জবরদখল করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৬২ সালের দাঙ্গায় এ অঞ্চল আদিবাসীশূন্য হয়ে পড়ে। ঐতিহাসিক পেগামারী-পানিহাটা গণহত্যা তখনই ঘটে। ধীরে ধীরে দেশের নানা অঞ্চল থেকে বাঙালিরা এই অঞ্চলে অভিবাসিত হতে থাকেন এবং এমনকি উত্তর-পূর্ব ভারতে বাঙালি খেদাও আন্দোলনের ফলে আসাম থেকে উদ্বাস্তু বাঙালিদের বহু মানুষ এই এলাকা জবরদখল করে আবাস গড়ে তুলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় আবারো আদিবাসীরা বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েন। সামগ্রিকভাবে এ সীমান্ত অঞ্চলে জনমিতির বিন্যাস এবং বসতি স্থাপনের ইতিহাসে এক প্রবল পরিবর্তন ঘটে। বহিরাগত বাঙালির নয়াবসতি এবং সংস্কৃতি ভিন্ন হওয়ায় স্থানীয় পাহাড়-জঙ্গল এবং বন্যপ্রাণীরা সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক পাল্টাতে থাকে। আগে এই অঞ্চলটি আদিবাসীরা থাকায় এখানে জনসংখ্যা কম ছিল, মানুষের বসতি কম ছিল এবং জংগল ও পাহাড়ের অংশ বেশ ছিল।

বহিরাগত বাঙালিদের মাধ্যমে পাহাড়-জঙ্গলের প্রায় সবকিছুই ধ্বংস হয়ে পড়ে এবং হাতিসহ বণ্যপ্রাণীর বিচরণঅঞ্চল কমতে থাকে। ঐতিহাসিকভাবে হাতির এ বিচরণ অঞ্চল জবরদখল করেই মূলত মানুষের এ নয়াবসতি গড়ে ওঠে। হাতির সঙ্গে আদিবাসী সংস্কৃতির ধর্মীয়-মনস্তাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক যে সম্পর্ক ছিল তা গরিষ্ঠভাগ বাঙালির নেই। নয়াবসতিস্থাপনকারী বাঙালিদের কাছে হাতি তাই ক্রমান্বয়ে ‘শত্রু’ এবং ‘প্রতিপক্ষ’ হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে। শুরু হয় ‘হাতি ও মানুষের’ নির্দয় দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। আজ পাহাড় ও বনে হাতির খাবার নেই, হাতির বিচরণস্থল ঝুঁকিপূর্ণ করেছে মানুষের বাণিজ্যিক লোভ। তাই হাতিরা হামলে পড়তে বাধ্য হচ্ছে সীমান্ত জনপদে। সাবাড় করছে ধানজমিন, ফলের বাগান ও বসতবাড়ি। হাতির সঙ্গে মানুষের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক এবং মনস্তাত্ত্বিক জাগরণ শক্তিশালী না করলে কোনোভাবেই সীমান্তঅঞ্চলে হাতিহত্যা বন্ধ করা সম্ভব নয়। এটি শুধু সাময়িক হাতিকে তাড়ানোর কোনো বিষয় নয়, এর জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং সর্বস্তরের সামাজিক ও পরিবেশগত শিক্ষা।

[লেখক : গবেষক]