বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব

সাবেরা চৌধুরী

গত ২৫ মে ছয় মার্কিন সিনেটরের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি পিটিশন অনলাইনে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে পাঠানো হয়। সিনেটররা হলেন- কিথ সেলফ, বব গুড, টিম বার্চেট, ব্যারি মুর, ওয়ারেন ডেভিডসন এবং স্কট পেরি। তারা সবাই কংগ্রেসের রিপাবলিকান সদস্য। চিঠির ঘোষণা, যা তাদের উদ্দেশ্যে সম্বোধন করা হয়েছে দীর্ঘ। এটা সম্ভব যে আর্থিক অংশীদার বাংলাদেশ বিরোধী গোষ্ঠীগুলো এই বিবৃতির খসড়া তৈরির জন্য লবিং সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করেছিল। তবে জার্মানির ডয়চে ভেলে এবং সুইডেনের নেত্র নিউজ এই দুটি সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশবিরোধী কুসংস্কারে পরিচালিত একটি বাংলাদেশি সংগঠন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বলে স্বীকৃত।

এর পেছনে কারা রয়েছে তা এখন স্পষ্ট কারণ এই দুটি গোষ্ঠীর নাম সিনেটরদের কাছে চিঠিতে রয়েছে। তাদের বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রের লক্ষ্য ইউটিউবে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে সরকার বিরোধী আন্দোলন প্রচার করা। বিশ্বও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা দেশের সামরিক বাহিনী, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য প্রচার করছে। ফলস্বরূপ, ছয় জন সিনেটর সরকারের কাছে তাদের অভিযোগগুলিতে তাদের কথা তুলে ধরেন এবং নেত্র নিউজ শান্তি মিশনে বাংলাদেশি সেনা সদস্যদের অংশ নেওয়া থেকে বিরত রাখতে রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের আবেদনকে সমর্থন করে।

বলা বাহুল্য, এই ব্যক্তি এবং সংস্থাগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শক্তিশালী লবিস্টদের প্রচুর পরিমাণে অর্থ দিয়ে অর্থায়নের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত। কংগ্রেসম্যানরা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে যে অনুরোধ করেছেন তা হয়তো সেই অর্থ ব্যয় করার পর তাদের সেরা সান্ত¡না নাও হতে পারে! মার্কিন প্রেসিডেন্ট কী করবেন বা করবেন না, কী সিদ্ধান্ত নেবেন এবং কী করবেন না, তা নিয়ে প্রেসিডেন্ট এবং পুরো সরকার উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশের নির্বাচনের এখনো ৬-৭ মাস বাকি। নির্বাচনের ফলাফলের ওপর নির্ভর করে, একক প্রশাসনের বিরুদ্ধে কাজ করা থেকে বিরত থাকা উচিত কিনা তা বিতর্কিত হতে পারে; তবে নির্বাচন এখনো অনেক দূরে।

হয়তো প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং জাতিসংঘের মতো সংস্থাগুলো এখন আর এত নিরক্ষর নয়। বাংলাদেশ শান্তি মিশন এখনো আফ্রিকার অনেক দেশে ভালোভাবে কাজ করছে। বাংলাদেশ শান্তি মিশনের কার্যক্রম জাতিসংঘের কাছ থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছে এবং সৈন্যরা বেশ কয়েকটি সম্মান অর্জন করেছে। শান্তি মিশনে কাজ করতে গিয়ে আমাদের বেশ কয়েকজন সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। বাংলাদেশের নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, লবিস্টরা বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য মার্কিন সরকারকে রাজি করানোর জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোন লবিস্ট অবশ্যই কোন কিছুর জন্য কাজ করে না। বব গুডের সমর্থন এর ঘোষণা অন্য পাঁচজন আইনপ্রণেতার সঙ্গে একটি ভিন্ন সমস্যার দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, শেখ হাসিনার প্রশাসন যেভাবে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে তা জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর। ফলস্বরূপ, এটি স্পষ্ট যে, মানবাধিকার পরিস্থিতি ছাড়াও, তাদের প্রধান উদ্বেগ চীন এবং রাশিয়ার সঙ্গে এই সরকারের দৃঢ় সম্পর্ক। এটা ঠিক, ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মধ্যে সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে ভূ-রাজনীতি পরিবর্তিত হয়েছে। মস্কোর হামলার পর পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনকে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা পুরোপুরি উন্মোচিত হয়েছে। রাশিয়া-চীন এবং পশ্চিমে মার্কিন বন্ধুরা দুটি স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বলয় গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সবসময় ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে ঘৃণা নয়’ পররাষ্ট্রনীতি সমুন্নত রাখতে সচেষ্ট।

র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার পর ছয় জন কংগ্রেসম্যান রাষ্ট্রপতিকে চিঠি লিখে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈন্যদের পরিণতি ভোগ করার অনুরোধ জানান। চিঠিটি যদি সেই স্বার্থান্বেষী মহলের নামে লেখা একটি নিয়মিত চিঠি হয় তবে কাউকে কিছু মন্তব্য বা বোঝাতে দেওয়া হত না। যাই হোক, চিঠিটি ছয়জন মার্কিন কংগ্রেসম্যানের কাছে পাঠানো হয়েছিল, যাদের রাজনৈতিক দক্ষতা এবং বুদ্ধিমত্তা নিঃসন্দেহে অন্তর্নিহিত স্বার্থের নয়। যাইহোক, মনে হচ্ছে যে চিঠিটি অন্তর্নিহিত স্বার্থদ্বারা লেখা হয়েছিল এবং আইনপ্রণেতাদের স্বাক্ষরসহ লবিং সংস্থা দ্বারা রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। যে কোনো বাংলাদেশি যিনি চিঠিটি পড়বেন, তারা ধরে নেবেন যে কংগ্রেসম্যানরা ঘটনার প্রকৃত পটভূমি সম্পর্কে অজ্ঞ। কারণ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বা তার আগেও যে সব সমস্যা ছিল, তার সবই এই চিঠিতে তুলে ধরা হয়েছে। কংগ্রেসম্যানরা এখন তাদের প্রতারণার উৎস প্রকাশ করতে পারেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বিগত সরকারগুলোর অপকর্ম তুলে ধরে নিজেদের সুনাম নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন কংগ্রেসসদস্যরা।

যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বা তার অগ্রদূতরা কিভাবে শেখ হাসিনার সরকারের প্রশংসা করেছেন? তারা নিঃসন্দেহে শেখ হাসিনার ওপর গভীর গবেষণা চালিয়েছে। তবে মার্কিন লবিস্ট থেকে কংগ্রেসম্যান হয়ে ওঠা এই চিঠিতে ঠিক বিপরীত কথা বলা হয়েছে। চিঠির ছয় জন প্রতিনিধি এর আগে কখনো বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করেননি। কংগ্রেসম্যানদের বিভ্রান্ত করার প্রয়াসে এই ধরনের ভুয়ো তথ্য ঢোকানো হয়েছিল।

জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে (ইউএনএইচআরসি) আসন্ন ২০২৩-২০২৫ মেয়াদের জন্য ২০২২ সালের শেষে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছে বাংলাদেশ। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় জয়। বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের কূটনৈতিক প্রভাব রয়েছে এমন একটি পদক্ষেপে ১৬০টি দেশের প্রতিনিধিরা মানবাধিকার কাউন্সিলে যোগ দেওয়ার জন্য দেশটির প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবাধিকারের অগ্রগতি ও সংরক্ষণে বাংলাদেশের চলমান প্রচেষ্টা ও অঙ্গীকারকে সর্বাধিক ভোটে মানবাধিকার কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত করে বিশ্ব সম্প্রদায় স্বীকৃতি দিয়েছে।

বাংলাদেশের এ বিজয় বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে খারাপ দৃষ্টিকোণ থেকে চিত্রিত করার প্রয়াসে কংগ্রেসের সদস্যদের ভুল তথ্য ও প্রচারণা প্রচারের প্রচেষ্টাকে বাতিল করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার স্বস্তি পেয়েছে এবং বিপুল সংখ্যক ভোটে বিজয়ী হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে সম্মানিত হয়েছে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১৮৯টি ভোট দিয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও মালদ্বীপ, ভিয়েতনাম এবং কিরগিজস্তানকে এই অঞ্চল থেকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। ষষ্ঠবারের মতো বাংলাদেশ জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচিত হয়েছে। এর আগে ২০০৬, ২০০৯, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে জাতিসংঘের ৪৭ সদস্যের এই গ্রুপে বাংলাদেশ নির্বাচিত হয়েছিল। রোহিঙ্গা সমস্যাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশাসনের মানবিক প্রচেষ্টার ভূয়সী প্রশংসা করেছে বিশ্ব। মানবাধিকার অপরাধের শিকার ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে, অন্যদিকে অন্যান্য অনেক দেশ মানবাধিকারের পতাকাতলে র‌্যালি করছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অন্যদিকে মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নৃশংসতা ও নিপীড়ন থেকে রক্ষা পাওয়ার পর রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার বিষয়টিও মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। ফলে বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদানে বাংলাদেশের সহানুভূতি জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশাল জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশে মানবাধিকার রক্ষায় অসাধারণ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। ৭৫ বছর বয়সেও জাতিসংঘ শান্তি বজায় রেখেছে।

তারা জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থানের পাশাপাশি এর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাবকে উন্নত করেছে। ১৯৭১ সালে নিপীড়ন ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ জলপাই পাতার বাহক, জাতীয় ও বৈশ্বিক উভয় স্তরে শান্তি ও স্থিতিশীলতা এগিয়ে নিতে কাজ করে যাচ্ছে। গত ২৯ মে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষণাবেক্ষণে কাজ করা বাংলাদেশি সেনাদের ‘সাহস ও নিষ্ঠার’ কথা স্বীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বাহিনীকে শাস্তি দেওয়া অত্যন্ত অযৌক্তিক হবে। বিশ্ব শান্তি ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতায় বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতি, গৌরব ও মর্যাদা সমুন্নত রাখতে বাংলাদেশ সরকার, বিশ্বশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের উচিত বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের সর্বোচ্চ প্রশিক্ষণ সুবিধা প্রদান এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী ফ্রন্টকে শক্তিশালী করতে আরও সহযোগিতামূলকভাবে কাজ করা। নিষেধাজ্ঞার মানসিকতা অবলম্বনের পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র কার্যকর শান্তিরক্ষা মোতায়েন বজায় রাখতে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে পারে এবং অবশ্যই করতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সামরিক মিত্র। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা খাতে আরও বেশি করে একসঙ্গে কাজ করছে। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে নিয়মিত যৌথ মহড়া পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী প্রায়শই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক কমান্ডের সঙ্গে জড়িত। মার্কিন ও দক্ষিণ কোরিয়ার বিশেষ বাহিনীর আদলে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর এলিট এসডব্লিউএডিএস মেরিন ইউনিটও যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় গঠন করা হয়।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম অবদানকারী দেশ। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা মিশনে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন বেশ সুবিধাজনক।

যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা সহায়তার কারণে দুর্যোগ মোকাবেলা ও মানবিক সহায়তায় বাংলাদেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ফাস্ট টহল নৌকা এবং সাবেক মার্কিন কোস্ট গার্ড কাটাররা তাদের ইলেকট্রনিক ও মেকানিক্যাল সিস্টেম আপগ্রেড করেছে, যা আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা ও সীমান্ত নিরাপত্তা মিশন, বাংলাদেশ সামরিক ও কোস্টগার্ড সদস্যদের জন্য কারিগরি ও পেশাগত প্রশিক্ষণ এবং যৌথ সামরিক মহড়ায় ব্যবহৃত হয়েছে। সামুদ্রিক ডোমেইন সম্পর্কে বাংলাদেশের বোঝাপড়া এবং নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর প্রচেষ্টা এই সহায়তা থেকে ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছে।

[লেখক : সিনিয়র গবেষক, সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, টরেন্টো ইউনিভার্সিটি, কানাডা]

শনিবার, ১০ জুন ২০২৩ , ২৭ জৈষ্ঠ্য ১৪৩০, ২০ জিলক্বদ ১৪৪৪

বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব

সাবেরা চৌধুরী

গত ২৫ মে ছয় মার্কিন সিনেটরের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি পিটিশন অনলাইনে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে পাঠানো হয়। সিনেটররা হলেন- কিথ সেলফ, বব গুড, টিম বার্চেট, ব্যারি মুর, ওয়ারেন ডেভিডসন এবং স্কট পেরি। তারা সবাই কংগ্রেসের রিপাবলিকান সদস্য। চিঠির ঘোষণা, যা তাদের উদ্দেশ্যে সম্বোধন করা হয়েছে দীর্ঘ। এটা সম্ভব যে আর্থিক অংশীদার বাংলাদেশ বিরোধী গোষ্ঠীগুলো এই বিবৃতির খসড়া তৈরির জন্য লবিং সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করেছিল। তবে জার্মানির ডয়চে ভেলে এবং সুইডেনের নেত্র নিউজ এই দুটি সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশবিরোধী কুসংস্কারে পরিচালিত একটি বাংলাদেশি সংগঠন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বলে স্বীকৃত।

এর পেছনে কারা রয়েছে তা এখন স্পষ্ট কারণ এই দুটি গোষ্ঠীর নাম সিনেটরদের কাছে চিঠিতে রয়েছে। তাদের বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রের লক্ষ্য ইউটিউবে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে সরকার বিরোধী আন্দোলন প্রচার করা। বিশ্বও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা দেশের সামরিক বাহিনী, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য প্রচার করছে। ফলস্বরূপ, ছয় জন সিনেটর সরকারের কাছে তাদের অভিযোগগুলিতে তাদের কথা তুলে ধরেন এবং নেত্র নিউজ শান্তি মিশনে বাংলাদেশি সেনা সদস্যদের অংশ নেওয়া থেকে বিরত রাখতে রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের আবেদনকে সমর্থন করে।

বলা বাহুল্য, এই ব্যক্তি এবং সংস্থাগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শক্তিশালী লবিস্টদের প্রচুর পরিমাণে অর্থ দিয়ে অর্থায়নের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত। কংগ্রেসম্যানরা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে যে অনুরোধ করেছেন তা হয়তো সেই অর্থ ব্যয় করার পর তাদের সেরা সান্ত¡না নাও হতে পারে! মার্কিন প্রেসিডেন্ট কী করবেন বা করবেন না, কী সিদ্ধান্ত নেবেন এবং কী করবেন না, তা নিয়ে প্রেসিডেন্ট এবং পুরো সরকার উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশের নির্বাচনের এখনো ৬-৭ মাস বাকি। নির্বাচনের ফলাফলের ওপর নির্ভর করে, একক প্রশাসনের বিরুদ্ধে কাজ করা থেকে বিরত থাকা উচিত কিনা তা বিতর্কিত হতে পারে; তবে নির্বাচন এখনো অনেক দূরে।

হয়তো প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং জাতিসংঘের মতো সংস্থাগুলো এখন আর এত নিরক্ষর নয়। বাংলাদেশ শান্তি মিশন এখনো আফ্রিকার অনেক দেশে ভালোভাবে কাজ করছে। বাংলাদেশ শান্তি মিশনের কার্যক্রম জাতিসংঘের কাছ থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছে এবং সৈন্যরা বেশ কয়েকটি সম্মান অর্জন করেছে। শান্তি মিশনে কাজ করতে গিয়ে আমাদের বেশ কয়েকজন সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। বাংলাদেশের নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, লবিস্টরা বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য মার্কিন সরকারকে রাজি করানোর জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোন লবিস্ট অবশ্যই কোন কিছুর জন্য কাজ করে না। বব গুডের সমর্থন এর ঘোষণা অন্য পাঁচজন আইনপ্রণেতার সঙ্গে একটি ভিন্ন সমস্যার দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, শেখ হাসিনার প্রশাসন যেভাবে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে তা জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর। ফলস্বরূপ, এটি স্পষ্ট যে, মানবাধিকার পরিস্থিতি ছাড়াও, তাদের প্রধান উদ্বেগ চীন এবং রাশিয়ার সঙ্গে এই সরকারের দৃঢ় সম্পর্ক। এটা ঠিক, ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মধ্যে সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে ভূ-রাজনীতি পরিবর্তিত হয়েছে। মস্কোর হামলার পর পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনকে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা পুরোপুরি উন্মোচিত হয়েছে। রাশিয়া-চীন এবং পশ্চিমে মার্কিন বন্ধুরা দুটি স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বলয় গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সবসময় ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে ঘৃণা নয়’ পররাষ্ট্রনীতি সমুন্নত রাখতে সচেষ্ট।

র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার পর ছয় জন কংগ্রেসম্যান রাষ্ট্রপতিকে চিঠি লিখে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈন্যদের পরিণতি ভোগ করার অনুরোধ জানান। চিঠিটি যদি সেই স্বার্থান্বেষী মহলের নামে লেখা একটি নিয়মিত চিঠি হয় তবে কাউকে কিছু মন্তব্য বা বোঝাতে দেওয়া হত না। যাই হোক, চিঠিটি ছয়জন মার্কিন কংগ্রেসম্যানের কাছে পাঠানো হয়েছিল, যাদের রাজনৈতিক দক্ষতা এবং বুদ্ধিমত্তা নিঃসন্দেহে অন্তর্নিহিত স্বার্থের নয়। যাইহোক, মনে হচ্ছে যে চিঠিটি অন্তর্নিহিত স্বার্থদ্বারা লেখা হয়েছিল এবং আইনপ্রণেতাদের স্বাক্ষরসহ লবিং সংস্থা দ্বারা রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। যে কোনো বাংলাদেশি যিনি চিঠিটি পড়বেন, তারা ধরে নেবেন যে কংগ্রেসম্যানরা ঘটনার প্রকৃত পটভূমি সম্পর্কে অজ্ঞ। কারণ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বা তার আগেও যে সব সমস্যা ছিল, তার সবই এই চিঠিতে তুলে ধরা হয়েছে। কংগ্রেসম্যানরা এখন তাদের প্রতারণার উৎস প্রকাশ করতে পারেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বিগত সরকারগুলোর অপকর্ম তুলে ধরে নিজেদের সুনাম নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন কংগ্রেসসদস্যরা।

যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বা তার অগ্রদূতরা কিভাবে শেখ হাসিনার সরকারের প্রশংসা করেছেন? তারা নিঃসন্দেহে শেখ হাসিনার ওপর গভীর গবেষণা চালিয়েছে। তবে মার্কিন লবিস্ট থেকে কংগ্রেসম্যান হয়ে ওঠা এই চিঠিতে ঠিক বিপরীত কথা বলা হয়েছে। চিঠির ছয় জন প্রতিনিধি এর আগে কখনো বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করেননি। কংগ্রেসম্যানদের বিভ্রান্ত করার প্রয়াসে এই ধরনের ভুয়ো তথ্য ঢোকানো হয়েছিল।

জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে (ইউএনএইচআরসি) আসন্ন ২০২৩-২০২৫ মেয়াদের জন্য ২০২২ সালের শেষে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছে বাংলাদেশ। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় জয়। বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের কূটনৈতিক প্রভাব রয়েছে এমন একটি পদক্ষেপে ১৬০টি দেশের প্রতিনিধিরা মানবাধিকার কাউন্সিলে যোগ দেওয়ার জন্য দেশটির প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবাধিকারের অগ্রগতি ও সংরক্ষণে বাংলাদেশের চলমান প্রচেষ্টা ও অঙ্গীকারকে সর্বাধিক ভোটে মানবাধিকার কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত করে বিশ্ব সম্প্রদায় স্বীকৃতি দিয়েছে।

বাংলাদেশের এ বিজয় বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে খারাপ দৃষ্টিকোণ থেকে চিত্রিত করার প্রয়াসে কংগ্রেসের সদস্যদের ভুল তথ্য ও প্রচারণা প্রচারের প্রচেষ্টাকে বাতিল করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার স্বস্তি পেয়েছে এবং বিপুল সংখ্যক ভোটে বিজয়ী হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে সম্মানিত হয়েছে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১৮৯টি ভোট দিয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও মালদ্বীপ, ভিয়েতনাম এবং কিরগিজস্তানকে এই অঞ্চল থেকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। ষষ্ঠবারের মতো বাংলাদেশ জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচিত হয়েছে। এর আগে ২০০৬, ২০০৯, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে জাতিসংঘের ৪৭ সদস্যের এই গ্রুপে বাংলাদেশ নির্বাচিত হয়েছিল। রোহিঙ্গা সমস্যাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশাসনের মানবিক প্রচেষ্টার ভূয়সী প্রশংসা করেছে বিশ্ব। মানবাধিকার অপরাধের শিকার ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে, অন্যদিকে অন্যান্য অনেক দেশ মানবাধিকারের পতাকাতলে র‌্যালি করছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অন্যদিকে মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নৃশংসতা ও নিপীড়ন থেকে রক্ষা পাওয়ার পর রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার বিষয়টিও মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। ফলে বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদানে বাংলাদেশের সহানুভূতি জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশাল জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশে মানবাধিকার রক্ষায় অসাধারণ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। ৭৫ বছর বয়সেও জাতিসংঘ শান্তি বজায় রেখেছে।

তারা জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থানের পাশাপাশি এর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাবকে উন্নত করেছে। ১৯৭১ সালে নিপীড়ন ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ জলপাই পাতার বাহক, জাতীয় ও বৈশ্বিক উভয় স্তরে শান্তি ও স্থিতিশীলতা এগিয়ে নিতে কাজ করে যাচ্ছে। গত ২৯ মে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষণাবেক্ষণে কাজ করা বাংলাদেশি সেনাদের ‘সাহস ও নিষ্ঠার’ কথা স্বীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বাহিনীকে শাস্তি দেওয়া অত্যন্ত অযৌক্তিক হবে। বিশ্ব শান্তি ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতায় বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতি, গৌরব ও মর্যাদা সমুন্নত রাখতে বাংলাদেশ সরকার, বিশ্বশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের উচিত বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের সর্বোচ্চ প্রশিক্ষণ সুবিধা প্রদান এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী ফ্রন্টকে শক্তিশালী করতে আরও সহযোগিতামূলকভাবে কাজ করা। নিষেধাজ্ঞার মানসিকতা অবলম্বনের পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র কার্যকর শান্তিরক্ষা মোতায়েন বজায় রাখতে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে পারে এবং অবশ্যই করতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সামরিক মিত্র। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা খাতে আরও বেশি করে একসঙ্গে কাজ করছে। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে নিয়মিত যৌথ মহড়া পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী প্রায়শই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক কমান্ডের সঙ্গে জড়িত। মার্কিন ও দক্ষিণ কোরিয়ার বিশেষ বাহিনীর আদলে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর এলিট এসডব্লিউএডিএস মেরিন ইউনিটও যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় গঠন করা হয়।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম অবদানকারী দেশ। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা মিশনে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন বেশ সুবিধাজনক।

যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা সহায়তার কারণে দুর্যোগ মোকাবেলা ও মানবিক সহায়তায় বাংলাদেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ফাস্ট টহল নৌকা এবং সাবেক মার্কিন কোস্ট গার্ড কাটাররা তাদের ইলেকট্রনিক ও মেকানিক্যাল সিস্টেম আপগ্রেড করেছে, যা আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা ও সীমান্ত নিরাপত্তা মিশন, বাংলাদেশ সামরিক ও কোস্টগার্ড সদস্যদের জন্য কারিগরি ও পেশাগত প্রশিক্ষণ এবং যৌথ সামরিক মহড়ায় ব্যবহৃত হয়েছে। সামুদ্রিক ডোমেইন সম্পর্কে বাংলাদেশের বোঝাপড়া এবং নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর প্রচেষ্টা এই সহায়তা থেকে ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছে।

[লেখক : সিনিয়র গবেষক, সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, টরেন্টো ইউনিভার্সিটি, কানাডা]