দুর্নীতির দৌলতে বিভাজনের রাজনীতি সহজ হয়েছে

গৌতম রায়

ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে থেকেই বিভাজনের রাজনীতিকে হাতিয়ার করে, ক্ষমতা দখলের রাস্তাকে মসৃণ করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখলের পর, সেই বিভাজনের রাজনীতিকে আরো শক্তিশালী করে, কেবলমাত্র নিজের ক্ষমতাকে ধরে রাখা নয়, যে আরএসএসের দৌলতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়ার স্পর্ধা দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন, সেই আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে কেন্দ্রে ক্ষমতা ধরে রাখবার ক্ষেত্রে, সর্বস্তরের বিভাজনের রাস্তাকে আরো বিস্তীর্ণ করাই হলো এখন তার একমাত্র রাজনৈতিক কাজ। আর সেই কাজটিকে নিজের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-পরিজন এবং দলীয় সতীর্থদের ভয়াবহ আর্থিক দুর্নীতির দ্বারা, সাধারণ মানুষের মনে এমন একটা প্রতিক্রিয়া মমতা তৈরি করেছেন, যার ফসল হিসেবে তার এই একদম ব্রিটিশের কায়দায় বিভাজনের রাজনীতির থেকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি সরে গিয়ে দুর্নীতির ক্ষেত্রেই সমস্ত ভাবনাচিন্তা সীমাবদ্ধ হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় ১২ বছর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে রয়েছেন। এই সময়কালে তার ঘনিষ্ঠ বলয়ের লোকজন এবং দলীয় সতীর্থদের প্রায় সর্বস্তরের যে ভয়াবহ দুর্নীতি, তেমন দুর্নীতি পশ্চিমবঙ্গবাসী ৪৭ সালের ক্ষমতা হস্তান্তরের পর থেকে কখনো দেখেনি। কংগ্রেস, যুক্তফ্রন্ট, বামফ্রন্ট- বিভিন্ন পর্যায়ে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় থেকেছে। নানা ধরনের দুর্নীতির সত্য মিথ্যা অভিযোগ এইসব সরকার সম্পর্কে বিরোধীরা তুলেছেন। কিন্তু সরকারের মন্ত্রী-সাংসদসহ, নানা স্তরের নেতা, তাদের বাড়ি থেকে টাকার পাহাড় উদ্ধার হওয়া, তাদের দুহাত পেতে ঘুষ নেওয়া, বিভিন্ন ধরনের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় তাদের কোটি কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ প্রায় আদালত দ্বারা চিহ্নিত হওয়াÑ এমন ছবি কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কোনোদিন দেখেনি।

পশ্চিমবঙ্গের বাইরে যেসব রাজ্যগুলোর দুর্নীতি ঘিরে ভারতে স্বাধীনতার পর থেকে নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে, যেমন বিহারের লালু বা তামিলনাড়ুর জয়ললিতা, এদেরও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-পরিজন বা মন্ত্রী সাংসদদের কাছ থেকে এভাবে টাকার পাহাড় উদ্ধার হওয়ার ধারাবাহিক ছবি, না সে রাজ্যের মানুষ দেখেছেন, না গোটা ভারতের মানুষ দেখেছেন। এসব বিতর্কিত রাজনীতিকদের নানা ধরনের দুর্নীতিকে ছাপিয়ে, মমতার গোটা দলটার দুর্নীতি, আজ এমন একটা জায়গায় গোটা ভারতের মানুষের কাছে পৌঁছেছে, যার ফলে পশ্চিমবঙ্গের মর্যাদা, সম্মান একেবারে ধুলোয় লুটিয়ে গেছে।

পশ্চিমবঙ্গ থেকে যেসব মানুষজনেরা ভারতে বিভিন্ন রাজ্যে কর্মরত রয়েছেন বা ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশে কর্মরত রয়েছেন, তাদের প্রত্যেকের সতীর্থ, বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে যে সমস্ত কথাবার্তা কেবলমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই শাসন কাল সম্বন্ধে শুনতে হচ্ছে, তাতে আর যাই হোক পশ্চিমবঙ্গ বা পশ্চিমবঙ্গবাসীর মর্যাদা এতটুকু বৃদ্ধি পাচ্ছে না।

সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পদ্ধতি ঘিরে দুর্নীতির অভিযোগটা পশ্চিমবঙ্গে এখন এমন একটা জায়গায় পৌঁছে গেছে যে, প্রতিদিনই আমাদের উদ্বিগ্ন থাকতে হয় এই ভেবে, নতুন করে আদালত কি বললেন সে বিষয়ে। দুর্ভাগ্যের বিষয় তৃণমূলের প্রায় সর্বস্তরের নেতা, কর্মী, মন্ত্রীÑ এদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি নতুন অভিযোগ আবার সামনে আসছে। আদালত যে একের পর এক নিয়োগ দুর্নীতিতে তৃণমূলের বিভিন্ন স্তরের নেতা কর্মীদের অভিযুক্ত করছে। গ্রেপ্তার করছে। তাদের বিচার প্রক্রিয়া চলছে।

এই গোটা বিষয়টি ঘিরে বিরোধী বামপন্থীদের পক্ষ থেকে নানা ধরনের আন্দোলন হলেও, শাসক তৃণমূলের পক্ষ থেকে ই গোটা বিষয় টিকেই কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের চক্রান্ত বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষের কাছে এমন একটা ধারণা তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে যাতে, সাধারণ মানুষ মনে করেন, রাজনৈতিক বিদ্বেষ বসতই তৃণমূলের একের পর এক নেতাকর্মী মন্ত্রীদের জেলে পুড়ছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলো।

বামপন্থীরা সমস্ত বিষয়টিকে নিয়েই অত্যন্ত জোরদার আন্দোলন করছে। কিন্তু জোরদার আন্দোলন করলেও একটা কথা বলতেই হয় যে, বামপন্থী আন্দোলনের নেতৃত্বভার মোহাম্মদ সেলিমের হাতে অর্পিত হওয়ার আগে পর্যন্ত, দুর্নীতির ইস্যুতে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের আন্দোলনের ধার এবং ভার এতই কম ছিল যে, সাধারণ মানুষকে, তৃণমূলের এই সীমাহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে সার্বিকভাবে সচেতন করবার কাজটি বামপন্থী আন্দোলনের নতুন ধারা প্রবাহে বহু পরিশ্রম সত্ত্বেও যথেষ্ট কষ্টসাধ্য হচ্ছে।

সাধারণ মানুষের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের অপদার্থতা, দুর্নীতি, চুরি সম্পর্কে গভীর বিতৃষ্ণাকে গত দুই বছরে মোহাম্মাদ সেলিমের নেতৃত্বাধীন আন্দোলন যে জায়গায় পৌঁছে দিতে পেরেছে, সেটা কিন্তু তার আগের সময়কালে ওই দলটি পারেনি। বিশেষ করে এই প্রসঙ্গে বলতে হয়,চিট ফান্ডের দুর্নীতির কথা। চিটফান্ডের দুর্নীতির সঙ্গে কিন্তু অতি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের প্রত্যক্ষ ক্ষতির পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। সেই মানুষদের মধ্যে যেমন উচ্চশিক্ষিত, উচ্চবিত্তের মানুষজনেরা ছিলেন,তেমনি প্রথাগত শিক্ষার সুযোগ না পাওয়া, অত্যন্ত গরিব মানুষের সংখ্যাও ছিল যথেষ্ট। এই মানুষদের নিয়ে আন্দোলন লাগামহীন ভাবে করতে পারলে আজ তৃণমূল কংগ্রেস সাধারণ মানুষের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারত। অথচ দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো এই আন্দোলনগুলো এত মামুলি, এত প্রথাগতভাবে করা হয়েছে, যাতে সাধারণ মানুষের ভেতরে শাসকের নানা ধরনের পাল্টা আঘাত সম্পর্কে ভয় কাটানোর জায়গাটা আদৌ তৈরি হতে পারেনি।

আর এই আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তার একটা বড় অংশ কোনো রকম রাজনীতির সঙ্গে সংযুক্ত ব্যক্তিই নয়। কোন বিশেষ রাজনৈতিক ব্যক্তির অন্তরঙ্গ এমন লোককে দেওয়া হয়েছে চিটফান্ড সাফারারদের আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। এইসব বিভিন্ন ব্যক্তির আদৌ কোনো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছিল না। এভাবেই একটা দিশাহীনতার মধ্যে আন্দোলনকে পরিচালিত করে, চিটফান্ড দুর্নীতির মতো ভয়াবহ দুর্নীতি, যার দ্বারা অত্যন্ত সাধারণ মানুষ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সেই গোটা ব্যাপারটাকেও মানুষের স্মৃতি থেকে হালকা করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

নিয়োগ দুর্নীতি এবং অর্থ তছরূপের ক্ষেত্রে মমতা সরকারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন, সেই আন্দোলনকে এমন একটা জায়গায় বামপন্থীরা এখন নিয়ে যেতে পেরেছে যে, কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের পক্ষেও সম্ভব নয় এসব দুর্নীতি ঘিরে, মমতার সঙ্গে কোনো গোপন বোঝাপড়া করা। এই আন্দোলনকে সিপিআই (এম) এখন এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে, যার দ্বারা আদালতকেও এখন আর কোনো বিষয় সহজে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

আদালতের এই সদা জাগ্রত চক্ষুকে অতি সক্রিয়তা বলে নানাভাবে তৃণমূল শিবির থেকে সমালোচনা করা হচ্ছে। নানাভাবে বাধা দেওয়া হচ্ছে বিচারপতিদের কর্মকা-কে। সরকারি কোষাগারের টাকা দিয়ে, সাধারণ মানুষের টাকা নিয়ে তছরূপ করার বিরুদ্ধে, বিচার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করবার জন্য নানাভাবে উচ্চতর আদালতের মামলা মোকদ্দমা করে অযথা সময়ক্ষেপ করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।

শিক্ষাক্ষেত্রেই নিয়োগ দুর্নীতির পাশাপাশি অতি সম্প্রতি সংযুক্ত হয়েছে পৌরনিগমগুলোতে এবং পৌরসভাগুলোতে পর্বত-প্রমাণ দুর্নীতি। সম্প্রতি কলকাতা শহর সংলগ্ন প্রায় ১৭টি পৌরসভাতে একযোগে সিবিআই তল্লাশি হয়েছে। স্বাধীনতার পর আজ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে এভাবে স্থানীয় সরকারগুলোতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার তল্লাশি ইতিহাস নেই। সম্ভবত ভারতের অন্য কোনো রাজ্যেও এভাবে, একযোগে এতগুলো পৌরসভাতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী দল একদিনে খানা তল্লাশি চালিয়েছে- এমন কোনো নজির নেই।

পৌরসভাগুলিতে সিবিআইয়ের এই তল্লাশির আগে বামপন্থীদের পক্ষ থেকে বারবার অভিযোগ করা হচ্ছিল যে, অদ্ভুত গোপনীয়তার সঙ্গে শাসক দলের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের নথি আগুনে পুড়িয়ে নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। পৌরসভাগুলোতে একযোগে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার অভিযানের পর, বামপন্থীদের, শাসক দলের পক্ষ থেকে নথি নষ্ট করার এ অভিযোগটির গুরুত্ব একটা ভিন্নমাত্রা পেয়েছে।

বহুভাবেই বামপন্থীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছিল, কেবলমাত্র শিক্ষা ক্ষেত্রেই নিয়োগ দুর্নীতি ঘটায় নেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন সরকার বা তার দল। রাজ্য সরকারের প্রায় প্রতিটি দপ্তরের নিয়োগ ঘিরে এখানে ব্যাপক আর্থিক কেলেঙ্কারি রয়েছে বলে বামপন্থীদের অভিযোগ। ঘটনাক্রম যেদিকে যাচ্ছে সেই অভিযোগী ক্রমশ মান্যতা পাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এই রকম একটা পরিস্থিতিতে যে জিনিসটা পশ্চিমবঙ্গের বুকে অত্যন্ত প্রবল হয়ে উঠেছে সেটা হলো ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক বিভাজন। এই দুর্নীতি প্রশ্নে সাধারণ মানুষের মনটাকে এমন ভাবে, একটা দিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল পরিচালিত করে দিয়েছে যে,তার জেরে সম্প্রতি উড়িষ্যার বালাসোরে ঘটে যাওয়া করমন্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা ঘিরে একটা ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক প্রচার চলছে গোটা পশ্চিমবঙ্গজুড়ে। প্রচারটি এইরকম যে, যে স্টেশনের অন্তর্গত জায়গায় ওই মারাত্মক দুর্ঘটনাটি ঘটেছে, সেই স্টেশনের, স্টেশন মাস্টার ছিলেন নাকি একজন মুসলমান এবং তিনি পবিত্র জুম্মা বারে, পবিত্র জুম্মার নামাজ পড়তে যাওয়ার জন্যই অসাবধানতাবশত এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।

দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো এই যে, নোংরা প্রচার, এটা কিন্তু চলছে তৃণমূল আর বিজেপির মধ্যস্থতায় যে তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন রয়েছে, তাদের শিবির থেকেই। বাস্তব ঘটনা হলো, সংশ্লিষ্ট স্টেশনটির, স্টেশন মাস্টার যিনি ছিলেন তিনি একজন উৎকলবাসী অথচ গোটা পশ্চিমবঙ্গজুড়ে নীরবে-নিভৃতে তৃণমূল আর বিজেপি একদম ভূমিস্তরে এই যে স্টেশন মাস্টারের জন্ম পরিচয় ঘিরে অসত্য প্রচার করে চলেছে, সে সম্পর্কে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ পর্যন্ত একটা শব্দ উচ্চারণ করেননি।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

শনিবার, ১০ জুন ২০২৩ , ২৭ জৈষ্ঠ্য ১৪৩০, ২০ জিলক্বদ ১৪৪৪

দুর্নীতির দৌলতে বিভাজনের রাজনীতি সহজ হয়েছে

গৌতম রায়

ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে থেকেই বিভাজনের রাজনীতিকে হাতিয়ার করে, ক্ষমতা দখলের রাস্তাকে মসৃণ করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখলের পর, সেই বিভাজনের রাজনীতিকে আরো শক্তিশালী করে, কেবলমাত্র নিজের ক্ষমতাকে ধরে রাখা নয়, যে আরএসএসের দৌলতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়ার স্পর্ধা দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন, সেই আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে কেন্দ্রে ক্ষমতা ধরে রাখবার ক্ষেত্রে, সর্বস্তরের বিভাজনের রাস্তাকে আরো বিস্তীর্ণ করাই হলো এখন তার একমাত্র রাজনৈতিক কাজ। আর সেই কাজটিকে নিজের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-পরিজন এবং দলীয় সতীর্থদের ভয়াবহ আর্থিক দুর্নীতির দ্বারা, সাধারণ মানুষের মনে এমন একটা প্রতিক্রিয়া মমতা তৈরি করেছেন, যার ফসল হিসেবে তার এই একদম ব্রিটিশের কায়দায় বিভাজনের রাজনীতির থেকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি সরে গিয়ে দুর্নীতির ক্ষেত্রেই সমস্ত ভাবনাচিন্তা সীমাবদ্ধ হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় ১২ বছর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে রয়েছেন। এই সময়কালে তার ঘনিষ্ঠ বলয়ের লোকজন এবং দলীয় সতীর্থদের প্রায় সর্বস্তরের যে ভয়াবহ দুর্নীতি, তেমন দুর্নীতি পশ্চিমবঙ্গবাসী ৪৭ সালের ক্ষমতা হস্তান্তরের পর থেকে কখনো দেখেনি। কংগ্রেস, যুক্তফ্রন্ট, বামফ্রন্ট- বিভিন্ন পর্যায়ে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় থেকেছে। নানা ধরনের দুর্নীতির সত্য মিথ্যা অভিযোগ এইসব সরকার সম্পর্কে বিরোধীরা তুলেছেন। কিন্তু সরকারের মন্ত্রী-সাংসদসহ, নানা স্তরের নেতা, তাদের বাড়ি থেকে টাকার পাহাড় উদ্ধার হওয়া, তাদের দুহাত পেতে ঘুষ নেওয়া, বিভিন্ন ধরনের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় তাদের কোটি কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ প্রায় আদালত দ্বারা চিহ্নিত হওয়াÑ এমন ছবি কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কোনোদিন দেখেনি।

পশ্চিমবঙ্গের বাইরে যেসব রাজ্যগুলোর দুর্নীতি ঘিরে ভারতে স্বাধীনতার পর থেকে নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে, যেমন বিহারের লালু বা তামিলনাড়ুর জয়ললিতা, এদেরও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-পরিজন বা মন্ত্রী সাংসদদের কাছ থেকে এভাবে টাকার পাহাড় উদ্ধার হওয়ার ধারাবাহিক ছবি, না সে রাজ্যের মানুষ দেখেছেন, না গোটা ভারতের মানুষ দেখেছেন। এসব বিতর্কিত রাজনীতিকদের নানা ধরনের দুর্নীতিকে ছাপিয়ে, মমতার গোটা দলটার দুর্নীতি, আজ এমন একটা জায়গায় গোটা ভারতের মানুষের কাছে পৌঁছেছে, যার ফলে পশ্চিমবঙ্গের মর্যাদা, সম্মান একেবারে ধুলোয় লুটিয়ে গেছে।

পশ্চিমবঙ্গ থেকে যেসব মানুষজনেরা ভারতে বিভিন্ন রাজ্যে কর্মরত রয়েছেন বা ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশে কর্মরত রয়েছেন, তাদের প্রত্যেকের সতীর্থ, বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে যে সমস্ত কথাবার্তা কেবলমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই শাসন কাল সম্বন্ধে শুনতে হচ্ছে, তাতে আর যাই হোক পশ্চিমবঙ্গ বা পশ্চিমবঙ্গবাসীর মর্যাদা এতটুকু বৃদ্ধি পাচ্ছে না।

সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পদ্ধতি ঘিরে দুর্নীতির অভিযোগটা পশ্চিমবঙ্গে এখন এমন একটা জায়গায় পৌঁছে গেছে যে, প্রতিদিনই আমাদের উদ্বিগ্ন থাকতে হয় এই ভেবে, নতুন করে আদালত কি বললেন সে বিষয়ে। দুর্ভাগ্যের বিষয় তৃণমূলের প্রায় সর্বস্তরের নেতা, কর্মী, মন্ত্রীÑ এদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি নতুন অভিযোগ আবার সামনে আসছে। আদালত যে একের পর এক নিয়োগ দুর্নীতিতে তৃণমূলের বিভিন্ন স্তরের নেতা কর্মীদের অভিযুক্ত করছে। গ্রেপ্তার করছে। তাদের বিচার প্রক্রিয়া চলছে।

এই গোটা বিষয়টি ঘিরে বিরোধী বামপন্থীদের পক্ষ থেকে নানা ধরনের আন্দোলন হলেও, শাসক তৃণমূলের পক্ষ থেকে ই গোটা বিষয় টিকেই কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের চক্রান্ত বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষের কাছে এমন একটা ধারণা তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে যাতে, সাধারণ মানুষ মনে করেন, রাজনৈতিক বিদ্বেষ বসতই তৃণমূলের একের পর এক নেতাকর্মী মন্ত্রীদের জেলে পুড়ছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলো।

বামপন্থীরা সমস্ত বিষয়টিকে নিয়েই অত্যন্ত জোরদার আন্দোলন করছে। কিন্তু জোরদার আন্দোলন করলেও একটা কথা বলতেই হয় যে, বামপন্থী আন্দোলনের নেতৃত্বভার মোহাম্মদ সেলিমের হাতে অর্পিত হওয়ার আগে পর্যন্ত, দুর্নীতির ইস্যুতে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের আন্দোলনের ধার এবং ভার এতই কম ছিল যে, সাধারণ মানুষকে, তৃণমূলের এই সীমাহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে সার্বিকভাবে সচেতন করবার কাজটি বামপন্থী আন্দোলনের নতুন ধারা প্রবাহে বহু পরিশ্রম সত্ত্বেও যথেষ্ট কষ্টসাধ্য হচ্ছে।

সাধারণ মানুষের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের অপদার্থতা, দুর্নীতি, চুরি সম্পর্কে গভীর বিতৃষ্ণাকে গত দুই বছরে মোহাম্মাদ সেলিমের নেতৃত্বাধীন আন্দোলন যে জায়গায় পৌঁছে দিতে পেরেছে, সেটা কিন্তু তার আগের সময়কালে ওই দলটি পারেনি। বিশেষ করে এই প্রসঙ্গে বলতে হয়,চিট ফান্ডের দুর্নীতির কথা। চিটফান্ডের দুর্নীতির সঙ্গে কিন্তু অতি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের প্রত্যক্ষ ক্ষতির পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। সেই মানুষদের মধ্যে যেমন উচ্চশিক্ষিত, উচ্চবিত্তের মানুষজনেরা ছিলেন,তেমনি প্রথাগত শিক্ষার সুযোগ না পাওয়া, অত্যন্ত গরিব মানুষের সংখ্যাও ছিল যথেষ্ট। এই মানুষদের নিয়ে আন্দোলন লাগামহীন ভাবে করতে পারলে আজ তৃণমূল কংগ্রেস সাধারণ মানুষের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারত। অথচ দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো এই আন্দোলনগুলো এত মামুলি, এত প্রথাগতভাবে করা হয়েছে, যাতে সাধারণ মানুষের ভেতরে শাসকের নানা ধরনের পাল্টা আঘাত সম্পর্কে ভয় কাটানোর জায়গাটা আদৌ তৈরি হতে পারেনি।

আর এই আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তার একটা বড় অংশ কোনো রকম রাজনীতির সঙ্গে সংযুক্ত ব্যক্তিই নয়। কোন বিশেষ রাজনৈতিক ব্যক্তির অন্তরঙ্গ এমন লোককে দেওয়া হয়েছে চিটফান্ড সাফারারদের আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। এইসব বিভিন্ন ব্যক্তির আদৌ কোনো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছিল না। এভাবেই একটা দিশাহীনতার মধ্যে আন্দোলনকে পরিচালিত করে, চিটফান্ড দুর্নীতির মতো ভয়াবহ দুর্নীতি, যার দ্বারা অত্যন্ত সাধারণ মানুষ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সেই গোটা ব্যাপারটাকেও মানুষের স্মৃতি থেকে হালকা করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

নিয়োগ দুর্নীতি এবং অর্থ তছরূপের ক্ষেত্রে মমতা সরকারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন, সেই আন্দোলনকে এমন একটা জায়গায় বামপন্থীরা এখন নিয়ে যেতে পেরেছে যে, কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের পক্ষেও সম্ভব নয় এসব দুর্নীতি ঘিরে, মমতার সঙ্গে কোনো গোপন বোঝাপড়া করা। এই আন্দোলনকে সিপিআই (এম) এখন এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে, যার দ্বারা আদালতকেও এখন আর কোনো বিষয় সহজে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

আদালতের এই সদা জাগ্রত চক্ষুকে অতি সক্রিয়তা বলে নানাভাবে তৃণমূল শিবির থেকে সমালোচনা করা হচ্ছে। নানাভাবে বাধা দেওয়া হচ্ছে বিচারপতিদের কর্মকা-কে। সরকারি কোষাগারের টাকা দিয়ে, সাধারণ মানুষের টাকা নিয়ে তছরূপ করার বিরুদ্ধে, বিচার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করবার জন্য নানাভাবে উচ্চতর আদালতের মামলা মোকদ্দমা করে অযথা সময়ক্ষেপ করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।

শিক্ষাক্ষেত্রেই নিয়োগ দুর্নীতির পাশাপাশি অতি সম্প্রতি সংযুক্ত হয়েছে পৌরনিগমগুলোতে এবং পৌরসভাগুলোতে পর্বত-প্রমাণ দুর্নীতি। সম্প্রতি কলকাতা শহর সংলগ্ন প্রায় ১৭টি পৌরসভাতে একযোগে সিবিআই তল্লাশি হয়েছে। স্বাধীনতার পর আজ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে এভাবে স্থানীয় সরকারগুলোতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার তল্লাশি ইতিহাস নেই। সম্ভবত ভারতের অন্য কোনো রাজ্যেও এভাবে, একযোগে এতগুলো পৌরসভাতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী দল একদিনে খানা তল্লাশি চালিয়েছে- এমন কোনো নজির নেই।

পৌরসভাগুলিতে সিবিআইয়ের এই তল্লাশির আগে বামপন্থীদের পক্ষ থেকে বারবার অভিযোগ করা হচ্ছিল যে, অদ্ভুত গোপনীয়তার সঙ্গে শাসক দলের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের নথি আগুনে পুড়িয়ে নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। পৌরসভাগুলোতে একযোগে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার অভিযানের পর, বামপন্থীদের, শাসক দলের পক্ষ থেকে নথি নষ্ট করার এ অভিযোগটির গুরুত্ব একটা ভিন্নমাত্রা পেয়েছে।

বহুভাবেই বামপন্থীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছিল, কেবলমাত্র শিক্ষা ক্ষেত্রেই নিয়োগ দুর্নীতি ঘটায় নেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন সরকার বা তার দল। রাজ্য সরকারের প্রায় প্রতিটি দপ্তরের নিয়োগ ঘিরে এখানে ব্যাপক আর্থিক কেলেঙ্কারি রয়েছে বলে বামপন্থীদের অভিযোগ। ঘটনাক্রম যেদিকে যাচ্ছে সেই অভিযোগী ক্রমশ মান্যতা পাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এই রকম একটা পরিস্থিতিতে যে জিনিসটা পশ্চিমবঙ্গের বুকে অত্যন্ত প্রবল হয়ে উঠেছে সেটা হলো ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক বিভাজন। এই দুর্নীতি প্রশ্নে সাধারণ মানুষের মনটাকে এমন ভাবে, একটা দিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল পরিচালিত করে দিয়েছে যে,তার জেরে সম্প্রতি উড়িষ্যার বালাসোরে ঘটে যাওয়া করমন্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা ঘিরে একটা ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক প্রচার চলছে গোটা পশ্চিমবঙ্গজুড়ে। প্রচারটি এইরকম যে, যে স্টেশনের অন্তর্গত জায়গায় ওই মারাত্মক দুর্ঘটনাটি ঘটেছে, সেই স্টেশনের, স্টেশন মাস্টার ছিলেন নাকি একজন মুসলমান এবং তিনি পবিত্র জুম্মা বারে, পবিত্র জুম্মার নামাজ পড়তে যাওয়ার জন্যই অসাবধানতাবশত এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।

দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো এই যে, নোংরা প্রচার, এটা কিন্তু চলছে তৃণমূল আর বিজেপির মধ্যস্থতায় যে তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন রয়েছে, তাদের শিবির থেকেই। বাস্তব ঘটনা হলো, সংশ্লিষ্ট স্টেশনটির, স্টেশন মাস্টার যিনি ছিলেন তিনি একজন উৎকলবাসী অথচ গোটা পশ্চিমবঙ্গজুড়ে নীরবে-নিভৃতে তৃণমূল আর বিজেপি একদম ভূমিস্তরে এই যে স্টেশন মাস্টারের জন্ম পরিচয় ঘিরে অসত্য প্রচার করে চলেছে, সে সম্পর্কে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ পর্যন্ত একটা শব্দ উচ্চারণ করেননি।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]