বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হুঁশিয়ারি

বাংলাদেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব বিশ্বের জন্য সতর্কবার্তা

সাম্প্রতিক বছরগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে এ বছর প্রাণঘাতি ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যাচ্ছে। গত এপ্রিল থেকে মশাবাহিত এ রোগে বাংলাদেশে ১ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি আক্রান্ত ও ছয়শরও বেশি মানুষ মারা গেছেন বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। আর ডব্লিওএইচও-এর এক বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, জলবায়ু সংকট এবং আবহাওয়ার অস্বাভাবিক অবস্থা এল নিনোর কারণে বাংলাদেশ ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহ কবলে পড়েছে। এছাড়া জলবায়ু সংকটের প্রভাব কী রকম ভয়াবহ হতে পারে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর মহামারী সেটি দেখিয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। এ বিশেষজ্ঞ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, এটি বিশ্ববাসীর জন্য একটি সতর্কবার্তা।

এদিকে, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৯১ জনে। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৬৮৯ জন। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ্ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ মো. জাহিদুল ইসলামের সই করা ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত বুধবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৬৮৯ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৮৯৯ জন ও ঢাকার বাইরের ১ হাজার ৭৯০ জন। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ৪০ হাজার ৭১১ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৬৪ হাজার ১৬২ জন। ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন ৭৬ হাজার ৫৩৯ জন। একই সময়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন এক লাখ ৩০ হাজার ৩০৯ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৫৯ হাজার ৫২৪ জন এবং ঢাকার বাইরের ৭০ হাজার ৭৮৫ জন।

এর আগে ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ২৮১ জন মারা যান। ওই বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ডেঙ্গুতে ২৭ জনের মৃত্যু হয়। একই সঙ্গে আলোচ্য বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। ২০২০ সালে করোনা মহামারীকালে ডেঙ্গু সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। একই বছর দেশব্যাপী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

আবেদুল মাহামুদ নামের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এ বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি এসব রোগের ভয়াবহ ভার বহন করছে আরও অনেক দেশ। জলবায়ু সংকট এবং বিশ্বব্যাপী শুরু হওয়া এল নিনো জলবায়ু প্যাটার্ন যেটির কারণে উষ্ণ ও শুষ্ক আবহাওয়া দেখা যায় এটি পরিস্থিতি আরও খারাপ করছে।’ ডেঙ্গু পরিস্থিতি যে শুধু বাংলাদেশে খারাপ হয়েছে তা নয়। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরু এই সংকট মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে। ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে বাদ যায়নি যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির ফ্লোরিডার অঙ্গরাজ্যের বেশ কয়েকটি জায়গায় সতর্কতা জারি করা হয়েছে। অন্যদিকে এশিয়ায় বাংলাদেশ ছাড়াও শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ায় ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রকোপ দেখা গেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এ বিশেষজ্ঞ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘এ বিষয়টি জলবায়ু সংকটের ভয়াবহতার একটি আগাম সতর্কতা।’ আর এই সংকট মোকাবিলা করতে বিশ্বের সবার সহযোগিতা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন তিনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান ট্রেডোস আধনম গেব্রেইয়েসুস গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ৬৫০ জনের মধ্যে ৩০০ জনেরেই মৃত্যু হয়েছে আগস্টে।

ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশে প্রতি বছর দেখা যায়, বিশেষ করে বর্ষার মৌসুমে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যায়। কিন্তু এ বছর এপ্রিল থেকেই ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান আরও জানিয়েছেন, ডেঙ্গুর ওপর পর্যবেক্ষণ, ল্যাবের ক্ষমতা বৃদ্ধি, রোগ বিষয়ক ব্যবস্থাপনা, ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ ও স্বাস্থ্যবিষয়ক জরুরি বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে তারা সহায়তা করে আসছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি এবং মাঠ পর্যায়ে বিশেষজ্ঞদের মোতায়েন করেছি। এছাড়া ডেঙ্গু পরীক্ষা এবং রোগীদের সহায়তা করেছি।’ বাংলাদেশে এবার ডেঙ্গুর অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ৬৪ জেলার সবকটিতেই ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে। এরমধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। তবে এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে এবং রোগীর সংখ্যা কমে আসছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান।

মশা মারার দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের একার না : স্থানীয় সরকারমন্ত্রী

এডিস মশা নিধন প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেছেন, মশা মারার দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের একার না। জনগণকে সম্পৃক্ত করে এই কাজ করা হয়। গতকাল বিকেলে সচিবালয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন। তাজুল ইসলাম বলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন চিকিৎসার দায়িত্ব ওনার, কথাটা ওনি ঠিকই বলেছেন। মশা মারার ব্যাপারে আমরা এবং জনগণ, আমরা একা না। নেতৃত্ব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। আমরা জনগণকে সম্পৃক্ত করে এই কাজটা করি এবং করছি। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে উদ্যোগ ও আন্তরিকতার কোথাও ঘাটতি নেই।

তিনি বলেন, মানুষ আক্রান্ত হবে স্বাভাবিকভাবে এবং চিকিৎসা নেবে। চিকিৎসা তো ওনারাই করবেন। আমাদের পক্ষ থেকে মশা নিধনের জন্য আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত আছে। এটা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব যেমন, তেমন এই দায়িত্বটা পালনের জন্য জনসম্পৃক্ততা অপরিহার্য। জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে মশা নিধন কার্যক্রমের সফলতা অর্জন করা যেতে পারে। জনগণ যদি ঢাকা শহরে অংশগ্রহণ না করতো তাহলে ঢাকা শহরে (শনাক্ত রোগী) ২০ লাখ হতো, এটা আমার ধারণা।

সবাই যদি অংশগ্রহণ করে তাহলে (ডেঙ্গু) এটা নির্মূল করা সম্ভব বলেও এ সময় মন্তব্য করেন তিনি। আমরা জনপ্রতিনিধিদের খালি গালি দেবো উল্লেখ করে তিনি বলেন, জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বটা কী আর না করলে তাকে সব সময় জবাবদিহিতার ভেতরে নিয়ে আসা, এ রকম একটা ব্যবস্থা মনে হয় আমাদের করলে, জনপ্রতিনিধিরা কিন্তু সারা পৃথিবীতে দেশের পরিবর্তন করেছে।

স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেন, একজন মেম্বার তিন হাজার লোকের প্রতিনিধিত্ব করে। এখানে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে তার সঙ্গে কাজ করে প্রায় ৩০০-৪০০ লোক, প্রতিটি ওয়ার্ডে। কোন না কোনভাবে করায়। ওরা দুর্যোগ, দুঃসময়, দুর্দিন, বিপদে-আপদে কাজ করে। ওদের জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে আবার কিছু সংখ্যক ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে! আমরা যদি এগুলোকে যেমন কোভিডের সময় ত্রাণ বিতরণ নিয়ে কিছু কিছু অভিযোগ উত্থাপিত হওয়া আরম্ভ হলো, আমি এক দিনে ১২ জন চেয়ারম্যান-মেম্বারকে বরখাস্ত করলাম। এরপর আস্তে আস্তে দেখা যায় এটা ঠিক হয়ে গেছে। পরে দেখা গেল, দশমিক পাঁচ শতাংশের নিচে জনপ্রতিনিধি দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হলেও ৯০ শতাংশের বেশি জনপ্রতিনিধি মানুষের বাড়িতে খাবার পৌঁছে দিয়েছে। মানুষকে হাসপাতালে নিয়েছে। মৃত্যুর পরে সমাধিস্থ করার ব্যবস্থা করেছে। আমরা যখন একটা লোককে শাস্তি দেবো, সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন যে ভালো কাজ করছে তাকে স্বীকৃতি দেবো। তখন যাদের খারাপ মানসিকতা আছে সেখানে পরিবর্তন আসবে।

স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেন, সারা পৃথিবীতেই নিয়ন্ত্রণের একটি পদ্ধতি হলো সব মানুষের অংশগ্রহণ। যেহেতু আমাদের এখানে ডেঙ্গুর মারাত্মক বিস্তার ঘটেছে, সেহেতু অধিকাংশ এডিস মশাই জীবাণু বহন করে। এখন এই মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনগুলো কাজ করছে। জনগণও আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে এসেছে, তাদরে অংশগ্রহণ রয়েছে। কিন্তু যে পরিমাণ অংশগ্রহণ দরকার, আমার মনে হয়, সেটা হচ্ছে না। গত বছর পর্যন্ত রোগটি ঢাকাসহ শহরে এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এবার তা গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, এখন এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ চলছে। বর্ষাকালের পরে এডিস মশা থাকে না, মানে খুবই কম থাকে। পাঁচ থেকে ১০ জন আক্রান্ত হতে পারে মাসে। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আমরা মশা মারার কার্যক্রম চালাই। পৃথিবীতে যত মশা মরার কার্যকর ওষুধ আছে, সেগুলো আমরা স্প্রে করি। আর এমন কীটনাশক স্প্রে করতে পারবো না, যাতে মশা মারতে গিয়ে মানুষ মরে যায়। মন্ত্রী বলেন, আমি যদি বাতাসেই মশাটি মেরে দিই, তাতে সব কীট-পতঙ্গ মরে যাবে। তাতে মানুষের ক্ষতি হবে। আমরা তো এটি করতে পারি না। হয়ত এমন স্প্রে করে দিতে পারবো যে সারা বছর আর মশা আসবে না, কিন্তু মানুষ মরে যাবে। এ ব্যাপারে আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

শুক্রবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ , ২৪ ভাদ্র ১৪৩০, ২২ সফর ১৪৪৫

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হুঁশিয়ারি

বাংলাদেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব বিশ্বের জন্য সতর্কবার্তা

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

সাম্প্রতিক বছরগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে এ বছর প্রাণঘাতি ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যাচ্ছে। গত এপ্রিল থেকে মশাবাহিত এ রোগে বাংলাদেশে ১ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি আক্রান্ত ও ছয়শরও বেশি মানুষ মারা গেছেন বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। আর ডব্লিওএইচও-এর এক বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, জলবায়ু সংকট এবং আবহাওয়ার অস্বাভাবিক অবস্থা এল নিনোর কারণে বাংলাদেশ ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহ কবলে পড়েছে। এছাড়া জলবায়ু সংকটের প্রভাব কী রকম ভয়াবহ হতে পারে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর মহামারী সেটি দেখিয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। এ বিশেষজ্ঞ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, এটি বিশ্ববাসীর জন্য একটি সতর্কবার্তা।

এদিকে, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৯১ জনে। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৬৮৯ জন। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ্ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ মো. জাহিদুল ইসলামের সই করা ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত বুধবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৬৮৯ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৮৯৯ জন ও ঢাকার বাইরের ১ হাজার ৭৯০ জন। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ৪০ হাজার ৭১১ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৬৪ হাজার ১৬২ জন। ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন ৭৬ হাজার ৫৩৯ জন। একই সময়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন এক লাখ ৩০ হাজার ৩০৯ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৫৯ হাজার ৫২৪ জন এবং ঢাকার বাইরের ৭০ হাজার ৭৮৫ জন।

এর আগে ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ২৮১ জন মারা যান। ওই বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ডেঙ্গুতে ২৭ জনের মৃত্যু হয়। একই সঙ্গে আলোচ্য বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। ২০২০ সালে করোনা মহামারীকালে ডেঙ্গু সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। একই বছর দেশব্যাপী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

আবেদুল মাহামুদ নামের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এ বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি এসব রোগের ভয়াবহ ভার বহন করছে আরও অনেক দেশ। জলবায়ু সংকট এবং বিশ্বব্যাপী শুরু হওয়া এল নিনো জলবায়ু প্যাটার্ন যেটির কারণে উষ্ণ ও শুষ্ক আবহাওয়া দেখা যায় এটি পরিস্থিতি আরও খারাপ করছে।’ ডেঙ্গু পরিস্থিতি যে শুধু বাংলাদেশে খারাপ হয়েছে তা নয়। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরু এই সংকট মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে। ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে বাদ যায়নি যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির ফ্লোরিডার অঙ্গরাজ্যের বেশ কয়েকটি জায়গায় সতর্কতা জারি করা হয়েছে। অন্যদিকে এশিয়ায় বাংলাদেশ ছাড়াও শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ায় ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রকোপ দেখা গেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এ বিশেষজ্ঞ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘এ বিষয়টি জলবায়ু সংকটের ভয়াবহতার একটি আগাম সতর্কতা।’ আর এই সংকট মোকাবিলা করতে বিশ্বের সবার সহযোগিতা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন তিনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান ট্রেডোস আধনম গেব্রেইয়েসুস গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ৬৫০ জনের মধ্যে ৩০০ জনেরেই মৃত্যু হয়েছে আগস্টে।

ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশে প্রতি বছর দেখা যায়, বিশেষ করে বর্ষার মৌসুমে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যায়। কিন্তু এ বছর এপ্রিল থেকেই ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান আরও জানিয়েছেন, ডেঙ্গুর ওপর পর্যবেক্ষণ, ল্যাবের ক্ষমতা বৃদ্ধি, রোগ বিষয়ক ব্যবস্থাপনা, ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ ও স্বাস্থ্যবিষয়ক জরুরি বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে তারা সহায়তা করে আসছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি এবং মাঠ পর্যায়ে বিশেষজ্ঞদের মোতায়েন করেছি। এছাড়া ডেঙ্গু পরীক্ষা এবং রোগীদের সহায়তা করেছি।’ বাংলাদেশে এবার ডেঙ্গুর অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ৬৪ জেলার সবকটিতেই ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে। এরমধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। তবে এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে এবং রোগীর সংখ্যা কমে আসছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান।

মশা মারার দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের একার না : স্থানীয় সরকারমন্ত্রী

এডিস মশা নিধন প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেছেন, মশা মারার দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের একার না। জনগণকে সম্পৃক্ত করে এই কাজ করা হয়। গতকাল বিকেলে সচিবালয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন। তাজুল ইসলাম বলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন চিকিৎসার দায়িত্ব ওনার, কথাটা ওনি ঠিকই বলেছেন। মশা মারার ব্যাপারে আমরা এবং জনগণ, আমরা একা না। নেতৃত্ব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। আমরা জনগণকে সম্পৃক্ত করে এই কাজটা করি এবং করছি। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে উদ্যোগ ও আন্তরিকতার কোথাও ঘাটতি নেই।

তিনি বলেন, মানুষ আক্রান্ত হবে স্বাভাবিকভাবে এবং চিকিৎসা নেবে। চিকিৎসা তো ওনারাই করবেন। আমাদের পক্ষ থেকে মশা নিধনের জন্য আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত আছে। এটা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব যেমন, তেমন এই দায়িত্বটা পালনের জন্য জনসম্পৃক্ততা অপরিহার্য। জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে মশা নিধন কার্যক্রমের সফলতা অর্জন করা যেতে পারে। জনগণ যদি ঢাকা শহরে অংশগ্রহণ না করতো তাহলে ঢাকা শহরে (শনাক্ত রোগী) ২০ লাখ হতো, এটা আমার ধারণা।

সবাই যদি অংশগ্রহণ করে তাহলে (ডেঙ্গু) এটা নির্মূল করা সম্ভব বলেও এ সময় মন্তব্য করেন তিনি। আমরা জনপ্রতিনিধিদের খালি গালি দেবো উল্লেখ করে তিনি বলেন, জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বটা কী আর না করলে তাকে সব সময় জবাবদিহিতার ভেতরে নিয়ে আসা, এ রকম একটা ব্যবস্থা মনে হয় আমাদের করলে, জনপ্রতিনিধিরা কিন্তু সারা পৃথিবীতে দেশের পরিবর্তন করেছে।

স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেন, একজন মেম্বার তিন হাজার লোকের প্রতিনিধিত্ব করে। এখানে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে তার সঙ্গে কাজ করে প্রায় ৩০০-৪০০ লোক, প্রতিটি ওয়ার্ডে। কোন না কোনভাবে করায়। ওরা দুর্যোগ, দুঃসময়, দুর্দিন, বিপদে-আপদে কাজ করে। ওদের জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে আবার কিছু সংখ্যক ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে! আমরা যদি এগুলোকে যেমন কোভিডের সময় ত্রাণ বিতরণ নিয়ে কিছু কিছু অভিযোগ উত্থাপিত হওয়া আরম্ভ হলো, আমি এক দিনে ১২ জন চেয়ারম্যান-মেম্বারকে বরখাস্ত করলাম। এরপর আস্তে আস্তে দেখা যায় এটা ঠিক হয়ে গেছে। পরে দেখা গেল, দশমিক পাঁচ শতাংশের নিচে জনপ্রতিনিধি দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হলেও ৯০ শতাংশের বেশি জনপ্রতিনিধি মানুষের বাড়িতে খাবার পৌঁছে দিয়েছে। মানুষকে হাসপাতালে নিয়েছে। মৃত্যুর পরে সমাধিস্থ করার ব্যবস্থা করেছে। আমরা যখন একটা লোককে শাস্তি দেবো, সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন যে ভালো কাজ করছে তাকে স্বীকৃতি দেবো। তখন যাদের খারাপ মানসিকতা আছে সেখানে পরিবর্তন আসবে।

স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বলেন, সারা পৃথিবীতেই নিয়ন্ত্রণের একটি পদ্ধতি হলো সব মানুষের অংশগ্রহণ। যেহেতু আমাদের এখানে ডেঙ্গুর মারাত্মক বিস্তার ঘটেছে, সেহেতু অধিকাংশ এডিস মশাই জীবাণু বহন করে। এখন এই মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনগুলো কাজ করছে। জনগণও আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে এসেছে, তাদরে অংশগ্রহণ রয়েছে। কিন্তু যে পরিমাণ অংশগ্রহণ দরকার, আমার মনে হয়, সেটা হচ্ছে না। গত বছর পর্যন্ত রোগটি ঢাকাসহ শহরে এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এবার তা গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, এখন এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ চলছে। বর্ষাকালের পরে এডিস মশা থাকে না, মানে খুবই কম থাকে। পাঁচ থেকে ১০ জন আক্রান্ত হতে পারে মাসে। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আমরা মশা মারার কার্যক্রম চালাই। পৃথিবীতে যত মশা মরার কার্যকর ওষুধ আছে, সেগুলো আমরা স্প্রে করি। আর এমন কীটনাশক স্প্রে করতে পারবো না, যাতে মশা মারতে গিয়ে মানুষ মরে যায়। মন্ত্রী বলেন, আমি যদি বাতাসেই মশাটি মেরে দিই, তাতে সব কীট-পতঙ্গ মরে যাবে। তাতে মানুষের ক্ষতি হবে। আমরা তো এটি করতে পারি না। হয়ত এমন স্প্রে করে দিতে পারবো যে সারা বছর আর মশা আসবে না, কিন্তু মানুষ মরে যাবে। এ ব্যাপারে আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে।