ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত মরক্কো

এক গ্রামের সবাই মৃত অথবা হাসপাতালে

থামছে না মৃত্যুর মিছিল। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। গতকাল পর্যন্ত ভয়াবহ ভূমিকম্পে দেশটিতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দুই হাজার ১২২ জনে দাঁড়িয়েছে। আহতের সংখ্যাও বেড়ে পৌঁছেছে দুই হাজার ৪২১ জনে। দেশটির যে স্থানে ভূমিকম্পে আঘাত হেনেছে তার আশপাশের অনেক অঞ্চলেই উদ্ধারকারীরা পৌঁছাতে পারেনি।

বিবিসির একজন সাংবাদিক মরক্কোর বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে দেখেছেন। তিনি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মরক্কোর অ্যাটলাস পর্বতমালার তাফেঘাঘতে গ্রামের প্রথম যে বাসিন্দার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়, তিনি তাদের গ্রামের পরিস্থিতির একটা আনুমানিক ধারণা দিচ্ছিলেন আমাদের। তিনি বলেছেন, এই গ্রামের সব মানুষ হয় হাসপাতালে, আর না হয় মৃত। ধুলো-পাথরের ধ্বংসস্তূপ পার করে উপরের দিকে উঠতে উঠতে আমরাও বুঝতে পারছিলাম কেন গ্রামের কেউই নিজেদের রক্ষা করতে পারেনি। ইট ও পাথরের তৈরি গ্রামের পুরনো ধাঁচের বাড়িগুলো কোনোভাবেই এই মাত্রার ভূমিকম্প সামাল দেয়ার মতো অবস্থায় ছিল না। গ্রামের ২০০ জন বাসিন্দার মধ্যে ৯০ জনের মৃত্যুর খবর সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আরও অনেকেই এখনও নিখোঁজ রয়েছেন।

ধ্বংসস্তূপের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা হাসান বলেন, তারা (নিখোঁজরা) সরে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। তাদের হাতে নিজেদের বাঁচানোর সময়ও ছিল না। হাসান বলছিলেন, তার চাচা এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে। তাকে সেখান থেকে বের করার কোনো সম্ভাবনাও নেই। গ্রামে কারো কাছে এই মাত্রার ধ্বংসস্তূপ খোঁড়ার যন্ত্রপাতি নেই। আর তিন দিন হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞরাও এসে পৌঁছায়নি।

তিনি আরও বলেছেন, আল্লাহ আমাদের এই পরিস্থিতির মুখোমুখি করেছেন এবং আমরা সবকিছুর জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু এখন আমাদের সরকারের সহায়তা দরকার। তারা মানুষকে সাহায্য করার বিষয়ে অনেক দেরি করে ফেলেছে।

হাসান বলছিলেন যে মরক্কোর কর্তৃপক্ষের উচিত সব ধরনের আন্তর্জাতিক সহায়তা গ্রহণ করা। কিন্তু তিনি সন্দেহ পোষণ করেন যে নিজেদের অহংকারের কারণে হয়তো তারা সেই সহায়তা নেবে না। গ্রামের আরেক প্রান্তে গিয়ে আমরা দেখতে পাই বেশ কিছু মানুষ এক ব্যক্তিকে সমবেদনা জানাচ্ছেন। আমরা জানতে পারি যে ওই ব্যক্তির নাম আব্দো রহমান। ভূমিকম্পে তার তিন ছেলে ও স্ত্রী মারা গেছে। বালি-পাথরের একটি স্তূপের দিকে নির্দেশ করে তিনি বলছিলেন, আমাদের বাড়ি ছিল ওখানে। একসময় তার বাড়ি থাকলেও এখন সেখানে কোনো বাড়ির চিহ্নও নেই।

‘ওই যে দেখুন সাদা কম্বল ও কিছু আসবাব এখনো দেখা যাচ্ছে। বাকি সব মাটির সাথে মিশে গেছে।’ ভূমিকম্প শুরু হওয়ার পর আব্দো রহমান তিন কিলোমিটার দৌড়ে তার বাড়ির দিকে আসেন। ভূমিকম্পের সময় তিনি যেই পেট্রোল পাম্পে কাজ করেন, সেখানে দায়িত্বরত ছিলেন। তার বাড়ির কাছে এসে চিৎকার করে তার ছেলেদের নাম ধরে ডাকাডাকি করেন। তার মতো আরও কয়েকজনও তখন তাদের পরিবারের সদস্যদের খুঁজছিলেন। গতকাল আমরা তাদের কবর দিয়েছি, বলছিলেন আব্দো রহমান। অ্যাটলাস পর্বতমালার মতো মরক্কোর আরো অনেক অঞ্চলেই জরুরি সেবা পৌঁছাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে দেশটির কর্তৃপক্ষকে। বিভিন্ন এলাকায় গ্রামবাসী হাত দিয়ে বা তাদের কাছে থাকা বেলচা, শাবল দিয়ে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে আটকে পড়া মানুষ উদ্ধার করছেন।

আবার কিছুক্ষণ পর ওই বেলচা আর শাবল দিয়েই মরদেহের জন্য কবরও খুঁড়তে হচ্ছে তাদের। বিবিসিকে এরকম একটি গ্রামের একজন বাসিন্দা বলেন, মানুষের কাছে আর কিছুই বাকি নেই। গ্রামে কোনো খাবার নেই, শিশুরা পানির পিপাসায় কষ্ট পাচ্ছে।

মারাকেশের অন্য এক বাসিন্দা খাদিজা সাতু বলেন, কী ঘটছে তা আমি বোঝার চেষ্টা করছিলাম। যখন সবকিছু কাঁপতে শুরু করলো তখন আমি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তিনি বলেন, প্রথমে আমি ভাবছিলাম আশপাশে কোথা আগুন লেগেছে। তবে ঝাঁকুনি খুবই অস্বাভাবিক লাগছিল। চারপাশে চিৎকারের শব্দ শুনে মনে হলো ভূমিকম্প হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল ফোন ও জুতো ছাড়াই বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েন।

এদিকে মারাকেশ থেকে আলজাজিরার সাংবাদিক জোনাহ হাল জানিয়েছেন, পুরনো শহরের এক কেন্দ্রীয় স্কয়ারে প্রচুর মানুষ দেখা গেছে।

শনিবার এখানেই তাদের রাত কেটেছে। রোববার সকালে তিনি জানিয়েছে, কিছু ভবন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকার কারণে পুলিশ বাসিন্দাদের ঘরে ফিরতে নিষেধ করেছে।

এদিকে ভূমিকম্পে হতাহতের ঘটনায় আগামী ৩ দিন রাষ্ট্রীয় শোক পালন করবে মরক্কো। রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকের পর মরক্কোর রাজা মোহাম্মেদ এই ঘোষণা দিয়েছেন।

রাজার কার্যালয় থেকে দেয়া এ সম্পর্কিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘আগামী ৩ দিন জাতীয় পর্যায়ে শোক পালন করা হবে। এ সময়ে সব সরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে।’

image

ভূমিকম্পে তছনছ হয়ে গেছে মরক্কোর পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে -বিবিসি

আরও খবর
২২ বছর পর নিহত দুজনের পরিচয় শনাক্ত, আজও অজ্ঞাত সহস্রাধিক

মঙ্গলবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ , ২৮ ভাদ্র ১৪৩০, ২৬ সফর ১৪৪৫

ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত মরক্কো

এক গ্রামের সবাই মৃত অথবা হাসপাতালে

image

ভূমিকম্পে তছনছ হয়ে গেছে মরক্কোর পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে -বিবিসি

থামছে না মৃত্যুর মিছিল। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। গতকাল পর্যন্ত ভয়াবহ ভূমিকম্পে দেশটিতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দুই হাজার ১২২ জনে দাঁড়িয়েছে। আহতের সংখ্যাও বেড়ে পৌঁছেছে দুই হাজার ৪২১ জনে। দেশটির যে স্থানে ভূমিকম্পে আঘাত হেনেছে তার আশপাশের অনেক অঞ্চলেই উদ্ধারকারীরা পৌঁছাতে পারেনি।

বিবিসির একজন সাংবাদিক মরক্কোর বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে দেখেছেন। তিনি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মরক্কোর অ্যাটলাস পর্বতমালার তাফেঘাঘতে গ্রামের প্রথম যে বাসিন্দার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়, তিনি তাদের গ্রামের পরিস্থিতির একটা আনুমানিক ধারণা দিচ্ছিলেন আমাদের। তিনি বলেছেন, এই গ্রামের সব মানুষ হয় হাসপাতালে, আর না হয় মৃত। ধুলো-পাথরের ধ্বংসস্তূপ পার করে উপরের দিকে উঠতে উঠতে আমরাও বুঝতে পারছিলাম কেন গ্রামের কেউই নিজেদের রক্ষা করতে পারেনি। ইট ও পাথরের তৈরি গ্রামের পুরনো ধাঁচের বাড়িগুলো কোনোভাবেই এই মাত্রার ভূমিকম্প সামাল দেয়ার মতো অবস্থায় ছিল না। গ্রামের ২০০ জন বাসিন্দার মধ্যে ৯০ জনের মৃত্যুর খবর সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আরও অনেকেই এখনও নিখোঁজ রয়েছেন।

ধ্বংসস্তূপের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা হাসান বলেন, তারা (নিখোঁজরা) সরে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। তাদের হাতে নিজেদের বাঁচানোর সময়ও ছিল না। হাসান বলছিলেন, তার চাচা এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে। তাকে সেখান থেকে বের করার কোনো সম্ভাবনাও নেই। গ্রামে কারো কাছে এই মাত্রার ধ্বংসস্তূপ খোঁড়ার যন্ত্রপাতি নেই। আর তিন দিন হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞরাও এসে পৌঁছায়নি।

তিনি আরও বলেছেন, আল্লাহ আমাদের এই পরিস্থিতির মুখোমুখি করেছেন এবং আমরা সবকিছুর জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু এখন আমাদের সরকারের সহায়তা দরকার। তারা মানুষকে সাহায্য করার বিষয়ে অনেক দেরি করে ফেলেছে।

হাসান বলছিলেন যে মরক্কোর কর্তৃপক্ষের উচিত সব ধরনের আন্তর্জাতিক সহায়তা গ্রহণ করা। কিন্তু তিনি সন্দেহ পোষণ করেন যে নিজেদের অহংকারের কারণে হয়তো তারা সেই সহায়তা নেবে না। গ্রামের আরেক প্রান্তে গিয়ে আমরা দেখতে পাই বেশ কিছু মানুষ এক ব্যক্তিকে সমবেদনা জানাচ্ছেন। আমরা জানতে পারি যে ওই ব্যক্তির নাম আব্দো রহমান। ভূমিকম্পে তার তিন ছেলে ও স্ত্রী মারা গেছে। বালি-পাথরের একটি স্তূপের দিকে নির্দেশ করে তিনি বলছিলেন, আমাদের বাড়ি ছিল ওখানে। একসময় তার বাড়ি থাকলেও এখন সেখানে কোনো বাড়ির চিহ্নও নেই।

‘ওই যে দেখুন সাদা কম্বল ও কিছু আসবাব এখনো দেখা যাচ্ছে। বাকি সব মাটির সাথে মিশে গেছে।’ ভূমিকম্প শুরু হওয়ার পর আব্দো রহমান তিন কিলোমিটার দৌড়ে তার বাড়ির দিকে আসেন। ভূমিকম্পের সময় তিনি যেই পেট্রোল পাম্পে কাজ করেন, সেখানে দায়িত্বরত ছিলেন। তার বাড়ির কাছে এসে চিৎকার করে তার ছেলেদের নাম ধরে ডাকাডাকি করেন। তার মতো আরও কয়েকজনও তখন তাদের পরিবারের সদস্যদের খুঁজছিলেন। গতকাল আমরা তাদের কবর দিয়েছি, বলছিলেন আব্দো রহমান। অ্যাটলাস পর্বতমালার মতো মরক্কোর আরো অনেক অঞ্চলেই জরুরি সেবা পৌঁছাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে দেশটির কর্তৃপক্ষকে। বিভিন্ন এলাকায় গ্রামবাসী হাত দিয়ে বা তাদের কাছে থাকা বেলচা, শাবল দিয়ে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে আটকে পড়া মানুষ উদ্ধার করছেন।

আবার কিছুক্ষণ পর ওই বেলচা আর শাবল দিয়েই মরদেহের জন্য কবরও খুঁড়তে হচ্ছে তাদের। বিবিসিকে এরকম একটি গ্রামের একজন বাসিন্দা বলেন, মানুষের কাছে আর কিছুই বাকি নেই। গ্রামে কোনো খাবার নেই, শিশুরা পানির পিপাসায় কষ্ট পাচ্ছে।

মারাকেশের অন্য এক বাসিন্দা খাদিজা সাতু বলেন, কী ঘটছে তা আমি বোঝার চেষ্টা করছিলাম। যখন সবকিছু কাঁপতে শুরু করলো তখন আমি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তিনি বলেন, প্রথমে আমি ভাবছিলাম আশপাশে কোথা আগুন লেগেছে। তবে ঝাঁকুনি খুবই অস্বাভাবিক লাগছিল। চারপাশে চিৎকারের শব্দ শুনে মনে হলো ভূমিকম্প হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল ফোন ও জুতো ছাড়াই বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েন।

এদিকে মারাকেশ থেকে আলজাজিরার সাংবাদিক জোনাহ হাল জানিয়েছেন, পুরনো শহরের এক কেন্দ্রীয় স্কয়ারে প্রচুর মানুষ দেখা গেছে।

শনিবার এখানেই তাদের রাত কেটেছে। রোববার সকালে তিনি জানিয়েছে, কিছু ভবন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকার কারণে পুলিশ বাসিন্দাদের ঘরে ফিরতে নিষেধ করেছে।

এদিকে ভূমিকম্পে হতাহতের ঘটনায় আগামী ৩ দিন রাষ্ট্রীয় শোক পালন করবে মরক্কো। রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকের পর মরক্কোর রাজা মোহাম্মেদ এই ঘোষণা দিয়েছেন।

রাজার কার্যালয় থেকে দেয়া এ সম্পর্কিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘আগামী ৩ দিন জাতীয় পর্যায়ে শোক পালন করা হবে। এ সময়ে সব সরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে।’