বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতিপত্তি বাড়ানোর লড়াইয়ে ফ্রান্স নিজেকে এশিয়া অঞ্চলে একটি বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর ঢাকা সফর এই কৌশল বাস্তবায়নের অংশ বলেই আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে আভাস দেয়া হয়েছে।
আর মাখোঁ তার ঢাকা সফরের সময় বলেছেন, এই অঞ্চলে ‘নতুন সাম্রাজ্যবাদী’ শক্তির উত্থানে তার দেশ ‘তৃতীয় পথ’ প্রস্তাব করছে। রয়টার্স এবং আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তিনি এ প্রস্তাব দিয়েছেন।
তিনি এও বলেছেন, তারা যে প্রস্তাব করছেন সেখানে তারা কখনও ‘খবরদারী’ করবেন না। অন্য দেশের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় ‘হস্তক্ষেপ’ করবেন না। বাংলাদেশ সফরের আগে মাখোঁ মঙ্গোলিয়া, পাপুয়া নিউগিনি এবং শ্রীলঙ্কা সফর করেছেন। ফ্রান্স ২০১৮ সালে প্রথম ইউরোপীয় দেশ হিসেবে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল গ্রহণ করে ‘তৃতীয় পথ’ গ্রহণের প্রস্তাব করেছে।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর দু’দিনের বাংলাদেশ সফরে দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে বোঝাপড়া আরও গভীর হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দিক দিয়ে ইউরোপের প্রভাবশালী দেশ হিসেবে ফ্রান্সের সঙ্গে আগে সম্পর্কের গভীরে যাওয়ার সুযোগ পায়নি বাংলাদেশ। শীর্ষ বৈঠকের পর যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ শান্তি, সমৃদ্ধি এবং জনগণের কল্যাণে দুই দেশের অংশীদারিত্বকে ‘কৌশলগত’ পর্যায়ে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, চলমান ভূরাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সার্বভৌমনীতি, স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা ও সমর্থন প্রকাশ করেছে ফ্রান্স। রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার জবাবদিহি নিশ্চিতের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার সমর্থনে ফ্রান্স আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মায়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার গণহত্যা মামলায় অন্য অংশীদারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজ ফ্রান্স ও বাংলাদেশের মধ্যে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের একটি ঐতিহাসিক দিন, যা পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে বিকশিত হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, গত দেড় দশকে বাংলাদেশে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা, উন্নয়ন ও সুশাসনের ওপর ভিত্তি করে এই নতুন সম্পর্কের ভিত রচিত হয়। মাখোঁ ও শেখ হাসিনা বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা এবং কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের সমর্থনে একটি আস্থাশীল ও অর্থপূর্ণ অংশীদারত্ব গড়ে তোলার অভিন্ন প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাশে থাকার যে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছে তাও বাংলাদেশকে অনেকটা আশ্বস্ত করেছে। মাখোঁর বাংলাদেশ সফরে বাংলাদেশ আস্থার স্বস্তি লাভ করলেও এ সফরে ফ্রান্সের বাণিজ্যিক অর্জন বেশি। অনেক দিন ধরেই ফ্রান্সের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের কাছে বিমান, স্যাটলাইট প্রযুক্তি এবং সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করার, সে লক্ষ্যও এবার অনেকটা পূরণ হয়েছে। বাংলাদেশের কাছে এয়ারবাস বিমান বিক্রির সম্মতি এবং স্যাটলাইট স্টেশন স্থাপনের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ফ্রান্স। সামরিক সরঞ্জাম বিক্রয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনাও হয়েছে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের। এর মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করার সুযোগ পেল ফ্রান্স। এজন্য মাখোঁ বাংলাদেশকে ধন্যবাদও জানিয়েছে। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে বলেছেন, ‘ইউরোপীয় অ্যারোনটিকসে (বিমানকৌশল) আস্থা রাখার জন্য এবং ১০টি এ-৩৫২ নেয়ার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেয়ার জন্য আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই।’ দুই দেশ বাংলাদেশের সব বিমানবন্দরে উন্নত উড়োজাহাজ চলাচল ব্যবস্থাপনায় অব্যাহত সহযোগিতার গুরুত্বের ওপরও জোর দিয়েছে। এসব প্রযুক্তি কেনা হবে ফ্রান্স থেকেই। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বহরে ২০টির বেশি উড়োজাহাজ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কোম্পানির তৈরি। ইউরোপের উড়োজাহাজ নির্মাণকারী এয়ারবাসের সঙ্গে এটাই হবে বাংলাদেশের প্রথম চুক্তি। মাখোঁর সফরের আগে ঢাকায় ফরাসি দূতাবাস তাদের ফেইসবুক পাতায় বলেছে, প্রেসিডেন্টের এই সফরে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রকল্প এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা এগিয়ে নেয়ার বিষয়ে ভূমিকা রাখবে বলে যে বক্তব্য দিয়েছিল বাস্তবে তাই হয়েছে।
এটি বাংলাদেশে মাখোঁর প্রথম ও কোন ফরাসি প্রেসিডেন্টের দ্বিতীয় সফর। এর আগে ১৯৯০ সালের ২০ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট মিতেরো বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। ১৯৯০ সালের শুরুর দিক থেকে দুদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক অনেক দূর এগিয়েছে। বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে মোট বাণিজ্য ২১০ মিলিয়ন ইউরো থেকে বর্তমানে ৪.৯ বিলিয়ন ইউরোতে উন্নীত হয়েছে এবং রপ্তানির ক্ষেত্রে ফ্রান্স হচ্ছে ৫ম দেশ। ফরাসি কোম্পানিগুলো এখন প্রকৌশল, জ্বালানি, মহাকাশ ও পানিসহ বিভিন্ন খাতে সম্পৃক্ত।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর আমন্ত্রণে ২০২১ সালের নভেম্বরে ফ্রান্স সফর করেন। ২০২১ সালে শেখ হাসিনার ফ্রান্স সফরের সময়ে একটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সমঝোতা পত্রে স্বাক্ষর করেছিল বাংলাদেশ ও ফ্রান্স। ফ্রান্স অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করতে আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে। এবারের সফরে সে প্রত্যাশা অনেকটাই পূরণ হয়েছে ফ্রান্সের।
ভারতের নয়াদিল্লীতে জি-২০ সম্মেলনে যোগদানের পর মাখোঁ দুই দিনের এক সরকারি সফরে গত রোববার সন্ধ্যায় ঢাকায় পৌঁছেন। গত সোমবার তিনি দেশে ফিরে যান।
এয়ারবাস কোম্পানির উড়োজাহাজ বাংলাদেশে বিমান পরিবহন খাতে যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িংয়ের আধিপত্য কমাতে ফলপ্রসু হবে। বাংলাদেশে বিমান বহর শুধু একটি কোম্পানির কাছ থেকে বিমান কেনা থেকে সরে আসা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
গত কিছুদিন ধরে কৌশলগত ভাবে ভারত মহাসাগরকে ঘিরে ইঙ্গ-মার্কিনসহ একাধিক পরাশক্তির ‘এক ধরনের’ প্রতিযোগিতা চলছে। এ অঞ্চলকে নিজেদের আধিপত্যে রাখার একটি প্রচেষ্টা বিভিন্নভাবে প্রকাশমান। এক্ষেত্রে এতদিন এক সময়ের ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্স ছিল কিছুটা দূরে এবং ভিন্ন অবস্থানে। কিন্তু এ অঞ্চলকে ঘিরে ফ্রান্সের আলাদা কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে এবং এ অঞ্চলে দেশটির সামরিক উপস্থিতিও আছে। সে অবস্থানকে আরও সংহত করতে এবং নিজের স্বার্থের সঙ্গে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও নিবিড় করার দিতে মনোনিবেশ করতে চায় ফ্রান্স। এবার এমানুয়েল মাখোঁর সফরে এ বিষয়টি অনেকের দৃষ্টি কেড়েছে।
আরেকটি বিষয় এখানে প্রনিধানযোগ্য যে, ইউরোপের এক সময়ে পরাশক্তি এবং বাণিজ্যিক টাইকুন ফ্রান্সের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে রাজনীতি এবং সরকারের মন্ত্রীরা যেমন তেমনি ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও ব্যবসা ও ভূ-কৌশলগত বিষয়ে সবসময় বিশেষ দৃষ্টি দিয়ে থাকে। মাখোঁ তারই প্রতিনিধিত্ব করেন। ব্যবসার জন্য ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সরাসরি ভূমিকা রেখে থাকেন বলে প্রচলিত আছে। এবারের সফরে মাখোঁ যেভাবে বাণিজ্যিক বিষয়ে কথাবার্তা বলেছেন, তৎপরতা দেখিয়েছেন তা তার দেশের চিরাচরিত অবস্থান থেকেই করেছেন। এ বিষয়টিও দৃশ্যমান হয়েছে তার বাংলাদেশ সফরে।
আশা করা হচ্ছে ২০৪০ সালের মধ্যে বিশ্বের বড় ২২টি অর্থনীতির একটি হবে বাংলাদেশ। সঙ্গত কারণেই ফ্রান্স প্রযুক্তি ও ব্যবসার নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
বুধবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ , ২৯ ভাদ্র ১৪৩০, ২৭ সফর ১৪৪৫
কূটনৈতিক বার্তা পরিবেশক
বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতিপত্তি বাড়ানোর লড়াইয়ে ফ্রান্স নিজেকে এশিয়া অঞ্চলে একটি বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর ঢাকা সফর এই কৌশল বাস্তবায়নের অংশ বলেই আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে আভাস দেয়া হয়েছে।
আর মাখোঁ তার ঢাকা সফরের সময় বলেছেন, এই অঞ্চলে ‘নতুন সাম্রাজ্যবাদী’ শক্তির উত্থানে তার দেশ ‘তৃতীয় পথ’ প্রস্তাব করছে। রয়টার্স এবং আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তিনি এ প্রস্তাব দিয়েছেন।
তিনি এও বলেছেন, তারা যে প্রস্তাব করছেন সেখানে তারা কখনও ‘খবরদারী’ করবেন না। অন্য দেশের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় ‘হস্তক্ষেপ’ করবেন না। বাংলাদেশ সফরের আগে মাখোঁ মঙ্গোলিয়া, পাপুয়া নিউগিনি এবং শ্রীলঙ্কা সফর করেছেন। ফ্রান্স ২০১৮ সালে প্রথম ইউরোপীয় দেশ হিসেবে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল গ্রহণ করে ‘তৃতীয় পথ’ গ্রহণের প্রস্তাব করেছে।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর দু’দিনের বাংলাদেশ সফরে দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে বোঝাপড়া আরও গভীর হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দিক দিয়ে ইউরোপের প্রভাবশালী দেশ হিসেবে ফ্রান্সের সঙ্গে আগে সম্পর্কের গভীরে যাওয়ার সুযোগ পায়নি বাংলাদেশ। শীর্ষ বৈঠকের পর যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ শান্তি, সমৃদ্ধি এবং জনগণের কল্যাণে দুই দেশের অংশীদারিত্বকে ‘কৌশলগত’ পর্যায়ে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, চলমান ভূরাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সার্বভৌমনীতি, স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা ও সমর্থন প্রকাশ করেছে ফ্রান্স। রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার জবাবদিহি নিশ্চিতের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার সমর্থনে ফ্রান্স আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মায়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার গণহত্যা মামলায় অন্য অংশীদারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজ ফ্রান্স ও বাংলাদেশের মধ্যে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের একটি ঐতিহাসিক দিন, যা পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে বিকশিত হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, গত দেড় দশকে বাংলাদেশে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা, উন্নয়ন ও সুশাসনের ওপর ভিত্তি করে এই নতুন সম্পর্কের ভিত রচিত হয়। মাখোঁ ও শেখ হাসিনা বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা এবং কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের সমর্থনে একটি আস্থাশীল ও অর্থপূর্ণ অংশীদারত্ব গড়ে তোলার অভিন্ন প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাশে থাকার যে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছে তাও বাংলাদেশকে অনেকটা আশ্বস্ত করেছে। মাখোঁর বাংলাদেশ সফরে বাংলাদেশ আস্থার স্বস্তি লাভ করলেও এ সফরে ফ্রান্সের বাণিজ্যিক অর্জন বেশি। অনেক দিন ধরেই ফ্রান্সের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের কাছে বিমান, স্যাটলাইট প্রযুক্তি এবং সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করার, সে লক্ষ্যও এবার অনেকটা পূরণ হয়েছে। বাংলাদেশের কাছে এয়ারবাস বিমান বিক্রির সম্মতি এবং স্যাটলাইট স্টেশন স্থাপনের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ফ্রান্স। সামরিক সরঞ্জাম বিক্রয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনাও হয়েছে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের। এর মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করার সুযোগ পেল ফ্রান্স। এজন্য মাখোঁ বাংলাদেশকে ধন্যবাদও জানিয়েছে। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে বলেছেন, ‘ইউরোপীয় অ্যারোনটিকসে (বিমানকৌশল) আস্থা রাখার জন্য এবং ১০টি এ-৩৫২ নেয়ার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেয়ার জন্য আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই।’ দুই দেশ বাংলাদেশের সব বিমানবন্দরে উন্নত উড়োজাহাজ চলাচল ব্যবস্থাপনায় অব্যাহত সহযোগিতার গুরুত্বের ওপরও জোর দিয়েছে। এসব প্রযুক্তি কেনা হবে ফ্রান্স থেকেই। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বহরে ২০টির বেশি উড়োজাহাজ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কোম্পানির তৈরি। ইউরোপের উড়োজাহাজ নির্মাণকারী এয়ারবাসের সঙ্গে এটাই হবে বাংলাদেশের প্রথম চুক্তি। মাখোঁর সফরের আগে ঢাকায় ফরাসি দূতাবাস তাদের ফেইসবুক পাতায় বলেছে, প্রেসিডেন্টের এই সফরে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রকল্প এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা এগিয়ে নেয়ার বিষয়ে ভূমিকা রাখবে বলে যে বক্তব্য দিয়েছিল বাস্তবে তাই হয়েছে।
এটি বাংলাদেশে মাখোঁর প্রথম ও কোন ফরাসি প্রেসিডেন্টের দ্বিতীয় সফর। এর আগে ১৯৯০ সালের ২০ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট মিতেরো বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। ১৯৯০ সালের শুরুর দিক থেকে দুদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক অনেক দূর এগিয়েছে। বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে মোট বাণিজ্য ২১০ মিলিয়ন ইউরো থেকে বর্তমানে ৪.৯ বিলিয়ন ইউরোতে উন্নীত হয়েছে এবং রপ্তানির ক্ষেত্রে ফ্রান্স হচ্ছে ৫ম দেশ। ফরাসি কোম্পানিগুলো এখন প্রকৌশল, জ্বালানি, মহাকাশ ও পানিসহ বিভিন্ন খাতে সম্পৃক্ত।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর আমন্ত্রণে ২০২১ সালের নভেম্বরে ফ্রান্স সফর করেন। ২০২১ সালে শেখ হাসিনার ফ্রান্স সফরের সময়ে একটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সমঝোতা পত্রে স্বাক্ষর করেছিল বাংলাদেশ ও ফ্রান্স। ফ্রান্স অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করতে আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে। এবারের সফরে সে প্রত্যাশা অনেকটাই পূরণ হয়েছে ফ্রান্সের।
ভারতের নয়াদিল্লীতে জি-২০ সম্মেলনে যোগদানের পর মাখোঁ দুই দিনের এক সরকারি সফরে গত রোববার সন্ধ্যায় ঢাকায় পৌঁছেন। গত সোমবার তিনি দেশে ফিরে যান।
এয়ারবাস কোম্পানির উড়োজাহাজ বাংলাদেশে বিমান পরিবহন খাতে যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িংয়ের আধিপত্য কমাতে ফলপ্রসু হবে। বাংলাদেশে বিমান বহর শুধু একটি কোম্পানির কাছ থেকে বিমান কেনা থেকে সরে আসা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
গত কিছুদিন ধরে কৌশলগত ভাবে ভারত মহাসাগরকে ঘিরে ইঙ্গ-মার্কিনসহ একাধিক পরাশক্তির ‘এক ধরনের’ প্রতিযোগিতা চলছে। এ অঞ্চলকে নিজেদের আধিপত্যে রাখার একটি প্রচেষ্টা বিভিন্নভাবে প্রকাশমান। এক্ষেত্রে এতদিন এক সময়ের ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্স ছিল কিছুটা দূরে এবং ভিন্ন অবস্থানে। কিন্তু এ অঞ্চলকে ঘিরে ফ্রান্সের আলাদা কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে এবং এ অঞ্চলে দেশটির সামরিক উপস্থিতিও আছে। সে অবস্থানকে আরও সংহত করতে এবং নিজের স্বার্থের সঙ্গে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও নিবিড় করার দিতে মনোনিবেশ করতে চায় ফ্রান্স। এবার এমানুয়েল মাখোঁর সফরে এ বিষয়টি অনেকের দৃষ্টি কেড়েছে।
আরেকটি বিষয় এখানে প্রনিধানযোগ্য যে, ইউরোপের এক সময়ে পরাশক্তি এবং বাণিজ্যিক টাইকুন ফ্রান্সের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে রাজনীতি এবং সরকারের মন্ত্রীরা যেমন তেমনি ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও ব্যবসা ও ভূ-কৌশলগত বিষয়ে সবসময় বিশেষ দৃষ্টি দিয়ে থাকে। মাখোঁ তারই প্রতিনিধিত্ব করেন। ব্যবসার জন্য ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সরাসরি ভূমিকা রেখে থাকেন বলে প্রচলিত আছে। এবারের সফরে মাখোঁ যেভাবে বাণিজ্যিক বিষয়ে কথাবার্তা বলেছেন, তৎপরতা দেখিয়েছেন তা তার দেশের চিরাচরিত অবস্থান থেকেই করেছেন। এ বিষয়টিও দৃশ্যমান হয়েছে তার বাংলাদেশ সফরে।
আশা করা হচ্ছে ২০৪০ সালের মধ্যে বিশ্বের বড় ২২টি অর্থনীতির একটি হবে বাংলাদেশ। সঙ্গত কারণেই ফ্রান্স প্রযুক্তি ও ব্যবসার নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।