স্বামীর বিরুদ্ধে একই অভিযোগ সানজিদারও
ছাত্রলীগ নেতাদের পেটানোর ঘটনায় সাময়িক বরখাস্ত ডিএমপির রমনা বিভাগের এডিসি হারুন অর রশিদের ওপর প্রথমে হামলা হয়েছে। এ হামলার নেতৃত্বে ছিলেন রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ও পুলিশ কর্মকর্তা সানজিদা আফরিন নিপার স্বামী আজিজুল হক মামুন। এডিসি হারুনের সঙ্গে সানজিদাকে দেখেই রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হারুনের গায়ে হাত তোলেন। এরপর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন নাইম ও বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক.... হারুনকে মারপিট করেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ গতকাল ডিবি কার্যালয়ে এমন দাবি করেন। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দেন যাকে ঘিরে এত সব ঘটনা সেই নারী পুলিশ কর্মকর্তা সানজিদা আফরিন নিপাও।
চ্যানেল আইয়ের ইউটিউব নিউজে সানজিদা এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এডিসি হারুন স্যারকে মেরেছিলেন আমার স্বামী।
এদিকে গতকাল পুলিশের নির্যাতনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আনোয়ার হোসেন নাঈমকে দেখতে যান ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। এ সময় থানায় ছাত্রলীগ নেতাদের মারপিটের ঘটনায় তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। এ ঘটনাকে বেআইনি বলে আখ্যা দেন তিনি। অন্যদিকে ছাত্রলীগ নেতাদের মারপিটে যুক্ত থাকার অভিযোগে শাহবাগ থানার ওসি (তদন্ত) মোস্তাফিজুর রহমানকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ডিএমপি কমিশনারের আদেশে তাকে প্রত্যাহার করা হয়।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, ছাত্রলীগের ৩ নেতা কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন নাঈম, বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক মামুনের গায়ে হাত তোলার নেপথ্যে ছিল হারুনের ক্রোধ। হাসপাতালে তাকে গায়ে স্বজোরে চর থাপ্পড় দেয়ার পাশাপাশি কিলঘুসিও দেয়া হয়। শুরুটা করেন রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক মামুন। তার সঙ্গে ছাত্রলীগের ওই দুই নেতারাও হারুনকে কিলঘুসি দেন। যে কারণে সবাইকে থানায় এনে বেধড়ক মারপিট করা হয়।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছে, তবে পুলিশের গায়ে হাত দেয়ার ঘটনার নেপথ্যে যেহেতু ব্যক্তিগত বিষয় ছিল। সেহেতু আইনিভাবে ব্যবস্থা না নিয়ে মারপিট করা এবং দাঁত তুলে ফেলার বিষয়টি অতি বাড়াবাড়ি ছিল এডিসি হারুনের। আগ থেকে বেপরোয়া আচরণ করে পার পেয়ে যাওয়ার কারণেই সে দিনের ঘটনা সে এত বাড়াবাড়ি করেছে। ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘এ ঘটনার সূত্রপাত যে কারণে হয়েছে, যিনি সূত্রপাত করেছেন, তিনিও (রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক) একজন সরকারি কর্মকর্তা। উনি আমাদের পুলিশের ওপর হামলাটি করেছেন। তিনি তো ইচ্ছে করলে আমাদের (পুলিশ) ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারতেন, অবহিত করতে পারতেন। অথবা তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারতেন। সেটি না করে হাসপাতালের ভেতরে অসংখ্য মানুষের সামনে একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে ধাওয়া করা, তার চশমা ভেঙে ফেলা, তার ওপর আঘাত করা এটা সঠিক করেছেন কি না, আমি জানি না। তবে এটা তদন্ত হওয়া উচিত।’
পুলিশ কখনোই কোন কর্মকর্তার ব্যক্তিগত দায় নেয় না উল্লেখ করে অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘পুলিশ বাংলাদেশে একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যেখানে যারা, যে অপরাধ করছেন, সেই অপরাধে তাদের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। আমি মনে করি, এ ঘটনায় তদন্তকারী কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে তদন্ত করছেন এবং করবেন। তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা যখন প্রতিবেদন দেবেন, তখনই বুঝতে পারবেন প্রকৃত পক্ষে কী ঘটেছে।’
নারী পুলিশ কর্মকর্তা সানজিদা যা বললেন
পুলিশের বরখাস্ত অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদ, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দুই নেতাকে নির্যাতন এবং রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) আজিজুল হক মামুনের মধ্যকার ঘটনার সূত্রপাত যাকে কেন্দ্র করে, সেই সানজিদা আফরিন অবশেষে মুখ খুলেছেন। তিনি বলেন, আমার স্বামীই এডিসি হারুন স্যারকে প্রথমে আঘাত করেছেন। সানজিদা রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক মামুনের স্ত্রী। তিনি ৩৩তম বিসিএসের কর্মকর্তা। ডিএমপির ক্রাইম বিভাগে অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন সানজিদা।
সেদিনের ঘটনা নিয়ে সানজিদা আফরিন একটি বেসরকারি টেলিভিশনে বলেন, আমি বেশ কয়েকদিন ধরে সিভিয়ার পেইনে (তীব্র ব্যথায়) ভুগছিলাম। সেদিন পেইনটা একটু বেশিই হচ্ছিল। তাই তখন আমার একজন ডাক্তার দরকার ছিল। যেহেতু ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল স্যারের (এডিসি হারুন) জুরিসডিকশনের (আওতা) মধ্যে পড়ে। তাই ডাক্তারের সিরিয়াল পাওয়ার জন্য আমি স্যারের হেল্প চেয়েছিলাম।
‘স্যারকে জানালে তিনি আমাকে বলেছিলেন, ঠিক আছে আমি আশপাশে আছি। আমি এসে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে দিচ্ছি। এরপর স্যার (এডিসি হারুন) এলেন। আসার পর একটা ডাক্তার ম্যানেজ হলো। এরপর ডাক্তার কিছু টেস্ট দিলেন। আমি ব্লাড টেস্টের জন্য স্যাম্পল দিলাম। ইকো টেস্ট আর ইসিজি করানো হলো।’
সানজিদা আরও বলেন, যে রুমে ইটিটি করানো হয় ঘটনার সময় আমি সেই রুমে ছিলাম। ইটিটি করানোর ১৫-২০ মিনিট পর আমি বাইরে হট্টগোলের শব্দ শুনি। শুনতে পাই স্যার (এডিসি হারুন) চিৎকার করে বলছেন- ভাই আপনি আমার গায়ে হাত তুললেন কেন? আপনি তো আমার গায়ে হাত তুলতে পারেন না। আমার প্রথমে ধারণা হয়েছিল যে হয়তো অন্য কারও সঙ্গে ঝামেলা। কিন্তু এর কিছুক্ষণ পর আমি দেখতে পাই আমার হাজবেন্ড (আজিজুল হক মামুন), উনি আসলে ওখানে কী করছিলেন, কেন গিয়েছিলেন আমি জানি না। ওনাকে টোটালি আউট অব মাইন্ড লাগছিল (মানসিকভাবে স্থির ছিলেন না) এবং খুবই উত্তেজিত অবস্থায় ছিলেন। ওনার সঙ্গে আরও কয়েকজন ছেলে ছিল, আমি তাদের চিনি না। তারা স্যারকে (এডিসি হারুন) মারতে মারতে ইটিটি রুমে নিয়ে এলেন।
‘ওই সময় হারুন স্যার নিজের সেফটির (নিরাপত্তার) জন্য আমি যেখানে দাঁড়ানো ছিলাম সেই রুমের দিকে দৌড়ে এসে দাঁড়ালেন। ইটিটি রুমে এত লোক ঢোকাতে তখন সেখানে একটা অকওয়ার্ড সিচুয়েশন (বিব্রতকর পরিস্থিতি) তৈরি হয়। কারণ ইটিটি রুমে রেস্ট্রিকশন থাকে। তখন আমি শাউট (চিৎকার) করছিলাম। কারণ এই রুমে কোন ছেলে ঢোকার কথা না।’
সানজিদা বলেন, এরপর আমার হাজবেন্ড তার সঙ্গে থাকা লোকজনকে বললেন, এই ভিডিও কর। এরপর সবাই ফোন বের করে ভিডিও করা শুরু করে। যখন তারা ভিডিও শুরু করে। তখন আমি আমার হাজবেন্ড এবং তার সঙ্গে থাকা লোকজনের সঙ্গে চিল্লাচিল্লি শুরু করছিলাম। এরপর যারা ভিডিও করছে, তাদের মোবাইল কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করলে তাদের হাতের সঙ্গে লেগে আমার হাতেও সামান্য ব্যথা পাই। কারণ আমি চাচ্ছিলাম না সে অবস্থায় কেউ আমার ভিডিও করুক। আর আমার হাজবেন্ডের সঙ্গে যেসব ছেলে ছিল আমি তাদের কাউকে চিনতাম না।
‘সেই অবস্থায় আমার হাজবেন্ড (এপিএস আজিজুল হক) আমার গায়ে হাত তোলেন এবং স্যারকে বের করার চেষ্টা করছিলেন। তখন স্যারের কাছে বিষয়টি সেফ মনে হয়নি। এরপর স্যার কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন। তখন হাসপাতালের সিকিউরিটির লোকজনও এলেন। এর ১০-১৫ মিনিট পর ফোর্স এলে তারা সেখান থেকে বের হয়ে যায়।’
এসব ঘটনার স্থান কোথায় এবং কয়টার দিকে হয়েছে, জানতে চাইলে সানজিদা আফরিন বলেন, আমার ডাক্তার দেখানোর সিরিয়াল ছিল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে। এরপর রাত ৭টার দিকে স্যার (হারুন) এসেছিলেন, পরে ডাক্তারও আসেন। এরপর আমি ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকি। ঘটনা ঘটেছে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের চারতলার কার্ডিওলজি বিভাগে।
অসুস্থের বিষয়ে আপনার স্বামী (আজিজুল হক মামুন) জানতেন কি না জানতে চাইলে সানজিদা বলেন, আমি অসুস্থ এটা আমার হাজবেন্ড জানতেন। কিন্তু আমি যে সেদিন ডাক্তার দেখাতে যাব, তা তিনি জানতেন না। এর আগেও বিভিন্ন সময় ডাক্তার দেখানোর কথা ছিল। কিন্তু কোন করণে তা তিনি মিস করেন। অথবা ব্যস্ত ছিলেন। যেহেতু ৬-৭ দিন ধরে আমার সিভিয়ার পেইন হচ্ছিল...। যাই হোক, সবসময় তো পরিস্থিতি সেরকম থাকে না যে আমি তার সঙ্গে শেয়ার করবো। যেহেতু আমার সিভিয়ার পেইন হচ্ছিল। তাই আমি নিজেই ডাক্তারের কাছে আসি।
থানায় মারপিট বেআইনি বললেন ডিএমপি কমিশনার
ছাত্রলীগের তিন নেতাকে এডিসি হারুন অর রশিদের মারধরের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন নাঈমকে গতকাল দুপুরে দেখতে গিয়ে ডিএমপি কমিশনার দুঃখ প্রকাশ করেন। এ সময় তিনি উল্লেখ করে থানায় মারপিট বেআইনি।
ডিএমপি কমিশনার সাংবাদিকদের বলেন, ‘সেদিন থানায় যা ঘটেছে, সে জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা নাঈম (আনোয়ার হোসেন) আহত হয়েছেন। তার শারীরিক অবস্থা ও চিকিৎসার খবর নিতে সহকর্মীদের নিয়ে হাসপাতালে এসেছি। এখনো তিনি (আনোয়ার) বেশ অসুস্থ। সুস্থ হতে আরও একটু সময় লাগবে।’
ডিএমপি কমিশনার বলেন, এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি সার্বিক ঘটনার তদন্ত করবে। কার কতটুকু দোষ, কে গিয়েছিল, কেন গিয়েছিল, সেটা তো পুরোপুরি বুঝা যাচ্ছে না। আমরা আপাতদৃষ্টে দেখেছি, একজন ছাত্রকে থানার ভেতরে মারধর করা হয়েছে, যেটা বেআইনি। এ কারণে আমরা অ্যাকশন (ব্যবস্থা) নিয়েছি। ঘটনাটি কেন ঘটল, ঘটনায় কে কে দোষী, কতটুকু দোষী সবই নিরুপণ করবে তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুসারে আমরা ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের বলব।’
মারধরের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি কাজ করছে, জানিয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এডিসি হারুন অর রশিদকে সরকার সাময়িক বরখাস্ত করেছে। মারধরের ঘটনায় জড়িত আরেকজন কর্মকর্তা শাহবাগ থানার পরিদর্শক (অপারেশন) গোলাম মোস্তফাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর তাদের বিভাগীয় ব্যবস্থাসহ অন্যান্য ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
যা বলছে মানবাধিকার কমিশন
গতকাল জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদের স্বাক্ষর করা এক আদেশে বলা হয়, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় একজন পুলিশ কর্মকর্তার এমন আচরণ আইন ও নীতিবিরুদ্ধ। ব্যক্তিগত আক্রোশকে কেন্দ্র করে থানায় নিয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের নির্যাতন একজন পুলিশ কর্মকর্তার ক্ষমতার অপব্যবহার মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র ফুটে উঠেছে। তদন্ত-সাপেক্ষে ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেয়া সমীচীন। এ ঘটনায় জড়িত পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। বিষয়টি কমিশনকে অবহিত করার জন্য সিনিয়র সচিব, জননিরাপত্তা বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে।
বুধবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ , ২৯ ভাদ্র ১৪৩০, ২৭ সফর ১৪৪৫
স্বামীর বিরুদ্ধে একই অভিযোগ সানজিদারও
নিজস্ব বার্তা পরিবেশক
ছাত্রলীগ নেতাদের পেটানোর ঘটনায় সাময়িক বরখাস্ত ডিএমপির রমনা বিভাগের এডিসি হারুন অর রশিদের ওপর প্রথমে হামলা হয়েছে। এ হামলার নেতৃত্বে ছিলেন রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ও পুলিশ কর্মকর্তা সানজিদা আফরিন নিপার স্বামী আজিজুল হক মামুন। এডিসি হারুনের সঙ্গে সানজিদাকে দেখেই রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হারুনের গায়ে হাত তোলেন। এরপর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন নাইম ও বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক.... হারুনকে মারপিট করেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ গতকাল ডিবি কার্যালয়ে এমন দাবি করেন। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দেন যাকে ঘিরে এত সব ঘটনা সেই নারী পুলিশ কর্মকর্তা সানজিদা আফরিন নিপাও।
চ্যানেল আইয়ের ইউটিউব নিউজে সানজিদা এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এডিসি হারুন স্যারকে মেরেছিলেন আমার স্বামী।
এদিকে গতকাল পুলিশের নির্যাতনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আনোয়ার হোসেন নাঈমকে দেখতে যান ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। এ সময় থানায় ছাত্রলীগ নেতাদের মারপিটের ঘটনায় তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। এ ঘটনাকে বেআইনি বলে আখ্যা দেন তিনি। অন্যদিকে ছাত্রলীগ নেতাদের মারপিটে যুক্ত থাকার অভিযোগে শাহবাগ থানার ওসি (তদন্ত) মোস্তাফিজুর রহমানকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ডিএমপি কমিশনারের আদেশে তাকে প্রত্যাহার করা হয়।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, ছাত্রলীগের ৩ নেতা কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন নাঈম, বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক মামুনের গায়ে হাত তোলার নেপথ্যে ছিল হারুনের ক্রোধ। হাসপাতালে তাকে গায়ে স্বজোরে চর থাপ্পড় দেয়ার পাশাপাশি কিলঘুসিও দেয়া হয়। শুরুটা করেন রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক মামুন। তার সঙ্গে ছাত্রলীগের ওই দুই নেতারাও হারুনকে কিলঘুসি দেন। যে কারণে সবাইকে থানায় এনে বেধড়ক মারপিট করা হয়।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছে, তবে পুলিশের গায়ে হাত দেয়ার ঘটনার নেপথ্যে যেহেতু ব্যক্তিগত বিষয় ছিল। সেহেতু আইনিভাবে ব্যবস্থা না নিয়ে মারপিট করা এবং দাঁত তুলে ফেলার বিষয়টি অতি বাড়াবাড়ি ছিল এডিসি হারুনের। আগ থেকে বেপরোয়া আচরণ করে পার পেয়ে যাওয়ার কারণেই সে দিনের ঘটনা সে এত বাড়াবাড়ি করেছে। ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘এ ঘটনার সূত্রপাত যে কারণে হয়েছে, যিনি সূত্রপাত করেছেন, তিনিও (রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক) একজন সরকারি কর্মকর্তা। উনি আমাদের পুলিশের ওপর হামলাটি করেছেন। তিনি তো ইচ্ছে করলে আমাদের (পুলিশ) ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারতেন, অবহিত করতে পারতেন। অথবা তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারতেন। সেটি না করে হাসপাতালের ভেতরে অসংখ্য মানুষের সামনে একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে ধাওয়া করা, তার চশমা ভেঙে ফেলা, তার ওপর আঘাত করা এটা সঠিক করেছেন কি না, আমি জানি না। তবে এটা তদন্ত হওয়া উচিত।’
পুলিশ কখনোই কোন কর্মকর্তার ব্যক্তিগত দায় নেয় না উল্লেখ করে অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘পুলিশ বাংলাদেশে একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যেখানে যারা, যে অপরাধ করছেন, সেই অপরাধে তাদের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। আমি মনে করি, এ ঘটনায় তদন্তকারী কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে তদন্ত করছেন এবং করবেন। তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা যখন প্রতিবেদন দেবেন, তখনই বুঝতে পারবেন প্রকৃত পক্ষে কী ঘটেছে।’
নারী পুলিশ কর্মকর্তা সানজিদা যা বললেন
পুলিশের বরখাস্ত অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদ, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দুই নেতাকে নির্যাতন এবং রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) আজিজুল হক মামুনের মধ্যকার ঘটনার সূত্রপাত যাকে কেন্দ্র করে, সেই সানজিদা আফরিন অবশেষে মুখ খুলেছেন। তিনি বলেন, আমার স্বামীই এডিসি হারুন স্যারকে প্রথমে আঘাত করেছেন। সানজিদা রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক মামুনের স্ত্রী। তিনি ৩৩তম বিসিএসের কর্মকর্তা। ডিএমপির ক্রাইম বিভাগে অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন সানজিদা।
সেদিনের ঘটনা নিয়ে সানজিদা আফরিন একটি বেসরকারি টেলিভিশনে বলেন, আমি বেশ কয়েকদিন ধরে সিভিয়ার পেইনে (তীব্র ব্যথায়) ভুগছিলাম। সেদিন পেইনটা একটু বেশিই হচ্ছিল। তাই তখন আমার একজন ডাক্তার দরকার ছিল। যেহেতু ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল স্যারের (এডিসি হারুন) জুরিসডিকশনের (আওতা) মধ্যে পড়ে। তাই ডাক্তারের সিরিয়াল পাওয়ার জন্য আমি স্যারের হেল্প চেয়েছিলাম।
‘স্যারকে জানালে তিনি আমাকে বলেছিলেন, ঠিক আছে আমি আশপাশে আছি। আমি এসে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে দিচ্ছি। এরপর স্যার (এডিসি হারুন) এলেন। আসার পর একটা ডাক্তার ম্যানেজ হলো। এরপর ডাক্তার কিছু টেস্ট দিলেন। আমি ব্লাড টেস্টের জন্য স্যাম্পল দিলাম। ইকো টেস্ট আর ইসিজি করানো হলো।’
সানজিদা আরও বলেন, যে রুমে ইটিটি করানো হয় ঘটনার সময় আমি সেই রুমে ছিলাম। ইটিটি করানোর ১৫-২০ মিনিট পর আমি বাইরে হট্টগোলের শব্দ শুনি। শুনতে পাই স্যার (এডিসি হারুন) চিৎকার করে বলছেন- ভাই আপনি আমার গায়ে হাত তুললেন কেন? আপনি তো আমার গায়ে হাত তুলতে পারেন না। আমার প্রথমে ধারণা হয়েছিল যে হয়তো অন্য কারও সঙ্গে ঝামেলা। কিন্তু এর কিছুক্ষণ পর আমি দেখতে পাই আমার হাজবেন্ড (আজিজুল হক মামুন), উনি আসলে ওখানে কী করছিলেন, কেন গিয়েছিলেন আমি জানি না। ওনাকে টোটালি আউট অব মাইন্ড লাগছিল (মানসিকভাবে স্থির ছিলেন না) এবং খুবই উত্তেজিত অবস্থায় ছিলেন। ওনার সঙ্গে আরও কয়েকজন ছেলে ছিল, আমি তাদের চিনি না। তারা স্যারকে (এডিসি হারুন) মারতে মারতে ইটিটি রুমে নিয়ে এলেন।
‘ওই সময় হারুন স্যার নিজের সেফটির (নিরাপত্তার) জন্য আমি যেখানে দাঁড়ানো ছিলাম সেই রুমের দিকে দৌড়ে এসে দাঁড়ালেন। ইটিটি রুমে এত লোক ঢোকাতে তখন সেখানে একটা অকওয়ার্ড সিচুয়েশন (বিব্রতকর পরিস্থিতি) তৈরি হয়। কারণ ইটিটি রুমে রেস্ট্রিকশন থাকে। তখন আমি শাউট (চিৎকার) করছিলাম। কারণ এই রুমে কোন ছেলে ঢোকার কথা না।’
সানজিদা বলেন, এরপর আমার হাজবেন্ড তার সঙ্গে থাকা লোকজনকে বললেন, এই ভিডিও কর। এরপর সবাই ফোন বের করে ভিডিও করা শুরু করে। যখন তারা ভিডিও শুরু করে। তখন আমি আমার হাজবেন্ড এবং তার সঙ্গে থাকা লোকজনের সঙ্গে চিল্লাচিল্লি শুরু করছিলাম। এরপর যারা ভিডিও করছে, তাদের মোবাইল কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করলে তাদের হাতের সঙ্গে লেগে আমার হাতেও সামান্য ব্যথা পাই। কারণ আমি চাচ্ছিলাম না সে অবস্থায় কেউ আমার ভিডিও করুক। আর আমার হাজবেন্ডের সঙ্গে যেসব ছেলে ছিল আমি তাদের কাউকে চিনতাম না।
‘সেই অবস্থায় আমার হাজবেন্ড (এপিএস আজিজুল হক) আমার গায়ে হাত তোলেন এবং স্যারকে বের করার চেষ্টা করছিলেন। তখন স্যারের কাছে বিষয়টি সেফ মনে হয়নি। এরপর স্যার কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন। তখন হাসপাতালের সিকিউরিটির লোকজনও এলেন। এর ১০-১৫ মিনিট পর ফোর্স এলে তারা সেখান থেকে বের হয়ে যায়।’
এসব ঘটনার স্থান কোথায় এবং কয়টার দিকে হয়েছে, জানতে চাইলে সানজিদা আফরিন বলেন, আমার ডাক্তার দেখানোর সিরিয়াল ছিল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে। এরপর রাত ৭টার দিকে স্যার (হারুন) এসেছিলেন, পরে ডাক্তারও আসেন। এরপর আমি ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকি। ঘটনা ঘটেছে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের চারতলার কার্ডিওলজি বিভাগে।
অসুস্থের বিষয়ে আপনার স্বামী (আজিজুল হক মামুন) জানতেন কি না জানতে চাইলে সানজিদা বলেন, আমি অসুস্থ এটা আমার হাজবেন্ড জানতেন। কিন্তু আমি যে সেদিন ডাক্তার দেখাতে যাব, তা তিনি জানতেন না। এর আগেও বিভিন্ন সময় ডাক্তার দেখানোর কথা ছিল। কিন্তু কোন করণে তা তিনি মিস করেন। অথবা ব্যস্ত ছিলেন। যেহেতু ৬-৭ দিন ধরে আমার সিভিয়ার পেইন হচ্ছিল...। যাই হোক, সবসময় তো পরিস্থিতি সেরকম থাকে না যে আমি তার সঙ্গে শেয়ার করবো। যেহেতু আমার সিভিয়ার পেইন হচ্ছিল। তাই আমি নিজেই ডাক্তারের কাছে আসি।
থানায় মারপিট বেআইনি বললেন ডিএমপি কমিশনার
ছাত্রলীগের তিন নেতাকে এডিসি হারুন অর রশিদের মারধরের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন নাঈমকে গতকাল দুপুরে দেখতে গিয়ে ডিএমপি কমিশনার দুঃখ প্রকাশ করেন। এ সময় তিনি উল্লেখ করে থানায় মারপিট বেআইনি।
ডিএমপি কমিশনার সাংবাদিকদের বলেন, ‘সেদিন থানায় যা ঘটেছে, সে জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা নাঈম (আনোয়ার হোসেন) আহত হয়েছেন। তার শারীরিক অবস্থা ও চিকিৎসার খবর নিতে সহকর্মীদের নিয়ে হাসপাতালে এসেছি। এখনো তিনি (আনোয়ার) বেশ অসুস্থ। সুস্থ হতে আরও একটু সময় লাগবে।’
ডিএমপি কমিশনার বলেন, এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি সার্বিক ঘটনার তদন্ত করবে। কার কতটুকু দোষ, কে গিয়েছিল, কেন গিয়েছিল, সেটা তো পুরোপুরি বুঝা যাচ্ছে না। আমরা আপাতদৃষ্টে দেখেছি, একজন ছাত্রকে থানার ভেতরে মারধর করা হয়েছে, যেটা বেআইনি। এ কারণে আমরা অ্যাকশন (ব্যবস্থা) নিয়েছি। ঘটনাটি কেন ঘটল, ঘটনায় কে কে দোষী, কতটুকু দোষী সবই নিরুপণ করবে তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুসারে আমরা ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের বলব।’
মারধরের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি কাজ করছে, জানিয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এডিসি হারুন অর রশিদকে সরকার সাময়িক বরখাস্ত করেছে। মারধরের ঘটনায় জড়িত আরেকজন কর্মকর্তা শাহবাগ থানার পরিদর্শক (অপারেশন) গোলাম মোস্তফাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর তাদের বিভাগীয় ব্যবস্থাসহ অন্যান্য ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
যা বলছে মানবাধিকার কমিশন
গতকাল জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদের স্বাক্ষর করা এক আদেশে বলা হয়, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় একজন পুলিশ কর্মকর্তার এমন আচরণ আইন ও নীতিবিরুদ্ধ। ব্যক্তিগত আক্রোশকে কেন্দ্র করে থানায় নিয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের নির্যাতন একজন পুলিশ কর্মকর্তার ক্ষমতার অপব্যবহার মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র ফুটে উঠেছে। তদন্ত-সাপেক্ষে ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেয়া সমীচীন। এ ঘটনায় জড়িত পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তা জানতে চেয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। বিষয়টি কমিশনকে অবহিত করার জন্য সিনিয়র সচিব, জননিরাপত্তা বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে।