মিথাশ্রিত লেখক শহীদুল জহির

জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত

তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি কখনো। কথাও না। তবুও তাঁকে আমি চিনতাম।

কয়েক বছর আগে তাঁর একটি উপন্যাসের নাম আমার নজরে আসে- ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল।’ মুহূর্তে শহীদুল জহিরের প্রতি মনোযোগী হই আমি। কেননা, ঐ সময়ের দু-তিন বছর আগে আমার প্রকাশিত একটি গল্পের শুরু ছিল এই রকম : ‘সেই রাত্রি পূর্ণিমার ছিল অথচ বাতাসে শোণিতের ঘ্রাণ ছিল না।’ নিউইয়র্কে প্রকাশিত আমার সেই গল্প শহীদুল জহির কখনো দেখেছেন বলেও আমি মনে করি না, কেবল পূর্ণিমা রাত্রির ব্যবহারে সাদৃশ্যই তাঁর প্রতি আমার আগ্রহ বাড়ায়, এবং সামান্য কিছুকাল পরে দেশে ফিরলে এক সাময়িকীতে তাঁর ‘কাঁটা’ গল্পটি পড়ি। গল্পে ঘটনা কি সংকেতসূত্রের পৌনঃপুনিক ব্যবহার ঐ গল্পের আড়ালে যে আরও একটি গল্প তৈরি করে এবং সমাজ, জীবন ও রাজনীতিসঞ্জাত এক অমোঘ সত্যে কাছে নিয়ে যায় দেখে আমি নিঃসন্দেহে চমৎকৃত হই। ‘কাঁটা’ কিছুতে মন থেকে সরে না দীর্ঘকাল যদিও তাঁর অন্যান্য রচনা সংগ্রহ করে পড়াও হয় না। অথচ পড়া উচিত ছিল- তাঁর ও আমার গল্পের ভুবনে, অন্তত শিল্পকৌশলের দিক থেকে, একই আলোছায়া খেলা করে বলে আমার মনে হয়েছিল। এই বিশ্বাস সম্প্রতি দৃঢ় হয়েছে তাঁর লেখা আরো গল্প পড়ে। ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ আমি আজও পড়িনি। প্রকৃতপক্ষে তাঁর কোনো উপন্যাসই আমি পড়িনি। ‘মুখের দিকে দেখি’ এবং ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ আমার হাতে আসে কিছুকাল আগে এবং শেষোক্ত উপন্যাসটি তাঁর গল্প ভুবনেরই ঘনিষ্ঠ শরিক বলে মনে হওয়ায় এখনও পড়িনি। এক অনুচ্ছেদের এই উপন্যাসটি অভিনবত্বের জন্যে মনোযোগ আকর্ষণ করলেও এই প্রকারের রচনা একেবারে অভূতপূর্ব নয়- এই বোধও সম্ভবত তাঁর গল্পের প্রতিই আমাকে টেনে নিয়ে যায়।

‘কাঁটা’র পরে অনেককাল পর্যন্ত শহীদুল জহীরের অন্য কোন রচনা না পড়লেও তাঁর সম্পর্কে অনেক কথা শুনি। কিংবদন্তীয় লেখকদের সম্পর্কে যেমন শোনা যায়। যেমন, তিনি নিভৃতচারী- উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা অথচ নিতান্ত সাধারণ একাকী জীবন যাপন করেন। ঘনিষ্ঠ কিছু পরিচিতজন ছাড়া আর কারো সঙ্গেই পরিচয়ে আগ্রীহ নন। (তাঁর এই মানসিকতার কথা আমি নিজেও জানি। আমার আগে ঢাকায় বাসকালে এক অনুজপ্রতিম প্রবাসী লেখক বন্ধু শহীদুল জহিরের সঙ্গে দীর্ঘসময় কাটানোর পরে আমার শান্তিনগরের বাসায় আসেন। শহীদুল জহির তার সঙ্গে আমার বাসার সামনে এলেও ভেতরে আসেননি। তিনি আমার পরিচয় জানতেন না এমন মনে করি না। আমার বন্ধু আমি কে নিশ্চয়ই তাঁকে বলেছিলেন, তবুও যে তিনি আমার সঙ্গে পরিচিত হননি অপরিচয়ে তাঁর আগ্রহ বেশি ছিল বলেই সম্ভবত।) নিজ রচনা সম্পর্কে উদাসীন- যদিও আমার তেমন মনে হয় না। অমন হলে ‘পারাপার’ গ্রন্থের গল্পসমূহকে নিজের সৃষ্টিকর্ম হিসেবে অগ্রাহ্য করতে চাইবেন কেন? অথবা কেবল ‘একটিমাত্র অনুচ্ছেদে রচিত, অন্তিমে পূর্ণচ্ছেদসূচক যতিচিহ্নবিহীন’ গল্পটির পাঠ নিশ্চিত করবার জন্যে সেটিকে পুনর্মুদ্রিত করবেন কেন? বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তার যে বিবরণ পাঠ করা যায়, তাতেও মনে হয় নিজ রচনা ও তার বিশেষ অবস্থান সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত ছিলেন তিনি। তবুও কিংবদন্তি তাঁকে ছাড়ে না। ‘শহীদুল জহির নিভৃত মানুষ’, মানবিক সম্পর্কের দেয়াল ভেঙ্গে তাঁর কাছে কেউ যেতে পারে না। প্রথাগত জীবন তিনি কাটাননি এবং এ কারণে নিজ স্বাস্থ্য সম্পর্কেও উদাসীন ছিলেন। কিঞ্চিৎ বিস্মিত ও বিমূঢ় হয়ে তাঁর কথা শুনি তাঁর জীবনাচরণের কথা ভাবি, আর ভাবি কিংবদন্তি বুঝি কেবল তাঁকেই সামনে নিয়ে এসেছে, তাঁর রচনাকে নয়। অন্তত আমার ক্ষেত্রে। আরও একটি বিষয়ও লক্ষ্য করি, কিংবদন্তি কবলিত প্রায় স্রষ্টারই সৃষ্টিকর্ম কম। আমাদের সময়ে এমন স্রষ্টা বিরল বলা যাবে না। অবশ্য তাঁদের সম্পর্কে এ-কথাও বলা প্রয়োজন যে, তাঁরা ‘মিথ’-এর জনক রচনার উৎকর্ষের কারণেই, সংখ্যাল্পতার কারণে নয়। তবুও ভয় হয়- মিথাশ্রিত লেখকের সাহিত্যিক সমাজে যে পরিমাণ পরিচিতি বাড়ে, তাঁর রচনা সেই পরিমাণে পঠিত হয় না। শহীদুল জহিরের ক্ষেত্রে আশা করি এমন ঘটবে না, ঘটলে অগণিত গল্পপাঠক চিরবঞ্চিত হবেন।

দুই

শহীদুল জহিরের সাতিহ্যসৃষ্টির পরিসর খুব দীর্ঘ নয়, খুব সামান্যও নয়। তাঁর গল্প রচনার কাল বিবেচনায় নিলে দেখি ‘ভালবাসা’ রচিত হয়েছে ১৯৭৪-এ, ‘ডলু নদীর হাওয়া’র রচনাকাল ২০০৩। এই দুই গল্পের আগে ও পরে আরো কিছু গল্প হয়তো তিনি রচনা করেছিলেন, এই মুহূর্তে আমি তার খোঁজ জানি না। তাঁর তিনটি উপন্যাসের বাইরে তিনটি গল্পগ্রন্থের উনিশটি গল্পের সঙ্গেই আমার পরিচয়। ‘নির্বাচিত গল্প’ সংকলনে ‘পারাপার’ থেকে নেয়া পাঁচটি এবং ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’ থেকে নেয়া আটটি- এই মোট তেরটি এবং ‘ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প’ সংকলনে গ্রন্থিত ছয়টি- এই মোট উনিশটি। ত্রিশ বছরের আবাদে তাঁর গল্পের এই ফসল সামান্যই বলা যায়, অবশ্য এই সময়ে রচিত তিনটি উপন্যাসের কথা স্মরণে রাখা প্রয়োজন, তবুও। ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করা যায় না। তিনি সচেতনভাবে লেখক হতে চাননি তাই যখন যেমন মনে এসেছে খেয়ালের বশে গল্প লিখে প্রকাশ করেছেন, মেনে নেয়া যায় না। ‘পারাপার’-এর গল্প সম্পর্কে তাঁর মনোভাবই বলে দেয় যে তিনি নিজ রচনা সম্পর্কে সচেতনই ছিলেন বরং। তাঁর ঘনিষ্ঠজন কি বিভিন্ন সুহৃদের কথা থেকেও এমন মনে হয় না যে নিজ রচনা সম্পর্কে তাঁর কোন আকর্ষণ ছিল না। ভাষা ব্যবহারে তাঁর যে স্বাচ্ছন্দ্য কি গল্পের গভীরে প্রবেশের জন্যে, ঘটনা কি চরিত্রকে উন্মোচিত করার জন্যে, ভিন্ন আলোয় উপস্থিত করার জন্যে ভাষার যে ব্যবহার তিনি আয়ত্ত করেছিলেন সেটি তাঁর সচেতন প্রয়াসের ফল নিঃসন্দেহে। গল্পের কাঠামো নির্মাণে তেমনি। তাহলে তাঁর রচনার এই স্বল্পতা কী কারণে? অবশ্য এমন হতেই পারে যে, জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে সৃষ্টিমুখী রচনা থেকে দীর্ঘকাল বিরত ছিলেন তিনি অথবা তাঁর বহু রচনাই এখনও গ্রন্থনার বাইরে রয়ে গেছে। আমার নিজের গল্প রচনার কালে আঠারো বছরের একটি ফাঁক আছে, জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনেই সেটি ঘটেছিল। শহীদুল জহিরেরও অনুমান করি, তেমন ঘটে থাকবে, কেননা সংকলনে গ্রন্থিত ‘পারাপার’-এর শেষ গল্প ও ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’ গ্রন্থের প্রথম গল্পের মধ্যে সময়ের ব্যবধান পনেরো বছরের। এই পনেরো বছরে কী ঘটেছিল তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা জানেন নিঃসন্দেহে। আমরা বাইরে থেকে কেবল অনুমানই করতে পারি। এমনকি হতে পারে যে এই সময়েই তিনি, নতুন গল্পের নতুন কৌশলের, নতুন বিধির সন্ধানে রত ছিলেন এবং তার সন্ধান পান? ‘পারাপার’-এর রচনাশৈলী ও ‘ডুমুরখেকো মানুষ...’র রচনাশৈলীর মধ্যেকার বিস্তর ফারাক সে-কথাই বলে। কোন সময়ে কত কাল তাঁর বিদেশে কেটেছিল এটিও সম্ভবত বিবেচ্য এই কাল গণনায়। বিষয়টির উল্লেখ এই জন্যে করা যে, সম্ভবত শহীদুল জহিরের শেষ পনেরো বছরের গল্প ভিন্ন কোন রচনার সঙ্গে সংস্পর্শের ফল।

তিন

‘পারাপার’ গ্রন্থের গল্পসমূহকে, শোনা যায়, শহীদুল জহির নিজ সৃষ্টি হিসাবে খুব উঁচুতে ধরে রাখেননি; প্রচলিত গল্প রচনার ধারায় মিলিয়ে ফেলা যায় বলেই সম্ভবত তাঁর এই মনোভাব। অবশ্য আমরা জানি, তিনিও জানতেন, প্রচলিত ধারার গল্পেও, নতুনতর পদ্ধতি অঙ্গিক ভাষা ইত্যাদি ব্যবহারের আগে, চিরস্মরণীয় অজস্র রচনা আছে। এই গ্রন্থের সব গল্প হয়তো অমন নয়, প্রথম গল্পটির প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতেই হয়। কলেজের মাঠ থেকে ছিঁড়ে আনা একটি ফুল শহীদ দিবসের জন্যে অন্যদের সঙ্গে জীবনবঞ্চিত হাফিজদ্দিও তুলেছিল এবং সেটি ঘরে নিয়ে এলে দেখা যায় ফুলটিই গল্পের শরীরে মিশে যায় এবং সকলের জন্যেই মুহূর্তের স্বপ্ন, জীবন, সান্ত¡না ও ভালোবাসার উৎস হয়। গল্পে প্রতীকের ব্যবহার কি প্রতীকী ব্যঞ্জনার প্রসঙ্গ তোলা এখানে প্রায় অবান্তর। ফুলটি এতো সহজে গল্প হয়ে যায় যে পাঠক অন্য কিছুই আর ভাবেন না। প্রতীকের সার্থক ব্যবহার এটিই যা রচনার সঙ্গে মিশে যায়, কোনোমতে আলাদা করা যায় না।

‘পারাপার’-এর গল্পে মার্কসীয় ভাবনার কিছু প্রতিফলন আছে- এমন কথা বলা যায়। রৌদ্রে পোড়া, জলেভেজা চিরবঞ্চিত মানুষ যারা জাগলেই বদলাবে দিনের রং এমন বিশ্বাস যদি মার্কসীয় চিন্তাপ্রসূত হয় তাহলে শহীদুল জহিরের অন্য গল্পাদিকে এই বিবেচনার বাইরে রাখা যায় না। যায় না সম্ভবত অদ্যাবধি পরিচিত আধুনিক কি উত্তরাধুনিক নানা লেখকের রচনাও। প্রকৃতপক্ষে সর্বহারা মানুষের হাতেই আছে নতুন দিনের নৌকা সামনে টেনে নিয়ে যাবার গুণ- এই বিশ্বাস চল্লিশের দশকের পর থেকেই প্রায় সাহিত্যরসের সমালোচনার প্রিয় উৎস, এবং এ কারণেই পরবর্তীকালে মধ্যবিত্ত জীবনের গাথা মধ্যবিত্ত জীবনের একঘেয়ে বর্ণনা বলে অভিহিত হয়। যদিও জানা আছে, দিনবদল যদি আদৌ কিছু ঘটে তার পেছনে ঐ একঘেয়ে জীবনের কাহিনী বর্ণনাই দায়ী। পুড়ে যাওয়া মাটি, ভেসে যাওয়া মানুষ, চিহ্নহীন হয়ে যাওয়ার গল্পও কিন্তু বলা হয় ঐ মধ্যবিত্ত জীবিত কি অজীবিতদের জন্যেই। শূন্যপ্রাণ যাদের কথা বলা হয় তারা ঐসব কাহিনীর ব্যবহার জানে না, পড়তে পারে না বলেই।

পারাপার-এর গল্প রচনাকালের পানেরো বছর পরের গল্পজগৎটি শহীদুল জহিরের আলাদা, কিন্তু মূল পাতাটি একেবারে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছেন এমন বলা যাবে না। পুরনো ঢাকার এক বিশেষ প্রায়ান্ধকার অঞ্চল, সেই অঞ্চলের মানুষ- নানা মিশেল থাকলেও অন্ধকারবাসী তো। বলা যায় হতভাগ্যই। ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’ সমগ্রের জীবন কি ঐসব মানুষ কি ঐ পৃথিবীরই নয়! শহীদুল জহির ঐ পৃথিবী এবং জীবনে প্রবেশ করে বদলে দেন তার আবহ কি তার মানুষের জীবনাচরণ, কি চোখে দেখার জগৎকে বাস্তব-অবাস্তবের সীমানা মুছে দিয়ে। চিরায়ত বিশ্বাসের ভিত্তি কিছু পরিমাণে শিথিল করবার জন্যে ব্যবহার করেন প্রাকৃতজন ও সংস্কৃতজনের ব্যবহৃত মিশ্রিত বয়ান। কাহিনীসূত্রের পৌনঃপুনিক ব্যবহার, পুনরাবৃত্তি, প্রাকৃতিক-অপ্রাকৃতিক নানা সংকেত ছড়িয়ে দিয়ে তিনি সময়ের বিশ্বাসটিকেও বদলে দিতে চান। ফলে লোকজ বিশ্বাসাশ্রিত কিংবদন্তি, কি রূপকথা নামে পূর্বপরিচিত এক জগৎ তাঁর হাতে সাম্প্রতিককালে পরিচিত জাদুবাস্তবতার জগৎ বলে ধরা দেয়। ক্রিয়াপদের আঞ্চলিক ব্যবহার ব্যাখাতীত মানসিক অবস্থা বোঝানোর জন্যে কিছু বাঁধা শব্দের নিয়মিত ব্যবহার কি উদ্দেশ্য স্থান, কাল বর্ণনায় উম্মূল চেতনা সৃষ্টির উদ্দেশে নানা অনির্দিষ্ট শব্দের ব্যবহার তাঁর রচনাকে এক ভিন্ন তলে নিয়ে যায়। পাঠক প্রকৃতই সম্মোহিত হয়ে পড়েন। যদিও এখানে বলা প্রয়োজন মৌখিক, আঞ্চলিক শব্দাবলীর সঙ্গে প্রকাশিত তৎসম-তদ্ভব শব্দাবলীর মিশ্রণে সৃষ্ট গদ্যরীতি সর্বদা ব্যবহৃত শব্দাবলীর সঙ্গে অধিকতর তৎসম-তদ্ভব শব্দের মিশ্রণে প্রস্তুত গদ্যরীতি থেকে এমন কিছু ভিন্ন নয়।

‘ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প’ শহীদুল জহিরের স্থির চিন্তাপ্রসূত গল্প রচনার প্রয়াস। ‘ডুমুরখেকো মানুষ’-এর রক্তস্রোত যদিও এখানেও কিয়ৎ পরিমাণে প্রবাহিত। এক অনুচ্ছেদে বর্ণিত গল্পটি থেকে বহুল আলোচিত জাদুবাস্তবতার চাদর তুলে নিলে দেখা যাবে কিংবদন্তি কি রূপকথা কি গ্রামীণ পুঁথি রচয়িতার নানা অলৌকিক-অবস্থা সৃষ্টির কৌশলই সেখানে ব্যবহৃত হয়েছে মাত্র। যেমন ব্যবহৃত হয়েছে ‘কোথায় পাব তারে’ কি ‘আমাদের বকুল’ গল্পে। তবুও ‘ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প’ গ্রন্থের গল্পনিচয় জীবনঘনিষ্ঠ বিষয় ও বিশ্বাসের সঙ্গে প্রায় কালহীন, অবয়বহীন মানুষ ও তার ব্যাখ্যাতীত জীবনাচরণের বর্ণনায় চেতনার গভীরে প্রবেশ করে। মানবিক প্রাপ্তি আকাক্সক্ষা বাসনা ইত্যাদি পাশে সরিয়ে রেখে প্রায় এক দার্শনিক সত্যের সম্মুখেই দাঁড় করিয়ে দেয়। এই গ্রন্থের ‘ইন্দুর-বিলাই খেলা’ নামক দীর্ঘ গল্পটি যথার্থ অভিনব। গল্প বলার কৌশল, জনজীবনের যেন স্পর্শাতীত অথচ অতি চেনা বর্ণনা কি সমকালীন সমাজচেতনার সমন্বয়ে রচিত এমন গল্প তাঁর সৃষ্টি ক্ষমতাকে শীর্ষে নিয়ে গেছে। গল্পে ছক কি রেখাচিত্রের ব্যবহার চমকপ্রদ নিঃসন্দেহে, কিন্তু একেবার মৌলিক নয়। বিদেশী সাহিত্য খুঁজে দেখার আগে আমরা ত্রিশ, চল্লিশ এমনকি পঞ্চাশের দশকে ‘সচিত্র গল্প’ প্রকাশের রেওয়াজ স্মরণ করতে পারি। সেইসব গল্পে নানা প্রকার রেখাচিত্রের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। বিজ্ঞান কি সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ক রচনায় সর্বদাই নানা ছক, গতিপ্রদর্শক রেখা ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় বিষয়টিকে বোধগম্য করার জন্যে। শহীদুল জহির অমন চিন্তায় আবিষ্ট ছিলেন যদিও অভিনবত্বও তাঁর কাম্য ছিল। যেমন কাম্য ছিল গল্প বর্ণনায় প্রায় সর্বদাই বৃন্দচেতনা কি বৃন্দকথন প্রক্রিয়া ব্যবহারে সার্বজনীনতা সৃষ্টির।

শহীদুল জহিরের গল্পের জগৎ দিগন্তবিস্তৃত নয় বরং বলা যায় হাতের নাগালে সামান্য সীমার মধ্যেই আবদ্ধ সেটি। গল্পের মানুষও তেমনি বিশেষ কিছু চারিত্রিক কি আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যেরই অধিকারী সকলে। ফলে, রচনায় শিল্পকৌশলের ব্যাপারটি বিবেচনায় না-নিলে, বৈচিত্র্যহীনতার প্রসঙ্গ উঠতেই পারে। যদিও মাত্র উনিশটি গল্পে কতোই বা বিচিত্র হতে পারে সেটিও বিবেচ্য।

চার

শহীদুল জহিরের গল্প রচনা কালে, উপন্যাস রচনার কালেও, সাহিত্যসৃষ্টিতে জাদুবাস্তবতা নামক শিল্পকৌশলের ব্যবহার-এর কথা শুনেছিলেন অনেক সাহিত্যরসিক কি সমালোচক। মূলত লাতিন আমেরিকীয় সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয়ই তাদের মধ্যে অমন চেতনার সৃষ্টি করেছিল যদিও কৌশলটি আদৌ সাহিত্যক্ষেত্রে অপরিচিত ছিল না। প্রায় সত্তর-আশি বছর আগে এক জার্মান চিত্রসমালোচক শব্দটি ব্যবহার করেন, পরে মার্কিনী চিত্রকরদের কর্ম আলোচনায়ও এটি ব্যবহৃত হতে থাকে। পরে, ষাটের দশকের দিকে লাতিন আমেরিকার কিছু রচনাকে বিশেষ গোত্রভুক্ত করবার জন্যে শব্দটি ব্যবহৃত হতে থাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, চিত্রশিল্পে শব্দটি যে বৈশিষ্ট্য বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হতো সাহিত্যে ব্যবহৃত হয় তার ঠিক বিপরীত বৈশিষ্ট্য বোঝানোর জন্যে। চিত্রকর্মে যদি অতিসাধারণ ও অতিবাস্তব সত্যকে ধরবার জন্য কৌশলটি ব্যবহৃত হয় তো সাহিত্যে ব্যবহৃত হয় বাস্তব ও কল্পনার সম্মিলনের জন্যে। মার্কেজের ভাষায়- ‘বাস্তব ও কল্পনার মধ্যেকার সীমারেখা’ ঘুচিয়ে সব একাকার করে দেয়ার জন্যে। অবশ্য ঐসব কল্পনা বাস্তব বলে মনে হলেও লেখক কখনোই সেটিকে ব্যাখ্যা করেন না। জাদুবাস্তবতা-সঞ্জাত শিল্প প্রকরণের নানা লক্ষণ আছে, নানা চেহারা আছে। লোকগাথা, কল্পগাথা ধর্মীয় অনুষঙ্গ- সবই জাদুবাস্তবতায় অঙ্গীভূত হয় বাস্তব ও কল্পনার প্রোথিত অতীত ও বর্তমানে আশ্রিত সমস্ত ঘটনা কি জীবনচক্রের প্রতি পাঠককে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বে ফেলবার জন্যে। এই ব্যবহার রচনাকে চমৎকার করে মনোহারী করে, পাঠককে অভিভূত করে দেয়। লাতিন আমেরিকায় সাহিত্য সৃষ্টির প্লাবনকালে রাজনৈতিক বাস্তবতা কি বিধিনিষেধ ইত্যাদিকে আড়াল করবার জন্যেও এটি ব্যবহৃত হতে থাকে। পরে সারা পৃথিবীতে এর ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য জাদুবাস্তবতা বলে চিহ্নিত এই শিল্পকৌশলের সমগোত্রীয় সাহিত্যচিন্তা পূর্বেও পরিচিত ছিল। উত্তর-আধুনিকতা, পরাবাস্তবতা, বিচিত্র কল্পনা এবং এই উভয় গোত্রের মাঝামাঝি নানা প্রকার রচনাকৌশল দীর্ঘকাল যাবৎ ব্যবহৃত হয়েছে। আমাদের রচনাতেও। বর্তমান জীবনের কল্পগল্প সমৃদ্ধ-সাহিত্যগুণে জারিত হলে সেটিও হয়ে যায় জাদুবাস্তবতার সগ্রোত্রই।

শহীদুল জহির তাঁর পরবর্তীকালের রচনায় (আশির দশকের শেষে, নব্বইয়ের শুরুতে) ঐ শিল্পকৌশল ব্যবহার করে পাঠক ও সমালোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এক ভিন্ন, ব্রাত্য জীবনের গল্প ভিন্ন ভঙ্গিতে বলায় তাঁর রচনা মনোহারী হয়। যদিও স্মরণে থাকা প্রয়োজন যে জাদুবাস্তবতা নবজন কৌশলের স্বগোত্রীয় রচনা কৌশল আমাদের ভাষার রচনায় আমাদের দেশেই পূর্বেও ব্যবহৃত হয়েছে। নিতান্ত আত্মশ্লাঘা বলে বিবেচিত না হলে বলি যে, ষাটের দশকে রচিত আমার অনেক গল্পই, যা প্রতীকাকীর্ণ কি দুর্বোধ্য বলে বিবেচিত হয়েছে, এই নতুন গোত্রীয় রচনাই জাদুবাস্তবতা- বিষয়টি ঐ শিল্পকৌশলের সব জ্ঞান ঐ সময়ে না-জানা থাকলেও পরাবাস্তবের ব্যবহার, অন্তর্লীন চেতনার ব্যবহার, সময়ের পরিমাপ অগ্রাহ্য করা ইত্যাকার বিবিধ কৌশল আমার মতো অনেক লেখকই ব্যবহার করেছেন ঐকালে। মধ্য আশির কালে আঠারো বছর পরে আবার গল্প রচনায় ফিরে এলে আমার অনেক গল্পই জাদুবাস্তবতার ঘনিষ্ঠ হয়। তবুও ভাষা ব্যবহারে শহীদুল জহিরের অনন্যতা থাকেই এক ভিন্ন শিল্পসৃষ্টির কৌশল আত্তীকরণ ও লোকজ ভাষার সঙ্গে তার মেলবন্ধনের জন্যে শহীদুল স্মরণীয়ই থাকবেন।

পাঁচ

উনিশটি গল্পের জগতে নানা বর্ণ, নানা চিত্র আশা করা যায় না। তবুও শহীদুল জহিরের গল্প তার স্বাতন্ত্র্যের গুণে ঐ বর্ণ ও চিত্রের অভাব ভুলিয়ে দেয়। জানি না তাঁর আরও কতো গল্প অপ্রকাশিত কি অগ্রন্থিত রয়ে গেছে। তাঁর অনুরক্ত পাঠক, বান্ধব কি পরিশ্রমী প্রকাশক যদি সেইসব রচনাও সামনে নিয়ে আসেন তাহলে তাঁর রচনার জগত আরও প্রসারিত হয়, প্রবেশের দরজাটিও আরও উন্মুক্ত হয়।

image

শহীদুল জহির / জন্ম : ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৫৩; মৃত্যু : ২৩ মার্চ ২০০৮ প্রতিকৃতি : নজরুল ইসলাম দুলাল

আরও খবর
সেদিন হঠাৎ তুষার ঝরেছিল
লিখে আমি আমার রক্ত মোক্ষণ করি
মার্কেসের সাংবাদিকতা অজানা অধ্যায়
প্রেক্ষিত বাংলাদেশের লোকশিল্প
সাময়িকী কবিতা

বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ , ৩০ ভাদ্র ১৪৩০, ২৮ সফর ১৪৪৫

মিথাশ্রিত লেখক শহীদুল জহির

জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত

image

শহীদুল জহির / জন্ম : ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৫৩; মৃত্যু : ২৩ মার্চ ২০০৮ প্রতিকৃতি : নজরুল ইসলাম দুলাল

তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি কখনো। কথাও না। তবুও তাঁকে আমি চিনতাম।

কয়েক বছর আগে তাঁর একটি উপন্যাসের নাম আমার নজরে আসে- ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল।’ মুহূর্তে শহীদুল জহিরের প্রতি মনোযোগী হই আমি। কেননা, ঐ সময়ের দু-তিন বছর আগে আমার প্রকাশিত একটি গল্পের শুরু ছিল এই রকম : ‘সেই রাত্রি পূর্ণিমার ছিল অথচ বাতাসে শোণিতের ঘ্রাণ ছিল না।’ নিউইয়র্কে প্রকাশিত আমার সেই গল্প শহীদুল জহির কখনো দেখেছেন বলেও আমি মনে করি না, কেবল পূর্ণিমা রাত্রির ব্যবহারে সাদৃশ্যই তাঁর প্রতি আমার আগ্রহ বাড়ায়, এবং সামান্য কিছুকাল পরে দেশে ফিরলে এক সাময়িকীতে তাঁর ‘কাঁটা’ গল্পটি পড়ি। গল্পে ঘটনা কি সংকেতসূত্রের পৌনঃপুনিক ব্যবহার ঐ গল্পের আড়ালে যে আরও একটি গল্প তৈরি করে এবং সমাজ, জীবন ও রাজনীতিসঞ্জাত এক অমোঘ সত্যে কাছে নিয়ে যায় দেখে আমি নিঃসন্দেহে চমৎকৃত হই। ‘কাঁটা’ কিছুতে মন থেকে সরে না দীর্ঘকাল যদিও তাঁর অন্যান্য রচনা সংগ্রহ করে পড়াও হয় না। অথচ পড়া উচিত ছিল- তাঁর ও আমার গল্পের ভুবনে, অন্তত শিল্পকৌশলের দিক থেকে, একই আলোছায়া খেলা করে বলে আমার মনে হয়েছিল। এই বিশ্বাস সম্প্রতি দৃঢ় হয়েছে তাঁর লেখা আরো গল্প পড়ে। ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ আমি আজও পড়িনি। প্রকৃতপক্ষে তাঁর কোনো উপন্যাসই আমি পড়িনি। ‘মুখের দিকে দেখি’ এবং ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ আমার হাতে আসে কিছুকাল আগে এবং শেষোক্ত উপন্যাসটি তাঁর গল্প ভুবনেরই ঘনিষ্ঠ শরিক বলে মনে হওয়ায় এখনও পড়িনি। এক অনুচ্ছেদের এই উপন্যাসটি অভিনবত্বের জন্যে মনোযোগ আকর্ষণ করলেও এই প্রকারের রচনা একেবারে অভূতপূর্ব নয়- এই বোধও সম্ভবত তাঁর গল্পের প্রতিই আমাকে টেনে নিয়ে যায়।

‘কাঁটা’র পরে অনেককাল পর্যন্ত শহীদুল জহীরের অন্য কোন রচনা না পড়লেও তাঁর সম্পর্কে অনেক কথা শুনি। কিংবদন্তীয় লেখকদের সম্পর্কে যেমন শোনা যায়। যেমন, তিনি নিভৃতচারী- উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা অথচ নিতান্ত সাধারণ একাকী জীবন যাপন করেন। ঘনিষ্ঠ কিছু পরিচিতজন ছাড়া আর কারো সঙ্গেই পরিচয়ে আগ্রীহ নন। (তাঁর এই মানসিকতার কথা আমি নিজেও জানি। আমার আগে ঢাকায় বাসকালে এক অনুজপ্রতিম প্রবাসী লেখক বন্ধু শহীদুল জহিরের সঙ্গে দীর্ঘসময় কাটানোর পরে আমার শান্তিনগরের বাসায় আসেন। শহীদুল জহির তার সঙ্গে আমার বাসার সামনে এলেও ভেতরে আসেননি। তিনি আমার পরিচয় জানতেন না এমন মনে করি না। আমার বন্ধু আমি কে নিশ্চয়ই তাঁকে বলেছিলেন, তবুও যে তিনি আমার সঙ্গে পরিচিত হননি অপরিচয়ে তাঁর আগ্রহ বেশি ছিল বলেই সম্ভবত।) নিজ রচনা সম্পর্কে উদাসীন- যদিও আমার তেমন মনে হয় না। অমন হলে ‘পারাপার’ গ্রন্থের গল্পসমূহকে নিজের সৃষ্টিকর্ম হিসেবে অগ্রাহ্য করতে চাইবেন কেন? অথবা কেবল ‘একটিমাত্র অনুচ্ছেদে রচিত, অন্তিমে পূর্ণচ্ছেদসূচক যতিচিহ্নবিহীন’ গল্পটির পাঠ নিশ্চিত করবার জন্যে সেটিকে পুনর্মুদ্রিত করবেন কেন? বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তার যে বিবরণ পাঠ করা যায়, তাতেও মনে হয় নিজ রচনা ও তার বিশেষ অবস্থান সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত ছিলেন তিনি। তবুও কিংবদন্তি তাঁকে ছাড়ে না। ‘শহীদুল জহির নিভৃত মানুষ’, মানবিক সম্পর্কের দেয়াল ভেঙ্গে তাঁর কাছে কেউ যেতে পারে না। প্রথাগত জীবন তিনি কাটাননি এবং এ কারণে নিজ স্বাস্থ্য সম্পর্কেও উদাসীন ছিলেন। কিঞ্চিৎ বিস্মিত ও বিমূঢ় হয়ে তাঁর কথা শুনি তাঁর জীবনাচরণের কথা ভাবি, আর ভাবি কিংবদন্তি বুঝি কেবল তাঁকেই সামনে নিয়ে এসেছে, তাঁর রচনাকে নয়। অন্তত আমার ক্ষেত্রে। আরও একটি বিষয়ও লক্ষ্য করি, কিংবদন্তি কবলিত প্রায় স্রষ্টারই সৃষ্টিকর্ম কম। আমাদের সময়ে এমন স্রষ্টা বিরল বলা যাবে না। অবশ্য তাঁদের সম্পর্কে এ-কথাও বলা প্রয়োজন যে, তাঁরা ‘মিথ’-এর জনক রচনার উৎকর্ষের কারণেই, সংখ্যাল্পতার কারণে নয়। তবুও ভয় হয়- মিথাশ্রিত লেখকের সাহিত্যিক সমাজে যে পরিমাণ পরিচিতি বাড়ে, তাঁর রচনা সেই পরিমাণে পঠিত হয় না। শহীদুল জহিরের ক্ষেত্রে আশা করি এমন ঘটবে না, ঘটলে অগণিত গল্পপাঠক চিরবঞ্চিত হবেন।

দুই

শহীদুল জহিরের সাতিহ্যসৃষ্টির পরিসর খুব দীর্ঘ নয়, খুব সামান্যও নয়। তাঁর গল্প রচনার কাল বিবেচনায় নিলে দেখি ‘ভালবাসা’ রচিত হয়েছে ১৯৭৪-এ, ‘ডলু নদীর হাওয়া’র রচনাকাল ২০০৩। এই দুই গল্পের আগে ও পরে আরো কিছু গল্প হয়তো তিনি রচনা করেছিলেন, এই মুহূর্তে আমি তার খোঁজ জানি না। তাঁর তিনটি উপন্যাসের বাইরে তিনটি গল্পগ্রন্থের উনিশটি গল্পের সঙ্গেই আমার পরিচয়। ‘নির্বাচিত গল্প’ সংকলনে ‘পারাপার’ থেকে নেয়া পাঁচটি এবং ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’ থেকে নেয়া আটটি- এই মোট তেরটি এবং ‘ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প’ সংকলনে গ্রন্থিত ছয়টি- এই মোট উনিশটি। ত্রিশ বছরের আবাদে তাঁর গল্পের এই ফসল সামান্যই বলা যায়, অবশ্য এই সময়ে রচিত তিনটি উপন্যাসের কথা স্মরণে রাখা প্রয়োজন, তবুও। ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করা যায় না। তিনি সচেতনভাবে লেখক হতে চাননি তাই যখন যেমন মনে এসেছে খেয়ালের বশে গল্প লিখে প্রকাশ করেছেন, মেনে নেয়া যায় না। ‘পারাপার’-এর গল্প সম্পর্কে তাঁর মনোভাবই বলে দেয় যে তিনি নিজ রচনা সম্পর্কে সচেতনই ছিলেন বরং। তাঁর ঘনিষ্ঠজন কি বিভিন্ন সুহৃদের কথা থেকেও এমন মনে হয় না যে নিজ রচনা সম্পর্কে তাঁর কোন আকর্ষণ ছিল না। ভাষা ব্যবহারে তাঁর যে স্বাচ্ছন্দ্য কি গল্পের গভীরে প্রবেশের জন্যে, ঘটনা কি চরিত্রকে উন্মোচিত করার জন্যে, ভিন্ন আলোয় উপস্থিত করার জন্যে ভাষার যে ব্যবহার তিনি আয়ত্ত করেছিলেন সেটি তাঁর সচেতন প্রয়াসের ফল নিঃসন্দেহে। গল্পের কাঠামো নির্মাণে তেমনি। তাহলে তাঁর রচনার এই স্বল্পতা কী কারণে? অবশ্য এমন হতেই পারে যে, জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে সৃষ্টিমুখী রচনা থেকে দীর্ঘকাল বিরত ছিলেন তিনি অথবা তাঁর বহু রচনাই এখনও গ্রন্থনার বাইরে রয়ে গেছে। আমার নিজের গল্প রচনার কালে আঠারো বছরের একটি ফাঁক আছে, জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনেই সেটি ঘটেছিল। শহীদুল জহিরেরও অনুমান করি, তেমন ঘটে থাকবে, কেননা সংকলনে গ্রন্থিত ‘পারাপার’-এর শেষ গল্প ও ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’ গ্রন্থের প্রথম গল্পের মধ্যে সময়ের ব্যবধান পনেরো বছরের। এই পনেরো বছরে কী ঘটেছিল তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা জানেন নিঃসন্দেহে। আমরা বাইরে থেকে কেবল অনুমানই করতে পারি। এমনকি হতে পারে যে এই সময়েই তিনি, নতুন গল্পের নতুন কৌশলের, নতুন বিধির সন্ধানে রত ছিলেন এবং তার সন্ধান পান? ‘পারাপার’-এর রচনাশৈলী ও ‘ডুমুরখেকো মানুষ...’র রচনাশৈলীর মধ্যেকার বিস্তর ফারাক সে-কথাই বলে। কোন সময়ে কত কাল তাঁর বিদেশে কেটেছিল এটিও সম্ভবত বিবেচ্য এই কাল গণনায়। বিষয়টির উল্লেখ এই জন্যে করা যে, সম্ভবত শহীদুল জহিরের শেষ পনেরো বছরের গল্প ভিন্ন কোন রচনার সঙ্গে সংস্পর্শের ফল।

তিন

‘পারাপার’ গ্রন্থের গল্পসমূহকে, শোনা যায়, শহীদুল জহির নিজ সৃষ্টি হিসাবে খুব উঁচুতে ধরে রাখেননি; প্রচলিত গল্প রচনার ধারায় মিলিয়ে ফেলা যায় বলেই সম্ভবত তাঁর এই মনোভাব। অবশ্য আমরা জানি, তিনিও জানতেন, প্রচলিত ধারার গল্পেও, নতুনতর পদ্ধতি অঙ্গিক ভাষা ইত্যাদি ব্যবহারের আগে, চিরস্মরণীয় অজস্র রচনা আছে। এই গ্রন্থের সব গল্প হয়তো অমন নয়, প্রথম গল্পটির প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতেই হয়। কলেজের মাঠ থেকে ছিঁড়ে আনা একটি ফুল শহীদ দিবসের জন্যে অন্যদের সঙ্গে জীবনবঞ্চিত হাফিজদ্দিও তুলেছিল এবং সেটি ঘরে নিয়ে এলে দেখা যায় ফুলটিই গল্পের শরীরে মিশে যায় এবং সকলের জন্যেই মুহূর্তের স্বপ্ন, জীবন, সান্ত¡না ও ভালোবাসার উৎস হয়। গল্পে প্রতীকের ব্যবহার কি প্রতীকী ব্যঞ্জনার প্রসঙ্গ তোলা এখানে প্রায় অবান্তর। ফুলটি এতো সহজে গল্প হয়ে যায় যে পাঠক অন্য কিছুই আর ভাবেন না। প্রতীকের সার্থক ব্যবহার এটিই যা রচনার সঙ্গে মিশে যায়, কোনোমতে আলাদা করা যায় না।

‘পারাপার’-এর গল্পে মার্কসীয় ভাবনার কিছু প্রতিফলন আছে- এমন কথা বলা যায়। রৌদ্রে পোড়া, জলেভেজা চিরবঞ্চিত মানুষ যারা জাগলেই বদলাবে দিনের রং এমন বিশ্বাস যদি মার্কসীয় চিন্তাপ্রসূত হয় তাহলে শহীদুল জহিরের অন্য গল্পাদিকে এই বিবেচনার বাইরে রাখা যায় না। যায় না সম্ভবত অদ্যাবধি পরিচিত আধুনিক কি উত্তরাধুনিক নানা লেখকের রচনাও। প্রকৃতপক্ষে সর্বহারা মানুষের হাতেই আছে নতুন দিনের নৌকা সামনে টেনে নিয়ে যাবার গুণ- এই বিশ্বাস চল্লিশের দশকের পর থেকেই প্রায় সাহিত্যরসের সমালোচনার প্রিয় উৎস, এবং এ কারণেই পরবর্তীকালে মধ্যবিত্ত জীবনের গাথা মধ্যবিত্ত জীবনের একঘেয়ে বর্ণনা বলে অভিহিত হয়। যদিও জানা আছে, দিনবদল যদি আদৌ কিছু ঘটে তার পেছনে ঐ একঘেয়ে জীবনের কাহিনী বর্ণনাই দায়ী। পুড়ে যাওয়া মাটি, ভেসে যাওয়া মানুষ, চিহ্নহীন হয়ে যাওয়ার গল্পও কিন্তু বলা হয় ঐ মধ্যবিত্ত জীবিত কি অজীবিতদের জন্যেই। শূন্যপ্রাণ যাদের কথা বলা হয় তারা ঐসব কাহিনীর ব্যবহার জানে না, পড়তে পারে না বলেই।

পারাপার-এর গল্প রচনাকালের পানেরো বছর পরের গল্পজগৎটি শহীদুল জহিরের আলাদা, কিন্তু মূল পাতাটি একেবারে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছেন এমন বলা যাবে না। পুরনো ঢাকার এক বিশেষ প্রায়ান্ধকার অঞ্চল, সেই অঞ্চলের মানুষ- নানা মিশেল থাকলেও অন্ধকারবাসী তো। বলা যায় হতভাগ্যই। ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’ সমগ্রের জীবন কি ঐসব মানুষ কি ঐ পৃথিবীরই নয়! শহীদুল জহির ঐ পৃথিবী এবং জীবনে প্রবেশ করে বদলে দেন তার আবহ কি তার মানুষের জীবনাচরণ, কি চোখে দেখার জগৎকে বাস্তব-অবাস্তবের সীমানা মুছে দিয়ে। চিরায়ত বিশ্বাসের ভিত্তি কিছু পরিমাণে শিথিল করবার জন্যে ব্যবহার করেন প্রাকৃতজন ও সংস্কৃতজনের ব্যবহৃত মিশ্রিত বয়ান। কাহিনীসূত্রের পৌনঃপুনিক ব্যবহার, পুনরাবৃত্তি, প্রাকৃতিক-অপ্রাকৃতিক নানা সংকেত ছড়িয়ে দিয়ে তিনি সময়ের বিশ্বাসটিকেও বদলে দিতে চান। ফলে লোকজ বিশ্বাসাশ্রিত কিংবদন্তি, কি রূপকথা নামে পূর্বপরিচিত এক জগৎ তাঁর হাতে সাম্প্রতিককালে পরিচিত জাদুবাস্তবতার জগৎ বলে ধরা দেয়। ক্রিয়াপদের আঞ্চলিক ব্যবহার ব্যাখাতীত মানসিক অবস্থা বোঝানোর জন্যে কিছু বাঁধা শব্দের নিয়মিত ব্যবহার কি উদ্দেশ্য স্থান, কাল বর্ণনায় উম্মূল চেতনা সৃষ্টির উদ্দেশে নানা অনির্দিষ্ট শব্দের ব্যবহার তাঁর রচনাকে এক ভিন্ন তলে নিয়ে যায়। পাঠক প্রকৃতই সম্মোহিত হয়ে পড়েন। যদিও এখানে বলা প্রয়োজন মৌখিক, আঞ্চলিক শব্দাবলীর সঙ্গে প্রকাশিত তৎসম-তদ্ভব শব্দাবলীর মিশ্রণে সৃষ্ট গদ্যরীতি সর্বদা ব্যবহৃত শব্দাবলীর সঙ্গে অধিকতর তৎসম-তদ্ভব শব্দের মিশ্রণে প্রস্তুত গদ্যরীতি থেকে এমন কিছু ভিন্ন নয়।

‘ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প’ শহীদুল জহিরের স্থির চিন্তাপ্রসূত গল্প রচনার প্রয়াস। ‘ডুমুরখেকো মানুষ’-এর রক্তস্রোত যদিও এখানেও কিয়ৎ পরিমাণে প্রবাহিত। এক অনুচ্ছেদে বর্ণিত গল্পটি থেকে বহুল আলোচিত জাদুবাস্তবতার চাদর তুলে নিলে দেখা যাবে কিংবদন্তি কি রূপকথা কি গ্রামীণ পুঁথি রচয়িতার নানা অলৌকিক-অবস্থা সৃষ্টির কৌশলই সেখানে ব্যবহৃত হয়েছে মাত্র। যেমন ব্যবহৃত হয়েছে ‘কোথায় পাব তারে’ কি ‘আমাদের বকুল’ গল্পে। তবুও ‘ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প’ গ্রন্থের গল্পনিচয় জীবনঘনিষ্ঠ বিষয় ও বিশ্বাসের সঙ্গে প্রায় কালহীন, অবয়বহীন মানুষ ও তার ব্যাখ্যাতীত জীবনাচরণের বর্ণনায় চেতনার গভীরে প্রবেশ করে। মানবিক প্রাপ্তি আকাক্সক্ষা বাসনা ইত্যাদি পাশে সরিয়ে রেখে প্রায় এক দার্শনিক সত্যের সম্মুখেই দাঁড় করিয়ে দেয়। এই গ্রন্থের ‘ইন্দুর-বিলাই খেলা’ নামক দীর্ঘ গল্পটি যথার্থ অভিনব। গল্প বলার কৌশল, জনজীবনের যেন স্পর্শাতীত অথচ অতি চেনা বর্ণনা কি সমকালীন সমাজচেতনার সমন্বয়ে রচিত এমন গল্প তাঁর সৃষ্টি ক্ষমতাকে শীর্ষে নিয়ে গেছে। গল্পে ছক কি রেখাচিত্রের ব্যবহার চমকপ্রদ নিঃসন্দেহে, কিন্তু একেবার মৌলিক নয়। বিদেশী সাহিত্য খুঁজে দেখার আগে আমরা ত্রিশ, চল্লিশ এমনকি পঞ্চাশের দশকে ‘সচিত্র গল্প’ প্রকাশের রেওয়াজ স্মরণ করতে পারি। সেইসব গল্পে নানা প্রকার রেখাচিত্রের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। বিজ্ঞান কি সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ক রচনায় সর্বদাই নানা ছক, গতিপ্রদর্শক রেখা ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় বিষয়টিকে বোধগম্য করার জন্যে। শহীদুল জহির অমন চিন্তায় আবিষ্ট ছিলেন যদিও অভিনবত্বও তাঁর কাম্য ছিল। যেমন কাম্য ছিল গল্প বর্ণনায় প্রায় সর্বদাই বৃন্দচেতনা কি বৃন্দকথন প্রক্রিয়া ব্যবহারে সার্বজনীনতা সৃষ্টির।

শহীদুল জহিরের গল্পের জগৎ দিগন্তবিস্তৃত নয় বরং বলা যায় হাতের নাগালে সামান্য সীমার মধ্যেই আবদ্ধ সেটি। গল্পের মানুষও তেমনি বিশেষ কিছু চারিত্রিক কি আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যেরই অধিকারী সকলে। ফলে, রচনায় শিল্পকৌশলের ব্যাপারটি বিবেচনায় না-নিলে, বৈচিত্র্যহীনতার প্রসঙ্গ উঠতেই পারে। যদিও মাত্র উনিশটি গল্পে কতোই বা বিচিত্র হতে পারে সেটিও বিবেচ্য।

চার

শহীদুল জহিরের গল্প রচনা কালে, উপন্যাস রচনার কালেও, সাহিত্যসৃষ্টিতে জাদুবাস্তবতা নামক শিল্পকৌশলের ব্যবহার-এর কথা শুনেছিলেন অনেক সাহিত্যরসিক কি সমালোচক। মূলত লাতিন আমেরিকীয় সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয়ই তাদের মধ্যে অমন চেতনার সৃষ্টি করেছিল যদিও কৌশলটি আদৌ সাহিত্যক্ষেত্রে অপরিচিত ছিল না। প্রায় সত্তর-আশি বছর আগে এক জার্মান চিত্রসমালোচক শব্দটি ব্যবহার করেন, পরে মার্কিনী চিত্রকরদের কর্ম আলোচনায়ও এটি ব্যবহৃত হতে থাকে। পরে, ষাটের দশকের দিকে লাতিন আমেরিকার কিছু রচনাকে বিশেষ গোত্রভুক্ত করবার জন্যে শব্দটি ব্যবহৃত হতে থাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, চিত্রশিল্পে শব্দটি যে বৈশিষ্ট্য বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হতো সাহিত্যে ব্যবহৃত হয় তার ঠিক বিপরীত বৈশিষ্ট্য বোঝানোর জন্যে। চিত্রকর্মে যদি অতিসাধারণ ও অতিবাস্তব সত্যকে ধরবার জন্য কৌশলটি ব্যবহৃত হয় তো সাহিত্যে ব্যবহৃত হয় বাস্তব ও কল্পনার সম্মিলনের জন্যে। মার্কেজের ভাষায়- ‘বাস্তব ও কল্পনার মধ্যেকার সীমারেখা’ ঘুচিয়ে সব একাকার করে দেয়ার জন্যে। অবশ্য ঐসব কল্পনা বাস্তব বলে মনে হলেও লেখক কখনোই সেটিকে ব্যাখ্যা করেন না। জাদুবাস্তবতা-সঞ্জাত শিল্প প্রকরণের নানা লক্ষণ আছে, নানা চেহারা আছে। লোকগাথা, কল্পগাথা ধর্মীয় অনুষঙ্গ- সবই জাদুবাস্তবতায় অঙ্গীভূত হয় বাস্তব ও কল্পনার প্রোথিত অতীত ও বর্তমানে আশ্রিত সমস্ত ঘটনা কি জীবনচক্রের প্রতি পাঠককে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বে ফেলবার জন্যে। এই ব্যবহার রচনাকে চমৎকার করে মনোহারী করে, পাঠককে অভিভূত করে দেয়। লাতিন আমেরিকায় সাহিত্য সৃষ্টির প্লাবনকালে রাজনৈতিক বাস্তবতা কি বিধিনিষেধ ইত্যাদিকে আড়াল করবার জন্যেও এটি ব্যবহৃত হতে থাকে। পরে সারা পৃথিবীতে এর ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য জাদুবাস্তবতা বলে চিহ্নিত এই শিল্পকৌশলের সমগোত্রীয় সাহিত্যচিন্তা পূর্বেও পরিচিত ছিল। উত্তর-আধুনিকতা, পরাবাস্তবতা, বিচিত্র কল্পনা এবং এই উভয় গোত্রের মাঝামাঝি নানা প্রকার রচনাকৌশল দীর্ঘকাল যাবৎ ব্যবহৃত হয়েছে। আমাদের রচনাতেও। বর্তমান জীবনের কল্পগল্প সমৃদ্ধ-সাহিত্যগুণে জারিত হলে সেটিও হয়ে যায় জাদুবাস্তবতার সগ্রোত্রই।

শহীদুল জহির তাঁর পরবর্তীকালের রচনায় (আশির দশকের শেষে, নব্বইয়ের শুরুতে) ঐ শিল্পকৌশল ব্যবহার করে পাঠক ও সমালোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এক ভিন্ন, ব্রাত্য জীবনের গল্প ভিন্ন ভঙ্গিতে বলায় তাঁর রচনা মনোহারী হয়। যদিও স্মরণে থাকা প্রয়োজন যে জাদুবাস্তবতা নবজন কৌশলের স্বগোত্রীয় রচনা কৌশল আমাদের ভাষার রচনায় আমাদের দেশেই পূর্বেও ব্যবহৃত হয়েছে। নিতান্ত আত্মশ্লাঘা বলে বিবেচিত না হলে বলি যে, ষাটের দশকে রচিত আমার অনেক গল্পই, যা প্রতীকাকীর্ণ কি দুর্বোধ্য বলে বিবেচিত হয়েছে, এই নতুন গোত্রীয় রচনাই জাদুবাস্তবতা- বিষয়টি ঐ শিল্পকৌশলের সব জ্ঞান ঐ সময়ে না-জানা থাকলেও পরাবাস্তবের ব্যবহার, অন্তর্লীন চেতনার ব্যবহার, সময়ের পরিমাপ অগ্রাহ্য করা ইত্যাকার বিবিধ কৌশল আমার মতো অনেক লেখকই ব্যবহার করেছেন ঐকালে। মধ্য আশির কালে আঠারো বছর পরে আবার গল্প রচনায় ফিরে এলে আমার অনেক গল্পই জাদুবাস্তবতার ঘনিষ্ঠ হয়। তবুও ভাষা ব্যবহারে শহীদুল জহিরের অনন্যতা থাকেই এক ভিন্ন শিল্পসৃষ্টির কৌশল আত্তীকরণ ও লোকজ ভাষার সঙ্গে তার মেলবন্ধনের জন্যে শহীদুল স্মরণীয়ই থাকবেন।

পাঁচ

উনিশটি গল্পের জগতে নানা বর্ণ, নানা চিত্র আশা করা যায় না। তবুও শহীদুল জহিরের গল্প তার স্বাতন্ত্র্যের গুণে ঐ বর্ণ ও চিত্রের অভাব ভুলিয়ে দেয়। জানি না তাঁর আরও কতো গল্প অপ্রকাশিত কি অগ্রন্থিত রয়ে গেছে। তাঁর অনুরক্ত পাঠক, বান্ধব কি পরিশ্রমী প্রকাশক যদি সেইসব রচনাও সামনে নিয়ে আসেন তাহলে তাঁর রচনার জগত আরও প্রসারিত হয়, প্রবেশের দরজাটিও আরও উন্মুক্ত হয়।