সেদিন হঠাৎ তুষার ঝরেছিল

ইমতিয়ার শামীম

শহীদুল জহিরের সঙ্গে আমার মুখোমুখি পরিচয় ছিল না। দশকওয়ারি সাহিত্যবিভাজনে বিশ্বাসী সম্পাদক ও আলোচকরা যাদের গায়ে আশির দশকের ছাপ লাগিয়েছিলেন, শহীদুল জহিরসহ আমাদের অনেকের গায়েই সেই ছাপ এতদিনে সুস্পষ্টভাবে বসে গেছে অনেকটা জন্মদাগের মতো। সত্যিকারের জন্মকথা হিসেবে নিলে তিনি আমার একযুগ আগে পৃথিবীতে এসেছেন। তবু এখন সম্পাদক ও আলোচকদের প্রতি কৃতজ্ঞ আমি,- তাঁরা আমাদের একই সময়ের বৃত্তে বেঁধেছেন জন্যে। আশির দশকের উল্লেখযোগ্য সব লেখকের সঙ্গেই কোনও না কোনও সময় আমার কথা হয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু শহীদুল জহির। তাঁকে আমি মুখোমুখি দেখি নি। তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়নি।

কালাকালের অর্থে এই দেখা হওয়া না-হওয়া অবশ্য কোনও বড় ব্যাপার নয়। কিন্তু মানুষ যখন বেদনার্ত হয় তখন মহাকালের কথা ভেবে হয় না। মৃত্যুগন্ধী সময়ের আবেগই তাঁর কাছে বড় হয়ে ওঠে। এ জন্যেই হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তিটির কথা বলতে গিয়ে হয়তো ব্যক্তিটির সঙ্গে স্মৃতিচারকের স্মৃতিগুলিই বড় হয়ে ওঠে। যতক্ষণ না তা হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তিটির কাঁধে ভর করে নিজেকেই বড় করে তোলার মতো কিছু না হয় ততক্ষণ তা দৃষ্টিকটূও নয়। সত্যিকার অর্থে মানুষটির প্রতি ব্যক্তিগত মুগ্ধতার স্মৃতি ছাড়া এইসব সময়ে অন্য কোনও বয়ান খুব বেশি প্রীতিকর মনে হয় না। অথচ তেমন কোনও সঞ্চয়ই নেই আমার, যা দিয়ে আমি তাঁর সঙ্গে একটু ব্যক্তিগত হতে পারি।

তারপরও কোনও না কোনওভাবে তিনি আমার ব্যক্তিগত আত্মার সঙ্গী। কারণ ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁর পাঠক এবং আমরা একই সময়ের মানুষ। কারণ যে জনপদ আর মানুষগুলো তাঁর জনপ্রিয় ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ উপন্যাসে বেড়ে ওঠে, বেড়ে ওঠে বেশ ক’টি ছোটগল্পে, কাকতালীয়ভাবে হলেও তাঁর মতো আমিও সেই জনপদের মানুষ। তাঁর মতো আমারও বাবার ভিটে সিরাজগঞ্জ জেলাতে। তাঁর রায়গঞ্জ আমার চেনা জায়গা, চেনা ওই গোপন রাজনীতির ক্ষত ও ক্ষতি। ‘ক্ষত যত ক্ষতি তত’ এই সত্যেরই তো মুখোমুখি করেন তিনি তাঁর কথাসাহিত্যে। আমরা আমাদের শৈশব কৈশোরের দিনগুলোয় জনপদের সেই ক্ষত ও ক্ষতিকে দেখেছি রক্তপাতের মধ্যে দিয়ে, অশ্রুপাতের মধ্যে দিয়ে। এমনকি যখন আমরা প্রায়উন্মূল হয়েছি সিরাজগঞ্জ থেকে এবং বিশেষত সিরাজগঞ্জ শহরবাসী কারও টেলিফোন পেলেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি কারও মৃত্যু অথবা দুর্ঘটনার খবর পেতে, এই ক্ষত ও ক্ষতি তখন আরও ঘনিষ্ঠ সঙ্গী হয়েছে। যেমন, এক সকালে এক বন্ধুর ফোন পেয়ে আমি জানতে পারি ফিরোজ মাস্টার খুন হয়েছেন। ফিরোজ মাস্টার ছিলেন সিরাজগঞ্জ জনপদে গোপন রাজনীতির এক কিংবদন্তি। গোপন রাজনৈতিক জীবন পেরিয়ে তিনি তখন একটি ডানপন্থী দলে যোগ দিয়ে নির্জন জীবনযাপনের পথ বেঁছে নিয়েছেন। প্রতিদিন রাতে খাওয়ার পর বাড়ি থেকে বের হন এবং হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে একটি কালভার্টের ওপর গিয়ে কিছুক্ষণ একা একা বসে থাকেন। এক রাতে তিনি হাঁটতে বেরিয়ে আর ফিরে আসেন না। তাঁকে উদ্ধার করা হয় নিহত অবস্থায়।

আরও একদিন গভীর রাতে খবর এলো, ভয়ানক এক গাড়িদুর্ঘটনা ঘটেছে বগুড়া মহাসড়কে। নিহত হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা ও একদা গণবাহিনীর সংগঠক মির্জা আবদুল আজিজ ও ম. মামুন। গুরুতর আহত আরেকজন গণবাহিনীর সংগঠক ও জাসদ নেতা আবদুল হাই। ম. মামুন ছিলেন গোপন রাজনীতির কালে ফিরোজ মাস্টারের প্রিয় অনুসারী। তারুণ্যে কামারখন্দে দিনেদুপুরে এক পুলিশ অফিসার হত্যার দায়ে ম. মামুন অভিযুক্ত হয়েছিলেন। কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে তিনি যুক্ত হন স্থানীয় একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সঙ্গে।

দূর থেকে এরকম যত মৃত্যুর খবর পেয়েছি কিংবদন্তিময় একটি সময়ের একেক সংগঠকের ততবারই কেন জানি মনে পড়েছে ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’র কথা। বললে হয়তো বিশ্বাস হবে না- কিন্তু ওই জনপদের অধিবাসী আমরা জানি- রায়গঞ্জ-কামারখন্দ-জামতৈল জনপদের কোনও কোনও এলাকার চেয়ারম্যান হওয়ার মানে জেনেশুনে নিজের মৃত্যু ডেকে আনা। অথচ সেই মৃত্যুর মোহে প্রতিবারই কেউ না কেউ নির্বাচন করে, চেয়ারম্যান হয় এবং কোনও এক রাতে অথবা দিনে খুন হয়ে যায়।

এও এক জাদুবাস্তবতাই বটে!

দুই.

ক্ষত ও ক্ষতি নিয়ে এইভাবে আমরা সিরাজগঞ্জ থেকে প্রায়উন্মূল হয়েছি, প্রায় সম্পর্কহীন হয়ে পড়েছি সিরাজগঞ্জের সঙ্গে, পৃথিবীমুখী হয়েছি তারপর আমাদের প্রিয় মার্কেজের বুয়েন্দিয়ার মতো। মাকের্জের উপন্যাস ‘হাজার বছরের নির্জনতা’য় গভীর এক ক্রান্তিকাল আছে। হোসে আর্কাদিও বুুয়েন্দিয়া সেখানে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে আবারও দূর অভিযানে বের হওয়ার। কিন্তু তার স্ত্রী উরসুলা কিছুতেই রাজি হয় না বসতি ত্যাগ করতে। বুয়েন্দিয়া তাকে বলে, দূরঅভিযানে যেতে তার কোনও অসুবিধা নেই, পিছুটানও নেই, কেননা ‘এখনও এখানে আমাদের কেউ মারা যায় নি। মরে মাটির তলায় আত্মীয় কেউ না শোয়া পর্যন্ত কোনও জায়গায় কারও অধিকার বা প্রেম জন্মায় না।’ বুয়েন্দিয়ার এ কথা শুনে তার বউ উরসুলা শান্ত কঠিন কণ্ঠে বলে, ‘তা হলে আমি এখানেই মরব, যাতে তোমরা সবাই এখানেই থাকো।’ মানুষের মাটি, স্বদেশ ও বসতি গড়ে ওঠে এরকম সব বুয়েন্দিয়ার আত্মার হাহাকার দিয়ে, এরকম সব উরসুলার হৃদয়ের শোক দিয়ে।

শহীদুল জহিরের গ্রামের বাড়ি ছিল রায়গঞ্জে, কিন্তু তিনি জন্ম নিয়েছিলেন পুরানো ঢাকায়। নিজের এক বসতি তিনি স্থাপন করতে চেয়েছেন তাঁর সব গল্পউপন্যাসের মধ্যে দিয়ে। সেইখানে কখনও তরমুজের ঘ্রাণ পাওয়া যায়, ডালপুরিভাসা তেল টগবগিয়ে ফোটে, ইঁদুর ও বিড়াল খেলা করে, আবদুল করিম বারবার কাচের গ্লাস ভেঙে জানালার পাশে রাখে, পাতকুয়ায় সুবোধচন্দ্র ও তার স্ত্রী স্বপ্না বারবার পড়ে যায়। কখনও আবার তিনি যেনবা জেনেশুনেই সংখ্যালঘু হয়ে যান, বিচ্ছিন্নতার বদলে ডুবে যান সংখ্যালঘুতার বিপন্নতায়। কিন্তু নিজের এই বসতি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার তাগিদ তাঁর মধ্যে কখনোই জন্মায় নি। তিনি তাঁর আত্মা ও হৃদয়ের হাহাকার ও শোক নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন নিজস্ব ভূগোলে। বিবিধ অঞ্চল ও আঞ্চলিক ভাষাকে তিনি অবলম্বন করেছেন বিভিন্ন গল্পে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বজায় রেখেছেন ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ উপন্যাসের উপস্থাপনস্বর।

আমাদের সেই জনপদের একঘেয়ে মুথা ও মেঠো সমতল, খরখরে গ্রীষ্মের দাবদাহ সঞ্চয় করে রাখা প্রায়উৎপাটিত নিঃসঙ্গ বটগাছ, আঁকাবাঁকা মেঠোরাস্তা, অথবা বর্ষায় ডুবে যাওয়া রুপালি আকাশ, কর্দমাক্ত রাস্তা এবং একজন চেয়ারম্যান খুন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খুন হওয়ার জন্যে প্রস্তুত আরও সব হবু চেয়ারম্যান, এসব কিছুই শহীদুল জহির একে একে কব্জা করে নিয়েছিলেন। তাঁর মতো আর কেউ জানে নি, এইসব জনপদ ও মানুষের জীবন ও বাস্তবতা কেবলই গল্প হয়ে যায়। আমাদের গ্রামগুলোর মানুষের গল্প, জীবন, হতাশা, সংগ্রাম আর যৌনতাও এত বিচিত্র যে এই আমিও যখন তা এমনকি সিরাজগঞ্জেরই কাউকে শোনাই, শুনতে শুনতে তারা বলে, ‘এইসব আজগুবি গল্প কোনখানে পাই’ছো? সলপের গল্প, না?’ ভেবে দেখুন, ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত একজন মানুষ দণ্ডিত হওয়ার পর্ব এড়াতে গ্রামের সালিশে অজ্ঞান হয়ে গেল। কিছুতেই তার সংজ্ঞা আর ফিরিয়ে আনাই যাচ্ছে না। দাঁতের মধ্যে চামচ ঢুকিয়ে চেষ্টা করা হচ্ছে তাকে পানি খাওয়ানোর। কিন্তু সে পণ করেছে কিছুতেই কিছু খাবে না। হঠাৎ একজন কী মনে করে একগ্লাস দুধ এনে ঠোঁটের ওপর রাখতেই অজ্ঞান মানুষটা গরুর দুধের ঘ্রাণ পেয়ে ধর্ষণের দায়ে দণ্ডিত হওয়ার যাবতীয় আশংকা ভুলে ঢক ঢক করে তা গিলে ফেলল। আবার এই মানুষটিই যখন প্রবীণ আর স্মৃতিভ্রষ্টতায় আক্রান্ত, একদিন হঠাৎ তার পাড়াপড়শিদের সম্পর্কে দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করার প্রতিজ্ঞা ঘোষণা করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সেই যে ট্রেনে চড়ল, নিজের এলাকার নাম মনে না থাকায় সে আর পারল না নিজের বাড়িতেও ফিরে আসতে। গ্রামের মানুষদের কাছে সে একশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও বেঁচে আছে নিরুদ্দেশ এক গ্রামবাসী হিসেবে। কেউ আবার বুড়ো হয়ে গেল প্রচণ্ড বর্ষার সময় বোয়াল মাছের গ্রাসে অণ্ডকোষ হারানোর স্মৃতি নিয়ে। আবার যুদ্ধ যখন চলছে, তখন এমন একজন মানুষকে পাওয়া গেল, যে মৃত, অর্ধমৃত সব খানসেনা আর রাজাকারদের লিঙ্গ কেটে একটি টুকরিতে জমাতে লাগল। জালিম খানসেনা আর তার দোসরদের জন্মক্ষমতাই সে নষ্ট করে দেবে, এই তার একমাত্র আকাক্সক্ষা।

এরকম এক জনপদ যেখানে সত্যিই রয়েছে সেখানে শুধুমাত্র জাদুবাস্তবতা দিয়ে শহীদুল জহিরকে বিচার করতে যাওয়া এক অর্থে তাঁর প্রতি অবিচার করা। আমি অবশ্য তাঁর পাঠক হই অনেক পরে। সম্ভবত ১৯৯৩ সালে। মারুফ রায়হানের আগ্রহে ‘মাটি’ পত্রিকার গল্পসংখ্যায় শহীদুল জহির লেখেন ‘আমাদের কুটিরশিল্প’, আমি লিখি ‘বালকের বামহাত’। ততদিনে তিনি ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ লিখে সুপরিচিত। কিন্তু আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটল তাঁর গল্প পড়ার মধ্যে দিয়ে। তাঁর লেখার শক্তিমত্তা নিয়ে আমার কোনও সংশয় ছিল না, এখনও নেই; কিন্তু তাঁকে ‘জাদুবাস্তবতার’ ঘেরাটোপে বন্দি করতে আমি বরাবরই দ্বিধান্বিত হয়েছি। অনেক পরে বাংলাপিডিয়াতে একটি সংক্ষিপ্ত মন্তব্য পাই তাঁর সম্পর্কে, সেটিকেই বরং অনেক ঠিক মনে হয়। তাঁর লেখার অন্যতর একটি রূপ তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে সেখানটাতে, বলা হয়েছে শহীদুল জহিরের ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’তে প্রকাশ পেয়েছে বাস্তবতা ও সুরিয়ালিজম।

এর মধ্যে শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’র বিশ বছর পার হয়েছে গত বছর। আমাদের বুর্জোয়া রাজনীতির ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপে যে রক্তাক্ত অধ্যায় তৈরি হয় এবং ক্রমাগত যা ধর্মাশ্রয়ী বিশ্বরাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় বিকৃত গণতন্ত্রচর্চার ধারা গড়ে তোলে, কবিতায় এই পরিস্থিতির একটি মনোজগত ও সংঘবদ্ধ ছায়া পড়ে শামসুর রাহমানের ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ বইটিতে। কয়েক বছরের মধ্যেই সৈয়দ শামসুল হক লেখেন ‘স্মৃতিমেধ’ নামের উপন্যাস, যাতে স্বাধীনতার দশ বছর পর শহীদ এক মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী জিনাত নিজেই নিজেকে অপমানিত করার মধ্যে দিয়ে প্রস্তুতি নেয় মুক্তিযোদ্ধাদের লুপ্ত স্মৃতি ফিরিয়ে আনার। এক রাজাকারকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে সবাইকে অবাক, অস্থির ও আতংকিত করে তোলে সে। বিস্মিত, আহত ও ক্রুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা দেবর মুখোমুখি হয় তার ভাবি জিনাতের। আর জিনাত পাল্টা প্রশ্ন করে, তোরা রাজাকারকে মন্ত্রী বানাতে পারিস, আমি পারি না স্বামী বানাতে? এই উপন্যাস পত্রিকায় ছাপা হওয়ারও বছরপাঁচেক পর ১৯৮৭-তে আমাদের হাতে আসে শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা।’ যাকে অনেকেই প্রথমে প্রবন্ধের বই মনে করে হাতে নেন, তারপর ‘ও-অ-অ...’ বলে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেন। এ বইটি থেকেই মূলত শহীদুল জহিরকে জাদুবাস্তবতার লেখক হিসেবে অভিহিত করা হতে থাকে। যদিও অস্তিত্ববাদী দর্শনই এ লেখায় অনেক জোরালোভাবে প্রকাশিত। জাদুবাস্তবতার ফর্মকে নির্ভর করে অস্তিত্ববাদী সাহিত্য কতটুকু বিকশিত হতে পারে বাংলা সাহিত্যে এরকম একটি প্রাণবন্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিত এ বইটির মধ্যে দিয়েই দেখা দিয়েছে।

‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’র কাহিনী লতিয়ে ওঠে ১৯৮৫ সালে, ঢাকার লক্ষ্মীবাজার লেনে। এ কাহিনী প্রকৃতার্থে বাংলাদেশে ধর্মীয় রাজনীতির পথপরিক্রমার কাহিনী, যে রাজনীতি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর লুপ্ত হয়েছিল, ১৯৭৫-এর পর আবার ফিরে এসেছে মহাসমারোহে। যুদ্ধাপরাধী, যে প্রত্যয়টি ব্যবহারে ইদানীং আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি, এক অর্থে তা অনেক বেশি নিরীহ। কেননা এই প্রত্যয়টি কেবল যুদ্ধের অপরাধকেই উচ্চকিত করে, ধর্মীয় রাজনীতির নিষ্ঠুরতা এ প্রত্যয়ে ঢাকা পড়ে যায়। অথচ একাত্তরের স্মৃতি, যন্ত্রণা ও অভিজ্ঞান থেকে আমাদের কাছে ধর্মীয় রাজনীতি যুদ্ধাপরাধের সমার্থক। রাজাকার, আলবদর বা আলশামস প্রত্যয়গুলির প্রয়োগ বরং তাই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অনেক ইতিহাসচেতনাজাত। যাই হোক, এটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু এইসব প্রসঙ্গও এ উপন্যাস পড়তে পড়তে কারও মনে ভিড় জমাতে পারে, কারণ শহীদুল জহিরের এ উপন্যাসে বদু মওলানা খানসেনাদের দোসর, যে একাত্তরে মানুষকে চাপাতি দিয়ে খণ্ডবিখণ্ড করে ফেলে তার বাড়ির ছাদ থেকে জনতার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। এই বদু মওলানারই ছেলে আবুল খায়ের তার পিতার চেতনাসমেত মহাসমারোহে ফিরে আসে লক্ষ্মীবাজার লেনে। আবুল খায়ের আবিষ্কার করে মেয়ের নাম মোমেনা রাখার মধ্যে দিয়ে এই মহল্লার এক অর্বাচীন প্রকারান্তরে তার প্রতি, তার আদর্শের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। কেননা একাত্তরে ওই অর্বাচীনের বোন মোমেনাকেই তো তারা ধর্ষণ করেছিল। তার মানে একাত্তরকে এ বান্দা ভুলে যায় নি। আবদুল মজিদ,- আবুল খায়েরকে ভাষণ দিতে দেখে সে, দ্বিধান্বিত হয় এবং দ্বিধার এ জগত ক্রমশ বাড়তে থাকে। তার এই দ্বিধাকে আরও স্থায়ী করে শঙ্কার পর্যায়ে উন্নীত করে এলাকাবাসী,- যারা বদু মওলানার ভয়ে ভীত- নিজেদের বাড়ি থেকে উৎপাটিত হওয়ার ও নির্যাতিত হওয়ার কিংবা আবারও চাপাতির কোপে খণ্ডবিখণ্ড হওয়ার ভয়ে যাদের পক্ষে সম্ভব নয় আর জেগে ওঠা। সৈয়দ হকের ‘স্মৃতিমেধ’-এর সঙ্গে শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’র কাহিনীর একটি শ্রেণিরূপ তফাৎ সুস্পষ্ট। ‘স্মৃতিমেধ’-এ পুরুষেরা, মধ্যবিত্ত পুরুষেরা, তাদের ওপর, তাদের নারীদের ওপর খানসেনা ও তাদের দোসরদের ধর্ষণ-নির্যাতন ভুলে গিয়ে একই শ্রেণিতে লীন হয়ে যাচ্ছে। স্মৃতিতপ্ত মধ্যবিত্ত নারীটিকেই বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চালাতে হচ্ছে নিজের ইতিহাসগত অস্তিত্ব। আর শহীদুল জহিরের উপন্যাসে নি¤œমধ্যবিত্ত পুরুষ নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করার চেষ্টা চালাচ্ছে তার আত্মার নিগড়ে বাঁধা এক নারীর স্মৃতিকে ঘিরে নতুন এক নারীর উদ্বোধনের মাধ্যমে।

শহীদুল জহিরের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ তাঁর প্রথম উপন্যাসের মতোই মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সময়ের গল্প। অবক্ষয়িত সময়, গুপ্ত সব হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি এখানে শান্ত সমাহিত পূর্ণিমা রাতের নিচে। গোপন রাজনীতিতে ক্ষতবিক্ষত হতে হতে বুর্জোয়া ও সাম্যবাদী উভয় রাজনৈতিক শক্তিরই ধর্মীয় রাজনীতির কাছে পরাস্ত হওয়ার আখ্যান তুলে ধরার প্রয়াস রয়েছে এতে। সপরিবারে একটি হিন্দুপরিবারকে হত্যা করার অভিজ্ঞতাকে মূলসূত্র ধরে শহীদুল জহির এ ঘটনাকে নিজের সমস্ত প্রাণশক্তি দিয়ে উন্নীত করেন এমন এক অভিজ্ঞানে, যার ফলে খুব সাধারণ পাঠকও বুঝতে পারেন এটি আসলে শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার রূপক উপাখ্যান। বন্যার স্রোতের মতো বাক্যের পর বাক্য বেরিয়ে আসে এ উপন্যাসে, প্রায়ই আমাদের মনে থাকে না কে এসব বাক্যের কথক, লেখক নিজে নাকি কোনও চরিত্র, নাকি কোনও প্রতিচরিত্র। ‘চাঁদের অমাবস্যা’র বিভ্রমও রয়েছে একইসঙ্গে। শহীদুল জহিরের আলোচকরা বিশেষত এ উপন্যাসটিকেই জাদুবাস্তবতার প্রামাণ্য বই হিসেবে উপস্থাপন করে আসছেন।

আমার মনে হয়, জাদুবাস্তবতার যোগ যতটুকুই থাক না কেন, শহীদুল জহিরের সাহিত্য আলোচনার জন্যে এ প্রত্যয়টি যথেষ্ট নয়। ২০০৫-এ বাংলা সাহিত্যের জাদুবাস্তবতাসংক্রান্ত এক লেখায়ও প্রসঙ্গক্রমে আমি লিখেছিলাম, ‘এইসব ছাপ ছাড়াও শহীদুল জহির টিকে থাকতে পারেন, তাঁর কথাসাহিত্যের একটি উপসংহার তৈরি করতে পারেন।’ এ ছাড়াও লিখেছিলাম, ‘‘যে জন্যে তাঁর লেখার প্রতি আমাদের মনোযোগ ও মোহাচ্ছন্নতা তৈরি হয় তা হলো লোকজ উপাদান, ভূগোলের প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ এবং একই প্রসঙ্গে ঘুরপাক খাওয়ার মতো গ্রামীণ (গ্রাম্য নয়) ভাষাভঙ্গি। বিশেষত এই ভাষাভঙ্গির কারণে নগরের কাহিনীতে প্রবেশ করার পরও শহীদুল জহির পাঠকের কাছে স্বস্তিকর মনে হয়, কেননা আমরা আসলে নিজেদের মধ্যে পরিক্রমণ করতেই ভালবাসি এবং এই ভাষাভঙ্গি পুনরাবৃত্তির মধ্যে দিয়ে অপার এক দুলুনি তৈরি করে। কিন্তু এসবের পাশাপাশি ইতিহাসবোধের প্রতি উপেক্ষা অথবা অমনোযোগ শহীদুল জহিরের লেখা ও অনুভূতির বিস্তৃতিকে সীমিত করে ফেলতে পারে, যা আমরা বিশেষ করে তাঁর সব উপন্যাসেই লক্ষ্য করি। তাঁর ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ কিংবা ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ উপন্যাসে আমরা একটি জাতির জাদুবাস্তবতাময় ক্রান্তিকাল খুঁজে পাই বটে, কিন্তু তা কি আমাদের মধ্যে সেই জাতির হাজার বছরের মিশে যাওয়া ইতিহাসবোধের ক্ষরণ ঘটাতে পারে? না কি আমরা হঠাৎ হোঁচট খেয়ে থেমে গিয়ে সীমিত এক পরিসরেই আনন্দিত হতে থাকি?’’ তাঁর মুগ্ধ পাঠকদের দলে থেকেও এ রকম একটি মন্তব্য করায় তিনি কী মনে করেছিলেন, সেটি আমার আর কোনওদিনই জানা হবে না।

তিন.

মৃত্যুগন্ধী এই সময়ে পুরানো ওই অনুভূতিটুকু আবারও উল্লেখ করছি শুধু এ কারণেই যে অপরিচয়ের বদলে তাঁর সঙ্গে পরিচিত হওয়াটাই যৌক্তিক ছিল আমার চিন্তাগুলোকে আরও পরিণত করতে। যদি আমার তাঁর সঙ্গে পরিচয় হতো, যদি আমরা একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলতাম, তা হলে নিশ্চয়ই তাঁর লেখার এরকম সব দিকই হতো তাঁর ও আমার আলোচনার বিষয়। এখন তাঁর সঙ্গে আর কারোরই দেখা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।

এমন হয়েছে, কয়েকবারই আমাদের দেখা হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে আমাদের বন্ধু গল্পকার ও সরকারি কর্মকর্তা ফয়জুল ইসলামের কারণে। আমি আগ্রহী হয়েছি সেই মানুষটিকে দেখতে, যার বিছানা বরাবর একটি টিভি এমনভাবে প্রতিস্থাপন করা যাতে মানুষটি শুয়ে থেকেও আরাম করে রিমোট ঘুরিয়ে টিভি দেখতে পারে। তাঁর সম্পর্কে ওপরের স্পর্শকাতর বিভিন্ন সব বাক্য লেখার ও ছাপানোর পর আমি তাঁকে আমার তখনকার সর্বশেষ বইটি (মাৎস্যন্যায়ের বাকপ্রতিমা) পাঠাই পাঠ করতে। এবং কয়েকদিন পরে উত্তেজিত কিংবা নিরুত্তেজিত ফয়জুল ইসলাম আমাকে বলে, ‘স্যার তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছে।’ এই বলাবলি বেশ কয়েকবার ঘটে, আবদুল করিমের গ্লাস ভেঙে জানালার পাশে রাখার মতো। কখনও আমি হাসি, ‘যেতে তো হবেই, আপনি ওনাকে স্যার বলেন, আর আমি তাকে ভাই বলব। আপনি কীভাবে স্যার বলেন সেটা তো আমাকে দেখতে হবে।’ কখনও ফয়জুল আমাকে শোনায়, শহীদুল জহির কার কার লেখার প্রশংসা করেছেন। শুনতে শুনতে বলি, ‘বড় লেখকরা সব সময়েই প্রশংসা করেন। এমনকি খারাপ লেখকদের লেখায়ও মহৎ উপাদান খুঁজে পান। উত্তেজিত হবেন না, ধৈর্য হারাবেন না।’

আসলেই যদি তাঁর কাছে আমরা যেতাম তা হলে কী হতো আমাদের কথাবার্তার বিষয়আশয়? এই জাদুবাস্তবতার ঘোর? অথবা অস্তিত্ববাদ? অথবা বাস্তবতা ও সুরিয়ালিজম? অথবা এসব কিছুই নয়! আমরা কথা বলতাম দুর্ধর্ষ নকশালী ইসমাইলকে নিয়ে,- বাংলাদেশের পতাকা যে সবসময় মাথায় বেঁধে রাখত যুদ্ধকালে আর স্বাধীন সিরাজগঞ্জ শহরে প্রথম প্রবেশ করেছিল যার বাহিনী। অথচ পরে যে পুরো বাহিনীই খুন হয়ে গেল নিজেদের মধ্যেই যুদ্ধ করে! হয়তো কথা বলতাম ফিরোজ মাস্টারকে নিয়ে, গণবাহিনী নিয়ে, গোপন রাজনীতি নিয়ে, ধর্মজ রাজনীতির হিংস্র কদর্য মানুষগুলিকে হত্যা না করে কেন গোপন রাজনীতির মানুষগুলো কেবল নিজেদের মধ্যেই হানাহানি করেছে সেসব নিয়ে। আর মুক্তিযুদ্ধ,- সে কথাও নিশ্চয়ই উঠত। বিষয় হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাঁর দুর্বলতার কথা কে না জানে! আর এই জন্যে তো জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পোস্টিং পেয়ে তিনি বিব্রতও হয়েছিলেন ভীষণরকম। যে কার্যালয়ে পোস্টিং পাওয়ার জন্যে সরকারি কর্মকর্তারা তদ্বির করেন, সে কার্যালয় থেকে অন্যখানে পোস্টিং পাওয়ার পর তিনি পেয়েছিলেন মহামুক্তির আস্বাদ।

প্রবাদ হিসেবে এটি প্রতিষ্ঠিত, নিজেকে শহীদুল জহির সরিয়ে রেখেছিলেন আর সব লেখক থেকে অনেক দূরে। কিন্তু মানুষ থেকেও কি? যাকে তাঁর একাকিত্ব ও নির্জনতা বলছি সেটিকে কি আমরা ব্যাখ্যা করব শুধু লেখকদের আড্ডায় তাঁর অনুপস্থিতির তত্ত্ব দিয়ে? ছাত্র রাজনীতির সংগঠক ছিলেন তিনি; একাকিত্ব ও নির্জনতা তাঁকে যতই ঘিরুক, এরকম মানুষের পক্ষে কি সম্ভব মানুষ থেকে দূরে থাকা? রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে, ধরা যাক একা-একাই, চা পান করতে করতে তিনি কি শুনতেন না মানুষের কথা? এই যে এত মানুষ, এত চরিত্র, এত অঞ্চলভাষা তা তিনি পেলেন কোথা থেকে? বেশ কয়েক বছর আগে ‘কথা’ পত্রিকায় কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের নেয়া তাঁর একটি সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম। উত্তর দেয়ার ভাষাভঙ্গি থেকে মনে হয়েছিল, মানুষ থেকে তিনি যত নির্জনে ছিলেন বলে শোনা যায় তত নির্জনে ছিলেন না সম্ভবত। মিডিয়া থেকে দূরে ছিলেন এবং এই দূরত্বই তাঁকে এ ছাপ এঁটে দিয়েছে। কেননা লেখক হিসেবে মিডিয়ার প্রতি অনেকের যে দাসত্ব রয়েছে, শহীদুল জহিরের দাসত্বহীনতা সে ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয়, অনুকরণীয়। দাসত্বের গ্লানি ঢাকার জন্যে আমাদের পক্ষ থেকে তাঁকে তাই ঠেলে দেয়া হয়েছে নির্জনতার প্রকোষ্ঠে।

শহীদুল জহিরের কাছে শেষ পর্যন্ত যাওয়া হলো না, কেননা মোটা দাগে বলতে গেলে ফয়জুল ইসলামের সঙ্গেও আমার দেখাসাক্ষাৎ কমে এসেছিল। কেন, সেটা খুবই ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে দূরত্বও অনেক দূরত্ব কমিয়ে আনে। ফয়জুলই আমাকে তাঁর মৃত্যুসংবাদ জানালেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। আমি সেই মৃত্যুর দৃশ্যকল্পের অনেকটাই অনুমান করতে পারলাম, কেননা আমি নিজেও দীর্ঘকাল একা থাকতে অভ্যস্ত। আমি দেখতে পেলাম, একজন মানুষ ভর দুপুরে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে কষ্ট পাচ্ছেন। মুগ্ধ পাঠকদের কেউ কাছে নেই, পদাধিকার বলে অনেক ক্ষমতা থাকলেও সেই সময় ‘জ্বি স্যার’ বলার মতো কেউই নেই তাঁর কাছে। তিনি অনেক কষ্টে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে নামতে নামতে একসময় নোংরা সিঁড়িতেই বসে পড়লেন। দুপুরের উজ্জ্বল আলো পৃথিবীর সবখানে। ইস্কাটনের ওইসব সরকারি বাসাগুলো দেখার ভাগ্য আমাদের অনেকেরই আছে। তিনি তাঁর অস্তিত্ব ঘোষণা করার চেষ্টা করছেন চারপাশের উজ্জ্বল আলোর কাছে। চেষ্টা করছেন বসন্তের বাতাস টেনে নিতে অবাধ্য বুকের ভেতর। অপেক্ষা করছেন নিজস্ব এক জাদুবাস্তবতার। টেলিফোন করছেন বোনের ছেলের কাছে। কিন্তু দিঘল দুপুরের ব্যস্ততায় মানুষের কানে রিংটোন খুব সহজে পৌঁছায় না, তা সে যত আপনই হোক না কেন। কেউ তাঁর কোনও কাজে আসে নি, কেবল তাঁকে মানুষ ভেবে হঠাৎ করেই তাঁকে দেখে ছুটে এসেছে ‘সামান্য’ এক কাজের মানুষ। সে তাঁকে হলি ফ্যামিলিতে পৌঁছে দিয়েছে রিকশায় তুলে। তারপর ডাক্তারদের প্রসঙ্গ না হয় থাক। মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আমরা তাঁর অনেক নিঃসঙ্গতা ও মহীয়ানতার সন্ধান পেয়েছি, তিনি তাই নিয়ে বেঁচে থাকুন এই পৃথিবীতে।

চার.

ইংল্যান্ডে তুষার পড়লেও লন্ডনে তুষারপাত বিরল এক ঘটনা। গুড ফ্রাইডেতে হঠাৎ করেই ঘোষণা আসে, আগামীকাল থেকে তুষার পড়তে পারে। ওই রাতে আমি অনেকদিন পর সিগারেট কিনি আসন্ন হিমের আশংকায়। শনিবার সকালে দেখি, সত্যিই এই মার্চের দিনে, যখন সামার খুব কাছে চলে এসেছে, ঝিরঝির তুষার পড়ছে আকাশ থেকে। পরদিন রবিবার, সকাল নয়টা পেরিয়ে গেছে আর তখনও আমি শুয়ে, স্ত্রী বাইরে থেকে টেলিফোন করে আমাকে আবারও তুষারপাতের খবর জানায়। আমি ওঠার পর জানালা খুলে মুখে একটু বরফ মেখে অভ্যাসবশত ই-মেইল চেক করতে বসি এবং ইনবক্সের প্রথমেই চোখ আটকে যায় ফয়জুল ইসলামের চিঠিটিতে : ‘শহীদুল জহির হ্যাজ ডায়েজ টুডে : লাইফ ইজ মোর পাওয়ারফুল দ্যান ডেথ।’ আমার চ্যাটিংবক্সে লালবৃত্ত জ্বলজ্বল করছে, কিন্তু মাহবুব মোর্শেদ সেই লাল বৃত্ত পেরিয়ে একই মেসেজ দেয়। আমি এইসব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে জানালার পাশে এসে দাঁড়াই।

দেখি সমস্ত প্রাকৃতিক নিয়ম ভঙ্গ করে আমার প্রিয় বাংলাদেশের কার্পাস তুলোর মতো পেঁজা পেঁজা শাদা শাদা নৃত্যরতা তুষার ঝরে পড়ছে, গলে পড়ছে জানালার কাঁচে, রাস্তার ওপরে, লাইটপোস্টের গায়ে, ওক আর চেরিনাস্ট গাছের গায়ে। মনে হচ্ছে, যে প্রকৃতি এতদিন নীরবে তাঁর সঙ্গী ছিল সেই প্রকৃতি আজ ভেঙে পড়ছে শহীদুল জহিরের শোকে। এই কদিন আগেই এক প্রিয় মানুষকে আমি লিখেছিলাম, মানুষকে বাঁ হাতের উল্টো পিঠে কান্না মুছে হাসি আনতে হয়। আজ আমিও সেই চেষ্টা করি, কাঁপা কাঁপা হাতে তুষারের দিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে সিগারেট জ্বালানোর চেষ্টা করি, মনে মনে বলি, যিশু চলে গেছেন, যিশু তুষারে ঢেকে যাচ্ছেন।

বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ , ৩০ ভাদ্র ১৪৩০, ২৮ সফর ১৪৪৫

সেদিন হঠাৎ তুষার ঝরেছিল

ইমতিয়ার শামীম

image

শহীদুল জহিরের সঙ্গে আমার মুখোমুখি পরিচয় ছিল না। দশকওয়ারি সাহিত্যবিভাজনে বিশ্বাসী সম্পাদক ও আলোচকরা যাদের গায়ে আশির দশকের ছাপ লাগিয়েছিলেন, শহীদুল জহিরসহ আমাদের অনেকের গায়েই সেই ছাপ এতদিনে সুস্পষ্টভাবে বসে গেছে অনেকটা জন্মদাগের মতো। সত্যিকারের জন্মকথা হিসেবে নিলে তিনি আমার একযুগ আগে পৃথিবীতে এসেছেন। তবু এখন সম্পাদক ও আলোচকদের প্রতি কৃতজ্ঞ আমি,- তাঁরা আমাদের একই সময়ের বৃত্তে বেঁধেছেন জন্যে। আশির দশকের উল্লেখযোগ্য সব লেখকের সঙ্গেই কোনও না কোনও সময় আমার কথা হয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু শহীদুল জহির। তাঁকে আমি মুখোমুখি দেখি নি। তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়নি।

কালাকালের অর্থে এই দেখা হওয়া না-হওয়া অবশ্য কোনও বড় ব্যাপার নয়। কিন্তু মানুষ যখন বেদনার্ত হয় তখন মহাকালের কথা ভেবে হয় না। মৃত্যুগন্ধী সময়ের আবেগই তাঁর কাছে বড় হয়ে ওঠে। এ জন্যেই হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তিটির কথা বলতে গিয়ে হয়তো ব্যক্তিটির সঙ্গে স্মৃতিচারকের স্মৃতিগুলিই বড় হয়ে ওঠে। যতক্ষণ না তা হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তিটির কাঁধে ভর করে নিজেকেই বড় করে তোলার মতো কিছু না হয় ততক্ষণ তা দৃষ্টিকটূও নয়। সত্যিকার অর্থে মানুষটির প্রতি ব্যক্তিগত মুগ্ধতার স্মৃতি ছাড়া এইসব সময়ে অন্য কোনও বয়ান খুব বেশি প্রীতিকর মনে হয় না। অথচ তেমন কোনও সঞ্চয়ই নেই আমার, যা দিয়ে আমি তাঁর সঙ্গে একটু ব্যক্তিগত হতে পারি।

তারপরও কোনও না কোনওভাবে তিনি আমার ব্যক্তিগত আত্মার সঙ্গী। কারণ ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁর পাঠক এবং আমরা একই সময়ের মানুষ। কারণ যে জনপদ আর মানুষগুলো তাঁর জনপ্রিয় ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ উপন্যাসে বেড়ে ওঠে, বেড়ে ওঠে বেশ ক’টি ছোটগল্পে, কাকতালীয়ভাবে হলেও তাঁর মতো আমিও সেই জনপদের মানুষ। তাঁর মতো আমারও বাবার ভিটে সিরাজগঞ্জ জেলাতে। তাঁর রায়গঞ্জ আমার চেনা জায়গা, চেনা ওই গোপন রাজনীতির ক্ষত ও ক্ষতি। ‘ক্ষত যত ক্ষতি তত’ এই সত্যেরই তো মুখোমুখি করেন তিনি তাঁর কথাসাহিত্যে। আমরা আমাদের শৈশব কৈশোরের দিনগুলোয় জনপদের সেই ক্ষত ও ক্ষতিকে দেখেছি রক্তপাতের মধ্যে দিয়ে, অশ্রুপাতের মধ্যে দিয়ে। এমনকি যখন আমরা প্রায়উন্মূল হয়েছি সিরাজগঞ্জ থেকে এবং বিশেষত সিরাজগঞ্জ শহরবাসী কারও টেলিফোন পেলেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি কারও মৃত্যু অথবা দুর্ঘটনার খবর পেতে, এই ক্ষত ও ক্ষতি তখন আরও ঘনিষ্ঠ সঙ্গী হয়েছে। যেমন, এক সকালে এক বন্ধুর ফোন পেয়ে আমি জানতে পারি ফিরোজ মাস্টার খুন হয়েছেন। ফিরোজ মাস্টার ছিলেন সিরাজগঞ্জ জনপদে গোপন রাজনীতির এক কিংবদন্তি। গোপন রাজনৈতিক জীবন পেরিয়ে তিনি তখন একটি ডানপন্থী দলে যোগ দিয়ে নির্জন জীবনযাপনের পথ বেঁছে নিয়েছেন। প্রতিদিন রাতে খাওয়ার পর বাড়ি থেকে বের হন এবং হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে একটি কালভার্টের ওপর গিয়ে কিছুক্ষণ একা একা বসে থাকেন। এক রাতে তিনি হাঁটতে বেরিয়ে আর ফিরে আসেন না। তাঁকে উদ্ধার করা হয় নিহত অবস্থায়।

আরও একদিন গভীর রাতে খবর এলো, ভয়ানক এক গাড়িদুর্ঘটনা ঘটেছে বগুড়া মহাসড়কে। নিহত হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা ও একদা গণবাহিনীর সংগঠক মির্জা আবদুল আজিজ ও ম. মামুন। গুরুতর আহত আরেকজন গণবাহিনীর সংগঠক ও জাসদ নেতা আবদুল হাই। ম. মামুন ছিলেন গোপন রাজনীতির কালে ফিরোজ মাস্টারের প্রিয় অনুসারী। তারুণ্যে কামারখন্দে দিনেদুপুরে এক পুলিশ অফিসার হত্যার দায়ে ম. মামুন অভিযুক্ত হয়েছিলেন। কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে তিনি যুক্ত হন স্থানীয় একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সঙ্গে।

দূর থেকে এরকম যত মৃত্যুর খবর পেয়েছি কিংবদন্তিময় একটি সময়ের একেক সংগঠকের ততবারই কেন জানি মনে পড়েছে ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’র কথা। বললে হয়তো বিশ্বাস হবে না- কিন্তু ওই জনপদের অধিবাসী আমরা জানি- রায়গঞ্জ-কামারখন্দ-জামতৈল জনপদের কোনও কোনও এলাকার চেয়ারম্যান হওয়ার মানে জেনেশুনে নিজের মৃত্যু ডেকে আনা। অথচ সেই মৃত্যুর মোহে প্রতিবারই কেউ না কেউ নির্বাচন করে, চেয়ারম্যান হয় এবং কোনও এক রাতে অথবা দিনে খুন হয়ে যায়।

এও এক জাদুবাস্তবতাই বটে!

দুই.

ক্ষত ও ক্ষতি নিয়ে এইভাবে আমরা সিরাজগঞ্জ থেকে প্রায়উন্মূল হয়েছি, প্রায় সম্পর্কহীন হয়ে পড়েছি সিরাজগঞ্জের সঙ্গে, পৃথিবীমুখী হয়েছি তারপর আমাদের প্রিয় মার্কেজের বুয়েন্দিয়ার মতো। মাকের্জের উপন্যাস ‘হাজার বছরের নির্জনতা’য় গভীর এক ক্রান্তিকাল আছে। হোসে আর্কাদিও বুুয়েন্দিয়া সেখানে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে আবারও দূর অভিযানে বের হওয়ার। কিন্তু তার স্ত্রী উরসুলা কিছুতেই রাজি হয় না বসতি ত্যাগ করতে। বুয়েন্দিয়া তাকে বলে, দূরঅভিযানে যেতে তার কোনও অসুবিধা নেই, পিছুটানও নেই, কেননা ‘এখনও এখানে আমাদের কেউ মারা যায় নি। মরে মাটির তলায় আত্মীয় কেউ না শোয়া পর্যন্ত কোনও জায়গায় কারও অধিকার বা প্রেম জন্মায় না।’ বুয়েন্দিয়ার এ কথা শুনে তার বউ উরসুলা শান্ত কঠিন কণ্ঠে বলে, ‘তা হলে আমি এখানেই মরব, যাতে তোমরা সবাই এখানেই থাকো।’ মানুষের মাটি, স্বদেশ ও বসতি গড়ে ওঠে এরকম সব বুয়েন্দিয়ার আত্মার হাহাকার দিয়ে, এরকম সব উরসুলার হৃদয়ের শোক দিয়ে।

শহীদুল জহিরের গ্রামের বাড়ি ছিল রায়গঞ্জে, কিন্তু তিনি জন্ম নিয়েছিলেন পুরানো ঢাকায়। নিজের এক বসতি তিনি স্থাপন করতে চেয়েছেন তাঁর সব গল্পউপন্যাসের মধ্যে দিয়ে। সেইখানে কখনও তরমুজের ঘ্রাণ পাওয়া যায়, ডালপুরিভাসা তেল টগবগিয়ে ফোটে, ইঁদুর ও বিড়াল খেলা করে, আবদুল করিম বারবার কাচের গ্লাস ভেঙে জানালার পাশে রাখে, পাতকুয়ায় সুবোধচন্দ্র ও তার স্ত্রী স্বপ্না বারবার পড়ে যায়। কখনও আবার তিনি যেনবা জেনেশুনেই সংখ্যালঘু হয়ে যান, বিচ্ছিন্নতার বদলে ডুবে যান সংখ্যালঘুতার বিপন্নতায়। কিন্তু নিজের এই বসতি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার তাগিদ তাঁর মধ্যে কখনোই জন্মায় নি। তিনি তাঁর আত্মা ও হৃদয়ের হাহাকার ও শোক নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন নিজস্ব ভূগোলে। বিবিধ অঞ্চল ও আঞ্চলিক ভাষাকে তিনি অবলম্বন করেছেন বিভিন্ন গল্পে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বজায় রেখেছেন ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ উপন্যাসের উপস্থাপনস্বর।

আমাদের সেই জনপদের একঘেয়ে মুথা ও মেঠো সমতল, খরখরে গ্রীষ্মের দাবদাহ সঞ্চয় করে রাখা প্রায়উৎপাটিত নিঃসঙ্গ বটগাছ, আঁকাবাঁকা মেঠোরাস্তা, অথবা বর্ষায় ডুবে যাওয়া রুপালি আকাশ, কর্দমাক্ত রাস্তা এবং একজন চেয়ারম্যান খুন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খুন হওয়ার জন্যে প্রস্তুত আরও সব হবু চেয়ারম্যান, এসব কিছুই শহীদুল জহির একে একে কব্জা করে নিয়েছিলেন। তাঁর মতো আর কেউ জানে নি, এইসব জনপদ ও মানুষের জীবন ও বাস্তবতা কেবলই গল্প হয়ে যায়। আমাদের গ্রামগুলোর মানুষের গল্প, জীবন, হতাশা, সংগ্রাম আর যৌনতাও এত বিচিত্র যে এই আমিও যখন তা এমনকি সিরাজগঞ্জেরই কাউকে শোনাই, শুনতে শুনতে তারা বলে, ‘এইসব আজগুবি গল্প কোনখানে পাই’ছো? সলপের গল্প, না?’ ভেবে দেখুন, ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত একজন মানুষ দণ্ডিত হওয়ার পর্ব এড়াতে গ্রামের সালিশে অজ্ঞান হয়ে গেল। কিছুতেই তার সংজ্ঞা আর ফিরিয়ে আনাই যাচ্ছে না। দাঁতের মধ্যে চামচ ঢুকিয়ে চেষ্টা করা হচ্ছে তাকে পানি খাওয়ানোর। কিন্তু সে পণ করেছে কিছুতেই কিছু খাবে না। হঠাৎ একজন কী মনে করে একগ্লাস দুধ এনে ঠোঁটের ওপর রাখতেই অজ্ঞান মানুষটা গরুর দুধের ঘ্রাণ পেয়ে ধর্ষণের দায়ে দণ্ডিত হওয়ার যাবতীয় আশংকা ভুলে ঢক ঢক করে তা গিলে ফেলল। আবার এই মানুষটিই যখন প্রবীণ আর স্মৃতিভ্রষ্টতায় আক্রান্ত, একদিন হঠাৎ তার পাড়াপড়শিদের সম্পর্কে দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করার প্রতিজ্ঞা ঘোষণা করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সেই যে ট্রেনে চড়ল, নিজের এলাকার নাম মনে না থাকায় সে আর পারল না নিজের বাড়িতেও ফিরে আসতে। গ্রামের মানুষদের কাছে সে একশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও বেঁচে আছে নিরুদ্দেশ এক গ্রামবাসী হিসেবে। কেউ আবার বুড়ো হয়ে গেল প্রচণ্ড বর্ষার সময় বোয়াল মাছের গ্রাসে অণ্ডকোষ হারানোর স্মৃতি নিয়ে। আবার যুদ্ধ যখন চলছে, তখন এমন একজন মানুষকে পাওয়া গেল, যে মৃত, অর্ধমৃত সব খানসেনা আর রাজাকারদের লিঙ্গ কেটে একটি টুকরিতে জমাতে লাগল। জালিম খানসেনা আর তার দোসরদের জন্মক্ষমতাই সে নষ্ট করে দেবে, এই তার একমাত্র আকাক্সক্ষা।

এরকম এক জনপদ যেখানে সত্যিই রয়েছে সেখানে শুধুমাত্র জাদুবাস্তবতা দিয়ে শহীদুল জহিরকে বিচার করতে যাওয়া এক অর্থে তাঁর প্রতি অবিচার করা। আমি অবশ্য তাঁর পাঠক হই অনেক পরে। সম্ভবত ১৯৯৩ সালে। মারুফ রায়হানের আগ্রহে ‘মাটি’ পত্রিকার গল্পসংখ্যায় শহীদুল জহির লেখেন ‘আমাদের কুটিরশিল্প’, আমি লিখি ‘বালকের বামহাত’। ততদিনে তিনি ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ লিখে সুপরিচিত। কিন্তু আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটল তাঁর গল্প পড়ার মধ্যে দিয়ে। তাঁর লেখার শক্তিমত্তা নিয়ে আমার কোনও সংশয় ছিল না, এখনও নেই; কিন্তু তাঁকে ‘জাদুবাস্তবতার’ ঘেরাটোপে বন্দি করতে আমি বরাবরই দ্বিধান্বিত হয়েছি। অনেক পরে বাংলাপিডিয়াতে একটি সংক্ষিপ্ত মন্তব্য পাই তাঁর সম্পর্কে, সেটিকেই বরং অনেক ঠিক মনে হয়। তাঁর লেখার অন্যতর একটি রূপ তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে সেখানটাতে, বলা হয়েছে শহীদুল জহিরের ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’তে প্রকাশ পেয়েছে বাস্তবতা ও সুরিয়ালিজম।

এর মধ্যে শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’র বিশ বছর পার হয়েছে গত বছর। আমাদের বুর্জোয়া রাজনীতির ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপে যে রক্তাক্ত অধ্যায় তৈরি হয় এবং ক্রমাগত যা ধর্মাশ্রয়ী বিশ্বরাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় বিকৃত গণতন্ত্রচর্চার ধারা গড়ে তোলে, কবিতায় এই পরিস্থিতির একটি মনোজগত ও সংঘবদ্ধ ছায়া পড়ে শামসুর রাহমানের ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ বইটিতে। কয়েক বছরের মধ্যেই সৈয়দ শামসুল হক লেখেন ‘স্মৃতিমেধ’ নামের উপন্যাস, যাতে স্বাধীনতার দশ বছর পর শহীদ এক মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী জিনাত নিজেই নিজেকে অপমানিত করার মধ্যে দিয়ে প্রস্তুতি নেয় মুক্তিযোদ্ধাদের লুপ্ত স্মৃতি ফিরিয়ে আনার। এক রাজাকারকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে সবাইকে অবাক, অস্থির ও আতংকিত করে তোলে সে। বিস্মিত, আহত ও ক্রুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা দেবর মুখোমুখি হয় তার ভাবি জিনাতের। আর জিনাত পাল্টা প্রশ্ন করে, তোরা রাজাকারকে মন্ত্রী বানাতে পারিস, আমি পারি না স্বামী বানাতে? এই উপন্যাস পত্রিকায় ছাপা হওয়ারও বছরপাঁচেক পর ১৯৮৭-তে আমাদের হাতে আসে শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা।’ যাকে অনেকেই প্রথমে প্রবন্ধের বই মনে করে হাতে নেন, তারপর ‘ও-অ-অ...’ বলে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেন। এ বইটি থেকেই মূলত শহীদুল জহিরকে জাদুবাস্তবতার লেখক হিসেবে অভিহিত করা হতে থাকে। যদিও অস্তিত্ববাদী দর্শনই এ লেখায় অনেক জোরালোভাবে প্রকাশিত। জাদুবাস্তবতার ফর্মকে নির্ভর করে অস্তিত্ববাদী সাহিত্য কতটুকু বিকশিত হতে পারে বাংলা সাহিত্যে এরকম একটি প্রাণবন্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিত এ বইটির মধ্যে দিয়েই দেখা দিয়েছে।

‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’র কাহিনী লতিয়ে ওঠে ১৯৮৫ সালে, ঢাকার লক্ষ্মীবাজার লেনে। এ কাহিনী প্রকৃতার্থে বাংলাদেশে ধর্মীয় রাজনীতির পথপরিক্রমার কাহিনী, যে রাজনীতি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর লুপ্ত হয়েছিল, ১৯৭৫-এর পর আবার ফিরে এসেছে মহাসমারোহে। যুদ্ধাপরাধী, যে প্রত্যয়টি ব্যবহারে ইদানীং আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি, এক অর্থে তা অনেক বেশি নিরীহ। কেননা এই প্রত্যয়টি কেবল যুদ্ধের অপরাধকেই উচ্চকিত করে, ধর্মীয় রাজনীতির নিষ্ঠুরতা এ প্রত্যয়ে ঢাকা পড়ে যায়। অথচ একাত্তরের স্মৃতি, যন্ত্রণা ও অভিজ্ঞান থেকে আমাদের কাছে ধর্মীয় রাজনীতি যুদ্ধাপরাধের সমার্থক। রাজাকার, আলবদর বা আলশামস প্রত্যয়গুলির প্রয়োগ বরং তাই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অনেক ইতিহাসচেতনাজাত। যাই হোক, এটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু এইসব প্রসঙ্গও এ উপন্যাস পড়তে পড়তে কারও মনে ভিড় জমাতে পারে, কারণ শহীদুল জহিরের এ উপন্যাসে বদু মওলানা খানসেনাদের দোসর, যে একাত্তরে মানুষকে চাপাতি দিয়ে খণ্ডবিখণ্ড করে ফেলে তার বাড়ির ছাদ থেকে জনতার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। এই বদু মওলানারই ছেলে আবুল খায়ের তার পিতার চেতনাসমেত মহাসমারোহে ফিরে আসে লক্ষ্মীবাজার লেনে। আবুল খায়ের আবিষ্কার করে মেয়ের নাম মোমেনা রাখার মধ্যে দিয়ে এই মহল্লার এক অর্বাচীন প্রকারান্তরে তার প্রতি, তার আদর্শের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। কেননা একাত্তরে ওই অর্বাচীনের বোন মোমেনাকেই তো তারা ধর্ষণ করেছিল। তার মানে একাত্তরকে এ বান্দা ভুলে যায় নি। আবদুল মজিদ,- আবুল খায়েরকে ভাষণ দিতে দেখে সে, দ্বিধান্বিত হয় এবং দ্বিধার এ জগত ক্রমশ বাড়তে থাকে। তার এই দ্বিধাকে আরও স্থায়ী করে শঙ্কার পর্যায়ে উন্নীত করে এলাকাবাসী,- যারা বদু মওলানার ভয়ে ভীত- নিজেদের বাড়ি থেকে উৎপাটিত হওয়ার ও নির্যাতিত হওয়ার কিংবা আবারও চাপাতির কোপে খণ্ডবিখণ্ড হওয়ার ভয়ে যাদের পক্ষে সম্ভব নয় আর জেগে ওঠা। সৈয়দ হকের ‘স্মৃতিমেধ’-এর সঙ্গে শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’র কাহিনীর একটি শ্রেণিরূপ তফাৎ সুস্পষ্ট। ‘স্মৃতিমেধ’-এ পুরুষেরা, মধ্যবিত্ত পুরুষেরা, তাদের ওপর, তাদের নারীদের ওপর খানসেনা ও তাদের দোসরদের ধর্ষণ-নির্যাতন ভুলে গিয়ে একই শ্রেণিতে লীন হয়ে যাচ্ছে। স্মৃতিতপ্ত মধ্যবিত্ত নারীটিকেই বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চালাতে হচ্ছে নিজের ইতিহাসগত অস্তিত্ব। আর শহীদুল জহিরের উপন্যাসে নি¤œমধ্যবিত্ত পুরুষ নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করার চেষ্টা চালাচ্ছে তার আত্মার নিগড়ে বাঁধা এক নারীর স্মৃতিকে ঘিরে নতুন এক নারীর উদ্বোধনের মাধ্যমে।

শহীদুল জহিরের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ তাঁর প্রথম উপন্যাসের মতোই মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সময়ের গল্প। অবক্ষয়িত সময়, গুপ্ত সব হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি এখানে শান্ত সমাহিত পূর্ণিমা রাতের নিচে। গোপন রাজনীতিতে ক্ষতবিক্ষত হতে হতে বুর্জোয়া ও সাম্যবাদী উভয় রাজনৈতিক শক্তিরই ধর্মীয় রাজনীতির কাছে পরাস্ত হওয়ার আখ্যান তুলে ধরার প্রয়াস রয়েছে এতে। সপরিবারে একটি হিন্দুপরিবারকে হত্যা করার অভিজ্ঞতাকে মূলসূত্র ধরে শহীদুল জহির এ ঘটনাকে নিজের সমস্ত প্রাণশক্তি দিয়ে উন্নীত করেন এমন এক অভিজ্ঞানে, যার ফলে খুব সাধারণ পাঠকও বুঝতে পারেন এটি আসলে শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার রূপক উপাখ্যান। বন্যার স্রোতের মতো বাক্যের পর বাক্য বেরিয়ে আসে এ উপন্যাসে, প্রায়ই আমাদের মনে থাকে না কে এসব বাক্যের কথক, লেখক নিজে নাকি কোনও চরিত্র, নাকি কোনও প্রতিচরিত্র। ‘চাঁদের অমাবস্যা’র বিভ্রমও রয়েছে একইসঙ্গে। শহীদুল জহিরের আলোচকরা বিশেষত এ উপন্যাসটিকেই জাদুবাস্তবতার প্রামাণ্য বই হিসেবে উপস্থাপন করে আসছেন।

আমার মনে হয়, জাদুবাস্তবতার যোগ যতটুকুই থাক না কেন, শহীদুল জহিরের সাহিত্য আলোচনার জন্যে এ প্রত্যয়টি যথেষ্ট নয়। ২০০৫-এ বাংলা সাহিত্যের জাদুবাস্তবতাসংক্রান্ত এক লেখায়ও প্রসঙ্গক্রমে আমি লিখেছিলাম, ‘এইসব ছাপ ছাড়াও শহীদুল জহির টিকে থাকতে পারেন, তাঁর কথাসাহিত্যের একটি উপসংহার তৈরি করতে পারেন।’ এ ছাড়াও লিখেছিলাম, ‘‘যে জন্যে তাঁর লেখার প্রতি আমাদের মনোযোগ ও মোহাচ্ছন্নতা তৈরি হয় তা হলো লোকজ উপাদান, ভূগোলের প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ এবং একই প্রসঙ্গে ঘুরপাক খাওয়ার মতো গ্রামীণ (গ্রাম্য নয়) ভাষাভঙ্গি। বিশেষত এই ভাষাভঙ্গির কারণে নগরের কাহিনীতে প্রবেশ করার পরও শহীদুল জহির পাঠকের কাছে স্বস্তিকর মনে হয়, কেননা আমরা আসলে নিজেদের মধ্যে পরিক্রমণ করতেই ভালবাসি এবং এই ভাষাভঙ্গি পুনরাবৃত্তির মধ্যে দিয়ে অপার এক দুলুনি তৈরি করে। কিন্তু এসবের পাশাপাশি ইতিহাসবোধের প্রতি উপেক্ষা অথবা অমনোযোগ শহীদুল জহিরের লেখা ও অনুভূতির বিস্তৃতিকে সীমিত করে ফেলতে পারে, যা আমরা বিশেষ করে তাঁর সব উপন্যাসেই লক্ষ্য করি। তাঁর ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ কিংবা ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ উপন্যাসে আমরা একটি জাতির জাদুবাস্তবতাময় ক্রান্তিকাল খুঁজে পাই বটে, কিন্তু তা কি আমাদের মধ্যে সেই জাতির হাজার বছরের মিশে যাওয়া ইতিহাসবোধের ক্ষরণ ঘটাতে পারে? না কি আমরা হঠাৎ হোঁচট খেয়ে থেমে গিয়ে সীমিত এক পরিসরেই আনন্দিত হতে থাকি?’’ তাঁর মুগ্ধ পাঠকদের দলে থেকেও এ রকম একটি মন্তব্য করায় তিনি কী মনে করেছিলেন, সেটি আমার আর কোনওদিনই জানা হবে না।

তিন.

মৃত্যুগন্ধী এই সময়ে পুরানো ওই অনুভূতিটুকু আবারও উল্লেখ করছি শুধু এ কারণেই যে অপরিচয়ের বদলে তাঁর সঙ্গে পরিচিত হওয়াটাই যৌক্তিক ছিল আমার চিন্তাগুলোকে আরও পরিণত করতে। যদি আমার তাঁর সঙ্গে পরিচয় হতো, যদি আমরা একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলতাম, তা হলে নিশ্চয়ই তাঁর লেখার এরকম সব দিকই হতো তাঁর ও আমার আলোচনার বিষয়। এখন তাঁর সঙ্গে আর কারোরই দেখা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।

এমন হয়েছে, কয়েকবারই আমাদের দেখা হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে আমাদের বন্ধু গল্পকার ও সরকারি কর্মকর্তা ফয়জুল ইসলামের কারণে। আমি আগ্রহী হয়েছি সেই মানুষটিকে দেখতে, যার বিছানা বরাবর একটি টিভি এমনভাবে প্রতিস্থাপন করা যাতে মানুষটি শুয়ে থেকেও আরাম করে রিমোট ঘুরিয়ে টিভি দেখতে পারে। তাঁর সম্পর্কে ওপরের স্পর্শকাতর বিভিন্ন সব বাক্য লেখার ও ছাপানোর পর আমি তাঁকে আমার তখনকার সর্বশেষ বইটি (মাৎস্যন্যায়ের বাকপ্রতিমা) পাঠাই পাঠ করতে। এবং কয়েকদিন পরে উত্তেজিত কিংবা নিরুত্তেজিত ফয়জুল ইসলাম আমাকে বলে, ‘স্যার তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছে।’ এই বলাবলি বেশ কয়েকবার ঘটে, আবদুল করিমের গ্লাস ভেঙে জানালার পাশে রাখার মতো। কখনও আমি হাসি, ‘যেতে তো হবেই, আপনি ওনাকে স্যার বলেন, আর আমি তাকে ভাই বলব। আপনি কীভাবে স্যার বলেন সেটা তো আমাকে দেখতে হবে।’ কখনও ফয়জুল আমাকে শোনায়, শহীদুল জহির কার কার লেখার প্রশংসা করেছেন। শুনতে শুনতে বলি, ‘বড় লেখকরা সব সময়েই প্রশংসা করেন। এমনকি খারাপ লেখকদের লেখায়ও মহৎ উপাদান খুঁজে পান। উত্তেজিত হবেন না, ধৈর্য হারাবেন না।’

আসলেই যদি তাঁর কাছে আমরা যেতাম তা হলে কী হতো আমাদের কথাবার্তার বিষয়আশয়? এই জাদুবাস্তবতার ঘোর? অথবা অস্তিত্ববাদ? অথবা বাস্তবতা ও সুরিয়ালিজম? অথবা এসব কিছুই নয়! আমরা কথা বলতাম দুর্ধর্ষ নকশালী ইসমাইলকে নিয়ে,- বাংলাদেশের পতাকা যে সবসময় মাথায় বেঁধে রাখত যুদ্ধকালে আর স্বাধীন সিরাজগঞ্জ শহরে প্রথম প্রবেশ করেছিল যার বাহিনী। অথচ পরে যে পুরো বাহিনীই খুন হয়ে গেল নিজেদের মধ্যেই যুদ্ধ করে! হয়তো কথা বলতাম ফিরোজ মাস্টারকে নিয়ে, গণবাহিনী নিয়ে, গোপন রাজনীতি নিয়ে, ধর্মজ রাজনীতির হিংস্র কদর্য মানুষগুলিকে হত্যা না করে কেন গোপন রাজনীতির মানুষগুলো কেবল নিজেদের মধ্যেই হানাহানি করেছে সেসব নিয়ে। আর মুক্তিযুদ্ধ,- সে কথাও নিশ্চয়ই উঠত। বিষয় হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাঁর দুর্বলতার কথা কে না জানে! আর এই জন্যে তো জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পোস্টিং পেয়ে তিনি বিব্রতও হয়েছিলেন ভীষণরকম। যে কার্যালয়ে পোস্টিং পাওয়ার জন্যে সরকারি কর্মকর্তারা তদ্বির করেন, সে কার্যালয় থেকে অন্যখানে পোস্টিং পাওয়ার পর তিনি পেয়েছিলেন মহামুক্তির আস্বাদ।

প্রবাদ হিসেবে এটি প্রতিষ্ঠিত, নিজেকে শহীদুল জহির সরিয়ে রেখেছিলেন আর সব লেখক থেকে অনেক দূরে। কিন্তু মানুষ থেকেও কি? যাকে তাঁর একাকিত্ব ও নির্জনতা বলছি সেটিকে কি আমরা ব্যাখ্যা করব শুধু লেখকদের আড্ডায় তাঁর অনুপস্থিতির তত্ত্ব দিয়ে? ছাত্র রাজনীতির সংগঠক ছিলেন তিনি; একাকিত্ব ও নির্জনতা তাঁকে যতই ঘিরুক, এরকম মানুষের পক্ষে কি সম্ভব মানুষ থেকে দূরে থাকা? রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে, ধরা যাক একা-একাই, চা পান করতে করতে তিনি কি শুনতেন না মানুষের কথা? এই যে এত মানুষ, এত চরিত্র, এত অঞ্চলভাষা তা তিনি পেলেন কোথা থেকে? বেশ কয়েক বছর আগে ‘কথা’ পত্রিকায় কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের নেয়া তাঁর একটি সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম। উত্তর দেয়ার ভাষাভঙ্গি থেকে মনে হয়েছিল, মানুষ থেকে তিনি যত নির্জনে ছিলেন বলে শোনা যায় তত নির্জনে ছিলেন না সম্ভবত। মিডিয়া থেকে দূরে ছিলেন এবং এই দূরত্বই তাঁকে এ ছাপ এঁটে দিয়েছে। কেননা লেখক হিসেবে মিডিয়ার প্রতি অনেকের যে দাসত্ব রয়েছে, শহীদুল জহিরের দাসত্বহীনতা সে ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয়, অনুকরণীয়। দাসত্বের গ্লানি ঢাকার জন্যে আমাদের পক্ষ থেকে তাঁকে তাই ঠেলে দেয়া হয়েছে নির্জনতার প্রকোষ্ঠে।

শহীদুল জহিরের কাছে শেষ পর্যন্ত যাওয়া হলো না, কেননা মোটা দাগে বলতে গেলে ফয়জুল ইসলামের সঙ্গেও আমার দেখাসাক্ষাৎ কমে এসেছিল। কেন, সেটা খুবই ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে দূরত্বও অনেক দূরত্ব কমিয়ে আনে। ফয়জুলই আমাকে তাঁর মৃত্যুসংবাদ জানালেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। আমি সেই মৃত্যুর দৃশ্যকল্পের অনেকটাই অনুমান করতে পারলাম, কেননা আমি নিজেও দীর্ঘকাল একা থাকতে অভ্যস্ত। আমি দেখতে পেলাম, একজন মানুষ ভর দুপুরে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে কষ্ট পাচ্ছেন। মুগ্ধ পাঠকদের কেউ কাছে নেই, পদাধিকার বলে অনেক ক্ষমতা থাকলেও সেই সময় ‘জ্বি স্যার’ বলার মতো কেউই নেই তাঁর কাছে। তিনি অনেক কষ্টে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে নামতে নামতে একসময় নোংরা সিঁড়িতেই বসে পড়লেন। দুপুরের উজ্জ্বল আলো পৃথিবীর সবখানে। ইস্কাটনের ওইসব সরকারি বাসাগুলো দেখার ভাগ্য আমাদের অনেকেরই আছে। তিনি তাঁর অস্তিত্ব ঘোষণা করার চেষ্টা করছেন চারপাশের উজ্জ্বল আলোর কাছে। চেষ্টা করছেন বসন্তের বাতাস টেনে নিতে অবাধ্য বুকের ভেতর। অপেক্ষা করছেন নিজস্ব এক জাদুবাস্তবতার। টেলিফোন করছেন বোনের ছেলের কাছে। কিন্তু দিঘল দুপুরের ব্যস্ততায় মানুষের কানে রিংটোন খুব সহজে পৌঁছায় না, তা সে যত আপনই হোক না কেন। কেউ তাঁর কোনও কাজে আসে নি, কেবল তাঁকে মানুষ ভেবে হঠাৎ করেই তাঁকে দেখে ছুটে এসেছে ‘সামান্য’ এক কাজের মানুষ। সে তাঁকে হলি ফ্যামিলিতে পৌঁছে দিয়েছে রিকশায় তুলে। তারপর ডাক্তারদের প্রসঙ্গ না হয় থাক। মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আমরা তাঁর অনেক নিঃসঙ্গতা ও মহীয়ানতার সন্ধান পেয়েছি, তিনি তাই নিয়ে বেঁচে থাকুন এই পৃথিবীতে।

চার.

ইংল্যান্ডে তুষার পড়লেও লন্ডনে তুষারপাত বিরল এক ঘটনা। গুড ফ্রাইডেতে হঠাৎ করেই ঘোষণা আসে, আগামীকাল থেকে তুষার পড়তে পারে। ওই রাতে আমি অনেকদিন পর সিগারেট কিনি আসন্ন হিমের আশংকায়। শনিবার সকালে দেখি, সত্যিই এই মার্চের দিনে, যখন সামার খুব কাছে চলে এসেছে, ঝিরঝির তুষার পড়ছে আকাশ থেকে। পরদিন রবিবার, সকাল নয়টা পেরিয়ে গেছে আর তখনও আমি শুয়ে, স্ত্রী বাইরে থেকে টেলিফোন করে আমাকে আবারও তুষারপাতের খবর জানায়। আমি ওঠার পর জানালা খুলে মুখে একটু বরফ মেখে অভ্যাসবশত ই-মেইল চেক করতে বসি এবং ইনবক্সের প্রথমেই চোখ আটকে যায় ফয়জুল ইসলামের চিঠিটিতে : ‘শহীদুল জহির হ্যাজ ডায়েজ টুডে : লাইফ ইজ মোর পাওয়ারফুল দ্যান ডেথ।’ আমার চ্যাটিংবক্সে লালবৃত্ত জ্বলজ্বল করছে, কিন্তু মাহবুব মোর্শেদ সেই লাল বৃত্ত পেরিয়ে একই মেসেজ দেয়। আমি এইসব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে জানালার পাশে এসে দাঁড়াই।

দেখি সমস্ত প্রাকৃতিক নিয়ম ভঙ্গ করে আমার প্রিয় বাংলাদেশের কার্পাস তুলোর মতো পেঁজা পেঁজা শাদা শাদা নৃত্যরতা তুষার ঝরে পড়ছে, গলে পড়ছে জানালার কাঁচে, রাস্তার ওপরে, লাইটপোস্টের গায়ে, ওক আর চেরিনাস্ট গাছের গায়ে। মনে হচ্ছে, যে প্রকৃতি এতদিন নীরবে তাঁর সঙ্গী ছিল সেই প্রকৃতি আজ ভেঙে পড়ছে শহীদুল জহিরের শোকে। এই কদিন আগেই এক প্রিয় মানুষকে আমি লিখেছিলাম, মানুষকে বাঁ হাতের উল্টো পিঠে কান্না মুছে হাসি আনতে হয়। আজ আমিও সেই চেষ্টা করি, কাঁপা কাঁপা হাতে তুষারের দিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে সিগারেট জ্বালানোর চেষ্টা করি, মনে মনে বলি, যিশু চলে গেছেন, যিশু তুষারে ঢেকে যাচ্ছেন।