মামুন হুসাইন
(পূর্ব প্রকাশের পর)
আহমেদুর চৌধুরী : এমন একটি ছোটগল্প সম্পর্কে বলুন যা আপনাকে কাঁদিয়েছে বা আপনার চিন্তা ও বোধকে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দিয়েছে।
মামুন হুসাইন : ডারউইনের তৃতীয় শ্রেষ্ঠ কাজ ছিল, দ্য এক্সপ্রেশন অফ দ্য ইমোশনস ইন ম্যান এন্ড এনিমেলস- সেখানে কান্নাকাটি ব্যতিরেকে তিনি ছয় প্রকারের আবেগের কথা উল্লেখ করেছেন : সুখানুভব, বেদনা, ভয়, ক্রোধ, বিস্ময় এবং বিতৃষ্ণা। তুমি অবশ্য ঝোঁক দিয়ে ‘কান্না’র কথা বলেছ; আবার জানতে চেয়েছ ‘চিন্তা ও বোধ’কে আলোড়ন করার অনুষঙ্গ। আমি কান্না বিষয় একটি গদ্য লিখেছিলাম- ‘আর চোখে জল’; ‘কথা ইশারা’ গ্রন্থে আছে, তোমার চোখে পড়েছে কি? এ্যালিসের কথা স্মরণে আসে- বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়, ‘দা পুল অফ টিয়ার’- কেক খাওয়ার পর এ্যালিস ৯ ফুট লম্বা হয়। তারপর দরজা দিয়ে বেরুতে না পেরে, ভয়ে দুঃখে কান্না বিগলিত হয়। কান্না জমতে জমতে জলাশয় হয় এবং সেই জলাশয় সে পাড়ি দেয়। কান্না আমার কাছে সে অর্থে একপ্রকার ‘শব্দ’ যা লিখিত হয়। এবং এটি ক্যাথারসিসও বটে, যা আমাদেরকে বিশোধন করে। ‘রিপ ভ্যান উইংকেল’ খ্যাত আমেরিকার লেখক ওয়াশিংটন আর্ভিং বলতেন- কান্নায় একপ্রকার পবিত্রতা থাকে। এটি কোনো দুর্বলতা নয়, শক্তির প্রকাশ। ১০ হাজার জিহ্বার চেয়েও কান্নার বক্তব্য হয় অধিক প্রাঞ্জল ও স্পষ্ট। একটি দলছুট কথা বলি, -মারিনা আবরামোভীকের পারফরম্যান্স সরাসরি দেখিনি; আলোচনায় পড়েছি এবং ভিডিও ক্লিপস দেখেছি : কান্না উদ্রেককারী তীব্র বেদনা, শ্রম এবং একাকিত্ব মিশিয়ে উপস্থাপনা। একটি উপস্থাপনাতে দেখছি টানা ১২ দিন খোলা মঞ্চে অভুক্ত হয়ে আছেন। দেখছি মোমায় (গঙগঅ) টানা তিন মাস, প্রতিদিন ৮ ঘণ্টাব্যাপী ৭৫০ ঘণ্টা চেয়ারে বসে আছেন নীরব। ‘নৈঃশব্দ্য’ কি তাহলে অপর একটি ভাষা! অপ্রাসঙ্গিক হলো কিনা কে জানে- কথাগুলো বলছি কান্নার রকমফের বোঝাতে এবং মানুষ কত বিপজ্জনকভাবে কান্নার শিল্প নির্মাণ করে তার সামান্য ইশারা দেওয়া।
তুমি অবশ্য একক গল্পের নিরিখেই কান্নার স্বরূপ খোঁজার হোমওয়ার্ক দিয়েছো- এটি যথাযথ পালন সত্যিই ঝুঁকিপূর্ণ। ‘গল্প পোষ্য মানুষ’ শুধু বইয়ের পৃষ্ঠায় গল্প খোঁজেন তা তো নয়, নিজেদের জীবন কি তাদের কম অশ্রুময়? আমার বাবার অকাল মৃত্যু হয়, যখন আমার বয়স সাকল্যে সাত; কেউ একজন ভিড়ের ভেতর আমাকে কাঁধে নেয়- তোমার বাবাকে শেষবারের মতো দেখো; কবরের ভেতর ঝুপ ঝুপ ঝরে পড়া মাটিতে বাবার আবছায়া মুখ জুড়ে ইতস্তত কর্পূরের শোভা এবং কাফনের উজ্জ্বল সাদা রং ছাড়া কিছুই দেখতে পাই না। মৃদু আতর, লোবান ও গোলাপজলের ঘ্রাণে দম বন্ধ হতে হতে কান্নার শক্তি গলার ভেতর আটক হয়ে আমাকে ঠেলে দেয় চির বিস্মৃতির যুগে।
নব্বইয়ের দশকে চাকরি করতে গেছি পূর্ববঙ্গের এক মফস্বল শহরে, যেখানে পৌঁছতে দেশের সকল যানবাহনের আশ্রয় নিতে হতো। এখানে দুটি ঘটনা এখনো অশ্রু সজল করে- প্রথমটি : আমার হাসপাতালে সেদিন লোডশেডিং। হাসপাতালের দেয়াল ঘেঁষে শ্মশান। সন্ধ্যায় পুড়ে যাওয়া লাশের ছাইভস্ম মাঝেমধ্যে ঘরে, বারান্দায়, ছাদে উড়ে উড়ে আসছে?। তারা ভরা আকাশের নিচে, খোলা ছাদে আমি, আমার এক সহকর্মী এবং আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠা রাঁধুনি অন্ধকার উদযাপন করছি। রাঁধুনি সামান্য আড়াল পেয়ে, স্বামীর কথা বলতে শুরু করেন- বিয়ের পর মাথায় তার এত দীর্ঘ চুল যে, স্বামী তাকে পিঁড়িতে দাঁড় করিয়ে নিজ হাতে তেল দিয়ে দিতেন। লোকটি যখন ভাত খেতেন সেই ভাতের ঢিবিতে দাঁড়িয়ে টাঙ্গাইল শহর দেখা যেত। তারপর তার অকাল মৃত্যু হয় এবং তিনি একা হন; বোঝা হয়ে যান তার নিজের সন্তানসন্ততির কাছে। সামান্য এইগল্প বলতে বলতে ফুঁপাতে শুরু করেন। তারার আলো এবং রাতের আঁধারে তার কান্না আমাকে সংক্রমিত করে। দ্বিতীয় ঘটনা : এক বিকেল-সন্ধ্যায় আমি সর্পাহত হই। তখন মানুষের ভালোবাসা বিজড়িত নির্দেশ বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা স্থগিত করে, এবং পুরো গ্রাম আমার জন্য পালা করে ওঝা ও গুণিন জোগাড়ে শশব্যস্ত হয়। সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ, যার দোকানে আমি চা খাই নিত্য, তিনি বর্ষার নদী সাঁতরে এক গুণীনের বাড়ি পৌঁছান। এই গুণীনের চিকিৎসা তৎপরতার প্রথম ধাপ, বার্তাবাহককে তীব্র চপেটাঘাত করা অর্থাৎ চপেটাঘাতে বিষ আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে আটক হয়ে গেল! এই গুণীন যখন আসেন, তখন আমার এই পরমহিতৈষী আমাকে ঝাপটে কান্নায় ভেঙে পড়েন; পাঞ্জাবির পকেটে সংরক্ষিত কাঁচামরিচ বের করে তারপর চিবুতে দেন- ঝাল না মিষ্টি? এর অর্থ বিষ অথবা বিষহীনতা! কাঁচামরিচ চিবুতে চিবুতে দুই অসম বয়সের মানুষ ক্রমাগত আর্দ্র হই; গল্পটি আমি আজও ভুলতে পারিনি। কিন্তু তুমি তো আসলে আমার কোনো ব্যক্তিগত এ্যানেকডট্স জানতে চাওনি। অতএব আমাকে গল্পের নাম বলতেই হবে। এ প্রসঙ্গে শুরুতেই তারাশঙ্করের ‘ডাইনি’ মনে পড়ে; বিশেষ করে যখন সে ধূসর শূন্যলোকে মিলিয়ে যাচ্ছে- ডাইনি একবার মানুষ হয় তারপর অন্তর্গত দোলাচলে সাধারণ মানুষের আকাক্সক্ষা, ইচ্ছা, স্বপ্নে কেবলই স্মৃতিমেদুর হয়; আবার পরক্ষণেই জনপদের সার্বক্ষণিক অবুঝ মানুষের বিবেচনাতে সে হয় ডাকিনী ও হন্তারক। ‘নিম অন্নপূর্ণা’য় যুথীর ছোলা চুরি এবং প্রীতিলতার চাল অনুসন্ধান পর্ব- আমাকে এখনো তীব্র আলোকিত করে। রাস্তার তীর্যক গ্যাসের আলোয় ঢলে পড়া বৃদ্ধের মৃত্যু ছবি আঁকছেন কমল কুমার; মৃত মানুষের চাউনি কমল মজুমদারের হাতে অন্য এক ‘খেলার প্রতিভা’ নির্মাণ করে মুহূর্তে- এখনো কি মানুষেরা মৃদুস্বরে কথা হয়, ছোট করে হাসে। এই দৃশ্যময়তার পাশাপাশি আবার গরম ভাত যখন পরিবেশিত হচ্ছে, তখন প্রীতিলতার কোমল বেদনাময় হেঁয়ালি- বুড়োর জন্য মন খারাপ করছে, খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এরকম চমকে ওঠা এক বৃদ্ধের সন্ধান পেয়েছিলাম ‘ফাদার সিয়েরগি’তে; তলস্তয় লিখছেন, কামনাকে দূর করার জন্য হাত পুড়িয়ে ফেলেছেন এবং অনুশোচনায় আঙুল ক্ষত করেছেন ফাদার সিয়েরগি?। ধীরে ধীরে নতুন উপলব্ধি হয়- বড় যাজক হওয়ার আয়োজন স্তব্ধ করে সাধারণ মানুষের পঙক্তিতে দাঁড়ান জীবনের শেষ প্রান্তে- এক কৃষকের বাড়িতে কিচেন গার্ডেনার হন, তার শিশুদের পাঠদান করেন, আর অসুস্থ মানুষকে সেবা করেন। তোমার প্রশ্নের উত্তর আবারও বোধ হয় গোলমালে হয়ে গেল।
এক্ষুনি আমাকে পাপ স্বীকার করতেই হবে- কারণ একটিমাত্র গল্প নিয়ে কথা বলার চুক্তিপত্র, আমার কু-অভ্যাসে শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারিনি।
আ. চৌ. : আপনার গল্প লিখতে আপনি কীভাবে কাঠামো, ভাষা এবং ব্যাকরণ নির্মাণ/ব্যবহার করেন? আপনি কি নিজস্ব ফর্ম গড়তে এবং ভাঙতে অভ্যস্ত?
মা. হু. : ‘আপন ভজন কথা না কহিবে যথা তথা, আপনাতে আপনি সাবধান- সাঁইজির এই গান আমাকে সাহস যোগায়। যেহেতু বাংলা সাহিত্যের আনুষ্ঠানিক ছাত্রত্ব আমার নেই, আমি ভাষার কাঠামো, ব্যাকরণ, ফর্ম ইত্যাদি বিষয়ে তীব্র অজ্ঞ। ‘অবচেতন’ যদি থাকে ভাষার মতো তবে অন্তরলোকে কী ঘটে, সব ব্যাখ্যা আমি কি জানি? বহুদিনের ভুল অভ্যাসে অনুমান হয়- যে কোনো শিল্পকর্মই শেষ বিচারে আমাদের ইচ্ছা-স্বপ্ন-বিশ্বাস এবং সংযুক্তির মিথস্ক্রিয়া। ‘লিখনে কি ঘটে’- এই নামে মহান অমিয়ভূষণের বই ভূমিকা হিসেবে পড়া যায়। বুঝতে পারি- বয়স বাড়ছে, আমরা যেমন জগৎকে ভুলে যাব, জগৎও তেমনি আমাকে ভুলে যাবে। আমরা আমাদের বেঁচে থাকার সময় ক্ষণকে বলেছি- খুব সিরিয়াস মুখভঙ্গি করে কখনো, অথবা একেবারেই হালকা চালে, যেন তা চেনা যায় এবং বহুত্বের ছায়া আনে দৃষ্টি বলয়ে। যত্নে তৈরি যে কোনো লেখাই, আমার ধারণা, আমাদের মানসলোকে একপ্রকার উদ্বিগ্নতা ছড়ায়। যেহেতু আমার জ্ঞান-গরিমার তীব্র ঘাটতি- আমার চারপাশ, আমার সময় আমাকে যেভাবে নির্দেশ দেয় কথা বলার, তাই আমার ব্যাকরণ, ফর্ম বা ভাষা কাঠামো। ভেবে ভেবে স্থির করি- কোনো একটি গ্রন্থ যদি বরফ জমে থাকা সমুদ্রের কুঠার হয়, তবে একেবারেই নমনীয় না হওয়া, অন্তর্গত সত্তার কোনো পরিমার্জনা ছাড়াই ক্ষমাহীনভাবে, লেখা নামক একটি অসুস্থতার দাসত্ব গ্রহণ, আমার-আমাদের ভবিতব্য।
আ. চৌ. : আপনার কাছে একটি সার্থক ছোটগল্পের মূল উপাদান কী?
মা. হু. : এখন পর্যন্ত ছোটগল্পতেই ঘোরাফেরা করছি আমরা। শেষ ক্লাসের মাস্টারমশাই শেখান- ছোটগল্পে বাহ্যিক বর্ণনা থাকবে না, চকিত চমক থাকবে, বিষয় হবে ছোট, নাটকীয়তা থাকবে, দ্বন্দ্ব থাকবে এবং অনন্য বাঁক থাকবে। কেউ বলেছেন ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে গল্প শেষ হওয়া বাঞ্ছনীয় অথবা অর্ধ হতে ১/২ ঘণ্টা। দেখেছ- আমি আমার লেখার কালে এইসব শর্তাবলি একটিও মানতে পারিনি। খানিক আগে বলেছি: ‘লেখা নামক অসুস্থতা’ সম্ভবত একপ্রকার ট্রান্স তৈরি করে; তখন আমি বা আমরা নির্দেশিত হই। বাক্য-শব্দ-কাগজ- আমাকে যেভাবে পরিচালিত করে আমি সেই নির্দেশনা কেবল প্রতিপালন করি নিষ্ঠার সঙ্গে। আমার বলার কথাগুলো যথাযথ প্রকাশিত হওয়ার জন্য যা করণীয় আমি তাই করতে বাধ্য হই। ফলে আমাকে নিয়ে ব্যাকরণমনষ্ক-রুচিশীল-বিদগ্ধ বিদ্বৎজনের অস্বস্তি কোনোকালেই আর ঘোচে না- আমার না হয় গল্প, না হয় প্রবন্ধ না হয় উপন্যাস; আমি কারাবাস করি এক অনন্ত নোম্যান্স আইল্যান্ডে। আমি বিশ্বাস করি- যেকোনো লেখার মূল উপাদান, চূড়ান্ত ভাবনায় লেখকের চিন্তা প্রকাশের স্বাধীন-ইচ্ছা বৈ কিছু নয়।
আ. চৌ. : লেখকের রাজনৈতিক বোধ কতটা গুরুত্বপূর্ণ? রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক অন্যায্যতার বিরুদ্ধে লেখকের কোন ধরনের ভূমিকা থাকা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
মা. হু. : এ প্রসঙ্গে খানিকটা কথাবার্তা আমরা ইতোমধ্যে শুরু করেছি। মানুষ যদি ‘রাজনৈতিক জীব’ হয়- তবে জগত সংসারের সকল মানুষই রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের জায়গা থেকে দেখলে অর্থনীতি যখন ভিত্তি, তখন সামাজিক উপরি কাঠামোর অন্যতম উপাদান হলো রাজনীতি। দলের আনুষ্ঠানিক তকমা ছাড়াও একজন মানুষ তার রাজনৈতিক দৃষ্টি দিয়ে জগৎ সংসার পরিমাপ করে চলেন আমৃত্যু। ‘রাজনীতি’ শব্দের মজা কম নয়: আমরা কখনো বলি রাষ্ট্রনীতি, রাজগতি অথবা রাজবুদ্ধি। কেরি মহাশয় তাঁর অভিধানে রাজনীতির শব্দের অর্থ করেছেন- রাজন্য + নীতি অর্থাৎ ‘রাজার ন্যায় বিচার’। আরিস্ততল বলতেন, রাজনৈতিক হওয়ার অর্থ হলো সবকিছুই কথা ও যুক্তির মাধ্যমে নির্ধারিত হবে; সহিংসতার মাধ্যমে নয়। কিন্তু মানব ইতিহাসে ‘রাজার ন্যায় বিচার’-এর সুযোগ সন্ধানে নামলে তুমিও মানবে আলোচনা ধাবিত হয় এক অতল আঁধার বিশ্বলোকে। একটি বাক্য রচনা না করেও, যেকোনো সংবেদী মানুষ সংক্ষুব্ধ হতে পারে, দ্রোহী হতে পারে এবং রাষ্ট্র কর্তৃত্বের মতাদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ে মতান্তর প্রকাশ করতে পারে। একজন লেখক সকল রাজনৈতিক জন্তুর মতো রাজনীতির কলাকৌশল ও মতামত নিয়ে আক্রান্ত হবেন, এটি আমার কাছে খুব স্বাভাবিক একটি ঘটনা। এখন এই লেখকের সরকার কর্তৃত্ববাদী, সাংবিধানিক, সর্বনিয়ন্ত্রণবাদী না স্বৈরতান্ত্রিক তার উপর ভিত্তি করে তোমার কথিত ‘বোধ’ নির্মাণ ও বিনির্মাণ হবে- তুমি বলবে কোনো এক বোধ কাজ করে... হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম নেয়...। ইতিহাসের খেরোখাতায় সংবেদী মানুষের ‘রাজনৈতিক জীব’ হয়ে ওঠার নানান কাহিনি ছড়ানো। এক্ষুণি মনে পড়ছে রবীন্দ্রজয়ন্তীর আয়োজন হচ্ছে অবিভক্ত পাকিস্তানের ঢাকায়; সুফিয়া কামালের বাড়িতে পুলিশ- এটি বন্ধ করে দিন। কিন্তু তাঁর মতো তিনি সোচ্চার হয়েছেন। কবি শামসুর রাহমান বলছিলেন যখন নোয়াখালীতে তীব্র দাঙ্গা, তখন রায় পাড়া থানার কৈবর্ত জনগোষ্ঠীর সামনে তাঁর বাবা বন্দুক নিয়ে উন্মত্ত জনতার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। এটি কি তাঁর বাবার কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ, না কি মানুষের চিরায়ত শুভবোধ? কবি আহসান হাবীবের যোগ্যতার শেষ নেই; কিন্তু কর্মক্ষেত্রে যে ৪০ জনের সঙ্গে স্বাক্ষর দিয়েছিলেন, তারা সবাই রবীন্দ্রবিরোধী।? শামসুর রাহমান ক্ষোভে তাঁর সঙ্গে বহুদিন কথা বলেননি। স্বাধীন মতামত প্রকাশের জন্য বদরুদ্দিন উমরকে ওই ষাটের দশকেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের খুৎবাতে গালাগালি করা হচ্ছে ধর্মদ্রোহী বলে। রাষ্ট্র বলছে, তিনি ধীরেন দত্তের সঙ্গে চক্রান্তে লিপ্ত। শেষমেশ চাকরি থেকে পদত্যাগ?। ৬০ থেকে শুরু হয়ে ৮০-৯০-এর উত্তাল দিনে আমাদের বহু অগ্রজ লেখক চিন্তক ভাবুক তাঁদের সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন, বলা যায়। রোমান প্রবচন, রাষ্ট্র যখন নিজেই সন্ত্রাসী, তখন ম্যান ইজ আ উল্ফ টু ম্যান- পরিসংখ্যান বলে সারাদেশে ১৯৭১-এর গণহত্যায় এক হাজারের উপর বুদ্ধিজীবী হত্যা হয় তাঁদের রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য। তুমি মানবে প্রত্যেকটি মানুষ যেহেতু আলাদা আলাদা অবলোকনের উপায় খুঁজে পায়, আলাদা হয় তার অভিজ্ঞতার জগৎ, এবং সমাজে তার ভূমিকাও হয়ে পড়ে আলাদা। কাগজ-কলমে রাষ্ট্রীয় অন্যায্যতার কথা লিপিবদ্ধ করা আর রাজপথে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বলিকাষ্ঠে জীবন দান নিশ্চয়ই সবাই সমান সাহসে করতে সক্ষম হয় না। এরকম একটি সাহসের কথা বলি: খুব কম আলোচিত হয়?, কুর্ট আইসনার- তিনি ছিলেন একাধারে বিপ্লবী, সাংবাদিক এবং নাট্য সমালোচক?। বাভারিয়ান সোভিয়েত রিপাবলিকের রাষ্ট্রপতি হন ১৯১৪ এ। তাঁর সঙ্গে কবি, লেখক ও নাট্যকারের সম্পর্ক ছিল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের থেকেও বেশি। তিনি ভাবতেন, রাজনীতি হলো শিল্প আর শিল্প হলো রাজনীতি। স্বপ্ন দেখতেন কবি-নাট্যকার, এঁরা বিপ্লবের বীজমন্ত্র দূর গ্রামে ছড়িয়ে দিবে। কিন্তু ১৯১৯, আমাদের সুবিখ্যাত একুশে ফেব্রুয়ারির দিন তাঁকে বিপ্লব বিরোধীরা মিউনিখের রাস্তায় হত্যা করে, হুমায়ন আজাদ, দীপেন বা অভিজিৎ-এর মতো।
আবার একেবারেই উল্টো পিঠে- এই দেশেই অন্য ঘটনা আছে: সামরিক অধিকর্তা যখন নিজেই স্বঘোষিত কবি তখন তার চারপাশে আমাদের কতিপয় লেখকের সম্মিলন ও গুঞ্জনপর্ব, যেন পদোন্নতি, জমির দলিল এবং দরদালানের চটজলদি বন্দোবস্ত হয়; অথবা কৃতজ্ঞতায় তারা সবাই তখন সভাকবি- যৌথ উদ্যোগে নির্মাণ করছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেলের কাব্যগ্রন্থ। এও তো একপ্রকার রাজনীতি- হাক্সলির ভাষায়, এই প্রকার বুদ্ধি ব্যবসায়ীরা ইন্টেলেকচুয়ালি জায়েন্ট, কিন্তু সড়ৎধষষু ফধিৎ। এই আপসকামিতার একেবারে বিপরীত প্রান্তে লেখকদের বৈপ্লবিক লেখালেখি প্রসঙ্গে পৃথিবীতে সাহিত্যের একটি জনরা তৈরি হয়েছে- রেজিস্ট্যান্স লিটারেচার এবং প্রিজন লিটারেচার। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এই মুহূর্তে অব্যাহত পৃথিবীর নানান প্রান্তে; খবরের পাতায় দেখি- ফ্রান্স, আমেরিকা, ইসরাইল, আফগানিস্তান, ভারতসহ সকল দেশেই রাষ্ট্রীয় নিবর্তনের পক্ষে লেখক চিন্তক সোচ্চার।
আমার ভয়কাতুরে চিত্ত সকল দুর্বলতা সত্ত্বেও গভীরভাবে বিশ্বাস করে, সামাজিক মানুষ হিসেবে যে কোনো অন্যায্যতার বিপক্ষেই আমাদের দাঁড়ানো উচিত। নিজেকে শাসন করার জন্য ডেসমন্ড টুটুর কথাটি স্তত্রের মতো বলি: তুমি যদি অন্যায্যতার মুহূর্তে নিরপেক্ষ থাকো তাহলে তুমি স্বৈরাচারের পক্ষে। ধরো একটি হাতি ইঁদুরের লেজে পা দিয়েছে, আর তুমি বলছো আমি নিরপেক্ষ, ইঁদুর তোমার এই নির্দলীয় ভঙ্গি কখনো পছন্দ করবে না। সিমন দ্য ব্যুভেয়ারের একটি লেখা, কোনো উপন্যাস কি? স্মরণে পড়ছে না; একজনকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, এই রেজিস্টেন্স মুভমেন্টে তোমার অবদান কী? সে তখন জবাব দিচ্ছে, একজন ফরাসি হয়েও আমি যে আজও জীবিত, এটাই আমার অবদান। কথাটি আমার স্বপক্ষে জুড়ি : নির্বুদ্ধিতায়, লোভে, ক্রমাগত আপস করতে করতে- এই যে বেঁচে আছি, ভয়ংকর-সহিংস-পশ্চাৎপদ-কূপমণ্ডুক এক জনপদে এখনো- বলতে পারো, এইটুকুই আমার অবদান ও রাজনীতির জ্ঞানগম্মি। পেছন ফিরে দেখি- অসম্মানে-অবহেলায়, জনপদের নামহীন গোত্রহীন মানুষের সঙ্গে- সংযুক্ত হতে হতে, বিযুক্ত হতে হতে ভুল মেধায়, ভুল উচ্চারণে একটি ব্যক্তিগত পথ খুঁজেছি অনন্ত- ‘আত্ম দীপো ভব’- তুমি নিজে নিজের পথনির্দেশক আলো হয়ে ওঠো...।
আ. চৌ. : আপনি এখন কী লিখছেন? আপনার বর্তমান লেখালেখি সম্পর্কে পাঠকদের জন্য কিছু বলুন।
মা. হু. : খুব ভেবেচিন্তেই বলি- তোমার মতো আমার কয়েক ঘর আত্মীয় আছে ভূ-ভারতে কেবলমাত্র তাঁরাই ভাবে আমি বোধহয় হিজিবিজি কিছু লিখতে শিখেছি। পৃথিবীতে এত সব মহার্ঘ রচিত হয়ে আছে যে তার কিছু মাত্র আস্বাদনের আগেই জীবনের ‘আলো ক্রমশ নিভিয়া আসিতেছে’! সামান্য যা কাগজে ছাপা হয়েছে, তা ঐসব দূর-নমস্য-বাতিঘরের চুইয়ে পড়া আলো মাত্র। আমি তো রবিঠাকুর, দস্তয়ভস্কি, তলস্তয়ের মতো কোনো মৌলিক লেখক নই- ফলে ঘাটতি পূরণের জন্য, লেখার চেয়ে পড়াটাই বেশি হয়। বলতে পারো নানান বইপুস্তক গুছিয়ে মিথ্যে-মিথ্যে তীব্র পড়ার আয়োজন করি মাত্র। তারপর কিছু একটা বীজমন্ত্র উড়ে এলে, তা গোছাতে যে এতসব নথিপত্র দেখতে বসি, যে সামান্য একটি অনুচ্ছেদ রচনার আগেই ?মস্তিষ্কের শক্তি উবে যায়। ফলে আমার আর লেখক-জন্ম উদযাপন হয় না; রচিত হয় একেবারেই সাধারণ এক উন্মুল পাঠকের জীবন। বলতে পারো, কিছু না বুঝেই যত্রতত্র যা পাই তাই পড়তে থাকি।
একা জীবনানন্দ খুব শক্ত ধাতের মানুষ ছিলেন, এই ব্যাখ্যা খোঁজ করতে ইচ্ছে করে কখনো, যখন দেখি লোকালয় ছেড়ে তিনি কেবল হাঁটছেন; একেই কি বলে, দ্য আর্ট অফ ওয়ার্কিং? কখনো ভেবেছি- নিৎসের মতো শক্ত গোঁফওয়ালা মানুষ, চাবুকে আহত ঘোড়ার গলা জড়িয়ে হাপুস কান্নারত; এই বিষয়ে কিছু লেখার আছে কি? সংগীত মস্তিষ্কে কি কাজ করে- কখনো ভাবি এ বিষয়ে একটি মলিন পাঠ রচনা করব। সম্প্রতি কোথাও পড়লাম, পাকিস্তানের তমঘা-ই-ইমতিয়াজ পদক বর্জনকারী, তেজস্বিনী সুফিয়া কামাল প্রতি শনিবার মধু আর দারুচিনি মিলিয়ে একটি স্বপ্ন পাওয়া ওষুধ বিতরণ করতেন। ঢাকায় ওঁর বাড়ির সামনে দিয়ে হাঁটার সময় আঁধার আঁধার পরিত্যক্ত ঘরের বারান্দায় উঁকি দিই রাস্তা থেকে, আর মনে মনে প্রজ্ঞাপন লিখি- এখন এই ‘সাঁঝের মায়া’ নামক গৃহ থেকে কোনো দারুচিনি-মধু পাওয়া যাবে না! বলতে পারো বইয়ের সঙ্গে আমার কথাবার্তা এরকম বিচিত্র দুষ্কর্মে লিপ্ত হয় অহরহ।
অতি সম্প্রতি একটি লেখা আলিম আজিজকে দিয়েছি- ফার্মার্স সুইসাইড ভেবে, ‘জলছাপের চিত্রকলা’ নাম। এখন ভবিষ্যৎ জানে-
লেখাজোখার কারখানায় আমার শিক্ষানবিশী কাল আরও খানিকটা বাড়বে, নাকি সামনেই দূর গির্জা ঘরের অন্তিম ঘণ্টাধ্বনি! জীবন যখন ভাবি প্রকৃতির সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ, তখন কিয়ের্কেগাদ লিখছেন ১৮৪৩-এ তাঁর আয়েদার / অর গ্রন্থে : কি অন্তঃসারশূন্য আর অর্থহীনই না এ জীবন! আমরা মৃত ব্যক্তিকে কবরস্থ করার জন্য লাশ নিয়ে গোরস্তানে যাই, তার ওপর তিন কোদাল সমান মাটি ফেলে দিয়ে জুড়িগাড়ি করে ঘরে ফিরে এসে এইভাবে সুখ পেতে থাকি যে, কী দীর্ঘ জীবন-ই না আমাদের জন্য অপেক্ষমান! বলতে কি, জীবনের অনেক মৌল অনুষঙ্গ সন্দেহ করার সাহস এইভাবে হয়তো কখনো অনুবাদ করার প্রণোদনা ছড়ায়; অথবা তর্কে-ঝগড়ায় ক্লান্ত হয়ে আবারও দুর্বল মেধায় স্থির করি- জীবন এক আশ্চর্য-বিপজ্জনক-মনোহর কাহিনিই বটে! (সমাপ্ত)
সৌজন্যে : শুদ্ধস্বর ওয়েব পোর্টাল
বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ , ৩০ ভাদ্র ১৪৩০, ২৮ সফর ১৪৪৫
মামুন হুসাইন
মামুন হুসাইন
(পূর্ব প্রকাশের পর)
আহমেদুর চৌধুরী : এমন একটি ছোটগল্প সম্পর্কে বলুন যা আপনাকে কাঁদিয়েছে বা আপনার চিন্তা ও বোধকে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দিয়েছে।
মামুন হুসাইন : ডারউইনের তৃতীয় শ্রেষ্ঠ কাজ ছিল, দ্য এক্সপ্রেশন অফ দ্য ইমোশনস ইন ম্যান এন্ড এনিমেলস- সেখানে কান্নাকাটি ব্যতিরেকে তিনি ছয় প্রকারের আবেগের কথা উল্লেখ করেছেন : সুখানুভব, বেদনা, ভয়, ক্রোধ, বিস্ময় এবং বিতৃষ্ণা। তুমি অবশ্য ঝোঁক দিয়ে ‘কান্না’র কথা বলেছ; আবার জানতে চেয়েছ ‘চিন্তা ও বোধ’কে আলোড়ন করার অনুষঙ্গ। আমি কান্না বিষয় একটি গদ্য লিখেছিলাম- ‘আর চোখে জল’; ‘কথা ইশারা’ গ্রন্থে আছে, তোমার চোখে পড়েছে কি? এ্যালিসের কথা স্মরণে আসে- বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়, ‘দা পুল অফ টিয়ার’- কেক খাওয়ার পর এ্যালিস ৯ ফুট লম্বা হয়। তারপর দরজা দিয়ে বেরুতে না পেরে, ভয়ে দুঃখে কান্না বিগলিত হয়। কান্না জমতে জমতে জলাশয় হয় এবং সেই জলাশয় সে পাড়ি দেয়। কান্না আমার কাছে সে অর্থে একপ্রকার ‘শব্দ’ যা লিখিত হয়। এবং এটি ক্যাথারসিসও বটে, যা আমাদেরকে বিশোধন করে। ‘রিপ ভ্যান উইংকেল’ খ্যাত আমেরিকার লেখক ওয়াশিংটন আর্ভিং বলতেন- কান্নায় একপ্রকার পবিত্রতা থাকে। এটি কোনো দুর্বলতা নয়, শক্তির প্রকাশ। ১০ হাজার জিহ্বার চেয়েও কান্নার বক্তব্য হয় অধিক প্রাঞ্জল ও স্পষ্ট। একটি দলছুট কথা বলি, -মারিনা আবরামোভীকের পারফরম্যান্স সরাসরি দেখিনি; আলোচনায় পড়েছি এবং ভিডিও ক্লিপস দেখেছি : কান্না উদ্রেককারী তীব্র বেদনা, শ্রম এবং একাকিত্ব মিশিয়ে উপস্থাপনা। একটি উপস্থাপনাতে দেখছি টানা ১২ দিন খোলা মঞ্চে অভুক্ত হয়ে আছেন। দেখছি মোমায় (গঙগঅ) টানা তিন মাস, প্রতিদিন ৮ ঘণ্টাব্যাপী ৭৫০ ঘণ্টা চেয়ারে বসে আছেন নীরব। ‘নৈঃশব্দ্য’ কি তাহলে অপর একটি ভাষা! অপ্রাসঙ্গিক হলো কিনা কে জানে- কথাগুলো বলছি কান্নার রকমফের বোঝাতে এবং মানুষ কত বিপজ্জনকভাবে কান্নার শিল্প নির্মাণ করে তার সামান্য ইশারা দেওয়া।
তুমি অবশ্য একক গল্পের নিরিখেই কান্নার স্বরূপ খোঁজার হোমওয়ার্ক দিয়েছো- এটি যথাযথ পালন সত্যিই ঝুঁকিপূর্ণ। ‘গল্প পোষ্য মানুষ’ শুধু বইয়ের পৃষ্ঠায় গল্প খোঁজেন তা তো নয়, নিজেদের জীবন কি তাদের কম অশ্রুময়? আমার বাবার অকাল মৃত্যু হয়, যখন আমার বয়স সাকল্যে সাত; কেউ একজন ভিড়ের ভেতর আমাকে কাঁধে নেয়- তোমার বাবাকে শেষবারের মতো দেখো; কবরের ভেতর ঝুপ ঝুপ ঝরে পড়া মাটিতে বাবার আবছায়া মুখ জুড়ে ইতস্তত কর্পূরের শোভা এবং কাফনের উজ্জ্বল সাদা রং ছাড়া কিছুই দেখতে পাই না। মৃদু আতর, লোবান ও গোলাপজলের ঘ্রাণে দম বন্ধ হতে হতে কান্নার শক্তি গলার ভেতর আটক হয়ে আমাকে ঠেলে দেয় চির বিস্মৃতির যুগে।
নব্বইয়ের দশকে চাকরি করতে গেছি পূর্ববঙ্গের এক মফস্বল শহরে, যেখানে পৌঁছতে দেশের সকল যানবাহনের আশ্রয় নিতে হতো। এখানে দুটি ঘটনা এখনো অশ্রু সজল করে- প্রথমটি : আমার হাসপাতালে সেদিন লোডশেডিং। হাসপাতালের দেয়াল ঘেঁষে শ্মশান। সন্ধ্যায় পুড়ে যাওয়া লাশের ছাইভস্ম মাঝেমধ্যে ঘরে, বারান্দায়, ছাদে উড়ে উড়ে আসছে?। তারা ভরা আকাশের নিচে, খোলা ছাদে আমি, আমার এক সহকর্মী এবং আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠা রাঁধুনি অন্ধকার উদযাপন করছি। রাঁধুনি সামান্য আড়াল পেয়ে, স্বামীর কথা বলতে শুরু করেন- বিয়ের পর মাথায় তার এত দীর্ঘ চুল যে, স্বামী তাকে পিঁড়িতে দাঁড় করিয়ে নিজ হাতে তেল দিয়ে দিতেন। লোকটি যখন ভাত খেতেন সেই ভাতের ঢিবিতে দাঁড়িয়ে টাঙ্গাইল শহর দেখা যেত। তারপর তার অকাল মৃত্যু হয় এবং তিনি একা হন; বোঝা হয়ে যান তার নিজের সন্তানসন্ততির কাছে। সামান্য এইগল্প বলতে বলতে ফুঁপাতে শুরু করেন। তারার আলো এবং রাতের আঁধারে তার কান্না আমাকে সংক্রমিত করে। দ্বিতীয় ঘটনা : এক বিকেল-সন্ধ্যায় আমি সর্পাহত হই। তখন মানুষের ভালোবাসা বিজড়িত নির্দেশ বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা স্থগিত করে, এবং পুরো গ্রাম আমার জন্য পালা করে ওঝা ও গুণিন জোগাড়ে শশব্যস্ত হয়। সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ, যার দোকানে আমি চা খাই নিত্য, তিনি বর্ষার নদী সাঁতরে এক গুণীনের বাড়ি পৌঁছান। এই গুণীনের চিকিৎসা তৎপরতার প্রথম ধাপ, বার্তাবাহককে তীব্র চপেটাঘাত করা অর্থাৎ চপেটাঘাতে বিষ আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে আটক হয়ে গেল! এই গুণীন যখন আসেন, তখন আমার এই পরমহিতৈষী আমাকে ঝাপটে কান্নায় ভেঙে পড়েন; পাঞ্জাবির পকেটে সংরক্ষিত কাঁচামরিচ বের করে তারপর চিবুতে দেন- ঝাল না মিষ্টি? এর অর্থ বিষ অথবা বিষহীনতা! কাঁচামরিচ চিবুতে চিবুতে দুই অসম বয়সের মানুষ ক্রমাগত আর্দ্র হই; গল্পটি আমি আজও ভুলতে পারিনি। কিন্তু তুমি তো আসলে আমার কোনো ব্যক্তিগত এ্যানেকডট্স জানতে চাওনি। অতএব আমাকে গল্পের নাম বলতেই হবে। এ প্রসঙ্গে শুরুতেই তারাশঙ্করের ‘ডাইনি’ মনে পড়ে; বিশেষ করে যখন সে ধূসর শূন্যলোকে মিলিয়ে যাচ্ছে- ডাইনি একবার মানুষ হয় তারপর অন্তর্গত দোলাচলে সাধারণ মানুষের আকাক্সক্ষা, ইচ্ছা, স্বপ্নে কেবলই স্মৃতিমেদুর হয়; আবার পরক্ষণেই জনপদের সার্বক্ষণিক অবুঝ মানুষের বিবেচনাতে সে হয় ডাকিনী ও হন্তারক। ‘নিম অন্নপূর্ণা’য় যুথীর ছোলা চুরি এবং প্রীতিলতার চাল অনুসন্ধান পর্ব- আমাকে এখনো তীব্র আলোকিত করে। রাস্তার তীর্যক গ্যাসের আলোয় ঢলে পড়া বৃদ্ধের মৃত্যু ছবি আঁকছেন কমল কুমার; মৃত মানুষের চাউনি কমল মজুমদারের হাতে অন্য এক ‘খেলার প্রতিভা’ নির্মাণ করে মুহূর্তে- এখনো কি মানুষেরা মৃদুস্বরে কথা হয়, ছোট করে হাসে। এই দৃশ্যময়তার পাশাপাশি আবার গরম ভাত যখন পরিবেশিত হচ্ছে, তখন প্রীতিলতার কোমল বেদনাময় হেঁয়ালি- বুড়োর জন্য মন খারাপ করছে, খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এরকম চমকে ওঠা এক বৃদ্ধের সন্ধান পেয়েছিলাম ‘ফাদার সিয়েরগি’তে; তলস্তয় লিখছেন, কামনাকে দূর করার জন্য হাত পুড়িয়ে ফেলেছেন এবং অনুশোচনায় আঙুল ক্ষত করেছেন ফাদার সিয়েরগি?। ধীরে ধীরে নতুন উপলব্ধি হয়- বড় যাজক হওয়ার আয়োজন স্তব্ধ করে সাধারণ মানুষের পঙক্তিতে দাঁড়ান জীবনের শেষ প্রান্তে- এক কৃষকের বাড়িতে কিচেন গার্ডেনার হন, তার শিশুদের পাঠদান করেন, আর অসুস্থ মানুষকে সেবা করেন। তোমার প্রশ্নের উত্তর আবারও বোধ হয় গোলমালে হয়ে গেল।
এক্ষুনি আমাকে পাপ স্বীকার করতেই হবে- কারণ একটিমাত্র গল্প নিয়ে কথা বলার চুক্তিপত্র, আমার কু-অভ্যাসে শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারিনি।
আ. চৌ. : আপনার গল্প লিখতে আপনি কীভাবে কাঠামো, ভাষা এবং ব্যাকরণ নির্মাণ/ব্যবহার করেন? আপনি কি নিজস্ব ফর্ম গড়তে এবং ভাঙতে অভ্যস্ত?
মা. হু. : ‘আপন ভজন কথা না কহিবে যথা তথা, আপনাতে আপনি সাবধান- সাঁইজির এই গান আমাকে সাহস যোগায়। যেহেতু বাংলা সাহিত্যের আনুষ্ঠানিক ছাত্রত্ব আমার নেই, আমি ভাষার কাঠামো, ব্যাকরণ, ফর্ম ইত্যাদি বিষয়ে তীব্র অজ্ঞ। ‘অবচেতন’ যদি থাকে ভাষার মতো তবে অন্তরলোকে কী ঘটে, সব ব্যাখ্যা আমি কি জানি? বহুদিনের ভুল অভ্যাসে অনুমান হয়- যে কোনো শিল্পকর্মই শেষ বিচারে আমাদের ইচ্ছা-স্বপ্ন-বিশ্বাস এবং সংযুক্তির মিথস্ক্রিয়া। ‘লিখনে কি ঘটে’- এই নামে মহান অমিয়ভূষণের বই ভূমিকা হিসেবে পড়া যায়। বুঝতে পারি- বয়স বাড়ছে, আমরা যেমন জগৎকে ভুলে যাব, জগৎও তেমনি আমাকে ভুলে যাবে। আমরা আমাদের বেঁচে থাকার সময় ক্ষণকে বলেছি- খুব সিরিয়াস মুখভঙ্গি করে কখনো, অথবা একেবারেই হালকা চালে, যেন তা চেনা যায় এবং বহুত্বের ছায়া আনে দৃষ্টি বলয়ে। যত্নে তৈরি যে কোনো লেখাই, আমার ধারণা, আমাদের মানসলোকে একপ্রকার উদ্বিগ্নতা ছড়ায়। যেহেতু আমার জ্ঞান-গরিমার তীব্র ঘাটতি- আমার চারপাশ, আমার সময় আমাকে যেভাবে নির্দেশ দেয় কথা বলার, তাই আমার ব্যাকরণ, ফর্ম বা ভাষা কাঠামো। ভেবে ভেবে স্থির করি- কোনো একটি গ্রন্থ যদি বরফ জমে থাকা সমুদ্রের কুঠার হয়, তবে একেবারেই নমনীয় না হওয়া, অন্তর্গত সত্তার কোনো পরিমার্জনা ছাড়াই ক্ষমাহীনভাবে, লেখা নামক একটি অসুস্থতার দাসত্ব গ্রহণ, আমার-আমাদের ভবিতব্য।
আ. চৌ. : আপনার কাছে একটি সার্থক ছোটগল্পের মূল উপাদান কী?
মা. হু. : এখন পর্যন্ত ছোটগল্পতেই ঘোরাফেরা করছি আমরা। শেষ ক্লাসের মাস্টারমশাই শেখান- ছোটগল্পে বাহ্যিক বর্ণনা থাকবে না, চকিত চমক থাকবে, বিষয় হবে ছোট, নাটকীয়তা থাকবে, দ্বন্দ্ব থাকবে এবং অনন্য বাঁক থাকবে। কেউ বলেছেন ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে গল্প শেষ হওয়া বাঞ্ছনীয় অথবা অর্ধ হতে ১/২ ঘণ্টা। দেখেছ- আমি আমার লেখার কালে এইসব শর্তাবলি একটিও মানতে পারিনি। খানিক আগে বলেছি: ‘লেখা নামক অসুস্থতা’ সম্ভবত একপ্রকার ট্রান্স তৈরি করে; তখন আমি বা আমরা নির্দেশিত হই। বাক্য-শব্দ-কাগজ- আমাকে যেভাবে পরিচালিত করে আমি সেই নির্দেশনা কেবল প্রতিপালন করি নিষ্ঠার সঙ্গে। আমার বলার কথাগুলো যথাযথ প্রকাশিত হওয়ার জন্য যা করণীয় আমি তাই করতে বাধ্য হই। ফলে আমাকে নিয়ে ব্যাকরণমনষ্ক-রুচিশীল-বিদগ্ধ বিদ্বৎজনের অস্বস্তি কোনোকালেই আর ঘোচে না- আমার না হয় গল্প, না হয় প্রবন্ধ না হয় উপন্যাস; আমি কারাবাস করি এক অনন্ত নোম্যান্স আইল্যান্ডে। আমি বিশ্বাস করি- যেকোনো লেখার মূল উপাদান, চূড়ান্ত ভাবনায় লেখকের চিন্তা প্রকাশের স্বাধীন-ইচ্ছা বৈ কিছু নয়।
আ. চৌ. : লেখকের রাজনৈতিক বোধ কতটা গুরুত্বপূর্ণ? রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক অন্যায্যতার বিরুদ্ধে লেখকের কোন ধরনের ভূমিকা থাকা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
মা. হু. : এ প্রসঙ্গে খানিকটা কথাবার্তা আমরা ইতোমধ্যে শুরু করেছি। মানুষ যদি ‘রাজনৈতিক জীব’ হয়- তবে জগত সংসারের সকল মানুষই রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের জায়গা থেকে দেখলে অর্থনীতি যখন ভিত্তি, তখন সামাজিক উপরি কাঠামোর অন্যতম উপাদান হলো রাজনীতি। দলের আনুষ্ঠানিক তকমা ছাড়াও একজন মানুষ তার রাজনৈতিক দৃষ্টি দিয়ে জগৎ সংসার পরিমাপ করে চলেন আমৃত্যু। ‘রাজনীতি’ শব্দের মজা কম নয়: আমরা কখনো বলি রাষ্ট্রনীতি, রাজগতি অথবা রাজবুদ্ধি। কেরি মহাশয় তাঁর অভিধানে রাজনীতির শব্দের অর্থ করেছেন- রাজন্য + নীতি অর্থাৎ ‘রাজার ন্যায় বিচার’। আরিস্ততল বলতেন, রাজনৈতিক হওয়ার অর্থ হলো সবকিছুই কথা ও যুক্তির মাধ্যমে নির্ধারিত হবে; সহিংসতার মাধ্যমে নয়। কিন্তু মানব ইতিহাসে ‘রাজার ন্যায় বিচার’-এর সুযোগ সন্ধানে নামলে তুমিও মানবে আলোচনা ধাবিত হয় এক অতল আঁধার বিশ্বলোকে। একটি বাক্য রচনা না করেও, যেকোনো সংবেদী মানুষ সংক্ষুব্ধ হতে পারে, দ্রোহী হতে পারে এবং রাষ্ট্র কর্তৃত্বের মতাদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ে মতান্তর প্রকাশ করতে পারে। একজন লেখক সকল রাজনৈতিক জন্তুর মতো রাজনীতির কলাকৌশল ও মতামত নিয়ে আক্রান্ত হবেন, এটি আমার কাছে খুব স্বাভাবিক একটি ঘটনা। এখন এই লেখকের সরকার কর্তৃত্ববাদী, সাংবিধানিক, সর্বনিয়ন্ত্রণবাদী না স্বৈরতান্ত্রিক তার উপর ভিত্তি করে তোমার কথিত ‘বোধ’ নির্মাণ ও বিনির্মাণ হবে- তুমি বলবে কোনো এক বোধ কাজ করে... হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম নেয়...। ইতিহাসের খেরোখাতায় সংবেদী মানুষের ‘রাজনৈতিক জীব’ হয়ে ওঠার নানান কাহিনি ছড়ানো। এক্ষুণি মনে পড়ছে রবীন্দ্রজয়ন্তীর আয়োজন হচ্ছে অবিভক্ত পাকিস্তানের ঢাকায়; সুফিয়া কামালের বাড়িতে পুলিশ- এটি বন্ধ করে দিন। কিন্তু তাঁর মতো তিনি সোচ্চার হয়েছেন। কবি শামসুর রাহমান বলছিলেন যখন নোয়াখালীতে তীব্র দাঙ্গা, তখন রায় পাড়া থানার কৈবর্ত জনগোষ্ঠীর সামনে তাঁর বাবা বন্দুক নিয়ে উন্মত্ত জনতার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। এটি কি তাঁর বাবার কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ, না কি মানুষের চিরায়ত শুভবোধ? কবি আহসান হাবীবের যোগ্যতার শেষ নেই; কিন্তু কর্মক্ষেত্রে যে ৪০ জনের সঙ্গে স্বাক্ষর দিয়েছিলেন, তারা সবাই রবীন্দ্রবিরোধী।? শামসুর রাহমান ক্ষোভে তাঁর সঙ্গে বহুদিন কথা বলেননি। স্বাধীন মতামত প্রকাশের জন্য বদরুদ্দিন উমরকে ওই ষাটের দশকেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের খুৎবাতে গালাগালি করা হচ্ছে ধর্মদ্রোহী বলে। রাষ্ট্র বলছে, তিনি ধীরেন দত্তের সঙ্গে চক্রান্তে লিপ্ত। শেষমেশ চাকরি থেকে পদত্যাগ?। ৬০ থেকে শুরু হয়ে ৮০-৯০-এর উত্তাল দিনে আমাদের বহু অগ্রজ লেখক চিন্তক ভাবুক তাঁদের সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন, বলা যায়। রোমান প্রবচন, রাষ্ট্র যখন নিজেই সন্ত্রাসী, তখন ম্যান ইজ আ উল্ফ টু ম্যান- পরিসংখ্যান বলে সারাদেশে ১৯৭১-এর গণহত্যায় এক হাজারের উপর বুদ্ধিজীবী হত্যা হয় তাঁদের রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য। তুমি মানবে প্রত্যেকটি মানুষ যেহেতু আলাদা আলাদা অবলোকনের উপায় খুঁজে পায়, আলাদা হয় তার অভিজ্ঞতার জগৎ, এবং সমাজে তার ভূমিকাও হয়ে পড়ে আলাদা। কাগজ-কলমে রাষ্ট্রীয় অন্যায্যতার কথা লিপিবদ্ধ করা আর রাজপথে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বলিকাষ্ঠে জীবন দান নিশ্চয়ই সবাই সমান সাহসে করতে সক্ষম হয় না। এরকম একটি সাহসের কথা বলি: খুব কম আলোচিত হয়?, কুর্ট আইসনার- তিনি ছিলেন একাধারে বিপ্লবী, সাংবাদিক এবং নাট্য সমালোচক?। বাভারিয়ান সোভিয়েত রিপাবলিকের রাষ্ট্রপতি হন ১৯১৪ এ। তাঁর সঙ্গে কবি, লেখক ও নাট্যকারের সম্পর্ক ছিল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের থেকেও বেশি। তিনি ভাবতেন, রাজনীতি হলো শিল্প আর শিল্প হলো রাজনীতি। স্বপ্ন দেখতেন কবি-নাট্যকার, এঁরা বিপ্লবের বীজমন্ত্র দূর গ্রামে ছড়িয়ে দিবে। কিন্তু ১৯১৯, আমাদের সুবিখ্যাত একুশে ফেব্রুয়ারির দিন তাঁকে বিপ্লব বিরোধীরা মিউনিখের রাস্তায় হত্যা করে, হুমায়ন আজাদ, দীপেন বা অভিজিৎ-এর মতো।
আবার একেবারেই উল্টো পিঠে- এই দেশেই অন্য ঘটনা আছে: সামরিক অধিকর্তা যখন নিজেই স্বঘোষিত কবি তখন তার চারপাশে আমাদের কতিপয় লেখকের সম্মিলন ও গুঞ্জনপর্ব, যেন পদোন্নতি, জমির দলিল এবং দরদালানের চটজলদি বন্দোবস্ত হয়; অথবা কৃতজ্ঞতায় তারা সবাই তখন সভাকবি- যৌথ উদ্যোগে নির্মাণ করছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেলের কাব্যগ্রন্থ। এও তো একপ্রকার রাজনীতি- হাক্সলির ভাষায়, এই প্রকার বুদ্ধি ব্যবসায়ীরা ইন্টেলেকচুয়ালি জায়েন্ট, কিন্তু সড়ৎধষষু ফধিৎ। এই আপসকামিতার একেবারে বিপরীত প্রান্তে লেখকদের বৈপ্লবিক লেখালেখি প্রসঙ্গে পৃথিবীতে সাহিত্যের একটি জনরা তৈরি হয়েছে- রেজিস্ট্যান্স লিটারেচার এবং প্রিজন লিটারেচার। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এই মুহূর্তে অব্যাহত পৃথিবীর নানান প্রান্তে; খবরের পাতায় দেখি- ফ্রান্স, আমেরিকা, ইসরাইল, আফগানিস্তান, ভারতসহ সকল দেশেই রাষ্ট্রীয় নিবর্তনের পক্ষে লেখক চিন্তক সোচ্চার।
আমার ভয়কাতুরে চিত্ত সকল দুর্বলতা সত্ত্বেও গভীরভাবে বিশ্বাস করে, সামাজিক মানুষ হিসেবে যে কোনো অন্যায্যতার বিপক্ষেই আমাদের দাঁড়ানো উচিত। নিজেকে শাসন করার জন্য ডেসমন্ড টুটুর কথাটি স্তত্রের মতো বলি: তুমি যদি অন্যায্যতার মুহূর্তে নিরপেক্ষ থাকো তাহলে তুমি স্বৈরাচারের পক্ষে। ধরো একটি হাতি ইঁদুরের লেজে পা দিয়েছে, আর তুমি বলছো আমি নিরপেক্ষ, ইঁদুর তোমার এই নির্দলীয় ভঙ্গি কখনো পছন্দ করবে না। সিমন দ্য ব্যুভেয়ারের একটি লেখা, কোনো উপন্যাস কি? স্মরণে পড়ছে না; একজনকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, এই রেজিস্টেন্স মুভমেন্টে তোমার অবদান কী? সে তখন জবাব দিচ্ছে, একজন ফরাসি হয়েও আমি যে আজও জীবিত, এটাই আমার অবদান। কথাটি আমার স্বপক্ষে জুড়ি : নির্বুদ্ধিতায়, লোভে, ক্রমাগত আপস করতে করতে- এই যে বেঁচে আছি, ভয়ংকর-সহিংস-পশ্চাৎপদ-কূপমণ্ডুক এক জনপদে এখনো- বলতে পারো, এইটুকুই আমার অবদান ও রাজনীতির জ্ঞানগম্মি। পেছন ফিরে দেখি- অসম্মানে-অবহেলায়, জনপদের নামহীন গোত্রহীন মানুষের সঙ্গে- সংযুক্ত হতে হতে, বিযুক্ত হতে হতে ভুল মেধায়, ভুল উচ্চারণে একটি ব্যক্তিগত পথ খুঁজেছি অনন্ত- ‘আত্ম দীপো ভব’- তুমি নিজে নিজের পথনির্দেশক আলো হয়ে ওঠো...।
আ. চৌ. : আপনি এখন কী লিখছেন? আপনার বর্তমান লেখালেখি সম্পর্কে পাঠকদের জন্য কিছু বলুন।
মা. হু. : খুব ভেবেচিন্তেই বলি- তোমার মতো আমার কয়েক ঘর আত্মীয় আছে ভূ-ভারতে কেবলমাত্র তাঁরাই ভাবে আমি বোধহয় হিজিবিজি কিছু লিখতে শিখেছি। পৃথিবীতে এত সব মহার্ঘ রচিত হয়ে আছে যে তার কিছু মাত্র আস্বাদনের আগেই জীবনের ‘আলো ক্রমশ নিভিয়া আসিতেছে’! সামান্য যা কাগজে ছাপা হয়েছে, তা ঐসব দূর-নমস্য-বাতিঘরের চুইয়ে পড়া আলো মাত্র। আমি তো রবিঠাকুর, দস্তয়ভস্কি, তলস্তয়ের মতো কোনো মৌলিক লেখক নই- ফলে ঘাটতি পূরণের জন্য, লেখার চেয়ে পড়াটাই বেশি হয়। বলতে পারো নানান বইপুস্তক গুছিয়ে মিথ্যে-মিথ্যে তীব্র পড়ার আয়োজন করি মাত্র। তারপর কিছু একটা বীজমন্ত্র উড়ে এলে, তা গোছাতে যে এতসব নথিপত্র দেখতে বসি, যে সামান্য একটি অনুচ্ছেদ রচনার আগেই ?মস্তিষ্কের শক্তি উবে যায়। ফলে আমার আর লেখক-জন্ম উদযাপন হয় না; রচিত হয় একেবারেই সাধারণ এক উন্মুল পাঠকের জীবন। বলতে পারো, কিছু না বুঝেই যত্রতত্র যা পাই তাই পড়তে থাকি।
একা জীবনানন্দ খুব শক্ত ধাতের মানুষ ছিলেন, এই ব্যাখ্যা খোঁজ করতে ইচ্ছে করে কখনো, যখন দেখি লোকালয় ছেড়ে তিনি কেবল হাঁটছেন; একেই কি বলে, দ্য আর্ট অফ ওয়ার্কিং? কখনো ভেবেছি- নিৎসের মতো শক্ত গোঁফওয়ালা মানুষ, চাবুকে আহত ঘোড়ার গলা জড়িয়ে হাপুস কান্নারত; এই বিষয়ে কিছু লেখার আছে কি? সংগীত মস্তিষ্কে কি কাজ করে- কখনো ভাবি এ বিষয়ে একটি মলিন পাঠ রচনা করব। সম্প্রতি কোথাও পড়লাম, পাকিস্তানের তমঘা-ই-ইমতিয়াজ পদক বর্জনকারী, তেজস্বিনী সুফিয়া কামাল প্রতি শনিবার মধু আর দারুচিনি মিলিয়ে একটি স্বপ্ন পাওয়া ওষুধ বিতরণ করতেন। ঢাকায় ওঁর বাড়ির সামনে দিয়ে হাঁটার সময় আঁধার আঁধার পরিত্যক্ত ঘরের বারান্দায় উঁকি দিই রাস্তা থেকে, আর মনে মনে প্রজ্ঞাপন লিখি- এখন এই ‘সাঁঝের মায়া’ নামক গৃহ থেকে কোনো দারুচিনি-মধু পাওয়া যাবে না! বলতে পারো বইয়ের সঙ্গে আমার কথাবার্তা এরকম বিচিত্র দুষ্কর্মে লিপ্ত হয় অহরহ।
অতি সম্প্রতি একটি লেখা আলিম আজিজকে দিয়েছি- ফার্মার্স সুইসাইড ভেবে, ‘জলছাপের চিত্রকলা’ নাম। এখন ভবিষ্যৎ জানে-
লেখাজোখার কারখানায় আমার শিক্ষানবিশী কাল আরও খানিকটা বাড়বে, নাকি সামনেই দূর গির্জা ঘরের অন্তিম ঘণ্টাধ্বনি! জীবন যখন ভাবি প্রকৃতির সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ, তখন কিয়ের্কেগাদ লিখছেন ১৮৪৩-এ তাঁর আয়েদার / অর গ্রন্থে : কি অন্তঃসারশূন্য আর অর্থহীনই না এ জীবন! আমরা মৃত ব্যক্তিকে কবরস্থ করার জন্য লাশ নিয়ে গোরস্তানে যাই, তার ওপর তিন কোদাল সমান মাটি ফেলে দিয়ে জুড়িগাড়ি করে ঘরে ফিরে এসে এইভাবে সুখ পেতে থাকি যে, কী দীর্ঘ জীবন-ই না আমাদের জন্য অপেক্ষমান! বলতে কি, জীবনের অনেক মৌল অনুষঙ্গ সন্দেহ করার সাহস এইভাবে হয়তো কখনো অনুবাদ করার প্রণোদনা ছড়ায়; অথবা তর্কে-ঝগড়ায় ক্লান্ত হয়ে আবারও দুর্বল মেধায় স্থির করি- জীবন এক আশ্চর্য-বিপজ্জনক-মনোহর কাহিনিই বটে! (সমাপ্ত)
সৌজন্যে : শুদ্ধস্বর ওয়েব পোর্টাল