মার্কেসের সাংবাদিকতা অজানা অধ্যায়

মূল: জেরাল্ড মার্টিন অনুবাদ: সুরাইয়া ফারজানা হাসান

পর্ব ১০

(পূর্ব প্রকাশের পর)

প্যারিসে ক্ষুধা: লা বোয়েম

(১৯৫৬-১৯৫৭)

একদিন বলা নেই, কওয়া নেই, তাঁর জীবনে আচমকা এক পরিবর্তন আসে। মার্চের এক সন্ধ্যায়, ভাগ্যচক্রে তাঁর এক তরুণীর সাথে দেখা হয়। তখন তিনি এক পর্তুগীজ সাংবাদিকের সাথে বাইরে ছিলেন, যিনি ফ্রান্সের গুপ্তচরবৃত্তির বিচারের ওপর ব্রাজিলের এক সংবাদপত্রে সংবাদ পরিবেশন করছেন। যাই হোক তরুণীটি ছিলেন স্পেন থেকে আগত ছাব্বিশ বছর বয়স্কা অভিনেত্রী তাচিয়া। তাঁর এখানে এক কবিতা আবৃত্তি অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা। প্রায় চল্লিশ বছর পর তিনি এদিনের কথা স্মরণ করে বলবেন, গাব্রিয়েল (এ নামেই তিনি সবসময় তাঁকে ডাকতেন) সেই আবৃত্তি অনুষ্ঠানে যোগদানে অনিহা প্রকাশ করেন: ‘কবিতার আবৃত্তি’, তিনি টিটকারি মেরে বলেন, ‘একঘেয়েমি লাগে ব্যাপারটা!’ আমি ধরে নেই, তিনি কবিতা ঘৃণা করেন।’ তিনি গির্জার কাছে সাঁ জামের্ঁ দে প্রে বুলেভার্ডে, ক্যাফে ল্য মাবিয়েনে অপেক্ষা করেন। আমরা আবৃত্তি শেষে তাঁর সাথে যোগ দেই। তিনি আঙুলের মতো চিকন ছিলেন, কোঁকড়া চুল আর গোঁফে তাকে আলজেরীয়দের মতো দেখাচ্ছিল, আমি কখনো গোঁফওয়ালা লোক পছন্দ করিনি। অমার্জিত পৌরুষ দেখানো লোকও পছন্দ করি না; এবং আমার সবসময় স্পেনের লোকজনের মতো বর্ণবাদী এবং সাংস্কৃতিক কুসংস্কার ছিল যে­, লাতিন আমেরিকার পুরুষরা নিম্নমানের।

তাচিয়ার ভাষ্যমতে, ‘আমি প্রথম দেখায় গাবরিয়েলকে দেখে অপছন্দ করেছিলাম: তার মধ্যে কবিতার কোনো ভাব ছিল না, তিনি ছিলেন অহংকারী এবং খানিকটা ভীতু স্বভাবের। এছাড়া আমি সবসময়ই বয়স্ক লোক পছন্দ করতাম, গাবরিয়েল তখন কমবেশি আমারই বয়সী। তিনি খুব শিঘ্রই আমার সামনে তাঁর কাজ নিয়ে বড়াই করা শুরু করলেন, সম্ভবত তিনি নিজেকে সাংবাদিক ভাবতেন, লেখক নয়। আমার সেই বন্ধু দশটা বাজলে পানশালা থেকে চলে গেল, তবে আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলা চালিয়ে যাই এবং এরপর প্যারিসের রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতে থাকি। গাবরিয়েল ফরাসিদের সম্পর্কে ভয়ানক কথা বলে... যদিও ফরাসিরা তার জন্য বুকটা পেতে দিয়েছে কারণ পরবর্তীতে তাঁরা তাঁর জাদুবাস্তবতার ব্যাপারে খুব যৌক্তিক অবস্থান নিবে।’

তাচিয়া আরো বলেন, ‘যখন আপনি এই তীব্র ব্যাঙ্গকারী কলম্বীয়র সাথে কথা বলা শুরু করবেন, তখন তাঁর আরেকটি দিক চোখে পড়বে, তাঁর গল্প বলার সময়ে কণ্ঠস্বরে কিছু একটা পাবেন আর আছে আত্মবিশ্বাসের হাসি। গার্সিয়া মার্কেস আর এই স্পষ্টভাষী স্প্যানিশ নারী সম্পর্কে জড়িয়ে যান, অচিরেই তা ঘনিষ্ঠতায় রূপ নেয়। এবং সম্ভবত আদিম সে সম্পর্ক। ঘটনাটি এপ্রিল মাসে। শুরুর দিকে গাবরিয়েলের কোনো মেয়েকে পানীয়, অথবা এক কাপ চকোলেট কিংবা সিনেমা দেখানোর জন্য পর্যাপ্ত টাকাপয়সা ছিল না। এরপর তাঁর পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেল তাঁর হাতে আর কিছুই রইল না।

কথা সত্যি। তাচিয়ার সাথে পরিচয়ের তিন সপ্তাহ পরে ‘এল ইন্দিপিডিয়েন্তে’ বোগোতায় বন্ধ হয়ে যায়: এই সময়, যদিও তিনি এই ব্যাপারটা সম্পর্কে প্রায় এক বছর বেখবর থাকে। এটিকে নতুন সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। তাঁর পাওনা টাকা পরিশোধের বদলে, পত্রিকার ‘ব্যবস্থাপনা পর্ষদ’ অবশেষে তাঁর জন্য কলম্বিয়ায় ফিরে যাওয়ার একটা প্লেনের টিকিট পাঠায়। যখন টিকেট এসে পৌঁছায়, গার্সিয়া মার্কেস ঢোক গিলে, একটা গভীর শ^াস নেন, এবং এটি ভাঙ্গিয়ে টাকা করে নেন। কারণটা কি তবে ইউরোপকে ভালো করে জানা; তাঁর নতুন উপন্যাস শেষ করার আকাক্সক্ষা; নাকি তিনি সত্যিই প্রেমে পড়েছিলেন? তিন মাস ধরে ‘অশুভ সময়’ উপন্যাস লিখছেন এবং এটা তিনি এটা চালিয়ে নিতে চান। সুতরাং বলা চলে তিনি নানা কারণে প্যারিস ছাড়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। বোগোতায় তিনি লেখালেখির জন্য খুব অল্প সময়ই পেতেন আর এখন তিনি তা বেশ উদ্দীপনার সাথে করছেন। এটা তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত। তবে লেখালেখি বিষয়টা তাঁর জন্য কঠিন হবে। তাছাড়া তাচিয়ার ব্যাপারটা তো রয়েইছে।

তাচিয়ার সাথে দেখা হবার পরপরই, কলম্বীয় লোকটি দেখলেন তিনি যে বইটি শুরু করেছেন এবং যার ওপর করেছেন তা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। একটি চরিত্র জন্মাতে শুরু করেছে- কর্নেল, যিনি একই সাথে আত্মবিশ^াসহীন এবং একগুঁয়ে জেদী, মাকোন্দো হতে এবং পেকে গলগলা হওয়া কলার গন্ধ থেকে বিচ্যুত শরণার্থী, এমন একজন মানুষ যিনি ‘এক হাজার দিবসের যুদ্ধের’ পর পঞ্চাশ বছর ধরে একটি চিঠির জন্য অপেক্ষা করছেন। আসল উপন্যাসটি (অশুভ সময়) এখন একপাশে সরানো, এ ছিল এক শীতল, নিষ্ঠুর কাজ যার জন্য ¯œায়ু এবং বিচ্ছিন্নতা প্রয়োজন, তবে এর লেখক তাকে একদম অনভিপ্রেত মুহূর্তে পান, অভাব এবং আবেগ দুটোই, তার নিজের লা বোয়েম সংস্করণের বাইরে বসবাস করছেন।

মায়ের সাথে যাত্রার স্মৃতিকাতরতা যেমন পাতার ঝড়’র জন্ম দিয়েছে, একই আবেগে, গ্লানিকর (বর্তমানে বসবাসের অসম্ভাবনার স্মৃতিকাতরতা), থেকে তিনি লিখলেন ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লিখে না’ (এল করোনেল নো তিয়েনে কিয়েন লে এস্ক্রিবা: আক্ষরিক অর্থেই কর্নেলকে চিঠি লেখার কেউ ছিল না)। গার্সিয়া মার্কেস বাস্তবে যে জীবন যাপন করে যাচ্ছেন, ঠিক সেখানে এবং তখন, তাচিয়ার সাথে। তারা তখন এক বিস্ময়কর, উত্তেজনাপূর্ণ, আবেগীয়, এবং সম্পূর্ণ অনাকাক্সিক্ষত এক সম্পর্কে জড়িয়ে গেছেন; তবে খুব শিঘ্রই তারা নিদারুণ অর্থকষ্টে পড়বেন। একদম শুরু থেকে সম্পর্কটা দারিদ্র্যপীড়িত এবং তারপর, বেশ দ্রুতই বিয়োগান্তক অবস্থার হুমকিতে পড়ে যায়। সুতরাং প্রথম উপন্যাসটি (অশুভ সময়), যেটির তখনও বেশ অগ্রগতি হয়েছে, সেটি শেষবারের মতো বাঁধা হয়, একটি ডোরাকাটা গলার টাই দিয়ে, এবং ওতেল দ্য ফ্লঁদ্রের একটি ভাঙ্গাচোরা ওয়ার্ডরোবের ভিতর রাখা হয়; এবং আরো নিবিড়, এবং দুর্দান্ত গল্প লেখা হয়, ক্ষুধার্ত কর্নেল আর তার অসুখী, দীর্ঘদিন রোগে ভোগা স্ত্রী, যেটি লেখা শুরু হয় ১৯৫৬ সালের মে অথবা জুনের শুরুতে।

গার্সিয়া মার্কেসের হোটেলের পাওনা আশঙ্কাজনকভাবে পর্বত প্রমাণ হয়ে ওঠে, তবে, তিনি কষ্ট করে হলেও ঘরটা ধরে রাখেন, যদিও তিনি ভাড়া পরিশোধ করতে পারছেন না। অথবা বলা যায়, তিনি তা করেননি। কয়েক সপ্তাহ পরে তিনি এবং তাচিয়ার এমনকি খেতে পারাটাও দুষ্কর হয়ে দাড়ায়। ঠিক তিনি ফরাসি ভাষা এখনও তেমন একটা আয়ত্তে আনতে পারেননি আর চাকরি পাওয়াও চাট্টিখানি কথা নয়; তবে সত্যটা হলো, তিনি তা খুঁজছেনও না। যখন প্লেনের টিকিটের টাকাটা খরচ হয়ে গেল, তিনি খালি বোতল এবং পুরনো পত্রিকা সংগ্রহ করতে লাগলেন এবং স্থানীয় দোকানগুলো থেকে এ বাবদ একশ ফ্রাঁ পেতেন। সময়ে সময়ে তিনি কসাইয়ের কাছ থেকে একটি হাড্ডি চেয়ে এনেছেন, যাতে তাচিয়া সুরুয়া জাতীয় কিছু রাঁধতে পারেন। তিনি একবার মেট্রোতে কয়েক সেন্ট কম পড়ে যাওয়াতে টিকিটের টাকা অন্যের কাছ থেকে চেয়ে নেন, তাকে যে লোকটি অর্থ সহায়তা দিয়েছিলেন সেই ফরাসি ভদ্রলোকের প্রতিক্রিয়ায় তার নিজেকে খেলো লাগছিল। তিনি কলম্বিয়ায় তার বন্ধুদের কাছে অর্থ সাহায্যের আর্জি জানিয়ে ক্রমাগত বার্তা পাঠাতে থাকেন, আর নিজেকে দেখতে পান তিনি একটা সুখবরের জন্য সপ্তাহের পর সপ্তাহ অপেক্ষা করছেন, ঠিক যেমনভাবে তাঁর নানা অতীতের দিনগুলিতে অবসর ভাতার জন্য অপেক্ষা করেছেন নতুন উপন্যাসের সেই কর্নেলের মতো। সম্ভবত ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তাকে টিকিয়ে রেখেছে।

পরের কয়েকটা মাসে আরেকটি বিপর্যয় তাঁদের সম্পর্কে আঘাত হানে। তাচিয়া গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এ বিষয়ে তাচিয়া বলেন, ‘গর্ভধারণের বিষয়টা সম্পূর্ণই আমার সিদ্ধান্ত ছিল, তাঁর নয়। অবশ্যই তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে, যদিও এবং সম্ভবত আমার পারিবারিক পটভূমিতে, আমি ঈশ^রের বিপরীতে গেছি।’ গর্ভের বাচ্চার সাড়ে চার মাস চলাকালীন হঠাৎ তাচিয়ার গর্ভপাত হয়। তাঁর বয়ানে জানা যায়, ‘আমি আট দিন মাতেরনিতে পোর্ত রোয়া হাসপাতালে ছিলাম। হাসপাতালটা আমরা যেখানে থাকতাম তাঁর খুব কাছে। গাবরিয়েল, সবসময় সন্ধ্যায় দেখা করার সময়টাতে অনাগত সন্তানের বাবাদের মধ্যে প্রথম হাসপাতালে এসে উপস্থিত হতো। গর্ভপাতের পর আমরা দুজনেই বুঝলাম সব কিছু চুকেবুকে গেছে। আমি চলে যাওয়ার ভয় দেখাই। আর অবশেষে আমি তা করি, আমি একদম চলে আসি, প্রথমে যাই বিয়েকোর বাড়ি, স্বাস্থ্য পুনরূদ্ধারের জন্য আর এরপর মাদ্রিদ চলে যাই। আমি খুব মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ি, বেহাল অবস্থা আমার। আমি সবসময় সম্পর্কের ক্ষেত্রে উঁচুতে ছিলাম, কিন্তু গর্ভধারণ আমায় নামিয়ে আনে। আমি ১৯৫৬ সালের ডিসেম্বর মাসে গার দোস্তারলিত্স স্টেশন থেকে প্যারিস ছাড়ি। গাবরিয়েল বন্ধুদের পুরো দলবল নিয়ে আমাকে স্টেশনে নিয়ে যায়। গর্ভপাতের অবস্থা থেকে আমি সেরে উঠি, তবে ভেতরে ভেতরে দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছিলাম। আমরা দেরি করে ফেলি, বাক্স প্যাটরা ট্রেনে ছুড়ে মারা হচ্ছিল, আমার দ্রুত টেনে চড়তে হলো এবং এমনকি কাউকে বিদায় বলার সময় পর্যন্ত নেই হাতে। আমার আটটি স্যুটকেস ছিল। গাবরিয়েল সবসময় বলতো এগুলো আদতে ষোলটি স্যুটকেস। ট্রেনটি নড়েচড়ে উঠলে আমার মন বিক্ষিপ্ত হয়ে যায় এবং জানালায় হাত রেখে কাঁদতে থাকি। ট্রেনটা চলতে শুরু করলে, আর আমি গাবরিয়েলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাই, তার চোখেমুখে বেদনা। সে হাঁটতে শুরু করে এবং আস্তে আস্তে দৃষ্টির অগোচরে চলে যায়। সত্যিই সে ১৯৫৬ সালে আমাকে সাহায্য সহায়তা দিতে ব্যর্থ হয়। সে কেবল এটে উঠতে পারেনি। অবশ্যই আমি তাকে কখনো বিয়ে করতে পারতাম না। আমার এ নিয়ে নূন্যতম খেদও নেই। তার ওপর একদমই নির্ভর করা যায় না। আর আমি এমন বাবার জন্য পৃথিবীতে কোনো সন্তান আনতে পারি না। কারণ সন্তানের চেয়ে কোনো কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়, তাই নয় কি? এখন অবশ্য আমি মনে করি আমার একদম ভুল ধারণা ছিল, কারণ সে চমৎকার বাবায় পরিবর্তিত হয়েছে।

তাচিয়া চলে গেছেন। তবে তাঁর উপন্যাস রয়ে গেছে। যে উপন্যাসটি গার্সিয়া মার্কেসের জন্য অনন্য, যেটি ১৯৫৬ সালের শেষের মাসগুলোতে তিনি লেখেন এবং সুয়েজ সঙ্কটের সাথে সমন্বয় সাধন করেন। পুরো কাহিনি তাচিয়ার মাদ্রিদের উদ্দেশ্যে ছাড়ার বহু আগেই ঠিক করা হয়েছিল। অক্টোবর মাস: একজন কর্নেল, যার নাম পাঠকের কাছে অজানাই থেকে যাবে, যিনি মাকোন্দোয় বাস করতেন, পঁচাত্তর বছর বয়সী, যিনি কলম্বিয়ার বনে হারিয়ে যাওয়া একটি ছোট্ট, সরু, যেন গলা চেপে ধরা হয়েছে এমন নদী বিধৌত মফস্বল শহরে থাকতেন। কর্নেল ছাপ্পান্ন বছর ধরে ‘এক হাজার বছরের যুদ্ধের’ অবসর ভাতার জন্য অপেক্ষা করছেন এবং তাঁর আর কেনো সহায়সম্বল ছিল না। পনের বছর হয়ে গেছে, তিনি পেনশন বিভাগ থেকে শেষ চিঠি পেয়েছেন, তবে এখনও তিনি প্রতিদিন পোস্ট অফিস যান, কোন খবর এসেছে কিনা তা দেখার জন্য। এভাবে তিনি জীবন কাটাতে লাগলেন এমন এক খবরের জন্য অপেক্ষায়, যেটি কখনো আসেনি। তাঁর এক ছেলে ছিল, নাম আগুস্তিন, একজন দর্জি, তাকে সরকারের লোক খুন করে কারণ সে বছরের শুরুতে চোরাগুপ্তা রাজনৈতিক প্রচারণা চালাচ্ছিল। বুড়ো দম্পত্তির দেখভাল করা পুত্র আগুস্তিনকে খুন করা হলে, মৃত ছেলেটি তার চ্যাম্পিয়ন হওয়া লড়াকু মোরগটিকে রেখে যায়, যার বিক্রয় মূল্য বেশ বড় অংকের টাকা হবার কথা। কর্নেলকে সীমাহীন নাকাল সহ্য করতে হয় আর সেই মোরগটিকে বিক্রি না করায়, যেটি তাঁর এবং ছেলের বন্ধুদের (আলফোনসো, আলবারো এবং খেরমান) জন্য সম্মান এবং প্রতিরোধের প্রতীক, এবং অবশ্যই ছেলে আগুস্তিনের স্মৃতিচিহ্ন। কর্নেলের স্ত্রী, যিনি বেশ বাস্তববাদী মহিলা, তিনি অসুস্থ এবং তাঁর চিকিৎসা প্রয়োজন। তিনি কর্নেলের মতের বিরোধিতা করেন এবং বারংবার তাকে মোরগ বিক্রির জন্য জোরাজুরি করতে থাকেন। উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ে, কর্নেলের পূর্বের মতোই মোরগটিকে বিক্রি না করার ব্যাপারে তার একগুঁয়েমি জারি রাখেন।

কয়েক বছর পর, গার্সিয়া মার্কেসের ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ হেমিংওয়ের ‘দ্য ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি’র মতো বিশ্বব্যাপি বহু সমাদৃত সেরা হ্রস্য-কাহিনিতে পরিণত হলো- এর তীক্ষ্ণতা, এর সযত্নে ব্যবহৃত যতিচিহ্ন সন্নিবেশিত কাহিনি এবং বুদ্ধিদীপ্তভাবে তৈরি উপসংহার লক্ষণীয়। লেখক নিজেই বলেন, ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’র ‘চেতনা, বাহুল্যবর্জিত এবং স্পষ্ট ভাব প্রকাশ আমি সাংবাদিকতা থেকে শিখেছি।

তাচিয়া চলে গেছে। বড়দিনে গার্সিয়া মার্কেস ওতেল দ্য ফ্লঁদ্রতে চলে আসেন পুরো সময় থাকার জন্য, সে সময়টিকে তিনি পরবর্তীকালে বলবেন, ‘১৯৫৬ সালের সেই বিষণ্ণ হেমন্ত কাল’। ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লিখে না’ উপন্যাসিকার শেষে মোরগের টিকে থাকা, বুড়ো মহিলার ঘ্যানঘানানি সত্ত্বেও ঔপন্যাসিকার টিকে থাকাও বটে; এবং অবশেষে সেটির সমাপ্তি ঘটে তাচিয়া মাদ্রিদের উদ্দেশ্যে রওনা দেবার কয়েক সপ্তাহ পর। তিনি ঔপন্যাসিকাটির তারিখ দেন- জানুয়ারি ১৯৫৭।’ দুজনের সম্পর্কে কোনো শিশুর জন্ম হয়নি বটে, তবে ঔপন্যাসিকা জন্ম নিয়েছিল।

এখন খাবার কেনার জন্য, দাম নিয়ে তর্কাতর্কি অথবা শস্তায় খাবার রান্না করার কোনো তাচিয়া তার পাশে নেই। কর্নেল যেমন তাঁর কফির পাত্রের শেষ কনাটুকু চেঁছেপুছে নিচ্ছিলেন ঔপন্যাসিকার প্রথম পৃষ্ঠায়, গার্সিয়া মার্কেসও তেমনি তাঁর শেষ সম্বলগুলো ঝেড়েপুছে নিচ্ছিলেন। তিনি তার বন্ধু খোসে ফন্ত কাস্ত্রোকে বলেছেন, তিনি নাকি একবার পুরো একটি সপ্তাহ তাঁর ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া চিলেকোঠায়, না খেয়ে, না দেয়ে কেবলমাত্র বেসিনের পানি পান করে হোটেলের মালিক পক্ষের কাছ থেকে লুকিয়ে ছিলেন। তাঁর ভাই গুস্তাবো স্মরণ করেন, ‘আমার মনে পড়ে, একবার বারানকিইয়্যায় মদ্যপান করার সময় গাবিতো আমাকে আত্মবিশ্বাস এনে দেয় যখন তিনি বলেন: ‘প্রত্যেকেই আমার বন্ধু হয়েছে সেই ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ থেকে, তবে কেউ জানে না তার জন্য তাকে কত মূল্য দিতে হয়েছে। কেউ জানে না আমি প্যারিসে উচ্ছিষ্ট খেতে বাধ্য হই।’ তিনি আমাকে আরো বলেছেন, ‘একবার আমি বন্ধুদের বাড়িতে একটি পার্টিতে ছিলাম, যারা তখন আমাকে একটু আধটু সাহায্য করত। পার্টি শেষে, বাড়ির গৃহিণী আমাকে অনুরোধ করলেন, তার পক্ষ থেকে রাস্তায় গিয়ে উচ্ছিষ্ট ফেলে আসতে। আমি এত ক্ষধুার্ত ছিলাম, যে আমি সেখান থেকে খাওয়া যায় এমন কিছু খাদ্যবস্তু উদ্ধার করি এবং সেখানে তৎক্ষণাৎই খেয়ে ফেলি।

অন্যক্ষেত্রে তিনি হেরে যাওয়ার শেষ প্রান্তেও ছিলেন। তিনি লাতিন আমেরিকার নাইটক্লাব লেসকালেতে গান গাওয়ার কাজ পান, সেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনি বাইয়্যেনাতোর বদলে মেহিকোর জনপ্রিয় সঙ্গীত রাঞ্চেরাস ডুয়েট গাইতেন বেনেসুয়েলার চিত্রশিল্পী এবং ভাস্কর খেসুস রাফায়েল সেতোর সাথে। তিনি প্রতিরাতে এক ডলার করে আয় করতেন (যেটি ২০০৮ সালের আট ডলার সমমূল্যের সমান)। তিনি হোটেলের আশেপাশে এলাকায় আড্ডা দিতেন। এদিকে কলম্বিয়ায় আড্ডাস্থল ‘দ্য কেভ’-এ বাররানকিইয়্যার বন্ধুরা একটা দল তৈরি করেছেন ‘গাবিতো সাহায্য সমিতি’ (‘সোসিওদাদ দে আমিগোস পারা আয়ুদার আ গাবিতো’)। ওরা ১০০ ডলার নিয়ে ‘রনদন’ বইয়ের দোকানে গিয়ে এর মালিক খোর্খে রনদনের সাথে শলাপরামর্শ করে কীভাবে যোগাড় করা টাকাপয়সা ওদের বন্ধু গার্সিয়া মার্কেসের কাছে পাঠানো যায়, রনদন এ ক্ষেত্রে তাঁর সমাজতন্ত্রী দলের অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন এবং বুঝিয়ে বললেন কীভাবে তিনি পোস্টকার্ডের ভিতর গুপ্ত বার্তা পাঠাতেন। বন্ধুরা গার্সিয়া মার্কেসকেও একই রকম গুপ্ত চিঠি পাঠালেন এবং সেই সাথে তা মর্মোদ্ধারের কৌশলও লিখে পাঠালেন। অবশ্যই, কার্ডটা গুপ্ত চিঠির আগে আসল, এবং দৈন্যপীড়িত গার্সিয়া মার্কেস, যিনি আরো কিছু আশা করেছিলেন, তিনি আশাহত হয়ে কার্ডটা আবর্জনার ঝুড়িতে ছুড়ে ফেলে দেন। সেইদিন বিকেলেই গুপ্ত চিঠি মর্মোদ্ধারের কৌশল চলে আসে এবং তাঁর ভাগ্য ভালো যে হোটেলের আবর্জনার ড্রামটা তন্ন তন্ন করে খুঁজে শেষ অবধি পোস্টকার্ডটা খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি।

গার্সিয়া মার্কেস প্যারিসে আঠারো মাস থাকেন, কেবল একটি টিকিট ভাঙানো টাকা, বন্ধুদের কিছু বিক্ষিপ্ত দান-দক্ষিণা এবং তাঁর নিজের টিকে থাকার জন্য কিছু অল্প স্বল্প সঞ্চয় সম্বল করে। এছাড়া তাঁর কলম্বিয়ার ফিরে যাওয়ার আর কোনো উপায়ও নেই। ইতোমধ্যে তিনি ফরাসি ভাষায় কথা বলা শিখে গেছেন, প্যারিসকে খুব ভালোভাবে চিনে ফেলেছেন এবং সেখানে তাঁর নানান কিসিমের বন্ধু-বান্ধব জুটে গেছে, বিশেষ করে দু চারজন ফরাসি, ভিন্ন দেশের কিছু লাতিন আমেরিকান এবং বেশ কজন আরব- সময়টা শুধুমাত্র সুয়েজখালের ছিল না, আলজেরিয়ায় সংঘর্ষ চলছিল- এবং কয়েকবার পুলিশ নিয়মিত নিরাপত্তা তল্লাশির সময় তাঁকে ধরেও নিয়ে গেছে:

‘একরাতে, আমি সিনেমা দেখে ফিরছি, প্রহরারত একদল পুলিশ রাস্তায় নেমেছে, তারা আমার মুখে থুতু ছিটিয়ে আমাকে ঘুষি মেরে বেঁধে নিয়ে ওদের অস্ত্র সজ্জিত ওয়াগনে ওঠায়। গাড়ি ভর্তি সব নিশ্চুপ আলজেরীয়। তাদেরও স্থানীয় ক্যাফে থেকে তুলে নিয়ে প্রহার করে গাড়িতে তুলেছে। আমাকে যে পুলিশগুলো আলজেরীয় ভেবে গ্রেফতার করেছে, তারা সেই আলজেরীয়। সুতরাং রাতটা আমি তাদের সাথে মিলেমিশে, নিকটস্থ পুলিশ ক্যাম্পে সার্ডিন মাছের মতো একটি গরাদে থাকি, যে সময়ে উর্দি পরা পুলিশগুলো, মদের ভেতর রুটির টুকরো ভিজিয়ে খেতে খেতে নিজেদের মধ্যে বাচ্চাদের কথা আলাপ করছিল। আইন-শৃঙ্খলার প্রয়োগের ক্ষেত্রে ওদের শোষণ এবং গাধামোর প্রতিবাদে ওদের কান ঝালাপালা করে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য আমি আর আলজেরীয়রা সারা রাত জেগে ব্রাসসেনসের গান গাইতে থাকি।’

একরাতেই তিনি আহমেদ তেব্বালকে বন্ধু বানিয়ে ফেলেন, যিনি পেশায় একজন ডাক্তার, তিনি তাকে সংঘর্ষ সম্পর্কে আলজেরীয় দৃষ্টিভঙ্গি অবগত করেন এবং এমনকি আলজেরীয় ইস্যুতে তাদের পক্ষে গার্সিয়া মার্কেসকে কিছু বিধ্বংসী কাজেও যুক্ত করেন। যাইহোক, আর্থিকভাবে, সব কিছু খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছিল। এক ভয়ানক রাতে, তিনি দেখতে পান এক লোক পোঁয়া সাঁ মিশেল সেতু পার হয়ে যাচ্ছেন:

নিজের পরিস্থিতি সম্পর্কে, আমার পুর্র্ণাঙ্গ ধারণা ছিল না, যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি নিজেকে জার্দাঁ দু লুক্সেমবুর্গে দেখতে পাই, সারাদিনে একটি চেস্টনাটের দানাও পেটে পড়েনি আর ঘুমানোর জায়গাটুকুও নেই... আমি যখন পোঁয়া সাঁ মিশেল সেতু পার হয়ে যাই, আমার মনে হচ্ছিল কুয়াশায় কেবল আমি একা নই, কারণ আমি স্পষ্টভাবে অপর পাশ হতে কেউ একজন হেঁটে আসছে এমন পায়ের আওয়াজ পাই। ‘আমি কুয়াশার মধ্যে তার বাহ্যিক একটা অবয়ব দেখতে পাই, একই ফুটপাতে এবং আমার মতো একই গতিতে হেঁটে আসছে সে, এবং আমি তার লাল-কালো ছককাটা পশমী কাপড়ের জ্যাকেটখানা দেখতে পাই, তাৎক্ষণিকভাবে আমরা একে অপরকে অতিক্রম করে সেতুর বাকি অর্ধেক পথে পা বাড়াই, আমি তার অপরিচ্ছন্ন উস্কখুস্ক চুল, তুর্কি মোচ, এবং বিষাদগ্রস্ত চেহারা দেখতে পাই, যেটি বলে দেয় সে রোজ না খেয়ে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে, আর আমি দেখি তার চোখে জল টলমল করছে। আমার রক্ত হিম হয়ে আসে কারণ আমার পিছনে চলে গেছে যে মানুষটি, সে দেখতে আমার মতই।

পরবর্তীকালে, ওইসব দিনের কথা স্মরণ করে তিনি বলবেন: ‘আমিও জানি চিঠির জন্য অপেক্ষা করা এবং ভুখা থাকা আর ভিক্ষে করে খাওয়া ব্যাপারটা কেমন: ওই অবস্থায়ই আমি প্যারিসে ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লিখে না’ শেষ করি। লোকটা খানিকটা আমারই মতোন, একই রকম।’

সেসময় এরনান বিয়েকো, যার আর্থিক অবস্থা গার্সিয়া মার্কেসের ঠিক উল্টো, তিনি তাঁর সমস্যার অনেকখানি সমাধান করেছেন তাঁকে ওতেল দ্য ফ্লঁদ্রর মালিক মাদাম লাখোয়ার অর্থ পরিশোধ বাবদ ১২০,০০০ ফ্রাঁ ধার দিয়ে। অত্যধিক মদ্যপান করে, রাতের বেলায় পার্টি থেকে ফেরার সময়, বিয়েকো গার্সিয়া মার্কেসকে বলেন, তাদের সম্পর্ক খোলামেলা হওয়া জরুরি। তিনি তাঁর কাছে জানতে চান তাঁর হোটেলের বিল এখন কতোয় গিয়ে ঠেকেছে। গার্সিয়া মার্কেস এ নিয়ে আলোচনা করতে চান না। তাঁর তারুণ্যের সময়টিতে যে কারণে লোকজন প্রায়ই তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত, তা হলো তাঁর পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, তিনি কখনো নিজের জন্য দুঃখবোধ করতেন না এবং কখনো মুখ ফুটে সাহায্যও চাননি। অবশেষে, মদ্যপ অবস্থায় নাটকীয় দৃশ্যের অবতারণার পর, বিয়েকো একটি ঝরণা কলম বের করলেন, এবং সামনে পার্ক করা গাড়ির ছাদে একটি চেক লিখে, বন্ধুর পকেটে গুঁজে দিলেন। টাকার অঙ্কে এটি ছিল ৩০০ ডলারের সমমূল্যের, সে সময়ের বিবেচনায় একটি বিশাল অংক বটে। গার্সিয়া মার্কেস লজ্জা এবং কৃতজ্ঞতায় অবনত হলেন। যখন তিনি টাকাটা মাদাম লাখোয়ার কাছে হোটেলের বিল বাবদ পাওনা টাকাটি নিয়ে গেলেন, ভদ্রমহিলা যেন তোতলাচ্ছিলেন, লজ্জায় মুখ রাঙা গেছে- প্যারিস বলে কথা- বোহেমীয় আর জীবনের সাথে সংগ্রামরত শিল্পীদের আবাসস্থল- ‘না, না, মশিয়েঁ, এ অনেক টাকা, কেন আপনি আমায় এখন কিছু, আর বাকিটা পরে দিচ্ছেন না।’

তিনি সেবার শীতে বেঁচে গেলেন। তবে মনোমোহনী ইউরোপের ফাঁদে ধরা দিলেন না। মের্সেদেস এখনো কলম্বিয়ায় তার জন্য অপেক্ষা করছে। ১৯৫৭ সালের কোনো এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে, তাঁর চোখে পড়ে, তাঁর জীবনের আদর্শ আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তাঁর স্ত্রী মেরি ওয়েলশের সাথে বুলেভার্ড সাঁ-মিশেলের পথ ধরে জাদর্ঁা দ্যু লুক্সেমবুর্গ উদ্যানের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। তাঁর পরনে পুরনো জিন্সের প্যান্ট, লাম্বারজ্যাক শার্ট আর মাথায় বেসবল ক্যাপ। গার্সিয়া মার্কেসের তাঁর দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় একটু যেন ভয় পাচ্ছিলেন, এত বেশি উত্তেজনা অনুভব করছিলেন যে, রাস্তার ওপর পাশ থেকে ডাকতে পারলেন না: ‘মায়েস্ত্রো।’ বিখ্যাত লেখকটি, যার উপন্যাস একজন বুড়ো মানুষ, সমুদ্র আর বিরাট এক মাছ নিয়ে লেখা, তিনি আংশিকভাবে এই তরুণকে তাঁর সম্প্রতি সমাপ্ত করা ঔপন্যাসিকায় অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, যে ঔপন্যাসিকায় এক বুড়ো লোক, সরকারী অবসরভাতা এবং একটি লড়াকু মোরগ আছে, সেই তরুণ লেখক তাঁর দিকে হাত উঁচিয়ে চেঁচিয়ে, ‘খানিকটা বালকসুলভ কণ্ঠে’ বলে ওঠেন: আদিওস, আমিগো!’ (ক্রমশ)

বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ , ৩০ ভাদ্র ১৪৩০, ২৮ সফর ১৪৪৫

মার্কেসের সাংবাদিকতা অজানা অধ্যায়

মূল: জেরাল্ড মার্টিন অনুবাদ: সুরাইয়া ফারজানা হাসান

image

গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

পর্ব ১০

(পূর্ব প্রকাশের পর)

প্যারিসে ক্ষুধা: লা বোয়েম

(১৯৫৬-১৯৫৭)

একদিন বলা নেই, কওয়া নেই, তাঁর জীবনে আচমকা এক পরিবর্তন আসে। মার্চের এক সন্ধ্যায়, ভাগ্যচক্রে তাঁর এক তরুণীর সাথে দেখা হয়। তখন তিনি এক পর্তুগীজ সাংবাদিকের সাথে বাইরে ছিলেন, যিনি ফ্রান্সের গুপ্তচরবৃত্তির বিচারের ওপর ব্রাজিলের এক সংবাদপত্রে সংবাদ পরিবেশন করছেন। যাই হোক তরুণীটি ছিলেন স্পেন থেকে আগত ছাব্বিশ বছর বয়স্কা অভিনেত্রী তাচিয়া। তাঁর এখানে এক কবিতা আবৃত্তি অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা। প্রায় চল্লিশ বছর পর তিনি এদিনের কথা স্মরণ করে বলবেন, গাব্রিয়েল (এ নামেই তিনি সবসময় তাঁকে ডাকতেন) সেই আবৃত্তি অনুষ্ঠানে যোগদানে অনিহা প্রকাশ করেন: ‘কবিতার আবৃত্তি’, তিনি টিটকারি মেরে বলেন, ‘একঘেয়েমি লাগে ব্যাপারটা!’ আমি ধরে নেই, তিনি কবিতা ঘৃণা করেন।’ তিনি গির্জার কাছে সাঁ জামের্ঁ দে প্রে বুলেভার্ডে, ক্যাফে ল্য মাবিয়েনে অপেক্ষা করেন। আমরা আবৃত্তি শেষে তাঁর সাথে যোগ দেই। তিনি আঙুলের মতো চিকন ছিলেন, কোঁকড়া চুল আর গোঁফে তাকে আলজেরীয়দের মতো দেখাচ্ছিল, আমি কখনো গোঁফওয়ালা লোক পছন্দ করিনি। অমার্জিত পৌরুষ দেখানো লোকও পছন্দ করি না; এবং আমার সবসময় স্পেনের লোকজনের মতো বর্ণবাদী এবং সাংস্কৃতিক কুসংস্কার ছিল যে­, লাতিন আমেরিকার পুরুষরা নিম্নমানের।

তাচিয়ার ভাষ্যমতে, ‘আমি প্রথম দেখায় গাবরিয়েলকে দেখে অপছন্দ করেছিলাম: তার মধ্যে কবিতার কোনো ভাব ছিল না, তিনি ছিলেন অহংকারী এবং খানিকটা ভীতু স্বভাবের। এছাড়া আমি সবসময়ই বয়স্ক লোক পছন্দ করতাম, গাবরিয়েল তখন কমবেশি আমারই বয়সী। তিনি খুব শিঘ্রই আমার সামনে তাঁর কাজ নিয়ে বড়াই করা শুরু করলেন, সম্ভবত তিনি নিজেকে সাংবাদিক ভাবতেন, লেখক নয়। আমার সেই বন্ধু দশটা বাজলে পানশালা থেকে চলে গেল, তবে আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলা চালিয়ে যাই এবং এরপর প্যারিসের রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতে থাকি। গাবরিয়েল ফরাসিদের সম্পর্কে ভয়ানক কথা বলে... যদিও ফরাসিরা তার জন্য বুকটা পেতে দিয়েছে কারণ পরবর্তীতে তাঁরা তাঁর জাদুবাস্তবতার ব্যাপারে খুব যৌক্তিক অবস্থান নিবে।’

তাচিয়া আরো বলেন, ‘যখন আপনি এই তীব্র ব্যাঙ্গকারী কলম্বীয়র সাথে কথা বলা শুরু করবেন, তখন তাঁর আরেকটি দিক চোখে পড়বে, তাঁর গল্প বলার সময়ে কণ্ঠস্বরে কিছু একটা পাবেন আর আছে আত্মবিশ্বাসের হাসি। গার্সিয়া মার্কেস আর এই স্পষ্টভাষী স্প্যানিশ নারী সম্পর্কে জড়িয়ে যান, অচিরেই তা ঘনিষ্ঠতায় রূপ নেয়। এবং সম্ভবত আদিম সে সম্পর্ক। ঘটনাটি এপ্রিল মাসে। শুরুর দিকে গাবরিয়েলের কোনো মেয়েকে পানীয়, অথবা এক কাপ চকোলেট কিংবা সিনেমা দেখানোর জন্য পর্যাপ্ত টাকাপয়সা ছিল না। এরপর তাঁর পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেল তাঁর হাতে আর কিছুই রইল না।

কথা সত্যি। তাচিয়ার সাথে পরিচয়ের তিন সপ্তাহ পরে ‘এল ইন্দিপিডিয়েন্তে’ বোগোতায় বন্ধ হয়ে যায়: এই সময়, যদিও তিনি এই ব্যাপারটা সম্পর্কে প্রায় এক বছর বেখবর থাকে। এটিকে নতুন সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। তাঁর পাওনা টাকা পরিশোধের বদলে, পত্রিকার ‘ব্যবস্থাপনা পর্ষদ’ অবশেষে তাঁর জন্য কলম্বিয়ায় ফিরে যাওয়ার একটা প্লেনের টিকিট পাঠায়। যখন টিকেট এসে পৌঁছায়, গার্সিয়া মার্কেস ঢোক গিলে, একটা গভীর শ^াস নেন, এবং এটি ভাঙ্গিয়ে টাকা করে নেন। কারণটা কি তবে ইউরোপকে ভালো করে জানা; তাঁর নতুন উপন্যাস শেষ করার আকাক্সক্ষা; নাকি তিনি সত্যিই প্রেমে পড়েছিলেন? তিন মাস ধরে ‘অশুভ সময়’ উপন্যাস লিখছেন এবং এটা তিনি এটা চালিয়ে নিতে চান। সুতরাং বলা চলে তিনি নানা কারণে প্যারিস ছাড়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। বোগোতায় তিনি লেখালেখির জন্য খুব অল্প সময়ই পেতেন আর এখন তিনি তা বেশ উদ্দীপনার সাথে করছেন। এটা তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত। তবে লেখালেখি বিষয়টা তাঁর জন্য কঠিন হবে। তাছাড়া তাচিয়ার ব্যাপারটা তো রয়েইছে।

তাচিয়ার সাথে দেখা হবার পরপরই, কলম্বীয় লোকটি দেখলেন তিনি যে বইটি শুরু করেছেন এবং যার ওপর করেছেন তা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। একটি চরিত্র জন্মাতে শুরু করেছে- কর্নেল, যিনি একই সাথে আত্মবিশ^াসহীন এবং একগুঁয়ে জেদী, মাকোন্দো হতে এবং পেকে গলগলা হওয়া কলার গন্ধ থেকে বিচ্যুত শরণার্থী, এমন একজন মানুষ যিনি ‘এক হাজার দিবসের যুদ্ধের’ পর পঞ্চাশ বছর ধরে একটি চিঠির জন্য অপেক্ষা করছেন। আসল উপন্যাসটি (অশুভ সময়) এখন একপাশে সরানো, এ ছিল এক শীতল, নিষ্ঠুর কাজ যার জন্য ¯œায়ু এবং বিচ্ছিন্নতা প্রয়োজন, তবে এর লেখক তাকে একদম অনভিপ্রেত মুহূর্তে পান, অভাব এবং আবেগ দুটোই, তার নিজের লা বোয়েম সংস্করণের বাইরে বসবাস করছেন।

মায়ের সাথে যাত্রার স্মৃতিকাতরতা যেমন পাতার ঝড়’র জন্ম দিয়েছে, একই আবেগে, গ্লানিকর (বর্তমানে বসবাসের অসম্ভাবনার স্মৃতিকাতরতা), থেকে তিনি লিখলেন ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লিখে না’ (এল করোনেল নো তিয়েনে কিয়েন লে এস্ক্রিবা: আক্ষরিক অর্থেই কর্নেলকে চিঠি লেখার কেউ ছিল না)। গার্সিয়া মার্কেস বাস্তবে যে জীবন যাপন করে যাচ্ছেন, ঠিক সেখানে এবং তখন, তাচিয়ার সাথে। তারা তখন এক বিস্ময়কর, উত্তেজনাপূর্ণ, আবেগীয়, এবং সম্পূর্ণ অনাকাক্সিক্ষত এক সম্পর্কে জড়িয়ে গেছেন; তবে খুব শিঘ্রই তারা নিদারুণ অর্থকষ্টে পড়বেন। একদম শুরু থেকে সম্পর্কটা দারিদ্র্যপীড়িত এবং তারপর, বেশ দ্রুতই বিয়োগান্তক অবস্থার হুমকিতে পড়ে যায়। সুতরাং প্রথম উপন্যাসটি (অশুভ সময়), যেটির তখনও বেশ অগ্রগতি হয়েছে, সেটি শেষবারের মতো বাঁধা হয়, একটি ডোরাকাটা গলার টাই দিয়ে, এবং ওতেল দ্য ফ্লঁদ্রের একটি ভাঙ্গাচোরা ওয়ার্ডরোবের ভিতর রাখা হয়; এবং আরো নিবিড়, এবং দুর্দান্ত গল্প লেখা হয়, ক্ষুধার্ত কর্নেল আর তার অসুখী, দীর্ঘদিন রোগে ভোগা স্ত্রী, যেটি লেখা শুরু হয় ১৯৫৬ সালের মে অথবা জুনের শুরুতে।

গার্সিয়া মার্কেসের হোটেলের পাওনা আশঙ্কাজনকভাবে পর্বত প্রমাণ হয়ে ওঠে, তবে, তিনি কষ্ট করে হলেও ঘরটা ধরে রাখেন, যদিও তিনি ভাড়া পরিশোধ করতে পারছেন না। অথবা বলা যায়, তিনি তা করেননি। কয়েক সপ্তাহ পরে তিনি এবং তাচিয়ার এমনকি খেতে পারাটাও দুষ্কর হয়ে দাড়ায়। ঠিক তিনি ফরাসি ভাষা এখনও তেমন একটা আয়ত্তে আনতে পারেননি আর চাকরি পাওয়াও চাট্টিখানি কথা নয়; তবে সত্যটা হলো, তিনি তা খুঁজছেনও না। যখন প্লেনের টিকিটের টাকাটা খরচ হয়ে গেল, তিনি খালি বোতল এবং পুরনো পত্রিকা সংগ্রহ করতে লাগলেন এবং স্থানীয় দোকানগুলো থেকে এ বাবদ একশ ফ্রাঁ পেতেন। সময়ে সময়ে তিনি কসাইয়ের কাছ থেকে একটি হাড্ডি চেয়ে এনেছেন, যাতে তাচিয়া সুরুয়া জাতীয় কিছু রাঁধতে পারেন। তিনি একবার মেট্রোতে কয়েক সেন্ট কম পড়ে যাওয়াতে টিকিটের টাকা অন্যের কাছ থেকে চেয়ে নেন, তাকে যে লোকটি অর্থ সহায়তা দিয়েছিলেন সেই ফরাসি ভদ্রলোকের প্রতিক্রিয়ায় তার নিজেকে খেলো লাগছিল। তিনি কলম্বিয়ায় তার বন্ধুদের কাছে অর্থ সাহায্যের আর্জি জানিয়ে ক্রমাগত বার্তা পাঠাতে থাকেন, আর নিজেকে দেখতে পান তিনি একটা সুখবরের জন্য সপ্তাহের পর সপ্তাহ অপেক্ষা করছেন, ঠিক যেমনভাবে তাঁর নানা অতীতের দিনগুলিতে অবসর ভাতার জন্য অপেক্ষা করেছেন নতুন উপন্যাসের সেই কর্নেলের মতো। সম্ভবত ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তাকে টিকিয়ে রেখেছে।

পরের কয়েকটা মাসে আরেকটি বিপর্যয় তাঁদের সম্পর্কে আঘাত হানে। তাচিয়া গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এ বিষয়ে তাচিয়া বলেন, ‘গর্ভধারণের বিষয়টা সম্পূর্ণই আমার সিদ্ধান্ত ছিল, তাঁর নয়। অবশ্যই তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে, যদিও এবং সম্ভবত আমার পারিবারিক পটভূমিতে, আমি ঈশ^রের বিপরীতে গেছি।’ গর্ভের বাচ্চার সাড়ে চার মাস চলাকালীন হঠাৎ তাচিয়ার গর্ভপাত হয়। তাঁর বয়ানে জানা যায়, ‘আমি আট দিন মাতেরনিতে পোর্ত রোয়া হাসপাতালে ছিলাম। হাসপাতালটা আমরা যেখানে থাকতাম তাঁর খুব কাছে। গাবরিয়েল, সবসময় সন্ধ্যায় দেখা করার সময়টাতে অনাগত সন্তানের বাবাদের মধ্যে প্রথম হাসপাতালে এসে উপস্থিত হতো। গর্ভপাতের পর আমরা দুজনেই বুঝলাম সব কিছু চুকেবুকে গেছে। আমি চলে যাওয়ার ভয় দেখাই। আর অবশেষে আমি তা করি, আমি একদম চলে আসি, প্রথমে যাই বিয়েকোর বাড়ি, স্বাস্থ্য পুনরূদ্ধারের জন্য আর এরপর মাদ্রিদ চলে যাই। আমি খুব মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ি, বেহাল অবস্থা আমার। আমি সবসময় সম্পর্কের ক্ষেত্রে উঁচুতে ছিলাম, কিন্তু গর্ভধারণ আমায় নামিয়ে আনে। আমি ১৯৫৬ সালের ডিসেম্বর মাসে গার দোস্তারলিত্স স্টেশন থেকে প্যারিস ছাড়ি। গাবরিয়েল বন্ধুদের পুরো দলবল নিয়ে আমাকে স্টেশনে নিয়ে যায়। গর্ভপাতের অবস্থা থেকে আমি সেরে উঠি, তবে ভেতরে ভেতরে দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছিলাম। আমরা দেরি করে ফেলি, বাক্স প্যাটরা ট্রেনে ছুড়ে মারা হচ্ছিল, আমার দ্রুত টেনে চড়তে হলো এবং এমনকি কাউকে বিদায় বলার সময় পর্যন্ত নেই হাতে। আমার আটটি স্যুটকেস ছিল। গাবরিয়েল সবসময় বলতো এগুলো আদতে ষোলটি স্যুটকেস। ট্রেনটি নড়েচড়ে উঠলে আমার মন বিক্ষিপ্ত হয়ে যায় এবং জানালায় হাত রেখে কাঁদতে থাকি। ট্রেনটা চলতে শুরু করলে, আর আমি গাবরিয়েলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাই, তার চোখেমুখে বেদনা। সে হাঁটতে শুরু করে এবং আস্তে আস্তে দৃষ্টির অগোচরে চলে যায়। সত্যিই সে ১৯৫৬ সালে আমাকে সাহায্য সহায়তা দিতে ব্যর্থ হয়। সে কেবল এটে উঠতে পারেনি। অবশ্যই আমি তাকে কখনো বিয়ে করতে পারতাম না। আমার এ নিয়ে নূন্যতম খেদও নেই। তার ওপর একদমই নির্ভর করা যায় না। আর আমি এমন বাবার জন্য পৃথিবীতে কোনো সন্তান আনতে পারি না। কারণ সন্তানের চেয়ে কোনো কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়, তাই নয় কি? এখন অবশ্য আমি মনে করি আমার একদম ভুল ধারণা ছিল, কারণ সে চমৎকার বাবায় পরিবর্তিত হয়েছে।

তাচিয়া চলে গেছেন। তবে তাঁর উপন্যাস রয়ে গেছে। যে উপন্যাসটি গার্সিয়া মার্কেসের জন্য অনন্য, যেটি ১৯৫৬ সালের শেষের মাসগুলোতে তিনি লেখেন এবং সুয়েজ সঙ্কটের সাথে সমন্বয় সাধন করেন। পুরো কাহিনি তাচিয়ার মাদ্রিদের উদ্দেশ্যে ছাড়ার বহু আগেই ঠিক করা হয়েছিল। অক্টোবর মাস: একজন কর্নেল, যার নাম পাঠকের কাছে অজানাই থেকে যাবে, যিনি মাকোন্দোয় বাস করতেন, পঁচাত্তর বছর বয়সী, যিনি কলম্বিয়ার বনে হারিয়ে যাওয়া একটি ছোট্ট, সরু, যেন গলা চেপে ধরা হয়েছে এমন নদী বিধৌত মফস্বল শহরে থাকতেন। কর্নেল ছাপ্পান্ন বছর ধরে ‘এক হাজার বছরের যুদ্ধের’ অবসর ভাতার জন্য অপেক্ষা করছেন এবং তাঁর আর কেনো সহায়সম্বল ছিল না। পনের বছর হয়ে গেছে, তিনি পেনশন বিভাগ থেকে শেষ চিঠি পেয়েছেন, তবে এখনও তিনি প্রতিদিন পোস্ট অফিস যান, কোন খবর এসেছে কিনা তা দেখার জন্য। এভাবে তিনি জীবন কাটাতে লাগলেন এমন এক খবরের জন্য অপেক্ষায়, যেটি কখনো আসেনি। তাঁর এক ছেলে ছিল, নাম আগুস্তিন, একজন দর্জি, তাকে সরকারের লোক খুন করে কারণ সে বছরের শুরুতে চোরাগুপ্তা রাজনৈতিক প্রচারণা চালাচ্ছিল। বুড়ো দম্পত্তির দেখভাল করা পুত্র আগুস্তিনকে খুন করা হলে, মৃত ছেলেটি তার চ্যাম্পিয়ন হওয়া লড়াকু মোরগটিকে রেখে যায়, যার বিক্রয় মূল্য বেশ বড় অংকের টাকা হবার কথা। কর্নেলকে সীমাহীন নাকাল সহ্য করতে হয় আর সেই মোরগটিকে বিক্রি না করায়, যেটি তাঁর এবং ছেলের বন্ধুদের (আলফোনসো, আলবারো এবং খেরমান) জন্য সম্মান এবং প্রতিরোধের প্রতীক, এবং অবশ্যই ছেলে আগুস্তিনের স্মৃতিচিহ্ন। কর্নেলের স্ত্রী, যিনি বেশ বাস্তববাদী মহিলা, তিনি অসুস্থ এবং তাঁর চিকিৎসা প্রয়োজন। তিনি কর্নেলের মতের বিরোধিতা করেন এবং বারংবার তাকে মোরগ বিক্রির জন্য জোরাজুরি করতে থাকেন। উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ে, কর্নেলের পূর্বের মতোই মোরগটিকে বিক্রি না করার ব্যাপারে তার একগুঁয়েমি জারি রাখেন।

কয়েক বছর পর, গার্সিয়া মার্কেসের ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ হেমিংওয়ের ‘দ্য ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি’র মতো বিশ্বব্যাপি বহু সমাদৃত সেরা হ্রস্য-কাহিনিতে পরিণত হলো- এর তীক্ষ্ণতা, এর সযত্নে ব্যবহৃত যতিচিহ্ন সন্নিবেশিত কাহিনি এবং বুদ্ধিদীপ্তভাবে তৈরি উপসংহার লক্ষণীয়। লেখক নিজেই বলেন, ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’র ‘চেতনা, বাহুল্যবর্জিত এবং স্পষ্ট ভাব প্রকাশ আমি সাংবাদিকতা থেকে শিখেছি।

তাচিয়া চলে গেছে। বড়দিনে গার্সিয়া মার্কেস ওতেল দ্য ফ্লঁদ্রতে চলে আসেন পুরো সময় থাকার জন্য, সে সময়টিকে তিনি পরবর্তীকালে বলবেন, ‘১৯৫৬ সালের সেই বিষণ্ণ হেমন্ত কাল’। ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লিখে না’ উপন্যাসিকার শেষে মোরগের টিকে থাকা, বুড়ো মহিলার ঘ্যানঘানানি সত্ত্বেও ঔপন্যাসিকার টিকে থাকাও বটে; এবং অবশেষে সেটির সমাপ্তি ঘটে তাচিয়া মাদ্রিদের উদ্দেশ্যে রওনা দেবার কয়েক সপ্তাহ পর। তিনি ঔপন্যাসিকাটির তারিখ দেন- জানুয়ারি ১৯৫৭।’ দুজনের সম্পর্কে কোনো শিশুর জন্ম হয়নি বটে, তবে ঔপন্যাসিকা জন্ম নিয়েছিল।

এখন খাবার কেনার জন্য, দাম নিয়ে তর্কাতর্কি অথবা শস্তায় খাবার রান্না করার কোনো তাচিয়া তার পাশে নেই। কর্নেল যেমন তাঁর কফির পাত্রের শেষ কনাটুকু চেঁছেপুছে নিচ্ছিলেন ঔপন্যাসিকার প্রথম পৃষ্ঠায়, গার্সিয়া মার্কেসও তেমনি তাঁর শেষ সম্বলগুলো ঝেড়েপুছে নিচ্ছিলেন। তিনি তার বন্ধু খোসে ফন্ত কাস্ত্রোকে বলেছেন, তিনি নাকি একবার পুরো একটি সপ্তাহ তাঁর ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া চিলেকোঠায়, না খেয়ে, না দেয়ে কেবলমাত্র বেসিনের পানি পান করে হোটেলের মালিক পক্ষের কাছ থেকে লুকিয়ে ছিলেন। তাঁর ভাই গুস্তাবো স্মরণ করেন, ‘আমার মনে পড়ে, একবার বারানকিইয়্যায় মদ্যপান করার সময় গাবিতো আমাকে আত্মবিশ্বাস এনে দেয় যখন তিনি বলেন: ‘প্রত্যেকেই আমার বন্ধু হয়েছে সেই ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ থেকে, তবে কেউ জানে না তার জন্য তাকে কত মূল্য দিতে হয়েছে। কেউ জানে না আমি প্যারিসে উচ্ছিষ্ট খেতে বাধ্য হই।’ তিনি আমাকে আরো বলেছেন, ‘একবার আমি বন্ধুদের বাড়িতে একটি পার্টিতে ছিলাম, যারা তখন আমাকে একটু আধটু সাহায্য করত। পার্টি শেষে, বাড়ির গৃহিণী আমাকে অনুরোধ করলেন, তার পক্ষ থেকে রাস্তায় গিয়ে উচ্ছিষ্ট ফেলে আসতে। আমি এত ক্ষধুার্ত ছিলাম, যে আমি সেখান থেকে খাওয়া যায় এমন কিছু খাদ্যবস্তু উদ্ধার করি এবং সেখানে তৎক্ষণাৎই খেয়ে ফেলি।

অন্যক্ষেত্রে তিনি হেরে যাওয়ার শেষ প্রান্তেও ছিলেন। তিনি লাতিন আমেরিকার নাইটক্লাব লেসকালেতে গান গাওয়ার কাজ পান, সেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনি বাইয়্যেনাতোর বদলে মেহিকোর জনপ্রিয় সঙ্গীত রাঞ্চেরাস ডুয়েট গাইতেন বেনেসুয়েলার চিত্রশিল্পী এবং ভাস্কর খেসুস রাফায়েল সেতোর সাথে। তিনি প্রতিরাতে এক ডলার করে আয় করতেন (যেটি ২০০৮ সালের আট ডলার সমমূল্যের সমান)। তিনি হোটেলের আশেপাশে এলাকায় আড্ডা দিতেন। এদিকে কলম্বিয়ায় আড্ডাস্থল ‘দ্য কেভ’-এ বাররানকিইয়্যার বন্ধুরা একটা দল তৈরি করেছেন ‘গাবিতো সাহায্য সমিতি’ (‘সোসিওদাদ দে আমিগোস পারা আয়ুদার আ গাবিতো’)। ওরা ১০০ ডলার নিয়ে ‘রনদন’ বইয়ের দোকানে গিয়ে এর মালিক খোর্খে রনদনের সাথে শলাপরামর্শ করে কীভাবে যোগাড় করা টাকাপয়সা ওদের বন্ধু গার্সিয়া মার্কেসের কাছে পাঠানো যায়, রনদন এ ক্ষেত্রে তাঁর সমাজতন্ত্রী দলের অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন এবং বুঝিয়ে বললেন কীভাবে তিনি পোস্টকার্ডের ভিতর গুপ্ত বার্তা পাঠাতেন। বন্ধুরা গার্সিয়া মার্কেসকেও একই রকম গুপ্ত চিঠি পাঠালেন এবং সেই সাথে তা মর্মোদ্ধারের কৌশলও লিখে পাঠালেন। অবশ্যই, কার্ডটা গুপ্ত চিঠির আগে আসল, এবং দৈন্যপীড়িত গার্সিয়া মার্কেস, যিনি আরো কিছু আশা করেছিলেন, তিনি আশাহত হয়ে কার্ডটা আবর্জনার ঝুড়িতে ছুড়ে ফেলে দেন। সেইদিন বিকেলেই গুপ্ত চিঠি মর্মোদ্ধারের কৌশল চলে আসে এবং তাঁর ভাগ্য ভালো যে হোটেলের আবর্জনার ড্রামটা তন্ন তন্ন করে খুঁজে শেষ অবধি পোস্টকার্ডটা খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি।

গার্সিয়া মার্কেস প্যারিসে আঠারো মাস থাকেন, কেবল একটি টিকিট ভাঙানো টাকা, বন্ধুদের কিছু বিক্ষিপ্ত দান-দক্ষিণা এবং তাঁর নিজের টিকে থাকার জন্য কিছু অল্প স্বল্প সঞ্চয় সম্বল করে। এছাড়া তাঁর কলম্বিয়ার ফিরে যাওয়ার আর কোনো উপায়ও নেই। ইতোমধ্যে তিনি ফরাসি ভাষায় কথা বলা শিখে গেছেন, প্যারিসকে খুব ভালোভাবে চিনে ফেলেছেন এবং সেখানে তাঁর নানান কিসিমের বন্ধু-বান্ধব জুটে গেছে, বিশেষ করে দু চারজন ফরাসি, ভিন্ন দেশের কিছু লাতিন আমেরিকান এবং বেশ কজন আরব- সময়টা শুধুমাত্র সুয়েজখালের ছিল না, আলজেরিয়ায় সংঘর্ষ চলছিল- এবং কয়েকবার পুলিশ নিয়মিত নিরাপত্তা তল্লাশির সময় তাঁকে ধরেও নিয়ে গেছে:

‘একরাতে, আমি সিনেমা দেখে ফিরছি, প্রহরারত একদল পুলিশ রাস্তায় নেমেছে, তারা আমার মুখে থুতু ছিটিয়ে আমাকে ঘুষি মেরে বেঁধে নিয়ে ওদের অস্ত্র সজ্জিত ওয়াগনে ওঠায়। গাড়ি ভর্তি সব নিশ্চুপ আলজেরীয়। তাদেরও স্থানীয় ক্যাফে থেকে তুলে নিয়ে প্রহার করে গাড়িতে তুলেছে। আমাকে যে পুলিশগুলো আলজেরীয় ভেবে গ্রেফতার করেছে, তারা সেই আলজেরীয়। সুতরাং রাতটা আমি তাদের সাথে মিলেমিশে, নিকটস্থ পুলিশ ক্যাম্পে সার্ডিন মাছের মতো একটি গরাদে থাকি, যে সময়ে উর্দি পরা পুলিশগুলো, মদের ভেতর রুটির টুকরো ভিজিয়ে খেতে খেতে নিজেদের মধ্যে বাচ্চাদের কথা আলাপ করছিল। আইন-শৃঙ্খলার প্রয়োগের ক্ষেত্রে ওদের শোষণ এবং গাধামোর প্রতিবাদে ওদের কান ঝালাপালা করে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য আমি আর আলজেরীয়রা সারা রাত জেগে ব্রাসসেনসের গান গাইতে থাকি।’

একরাতেই তিনি আহমেদ তেব্বালকে বন্ধু বানিয়ে ফেলেন, যিনি পেশায় একজন ডাক্তার, তিনি তাকে সংঘর্ষ সম্পর্কে আলজেরীয় দৃষ্টিভঙ্গি অবগত করেন এবং এমনকি আলজেরীয় ইস্যুতে তাদের পক্ষে গার্সিয়া মার্কেসকে কিছু বিধ্বংসী কাজেও যুক্ত করেন। যাইহোক, আর্থিকভাবে, সব কিছু খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছিল। এক ভয়ানক রাতে, তিনি দেখতে পান এক লোক পোঁয়া সাঁ মিশেল সেতু পার হয়ে যাচ্ছেন:

নিজের পরিস্থিতি সম্পর্কে, আমার পুর্র্ণাঙ্গ ধারণা ছিল না, যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি নিজেকে জার্দাঁ দু লুক্সেমবুর্গে দেখতে পাই, সারাদিনে একটি চেস্টনাটের দানাও পেটে পড়েনি আর ঘুমানোর জায়গাটুকুও নেই... আমি যখন পোঁয়া সাঁ মিশেল সেতু পার হয়ে যাই, আমার মনে হচ্ছিল কুয়াশায় কেবল আমি একা নই, কারণ আমি স্পষ্টভাবে অপর পাশ হতে কেউ একজন হেঁটে আসছে এমন পায়ের আওয়াজ পাই। ‘আমি কুয়াশার মধ্যে তার বাহ্যিক একটা অবয়ব দেখতে পাই, একই ফুটপাতে এবং আমার মতো একই গতিতে হেঁটে আসছে সে, এবং আমি তার লাল-কালো ছককাটা পশমী কাপড়ের জ্যাকেটখানা দেখতে পাই, তাৎক্ষণিকভাবে আমরা একে অপরকে অতিক্রম করে সেতুর বাকি অর্ধেক পথে পা বাড়াই, আমি তার অপরিচ্ছন্ন উস্কখুস্ক চুল, তুর্কি মোচ, এবং বিষাদগ্রস্ত চেহারা দেখতে পাই, যেটি বলে দেয় সে রোজ না খেয়ে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে, আর আমি দেখি তার চোখে জল টলমল করছে। আমার রক্ত হিম হয়ে আসে কারণ আমার পিছনে চলে গেছে যে মানুষটি, সে দেখতে আমার মতই।

পরবর্তীকালে, ওইসব দিনের কথা স্মরণ করে তিনি বলবেন: ‘আমিও জানি চিঠির জন্য অপেক্ষা করা এবং ভুখা থাকা আর ভিক্ষে করে খাওয়া ব্যাপারটা কেমন: ওই অবস্থায়ই আমি প্যারিসে ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লিখে না’ শেষ করি। লোকটা খানিকটা আমারই মতোন, একই রকম।’

সেসময় এরনান বিয়েকো, যার আর্থিক অবস্থা গার্সিয়া মার্কেসের ঠিক উল্টো, তিনি তাঁর সমস্যার অনেকখানি সমাধান করেছেন তাঁকে ওতেল দ্য ফ্লঁদ্রর মালিক মাদাম লাখোয়ার অর্থ পরিশোধ বাবদ ১২০,০০০ ফ্রাঁ ধার দিয়ে। অত্যধিক মদ্যপান করে, রাতের বেলায় পার্টি থেকে ফেরার সময়, বিয়েকো গার্সিয়া মার্কেসকে বলেন, তাদের সম্পর্ক খোলামেলা হওয়া জরুরি। তিনি তাঁর কাছে জানতে চান তাঁর হোটেলের বিল এখন কতোয় গিয়ে ঠেকেছে। গার্সিয়া মার্কেস এ নিয়ে আলোচনা করতে চান না। তাঁর তারুণ্যের সময়টিতে যে কারণে লোকজন প্রায়ই তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত, তা হলো তাঁর পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, তিনি কখনো নিজের জন্য দুঃখবোধ করতেন না এবং কখনো মুখ ফুটে সাহায্যও চাননি। অবশেষে, মদ্যপ অবস্থায় নাটকীয় দৃশ্যের অবতারণার পর, বিয়েকো একটি ঝরণা কলম বের করলেন, এবং সামনে পার্ক করা গাড়ির ছাদে একটি চেক লিখে, বন্ধুর পকেটে গুঁজে দিলেন। টাকার অঙ্কে এটি ছিল ৩০০ ডলারের সমমূল্যের, সে সময়ের বিবেচনায় একটি বিশাল অংক বটে। গার্সিয়া মার্কেস লজ্জা এবং কৃতজ্ঞতায় অবনত হলেন। যখন তিনি টাকাটা মাদাম লাখোয়ার কাছে হোটেলের বিল বাবদ পাওনা টাকাটি নিয়ে গেলেন, ভদ্রমহিলা যেন তোতলাচ্ছিলেন, লজ্জায় মুখ রাঙা গেছে- প্যারিস বলে কথা- বোহেমীয় আর জীবনের সাথে সংগ্রামরত শিল্পীদের আবাসস্থল- ‘না, না, মশিয়েঁ, এ অনেক টাকা, কেন আপনি আমায় এখন কিছু, আর বাকিটা পরে দিচ্ছেন না।’

তিনি সেবার শীতে বেঁচে গেলেন। তবে মনোমোহনী ইউরোপের ফাঁদে ধরা দিলেন না। মের্সেদেস এখনো কলম্বিয়ায় তার জন্য অপেক্ষা করছে। ১৯৫৭ সালের কোনো এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে, তাঁর চোখে পড়ে, তাঁর জীবনের আদর্শ আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তাঁর স্ত্রী মেরি ওয়েলশের সাথে বুলেভার্ড সাঁ-মিশেলের পথ ধরে জাদর্ঁা দ্যু লুক্সেমবুর্গ উদ্যানের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন। তাঁর পরনে পুরনো জিন্সের প্যান্ট, লাম্বারজ্যাক শার্ট আর মাথায় বেসবল ক্যাপ। গার্সিয়া মার্কেসের তাঁর দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় একটু যেন ভয় পাচ্ছিলেন, এত বেশি উত্তেজনা অনুভব করছিলেন যে, রাস্তার ওপর পাশ থেকে ডাকতে পারলেন না: ‘মায়েস্ত্রো।’ বিখ্যাত লেখকটি, যার উপন্যাস একজন বুড়ো মানুষ, সমুদ্র আর বিরাট এক মাছ নিয়ে লেখা, তিনি আংশিকভাবে এই তরুণকে তাঁর সম্প্রতি সমাপ্ত করা ঔপন্যাসিকায় অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, যে ঔপন্যাসিকায় এক বুড়ো লোক, সরকারী অবসরভাতা এবং একটি লড়াকু মোরগ আছে, সেই তরুণ লেখক তাঁর দিকে হাত উঁচিয়ে চেঁচিয়ে, ‘খানিকটা বালকসুলভ কণ্ঠে’ বলে ওঠেন: আদিওস, আমিগো!’ (ক্রমশ)