চিত্রিত মৃৎশিল্প

প্রেক্ষিত বাংলাদেশের লোকশিল্প

দিলীপ কর

গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ মানুষ যাঁরা নিজেদের আনন্দের জন্য এবং সাধারণ মানুষের মনোরঞ্জন, সেই সাথে জীবিকার জন্য যে শিল্পকর্ম করে তাই লোকশিল্প। সাধারণ মানুষের জন্য তৈরি করা হয় তাই এসব শিল্পকর্মে খুবই সাধারণ রঙ ও সাধারণ সামগ্রী ব্যবহার করা হয় যাতে এই শিল্পকর্মসমূহ সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে।

গ্রাম-গঞ্জের বিভিন্ন উৎসব, পার্বণকে কেন্দ্র করে যে মেলা বা জনজমায়েত হয় তাতে আমরা এই লোকশিল্পকর্ম দেখতে পাই। মাটির পুতুল, শোলার পুতুল, কাঠের পুতুল, শখের হাঁড়ি, লক্ষ্মীর সরা ইত্যাদি লোকশিল্পকর্মের নিদর্শন।

একটি শিশুমেলা থেকে একটা মাটির পুতুল তার অভিভাবক থেকে উপহার পেয়ে আনন্দ পায়। লক্ষ্মীপুজো উপলক্ষে সাধারণ মানুষ লক্ষ্মীসরা কেনে। অন্যদিকে ধনবানেরা লক্ষ্মীর প্রতিমা গড়ে পুজো করে। মেলায় অবশ্য কারুশিল্পও পাওয়া যায়। তবে কারুশিল্প আর লোকশিল্পের মধ্যে প্রভেদ আছে। ব্যবহার্য জিনিসপত্রে সৌন্দর্য আরোপ করাই কারুশিল্পের কাজ।

লোকশিল্পের সাথে সাধারণের যোগ চিরকালীন। লোকশিল্পীরা স্বশিক্ষিত, গুরু বা বংশপরম্পরায় এ শিল্পদক্ষতা, শিল্পবৈশিষ্ট্য, শৈলী ও শিল্পধারা প্রবাহিত। তাই লোকশিল্প ঐতিহ্যের নিদর্শন, আমাদের শেকড়ের শিল্প।

বেঙ্গল ফাউন্ডেশন যে প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে তা লোকশিল্পের বৃহৎ শাখা- চিত্রিত মৃৎশিল্পের। চিত্রিত মৃৎশিল্পের মধ্যে পুতুল, বিভিন্ন প্রকার খেলনা, ছাঁচ ও ছাঁচের পুতুল, চিত্রিত ঘট, মনসা ঘট, মঙ্গল ঘট, নাগ ঘট, মনসার চালি ও মনসার ঝাড়, চিত্রিত হাঁড়ি-শখের হাঁড়ি, ষাঁড়, লক্ষ্মীসরা ইত্যাদির বিশাল সংগ্রহ নিয়ে চমৎকার এই প্রদর্শনীটি, যার শিরোনাম ‘বাংলাদেশের লোকশিল্প- চিত্রিত মৃৎশিল্প’। বিভিন্ন ব্যক্তিগত সংগ্রাহকের আনুকূল্যে এ প্রদর্শনীর আয়োজন।

চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেনের গবেষণা ও নির্দেশনায় এ প্রদর্শনী। বাংলাদেশের বেশিরভাগ জেলায় বর্তমানে কোথায় কী হচ্ছে তার তথ্য এবং মৃৎশিল্পের নিদর্শন স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে। বিভিন্ন ব্যক্তিগত সংগ্রাহকদের ঐতিহাসিক মৃৎপাত্র এ প্রদর্শনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নানা বর্ণ, আকৃতি ও অলংকরণে উজ্জ্বল মৃৎশিল্পের বিপুল বৈচিত্র্য ও শৈল্পিক ব্যঞ্জনা দর্শকের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে অধ্যাপক নিসার হোসেনের গবেষণা ও নির্দেশনার ভিত্তিতে প্রদর্শনীটি রূপলাভ করেছে। অগ্রজ গবেষক ও সংগ্রাহকদের অবদান তুলে ধরা, মাঠ পর্যায়ের উপাদান ও তথ্যসংগ্রহ, সমসাময়িক সংগ্রাহকদের মৃৎশিল্পের বিপুল সম্ভার চমৎকার ভাবে প্রদর্শনীতে উপস্থাপন করা হয়েছে।

প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনের সংগ্রাহক শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। অন্যান্য সংগ্রাহকেরা হলেন- প্রকৌশলী ময়নুল আবেদিন, শিল্পী তরুণ ঘোষ, শিশির ভট্টাচার্য্য, সাইদুল হক, নিসার হোসেন, কারুকলা বিভাগ- চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সুশান্ত ঘোষ, ইমরান উজ-জামান, নবরাজ রায়, টিটু সাহা। মাঠ পর্যায়ে উপাদান ও তথ্য সংগ্রহ করেছেন শেষোক্ত তিন জন।

বেঙ্গল শিল্পালয়ের কামরুল হাসান প্রদর্শনালয়ে এ প্রদর্শনী চলছে গত ২৯ জুলাই থেকে, চলবে ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত।

বেঙ্গল শিল্পালয়ের লেভেল ১-এর কামরুল হাসান প্রদর্শনালয়ের প্রবেশ পথের পাশে দীর্ঘ কয়েকটি ফেস্টুনে তুলে ধরা হয়েছে লোকশিল্প তথা লোকসংস্কৃতি প্রকাশ ও বিকাশে কাজ করেছিলেন সেরকম নিবেদিতপ্রাণ অগ্রজ গবেষক ও সংগ্রাহকদের পরিচিতি, অবদান।

তাঁদের মধ্যে আছেন- ব্রতচারী আন্দোলনের প্রবর্তক, লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানের সংগ্রাহক ও তাদের ইতিকথা লিপিবদ্ধকার গুরুসদয় দত্ত (১৮৮২-১৯৪১)। *কবি ও শিক্ষাবিদ জসীম উদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬) যিনি অবিভক্ত বাংলার লোকশিল্পের প্রথম প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। *শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন (১৯১৪-১৯৭৬) : লোকশিল্প জাদুঘর ও পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন।* তোফায়েল আহমেদ (১৯১৯-২০০২) : শিল্পাচার্যের অনুরোধে লোকশিল্প জাদুঘরের মূল পরিকল্পনা প্রণেতা। *শিল্পী কামরুল হাসান (১৯২১-১৯৮৮) : লোকশিল্পের নিদর্শন থেকে বিসিককে সমৃদ্ধ করেছেন, লোকশিল্পের উপাদান ব্যবহার করে নিজস্ব শিল্পরীতি তৈরি করেছেন। *মোহাম্মদ সাইদুর রহমান (১৯৪০-১৯৯৩) : ‘জামদানী’ তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাগ্রন্থ, লোক সাহিত্য সংকলনের সম্পাদক, নকশিকাঁথা বিশেষজ্ঞ।

লোকসংস্কৃতির নিদর্শন সংগ্রহ ও প্রথম প্রদর্শনীর বিষয়টি আমরা জানতে পারি দে’জ পাবলিশিং, ২০১৬, ঠাকুরবাড়ির আঙ্গিনায় জসীম উদ্দীনের স্মৃতিকথা সমগ্র থেকে। এখানে অংশবিশেষ তুলে ধরা হচ্ছে-

‘বহুদিন বহু গ্রাম ঘুরিয়া আমি নানারকম পুতুল, নক্সীকাঁথা, গাজির পট, পিঁড়িচিত্র, আলপনা চিত্র, ব্যাটন, সিকা, পুতুলনাচের পুতুল প্রভৃতি সংগ্রহ করিয়াছিলাম। বন্ধুরা পরামর্শ দিল, এইগুলি দিয়া কলিকাতায় প্রদর্শনী খুলিতে। রবীন্দ্রনাথের ঘরের ছাতে গবাদা (ব্রতীন্দ্রনাথ ঠাকুর) এই সংগ্রহগুলি উত্তম করিয়া সাজাইয়া রবীন্দ্রনাথকে ডাকিয়া আনিলেন। অবনীন্দ্রনাথও আসিলেন। রবীন্দ্রনাথ আমার সংগ্রহের এটা-ওটা নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিতে লাগিলেন। অবনীন্দ্রনাথ তো পুতুল নাচের পুতুলগুলি দেখিয়া খুশিতে বিভোর। সমস্ত দেখিয়া রবীন্দ্রনাথ বলিলেন ‘আমার ইচ্ছে করে এমন একটি নানারকমের পল্লীশিল্পের সংগ্রহ আমার শান্তিনিকেতনে সংরক্ষিত করি।’... পল্লীশিল্পের এই প্রদর্শনী দেখিয়া রবীন্দ্রনাথ যে বিবৃতি দিয়াছিলেন, তাহা তৎকালীন পত্রপত্রিকায় ছাপা হইয়াছিল। ইহার পূর্বে আমার এই শিল্পকলার নিদর্শনগুলি দিয়া কতিপয় বন্ধুর সাহায্যে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগে একটি প্রদর্শনী খুলিয়াছিলাম।... আরো কয়েকজনের চেষ্টায় ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের হলে আমার সংগ্রহগুলির আরেকটি প্রদর্শনী হয়।’

বেঙ্গল শিল্পালয়ের ‘চিত্রিত মৃৎশিল্প’ প্রদর্শনীর প্রদর্শনালয়ে প্রবেশ করলেই লোকশিল্পের নিদর্শনসমূহ দেখা যায়। এসব নিদর্শন অতীত থেকে সমসাময়িক, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের। কক্ষের মেঝেতে স্বচ্ছ কাঁচের বাক্সে প্রদর্শিত হচ্ছে মাটির ঘোড়া, ষাঁড়, হাতিসহ নানা প্রাণি। দেয়াল ঘেরা কাঁচের আড়ালে ঐতিহাসিক মৃৎপাত্র, টেপা পুতুল, নৌকাসহ বহু লোকশিল্প নিদর্শনের এক ভুবন। প্রদর্শনীতে সরার বিশাল সংগ্রহ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখার সুযোগে দর্শক বুঝতে পারেন একই দেব-দেবীর সরায় অঞ্চল ভেদে তাদের চেহারা যেমন আলাদা, দেখানোর ঢঙও আলাদা। আদিকল্প এক হলেও জনপদের আর্থিক-বৈষয়িক অবস্থার সঙ্গে সরার আকার, অলঙ্করণ ও দেব-দেবীর আভিজাত্য পাল্টায়। অঞ্চল ও শিল্পীর পার্থক্যে রূপায়ণ ও শৈলির ভিন্নতা অনুমেয়।

প্রদর্শনী আরো বিন্যস্ত পরিবেশে, আলোর পর্যাপ্ততা ও ব্যাখ্যাসহ উপাস্থপন করা গেলে দর্শনার্থীদের দেখা-জানার সুযোগ বাড়াত।

বাংলাদেশে মৃৎশিল্পের সুদীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের নানামুখী উদ্ভাবন, ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন, বাজার অর্থনীতির বিস্তারের কারণে বাংলার আবহমান সংস্কৃতি ও চিরায়ত ঐতিহ্য রক্ষায় নবীন প্রজন্মের এগিয়ে আসার বিকল্প নেই। এই প্রদর্শনী কিছুটা হলেও আমাদের শিকড়ের টান অনুভব করাবে।

বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ , ৩০ ভাদ্র ১৪৩০, ২৮ সফর ১৪৪৫

চিত্রিত মৃৎশিল্প

প্রেক্ষিত বাংলাদেশের লোকশিল্প

দিলীপ কর

image

হাতে বানানো ঘট, বরিশাল নিসার হোসেন সংগৃহীত

গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ মানুষ যাঁরা নিজেদের আনন্দের জন্য এবং সাধারণ মানুষের মনোরঞ্জন, সেই সাথে জীবিকার জন্য যে শিল্পকর্ম করে তাই লোকশিল্প। সাধারণ মানুষের জন্য তৈরি করা হয় তাই এসব শিল্পকর্মে খুবই সাধারণ রঙ ও সাধারণ সামগ্রী ব্যবহার করা হয় যাতে এই শিল্পকর্মসমূহ সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে।

গ্রাম-গঞ্জের বিভিন্ন উৎসব, পার্বণকে কেন্দ্র করে যে মেলা বা জনজমায়েত হয় তাতে আমরা এই লোকশিল্পকর্ম দেখতে পাই। মাটির পুতুল, শোলার পুতুল, কাঠের পুতুল, শখের হাঁড়ি, লক্ষ্মীর সরা ইত্যাদি লোকশিল্পকর্মের নিদর্শন।

একটি শিশুমেলা থেকে একটা মাটির পুতুল তার অভিভাবক থেকে উপহার পেয়ে আনন্দ পায়। লক্ষ্মীপুজো উপলক্ষে সাধারণ মানুষ লক্ষ্মীসরা কেনে। অন্যদিকে ধনবানেরা লক্ষ্মীর প্রতিমা গড়ে পুজো করে। মেলায় অবশ্য কারুশিল্পও পাওয়া যায়। তবে কারুশিল্প আর লোকশিল্পের মধ্যে প্রভেদ আছে। ব্যবহার্য জিনিসপত্রে সৌন্দর্য আরোপ করাই কারুশিল্পের কাজ।

লোকশিল্পের সাথে সাধারণের যোগ চিরকালীন। লোকশিল্পীরা স্বশিক্ষিত, গুরু বা বংশপরম্পরায় এ শিল্পদক্ষতা, শিল্পবৈশিষ্ট্য, শৈলী ও শিল্পধারা প্রবাহিত। তাই লোকশিল্প ঐতিহ্যের নিদর্শন, আমাদের শেকড়ের শিল্প।

বেঙ্গল ফাউন্ডেশন যে প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে তা লোকশিল্পের বৃহৎ শাখা- চিত্রিত মৃৎশিল্পের। চিত্রিত মৃৎশিল্পের মধ্যে পুতুল, বিভিন্ন প্রকার খেলনা, ছাঁচ ও ছাঁচের পুতুল, চিত্রিত ঘট, মনসা ঘট, মঙ্গল ঘট, নাগ ঘট, মনসার চালি ও মনসার ঝাড়, চিত্রিত হাঁড়ি-শখের হাঁড়ি, ষাঁড়, লক্ষ্মীসরা ইত্যাদির বিশাল সংগ্রহ নিয়ে চমৎকার এই প্রদর্শনীটি, যার শিরোনাম ‘বাংলাদেশের লোকশিল্প- চিত্রিত মৃৎশিল্প’। বিভিন্ন ব্যক্তিগত সংগ্রাহকের আনুকূল্যে এ প্রদর্শনীর আয়োজন।

চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেনের গবেষণা ও নির্দেশনায় এ প্রদর্শনী। বাংলাদেশের বেশিরভাগ জেলায় বর্তমানে কোথায় কী হচ্ছে তার তথ্য এবং মৃৎশিল্পের নিদর্শন স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে। বিভিন্ন ব্যক্তিগত সংগ্রাহকদের ঐতিহাসিক মৃৎপাত্র এ প্রদর্শনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নানা বর্ণ, আকৃতি ও অলংকরণে উজ্জ্বল মৃৎশিল্পের বিপুল বৈচিত্র্য ও শৈল্পিক ব্যঞ্জনা দর্শকের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে অধ্যাপক নিসার হোসেনের গবেষণা ও নির্দেশনার ভিত্তিতে প্রদর্শনীটি রূপলাভ করেছে। অগ্রজ গবেষক ও সংগ্রাহকদের অবদান তুলে ধরা, মাঠ পর্যায়ের উপাদান ও তথ্যসংগ্রহ, সমসাময়িক সংগ্রাহকদের মৃৎশিল্পের বিপুল সম্ভার চমৎকার ভাবে প্রদর্শনীতে উপস্থাপন করা হয়েছে।

প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনের সংগ্রাহক শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। অন্যান্য সংগ্রাহকেরা হলেন- প্রকৌশলী ময়নুল আবেদিন, শিল্পী তরুণ ঘোষ, শিশির ভট্টাচার্য্য, সাইদুল হক, নিসার হোসেন, কারুকলা বিভাগ- চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সুশান্ত ঘোষ, ইমরান উজ-জামান, নবরাজ রায়, টিটু সাহা। মাঠ পর্যায়ে উপাদান ও তথ্য সংগ্রহ করেছেন শেষোক্ত তিন জন।

বেঙ্গল শিল্পালয়ের কামরুল হাসান প্রদর্শনালয়ে এ প্রদর্শনী চলছে গত ২৯ জুলাই থেকে, চলবে ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত।

বেঙ্গল শিল্পালয়ের লেভেল ১-এর কামরুল হাসান প্রদর্শনালয়ের প্রবেশ পথের পাশে দীর্ঘ কয়েকটি ফেস্টুনে তুলে ধরা হয়েছে লোকশিল্প তথা লোকসংস্কৃতি প্রকাশ ও বিকাশে কাজ করেছিলেন সেরকম নিবেদিতপ্রাণ অগ্রজ গবেষক ও সংগ্রাহকদের পরিচিতি, অবদান।

তাঁদের মধ্যে আছেন- ব্রতচারী আন্দোলনের প্রবর্তক, লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানের সংগ্রাহক ও তাদের ইতিকথা লিপিবদ্ধকার গুরুসদয় দত্ত (১৮৮২-১৯৪১)। *কবি ও শিক্ষাবিদ জসীম উদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬) যিনি অবিভক্ত বাংলার লোকশিল্পের প্রথম প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। *শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন (১৯১৪-১৯৭৬) : লোকশিল্প জাদুঘর ও পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন।* তোফায়েল আহমেদ (১৯১৯-২০০২) : শিল্পাচার্যের অনুরোধে লোকশিল্প জাদুঘরের মূল পরিকল্পনা প্রণেতা। *শিল্পী কামরুল হাসান (১৯২১-১৯৮৮) : লোকশিল্পের নিদর্শন থেকে বিসিককে সমৃদ্ধ করেছেন, লোকশিল্পের উপাদান ব্যবহার করে নিজস্ব শিল্পরীতি তৈরি করেছেন। *মোহাম্মদ সাইদুর রহমান (১৯৪০-১৯৯৩) : ‘জামদানী’ তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাগ্রন্থ, লোক সাহিত্য সংকলনের সম্পাদক, নকশিকাঁথা বিশেষজ্ঞ।

লোকসংস্কৃতির নিদর্শন সংগ্রহ ও প্রথম প্রদর্শনীর বিষয়টি আমরা জানতে পারি দে’জ পাবলিশিং, ২০১৬, ঠাকুরবাড়ির আঙ্গিনায় জসীম উদ্দীনের স্মৃতিকথা সমগ্র থেকে। এখানে অংশবিশেষ তুলে ধরা হচ্ছে-

‘বহুদিন বহু গ্রাম ঘুরিয়া আমি নানারকম পুতুল, নক্সীকাঁথা, গাজির পট, পিঁড়িচিত্র, আলপনা চিত্র, ব্যাটন, সিকা, পুতুলনাচের পুতুল প্রভৃতি সংগ্রহ করিয়াছিলাম। বন্ধুরা পরামর্শ দিল, এইগুলি দিয়া কলিকাতায় প্রদর্শনী খুলিতে। রবীন্দ্রনাথের ঘরের ছাতে গবাদা (ব্রতীন্দ্রনাথ ঠাকুর) এই সংগ্রহগুলি উত্তম করিয়া সাজাইয়া রবীন্দ্রনাথকে ডাকিয়া আনিলেন। অবনীন্দ্রনাথও আসিলেন। রবীন্দ্রনাথ আমার সংগ্রহের এটা-ওটা নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিতে লাগিলেন। অবনীন্দ্রনাথ তো পুতুল নাচের পুতুলগুলি দেখিয়া খুশিতে বিভোর। সমস্ত দেখিয়া রবীন্দ্রনাথ বলিলেন ‘আমার ইচ্ছে করে এমন একটি নানারকমের পল্লীশিল্পের সংগ্রহ আমার শান্তিনিকেতনে সংরক্ষিত করি।’... পল্লীশিল্পের এই প্রদর্শনী দেখিয়া রবীন্দ্রনাথ যে বিবৃতি দিয়াছিলেন, তাহা তৎকালীন পত্রপত্রিকায় ছাপা হইয়াছিল। ইহার পূর্বে আমার এই শিল্পকলার নিদর্শনগুলি দিয়া কতিপয় বন্ধুর সাহায্যে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগে একটি প্রদর্শনী খুলিয়াছিলাম।... আরো কয়েকজনের চেষ্টায় ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের হলে আমার সংগ্রহগুলির আরেকটি প্রদর্শনী হয়।’

বেঙ্গল শিল্পালয়ের ‘চিত্রিত মৃৎশিল্প’ প্রদর্শনীর প্রদর্শনালয়ে প্রবেশ করলেই লোকশিল্পের নিদর্শনসমূহ দেখা যায়। এসব নিদর্শন অতীত থেকে সমসাময়িক, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের। কক্ষের মেঝেতে স্বচ্ছ কাঁচের বাক্সে প্রদর্শিত হচ্ছে মাটির ঘোড়া, ষাঁড়, হাতিসহ নানা প্রাণি। দেয়াল ঘেরা কাঁচের আড়ালে ঐতিহাসিক মৃৎপাত্র, টেপা পুতুল, নৌকাসহ বহু লোকশিল্প নিদর্শনের এক ভুবন। প্রদর্শনীতে সরার বিশাল সংগ্রহ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখার সুযোগে দর্শক বুঝতে পারেন একই দেব-দেবীর সরায় অঞ্চল ভেদে তাদের চেহারা যেমন আলাদা, দেখানোর ঢঙও আলাদা। আদিকল্প এক হলেও জনপদের আর্থিক-বৈষয়িক অবস্থার সঙ্গে সরার আকার, অলঙ্করণ ও দেব-দেবীর আভিজাত্য পাল্টায়। অঞ্চল ও শিল্পীর পার্থক্যে রূপায়ণ ও শৈলির ভিন্নতা অনুমেয়।

প্রদর্শনী আরো বিন্যস্ত পরিবেশে, আলোর পর্যাপ্ততা ও ব্যাখ্যাসহ উপাস্থপন করা গেলে দর্শনার্থীদের দেখা-জানার সুযোগ বাড়াত।

বাংলাদেশে মৃৎশিল্পের সুদীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের নানামুখী উদ্ভাবন, ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন, বাজার অর্থনীতির বিস্তারের কারণে বাংলার আবহমান সংস্কৃতি ও চিরায়ত ঐতিহ্য রক্ষায় নবীন প্রজন্মের এগিয়ে আসার বিকল্প নেই। এই প্রদর্শনী কিছুটা হলেও আমাদের শিকড়ের টান অনুভব করাবে।