ভাষা প্রশ্নে আমাদের আবেগ এবং কর্মপ্রয়াস

শেখর ভট্টাচার্য

‘জেলা মুখ্য ন্যায়দণ্ডাধীষের কার্যালয়’। বাঙালি অধ্যুষিত ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচর শহরের পথের পাশে এরকম একটি সাইনবোর্ড পড়ে থমকে দাঁড়িয়েছিলাম। ন্যায়দণ্ডাধীষ আবার মুখ্য। কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর বুঝতে পারলাম এটি হলো জেলার প্রধান বিচারকের কার্যালয়। সাইনবোর্ডটি মূলত সব মানুষের জন্য। একজন সাধারণ শিক্ষিত মানুষ যিনি বাংলা ভাষা পড়তে পারেন, সাধারণ বাংলার অর্থও বুঝতে পারেন তিনি কি মুখ্য ন্যায়দণ্ডাধীষের কার্যালয় কথাটি পড়ে এই কার্যালয়টি কার এবং এখানে কী কর্মকাণ্ড হয় তা বুঝতে পারবেন? গণযোগাযোগের বিষয় যেখানে মুখ্য সেখানে এরকম তৎসম শব্দের ব্যবহার কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা আমার মতো সামান্য মানুষের মাথায় আসে না। আবার অন্য একটি দেশের গণযোগাযোগ নিয়ে আমার কথা বলাও সমীচীন নয়।

এ প্রসঙ্গে আমার একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়- যিনি সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন তাকে নিয়ে একটি মজার গল্প বলি। তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। পরবর্তীতে সিলেটের বিখ্যাত মুরারী চাঁদ কলেজের সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। তার মেধা ও পাণ্ডিত্যের প্রতি তিনি সুবিচার করতে পারেননি- না হলে তিনি বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার সুপণ্ডিত হিসেবে দেশব্যাপী পরিচিত ও সবার কাছে গৃহীত হতে পারতেন। তার জ্ঞানগর্ভ আলোচনার মুগ্ধ শ্রোতা ছিলেন মুরারী চাঁদ কলেজের সব বিভাগের অনুজ, অগ্রজ, অধ্যাপকেরা। তার রসবোধ ছিল অত্যন্ত উচ্চস্তরের। এ কারণে তিনি সব সহকর্মীর অত্যন্ত প্রিয় একজন মানুষ ছিলেন এবং সবাই তাকে আন্তরিক শ্রদ্ধা করতেন। একবার কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলছে; সহকর্মীরা তার পাণ্ডিত্য যাচাই এবং তাকে কিছুটা বিপদে ফেলার জন্য, পোলভল্ট জ্যাম্প খেলাটি শুরু হওয়ার আগে তাকে অনুরোধ করলেন ধারাবিবরণী দেয়ার জন্য। তারা একটি শর্ত জুড়ে দিলেন- ধারাবিবরণীতে বাংলা ছাড়া অন্য কোন ভাষার শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। তারা মনে করেছিলেন, হঠাৎ করে ‘পোলভল্ট জাম্পে’কে বঙ্গানুবাদ করে ধারাবিবরণী দেয়া তার পক্ষে সম্ভব হবে না। তিনি মাইক্রফোন হাতে নিলেন এবং অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন, এখন শুরু হচ্ছে, ‘দণ্ড যোগে শূন্য মার্গে উল্লম্ফন প্রতিযোগিতা’। সবাই বিস্মিত হলেন। সত্যিই তো পোল মানে দণ্ড, সেই দণ্ড ব্যবহার করে শূন্যে উঠে তারপর একটি উচ্চতা পেরোতে হয় পোল ভল্ট জাম্পে। মুরারী চাঁদ কলেজের সে সময়ের অধ্যাপকেরা আজও এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। পুরো ঘটনাটি পাকিস্তান আমলের এবং আমার সেই আত্মীয়ও পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন অনেক বছর।

এ ঘটনাটি উল্লেখ করলাম যে কারণে তা হলো- এই ধারবিবরণীতে অধিকাংশ তৎসম শব্দ অর্থাৎ সংস্কৃত আশ্রয়ী বাংলা শব্দ ব্যবহার করা হয়েছিল এবং তার শ্রোতা ছিলেন উচ্চশিক্ষিত অধ্যাপক এবং শিক্ষার্থী। কিন্তু এরকম বাক্য স্বল্প শিক্ষিত মানুষের সামনে ব্যবহার করা বিদেশি ভাষা ব্যবহারের সমতুল্য বলে মনে হয়। তৎসম শব্দ ব্যবহার করে যে বাক্য রচনা করা হয় তা সাধারণের কাছে বোধগম্য হওয়া সম্ভব নয়।

এ কথা আমরা জানি প্রতিটি মাধ্যম, প্রতিটি বিষয়ের জন্য যথাযোগ্য শব্দ ব্যবহার করতে হয়। সংবাদপত্রের ভাষা হতে হয় স্বচ্ছ, সাবলীল। ভাষা যাতে সবার বোধগম্য পর্যায়ের হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হয়; আবার অত্যন্ত নিম্নমানের শব্দ ব্যবহার করে সার্বিক মান যাতে নষ্ট না হয় সে দিকটির প্রতিও সম্পাদকের তীক্ষè নজর রাখতে হয়। একই কথা প্রযোজ্য গণমাধ্যমের অন্যান্য শাখার জন্যও। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যারা গবেষক তাদের শব্দ ব্যবহার করতে হয় গবেষণার বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনা করে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যারা গবেষক তাদের অনেককেই দেখেছি, মনের ভাব প্রকাশের জন্য তৎসম শব্দের ব্যবহার করে জটিল এবং দুর্বোধ্য বাক্য নির্মাণ করে সবার সামনে নিজেদের পাণ্ডিত্যকে উপস্থাপন করতে। লিখিত ও মৌখিক যোগাযোগে তারা তৎসম শব্দ ব্যবহারে অতি আগ্রহী।

অন্যদিকে বাংলা ভাষার শব্দ সম্ভারে সাম্প্রতিককালে যে সমস্ত শব্দ লিখিত ও মৌখিকভাবে ব্যবহার করা হয় তা শুনে বা পড়ে রীতিমত হতাশ হতে হয়। টেলিভিশন নাটকে এবং সামাজিক গণমাধ্যমে এসব শব্দ শুনে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে রীতিমত ভীত হতে হয়। সামজিক গণমাধ্যম হলো সমাজের অপার স্বাধীনতা প্রদর্শনের স্থান এবং এর কোন নিয়ন্ত্রণ এবং নিয়ন্ত্রক নেই। এ কারণে এ নিয়ে না হয় আলোচনা না করলেও চলে। তারপরেও সামাজিক গণমাধ্যমে সমাজে বসবাসরত মানুষের সংস্কৃতির মান প্রতিফলিত হয়। বোঝা যায় একটি সমাজের সংস্কৃতির স্তর কেমন এবং কোন পর্যায়ে আছে। ভাষা নদীর স্রোতের মতো- এ কথাটি আমরা সবাই জানি। বহমান স্রোত থেকে ভাষা শব্দকে স্বপ্রণোদিত হয়ে শব্দকে গ্রহণ কিংবা বর্জন করে থাকে। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি বহুল ব্যবহৃত কয়েকটি শব্দ উল্লেখ করা যায়। ‘প্যারা’, ‘সেইরম’, ‘সেই’, ‘জোস’ বা ‘জোশ’। টেলিভিশন নাটকে প্রমিত বাংলা ভাষার বাক্যের মধ্যে যখন ‘প্যারা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় তখন এর উৎপত্তি, বুৎপত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। বোঝা যায় না এ রকম শব্দ ভাষার মানের উন্নয়ন না অবনয়ন করতে সাহায্য করবে। ‘প্যারা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়, ‘সমস্যা’ বা সাময়িক বিপদ অর্থে। যেমন- নায়ক, নায়িকাকে বলছে ‘আমি এখন প্যারায় আছি। কী করব বুঝতে পারছি না।’ একইভাবে উল্লেখিত প্রতিটি শব্দ প্রমিত বাংলায় যথেষ্ট উপযোগী শব্দ থাকা সত্ত্বেও অযাচিতভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে- যা ভাষার নান্দনিকতা বৃদ্ধিতে তেমন সহযোগিতা করছে বলে মনে হয় না।

যে কোন ভাষাকে সমৃদ্ধ করার জন্য, সেই ভাষায় যারা সাহিত্য চর্চা করে থাকেন তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকে। চর্যাপদ উত্তর বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করার জন্য বঙ্কিম চন্দ্র, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম অপরিসীম অবদান রেখে গেছেন। রবীন্দ্রনাথের সংগীত, ছোটগল্প, প্রবন্ধে এর প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। নজরুল ইসলাম নিজেও যেমন শব্দ তৈরি করেছেন একইভাবে বিদেশি শব্দের যথোপযুক্ত ব্যবহার করে ভাষাকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের ক্ষেত্রে অযাচিত তৎসম শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় না। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের ভাষা প্রকৃত অর্থে স্রোতঃস্বিনী নদীর মতো। বাক্য নির্মাণে তিনি ছিলেন সহজ, সরল এবং এর প্রধান কারণ বাক্যে অনর্থক তৎসম শব্দ ব্যবহার না করা। পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যের সব প্রথিতযশা সাহিত্য সাধকেরা একই কাজ করে গেছেন।

ইংরেজি সাহিত্যের আদিযুগের সঙ্গে আমরা যদি এলিয্যাবেথান, ভিক্টোরিয়ান, রোমান্টিক, আধুনিক এবং উত্তরাধুনিক যুগের শব্দ ও বাক্যের তুলনা করি আমরা দেখি যে প্রতিটি যুগে ভাষার বাক্য বিন্যাস সহজ ও বোধগম্য হয়েছে তবে শিল্প মানকে সম্পূর্ণ সুরক্ষা দেয়া হয়েছে। একইভাবে আমরা যদি চর্যাপদের ভাষার সঙ্গে মানিক বন্দোপাধ্যায়, বিভুতি ভূষণের ভাষার তুলনা করি তাহলে দেখতে পাব শিল্পের যথার্থতা রক্ষা করে ভাষাকে মানুষের বোধগম্যতার স্তরে নামিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে।

অতিরিক্ত, অপ্রয়োজনীয় সংস্কৃত আশ্রয়ী শব্দ ব্যবহার, অকারণে বিদেশি শব্দ প্রয়োগ, বাক্য নির্মাণে জটিলতা যেমন ভাষাকে গতিশীল করতে পারে না একইভাবে নিম্নমানের অতি আটপৌরে শব্দ ভাষার প্রমিত রূপে ব্যবহার করে অতিসরল বাক্য নির্মাণের মাধ্যমেও ভাষার সমৃদ্ধি লাভ সম্ভব নয়। ভাষার যদিও সর্বজনীন মান বলতে কিছু নেই তবে শব্দসম্ভার, সাহিত্য, সংস্কৃতির ঐতিহ্য, নান্দনিকতাসহ বেশ কিছু নির্ণায়কের দ্বারা ভাষা বিজ্ঞানীরা একটি ভাষাকে সমৃদ্ধ, অসমৃদ্ধ ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন।

ভাষার সমৃদ্ধির জন্য শুধু ভাষার মাস অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসে আলাপ-আলোচনা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ লিখে আমরা আমাদের দায়িত্ব সমাপন করে থাকি। ভাষার মান উন্নয়নের জন্য করণীয় বিষয়ে আমরা ধারাবাহিক আলাপ-আলোচনা, বিশ্লেষণ কিংবা উল্লেখযোগ্য গবেষণাকর্ম দেখতে পাই না। ভাষা নিয়ে আমাদের যে আবেগ সে আবেগ আমরা শুধু একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে দেখতে পাই। একুশের চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা যতটুকু রাজনীতি করি ভাষাকে সমৃদ্ধ করার জন্য ততটুকু কর্ম প্রয়াস চালাই না। সবকিছুতে আমাদের আড়ম্বর, নিবেদিত কাজের প্রতিফলন খুব সীমিত। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না- যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না;” একুশের চেতনাকে আমরা এখনও আড়ম্বর, উদযাপনের মধ্যে বৃত্তাবদ্ধ করে রেখেছি। সময় হয়েছে বৃত্তের খাঁচা খুলে, কর্মের মাধ্যমে ভাষার সমৃদ্ধি সাধনে মনোযোগ প্রদানের।

[লেখক: প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ , ৩০ ভাদ্র ১৪৩০, ২৮ সফর ১৪৪৫

ভাষা প্রশ্নে আমাদের আবেগ এবং কর্মপ্রয়াস

শেখর ভট্টাচার্য

‘জেলা মুখ্য ন্যায়দণ্ডাধীষের কার্যালয়’। বাঙালি অধ্যুষিত ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচর শহরের পথের পাশে এরকম একটি সাইনবোর্ড পড়ে থমকে দাঁড়িয়েছিলাম। ন্যায়দণ্ডাধীষ আবার মুখ্য। কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর বুঝতে পারলাম এটি হলো জেলার প্রধান বিচারকের কার্যালয়। সাইনবোর্ডটি মূলত সব মানুষের জন্য। একজন সাধারণ শিক্ষিত মানুষ যিনি বাংলা ভাষা পড়তে পারেন, সাধারণ বাংলার অর্থও বুঝতে পারেন তিনি কি মুখ্য ন্যায়দণ্ডাধীষের কার্যালয় কথাটি পড়ে এই কার্যালয়টি কার এবং এখানে কী কর্মকাণ্ড হয় তা বুঝতে পারবেন? গণযোগাযোগের বিষয় যেখানে মুখ্য সেখানে এরকম তৎসম শব্দের ব্যবহার কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা আমার মতো সামান্য মানুষের মাথায় আসে না। আবার অন্য একটি দেশের গণযোগাযোগ নিয়ে আমার কথা বলাও সমীচীন নয়।

এ প্রসঙ্গে আমার একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়- যিনি সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন তাকে নিয়ে একটি মজার গল্প বলি। তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। পরবর্তীতে সিলেটের বিখ্যাত মুরারী চাঁদ কলেজের সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। তার মেধা ও পাণ্ডিত্যের প্রতি তিনি সুবিচার করতে পারেননি- না হলে তিনি বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার সুপণ্ডিত হিসেবে দেশব্যাপী পরিচিত ও সবার কাছে গৃহীত হতে পারতেন। তার জ্ঞানগর্ভ আলোচনার মুগ্ধ শ্রোতা ছিলেন মুরারী চাঁদ কলেজের সব বিভাগের অনুজ, অগ্রজ, অধ্যাপকেরা। তার রসবোধ ছিল অত্যন্ত উচ্চস্তরের। এ কারণে তিনি সব সহকর্মীর অত্যন্ত প্রিয় একজন মানুষ ছিলেন এবং সবাই তাকে আন্তরিক শ্রদ্ধা করতেন। একবার কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলছে; সহকর্মীরা তার পাণ্ডিত্য যাচাই এবং তাকে কিছুটা বিপদে ফেলার জন্য, পোলভল্ট জ্যাম্প খেলাটি শুরু হওয়ার আগে তাকে অনুরোধ করলেন ধারাবিবরণী দেয়ার জন্য। তারা একটি শর্ত জুড়ে দিলেন- ধারাবিবরণীতে বাংলা ছাড়া অন্য কোন ভাষার শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। তারা মনে করেছিলেন, হঠাৎ করে ‘পোলভল্ট জাম্পে’কে বঙ্গানুবাদ করে ধারাবিবরণী দেয়া তার পক্ষে সম্ভব হবে না। তিনি মাইক্রফোন হাতে নিলেন এবং অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন, এখন শুরু হচ্ছে, ‘দণ্ড যোগে শূন্য মার্গে উল্লম্ফন প্রতিযোগিতা’। সবাই বিস্মিত হলেন। সত্যিই তো পোল মানে দণ্ড, সেই দণ্ড ব্যবহার করে শূন্যে উঠে তারপর একটি উচ্চতা পেরোতে হয় পোল ভল্ট জাম্পে। মুরারী চাঁদ কলেজের সে সময়ের অধ্যাপকেরা আজও এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। পুরো ঘটনাটি পাকিস্তান আমলের এবং আমার সেই আত্মীয়ও পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন অনেক বছর।

এ ঘটনাটি উল্লেখ করলাম যে কারণে তা হলো- এই ধারবিবরণীতে অধিকাংশ তৎসম শব্দ অর্থাৎ সংস্কৃত আশ্রয়ী বাংলা শব্দ ব্যবহার করা হয়েছিল এবং তার শ্রোতা ছিলেন উচ্চশিক্ষিত অধ্যাপক এবং শিক্ষার্থী। কিন্তু এরকম বাক্য স্বল্প শিক্ষিত মানুষের সামনে ব্যবহার করা বিদেশি ভাষা ব্যবহারের সমতুল্য বলে মনে হয়। তৎসম শব্দ ব্যবহার করে যে বাক্য রচনা করা হয় তা সাধারণের কাছে বোধগম্য হওয়া সম্ভব নয়।

এ কথা আমরা জানি প্রতিটি মাধ্যম, প্রতিটি বিষয়ের জন্য যথাযোগ্য শব্দ ব্যবহার করতে হয়। সংবাদপত্রের ভাষা হতে হয় স্বচ্ছ, সাবলীল। ভাষা যাতে সবার বোধগম্য পর্যায়ের হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হয়; আবার অত্যন্ত নিম্নমানের শব্দ ব্যবহার করে সার্বিক মান যাতে নষ্ট না হয় সে দিকটির প্রতিও সম্পাদকের তীক্ষè নজর রাখতে হয়। একই কথা প্রযোজ্য গণমাধ্যমের অন্যান্য শাখার জন্যও। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যারা গবেষক তাদের শব্দ ব্যবহার করতে হয় গবেষণার বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনা করে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যারা গবেষক তাদের অনেককেই দেখেছি, মনের ভাব প্রকাশের জন্য তৎসম শব্দের ব্যবহার করে জটিল এবং দুর্বোধ্য বাক্য নির্মাণ করে সবার সামনে নিজেদের পাণ্ডিত্যকে উপস্থাপন করতে। লিখিত ও মৌখিক যোগাযোগে তারা তৎসম শব্দ ব্যবহারে অতি আগ্রহী।

অন্যদিকে বাংলা ভাষার শব্দ সম্ভারে সাম্প্রতিককালে যে সমস্ত শব্দ লিখিত ও মৌখিকভাবে ব্যবহার করা হয় তা শুনে বা পড়ে রীতিমত হতাশ হতে হয়। টেলিভিশন নাটকে এবং সামাজিক গণমাধ্যমে এসব শব্দ শুনে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে রীতিমত ভীত হতে হয়। সামজিক গণমাধ্যম হলো সমাজের অপার স্বাধীনতা প্রদর্শনের স্থান এবং এর কোন নিয়ন্ত্রণ এবং নিয়ন্ত্রক নেই। এ কারণে এ নিয়ে না হয় আলোচনা না করলেও চলে। তারপরেও সামাজিক গণমাধ্যমে সমাজে বসবাসরত মানুষের সংস্কৃতির মান প্রতিফলিত হয়। বোঝা যায় একটি সমাজের সংস্কৃতির স্তর কেমন এবং কোন পর্যায়ে আছে। ভাষা নদীর স্রোতের মতো- এ কথাটি আমরা সবাই জানি। বহমান স্রোত থেকে ভাষা শব্দকে স্বপ্রণোদিত হয়ে শব্দকে গ্রহণ কিংবা বর্জন করে থাকে। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি বহুল ব্যবহৃত কয়েকটি শব্দ উল্লেখ করা যায়। ‘প্যারা’, ‘সেইরম’, ‘সেই’, ‘জোস’ বা ‘জোশ’। টেলিভিশন নাটকে প্রমিত বাংলা ভাষার বাক্যের মধ্যে যখন ‘প্যারা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় তখন এর উৎপত্তি, বুৎপত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। বোঝা যায় না এ রকম শব্দ ভাষার মানের উন্নয়ন না অবনয়ন করতে সাহায্য করবে। ‘প্যারা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়, ‘সমস্যা’ বা সাময়িক বিপদ অর্থে। যেমন- নায়ক, নায়িকাকে বলছে ‘আমি এখন প্যারায় আছি। কী করব বুঝতে পারছি না।’ একইভাবে উল্লেখিত প্রতিটি শব্দ প্রমিত বাংলায় যথেষ্ট উপযোগী শব্দ থাকা সত্ত্বেও অযাচিতভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে- যা ভাষার নান্দনিকতা বৃদ্ধিতে তেমন সহযোগিতা করছে বলে মনে হয় না।

যে কোন ভাষাকে সমৃদ্ধ করার জন্য, সেই ভাষায় যারা সাহিত্য চর্চা করে থাকেন তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকে। চর্যাপদ উত্তর বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করার জন্য বঙ্কিম চন্দ্র, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম অপরিসীম অবদান রেখে গেছেন। রবীন্দ্রনাথের সংগীত, ছোটগল্প, প্রবন্ধে এর প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। নজরুল ইসলাম নিজেও যেমন শব্দ তৈরি করেছেন একইভাবে বিদেশি শব্দের যথোপযুক্ত ব্যবহার করে ভাষাকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের ক্ষেত্রে অযাচিত তৎসম শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় না। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের ভাষা প্রকৃত অর্থে স্রোতঃস্বিনী নদীর মতো। বাক্য নির্মাণে তিনি ছিলেন সহজ, সরল এবং এর প্রধান কারণ বাক্যে অনর্থক তৎসম শব্দ ব্যবহার না করা। পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যের সব প্রথিতযশা সাহিত্য সাধকেরা একই কাজ করে গেছেন।

ইংরেজি সাহিত্যের আদিযুগের সঙ্গে আমরা যদি এলিয্যাবেথান, ভিক্টোরিয়ান, রোমান্টিক, আধুনিক এবং উত্তরাধুনিক যুগের শব্দ ও বাক্যের তুলনা করি আমরা দেখি যে প্রতিটি যুগে ভাষার বাক্য বিন্যাস সহজ ও বোধগম্য হয়েছে তবে শিল্প মানকে সম্পূর্ণ সুরক্ষা দেয়া হয়েছে। একইভাবে আমরা যদি চর্যাপদের ভাষার সঙ্গে মানিক বন্দোপাধ্যায়, বিভুতি ভূষণের ভাষার তুলনা করি তাহলে দেখতে পাব শিল্পের যথার্থতা রক্ষা করে ভাষাকে মানুষের বোধগম্যতার স্তরে নামিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে।

অতিরিক্ত, অপ্রয়োজনীয় সংস্কৃত আশ্রয়ী শব্দ ব্যবহার, অকারণে বিদেশি শব্দ প্রয়োগ, বাক্য নির্মাণে জটিলতা যেমন ভাষাকে গতিশীল করতে পারে না একইভাবে নিম্নমানের অতি আটপৌরে শব্দ ভাষার প্রমিত রূপে ব্যবহার করে অতিসরল বাক্য নির্মাণের মাধ্যমেও ভাষার সমৃদ্ধি লাভ সম্ভব নয়। ভাষার যদিও সর্বজনীন মান বলতে কিছু নেই তবে শব্দসম্ভার, সাহিত্য, সংস্কৃতির ঐতিহ্য, নান্দনিকতাসহ বেশ কিছু নির্ণায়কের দ্বারা ভাষা বিজ্ঞানীরা একটি ভাষাকে সমৃদ্ধ, অসমৃদ্ধ ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন।

ভাষার সমৃদ্ধির জন্য শুধু ভাষার মাস অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসে আলাপ-আলোচনা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ লিখে আমরা আমাদের দায়িত্ব সমাপন করে থাকি। ভাষার মান উন্নয়নের জন্য করণীয় বিষয়ে আমরা ধারাবাহিক আলাপ-আলোচনা, বিশ্লেষণ কিংবা উল্লেখযোগ্য গবেষণাকর্ম দেখতে পাই না। ভাষা নিয়ে আমাদের যে আবেগ সে আবেগ আমরা শুধু একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে দেখতে পাই। একুশের চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা যতটুকু রাজনীতি করি ভাষাকে সমৃদ্ধ করার জন্য ততটুকু কর্ম প্রয়াস চালাই না। সবকিছুতে আমাদের আড়ম্বর, নিবেদিত কাজের প্রতিফলন খুব সীমিত। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না- যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না;” একুশের চেতনাকে আমরা এখনও আড়ম্বর, উদযাপনের মধ্যে বৃত্তাবদ্ধ করে রেখেছি। সময় হয়েছে বৃত্তের খাঁচা খুলে, কর্মের মাধ্যমে ভাষার সমৃদ্ধি সাধনে মনোযোগ প্রদানের।

[লেখক: প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]