এডিসি হারুনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হবে

সানজিদাকে রংপুর রেঞ্জে বদলির খবর গুজব : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

থানায় নিয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের মারপিটের ঘটনায় সাময়িক বরখান্ত ডিএমপির রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশিদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার ইঙ্গিত দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। গতকাল সচিবালয়ে হারুনকান্ড প্রসঙ্গটি আসলে মন্ত্রী এ ইঙ্গিত দেন। এদিকে বরখাস্ত হওয়া হারুন অর রশিদকে রংপুর রেঞ্জে সংযুক্ত করার পাশাপাশি এডিসি সানিজদা আফরিন নিপাকেও রংপুর রেঞ্জে সংযুক্ত করার যে খবর ছড়িয়েছে তা গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

গত ৯ সেপ্টেম্বর রাতে শাহবাগ থানায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়রে ৩ নেতাকে ওসির (তদন্ত) রুমে আটকে বেধড়ক মারপিট করে শাহবাগ থানা পুলিশ। ছাত্রলীগ নেতাদের বেধড়ক পেটানোর ঘটনায় নেতৃত্বে ছিলেন রমনা জোনের এডিসি হারুন অর রশিদ। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন নাইমকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাতে ছাত্রলীগ নেতাদের মারপিটে থানা ঘেরাও করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। রাতে বিষয়টি মীমাংসার মাধ্যমে শেষ করতে চাইলে নাঈমের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি ঘুরে যায়। কী কারণে ছাত্রলীগ নেতাদের এভাবে মারপিট তা বেরিয়ে আসতে শুরু করে। এরপর বেরিয়ে আসে রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক মামুনের স্ত্রীর পুলিশের ৩৩ ব্যাচের নারী কর্মকর্তা এডিসি সানজিদা আফরিনকে ঘিরে হারুন ও মামুনের মধ্যে বিরোধ, মারামারির জেরে ছাত্রলীগ নেতাদের মারপিটের কাহিনী। উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতিতে প্রথমে হারুনকে সরিয়ে দেয়া হলেও তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়। কিন্তু রাষ্ট্রপতির এপিএসের নেতৃত্বে আগে হারুনকে মারপিট করা হয়েছে এমন খবরে পরিস্থিতি ভিন্নদিকে যেতে থাকে। এ ঘটনায় ডিএমপি ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। গত বুধবার সেই কমিটির তদন্তের সময়সীমাও বাড়ানো হয়।

ছাত্রলীগ নেতাদের ভাষ্য, শুধু সাময়িক বরখান্তই নয়, হারুনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধে মামলা করে বড় শাস্তি দিতে হবে। হারুনকে চাকরিচ্যুত করারও দাবি উঠে চাত্রলীগের পক্ষ থেকে। হারুন ইস্যুতে বেরিয়ে আসে রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক মামুনের সঙ্গে হারুনের বিরোধ থাকার নেপথ্য কাহিনীও। এমন পরিস্থিতিতে হারুনকে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে রংপুর রেঞ্জে সংযুক্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এ খবরের পর আরেকটি খবর বের হয়, এডিসি হারুনের সঙ্গে আজিজুল হক মামুনের স্ত্রী সানজিদাকেও রংপুর রেঞ্জে বদলি করা হয়েছে। এ নিয়ে রংপুরে বিক্ষোভও করে ছাত্রলীগ।

এডিসি হারুন (সদ্য বরখাস্ত হওয়া) এবং সানজিদাকে রংপুর রেঞ্জে বদলির বিষয়টিকে গুজব দাবি করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, হারুনের বিষয়ে আমাদের তাৎক্ষণিকভাবে যেটা করার, সেটা করেছি। এখন তার বিরুদ্ধে মামলা হবে, তদন্ত হবে। সবগুলোই-তো একটা প্রক্রিয়া। তাৎক্ষণিকভাবে যেটা দরকার ছিল আমরা তাকে সাসপেন্ড করেছি। এখন তদন্ত শুরু হয়ে তার নামে যদি মামলা হয়ে থাকে, সে মামলাগুলোর প্রক্রিয়া শুরু হবে।

সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার জানামতে যিনি ভিকটিম হয়েছেন তিনি এখনো মামলা করেননি। মামলা করলে তদন্ত শুরু হবে। আর যেহেতু ঘটনা একটা ঘটেছে এটার বিভাগীয় মামলা-তো হবেই। সেখানে যা সিদ্ধান্ত হয় সেটা হবে।

সেদিনের ঘটনা নিয়ে, যা বললেন বারডেমের নিরাপত্তা কর্মীরা

এদিকে পুলিশের পক্ষ থেকে যে দাবি উঠেছে যে এডিসি হারুন অর রশিদকে প্রথমে রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক মামুনের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ নেতারা মারপিট করেছে সেই ঘটনা নিয়ে কথা বলেছেন বারডেম হাসপাতালের দুই নিররপত্তা কর্মীরা। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তারা বলেছেন, তাদের সামনেই ঘটনা ঘটেছে। তারা এও বলেছেন, সেদিন হৈচৈ শুনে গিয়ে দেখেন হারুন সাহেব কে মারপিট করা হচ্ছে।

সিকিউরিট গার্ডের সুপার ভাইজার ওয়ারেছ আলী বলেন, ‘যেদিন ঘটনাটি ঘটেছে, সেদিন জড়িত কাউকে তিনি চিনতেন না। পরে টিভি/পত্রিকায় খবর পড়ে তিনি তাদের পরিচয় জানতে পারি। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলে সেদিন আমি রাউন্ড ডিউটিতে ছিলাম আর আমার কিছু সিকিউরিটি কর্মী নিচে ছিল। হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচি, হৈ-হুল্লোর শুনে আমি যখন চতুর্থ তলায় আসি, তখন দেখি, হারুন সাহেব (এডিসি হারুন অর রশীদ) ইটিটি রুমের সামনে, যেখানে রোগী বা রোগীর স্বজনরা ওয়েটিংয়ে থাকে সেখান থেকে লবি হয়ে লিফটের দিকে দৌড় দিচ্ছিলেন। আর তার পেছন পেছন ছুটছিলেন মামুন সাহেব (রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব আজিজুল হক মামুন)। তবে সে সময় লিফট বন্ধ থাকায় এবং নিচ থেকে আরও দুইজন চলে আসায় হারুন সাহেব ফের ইটিটি রুমের দিকে দৌড় দেয়।

এ সময় মামুন সাহেব এবং নতুন আসা বাকি দুইজনও হারুন সাহেবের পিছু নেয়। দুই পক্ষই ইটিটি রুমের সামনে গেলে আশপাশের মানুষও জড়ো হয়ে যায়। আমরা যারা নিরাপত্তাকর্মী আছি, তারাও দৌড়ে যাই। তখন দেখি এই তিনজন হারুন সাহেবকে মারতে চাচ্ছিল। আর উনাকে টেনে নিজেদের দিকে নিয়ে আসতে চাচ্ছিল। আর হারুন সাহেব চাচ্ছিল ইটিটি রুমের ভিতর ঢুকতে। এরপর আমরা মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলি, এখানে কোন গ্যাঞ্জাম হবে না। আপনারা আপনাদের পরিচয় দেন। তখন তিনজনের দলটি আমাদের বলে, ‘তোরা সিকিউরিটি অফিসার। তোদের সঙ্গে কোন কথা নেই। তোরা এখান থেকে সর।’ এর মাঝখানে কেউ একজন হারুন সাহেবের মোবাইল ফোন কেড়ে নিলে আমরা তাদের থেকে মোবাইলটা নিয়ে উনাকে ফেরত দিয়ে দেই।

ওয়ারেছ বলেন, ‘তখনও তারা সেই পুলিশ অফিসারকে মারতে চাচ্ছিল, কিন্তু আমরা মাঝখানে থাকায় সেটি সম্ভব হয়নি, যা লেগেছে সব আমাদের গায়ে লেগেছে, তবে শুনেছি, আমরা আসার আগে মারামারি হয়েছে, কিন্তু সেটা আমরা দেখিনি।’

ওয়ারেছ আলী বলেন, এ সময় (মারামারি) দুই পক্ষের ধাক্কাধাক্কিতে ইটিটি রুমের দরজা খুলে যায়। সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছিল আমাদের হাসপাতালের রোগী সানজিদা ম্যাডাম (ঢাকা মহানগর পুলিশের এডিসি সানজিদা আফরিন)। উনার নামটাও আমরা পরে রিপোর্ট আর টিভিতে দেখে জানতে পেরেছি।

এরপর পুলিশ অফিসার (হারুন অর রশীদ) ইটিটি রুমের ভেতর ঢুকে রুমের এক কোণায় অবস্থান নেয়। তখন উনাকে দেখে মনে হয়েছে উনি খুব আতঙ্কে আছেন। এদিকে হারুন সাহেব ঢুকার পর পর বাকি সবাইও রুমের ভেতর ঢুকে যায়। তখনও আমরা দুই পক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যাই। এরপর মামুন সাহেব তার সঙ্গে থাকা লোকজনকে বলছে, ‘ছবি তোল, ভিডিও কর।’ এ সময় আমাদের যিনি রোগী ছিলেন, তিনি এটার প্রতিবাদ করে তাদেরকে রুম থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। তখন মামুন সাহেবকে তার গায়ে হাত দিতে দেখি।

ওয়ারেছ আলী বলেন, ‘এই যখন অবস্থা, তখন আমি সেখান থেকে বের হয়ে আমাদের প্রশাসনকে জানাই। এরপর আমরা ৯৯৯-এ ফোন দিই। আমি যখন বের হচ্ছি তখন এই তিনজন সেই পুলিশ অফিসারকে ধরতে চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু আমাদের নিরাপত্তাকর্মীরা মাঝখানে দাঁড়ানো থাকায় সেটি করতে পারছিলেন না। এ সময় সেখানে একজন ড্রাইভার ছিল। উনিও নিরাপত্তাকর্মীদের সহযোগিতা করে তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছিল। ‘যেহেতু আমি প্রধান নিরাপত্তাকর্মী, তাই ঘটনার সময় আমার এদিক সেদিক দৌড়ানো লাগছে। তাই সব ঘটনা আমি দেখিনি।’

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রশিদ নামের আরেক নিরাপত্তাকর্মী বলেন, ইটিটি রুমের সামনে হাতাহাতি হয়েছিল, তবে কে কার গায়ে হাত তুলেছে সেটা মনে পড়ছে না। ইটিটি রুম খুলে যাওয়ার পরে সবাই যখন ভেতরে ঢুকে যায় তখন এই তিনজন সেই পুলিশ অফিসারকে (হারুন অর রশিদ) বের হতে বলে।

যেহেতু বের করতে পারলে কিছু হয়ে যেতে পারে, সেজন্য তাদের আমরা বলি, ‘আপনারা আগে বের হন। এরপর আমরা উনাকে বের করছি’, কিন্তু তারা আমাদের কথা না শোনায় আমরা মাঝখানে দাঁড়িয়ে তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করি।

রশিদ বলেন, সবাই যখন ইটিটি রুমের ভেতরে, তখন আমাদের যিনি রোগী ছিলেন, উনাকে মামুন সাহেবের উদ্দেশ করে বলতে শুনি, ‘আপনি এখানে কেন? আর উনাকে কেন মারতে চাচ্ছেন? ডাক্তার দেখাতে আমিই স্যারকে নিয়ে আসছি। আপনি চলে যান।’ এরপর মামুন সাহেব বলেন, ‘তুই আসলি কী জন্য? আর ও কেন আসলো?’ এরপর আমাদের রোগী সানজিদা ম্যাডাম বলেন, ‘আমি অসুস্থ, আপনি তো জানেন। আপনি কেন আনেননি আমাকে? তাই আমি স্যারকে নিয়ে আসছি।’” রশিদ বলেন, ‘এ ছাড়া আরও অনেক কথাবার্তা হচ্ছিল। সব আমাদের ঠিক মনে নেই।’ এই নিরাপত্তাকর্মী বলেন, ‘এর কিছুক্ষণ পর মূলত পুলিশ আসে। হারুন সাহেব যাকে যাকে দেখিয়েছেন, তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, তবে হাসপাতালের ভেতর পুলিশ কাউকে মারধর করেনি।’

ওয়ারেছ আলী বলেন, ‘ঘটনার শেষে রুম পরিষ্কার করতে গিয়ে ইটিটি রুমের ভেতরে একটা ভাঙা চশমা পাওয়া যায়। এরপর সেটা আমরা পুলিশে হস্তান্তর করি। তারা সেটা নিয়ে যায়।’

শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ , ১ আশ্বিন ১৪৩০, ২৯ সফর ১৪৪৫

এডিসি হারুনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হবে

সানজিদাকে রংপুর রেঞ্জে বদলির খবর গুজব : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

থানায় নিয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের মারপিটের ঘটনায় সাময়িক বরখান্ত ডিএমপির রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশিদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার ইঙ্গিত দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। গতকাল সচিবালয়ে হারুনকান্ড প্রসঙ্গটি আসলে মন্ত্রী এ ইঙ্গিত দেন। এদিকে বরখাস্ত হওয়া হারুন অর রশিদকে রংপুর রেঞ্জে সংযুক্ত করার পাশাপাশি এডিসি সানিজদা আফরিন নিপাকেও রংপুর রেঞ্জে সংযুক্ত করার যে খবর ছড়িয়েছে তা গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

গত ৯ সেপ্টেম্বর রাতে শাহবাগ থানায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়রে ৩ নেতাকে ওসির (তদন্ত) রুমে আটকে বেধড়ক মারপিট করে শাহবাগ থানা পুলিশ। ছাত্রলীগ নেতাদের বেধড়ক পেটানোর ঘটনায় নেতৃত্বে ছিলেন রমনা জোনের এডিসি হারুন অর রশিদ। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন নাইমকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাতে ছাত্রলীগ নেতাদের মারপিটে থানা ঘেরাও করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। রাতে বিষয়টি মীমাংসার মাধ্যমে শেষ করতে চাইলে নাঈমের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি ঘুরে যায়। কী কারণে ছাত্রলীগ নেতাদের এভাবে মারপিট তা বেরিয়ে আসতে শুরু করে। এরপর বেরিয়ে আসে রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক মামুনের স্ত্রীর পুলিশের ৩৩ ব্যাচের নারী কর্মকর্তা এডিসি সানজিদা আফরিনকে ঘিরে হারুন ও মামুনের মধ্যে বিরোধ, মারামারির জেরে ছাত্রলীগ নেতাদের মারপিটের কাহিনী। উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতিতে প্রথমে হারুনকে সরিয়ে দেয়া হলেও তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়। কিন্তু রাষ্ট্রপতির এপিএসের নেতৃত্বে আগে হারুনকে মারপিট করা হয়েছে এমন খবরে পরিস্থিতি ভিন্নদিকে যেতে থাকে। এ ঘটনায় ডিএমপি ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। গত বুধবার সেই কমিটির তদন্তের সময়সীমাও বাড়ানো হয়।

ছাত্রলীগ নেতাদের ভাষ্য, শুধু সাময়িক বরখান্তই নয়, হারুনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধে মামলা করে বড় শাস্তি দিতে হবে। হারুনকে চাকরিচ্যুত করারও দাবি উঠে চাত্রলীগের পক্ষ থেকে। হারুন ইস্যুতে বেরিয়ে আসে রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক মামুনের সঙ্গে হারুনের বিরোধ থাকার নেপথ্য কাহিনীও। এমন পরিস্থিতিতে হারুনকে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে রংপুর রেঞ্জে সংযুক্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এ খবরের পর আরেকটি খবর বের হয়, এডিসি হারুনের সঙ্গে আজিজুল হক মামুনের স্ত্রী সানজিদাকেও রংপুর রেঞ্জে বদলি করা হয়েছে। এ নিয়ে রংপুরে বিক্ষোভও করে ছাত্রলীগ।

এডিসি হারুন (সদ্য বরখাস্ত হওয়া) এবং সানজিদাকে রংপুর রেঞ্জে বদলির বিষয়টিকে গুজব দাবি করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, হারুনের বিষয়ে আমাদের তাৎক্ষণিকভাবে যেটা করার, সেটা করেছি। এখন তার বিরুদ্ধে মামলা হবে, তদন্ত হবে। সবগুলোই-তো একটা প্রক্রিয়া। তাৎক্ষণিকভাবে যেটা দরকার ছিল আমরা তাকে সাসপেন্ড করেছি। এখন তদন্ত শুরু হয়ে তার নামে যদি মামলা হয়ে থাকে, সে মামলাগুলোর প্রক্রিয়া শুরু হবে।

সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার জানামতে যিনি ভিকটিম হয়েছেন তিনি এখনো মামলা করেননি। মামলা করলে তদন্ত শুরু হবে। আর যেহেতু ঘটনা একটা ঘটেছে এটার বিভাগীয় মামলা-তো হবেই। সেখানে যা সিদ্ধান্ত হয় সেটা হবে।

সেদিনের ঘটনা নিয়ে, যা বললেন বারডেমের নিরাপত্তা কর্মীরা

এদিকে পুলিশের পক্ষ থেকে যে দাবি উঠেছে যে এডিসি হারুন অর রশিদকে প্রথমে রাষ্ট্রপতির এপিএস আজিজুল হক মামুনের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ নেতারা মারপিট করেছে সেই ঘটনা নিয়ে কথা বলেছেন বারডেম হাসপাতালের দুই নিররপত্তা কর্মীরা। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তারা বলেছেন, তাদের সামনেই ঘটনা ঘটেছে। তারা এও বলেছেন, সেদিন হৈচৈ শুনে গিয়ে দেখেন হারুন সাহেব কে মারপিট করা হচ্ছে।

সিকিউরিট গার্ডের সুপার ভাইজার ওয়ারেছ আলী বলেন, ‘যেদিন ঘটনাটি ঘটেছে, সেদিন জড়িত কাউকে তিনি চিনতেন না। পরে টিভি/পত্রিকায় খবর পড়ে তিনি তাদের পরিচয় জানতে পারি। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলে সেদিন আমি রাউন্ড ডিউটিতে ছিলাম আর আমার কিছু সিকিউরিটি কর্মী নিচে ছিল। হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচি, হৈ-হুল্লোর শুনে আমি যখন চতুর্থ তলায় আসি, তখন দেখি, হারুন সাহেব (এডিসি হারুন অর রশীদ) ইটিটি রুমের সামনে, যেখানে রোগী বা রোগীর স্বজনরা ওয়েটিংয়ে থাকে সেখান থেকে লবি হয়ে লিফটের দিকে দৌড় দিচ্ছিলেন। আর তার পেছন পেছন ছুটছিলেন মামুন সাহেব (রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব আজিজুল হক মামুন)। তবে সে সময় লিফট বন্ধ থাকায় এবং নিচ থেকে আরও দুইজন চলে আসায় হারুন সাহেব ফের ইটিটি রুমের দিকে দৌড় দেয়।

এ সময় মামুন সাহেব এবং নতুন আসা বাকি দুইজনও হারুন সাহেবের পিছু নেয়। দুই পক্ষই ইটিটি রুমের সামনে গেলে আশপাশের মানুষও জড়ো হয়ে যায়। আমরা যারা নিরাপত্তাকর্মী আছি, তারাও দৌড়ে যাই। তখন দেখি এই তিনজন হারুন সাহেবকে মারতে চাচ্ছিল। আর উনাকে টেনে নিজেদের দিকে নিয়ে আসতে চাচ্ছিল। আর হারুন সাহেব চাচ্ছিল ইটিটি রুমের ভিতর ঢুকতে। এরপর আমরা মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলি, এখানে কোন গ্যাঞ্জাম হবে না। আপনারা আপনাদের পরিচয় দেন। তখন তিনজনের দলটি আমাদের বলে, ‘তোরা সিকিউরিটি অফিসার। তোদের সঙ্গে কোন কথা নেই। তোরা এখান থেকে সর।’ এর মাঝখানে কেউ একজন হারুন সাহেবের মোবাইল ফোন কেড়ে নিলে আমরা তাদের থেকে মোবাইলটা নিয়ে উনাকে ফেরত দিয়ে দেই।

ওয়ারেছ বলেন, ‘তখনও তারা সেই পুলিশ অফিসারকে মারতে চাচ্ছিল, কিন্তু আমরা মাঝখানে থাকায় সেটি সম্ভব হয়নি, যা লেগেছে সব আমাদের গায়ে লেগেছে, তবে শুনেছি, আমরা আসার আগে মারামারি হয়েছে, কিন্তু সেটা আমরা দেখিনি।’

ওয়ারেছ আলী বলেন, এ সময় (মারামারি) দুই পক্ষের ধাক্কাধাক্কিতে ইটিটি রুমের দরজা খুলে যায়। সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছিল আমাদের হাসপাতালের রোগী সানজিদা ম্যাডাম (ঢাকা মহানগর পুলিশের এডিসি সানজিদা আফরিন)। উনার নামটাও আমরা পরে রিপোর্ট আর টিভিতে দেখে জানতে পেরেছি।

এরপর পুলিশ অফিসার (হারুন অর রশীদ) ইটিটি রুমের ভেতর ঢুকে রুমের এক কোণায় অবস্থান নেয়। তখন উনাকে দেখে মনে হয়েছে উনি খুব আতঙ্কে আছেন। এদিকে হারুন সাহেব ঢুকার পর পর বাকি সবাইও রুমের ভেতর ঢুকে যায়। তখনও আমরা দুই পক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যাই। এরপর মামুন সাহেব তার সঙ্গে থাকা লোকজনকে বলছে, ‘ছবি তোল, ভিডিও কর।’ এ সময় আমাদের যিনি রোগী ছিলেন, তিনি এটার প্রতিবাদ করে তাদেরকে রুম থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। তখন মামুন সাহেবকে তার গায়ে হাত দিতে দেখি।

ওয়ারেছ আলী বলেন, ‘এই যখন অবস্থা, তখন আমি সেখান থেকে বের হয়ে আমাদের প্রশাসনকে জানাই। এরপর আমরা ৯৯৯-এ ফোন দিই। আমি যখন বের হচ্ছি তখন এই তিনজন সেই পুলিশ অফিসারকে ধরতে চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু আমাদের নিরাপত্তাকর্মীরা মাঝখানে দাঁড়ানো থাকায় সেটি করতে পারছিলেন না। এ সময় সেখানে একজন ড্রাইভার ছিল। উনিও নিরাপত্তাকর্মীদের সহযোগিতা করে তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছিল। ‘যেহেতু আমি প্রধান নিরাপত্তাকর্মী, তাই ঘটনার সময় আমার এদিক সেদিক দৌড়ানো লাগছে। তাই সব ঘটনা আমি দেখিনি।’

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রশিদ নামের আরেক নিরাপত্তাকর্মী বলেন, ইটিটি রুমের সামনে হাতাহাতি হয়েছিল, তবে কে কার গায়ে হাত তুলেছে সেটা মনে পড়ছে না। ইটিটি রুম খুলে যাওয়ার পরে সবাই যখন ভেতরে ঢুকে যায় তখন এই তিনজন সেই পুলিশ অফিসারকে (হারুন অর রশিদ) বের হতে বলে।

যেহেতু বের করতে পারলে কিছু হয়ে যেতে পারে, সেজন্য তাদের আমরা বলি, ‘আপনারা আগে বের হন। এরপর আমরা উনাকে বের করছি’, কিন্তু তারা আমাদের কথা না শোনায় আমরা মাঝখানে দাঁড়িয়ে তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করি।

রশিদ বলেন, সবাই যখন ইটিটি রুমের ভেতরে, তখন আমাদের যিনি রোগী ছিলেন, উনাকে মামুন সাহেবের উদ্দেশ করে বলতে শুনি, ‘আপনি এখানে কেন? আর উনাকে কেন মারতে চাচ্ছেন? ডাক্তার দেখাতে আমিই স্যারকে নিয়ে আসছি। আপনি চলে যান।’ এরপর মামুন সাহেব বলেন, ‘তুই আসলি কী জন্য? আর ও কেন আসলো?’ এরপর আমাদের রোগী সানজিদা ম্যাডাম বলেন, ‘আমি অসুস্থ, আপনি তো জানেন। আপনি কেন আনেননি আমাকে? তাই আমি স্যারকে নিয়ে আসছি।’” রশিদ বলেন, ‘এ ছাড়া আরও অনেক কথাবার্তা হচ্ছিল। সব আমাদের ঠিক মনে নেই।’ এই নিরাপত্তাকর্মী বলেন, ‘এর কিছুক্ষণ পর মূলত পুলিশ আসে। হারুন সাহেব যাকে যাকে দেখিয়েছেন, তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, তবে হাসপাতালের ভেতর পুলিশ কাউকে মারধর করেনি।’

ওয়ারেছ আলী বলেন, ‘ঘটনার শেষে রুম পরিষ্কার করতে গিয়ে ইটিটি রুমের ভেতরে একটা ভাঙা চশমা পাওয়া যায়। এরপর সেটা আমরা পুলিশে হস্তান্তর করি। তারা সেটা নিয়ে যায়।’