লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলের দারনা শহরে ভয়াবহ বন্যায় হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। উপকূলীয় শহর দারনার উপকূলে ভেসে যাওয়া মরদেহ উদ্ধারে এখন চলছে অভিযান। যত সময় যাচ্ছে, মৃতের সংখ্যা ততই বেড়ে চলছে।
লিবিয়ার রেড ক্রিসেন্টের তথ্য অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় ড্যানিয়েল এবং ঝড় পরবর্তী বন্যায় এখন পর্যন্ত ১১ হাজার ৩০০ জনের মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে। দারনা শহরে এত প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে মূলত দু’টি বাঁধ ভেঙে, সেগুলোর পানি নিচে গড়িয়ে শহরে চলে আসায়। বাঁধগুলোর পানি যখন শহরে প্রবেশ করে তখন সেখানে সুনামি সদৃশ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
দারনার মেয়র জানিয়েছেন, মৃতের সংখ্যা ২০ হাজার ছাঁড়িয়ে যেতে পারে। তিনি আরও জানিয়েছেন, বর্ণনাতীত এ বন্যায় শহরটির একটি অংশ পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
আর ভয়াবহ এ বন্যার পর লিবিয়ার কিছু রাজনীতিবিদ প্রশ্ন তুলছেন, এটি কী নিছকই একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নাকি মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ ছিল? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্নীতি, সরকারি অবকাঠামোগুলো ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ না করা এবং কয়েক বছরের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে ঘূর্ণিঝড় ড্যানিয়েলের মতো বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য নিজেদের প্রস্তুতই করতে পারেনি লিবিয়া।
দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে লিবিয়া দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আর এখন দুই ভাগে দু’টি আলাদা সরকারের অধীনে চলছে দেশটি।
আর বিভক্ত হওয়ার কারণে বাঁধের মতো জরুরি অবকাঠামোগুলোতে যে সংস্কার কার্য চালানো হবে, সে ধরনের কোনো বাজেটই পাওয়া যায়নি। আলজাজিরাকে গত মঙ্গলবার দারনার ডেপুটি মেয়র আহমেদ মাদ্রুদ বলেছিলেন, এ দুটি বাঁধ সেই ২০০২ সাল থেকে সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। এর অর্থ সাবেক স্বৈরশাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফি এবং ২০১১ সালে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে আসা সরকার— কেউই দেশের জরুরি অবকাঠামোগুলো সংরক্ষণ করতে পারেনি বা করেনি।
গত বছর ওমর আল-মুখতার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, দারনার বাঁধ দুটি জরুরিভিত্তিতে সংস্কার করতে হবে নয়ত সেখানে বন্যা দেখা দিতে পারে। তাদের এমন হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও বাঁধ দুটি নিয়ে কোনো কাজই করা হয়নি।
লিবিয়ার পূর্ব উপকূলে গত রোববার আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ড্যানিয়েল। ঘূর্ণিঝড়টির আগে সেখানকার স্থানীয় প্রশাসন ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়ে জানায়, শুধুমাত্র উপকূলীয় এলাকায় কারফিউ জারি থাকবে এবং সেখান থেকে সবাইকে সরে যেতে হবে। কিন্তু পরেরদিন কর্তৃপক্ষ জানায়, দারনার অবস্থা ভয়াবহ।
এখানে মূলত স্থানীয় প্রশাসনের দায়িত্বে অবহেলাকে দুষছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, যদি ঠিক মতো দায়িত্ব পালন করা হতো তাহলে এত মানুষের মৃত্যু হতো না। এছাড়া লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে সরকারি অবকাঠামো নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতির কারণেও এমন করুণ পরিণতি বরণ করতে হয়েছে হাজার হাজার মানুষকে।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা বলেছে, অনেক মানুষকে বাঁচানো যেত যদি লিবিয়ার আবহাওয়া দপ্তর কার্যকর থাকত। সংস্থাটির প্রধান পেট্টেরি তালাশে বলছেন, ‘তারা সতর্কতা ইস্যু করতে পারতেন। জরুরি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ লোকজনকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারত। ফলে অনেক প্রাণহানি এড়ানো যেত।’
খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে-এমন সম্ভাবনার প্রকাশ পায় সাধারণত কুকুরের চিৎকার থেকে। আর এটা ছিল রাত প্রায় আড়াইটা এবং বাইরে অন্ধকার। লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় শহর ডেরনার ৩১ বছর বয়সী হিসাবরক্ষক হুসাম আব্দেলগাউই কুকুরের ডাকে জেগে ওঠেন ও ঘুম চোখেই নীচে নেমে দেখেন তার পায়ের নীচে পানি।
একই ঘরের এক অংশে হুসাম এবং অন্য অংশে তার ছোট ভাই ইব্রাহিম থাকেন। তিনি সামনের ঘরের দরজা খোলা মাত্রই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ে বন্যার পানি। দুই ভাই দৌড়ে ঘরের পেছনের দিকে যান। সেখানে গিয়ে তারা অবিশ্বাস্য পরিস্থিতির সম্মুখীন হন, যা তাদের কাছে ছিল ‘মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ’। আল কুব্বাহ শহর থেকে ফোনে এভাবেই পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন তিনি।
“শিশু ও নারীরা আমাদের পাশ দিয়ে ভেসে যাচ্ছিল। গাড়ি এবং পুরো ঘর বিদ্যুতায়িত হয়ে পড়েছিল। কিছু মৃতদেহ পানিতে ভাসতে ভাসতে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ছিল”। হুসাম ও ইব্রাহিমক পানির তোড়ে ভেসে যায়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তারা প্রায় দেড়শ মিটার দূরে চলে যায়।
২৮ বছর বয়সী ইব্রাহিম বিদ্যুতের ভাসমান তার ধরে একটি খাম্বার কাছে দাঁড়াতে সক্ষম হন, যেখানে তার ভাইও আটকা পড়েছিল। ওই তারকে রশির মতো ব্যবহার করে তারা পার্শ্ববর্তী একটি ভবনের দিকে এগুতে থাকেন এবং তৃতীয় তলার জানালা দিয়ে ঢুকে পড়েন। এরপর পাঁচতলার ছাদে গিয়ে আশ্রয় নেন।
“আমরা যেখানে ছিলাম সেটি শহরের অন্য এলাকাগুলোর চেয়ে উঁচু এলাকা,” হুসাম বলছিলেন।
“নীচু এলাকাগুলোতে আমার মনে হয় না ৫/৬ তলা পর্যন্ত কেউ বেঁচে ছিল। মনে হয় সবাই মারা গেছে। আল্লাহ তাদের ক্ষমা করুন।”
ঝড় পরবর্তী বন্যায় এখন পর্যন্ত ১১ হাজার ৩০০ জনের মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে -বিবিসি
আরও খবরশনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ , ২ আশ্বিন ১৪৩০, ৩০ সফর ১৪৪৫
ঝড় পরবর্তী বন্যায় এখন পর্যন্ত ১১ হাজার ৩০০ জনের মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে -বিবিসি
লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলের দারনা শহরে ভয়াবহ বন্যায় হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। উপকূলীয় শহর দারনার উপকূলে ভেসে যাওয়া মরদেহ উদ্ধারে এখন চলছে অভিযান। যত সময় যাচ্ছে, মৃতের সংখ্যা ততই বেড়ে চলছে।
লিবিয়ার রেড ক্রিসেন্টের তথ্য অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় ড্যানিয়েল এবং ঝড় পরবর্তী বন্যায় এখন পর্যন্ত ১১ হাজার ৩০০ জনের মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে। দারনা শহরে এত প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে মূলত দু’টি বাঁধ ভেঙে, সেগুলোর পানি নিচে গড়িয়ে শহরে চলে আসায়। বাঁধগুলোর পানি যখন শহরে প্রবেশ করে তখন সেখানে সুনামি সদৃশ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
দারনার মেয়র জানিয়েছেন, মৃতের সংখ্যা ২০ হাজার ছাঁড়িয়ে যেতে পারে। তিনি আরও জানিয়েছেন, বর্ণনাতীত এ বন্যায় শহরটির একটি অংশ পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
আর ভয়াবহ এ বন্যার পর লিবিয়ার কিছু রাজনীতিবিদ প্রশ্ন তুলছেন, এটি কী নিছকই একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নাকি মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ ছিল? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্নীতি, সরকারি অবকাঠামোগুলো ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ না করা এবং কয়েক বছরের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে ঘূর্ণিঝড় ড্যানিয়েলের মতো বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য নিজেদের প্রস্তুতই করতে পারেনি লিবিয়া।
দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে লিবিয়া দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আর এখন দুই ভাগে দু’টি আলাদা সরকারের অধীনে চলছে দেশটি।
আর বিভক্ত হওয়ার কারণে বাঁধের মতো জরুরি অবকাঠামোগুলোতে যে সংস্কার কার্য চালানো হবে, সে ধরনের কোনো বাজেটই পাওয়া যায়নি। আলজাজিরাকে গত মঙ্গলবার দারনার ডেপুটি মেয়র আহমেদ মাদ্রুদ বলেছিলেন, এ দুটি বাঁধ সেই ২০০২ সাল থেকে সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। এর অর্থ সাবেক স্বৈরশাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফি এবং ২০১১ সালে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে আসা সরকার— কেউই দেশের জরুরি অবকাঠামোগুলো সংরক্ষণ করতে পারেনি বা করেনি।
গত বছর ওমর আল-মুখতার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, দারনার বাঁধ দুটি জরুরিভিত্তিতে সংস্কার করতে হবে নয়ত সেখানে বন্যা দেখা দিতে পারে। তাদের এমন হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও বাঁধ দুটি নিয়ে কোনো কাজই করা হয়নি।
লিবিয়ার পূর্ব উপকূলে গত রোববার আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ড্যানিয়েল। ঘূর্ণিঝড়টির আগে সেখানকার স্থানীয় প্রশাসন ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়ে জানায়, শুধুমাত্র উপকূলীয় এলাকায় কারফিউ জারি থাকবে এবং সেখান থেকে সবাইকে সরে যেতে হবে। কিন্তু পরেরদিন কর্তৃপক্ষ জানায়, দারনার অবস্থা ভয়াবহ।
এখানে মূলত স্থানীয় প্রশাসনের দায়িত্বে অবহেলাকে দুষছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, যদি ঠিক মতো দায়িত্ব পালন করা হতো তাহলে এত মানুষের মৃত্যু হতো না। এছাড়া লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে সরকারি অবকাঠামো নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতির কারণেও এমন করুণ পরিণতি বরণ করতে হয়েছে হাজার হাজার মানুষকে।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা বলেছে, অনেক মানুষকে বাঁচানো যেত যদি লিবিয়ার আবহাওয়া দপ্তর কার্যকর থাকত। সংস্থাটির প্রধান পেট্টেরি তালাশে বলছেন, ‘তারা সতর্কতা ইস্যু করতে পারতেন। জরুরি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ লোকজনকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারত। ফলে অনেক প্রাণহানি এড়ানো যেত।’
খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে-এমন সম্ভাবনার প্রকাশ পায় সাধারণত কুকুরের চিৎকার থেকে। আর এটা ছিল রাত প্রায় আড়াইটা এবং বাইরে অন্ধকার। লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় শহর ডেরনার ৩১ বছর বয়সী হিসাবরক্ষক হুসাম আব্দেলগাউই কুকুরের ডাকে জেগে ওঠেন ও ঘুম চোখেই নীচে নেমে দেখেন তার পায়ের নীচে পানি।
একই ঘরের এক অংশে হুসাম এবং অন্য অংশে তার ছোট ভাই ইব্রাহিম থাকেন। তিনি সামনের ঘরের দরজা খোলা মাত্রই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ে বন্যার পানি। দুই ভাই দৌড়ে ঘরের পেছনের দিকে যান। সেখানে গিয়ে তারা অবিশ্বাস্য পরিস্থিতির সম্মুখীন হন, যা তাদের কাছে ছিল ‘মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ’। আল কুব্বাহ শহর থেকে ফোনে এভাবেই পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন তিনি।
“শিশু ও নারীরা আমাদের পাশ দিয়ে ভেসে যাচ্ছিল। গাড়ি এবং পুরো ঘর বিদ্যুতায়িত হয়ে পড়েছিল। কিছু মৃতদেহ পানিতে ভাসতে ভাসতে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ছিল”। হুসাম ও ইব্রাহিমক পানির তোড়ে ভেসে যায়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তারা প্রায় দেড়শ মিটার দূরে চলে যায়।
২৮ বছর বয়সী ইব্রাহিম বিদ্যুতের ভাসমান তার ধরে একটি খাম্বার কাছে দাঁড়াতে সক্ষম হন, যেখানে তার ভাইও আটকা পড়েছিল। ওই তারকে রশির মতো ব্যবহার করে তারা পার্শ্ববর্তী একটি ভবনের দিকে এগুতে থাকেন এবং তৃতীয় তলার জানালা দিয়ে ঢুকে পড়েন। এরপর পাঁচতলার ছাদে গিয়ে আশ্রয় নেন।
“আমরা যেখানে ছিলাম সেটি শহরের অন্য এলাকাগুলোর চেয়ে উঁচু এলাকা,” হুসাম বলছিলেন।
“নীচু এলাকাগুলোতে আমার মনে হয় না ৫/৬ তলা পর্যন্ত কেউ বেঁচে ছিল। মনে হয় সবাই মারা গেছে। আল্লাহ তাদের ক্ষমা করুন।”