হেফাজত ‘বিভ্রান্তিতে’ ‘অধিকারের’ শাস্তি নিয়ে ইইউর প্রস্তাবে উদ্বিগ্ন রপ্তানিকারকরা

‘মানবাধিকার সংগঠন’ ‘অধিকার’-এর নেতা আদিলুর রহমান ও এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানের শাস্তি বাতিলের দাবি জানিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্টে যে প্রস্তাব উঠেছে তা নিয়ে ক্ষুব্ধ বাংলাদেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্টের এমন তৎপরতার পর ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক সংকটে পড়তে পারে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী, রপ্তানিকারকরা।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের একটি বড় বাজার। তৈরি পোশাক ছাড়াও এই বাজারে হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, জুতা, বাইসাইকেল ইত্যাদি জিএসপির আওতায় শুল্কমুক্ত সুবিধায় রপ্তানি হয়।

ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের সরিয়ে দেয়ার অভিযানে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগে করা মামলায় গত বৃহস্পতিবার ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানের দুই বছরের সশ্রম কারাদ- দিয়েছে।

আদিলুর ও নাসির উদ্দিনকে শাস্তি দেয়ার পর প্রথমে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং পরে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশ উদ্বেগ প্রকাশ এবং তাদের মুক্তি দাবি করে প্রস্তাব গ্রহণ ও বিবৃতি দিয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে কণ্ঠভোটে গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয়, ‘প্রায় এক যুগ ধরে অধিকারের প্রতিনিধিদের হয়রানি করা হচ্ছে।’ একই সঙ্গে ইইউ পার্লামেন্ট অধিকারের ঘটনা মানবাধিকার পরিস্থিতির ‘অবনতি’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। সেই সঙ্গে তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা অব্যাহত থাকবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

ইইউর প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জন্য ইইউর অবাধ বাজারসুবিধা ‘এভরিথিং বাট আর্মসের’ (ইবিএ) পরিসর আরও বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলমান। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সনদ ‘লঙ্ঘনের’ মাধ্যমে ‘মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের’ মামলাটি একটি ‘পশ্চাদ্গামী’ পদক্ষেপ, যা উদ্বেগের। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ইবিএ সুবিধা অব্যাহত রাখা উচিত কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা।

ইইউ পার্লামেন্টের এই প্রস্তাবে উদ্বিগ্ন দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান সংবাদকে বলেন, ‘আমরা চাই, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে বিবৃতি দিয়েছে সে বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট কাজ করুক। আমরা ব্যবসায়ীরাও দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কাজ করছি। এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পরও যেন জিএসপি সুবিধা অব্যাহত থাকে সে জন্য আমরা প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখছি। আমরা আশা করি, রাজনীতির সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যকে একসঙ্গে জড়াবে না ইউরোপীয় ইউনিয়ন।’

নিট পোশাকশিল্প রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সংবাদকে বলেন, ‘আমরা যদি অতীত ইতিহাস দেখি তাহলে দেখতে পাবো, ইইউ কখনোই ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে রাজনৈতিক ইস্যুকে জড়ায়নি। তবে এবারের বিষয়টি কোন দিকে যাচ্ছে, তা আমরা এখনো বুঝতে পারছি না। আমাদের প্রত্যাশা, তারা (ইইউ) রাজনীতির সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য জড়াবে না।’

ইইউ পার্লামেন্টের প্রস্তাবে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার চর্চার বিষয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুসরণের আহ্বান জানানো হয়। নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলো যেন অনুমোদিত বিদেশি অনুদান কাজে লাগাতে পারে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতেও সরকারকে অনুরোধ করেছে ইইউ পার্লামেন্ট। প্রস্তাবে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে তুলে ধরতে ইউরোপীয় এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিস, ইইউ প্রতিনিধি ও বাংলাদেশে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর দূতাবাসকে অনুরোধ জানিয়েছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা।

ইইউ পার্লামেন্টে এমন প্রস্তাব গৃহীত হওয়ায় বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং ‘মানবাধিকার সংস্থা অধিকার’ নিয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রস্তাবকে ‘পক্ষপাতমূলক’ এবং ‘একটি সার্বভৌম দেশের স্বাধীন বিচার ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ’ বলে উল্লেখ করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে এ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলা হয়, ‘যে সময়ে এবং যে ভাষায় যৌথ প্রস্তাবটি ইউরোপীয় পার্লামেন্টে উত্থাপন করা হয়েছে, তা আসলে একটি বিচারাধীন বিষয় নিয়ে মন্তব্য করা এবং একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের বিচারব্যবস্থায় হস্তক্ষেপের শামিল।’ বিশেষ করে ‘মানবাধিকার’ সংস্থা ‘অধিকারের’ প্রতি ইউরোপীয় পার্লামেন্টের পক্ষপাতিত্বে বাংলাদেশ হতবাক। কারণ মন্ত্রণালয় বলছে ‘সংস্থাটি একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের অন্ধ সমর্থক এবং এর বিরুদ্ধে অতীতে ভুল তথ্য ছড়ানোর মাধ্যমে দেশজুড়ে সন্ত্রাসবাদ ও ভয়াবহ উগ্রপন্থা ছড়ানোর প্রমাণ রয়েছে।’

ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশে জার্মান দূতাবাসের ডেপুটি হেড অব মিশন জা জানোভস্কি সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্ম ‘এক্স’ এ দুই দেশের বিবৃতিটি পোস্ট করেছেন। বিবৃতিতে বলা হয়, ফ্রান্স ও জার্মানি ‘আইনের শাসনের পাশাপাশি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল’ এবং তারা ‘সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও মানবাধিকার রক্ষাকারীদের সমর্থন’ অব্যাহত রাখবে। বিবৃতিতে আদিলুর রহমান খান ও এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানের বিষয়ে বাংলাদেশের আদালতের রায়ে দুঃখ প্রকাশ করা হয়। আদিলুর এবং নাসির উদ্দিনের বিরুদ্ধে কারাদ-ের রায়ের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইইউতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৫২৩ কোটি ডলার। ছয় বছর আগে অর্থাৎ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই বাজারে রপ্তানি ছিল ২ হাজার ১৩৩ কোটি ডলার। পরের বছর রপ্তানি ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। গত অর্থবছরে এই বাজারে রপ্তানি আরো বেড়েছে। গত অর্থবছর মোট রপ্তানি ১৩ শতাংশ বা ৭০৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয় জার্মানিতে। তারপর স্পেনে ৩৬৮, ফ্রান্সে ৩২৯, পোল্যান্ডে ১৮৫, নেদারল্যান্ডসে ২০৯, ইতালিতে ২৩৯, ডেনমার্কে ১৩১ ও বেলজিয়ামে ৯৪ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়।

ইইউতে বাংলাদেশি পণ্যের মোট রপ্তানির মধ্যে ৯৩ শতাংশই হচ্ছে তৈরি পোশাক। গত অর্থবছর দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে ২ হাজার ৩৫৩ কোটি ডলারের পোশাক, যা মোট পোশাক রপ্তানির ৫০ শতাংশের বেশি।

বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেতারা যে ভাবে চায় তা যদি আমরা করতে না পারি তবে তার একটি নেতিবাচক প্রভাব ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব বিষয়েই পড়বে।’

‘আমরা চাই, সরকার যেন বিষয়টা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে।’

বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘ইউরোপীয় পার্লামেন্টে গৃহীত প্রস্তাবের কারণে জিএসপি প্লাসের আলোচনায় বাংলাদেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়তে পারে। কারণ এই প্রস্তাবের কারণে বাংলাদেশের সুনাম কিছুটা হলেও নষ্ট হলো। যখন একটা দেশের বিরুদ্ধে নেতিবাচক কথা উঠে তখন সেটার একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।’

ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তৈরি পোশাকশিল্পের মাধ্যমে প্রত্যন্ত এলাকার নারীদের পাশাপাশি বিশাল জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করেছি। এছাড়া তাদের অনেক প্রকল্প বাংলাদেশে হয়েছে যেগুলোতে তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হয়। সেহেতু আমরা বলতে পারি, ইইউর নেতৃত্ব চাইবে না এই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হোক।’

রবিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ , ৩ আশ্বিন ১৪৩০, ০১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫

হেফাজত ‘বিভ্রান্তিতে’ ‘অধিকারের’ শাস্তি নিয়ে ইইউর প্রস্তাবে উদ্বিগ্ন রপ্তানিকারকরা

কূটনৈতিক বার্তা পরিবেশক

‘মানবাধিকার সংগঠন’ ‘অধিকার’-এর নেতা আদিলুর রহমান ও এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানের শাস্তি বাতিলের দাবি জানিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্টে যে প্রস্তাব উঠেছে তা নিয়ে ক্ষুব্ধ বাংলাদেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্টের এমন তৎপরতার পর ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক সংকটে পড়তে পারে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী, রপ্তানিকারকরা।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের একটি বড় বাজার। তৈরি পোশাক ছাড়াও এই বাজারে হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, জুতা, বাইসাইকেল ইত্যাদি জিএসপির আওতায় শুল্কমুক্ত সুবিধায় রপ্তানি হয়।

ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বর থেকে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের সরিয়ে দেয়ার অভিযানে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগে করা মামলায় গত বৃহস্পতিবার ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানের দুই বছরের সশ্রম কারাদ- দিয়েছে।

আদিলুর ও নাসির উদ্দিনকে শাস্তি দেয়ার পর প্রথমে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং পরে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশ উদ্বেগ প্রকাশ এবং তাদের মুক্তি দাবি করে প্রস্তাব গ্রহণ ও বিবৃতি দিয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে কণ্ঠভোটে গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয়, ‘প্রায় এক যুগ ধরে অধিকারের প্রতিনিধিদের হয়রানি করা হচ্ছে।’ একই সঙ্গে ইইউ পার্লামেন্ট অধিকারের ঘটনা মানবাধিকার পরিস্থিতির ‘অবনতি’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। সেই সঙ্গে তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা অব্যাহত থাকবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

ইইউর প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জন্য ইইউর অবাধ বাজারসুবিধা ‘এভরিথিং বাট আর্মসের’ (ইবিএ) পরিসর আরও বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলমান। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সনদ ‘লঙ্ঘনের’ মাধ্যমে ‘মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের’ মামলাটি একটি ‘পশ্চাদ্গামী’ পদক্ষেপ, যা উদ্বেগের। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ইবিএ সুবিধা অব্যাহত রাখা উচিত কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা।

ইইউ পার্লামেন্টের এই প্রস্তাবে উদ্বিগ্ন দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান সংবাদকে বলেন, ‘আমরা চাই, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে বিবৃতি দিয়েছে সে বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট কাজ করুক। আমরা ব্যবসায়ীরাও দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কাজ করছি। এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পরও যেন জিএসপি সুবিধা অব্যাহত থাকে সে জন্য আমরা প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখছি। আমরা আশা করি, রাজনীতির সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যকে একসঙ্গে জড়াবে না ইউরোপীয় ইউনিয়ন।’

নিট পোশাকশিল্প রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সংবাদকে বলেন, ‘আমরা যদি অতীত ইতিহাস দেখি তাহলে দেখতে পাবো, ইইউ কখনোই ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে রাজনৈতিক ইস্যুকে জড়ায়নি। তবে এবারের বিষয়টি কোন দিকে যাচ্ছে, তা আমরা এখনো বুঝতে পারছি না। আমাদের প্রত্যাশা, তারা (ইইউ) রাজনীতির সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য জড়াবে না।’

ইইউ পার্লামেন্টের প্রস্তাবে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার চর্চার বিষয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুসরণের আহ্বান জানানো হয়। নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলো যেন অনুমোদিত বিদেশি অনুদান কাজে লাগাতে পারে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতেও সরকারকে অনুরোধ করেছে ইইউ পার্লামেন্ট। প্রস্তাবে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে তুলে ধরতে ইউরোপীয় এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিস, ইইউ প্রতিনিধি ও বাংলাদেশে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর দূতাবাসকে অনুরোধ জানিয়েছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা।

ইইউ পার্লামেন্টে এমন প্রস্তাব গৃহীত হওয়ায় বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং ‘মানবাধিকার সংস্থা অধিকার’ নিয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রস্তাবকে ‘পক্ষপাতমূলক’ এবং ‘একটি সার্বভৌম দেশের স্বাধীন বিচার ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ’ বলে উল্লেখ করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে এ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলা হয়, ‘যে সময়ে এবং যে ভাষায় যৌথ প্রস্তাবটি ইউরোপীয় পার্লামেন্টে উত্থাপন করা হয়েছে, তা আসলে একটি বিচারাধীন বিষয় নিয়ে মন্তব্য করা এবং একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের বিচারব্যবস্থায় হস্তক্ষেপের শামিল।’ বিশেষ করে ‘মানবাধিকার’ সংস্থা ‘অধিকারের’ প্রতি ইউরোপীয় পার্লামেন্টের পক্ষপাতিত্বে বাংলাদেশ হতবাক। কারণ মন্ত্রণালয় বলছে ‘সংস্থাটি একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের অন্ধ সমর্থক এবং এর বিরুদ্ধে অতীতে ভুল তথ্য ছড়ানোর মাধ্যমে দেশজুড়ে সন্ত্রাসবাদ ও ভয়াবহ উগ্রপন্থা ছড়ানোর প্রমাণ রয়েছে।’

ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশে জার্মান দূতাবাসের ডেপুটি হেড অব মিশন জা জানোভস্কি সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্ম ‘এক্স’ এ দুই দেশের বিবৃতিটি পোস্ট করেছেন। বিবৃতিতে বলা হয়, ফ্রান্স ও জার্মানি ‘আইনের শাসনের পাশাপাশি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল’ এবং তারা ‘সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও মানবাধিকার রক্ষাকারীদের সমর্থন’ অব্যাহত রাখবে। বিবৃতিতে আদিলুর রহমান খান ও এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানের বিষয়ে বাংলাদেশের আদালতের রায়ে দুঃখ প্রকাশ করা হয়। আদিলুর এবং নাসির উদ্দিনের বিরুদ্ধে কারাদ-ের রায়ের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইইউতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৫২৩ কোটি ডলার। ছয় বছর আগে অর্থাৎ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই বাজারে রপ্তানি ছিল ২ হাজার ১৩৩ কোটি ডলার। পরের বছর রপ্তানি ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। গত অর্থবছরে এই বাজারে রপ্তানি আরো বেড়েছে। গত অর্থবছর মোট রপ্তানি ১৩ শতাংশ বা ৭০৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয় জার্মানিতে। তারপর স্পেনে ৩৬৮, ফ্রান্সে ৩২৯, পোল্যান্ডে ১৮৫, নেদারল্যান্ডসে ২০৯, ইতালিতে ২৩৯, ডেনমার্কে ১৩১ ও বেলজিয়ামে ৯৪ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়।

ইইউতে বাংলাদেশি পণ্যের মোট রপ্তানির মধ্যে ৯৩ শতাংশই হচ্ছে তৈরি পোশাক। গত অর্থবছর দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে ২ হাজার ৩৫৩ কোটি ডলারের পোশাক, যা মোট পোশাক রপ্তানির ৫০ শতাংশের বেশি।

বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেতারা যে ভাবে চায় তা যদি আমরা করতে না পারি তবে তার একটি নেতিবাচক প্রভাব ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব বিষয়েই পড়বে।’

‘আমরা চাই, সরকার যেন বিষয়টা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে।’

বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘ইউরোপীয় পার্লামেন্টে গৃহীত প্রস্তাবের কারণে জিএসপি প্লাসের আলোচনায় বাংলাদেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়তে পারে। কারণ এই প্রস্তাবের কারণে বাংলাদেশের সুনাম কিছুটা হলেও নষ্ট হলো। যখন একটা দেশের বিরুদ্ধে নেতিবাচক কথা উঠে তখন সেটার একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।’

ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তৈরি পোশাকশিল্পের মাধ্যমে প্রত্যন্ত এলাকার নারীদের পাশাপাশি বিশাল জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করেছি। এছাড়া তাদের অনেক প্রকল্প বাংলাদেশে হয়েছে যেগুলোতে তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হয়। সেহেতু আমরা বলতে পারি, ইইউর নেতৃত্ব চাইবে না এই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হোক।’