ড. ইউনূসকে নিয়ে এত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কেন

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা স্থগিত করার অনুরোধ জানিয়ে সম্প্রতি বিশ্বের ৮ জন উদ্বিগ্ন নাগরিক ও শতাধিক নোবেল বিজয়ীসহ ১৮৩ ব্যক্তি ড. ইউনূসের পক্ষে যে বিবৃতি দিয়েছেন তা নিয়ে লিখতে বাংলাদেশ ব্যাংকে আমার সাবেক সহকর্মী বীর মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক এবং বন্ধু সরোয়ারসহ অনেকে বারবার অনুরোধ করেছেন। বিবৃতিদাতাদের মধ্যে রয়েছেন আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।

ওবামা আবার আলাদাভাবে পত্র দিয়ে ড. ইউনূসকে তার কাজের প্রশংসাও করেছেন। পরে আবার তিনিসহ আরো শতাধিক নোবেল বিজয়ী আইনি হয়রানির বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। অথচ এই বারাক ওবামাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়ার কারণে নোবেল পুরস্কার বিতর্কিত হয়ে পড়েছিল। কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার এক বছরের মধ্যে তাকে ‘শান্তিতে’ নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়, তখনো তিনি প্রেসিডেন্টের কাজ পুরোদমে শুরুই করেননি। তাই প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার কাজের গুরুত্ব বিচারের সুযোগও ছিল না।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি দুই টার্ম ক্ষমতায় ছিলেন, লম্বা সময়, আট বছর। কিন্তু এই আট বছরে বিশ্বে শান্তি রক্ষায় তিনি সামান্যতম অবদানও রাখেননি, বরং যুদ্ধের সম্প্রসারণ ঘটিয়েছিলেন। এমনকি ক্ষমতায় আসার আগেও বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তার কোন ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি।

সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেদ নোবেল ডিনেমাইট আবিষ্কার করে বিপুল অর্থ আয় করেন, আর সেই আয়ের অর্থ দিয়েই তিনি পুরস্কার প্রদানের কথা বলে যান। ধ্বংসাত্মক ডিনামাইটের আয় দিয়ে শান্তির নোবেল পুরস্কার দেয়া হলেও এই পুরস্কার বিশ্বে শান্তি স্থাপনে কিছুটা হলেও অবদান রাখছে। কিন্তু এই পুরস্কারকে ঘিরে অনেক বিতর্ক। কারণ সাহিত্য, রসায়ন, পদার্থ, চিকিৎসা, অর্থনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে কারো অবদান নির্ণয়ের মাপকাঠি বা আধার থাকে। কিন্তু শান্তিতে অবদান পরিমাপের কোন মাপকাঠি নেই। মাপকাঠি না থাকায় এই পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে নোবেল কমিটির বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে বারবার।

শুধু তাই নয়, নোবেল শান্তি পুরস্কার রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ কোন কোন ক্ষেত্রে সত্য বলে প্রতিপন্নও হয়েছে। যুদ্ধবাজ হেনরি কিসিঞ্জারকে ১৯৭৩ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া হলে বিতর্কের ঝড় ওঠে। ফিলিস্তিনিদের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে সমঝোতা করার জন্য মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ও ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট মেনাশিম বেগিনকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। চীনের বিরুদ্ধে তিব্বতের আন্দোলন ও আন্দোলনের আধ্যাত্মিক নেতা দালাইলামাকে বিশ্বে পরিচিত করে তোলার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ১৯৮৯ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে।

যে শান্তি পুরস্কারে মায়ানমারের অং সান সূচিকে ভূষিত করা হয় সেই সূচি রোহিঙ্গাদের ওপর মায়ানমার সরকারের অত্যাচার নির্যাতনের পক্ষে অবস্থান নেন। ড. ইউনূস ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কারণে তিনি সারা বিশ্বেই সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। শত শত লোক নোবেল পুরস্কার পেলেও ড. ইউনূসসহ মাত্র সাতজন নোবেল পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম এবং কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল পেয়েছেন। এছাড়া তিনি ‘সামাজিক ব্যবসা’র ধারণার প্রবর্তক।

আমাদের দেশে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে নিয়েও সমালোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে। সমালোচনায় বলা হচ্ছে- ড. ইউনুসের সঙ্গে নরওয়ের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ফোনের অংশীদারত্বমূলক সম্পর্ক থাকায় পুরস্কার পাওয়া সহজ হয়েছে। তার বিরুদ্ধে সমালোচনার আরেকটি মুখ্য কারণ হচ্ছে, জাতীয় জীবনের দুর্যোগ বা চরম সংকটকালে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কোনো রকম ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় না। তিনি শহীদ দিবস, বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস, বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবসে কখনো শহীদ মিনার, রায়ের বাজার বধ্যভূমি বা স্মৃতিসৌধে গিয়েছেন বলে শোনা যায় না। পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলে তাকে কেউ দেখেননি। তিনি প্রাকৃতিক দুর্যোগে কখনো গরিবদের পাশে দাঁড়াননি। তিনি দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতেও কোন ভূমিকা পালন করেননি। তাহলে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।

শুধু গ্রামীণ ব্যাংকের ভূমিকার জন্য তিনি বিশ্বখ্যাত। তার ২০ শতাংশ সুদ হারে গরিবদের কাছে অর্থ লগ্নিকে যত কঠোর শব্দে সমালোচনা করা হোক না কেন, তিনি ক্ষুদ্র ঋণের সফল বাস্তবায়ক হিসেবে সারা বিশ্বে সুপরিচিত। কিন্তু আওয়ামী লীগ বিরোধী এবং আওয়ামী লীগের সমর্থকরা দোষ-গুণ বিচার নির্বিশেষে ড. ইউনূসের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আমাদের দেশে রাজনীতি এত হিংসাত্মক হয়ে ওঠেছে যে, সব ইস্যুতেই দেশের জনতা দুইভাগে বিভক্ত।

শুধু নোবেল বিজয়ীদের তরফ থেকে নয়, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার ভলকার তুর্ক আশঙ্কা প্রকাশ করে উল্লেখ করেছেন যে, অধ্যাপক ড. ইউনূস শ্রম আইন লঙ্ঘন এবং দুর্নীতির অভিযোগে দণ্ডিত হতে পারেন। এসব বিবৃতির মাধ্যমে ড. ইউনূস তার বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন। ১৮৩ জনের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ড. ইউনূস ধারাবাহিক বিচারিক হয়রানির শিকার হচ্ছেন বিধায় তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা স্থগিত রেখে আন্তর্জাতিকভাবে আইনবিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃত একটি নিরপেক্ষ বিচারক প্যানেলের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের পর্যালোচনা করা হোক।এই ক্ষেত্রে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠাতায় ভূমিকা রাখতে প্রধানমন্ত্রীকেও অনুরোধ করা হয়েছে। এই বিবৃতি যিনি বা যারা মুসাবিধা করেছেন তিনি বা তারা বিবৃতিতে রাজনীতিকেও টেনে এনেছেন। বিবৃতিতে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার অনুরোধ ছাড়াও বিগত দুটি নির্বাচন যে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি তার উল্লেখও রয়েছে। নির্বাচনকালীন প্রশাসন দেশের প্রথম সারির দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়াটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে তারা বিবৃতিতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

সুষ্ঠু নির্বাচনের সঙ্গে ড. ইউনূসের কী সম্পর্ক বোঝা গেল না। রাজনীতি হয়েছে খোলা চিঠিতে। প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করার উদ্দেশ্য হলে তাকে সরাসরি চিঠি লেখার কথা; কিন্তু তারা সেই চিঠি পত্রিকায় দিয়েছেন। অর্থাৎ ড. ইউনূসের সমস্যার সমাধান তাদের কাছে মুখ্য নয়, মুখ্য হচ্ছে রাজনীতি করা। এছাড়াও চিঠির ভাষায় নমনীয়তা নেই, প্রধানমন্ত্রীকে সম্বোধন করা চিঠির ভাষা কর্তৃত্বমূলক হওয়ার কথা নয়। রাজনৈতিক শিষ্টাচার পরিপন্থি এই ভাষা অনুরোধ নয়, চাপ সৃষ্টি করার ভাষা। তারা একটা হুঁশিয়ারিও দিয়েছে- তারা তাদের উল্লেখিত সমস্যাগুলোর সমাধান প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করবেন। প্রকৃতপক্ষে তারা চাপ সৃষ্টি করে প্রধানমন্ত্রীকে আরও বেশি ক্ষুব্ধ করে তুলেছেন। চিঠিতে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি না থাকলে ড. ইউনূসের বিষয়টি অধিক গুরুত্ব পেত।

রাজনৈতিক নেতাদের মতো বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থাকে অবিশ্বাস করার কূটনীতি বিশ্বনেতাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে হয় না। বিচারব্যবস্থাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করা হলে প্রদত্ত রায়ের সংশ্লিষ্ট শাস্তিও প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে যায়, ন্যায়সঙ্গত শাস্তিও তখন আর ন্যায্যতা পায় না। তাই সুনির্দিষ্ট রায়ের সমালোচনা করা গেলেও বিচারব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলা বিচারিক ব্যবস্থাকে সামগ্রিকভাবে বাধাগ্রস্ত করার সামিল। সারা পৃথিবীতে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি উচ্চ আদালতে যেতে পারেন, আপিল করতে পারেন, অর্থাৎ বিচারিক রায়ের পরিবর্তন শুধু বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সম্ভব।

বিভিন্ন দেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে হাজার রকমের প্রশ্ন রয়েছে, তারপরও বিচারব্যবস্থাকে মেনে নিতে হবে। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা রয়েছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধেও একের পর এক মামলা দায়ের হচ্ছে। নোবেল বিজয়ী অং সান সুচিকে মামলার পর মামলা দিয়ে হেনস্তা করা হচ্ছে; কই, এসব ক্ষেত্রে তো এই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সোচ্চার হতে দেখা যায়নি। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মাধ্যমে কারো অধিকার ক্ষুণœ হলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির আইনের আশ্রয় নেয়ার সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। অন্যদিকে ড. ইউনূসেরও আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার রয়েছে। মামলা শুধু সরকার করছে না। গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হলে ড. ইউনূসও সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। সেই মামলায় ড. ইউনূসের পক্ষে লড়েছিলেন ড. কামাল হোসেন। আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি সম্পন্ন আইনজ্ঞ। দুর্ভাগ্য ড. ইউনূসের পক্ষে তিনি হেরে যান।

কারণ বিদ্যমান আইনানুযায়ী তার পক্ষে ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত চাকরি করার সুযোগ ছিল। এই মামলায় অন্যায়ভাবে ড. ইউনূসকে হারিয়ে দেয়া হয়েছে মর্মে ড. কামাল হোসেন কোন মন্তব্য করেছেন বলে শোনা যায়নি। ট্যাক্সের মামলাও ড. ইউনূস করেছেন, পরে ট্যাক্সের সেই টাকা পরিশোধে সম্মত হয়েছেন তিনি।

ড. ইউনূস অনেক সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, তার প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মচারীদের স্বার্থ রক্ষার পথ রুদ্ধ করার দাবি উত্থাপন করা অন্যায় ও অসঙ্গত। এক্ষেত্রে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে করা মামলার বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করা এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আইন বিশেষজ্ঞ বিচারক প্যানেল দ্বারা তার মামলাগুলো রিভিউ করার যে দাবি ১৮৩ জন ব্যক্তি উত্থাপন করেছেন সেই দাবি আইনসম্মত কিনা তা প্রথম রিভিউ করা দরকার। কারণ আইনগত বিষয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই। প্রস্তাব মোতাবেক রিভিউ করা হলে শ্রমিকদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হবে কিনা তা-ও পর্যবেক্ষণ করা দরকার। এমন রিভিউ কি শুধু ড. ইউনূসের মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, না সবাই মামলার ক্ষেত্রে?

আইন ও বিচারের দৃষ্টিতে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আলাদাভাবে দেখার কোন রীতি পৃথিবীর কোথাও অনুসৃত হয় বলে মনে হয় না। রাজা-রানী বা রাষ্ট্রপতিরা আইনের যে সুবিধা পান তা দেশের সব বিশিষ্ট ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করা হলে আইনের অসম প্রয়োগে অরাজকতার সৃষ্টি হবে। উল্লেখিত ১৮৩ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির মতো জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসি থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য শত শত ব্যক্তি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হককে অনুরোধ করেছিলেন; তাদের মধ্যে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার, সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি লিউনিদ ব্রেজনেভ, পোপ দ্বিতীয় জন পলও ছিলেন। জিয়াউল হক শোনেননি। বিচারও নিরপেক্ষ ছিল না। কারণ ক্ষমতা দখল করেই জিয়াউল হক ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, ‘এই বেজন্মাকে আমি ফাঁসিতে লটকাব’।

কারো কারো অভিমত হচ্ছে, জেলখানায় অত্যাচার করে ভুট্টোকে ফাঁসি দেয়ার আগেই মেরে ফেলা হয়েছিল। ফাঁসিতে ঝোলানোর ব্যাপারটা ছিল নাটক। বেনজির ভুট্টো তার আত্মজীবনীমূলক ‘ডটার অব দ্য ইস্ট’ বইটিতেও একই কথা বলেছেন। বারাক ওবামার ডেমোক্র্যাট দলের সরকারও শত শত মামলা দিয়ে বিরোধী দলের ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হয়রানি করছে, ট্রাম্প প্রতিদিন তা মিডিয়াকে বলে যাচ্ছেন। বারাক ওবামা ও হিলারি ক্লিনটনের ডেমোক্র্যাট দলের বিপক্ষে ট্রাম্প আগামী নির্বাচনে লড়াই করার ঘোষণা দিয়েছেন, তাই নির্বাচন পর্যন্ত তাকে হয়রানি না করে তার মামলাগুলো স্থগিত করে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিচারক প্যানেল দ্বারা রিভিউ করার দাবি পূর্বোক্ত ১৮৩ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি কেন করছেন না? রিভিউ করার ব্যবস্থা থাকলে পানামার শাসক নরিয়েগাকে কি তার দেশ থেকে ধরে নিয়ে আমেরিকা ও ফান্সে শাস্তি দেয়া সম্ভব হতো? ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসির রজ্জুতে ঝোলানোর বিচার কি সঠিক ছিল? অপরাধ নিরূপণ করার আগেই কি ওসামা বিন লাদেন এবং আয়মান আল-জাওয়াহিরিকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়নি? গুয়ানতানামোতে বন্দীদের ওপর আমেরিকার অমানুষিক নির্যাতনের সময় এই নোবেল বিজয়ীরা চুপ ছিলেন কেন?

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড পরিদর্শন ও তদন্ত হওয়া জরুরি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান ড. ইউনূস সরাসরি নিয়ম ভাঙার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না থাকলেও যে কোন অনিয়মের জন্য সাধারণত প্রতিষ্ঠানের প্রধানকেই জবাবদিহি করতে হয়। ড. ইউনূস গরিবদের বন্ধু হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন; তাই শ্রমিকদের মামলা করার আগেই তাদের পাওনা দিয়ে দিলে এভাবে বিচারালয়ে তাকে শ্রম আইন লঙ্ঘনের দায়ে আসামি হতে হতো না। তার আমলে গ্রামীণ ব্যাংক ঋণ আদায়ে কি সার্টিফিকেট মামলা করেনি, ওই সবাই মামলায় কি গরিব-নিঃস্ব ঋণ গ্রহীতার কোমরে পুলিশ দড়ি বাঁধেনি?

ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন গ্রামীণ ব্যাংক থেকে তখন যা বলেছিল তা হচ্ছে, ‘আইন সবার জন্য সমান; কোনো বিশেষ ব্যক্তির জন্য আইনের ব্যত্যয় ঘটানোর সুযোগ নেই।’ তাহলে ড. ইউনূসের জন্য আইনের ব্যত্যয় ঘটানোর সুপারিশ কেন? প্রকৃতপক্ষে তার সুখ্যাতিকে বারবার কাজে লাগাচ্ছেন ড. ইউনূস। কিন্তু শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলাটি ফয়সালার লক্ষ্যে বিপক্ষের আইনজীবীকে ১৬ কোটি টাকা ঘুষ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে, তার বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে, দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, তার পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ উঠেছে। যত অভিযোগই উঠুক না কেন, ১৮৩ জন ব্যক্তি এবং আওয়ালী লীগবিরোধীদের মধ্যে কেউ তা বিশ্বাস করেন না।

সরকার ও আওয়ামী লীগবিরোধী জনতার একাংশ মনে করে, দেশের অপরাপর প্রতিষ্ঠানগুলো একই ধরনের অপরাধ করা সত্ত্বেও শুধু ড. ইউনূসের সঙ্গে বর্তমান সরকারের ‘সখ্য’ না থাকায় বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাকে হয়রানি করা হচ্ছে। সরকারবিরোধী জনগণের এমন প্রতীতির অবসানও জরুরি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য ইতোমধ্যে বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা পর্যবেক্ষণের জন্য প্রতিনিধি পাঠাতে নোবেলজয়ী বিবৃতিদাতাদের আহ্বান জানিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন এবং বিশিষ্টজনেরা চাচ্ছেন ড. ইউনূসকে আইন করে সব অনিয়ম ও দুর্নীতি থেকে দায়মুক্তি দেয়া হোক। বিবৃতিদাতা ১৮৩ জনের ফেস ভ্যালু অনেক, তাই খোলা বিবৃতির মাধ্যমে তাদের দাবি সরাসরি নাকচ না করে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে তাদের প্রস্তাবের আইনগত ন্যায্যতার একটি গ্রহণযোগ্য ও আইন সম্মত উত্তর দেয়া শ্রেয় হবে।

[লেখক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও টাকশালের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

রবিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ , ৩ আশ্বিন ১৪৩০, ০১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫

ড. ইউনূসকে নিয়ে এত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কেন

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা স্থগিত করার অনুরোধ জানিয়ে সম্প্রতি বিশ্বের ৮ জন উদ্বিগ্ন নাগরিক ও শতাধিক নোবেল বিজয়ীসহ ১৮৩ ব্যক্তি ড. ইউনূসের পক্ষে যে বিবৃতি দিয়েছেন তা নিয়ে লিখতে বাংলাদেশ ব্যাংকে আমার সাবেক সহকর্মী বীর মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক এবং বন্ধু সরোয়ারসহ অনেকে বারবার অনুরোধ করেছেন। বিবৃতিদাতাদের মধ্যে রয়েছেন আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।

ওবামা আবার আলাদাভাবে পত্র দিয়ে ড. ইউনূসকে তার কাজের প্রশংসাও করেছেন। পরে আবার তিনিসহ আরো শতাধিক নোবেল বিজয়ী আইনি হয়রানির বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। অথচ এই বারাক ওবামাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়ার কারণে নোবেল পুরস্কার বিতর্কিত হয়ে পড়েছিল। কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার এক বছরের মধ্যে তাকে ‘শান্তিতে’ নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়, তখনো তিনি প্রেসিডেন্টের কাজ পুরোদমে শুরুই করেননি। তাই প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার কাজের গুরুত্ব বিচারের সুযোগও ছিল না।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি দুই টার্ম ক্ষমতায় ছিলেন, লম্বা সময়, আট বছর। কিন্তু এই আট বছরে বিশ্বে শান্তি রক্ষায় তিনি সামান্যতম অবদানও রাখেননি, বরং যুদ্ধের সম্প্রসারণ ঘটিয়েছিলেন। এমনকি ক্ষমতায় আসার আগেও বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তার কোন ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি।

সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেদ নোবেল ডিনেমাইট আবিষ্কার করে বিপুল অর্থ আয় করেন, আর সেই আয়ের অর্থ দিয়েই তিনি পুরস্কার প্রদানের কথা বলে যান। ধ্বংসাত্মক ডিনামাইটের আয় দিয়ে শান্তির নোবেল পুরস্কার দেয়া হলেও এই পুরস্কার বিশ্বে শান্তি স্থাপনে কিছুটা হলেও অবদান রাখছে। কিন্তু এই পুরস্কারকে ঘিরে অনেক বিতর্ক। কারণ সাহিত্য, রসায়ন, পদার্থ, চিকিৎসা, অর্থনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে কারো অবদান নির্ণয়ের মাপকাঠি বা আধার থাকে। কিন্তু শান্তিতে অবদান পরিমাপের কোন মাপকাঠি নেই। মাপকাঠি না থাকায় এই পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে নোবেল কমিটির বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে বারবার।

শুধু তাই নয়, নোবেল শান্তি পুরস্কার রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ কোন কোন ক্ষেত্রে সত্য বলে প্রতিপন্নও হয়েছে। যুদ্ধবাজ হেনরি কিসিঞ্জারকে ১৯৭৩ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া হলে বিতর্কের ঝড় ওঠে। ফিলিস্তিনিদের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে সমঝোতা করার জন্য মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ও ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট মেনাশিম বেগিনকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। চীনের বিরুদ্ধে তিব্বতের আন্দোলন ও আন্দোলনের আধ্যাত্মিক নেতা দালাইলামাকে বিশ্বে পরিচিত করে তোলার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ১৯৮৯ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে।

যে শান্তি পুরস্কারে মায়ানমারের অং সান সূচিকে ভূষিত করা হয় সেই সূচি রোহিঙ্গাদের ওপর মায়ানমার সরকারের অত্যাচার নির্যাতনের পক্ষে অবস্থান নেন। ড. ইউনূস ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কারণে তিনি সারা বিশ্বেই সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। শত শত লোক নোবেল পুরস্কার পেলেও ড. ইউনূসসহ মাত্র সাতজন নোবেল পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম এবং কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল পেয়েছেন। এছাড়া তিনি ‘সামাজিক ব্যবসা’র ধারণার প্রবর্তক।

আমাদের দেশে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে নিয়েও সমালোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে। সমালোচনায় বলা হচ্ছে- ড. ইউনুসের সঙ্গে নরওয়ের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ফোনের অংশীদারত্বমূলক সম্পর্ক থাকায় পুরস্কার পাওয়া সহজ হয়েছে। তার বিরুদ্ধে সমালোচনার আরেকটি মুখ্য কারণ হচ্ছে, জাতীয় জীবনের দুর্যোগ বা চরম সংকটকালে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কোনো রকম ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় না। তিনি শহীদ দিবস, বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস, বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবসে কখনো শহীদ মিনার, রায়ের বাজার বধ্যভূমি বা স্মৃতিসৌধে গিয়েছেন বলে শোনা যায় না। পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলে তাকে কেউ দেখেননি। তিনি প্রাকৃতিক দুর্যোগে কখনো গরিবদের পাশে দাঁড়াননি। তিনি দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতেও কোন ভূমিকা পালন করেননি। তাহলে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।

শুধু গ্রামীণ ব্যাংকের ভূমিকার জন্য তিনি বিশ্বখ্যাত। তার ২০ শতাংশ সুদ হারে গরিবদের কাছে অর্থ লগ্নিকে যত কঠোর শব্দে সমালোচনা করা হোক না কেন, তিনি ক্ষুদ্র ঋণের সফল বাস্তবায়ক হিসেবে সারা বিশ্বে সুপরিচিত। কিন্তু আওয়ামী লীগ বিরোধী এবং আওয়ামী লীগের সমর্থকরা দোষ-গুণ বিচার নির্বিশেষে ড. ইউনূসের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আমাদের দেশে রাজনীতি এত হিংসাত্মক হয়ে ওঠেছে যে, সব ইস্যুতেই দেশের জনতা দুইভাগে বিভক্ত।

শুধু নোবেল বিজয়ীদের তরফ থেকে নয়, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার ভলকার তুর্ক আশঙ্কা প্রকাশ করে উল্লেখ করেছেন যে, অধ্যাপক ড. ইউনূস শ্রম আইন লঙ্ঘন এবং দুর্নীতির অভিযোগে দণ্ডিত হতে পারেন। এসব বিবৃতির মাধ্যমে ড. ইউনূস তার বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন। ১৮৩ জনের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ড. ইউনূস ধারাবাহিক বিচারিক হয়রানির শিকার হচ্ছেন বিধায় তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা স্থগিত রেখে আন্তর্জাতিকভাবে আইনবিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃত একটি নিরপেক্ষ বিচারক প্যানেলের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের পর্যালোচনা করা হোক।এই ক্ষেত্রে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠাতায় ভূমিকা রাখতে প্রধানমন্ত্রীকেও অনুরোধ করা হয়েছে। এই বিবৃতি যিনি বা যারা মুসাবিধা করেছেন তিনি বা তারা বিবৃতিতে রাজনীতিকেও টেনে এনেছেন। বিবৃতিতে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার অনুরোধ ছাড়াও বিগত দুটি নির্বাচন যে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি তার উল্লেখও রয়েছে। নির্বাচনকালীন প্রশাসন দেশের প্রথম সারির দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়াটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে তারা বিবৃতিতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

সুষ্ঠু নির্বাচনের সঙ্গে ড. ইউনূসের কী সম্পর্ক বোঝা গেল না। রাজনীতি হয়েছে খোলা চিঠিতে। প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করার উদ্দেশ্য হলে তাকে সরাসরি চিঠি লেখার কথা; কিন্তু তারা সেই চিঠি পত্রিকায় দিয়েছেন। অর্থাৎ ড. ইউনূসের সমস্যার সমাধান তাদের কাছে মুখ্য নয়, মুখ্য হচ্ছে রাজনীতি করা। এছাড়াও চিঠির ভাষায় নমনীয়তা নেই, প্রধানমন্ত্রীকে সম্বোধন করা চিঠির ভাষা কর্তৃত্বমূলক হওয়ার কথা নয়। রাজনৈতিক শিষ্টাচার পরিপন্থি এই ভাষা অনুরোধ নয়, চাপ সৃষ্টি করার ভাষা। তারা একটা হুঁশিয়ারিও দিয়েছে- তারা তাদের উল্লেখিত সমস্যাগুলোর সমাধান প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করবেন। প্রকৃতপক্ষে তারা চাপ সৃষ্টি করে প্রধানমন্ত্রীকে আরও বেশি ক্ষুব্ধ করে তুলেছেন। চিঠিতে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি না থাকলে ড. ইউনূসের বিষয়টি অধিক গুরুত্ব পেত।

রাজনৈতিক নেতাদের মতো বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থাকে অবিশ্বাস করার কূটনীতি বিশ্বনেতাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে হয় না। বিচারব্যবস্থাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করা হলে প্রদত্ত রায়ের সংশ্লিষ্ট শাস্তিও প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে যায়, ন্যায়সঙ্গত শাস্তিও তখন আর ন্যায্যতা পায় না। তাই সুনির্দিষ্ট রায়ের সমালোচনা করা গেলেও বিচারব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলা বিচারিক ব্যবস্থাকে সামগ্রিকভাবে বাধাগ্রস্ত করার সামিল। সারা পৃথিবীতে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি উচ্চ আদালতে যেতে পারেন, আপিল করতে পারেন, অর্থাৎ বিচারিক রায়ের পরিবর্তন শুধু বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সম্ভব।

বিভিন্ন দেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে হাজার রকমের প্রশ্ন রয়েছে, তারপরও বিচারব্যবস্থাকে মেনে নিতে হবে। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা রয়েছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধেও একের পর এক মামলা দায়ের হচ্ছে। নোবেল বিজয়ী অং সান সুচিকে মামলার পর মামলা দিয়ে হেনস্তা করা হচ্ছে; কই, এসব ক্ষেত্রে তো এই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সোচ্চার হতে দেখা যায়নি। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মাধ্যমে কারো অধিকার ক্ষুণœ হলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির আইনের আশ্রয় নেয়ার সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। অন্যদিকে ড. ইউনূসেরও আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার রয়েছে। মামলা শুধু সরকার করছে না। গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হলে ড. ইউনূসও সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। সেই মামলায় ড. ইউনূসের পক্ষে লড়েছিলেন ড. কামাল হোসেন। আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি সম্পন্ন আইনজ্ঞ। দুর্ভাগ্য ড. ইউনূসের পক্ষে তিনি হেরে যান।

কারণ বিদ্যমান আইনানুযায়ী তার পক্ষে ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত চাকরি করার সুযোগ ছিল। এই মামলায় অন্যায়ভাবে ড. ইউনূসকে হারিয়ে দেয়া হয়েছে মর্মে ড. কামাল হোসেন কোন মন্তব্য করেছেন বলে শোনা যায়নি। ট্যাক্সের মামলাও ড. ইউনূস করেছেন, পরে ট্যাক্সের সেই টাকা পরিশোধে সম্মত হয়েছেন তিনি।

ড. ইউনূস অনেক সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার, তার প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মচারীদের স্বার্থ রক্ষার পথ রুদ্ধ করার দাবি উত্থাপন করা অন্যায় ও অসঙ্গত। এক্ষেত্রে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে করা মামলার বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করা এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আইন বিশেষজ্ঞ বিচারক প্যানেল দ্বারা তার মামলাগুলো রিভিউ করার যে দাবি ১৮৩ জন ব্যক্তি উত্থাপন করেছেন সেই দাবি আইনসম্মত কিনা তা প্রথম রিভিউ করা দরকার। কারণ আইনগত বিষয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই। প্রস্তাব মোতাবেক রিভিউ করা হলে শ্রমিকদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হবে কিনা তা-ও পর্যবেক্ষণ করা দরকার। এমন রিভিউ কি শুধু ড. ইউনূসের মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, না সবাই মামলার ক্ষেত্রে?

আইন ও বিচারের দৃষ্টিতে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আলাদাভাবে দেখার কোন রীতি পৃথিবীর কোথাও অনুসৃত হয় বলে মনে হয় না। রাজা-রানী বা রাষ্ট্রপতিরা আইনের যে সুবিধা পান তা দেশের সব বিশিষ্ট ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করা হলে আইনের অসম প্রয়োগে অরাজকতার সৃষ্টি হবে। উল্লেখিত ১৮৩ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির মতো জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসি থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য শত শত ব্যক্তি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হককে অনুরোধ করেছিলেন; তাদের মধ্যে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার, সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি লিউনিদ ব্রেজনেভ, পোপ দ্বিতীয় জন পলও ছিলেন। জিয়াউল হক শোনেননি। বিচারও নিরপেক্ষ ছিল না। কারণ ক্ষমতা দখল করেই জিয়াউল হক ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, ‘এই বেজন্মাকে আমি ফাঁসিতে লটকাব’।

কারো কারো অভিমত হচ্ছে, জেলখানায় অত্যাচার করে ভুট্টোকে ফাঁসি দেয়ার আগেই মেরে ফেলা হয়েছিল। ফাঁসিতে ঝোলানোর ব্যাপারটা ছিল নাটক। বেনজির ভুট্টো তার আত্মজীবনীমূলক ‘ডটার অব দ্য ইস্ট’ বইটিতেও একই কথা বলেছেন। বারাক ওবামার ডেমোক্র্যাট দলের সরকারও শত শত মামলা দিয়ে বিরোধী দলের ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হয়রানি করছে, ট্রাম্প প্রতিদিন তা মিডিয়াকে বলে যাচ্ছেন। বারাক ওবামা ও হিলারি ক্লিনটনের ডেমোক্র্যাট দলের বিপক্ষে ট্রাম্প আগামী নির্বাচনে লড়াই করার ঘোষণা দিয়েছেন, তাই নির্বাচন পর্যন্ত তাকে হয়রানি না করে তার মামলাগুলো স্থগিত করে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিচারক প্যানেল দ্বারা রিভিউ করার দাবি পূর্বোক্ত ১৮৩ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি কেন করছেন না? রিভিউ করার ব্যবস্থা থাকলে পানামার শাসক নরিয়েগাকে কি তার দেশ থেকে ধরে নিয়ে আমেরিকা ও ফান্সে শাস্তি দেয়া সম্ভব হতো? ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসির রজ্জুতে ঝোলানোর বিচার কি সঠিক ছিল? অপরাধ নিরূপণ করার আগেই কি ওসামা বিন লাদেন এবং আয়মান আল-জাওয়াহিরিকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়নি? গুয়ানতানামোতে বন্দীদের ওপর আমেরিকার অমানুষিক নির্যাতনের সময় এই নোবেল বিজয়ীরা চুপ ছিলেন কেন?

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড পরিদর্শন ও তদন্ত হওয়া জরুরি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান ড. ইউনূস সরাসরি নিয়ম ভাঙার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না থাকলেও যে কোন অনিয়মের জন্য সাধারণত প্রতিষ্ঠানের প্রধানকেই জবাবদিহি করতে হয়। ড. ইউনূস গরিবদের বন্ধু হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন; তাই শ্রমিকদের মামলা করার আগেই তাদের পাওনা দিয়ে দিলে এভাবে বিচারালয়ে তাকে শ্রম আইন লঙ্ঘনের দায়ে আসামি হতে হতো না। তার আমলে গ্রামীণ ব্যাংক ঋণ আদায়ে কি সার্টিফিকেট মামলা করেনি, ওই সবাই মামলায় কি গরিব-নিঃস্ব ঋণ গ্রহীতার কোমরে পুলিশ দড়ি বাঁধেনি?

ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন গ্রামীণ ব্যাংক থেকে তখন যা বলেছিল তা হচ্ছে, ‘আইন সবার জন্য সমান; কোনো বিশেষ ব্যক্তির জন্য আইনের ব্যত্যয় ঘটানোর সুযোগ নেই।’ তাহলে ড. ইউনূসের জন্য আইনের ব্যত্যয় ঘটানোর সুপারিশ কেন? প্রকৃতপক্ষে তার সুখ্যাতিকে বারবার কাজে লাগাচ্ছেন ড. ইউনূস। কিন্তু শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলাটি ফয়সালার লক্ষ্যে বিপক্ষের আইনজীবীকে ১৬ কোটি টাকা ঘুষ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে, তার বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে, দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, তার পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ উঠেছে। যত অভিযোগই উঠুক না কেন, ১৮৩ জন ব্যক্তি এবং আওয়ালী লীগবিরোধীদের মধ্যে কেউ তা বিশ্বাস করেন না।

সরকার ও আওয়ামী লীগবিরোধী জনতার একাংশ মনে করে, দেশের অপরাপর প্রতিষ্ঠানগুলো একই ধরনের অপরাধ করা সত্ত্বেও শুধু ড. ইউনূসের সঙ্গে বর্তমান সরকারের ‘সখ্য’ না থাকায় বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাকে হয়রানি করা হচ্ছে। সরকারবিরোধী জনগণের এমন প্রতীতির অবসানও জরুরি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য ইতোমধ্যে বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা পর্যবেক্ষণের জন্য প্রতিনিধি পাঠাতে নোবেলজয়ী বিবৃতিদাতাদের আহ্বান জানিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন এবং বিশিষ্টজনেরা চাচ্ছেন ড. ইউনূসকে আইন করে সব অনিয়ম ও দুর্নীতি থেকে দায়মুক্তি দেয়া হোক। বিবৃতিদাতা ১৮৩ জনের ফেস ভ্যালু অনেক, তাই খোলা বিবৃতির মাধ্যমে তাদের দাবি সরাসরি নাকচ না করে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে তাদের প্রস্তাবের আইনগত ন্যায্যতার একটি গ্রহণযোগ্য ও আইন সম্মত উত্তর দেয়া শ্রেয় হবে।

[লেখক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও টাকশালের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]