সৌন্দর্য হারাচ্ছে বরিশালের বিনোদন কেন্দ্র বঙ্গবন্ধু উদ্যান

বরিশাল নগরীর বঙ্গবন্ধু উদ্যানটির সার্বিক পরিবেশ এবং রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন নিয়ে নগরবাসীর মনে এখন নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। প্রাতঃকালীন ও বৈকালিক ভ্রমণকারীসহ নগরবাসী একটু শ্রান্তি খুঁজতে ঐতিহ্যবাহী এই উদ্যানে গিয়ে এখন নিয়মিত অস্বস্তির শিকার হচ্ছেন। বিকেল ও সন্ধ্যায় নারীরা সন্তানসহ এখানে ঘুরতে আসেন। অসংখ্য পথ খাবারের দোকানের সঙ্গে কিশোর গ্যাং ও কতিপয় মানুষের নানান অনৈতিক কর্মকাণ্ডে সুস্থ সামাজিক পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে মাঠের অভ্যন্তর ভাগও বিভিন্ন ধরনের অস্থায়ী দোকানপাট দখল নিতে শুরু করেছে। এসব দোকানের বর্জ্য মাঠের অভ্যন্তরসহ পাশের লেকে ফেলায় লেকটির পানি দুষিত হয়ে দুর্গন্ধ ছড়ায়। এমনকি সম্প্রতি মাঠের উত্তর প্রান্তে শতাধিক বছরের প্রাচীন বিশাল একটি রেইন-ট্রি গাছ মরে গেছে। যেকোন সময়ে এই গাছটি দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে। এছাড়া কিছু সংখ্যক যুবকের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে নারীদের নিরাপত্তাও বিঘিœত হচ্ছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পুরো উদ্যানের নানা অবকাঠামো বিনষ্ট হচ্ছে। বিপুল অর্থ ব্যয়ে পুরো মাঠ আলোকিত করা হলেও এখন সেখানে সন্ধ্যার পরে বেশিরভাগ বাতিই নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আলো দেয় না। এ উদ্যানটির দেখভালের কেউ আছে বলেও দৃশ্যমান নয়।

বৃটিশ যুগে তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার জেলা প্রশাসক মি. বেল প্রায় পৌনে ৯ একর সরকারি খাস জমির ওপর এ উদ্যানটি গড়ে তুলে ছিলেন। তখন তার নাম অনুসারেই উদ্যানটির নামকরণ করা হয় ‘বেলস্ পার্ক’। গণপূর্ত বিভাগ এ পার্কটির মালিকানাসহ তার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব লাভ করে। যদিও বছর কয়েক আগে উদ্যানটির দুই দিকে জেলা প্রশাসন থেকে নকশা খচিত বিশাল প্রস্তর খণ্ডে ভূমির মালিক ‘বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে জেলা প্রশাসক’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

১৯৭৩ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম বরিশাল সফরকালে একটি সুন্দর নান্দনিক উদ্যান গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রশাসনের অনুরোধে বঙ্গবন্ধু উদ্যানের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। এই ময়দানটিই আবার এক সময়ে ফুটবল খেলার মাঠ, প্রদর্শনীর (এক্সিবিশন) স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হত। বরিশালের প্রথম প্রদর্শনী এই মাঠেই হয়েছিল। তখন মাঠের নিকটেই ছিল নদী। রাতের বেলা প্রদর্শনীর জন্য নদীতে স্টিমার নোঙর করে তার সার্চ লাইট দিয়ে মাঠটি আলোকিত করা হয়েছিল। পাকিস্তান আমলেই এখানে একটি হেলিপ্যাড নির্মান করা হয়। সেটি এখনও একই কাজে ব্যবহৃত হত। বিশাল এই ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও জিয়াউর রহমান, শেখ হাসিনা, বেগম খালেদা জিয়া, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানী, ড. কামাল হোসেন, এইচএম এরশাদ ছাড়াও বিভিন্ন জাতীয় নেতারা বক্তব্য রেখেছেন।

২০০৪ সালে তৎকালীন সিটি মেয়র মজিবুর রহমান সারোয়ারের উদ্যোগে সরকারি প্রায় ৩ কোটি টাকা সংগ্রহ করে গণপূর্ত অধিদপ্তরের মাধ্যমে উদ্যানটির চারিধারে ওয়াকওয়ে, বসার জন্য বেঞ্চি, ছাতাসহ শৌচাগার ও বিশ্রামাগার নির্মাণ ছাড়াও পুরো উদ্যানটিজুড়ে দৃষ্টি নন্দন আলোর ব্যবস্থা করা হয়। পাশাপাশি শোভা বর্ধনের জন্য পুরো মাঠের চার ধারে গাছও লাগান হয়েছিল। সে থেকে উদ্যানটির পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে সিটি করপোরেশন। প্রতিদিনই এ উদ্যানে সকাল-বিকেল প্রচুর লোক হাঁটতে ও শ্রান্তি বিনোদনে আসেন।

২০১১ সালে তৎকালীন সিটি মেয়র শওকত হোসেন হিরন গনপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে তহবিল সংগ্রহ করে উদ্যানটিতে দ্বিতীয় ওয়াকওয়ে এবং পূর্ব পাশের্^ বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল স্থাপন করেন। পাশাপাশি উদ্যানটির পূর্বপাশের নালাটি সংস্কার করে সেখানে শাপলার আবাদ করা ছাড়াও সংলগ্ন বাঁধ রোডে পাকা ফুটপাথ নির্মানসহ সোনালু গাছ লাগান হয়। যা এখনও নগরবাসীর চোখ জুড়ায়। পরবর্তীতে বিএনপি নেতা আহসান হাবিব কামাল মেয়র থাকাবস্থায় উদ্যানটির পশ্চিম-উত্তর কোনায় একটি শিশু পার্ক স্থাপন করা হয়। এখন সেটির সব রাইডস নষ্ট হয়ে যাওয়ায় গেটে তালা মারা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু উদ্যানের মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গত কয়েক বছর ধরে গণপূর্ত বিভাগ ও নগর ভবনের নূন্যতম কোন উদ্যোগ নেই। বছর চারেক আগে উদ্যানটির পূর্ব পাশের দেয়ালের ওপর থেকে একটি বিশাল এসএস পাইপ ভেঙে একাংশ মাটিতে পড়ে গেলে তার কোন সংস্কার বা অপসারণ করা হয়নি। দক্ষিণ ও পশ্চিম পাড়ের গ্রিলের বেশিরভাগই দেয়াল থেকে খসে পড়ে আছে। সম্প্রতি পশ্চিম পাশের দেয়ালের ওপর গ্রিলগুলোও খুলে পড়ে গেছে। গত কয়েক বছর ধরে উদ্যানটির উত্তর প্রান্তে বৃক্ষমেলা আয়োজন করতে গিয়ে অপরিকল্পিতভাবে বালু ফেলায় মাঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই ওয়াকওয়ে ডুবে যাচ্ছে। কিন্তু এসব বিষয় দেখার কেউ নেই। ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ উদ্যানের স্থায়ী মঞ্চে বসে জনসভায় বক্তৃতা করেন। তারপরে আর উদ্যানটির কোন স্থাপনার মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার হয়নি। শুধুমাত্র সিটি করপোরেশনের কয়েকজন শ্রমিক ওয়াকওয়ে ঝাড়– দেয়া ছাড়া আর কাউকে এখানে দেখা যায় না।

সোমবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ , ৪ আশ্বিন ১৪৩০, ০২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫

সৌন্দর্য হারাচ্ছে বরিশালের বিনোদন কেন্দ্র বঙ্গবন্ধু উদ্যান

মানবেন্দ্র বটব্যাল, বরিশাল

image

বরিশাল নগরীর বঙ্গবন্ধু উদ্যানটির সার্বিক পরিবেশ এবং রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন নিয়ে নগরবাসীর মনে এখন নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। প্রাতঃকালীন ও বৈকালিক ভ্রমণকারীসহ নগরবাসী একটু শ্রান্তি খুঁজতে ঐতিহ্যবাহী এই উদ্যানে গিয়ে এখন নিয়মিত অস্বস্তির শিকার হচ্ছেন। বিকেল ও সন্ধ্যায় নারীরা সন্তানসহ এখানে ঘুরতে আসেন। অসংখ্য পথ খাবারের দোকানের সঙ্গে কিশোর গ্যাং ও কতিপয় মানুষের নানান অনৈতিক কর্মকাণ্ডে সুস্থ সামাজিক পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে মাঠের অভ্যন্তর ভাগও বিভিন্ন ধরনের অস্থায়ী দোকানপাট দখল নিতে শুরু করেছে। এসব দোকানের বর্জ্য মাঠের অভ্যন্তরসহ পাশের লেকে ফেলায় লেকটির পানি দুষিত হয়ে দুর্গন্ধ ছড়ায়। এমনকি সম্প্রতি মাঠের উত্তর প্রান্তে শতাধিক বছরের প্রাচীন বিশাল একটি রেইন-ট্রি গাছ মরে গেছে। যেকোন সময়ে এই গাছটি দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে। এছাড়া কিছু সংখ্যক যুবকের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে নারীদের নিরাপত্তাও বিঘিœত হচ্ছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পুরো উদ্যানের নানা অবকাঠামো বিনষ্ট হচ্ছে। বিপুল অর্থ ব্যয়ে পুরো মাঠ আলোকিত করা হলেও এখন সেখানে সন্ধ্যার পরে বেশিরভাগ বাতিই নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আলো দেয় না। এ উদ্যানটির দেখভালের কেউ আছে বলেও দৃশ্যমান নয়।

বৃটিশ যুগে তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার জেলা প্রশাসক মি. বেল প্রায় পৌনে ৯ একর সরকারি খাস জমির ওপর এ উদ্যানটি গড়ে তুলে ছিলেন। তখন তার নাম অনুসারেই উদ্যানটির নামকরণ করা হয় ‘বেলস্ পার্ক’। গণপূর্ত বিভাগ এ পার্কটির মালিকানাসহ তার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব লাভ করে। যদিও বছর কয়েক আগে উদ্যানটির দুই দিকে জেলা প্রশাসন থেকে নকশা খচিত বিশাল প্রস্তর খণ্ডে ভূমির মালিক ‘বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে জেলা প্রশাসক’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

১৯৭৩ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম বরিশাল সফরকালে একটি সুন্দর নান্দনিক উদ্যান গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রশাসনের অনুরোধে বঙ্গবন্ধু উদ্যানের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। এই ময়দানটিই আবার এক সময়ে ফুটবল খেলার মাঠ, প্রদর্শনীর (এক্সিবিশন) স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হত। বরিশালের প্রথম প্রদর্শনী এই মাঠেই হয়েছিল। তখন মাঠের নিকটেই ছিল নদী। রাতের বেলা প্রদর্শনীর জন্য নদীতে স্টিমার নোঙর করে তার সার্চ লাইট দিয়ে মাঠটি আলোকিত করা হয়েছিল। পাকিস্তান আমলেই এখানে একটি হেলিপ্যাড নির্মান করা হয়। সেটি এখনও একই কাজে ব্যবহৃত হত। বিশাল এই ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও জিয়াউর রহমান, শেখ হাসিনা, বেগম খালেদা জিয়া, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানী, ড. কামাল হোসেন, এইচএম এরশাদ ছাড়াও বিভিন্ন জাতীয় নেতারা বক্তব্য রেখেছেন।

২০০৪ সালে তৎকালীন সিটি মেয়র মজিবুর রহমান সারোয়ারের উদ্যোগে সরকারি প্রায় ৩ কোটি টাকা সংগ্রহ করে গণপূর্ত অধিদপ্তরের মাধ্যমে উদ্যানটির চারিধারে ওয়াকওয়ে, বসার জন্য বেঞ্চি, ছাতাসহ শৌচাগার ও বিশ্রামাগার নির্মাণ ছাড়াও পুরো উদ্যানটিজুড়ে দৃষ্টি নন্দন আলোর ব্যবস্থা করা হয়। পাশাপাশি শোভা বর্ধনের জন্য পুরো মাঠের চার ধারে গাছও লাগান হয়েছিল। সে থেকে উদ্যানটির পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে সিটি করপোরেশন। প্রতিদিনই এ উদ্যানে সকাল-বিকেল প্রচুর লোক হাঁটতে ও শ্রান্তি বিনোদনে আসেন।

২০১১ সালে তৎকালীন সিটি মেয়র শওকত হোসেন হিরন গনপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে তহবিল সংগ্রহ করে উদ্যানটিতে দ্বিতীয় ওয়াকওয়ে এবং পূর্ব পাশের্^ বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল স্থাপন করেন। পাশাপাশি উদ্যানটির পূর্বপাশের নালাটি সংস্কার করে সেখানে শাপলার আবাদ করা ছাড়াও সংলগ্ন বাঁধ রোডে পাকা ফুটপাথ নির্মানসহ সোনালু গাছ লাগান হয়। যা এখনও নগরবাসীর চোখ জুড়ায়। পরবর্তীতে বিএনপি নেতা আহসান হাবিব কামাল মেয়র থাকাবস্থায় উদ্যানটির পশ্চিম-উত্তর কোনায় একটি শিশু পার্ক স্থাপন করা হয়। এখন সেটির সব রাইডস নষ্ট হয়ে যাওয়ায় গেটে তালা মারা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু উদ্যানের মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গত কয়েক বছর ধরে গণপূর্ত বিভাগ ও নগর ভবনের নূন্যতম কোন উদ্যোগ নেই। বছর চারেক আগে উদ্যানটির পূর্ব পাশের দেয়ালের ওপর থেকে একটি বিশাল এসএস পাইপ ভেঙে একাংশ মাটিতে পড়ে গেলে তার কোন সংস্কার বা অপসারণ করা হয়নি। দক্ষিণ ও পশ্চিম পাড়ের গ্রিলের বেশিরভাগই দেয়াল থেকে খসে পড়ে আছে। সম্প্রতি পশ্চিম পাশের দেয়ালের ওপর গ্রিলগুলোও খুলে পড়ে গেছে। গত কয়েক বছর ধরে উদ্যানটির উত্তর প্রান্তে বৃক্ষমেলা আয়োজন করতে গিয়ে অপরিকল্পিতভাবে বালু ফেলায় মাঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই ওয়াকওয়ে ডুবে যাচ্ছে। কিন্তু এসব বিষয় দেখার কেউ নেই। ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ উদ্যানের স্থায়ী মঞ্চে বসে জনসভায় বক্তৃতা করেন। তারপরে আর উদ্যানটির কোন স্থাপনার মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার হয়নি। শুধুমাত্র সিটি করপোরেশনের কয়েকজন শ্রমিক ওয়াকওয়ে ঝাড়– দেয়া ছাড়া আর কাউকে এখানে দেখা যায় না।