কৃষির রূপান্তর : প্রাপ্তির মধ্যে অপ্রাপ্তিও আছে

মিহির কুমার রায়

করোনাকালীন বিশ্বে যখন সব দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে, অনেক দেশে যখন চলছে খাদ্যাভাব, তখন বাংলাদেশ তার অর্থনীতিকে সচল রেখেছে কৃষিকে ঘিরেই। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৭০ হাজার হেক্টর জমি কমে যাওয়া সত্ত্বেও ১৬ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার দেশে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের সুকঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৃষকদের অবদান অনন্য।

বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে তৃতীয়, শাকসবজি উৎপাদনে তৃতীয়, ‘সোনালি আঁশ’ পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, আম উৎপাদনে অষ্টম, ছাগলের দুধ উৎপাদনে দ্বিতীয়, মাংস উৎপাদনে চতুর্থ, ইলিশ উৎপাদনে ১ম স্থানে, আলু উৎপাদনে ৭ম স্থানে রয়েছে; যা কৃষিক্ষেত্রে সাফল্যেরই প্রমাণ। এর জন্য প্রযুক্তি বিশেষ ভূমিকা রেখেছে যেমন ব্রি ১০৬টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে, দেশে এখন পর্যন্ত ১৮টি ফসলের ১১২টি জাত আবিষ্কার করেছে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)। ১১৫টি হাইব্রিড ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে বেসরকারি বীজ কোম্পানি, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ফসলের ৩০৬টি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে। কৃষিপ্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে ৩৬৩টি। বর্তমানে ২১১টি ফসল নিয়ে গবেষণা চলছে।

বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট উচ্চ ফলনশীল ও অধিক চিনিযুক্ত ৪৪টি ইক্ষু জাত উদ্ভাবন করেছে, এদের গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ১০০ টনেরও বেশি এবং চিনি আহরণের হার ১২% এর ঊর্ধ্বে; অন্যদিকে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) এরই মধ্যে পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন করেছে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের রায়ে বিশাল সমুদ্র এলাকা জয় করে এবং বর্তমানে দেশের সমুদ্রসীমার আয়তন দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার, যেখান থেকে মৎস্যসম্পদ আহরণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রাণী অধিদফতরের তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের তরল দুধের উৎপাদন ১০৬.৮০ লাখ টন, মাংস উৎপাদন ৭৬.৭৪ লাখ টন, ডিমের উৎপাদন ১৭৩৬ কোটি। ইতোমধ্যে ডিম, দুধ ও মাংস উৎপাদনে দেশ শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণই হয়নি, প্রাণিজ উৎপাদন রফতানি করার সুযোগও তৈরি হচ্ছে।

কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ শুরু হয়েছে এবং এতে কৃষি আরও বেগবান হচ্ছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও গতিশীলতা নিশ্চিত করা। করোনাকাল বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার মধ্যে কৃষিই হচ্ছে আমাদের অর্থনীতি এবং টিকে থাকার মূল শক্তি। সমন্বিত আধুনিকায়ন ও যান্ত্রিকীকরণ প্রক্রিয়ায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে একদিকে যেমন প্রবীণ কৃষকদের কাজটা সহজ করে দিচ্ছে, অন্যদিকে যান্ত্রিক কৃষির প্রতি তরুণরা আগ্রহী হবার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। বাংলাদেশে ২০১৮ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, কৃষকের গড় বয়স ৪৮ বছর। ১৯৮৮ সালে দেশের কৃষিতে নিয়োজিত চাষিদের গড় বয়স ছিল ৩৫ বছর। অর্থাৎ বাংলাদেশের কৃষিতেও তরুণদের অংশগ্রহণ কমছে; কিন্তু বয়স্ক মানুষের শারীরিক সক্ষমতা কমে গেলে তারা কৃষিতে সফলভাবে ভূমিকা রাখতে পারে না। অর্থাৎ একদিকে তরুণদের কৃষিতে অংশগ্রহণ বাড়ানো যেমন জরুরি, একইভাবে জরুরি ব্যাপকভাবে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ।

করোনা পরিস্থিতি সব অর্থনৈতিক খাতকে বহুদিনের জন্য স্থবির করে দিয়েছে; ঠিক সেই সময়ে সবার কাছে পেশা হিসেবে কৃষিই যেন একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে কৃষিতে শ্রমিকের সংকট দেখা দেয়ায় ফসল কাটা, মাড়াই ও প্রক্রিয়াকরণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে যান্ত্রিকীকরণের বিষয়টি জোরের সঙ্গে আলোচনায় এসেছে।

কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষক লাভবান হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থান তৈরি হবে। একই সঙ্গে, ফসলের নিবিড়তা বাড়বে ও চাষ ত্বরান্বিত হবে। দেশের বিদ্যমান কৃষি ব্যবস্থার আধুনিক তথা যান্ত্রিকীকরণের জন্য বাজেটে ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার বিষয়টি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক।

রাজধানীসহ প্রায় সর্বত্র সুউচ্চ দালানকোঠা ও মার্কেট নির্মাণ করতে গিয়ে অত্যধিক চাপ পড়ছে কৃষিজমিতে। সরকার সমস্যাটি সম্পর্কে সম্যক সচেতন। গ্রামকে শহরায়ন করতে হবে, গ্রামের নিসর্গ-প্রকৃতি ও সৌন্দর্য অক্ষুণ্ণ রেখেই। শহরের সব নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দিতে হবে গ্রামেও। তাই বলে কেবল উন্নয়নের নামে কৃষিজমি অধিগ্রহণ করা যাবে না। মনে রাখতে হবে যে, কৃষি অদ্যাবধি বাংলাদেশের জীবন-জীবিকা ও অর্থনীতির প্রাণশক্তি। তবে বর্তমানে কৃষিকাজে উৎসাহী তথা কৃষিশ্রমিক পাওয়া রীতিমতো দুর্লভ হয়ে উঠেছে।

গত দুই বছর ধরে হাওর অঞ্চলে বোরোর বাম্পার ফলন হওয়ায় ধান কাটার শ্রমিক পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও একজন শ্রমিকের মজুরি ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা। অন্যদিকে বর্তমানে বাজারে এক মণ ধানের দাম বড়জোর ৪৫০-৫০০ টাকা। ইতোমধ্যে ধানের উৎপাদন খরচও বেড়েছে। প্রচলিত কৃষি ব্যবস্থায় যান্ত্রিকীকরণ শুরু হলে ধানবীজ, চারা রোপণসহ সার ও কীটনাশক ছিটানো, নিড়ানি, সর্বোপরি ধান কাটা, মাড়াইসহ শুকানো এমনকি সরাসরি সাইলোতে পাঠানো সবই করা সহজে সম্ভব আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে। কৃষিতে প্রতি বছর কমবেশি ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকে। এর মধ্যে ৬-৭ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে থাকে বিবিধ প্রণোদনা খাতে। এখন থেকে বাকি ৩ হাজার টাকা ব্যয় করা হবে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের কাজে।

উল্লেখ করা আবশ্যক, এ কাজটি শুরু হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই। তবে এর সার্বিক সুফল পেতে হলে টুকরো টুকরো জমির একত্রীকরণ অত্যাবশ্যক। সমবায় প্রথা এক্ষেত্রে সুফলদায়ক হতে পারে। এর পাশাপাশি উৎপাদিত ফসলের আধুনিক বিপণন ব্যবস্থাও জরুরি। গত কয়েক বছরে দেশে বিপ্লব ঘটে গেছে কৃষিতে, ডিজিটাল কৃষিসহ হাইব্রিড পদ্ধতি চালুর ফলে একেবারে বীজতলা থেকে শুরু করে সার, সেচ, কীটনাশক, আবহাওয়া, জলবায়ু, ফসল উৎপাদন, বাজার পরিস্থিতিসহ অন্যবিধ সমস্যা নিয়ে খোলামেলা মতবিনিময়, পরামর্শ ও প্রতিকারের সুযোগ পাওয়া যায় তাৎক্ষণিকভাবে।

এর অনিবার্য ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে কৃষি ব্যবস্থাপনায়, সুফল পাচ্ছে কৃষক, সর্বোপরি বাড়ছে ফসল উৎপাদন। তার মানে ডিজিটাল কৃষি ব্যবস্থা দেশের কৃষিতে প্রায় বিপ্লব নিয়ে এসেছে। হাইব্রিড বীজ, জিএম বীজসহ আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি ফসল, শাকসবজি, মৎস্য, পোলট্রি, ফল-ফলাদির উৎপাদন বাড়িয়েছে বহুগুণ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সর্বাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি। প্রতি বছর উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্যসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য আধুনিক খাদ্যগুদামের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এর পাশাপাশি কৃষির যান্ত্রিকীকরণসহ সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার হলো সব মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা।

এখন প্রশ্ন হলো- কোভিডের কারণে বিদেশ থেকে যে শ্রমিকরা দেশে ফিরে এসেছেন এবং এখনো বিদেশে যেতে পারেননি, শহর থেকে কাজ হারিয়ে যারা গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের কর্মসংস্থান কিংবা তাদের শ্রম বিনিয়োগ কিভাবে ঘটবে? কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সরকার ১ লাখ ২১ হাজার ১১৭ কোটি টাকা প্রণোদনা দিয়েছে, যার মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকা ৪ শতাংশ সুদে কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এসএমই খাতে দিয়েছে।

কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিকরণ, কৃষি গবেষণায় দক্ষতা বৃদ্ধি, কৃষির বহুমুখীকরণ, রপ্তানিমুখী কৃষিপণ্যের বাণিজ্যিকীকরণ, পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ইত্যাদিতে জোর দিতে হবে। সেক্ষেত্রে বর্তমান বছরের বাজেটে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির (জিডিপি) যে টার্গেট (৭.২%) ধরা হয়েছে, তা অর্জনে কৃষি খাতের গুরুত্ব অপরিসীম বিধায় সেই খাতে প্রবৃদ্ধি কমপক্ষে ৪.৫ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে বলে কৃষি অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। কোভিড-১৯ দেখিয়ে দিয়েছে রপ্তানিমুখী চিন্তা পরিহার করে গ্রামীণ অর্থনীতি ও খাদ্য উৎপাদন খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন বিষয়ে। প্রবৃদ্ধি যা-ই হোক না কেন, তা অর্জিত হয়েছে মূলত কৃষি, প্রবাসী আয় এবং পোশাক রপ্তানি খাত থেকে।

[লেখক : ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি]

image

কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ফলে কৃষকদের কাজ সহজ হয়েছে

আরও খবর
শিক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিক অবক্ষয়
কোর্ট ম্যারেজ সম্পর্কে ভুল ধারণা

সোমবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ , ৪ আশ্বিন ১৪৩০, ০২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫

কৃষির রূপান্তর : প্রাপ্তির মধ্যে অপ্রাপ্তিও আছে

মিহির কুমার রায়

image

কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ফলে কৃষকদের কাজ সহজ হয়েছে

করোনাকালীন বিশ্বে যখন সব দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে, অনেক দেশে যখন চলছে খাদ্যাভাব, তখন বাংলাদেশ তার অর্থনীতিকে সচল রেখেছে কৃষিকে ঘিরেই। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৭০ হাজার হেক্টর জমি কমে যাওয়া সত্ত্বেও ১৬ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার দেশে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের সুকঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৃষকদের অবদান অনন্য।

বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে তৃতীয়, শাকসবজি উৎপাদনে তৃতীয়, ‘সোনালি আঁশ’ পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, আম উৎপাদনে অষ্টম, ছাগলের দুধ উৎপাদনে দ্বিতীয়, মাংস উৎপাদনে চতুর্থ, ইলিশ উৎপাদনে ১ম স্থানে, আলু উৎপাদনে ৭ম স্থানে রয়েছে; যা কৃষিক্ষেত্রে সাফল্যেরই প্রমাণ। এর জন্য প্রযুক্তি বিশেষ ভূমিকা রেখেছে যেমন ব্রি ১০৬টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে, দেশে এখন পর্যন্ত ১৮টি ফসলের ১১২টি জাত আবিষ্কার করেছে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)। ১১৫টি হাইব্রিড ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে বেসরকারি বীজ কোম্পানি, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ফসলের ৩০৬টি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে। কৃষিপ্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে ৩৬৩টি। বর্তমানে ২১১টি ফসল নিয়ে গবেষণা চলছে।

বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট উচ্চ ফলনশীল ও অধিক চিনিযুক্ত ৪৪টি ইক্ষু জাত উদ্ভাবন করেছে, এদের গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ১০০ টনেরও বেশি এবং চিনি আহরণের হার ১২% এর ঊর্ধ্বে; অন্যদিকে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) এরই মধ্যে পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন করেছে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের রায়ে বিশাল সমুদ্র এলাকা জয় করে এবং বর্তমানে দেশের সমুদ্রসীমার আয়তন দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার, যেখান থেকে মৎস্যসম্পদ আহরণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রাণী অধিদফতরের তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের তরল দুধের উৎপাদন ১০৬.৮০ লাখ টন, মাংস উৎপাদন ৭৬.৭৪ লাখ টন, ডিমের উৎপাদন ১৭৩৬ কোটি। ইতোমধ্যে ডিম, দুধ ও মাংস উৎপাদনে দেশ শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণই হয়নি, প্রাণিজ উৎপাদন রফতানি করার সুযোগও তৈরি হচ্ছে।

কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ শুরু হয়েছে এবং এতে কৃষি আরও বেগবান হচ্ছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও গতিশীলতা নিশ্চিত করা। করোনাকাল বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার মধ্যে কৃষিই হচ্ছে আমাদের অর্থনীতি এবং টিকে থাকার মূল শক্তি। সমন্বিত আধুনিকায়ন ও যান্ত্রিকীকরণ প্রক্রিয়ায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে একদিকে যেমন প্রবীণ কৃষকদের কাজটা সহজ করে দিচ্ছে, অন্যদিকে যান্ত্রিক কৃষির প্রতি তরুণরা আগ্রহী হবার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। বাংলাদেশে ২০১৮ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, কৃষকের গড় বয়স ৪৮ বছর। ১৯৮৮ সালে দেশের কৃষিতে নিয়োজিত চাষিদের গড় বয়স ছিল ৩৫ বছর। অর্থাৎ বাংলাদেশের কৃষিতেও তরুণদের অংশগ্রহণ কমছে; কিন্তু বয়স্ক মানুষের শারীরিক সক্ষমতা কমে গেলে তারা কৃষিতে সফলভাবে ভূমিকা রাখতে পারে না। অর্থাৎ একদিকে তরুণদের কৃষিতে অংশগ্রহণ বাড়ানো যেমন জরুরি, একইভাবে জরুরি ব্যাপকভাবে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ।

করোনা পরিস্থিতি সব অর্থনৈতিক খাতকে বহুদিনের জন্য স্থবির করে দিয়েছে; ঠিক সেই সময়ে সবার কাছে পেশা হিসেবে কৃষিই যেন একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে কৃষিতে শ্রমিকের সংকট দেখা দেয়ায় ফসল কাটা, মাড়াই ও প্রক্রিয়াকরণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে যান্ত্রিকীকরণের বিষয়টি জোরের সঙ্গে আলোচনায় এসেছে।

কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষক লাভবান হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থান তৈরি হবে। একই সঙ্গে, ফসলের নিবিড়তা বাড়বে ও চাষ ত্বরান্বিত হবে। দেশের বিদ্যমান কৃষি ব্যবস্থার আধুনিক তথা যান্ত্রিকীকরণের জন্য বাজেটে ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার বিষয়টি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক।

রাজধানীসহ প্রায় সর্বত্র সুউচ্চ দালানকোঠা ও মার্কেট নির্মাণ করতে গিয়ে অত্যধিক চাপ পড়ছে কৃষিজমিতে। সরকার সমস্যাটি সম্পর্কে সম্যক সচেতন। গ্রামকে শহরায়ন করতে হবে, গ্রামের নিসর্গ-প্রকৃতি ও সৌন্দর্য অক্ষুণ্ণ রেখেই। শহরের সব নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দিতে হবে গ্রামেও। তাই বলে কেবল উন্নয়নের নামে কৃষিজমি অধিগ্রহণ করা যাবে না। মনে রাখতে হবে যে, কৃষি অদ্যাবধি বাংলাদেশের জীবন-জীবিকা ও অর্থনীতির প্রাণশক্তি। তবে বর্তমানে কৃষিকাজে উৎসাহী তথা কৃষিশ্রমিক পাওয়া রীতিমতো দুর্লভ হয়ে উঠেছে।

গত দুই বছর ধরে হাওর অঞ্চলে বোরোর বাম্পার ফলন হওয়ায় ধান কাটার শ্রমিক পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও একজন শ্রমিকের মজুরি ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা। অন্যদিকে বর্তমানে বাজারে এক মণ ধানের দাম বড়জোর ৪৫০-৫০০ টাকা। ইতোমধ্যে ধানের উৎপাদন খরচও বেড়েছে। প্রচলিত কৃষি ব্যবস্থায় যান্ত্রিকীকরণ শুরু হলে ধানবীজ, চারা রোপণসহ সার ও কীটনাশক ছিটানো, নিড়ানি, সর্বোপরি ধান কাটা, মাড়াইসহ শুকানো এমনকি সরাসরি সাইলোতে পাঠানো সবই করা সহজে সম্ভব আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে। কৃষিতে প্রতি বছর কমবেশি ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকে। এর মধ্যে ৬-৭ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে থাকে বিবিধ প্রণোদনা খাতে। এখন থেকে বাকি ৩ হাজার টাকা ব্যয় করা হবে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের কাজে।

উল্লেখ করা আবশ্যক, এ কাজটি শুরু হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই। তবে এর সার্বিক সুফল পেতে হলে টুকরো টুকরো জমির একত্রীকরণ অত্যাবশ্যক। সমবায় প্রথা এক্ষেত্রে সুফলদায়ক হতে পারে। এর পাশাপাশি উৎপাদিত ফসলের আধুনিক বিপণন ব্যবস্থাও জরুরি। গত কয়েক বছরে দেশে বিপ্লব ঘটে গেছে কৃষিতে, ডিজিটাল কৃষিসহ হাইব্রিড পদ্ধতি চালুর ফলে একেবারে বীজতলা থেকে শুরু করে সার, সেচ, কীটনাশক, আবহাওয়া, জলবায়ু, ফসল উৎপাদন, বাজার পরিস্থিতিসহ অন্যবিধ সমস্যা নিয়ে খোলামেলা মতবিনিময়, পরামর্শ ও প্রতিকারের সুযোগ পাওয়া যায় তাৎক্ষণিকভাবে।

এর অনিবার্য ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে কৃষি ব্যবস্থাপনায়, সুফল পাচ্ছে কৃষক, সর্বোপরি বাড়ছে ফসল উৎপাদন। তার মানে ডিজিটাল কৃষি ব্যবস্থা দেশের কৃষিতে প্রায় বিপ্লব নিয়ে এসেছে। হাইব্রিড বীজ, জিএম বীজসহ আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি ফসল, শাকসবজি, মৎস্য, পোলট্রি, ফল-ফলাদির উৎপাদন বাড়িয়েছে বহুগুণ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সর্বাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি। প্রতি বছর উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্যসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য আধুনিক খাদ্যগুদামের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এর পাশাপাশি কৃষির যান্ত্রিকীকরণসহ সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার হলো সব মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা।

এখন প্রশ্ন হলো- কোভিডের কারণে বিদেশ থেকে যে শ্রমিকরা দেশে ফিরে এসেছেন এবং এখনো বিদেশে যেতে পারেননি, শহর থেকে কাজ হারিয়ে যারা গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের কর্মসংস্থান কিংবা তাদের শ্রম বিনিয়োগ কিভাবে ঘটবে? কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সরকার ১ লাখ ২১ হাজার ১১৭ কোটি টাকা প্রণোদনা দিয়েছে, যার মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকা ৪ শতাংশ সুদে কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এসএমই খাতে দিয়েছে।

কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিকরণ, কৃষি গবেষণায় দক্ষতা বৃদ্ধি, কৃষির বহুমুখীকরণ, রপ্তানিমুখী কৃষিপণ্যের বাণিজ্যিকীকরণ, পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ইত্যাদিতে জোর দিতে হবে। সেক্ষেত্রে বর্তমান বছরের বাজেটে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির (জিডিপি) যে টার্গেট (৭.২%) ধরা হয়েছে, তা অর্জনে কৃষি খাতের গুরুত্ব অপরিসীম বিধায় সেই খাতে প্রবৃদ্ধি কমপক্ষে ৪.৫ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে বলে কৃষি অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। কোভিড-১৯ দেখিয়ে দিয়েছে রপ্তানিমুখী চিন্তা পরিহার করে গ্রামীণ অর্থনীতি ও খাদ্য উৎপাদন খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন বিষয়ে। প্রবৃদ্ধি যা-ই হোক না কেন, তা অর্জিত হয়েছে মূলত কৃষি, প্রবাসী আয় এবং পোশাক রপ্তানি খাত থেকে।

[লেখক : ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি]