কোর্ট ম্যারেজ সম্পর্কে ভুল ধারণা

মোশাররাফা পারভীন

আমাদের দেশে অধিকাংশ লোকেরই ধারণা ‘কোর্ট ম্যারেজ’ করলেই বিয়ে হয়ে গেল; কিন্তু বিষয়টি এত সরল নয়। কোর্ট ম্যারেজ সম্পর্কে সঠিক তথ্য না জানার কারণে পরবর্তী সময়ে অনেক আইনি ঝামেলাও পোহাতে হয়। ইসলামী শরিয়াহ আইন অনুসারে বিবাহ হলো একজন পুরুষ এবং একজন মহিলার মধ্যে একটি আইনত বাধ্যতামূলক ও সামাজিক চুক্তি।

বিবাহের চুক্তির আইন হলো- ‘একটি ধর্মীয় আইন’ যা মুসলমানরা তাদের ‘ব্যক্তিগত আইন’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। বৈধ বিবাহের অপরিহার্য শর্ত হলো- ইজাব (প্রস্তাব) এবং কাবুল (গ্রহণ) উভয়কেই একই বৈঠকে প্রকাশ করতে হবে। বালিঘ (‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯’ এর অধীনে বিবাহের পক্ষগুলোকে অবশ্যই সংখ্যাগরিষ্ঠতার বয়স প্রাপ্ত হতে হবে; যা ছেলেদের জন্য ২১ এবং মেয়েদের জন্য ১৮) দুই সাক্ষী (একজন পুরুষ বা দুইজন মহিলা সাক্ষী) এবং নিবন্ধন উভয়পক্ষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ করে মহিলাদের জন্য এবং বিবাহের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে কিছু আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। মুসলিম বিবাহ ‘মুসলিম ব্যক্তিগত (শরিয়ত) আবেদন আইন, ১৯৩৭’ দ্বারা পরিচালিত। বাংলাদেশে কোর্ট ম্যারেজের মতো প্রচলিত ধারণা কোর্ট ম্যারেজ বলতে কি বুঝায়?

কোর্ট ম্যারেজ হলো বিয়ের হলফনামা মাত্র। এ হলফনামাটি একটি নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে নোটারি পাবলিকের কার্যালয়ে কিংবা প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যালয়ে (কোর্টে) করতে হয়। প্রশ্ন হলো- আইনে কোর্ট ম্যারেজের অবস্থান কেমন? আইনে কোর্ট ম্যারেজ করার কোনো বিধান নেই এবং এর কোনো ভিত্তিও নেই। ‘কাবিননামা’ (বিবাহের প্রশংসাপত্র) ছাড়া বিবাহের একটি হলফনামার কোনো মূল্য নেই এবং এর কোনো আইনি পরিণতিও নেই। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারিবারিক আইনে বিবাহ সম্পন্ন হবে। একা হলফনামা দিয়ে বিবাহ সম্পন্ন হয় না। ‘মুসলিম বিবাহ এবং বিবাহবিচ্ছেদ (নিবন্ধন) আইন ১৯৭৪’, ধারা ৫(২) অনুসারে প্রতিটি বিবাহ অবশ্যই নিবন্ধিত হতে হবে।

বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে বিবাহ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। অন্যথায় এ আইনের ৫(৪) ধারা অনুযায়ী কাজী ও বরকে ২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিতের বিধান রয়েছে। কাবিননামা নিবন্ধন ছাড়া শুধুমাত্র হলফনামার মাধ্যমে বিবাহ হলে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয় তা হলো শিশুরা অবৈধ। স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক হারাম হয়। স্ত্রীর মোহরানার এবং ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী থাকে না। পারস্পরিক উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না। সখ্যতার নিয়ম কার্যকর হয় না। দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য কোনো মামলা করা যায় না। স্বামী যুক্তিসঙ্গত উপায়ে স্ত্রীর চলাফেরাকে সংযত করার অধিকারী পায় না। কাবিননামা ছাড়া আদালতে বিবাহ প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

কোর্ট ম্যারেজের বৈধতা সম্পর্কিত বিচারিক সিদ্ধান্ত : (১) আব্দুল্লাহ বনাম রোকেয়া খাতুন (১৯৬৯) ২১ ডিএলআর ২১৩- বৈধভাবে কার্যকর হলে বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা বিবাহ নিবন্ধন না করার জন্য প্রভাবিত নাও হতে পারে; কিন্তু বিবাহ নিবন্ধন না করায় বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা নিয়েই সন্দেহ দেখা দেয়। (২) খাদেজা বেগম বনাম সাদাক সরকার ১৯৯৮, ৫০ ডিএলআর (এইচসিডি) ১৮১- মুসলিম বিয়েতে বিবাহের বৈধতা প্রমাণের জন্য কাবিননামায় উভয় পক্ষের স্বাক্ষর অপরিহার্য। এটা স্পষ্ট যে, কাবিননামায় নিবন্ধিত ও স্বাক্ষরিত হলেই বিবাহ বৈধ হয়। তাই শুধুমাত্র হলফনামা দিয়ে কোর্ট ম্যারেজ না করে, আইনের দৃষ্টিতে বৈধ হওয়ার জন্য পারিবারিক আইন অনুযায়ী বিয়ে সম্পন্ন করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট নথিপত্র যথাযথভাবে সম্পাদন করতে হবে।

[লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়]

সোমবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ , ৪ আশ্বিন ১৪৩০, ০২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫

কোর্ট ম্যারেজ সম্পর্কে ভুল ধারণা

মোশাররাফা পারভীন

আমাদের দেশে অধিকাংশ লোকেরই ধারণা ‘কোর্ট ম্যারেজ’ করলেই বিয়ে হয়ে গেল; কিন্তু বিষয়টি এত সরল নয়। কোর্ট ম্যারেজ সম্পর্কে সঠিক তথ্য না জানার কারণে পরবর্তী সময়ে অনেক আইনি ঝামেলাও পোহাতে হয়। ইসলামী শরিয়াহ আইন অনুসারে বিবাহ হলো একজন পুরুষ এবং একজন মহিলার মধ্যে একটি আইনত বাধ্যতামূলক ও সামাজিক চুক্তি।

বিবাহের চুক্তির আইন হলো- ‘একটি ধর্মীয় আইন’ যা মুসলমানরা তাদের ‘ব্যক্তিগত আইন’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। বৈধ বিবাহের অপরিহার্য শর্ত হলো- ইজাব (প্রস্তাব) এবং কাবুল (গ্রহণ) উভয়কেই একই বৈঠকে প্রকাশ করতে হবে। বালিঘ (‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯’ এর অধীনে বিবাহের পক্ষগুলোকে অবশ্যই সংখ্যাগরিষ্ঠতার বয়স প্রাপ্ত হতে হবে; যা ছেলেদের জন্য ২১ এবং মেয়েদের জন্য ১৮) দুই সাক্ষী (একজন পুরুষ বা দুইজন মহিলা সাক্ষী) এবং নিবন্ধন উভয়পক্ষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ করে মহিলাদের জন্য এবং বিবাহের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে কিছু আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। মুসলিম বিবাহ ‘মুসলিম ব্যক্তিগত (শরিয়ত) আবেদন আইন, ১৯৩৭’ দ্বারা পরিচালিত। বাংলাদেশে কোর্ট ম্যারেজের মতো প্রচলিত ধারণা কোর্ট ম্যারেজ বলতে কি বুঝায়?

কোর্ট ম্যারেজ হলো বিয়ের হলফনামা মাত্র। এ হলফনামাটি একটি নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে নোটারি পাবলিকের কার্যালয়ে কিংবা প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যালয়ে (কোর্টে) করতে হয়। প্রশ্ন হলো- আইনে কোর্ট ম্যারেজের অবস্থান কেমন? আইনে কোর্ট ম্যারেজ করার কোনো বিধান নেই এবং এর কোনো ভিত্তিও নেই। ‘কাবিননামা’ (বিবাহের প্রশংসাপত্র) ছাড়া বিবাহের একটি হলফনামার কোনো মূল্য নেই এবং এর কোনো আইনি পরিণতিও নেই। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারিবারিক আইনে বিবাহ সম্পন্ন হবে। একা হলফনামা দিয়ে বিবাহ সম্পন্ন হয় না। ‘মুসলিম বিবাহ এবং বিবাহবিচ্ছেদ (নিবন্ধন) আইন ১৯৭৪’, ধারা ৫(২) অনুসারে প্রতিটি বিবাহ অবশ্যই নিবন্ধিত হতে হবে।

বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে বিবাহ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। অন্যথায় এ আইনের ৫(৪) ধারা অনুযায়ী কাজী ও বরকে ২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিতের বিধান রয়েছে। কাবিননামা নিবন্ধন ছাড়া শুধুমাত্র হলফনামার মাধ্যমে বিবাহ হলে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয় তা হলো শিশুরা অবৈধ। স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক হারাম হয়। স্ত্রীর মোহরানার এবং ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী থাকে না। পারস্পরিক উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না। সখ্যতার নিয়ম কার্যকর হয় না। দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য কোনো মামলা করা যায় না। স্বামী যুক্তিসঙ্গত উপায়ে স্ত্রীর চলাফেরাকে সংযত করার অধিকারী পায় না। কাবিননামা ছাড়া আদালতে বিবাহ প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

কোর্ট ম্যারেজের বৈধতা সম্পর্কিত বিচারিক সিদ্ধান্ত : (১) আব্দুল্লাহ বনাম রোকেয়া খাতুন (১৯৬৯) ২১ ডিএলআর ২১৩- বৈধভাবে কার্যকর হলে বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা বিবাহ নিবন্ধন না করার জন্য প্রভাবিত নাও হতে পারে; কিন্তু বিবাহ নিবন্ধন না করায় বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা নিয়েই সন্দেহ দেখা দেয়। (২) খাদেজা বেগম বনাম সাদাক সরকার ১৯৯৮, ৫০ ডিএলআর (এইচসিডি) ১৮১- মুসলিম বিয়েতে বিবাহের বৈধতা প্রমাণের জন্য কাবিননামায় উভয় পক্ষের স্বাক্ষর অপরিহার্য। এটা স্পষ্ট যে, কাবিননামায় নিবন্ধিত ও স্বাক্ষরিত হলেই বিবাহ বৈধ হয়। তাই শুধুমাত্র হলফনামা দিয়ে কোর্ট ম্যারেজ না করে, আইনের দৃষ্টিতে বৈধ হওয়ার জন্য পারিবারিক আইন অনুযায়ী বিয়ে সম্পন্ন করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট নথিপত্র যথাযথভাবে সম্পাদন করতে হবে।

[লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়]