বিদেশি কার্ড প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরতা কমাতে এবং ডলার সাশ্রয়ের জন্য চলতি বছরের জুলাইয়ে ‘ন্যাশনাল ডেবিট কার্ড’ চালুর উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী ১ নভেম্বর এই কার্ড আনুষ্ঠানিকভাবে গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘ন্যাশনাল ডেবিট কার্ড আগামী ১ নভেম্বর উদ্বোধন করার পরিকল্পনা আছে। প্রাথমিকভাবে ৮টি ব্যাংক নিয়ে পাইলটিং কার্যক্রম করা হচ্ছে। জাতীয় পর্যায়ে এই কার্ড ব্যবহার হলে গ্রাহকের খরচ কমবে। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক একটা কার্ডের জন্য যেসব সেবা দেবে তা সাশ্রয়ী হবে। তখন আন্তর্জাতিক কার্ড স্কিমগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা হবে। এখন আন্তর্জাতিক কার্ড স্কিমগুলো যা নির্ধারণ করে দেয়, তা-ই মানতে হয়। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য এটি চালু করবে, পরে টাকা-রুপি কার্ড চালু করা হবে।’
এর আগে গত ২ জুন বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ন্যাশনাল ডেবিট কার্ড প্রণয়নের উদ্যোগের কথা জানান গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে ভিসা, মাস্টার বা বাইরের কোম্পানিগুলোর ডেবিট কার্ড বা ক্রেডিট কার্ড আছে। আমাদের নিজস্ব কোন কার্ড ছিল না। এর ইউজার ছিল রেস্ট্রিকটেড। যে ফি দেয়া হয় এটা অনেকটা বাইরে চলে যায়। আমরা ন্যাশনাল ডেবিট কার্ড তৈরি করছি। সব ব্যাংক এবং ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন এক কার্ড ব্যবহার করবে। এটার প্রচলন হলে আমরা মনে করি টাকার পরিবর্তে এই কার্ডের ব্যবহার বেড়ে যাবে।’
পরবর্তীকালে মুদ্রানীতি অনুষ্ঠানে গভর্নর বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে যে ডেবিট কার্ড নিয়ে আসা হচ্ছে, এটার নাম দেয়া হয়েছে টাকা পে কার্ড। এই কার্ড ব্যবহার করে দেশের ভেতরে কেনাকাটা করা যাবে। এটাকে আমরা রুপির সঙ্গে যুক্ত করে ফেলব, সেই প্রক্রিয়া চলছে।’
আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘বাংলাদেশেও এই কার্ড দিয়ে লেনদেন করা যাবে। আবার কেউ ভারতে গেলে ভ্রমণকারীর ১২ হাজার ডলারের যে ভ্রমণ কোটা আছে, সেই পরিমাণ অর্থ তিনি রুপিতে কেনাকাটা করতে পারবেন। ফলে মুদ্রার বিনিময়ের কারণে যে ক্ষতি হতো, সেটা আর হবে না। তাতে দেখা গেছে, ৬ শতাংশের মতো অপচয় কমবে। বাংলাদেশিরা সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করেন ভারতে। এতে অনেক ডলার বাঁচবে।’
এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২টি কমিটি সম্প্রতি ন্যাশনাল ডেবিট কার্ড চালুর জন্য কাজ শুরু করেছে। দুটি কমিটির মধ্যে স্টিয়ারিং কমিটির নেতৃত্বে আছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী সায়েদুর রহমান এবং ওয়ার্কিং কমিটির নেতৃত্বে আছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগের পরিচালক মো. মোতাসেম বিল্লাহ। এছাড়া কমিটিতে আটটি ব্যাংকের স্থানীয় প্রতিনিধিরাও রয়েছে। টাকা পে কার্ড প্রস্তুত করতে প্যারিসভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ফিমকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ফিম ও ৮ ব্যাংকের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ৩ দিনের একটি কর্মশালার আয়োজন করা হয়।
জানা যায়, প্রথমে ৮টি ব্যাংক পাইলটভিত্তিতে এই কার্ড ইস্যু করবে। পরবর্তী সময়ে অন্যান্য ব্যাংকও ইস্যু করতে পারবে। ব্যাংকগুলো হলোÑ ব্র্যাক ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে ডেবিট কার্ডের লেনদেন পরিচালনা ও নিষ্পত্তির মতো প্রয়োজনীয় গ্রাহক সেবা দিতে আন্তর্জাতিক পেমেন্ট স্কিম (আইপিএস) থেকে দেশের ব্যাংকগুলো বিভিন্ন সেবা নিয়ে থাকে। আর এসব সেবা দিচ্ছে ভিসা, মাস্টারকার্ড, অ্যামেক্স, জেসিবি, ডিসকভার এবং ইউনিয়ন পে’র মতো প্রতিষ্ঠান। ফলে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে ইস্যুকৃত কার্ডের সংখ্যা ও লেনদেন বাড়ছে। এসব সেবা নিতে দেশের ব্যাংকগুলোকে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার ফি দিতে হয়। তাই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা কমানো ও ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রার হ্রাস কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ন্যাশনাল ডেবিট কার্ড’ চালু করার উদ্যোগ নেয়। নিরাপত্তা থেকে পুরো নিয়ন্ত্রণ থাকবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ বাংলাদেশের মাধ্যমে এই কার্ডের লেনদেন হবে।
জানা যায়, বর্তমানে ভারত রুপি পে, পাকিস্তান পাক পে, শ্রীলঙ্কা লঙ্কা পে এবং সৌদি আরব মাডা জাতীয় কার্ড স্কিমের মাধ্যমে সেবা দিচ্ছে। ফলে দেশগুলোর স্থানীয় কার্ড মার্কেটে জাতীয় কার্ড স্কিমের ওপর নির্ভরযোগ্যতা ও ব্যবহার বেড়েছে। আর আইপিএসের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত দেশে ডেবিট, ক্রেডিট ও প্রিপেইড কার্ডের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৩ কোটি ২৬ লাখ, ২২ লাখ ৬৮ হাজার এবং ৪৪ লাখ ৯ হাজারে। ওই মাসে ডেবিট কার্ডে লেনদেন হয়েছে ৩৪ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা, ক্রেডিট কার্ডে ২ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা এবং প্রিপেইড কার্ডে ২৯৯ কোটি টাকা।
মঙ্গলবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ , ৫ আশ্বিন ১৪৩০, ০৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫
অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক
বিদেশি কার্ড প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরতা কমাতে এবং ডলার সাশ্রয়ের জন্য চলতি বছরের জুলাইয়ে ‘ন্যাশনাল ডেবিট কার্ড’ চালুর উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী ১ নভেম্বর এই কার্ড আনুষ্ঠানিকভাবে গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘ন্যাশনাল ডেবিট কার্ড আগামী ১ নভেম্বর উদ্বোধন করার পরিকল্পনা আছে। প্রাথমিকভাবে ৮টি ব্যাংক নিয়ে পাইলটিং কার্যক্রম করা হচ্ছে। জাতীয় পর্যায়ে এই কার্ড ব্যবহার হলে গ্রাহকের খরচ কমবে। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক একটা কার্ডের জন্য যেসব সেবা দেবে তা সাশ্রয়ী হবে। তখন আন্তর্জাতিক কার্ড স্কিমগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা হবে। এখন আন্তর্জাতিক কার্ড স্কিমগুলো যা নির্ধারণ করে দেয়, তা-ই মানতে হয়। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য এটি চালু করবে, পরে টাকা-রুপি কার্ড চালু করা হবে।’
এর আগে গত ২ জুন বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ন্যাশনাল ডেবিট কার্ড প্রণয়নের উদ্যোগের কথা জানান গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে ভিসা, মাস্টার বা বাইরের কোম্পানিগুলোর ডেবিট কার্ড বা ক্রেডিট কার্ড আছে। আমাদের নিজস্ব কোন কার্ড ছিল না। এর ইউজার ছিল রেস্ট্রিকটেড। যে ফি দেয়া হয় এটা অনেকটা বাইরে চলে যায়। আমরা ন্যাশনাল ডেবিট কার্ড তৈরি করছি। সব ব্যাংক এবং ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন এক কার্ড ব্যবহার করবে। এটার প্রচলন হলে আমরা মনে করি টাকার পরিবর্তে এই কার্ডের ব্যবহার বেড়ে যাবে।’
পরবর্তীকালে মুদ্রানীতি অনুষ্ঠানে গভর্নর বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে যে ডেবিট কার্ড নিয়ে আসা হচ্ছে, এটার নাম দেয়া হয়েছে টাকা পে কার্ড। এই কার্ড ব্যবহার করে দেশের ভেতরে কেনাকাটা করা যাবে। এটাকে আমরা রুপির সঙ্গে যুক্ত করে ফেলব, সেই প্রক্রিয়া চলছে।’
আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘বাংলাদেশেও এই কার্ড দিয়ে লেনদেন করা যাবে। আবার কেউ ভারতে গেলে ভ্রমণকারীর ১২ হাজার ডলারের যে ভ্রমণ কোটা আছে, সেই পরিমাণ অর্থ তিনি রুপিতে কেনাকাটা করতে পারবেন। ফলে মুদ্রার বিনিময়ের কারণে যে ক্ষতি হতো, সেটা আর হবে না। তাতে দেখা গেছে, ৬ শতাংশের মতো অপচয় কমবে। বাংলাদেশিরা সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করেন ভারতে। এতে অনেক ডলার বাঁচবে।’
এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২টি কমিটি সম্প্রতি ন্যাশনাল ডেবিট কার্ড চালুর জন্য কাজ শুরু করেছে। দুটি কমিটির মধ্যে স্টিয়ারিং কমিটির নেতৃত্বে আছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী সায়েদুর রহমান এবং ওয়ার্কিং কমিটির নেতৃত্বে আছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগের পরিচালক মো. মোতাসেম বিল্লাহ। এছাড়া কমিটিতে আটটি ব্যাংকের স্থানীয় প্রতিনিধিরাও রয়েছে। টাকা পে কার্ড প্রস্তুত করতে প্যারিসভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ফিমকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ফিম ও ৮ ব্যাংকের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ৩ দিনের একটি কর্মশালার আয়োজন করা হয়।
জানা যায়, প্রথমে ৮টি ব্যাংক পাইলটভিত্তিতে এই কার্ড ইস্যু করবে। পরবর্তী সময়ে অন্যান্য ব্যাংকও ইস্যু করতে পারবে। ব্যাংকগুলো হলোÑ ব্র্যাক ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে ডেবিট কার্ডের লেনদেন পরিচালনা ও নিষ্পত্তির মতো প্রয়োজনীয় গ্রাহক সেবা দিতে আন্তর্জাতিক পেমেন্ট স্কিম (আইপিএস) থেকে দেশের ব্যাংকগুলো বিভিন্ন সেবা নিয়ে থাকে। আর এসব সেবা দিচ্ছে ভিসা, মাস্টারকার্ড, অ্যামেক্স, জেসিবি, ডিসকভার এবং ইউনিয়ন পে’র মতো প্রতিষ্ঠান। ফলে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে ইস্যুকৃত কার্ডের সংখ্যা ও লেনদেন বাড়ছে। এসব সেবা নিতে দেশের ব্যাংকগুলোকে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার ফি দিতে হয়। তাই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা কমানো ও ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রার হ্রাস কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ন্যাশনাল ডেবিট কার্ড’ চালু করার উদ্যোগ নেয়। নিরাপত্তা থেকে পুরো নিয়ন্ত্রণ থাকবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ বাংলাদেশের মাধ্যমে এই কার্ডের লেনদেন হবে।
জানা যায়, বর্তমানে ভারত রুপি পে, পাকিস্তান পাক পে, শ্রীলঙ্কা লঙ্কা পে এবং সৌদি আরব মাডা জাতীয় কার্ড স্কিমের মাধ্যমে সেবা দিচ্ছে। ফলে দেশগুলোর স্থানীয় কার্ড মার্কেটে জাতীয় কার্ড স্কিমের ওপর নির্ভরযোগ্যতা ও ব্যবহার বেড়েছে। আর আইপিএসের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত দেশে ডেবিট, ক্রেডিট ও প্রিপেইড কার্ডের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৩ কোটি ২৬ লাখ, ২২ লাখ ৬৮ হাজার এবং ৪৪ লাখ ৯ হাজারে। ওই মাসে ডেবিট কার্ডে লেনদেন হয়েছে ৩৪ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা, ক্রেডিট কার্ডে ২ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা এবং প্রিপেইড কার্ডে ২৯৯ কোটি টাকা।