মোস্তাফা জব্বার
বাংলাদেশের প্রেক্ষিত : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২১ আলোচনাটি জুমে ছিল; মণি সিংহ ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্টে। আমি শেখর দত্ত কর্তৃক আমন্ত্রিত হই। সেই ২০০১ সাল থেকে শেখর দা’র সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা। এটি বিস্ময়ের বিষয় ছিল যে তিনি ডিজিটাল যুগ নিয়ে আলোচনা করবেন। ‘অনেক ধন্যবাদ শেখর দা আপনাকে। আমি একটু থতমত খেয়ে গেছি তখন যখন আপনি আমাকে মন্ত্রী বলে দূরে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করছেন। আমি তো আপনার জব্বার ভাই ছিলাম এখনো জব্বার ভাই আছি। ভবিষ্যতেও জব্বার ভাই থাকব এবং আপনিও আমার শেখর দা ছিলেন, আছেন ও থাকবেন, যতদিন বেঁচে থাকি ততদিন পর্যন্ত। আমি প্রথমেই আপনাকে ধন্যবাদ দেই আপনি মণি সিংহ-ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্টের প্রধান ব্যক্তি হিসেবে এমন অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সমসাময়িক একটি বিষয়কে আলোচনার জন্য বাছাই করেছেন।’
যে আলোচনাটি অনুষ্ঠিত হলো এবং যারা আলোচনা করলেন আমার কাছে মনে হচ্ছে যে তারা একটি অসাধারণ আলোচনায় অংশ নিলেন। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এখন বিশ্বের মানুষের মুখে মুখে ফিরে। বাংলাদেশেও এটি বহুল আলোচিত বিষয়। আমি নিজে অবশ্য কখনও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে গুরুত্ব দেই না, আমি পঞ্চম শিল্প বিপ্লব বলি। সামগ্রিকভাবে এটি ডিজিটাল শিল্পযুগ।
২০১৬ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা কার্লস সোয়াব বিশ্বকে এ ধারণাটি দেন। এরই মাঝে ২০০৮ সালে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা করি। এখন বিশ্ববাসী পঞ্চম শিল্প বিপ্লবের কথা বলে। জাপান বলে সোসাইটি ৫.০ কথা। এসব বস্তুত একে অন্যের পরিপূরক। শেখরদার আলোচনায় মূল প্রবন্ধকার নজরুল ইসলাম অত্যন্ত সুন্দরভাবে পুরো বিষয়গুলো বোধগম্য ভাষায় একেবারে সহজ-সরলভাবে তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে পরবর্তীকালে যে আলোচকরা ছিলেন তারাও ছিলেন অনবদ্য। আলোচক লাফিফা জামালের সঙ্গে সেদিন সকালেও আমার দেখা হয়েছিল। আমি নতুন শুনলাম সঙ্গীতার মুখে আলোচনা এবং এসএম মুজিবুর রহমান সাহেব অত্যন্ত চমৎকার আলোচনা করেছেন। আর মাহবুব জামান ভাইয়ের কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তার সঙ্গে আমার একেবারে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তো দীর্ঘদিনের এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমরা সম্পর্কযুক্ত। ইন্ডাস্ট্রিতে এক সঙ্গে থাকি একসঙ্গেই কাজ করি। আমি সেদিনই প্রথম মাহবুব জামান ভাইয়ের সঙ্গেই কথাটা স্মরণ করে জাতির পিতার প্রতি একটু শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চাই যে আজকের দিনে ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ আমরা তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়েছিলাম। আমার স্মৃতিতে এখনো ভাসে রেসকোর্স ময়দানের সেই অসাধারণ জনসভা এবং তাতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সবাই মিলে সেই দিন যে অসাধারণ কাব্য রচিত হয়েছিল এটা আসলে সর্বাংশে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং মুক্তি সংগ্রামে অবিস্মরণীয় একটা গুরুত্ব বহন করে।
সাধারণ আলোচক হিসেবে আমার জন্য সুবিধা ছিল যে, অনেক কথা আমি আগে বলে ফেলতে পারতাম। আলোচকরা যেগুলো বলেছেন সেগুলোর ক্ষেত্রে আমার পুনরাবৃত্তি করার কোনো ইচ্ছা ছিল না। সার্বিকভাবে যে প্রেক্ষিতগুলো তুলে ধরা হয় সেটুকু থেকে আমি এটুকু বলব ইতিহাসের প্রশ্নে আমরা জাতিগতভাবে যে অবস্থায় ছিলাম তা একবাক্যে সবাই জানি। আমরা একটা পরাধীন জাতি হিসেবে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করে একাত্তরেই স্বাধীনতা অর্জন করেছি। তার আগপর্যন্ত আমাদের নিজেদের শাসন অথবা নিজের দেশ কিংবা আমাদের একজন শাসক নিজেদের হবে এটি আমাদের কপালে জুটেনি। ফলে আমাদের স্বাধীনতার বয়স ৫০ পার হলো মাত্র এবং সেই কারণেই আমাদের এটি উপলব্ধি করা দরকার যে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের এই তুলনাটা চলে না। একটি বিষয় আমি সুস্পষ্ট করে বলতে চাই সেটি হচ্ছে যে আমরা তো স্বাধীনতাই পেতাম না যদি আমাদের একজন বঙ্গবন্ধু না থাকত। তার বদৌলতে আমরা যে দেশটি অর্জন করেছি এ দেশটির প্রেক্ষিত তো একটু বোঝা দরকার।
আমরা বাহাত্তর সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ করে প্রথম পৃথিবীর খবরা খবর শুনতে চাইলাম তখন দেখলাম হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির সঙ্গে তুলনা করছে। আমার বা মাহবুব জামান ভাইয়ের মতো যারা মুক্তিযুদ্ধ করে আসছি আমাদের তখন মনে ছিল কিসিঞ্জারকে- তাকে একটা একটা চড় মারতে পারলে হতো। কিন্তু তখন বাংলাদেশের অবস্থাটা কিন্তু নিঃস্ব ছিল। চ্যালেঞ্জ ছিল একটা ধ্বংসস্তূপের উপর বাংলাদেশটিকে গড়ে তোলা। আমাদের স্মরণ করা দরকার রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে এমন কিছু নেই যা বিধস্ত ছিল না এবং সেই বিধস্ত দেশে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা এবং পিএল-৪৮০ এর অধীনে যে খাদ্য সহায়তা ছিল সেটাও যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরিয়ে নিয়েছিল তখন আমাদের জন্য বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে বড় কঠিন ছিল। আমরা যদি ওই সময়কার অবস্থাটি দেখি তাহলে দেখব শিক্ষার হার শতকরা ২০ ভাগের মতো, মাথাপিছু আয় ৭০ ডলারের মতো আর ৭২-৭৩ সালে ৭৮৬ কোটি টাকা ছিল বার্ষিক বাজেট। এরকম যদি বিবরণ দিতে চাই তাহলে সবগুলোই অবিশ্বাস্য বা হাস্যকর মনে হতে পারে। ভাবা যায় যে এটা কি একটা দেশের অবস্থা হতে পারে?
অন্যদিকে আজকে যখন আমরা বলছি আমাদের কৃষি খাতে অবদান জিডিপিতে শতকরা মাত্র ১৬ ভাগ তখন কিন্তু আমরা হিসাব করতাম কৃষির অবদান শতকরা একেবারে ৯৮ ভাগ। সেই দেশটাকে প্রাথমিকভাবে বলব এই অর্থে জামান ভাই যে তথ্যটা দিয়েছেন প্রিন্টিং মেশিনের এটাতে আমি একটু কারেকশন করছি। ১৪৫৪ সালে জার্মানিতে প্রিন্টিং মেশিন আবিষ্কৃত হয় এবং গুটেনবার্গ সেই আবিষ্কারটা করেন। আর আমাদের হুগলিতে বই ছাপার জন্য ওই প্রিন্টিং মেশিনটি এসেছে ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে। তার মানে ৩২৪ বছর লেগেছে জার্মানি থেকে মুদ্রণ প্রযুক্তি হুগলি পর্যন্ত আসতে। এই যে ৩২৪ বছর পিছিয়ে পড়া জাতি এই জাতি কি দেখেছে বাষ্পীয় ইঞ্জিনভিত্তিক প্রথম শিল্পযুগ? দেখেনি।
যদি দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের হাতিয়ার বিদ্যুতের কথা বলেন এই বিদ্যুতের দশা কি ছিল আমাদের এখানে যারা বয়স্ক লোক আছেন আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি তারা স্মৃতিচারণ করে দুঃখের কথা স্মরণ করতে পারবেন। এমন অনেকেই হয়তো আছেন যারা আমার মতো কুপি বাতি দিয়ে অথবা হারিকেন দিয়ে পড়াশোনা করেছি। আমাদের ছেলেমেয়েরা এখন হারিকেন কুপিবাতি নাও চিনতে পারে- তবে আমাদের ঘর আলোকিত করতো কুপি, হ্যাজাক বা হারিকেন। আমি শহরেই বিদ্যুৎ পেতাম নাÑ গ্রাম তো দূরের কথা।
তার মানে প্রথম ও দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবে শরিক হওয়ার কোনো প্রশ্নই ছিল না। যদি একটু খোঁজ করেন তাহলে বাহাত্তর সালে বঙ্গবন্ধুকে কি করতে হয়েছে তা স্মরণ করুন। বঙ্গবন্ধু যে কল-কারখানাগুলো পেয়েছিলেন এগুলোর মালিকরা সব পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে সেক্টর করপোরেশন বানিয়ে সেই কল-কারখানাগুলোকে রক্ষা করতে হয়েছিল। আমাদের এমন কোনো খাত ছিল না যে খাতে আমরা সম্পূর্ণভাবে আমদানিনির্ভর ছিলাম না।
আমার স্পষ্ট মনে আছে ’৭৪-’৭৫ সালেও আমরা চিন্তাই করতে পারতাম না যে একমাত্র তাঁতের শাড়ি বা তাঁতের কাপড় ছাড়া কাপড়চোপড় বাংলাদেশে প্রস্তুত হতে পারে অথবা তিব্বত সাবান ছাড়া অন্য কিছু বাংলাদেশে পাওয়া যেতে পারে। এই যে অবস্থাটা ছিল সেই অবস্থাটা থেকে বাংলাদেশকে গড়ে তোলা কত বড় দুঃসাহসী কাজ ছিল সেটি কল্পনা করুন।
আরেকটা জিনিস আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে হত্যা করার পর বাংলাদেশটাকে একনাগাড়ে পঁচাত্তর থেকে ছিয়ানব্বই পর্যন্ত এর পায়ের পাতাটা উল্টাদিকে ঘুরিয়ে দিয়ে এটাকে পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আমি এ প্রসঙ্গটা আলোচনা করতে চাই না কিন্তু আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই বাংলাদেশ যতটুকু সাড়ে তিন বছরে বঙ্গবন্ধুর আমলে সামনে গিয়েছিল সেটা পেছানো তো বটেই তার চেয়ে আরও কত পেছানো যায় সেই ব্যবস্থাটা কিন্তু আমাদের হয়েছে।
আপনাদের আমি শুধু প্রযুক্তির বিষয়টা বলব যে, কোনোভাবেই আমরা যাতে কোনো প্রযুক্তির দিকে যেতে না পারি সেই প্রচেষ্টাটা কিন্তু স্পষ্টভাবে ছিল। একটা দৃষ্টান্ত দিতে পারি। ১৯৯২ সালে আমাদের জন্য বিনামূল্যে সাবমেরিন ক্যাবল পেয়েছিলাম এবং সেই বিনামূল্যের সাবমেরিন কেবল আমাদের তৎকালীন সরকার শুধু প্রত্যাখ্যানই করেনি এ অভিযোগও করেছে যে, এটার ফলে বাংলাদেশের সমস্ত তথ্য পাচার হয়ে যাবে। সেই সাবমেরিনকে পেতে আমাদের ২০০৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। সাবমেরিন ক্যাবলই আমাদের ১৪ বছর পিছিয়ে দিয়েছে।
অনেকেই এ ইতিহাস তো জানেন না যে, ১৯৯৭ সালে আমাদের আজকের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাদের সাবমেরিন ক্যাবলে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। চট্টগ্রাম থেকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত কানেটিভিটি হওয়ার কথা ছিল। এর সমস্ত কিছু ঠিকঠাক করার পরও ২০০১ সালে যখন আবার সরকার বদল হয় তখন সেই প্রকল্প বাতিল করা হয়। একই সঙ্গে ১৯৯৭ সালে তিনি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা করেছিলেন। এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের ভিত্তি বঙ্গবন্ধু রচনা করেছিলেন বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন করে এবং সেটার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ১৯৯৭ সালে স্যাটেলাইট খুঁজে পাওয়ার স্কোপটা পেতাম।
২০০১ সালে যখন সরকার বদল হলো তখন একেবারে টিউলিপ কম্পিউটার বাতিল করার মতো এ প্রকল্পগুলোকে সম্পূর্ণরূপে বাতিল করে দেয়া হয়। অতএব আমাদের সামনে যাওয়ার জায়গাটার ক্ষেত্রে এই যে পেছনে টেনে রাখাটা এটাকে আমরা যদি বিবেচনায় না নেই তাহলে আমাদের অগ্রগণ্য বিষয়টাকে মূল্যায়ন করতে পারব না। আমি যেটা বলি যে, আমরা দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব পর্যন্ত যেটুকু মিস করেছি সেইটুকুর সঙ্গে তৃতীয় শিল্প বিপ্লবে আমাদের প্রতিষ্ঠিত করার কাজটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করেছেন ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সময়কালের মধ্যে। আমাদের জামান ভাই জানেন ১৯৯৮-৯৯ সালে যদি কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ভ্যাট প্রত্যাহার না করা হতো, যদি জেআরসি কমিটি গঠিত না হতো যদি ১০ হাজার প্রোগ্রামার করার ঘোষণা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী না দিতেন এবং সবাই ক্ষেত্রে কম্পিউটারাইজেশনের যে উদ্যোগগুলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিয়েছিলেন সেই সময়কালে সেটা যদি না নেয়া হতো তাহলে বাংলাদেশ তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের ঢেউ কাকে বলে এটাও জানতে পারতো না। সেই কারণে আমি বলি যে, আজকে যখন কথা বলতে হবে তখন আমরা অতীতকে দেখে এসে তারপর যেন বলি।
ঢাকা। ২২ এপ্রিল, ২০২২। আপডেট ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩।
[লেখক : ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক]
মঙ্গলবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ , ৫ আশ্বিন ১৪৩০, ০৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫
মোস্তাফা জব্বার
বাংলাদেশের প্রেক্ষিত : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২১ আলোচনাটি জুমে ছিল; মণি সিংহ ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্টে। আমি শেখর দত্ত কর্তৃক আমন্ত্রিত হই। সেই ২০০১ সাল থেকে শেখর দা’র সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা। এটি বিস্ময়ের বিষয় ছিল যে তিনি ডিজিটাল যুগ নিয়ে আলোচনা করবেন। ‘অনেক ধন্যবাদ শেখর দা আপনাকে। আমি একটু থতমত খেয়ে গেছি তখন যখন আপনি আমাকে মন্ত্রী বলে দূরে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করছেন। আমি তো আপনার জব্বার ভাই ছিলাম এখনো জব্বার ভাই আছি। ভবিষ্যতেও জব্বার ভাই থাকব এবং আপনিও আমার শেখর দা ছিলেন, আছেন ও থাকবেন, যতদিন বেঁচে থাকি ততদিন পর্যন্ত। আমি প্রথমেই আপনাকে ধন্যবাদ দেই আপনি মণি সিংহ-ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্টের প্রধান ব্যক্তি হিসেবে এমন অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সমসাময়িক একটি বিষয়কে আলোচনার জন্য বাছাই করেছেন।’
যে আলোচনাটি অনুষ্ঠিত হলো এবং যারা আলোচনা করলেন আমার কাছে মনে হচ্ছে যে তারা একটি অসাধারণ আলোচনায় অংশ নিলেন। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এখন বিশ্বের মানুষের মুখে মুখে ফিরে। বাংলাদেশেও এটি বহুল আলোচিত বিষয়। আমি নিজে অবশ্য কখনও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে গুরুত্ব দেই না, আমি পঞ্চম শিল্প বিপ্লব বলি। সামগ্রিকভাবে এটি ডিজিটাল শিল্পযুগ।
২০১৬ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা কার্লস সোয়াব বিশ্বকে এ ধারণাটি দেন। এরই মাঝে ২০০৮ সালে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা করি। এখন বিশ্ববাসী পঞ্চম শিল্প বিপ্লবের কথা বলে। জাপান বলে সোসাইটি ৫.০ কথা। এসব বস্তুত একে অন্যের পরিপূরক। শেখরদার আলোচনায় মূল প্রবন্ধকার নজরুল ইসলাম অত্যন্ত সুন্দরভাবে পুরো বিষয়গুলো বোধগম্য ভাষায় একেবারে সহজ-সরলভাবে তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে পরবর্তীকালে যে আলোচকরা ছিলেন তারাও ছিলেন অনবদ্য। আলোচক লাফিফা জামালের সঙ্গে সেদিন সকালেও আমার দেখা হয়েছিল। আমি নতুন শুনলাম সঙ্গীতার মুখে আলোচনা এবং এসএম মুজিবুর রহমান সাহেব অত্যন্ত চমৎকার আলোচনা করেছেন। আর মাহবুব জামান ভাইয়ের কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তার সঙ্গে আমার একেবারে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তো দীর্ঘদিনের এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমরা সম্পর্কযুক্ত। ইন্ডাস্ট্রিতে এক সঙ্গে থাকি একসঙ্গেই কাজ করি। আমি সেদিনই প্রথম মাহবুব জামান ভাইয়ের সঙ্গেই কথাটা স্মরণ করে জাতির পিতার প্রতি একটু শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চাই যে আজকের দিনে ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ আমরা তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়েছিলাম। আমার স্মৃতিতে এখনো ভাসে রেসকোর্স ময়দানের সেই অসাধারণ জনসভা এবং তাতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সবাই মিলে সেই দিন যে অসাধারণ কাব্য রচিত হয়েছিল এটা আসলে সর্বাংশে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং মুক্তি সংগ্রামে অবিস্মরণীয় একটা গুরুত্ব বহন করে।
সাধারণ আলোচক হিসেবে আমার জন্য সুবিধা ছিল যে, অনেক কথা আমি আগে বলে ফেলতে পারতাম। আলোচকরা যেগুলো বলেছেন সেগুলোর ক্ষেত্রে আমার পুনরাবৃত্তি করার কোনো ইচ্ছা ছিল না। সার্বিকভাবে যে প্রেক্ষিতগুলো তুলে ধরা হয় সেটুকু থেকে আমি এটুকু বলব ইতিহাসের প্রশ্নে আমরা জাতিগতভাবে যে অবস্থায় ছিলাম তা একবাক্যে সবাই জানি। আমরা একটা পরাধীন জাতি হিসেবে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করে একাত্তরেই স্বাধীনতা অর্জন করেছি। তার আগপর্যন্ত আমাদের নিজেদের শাসন অথবা নিজের দেশ কিংবা আমাদের একজন শাসক নিজেদের হবে এটি আমাদের কপালে জুটেনি। ফলে আমাদের স্বাধীনতার বয়স ৫০ পার হলো মাত্র এবং সেই কারণেই আমাদের এটি উপলব্ধি করা দরকার যে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের এই তুলনাটা চলে না। একটি বিষয় আমি সুস্পষ্ট করে বলতে চাই সেটি হচ্ছে যে আমরা তো স্বাধীনতাই পেতাম না যদি আমাদের একজন বঙ্গবন্ধু না থাকত। তার বদৌলতে আমরা যে দেশটি অর্জন করেছি এ দেশটির প্রেক্ষিত তো একটু বোঝা দরকার।
আমরা বাহাত্তর সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ করে প্রথম পৃথিবীর খবরা খবর শুনতে চাইলাম তখন দেখলাম হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির সঙ্গে তুলনা করছে। আমার বা মাহবুব জামান ভাইয়ের মতো যারা মুক্তিযুদ্ধ করে আসছি আমাদের তখন মনে ছিল কিসিঞ্জারকে- তাকে একটা একটা চড় মারতে পারলে হতো। কিন্তু তখন বাংলাদেশের অবস্থাটা কিন্তু নিঃস্ব ছিল। চ্যালেঞ্জ ছিল একটা ধ্বংসস্তূপের উপর বাংলাদেশটিকে গড়ে তোলা। আমাদের স্মরণ করা দরকার রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে এমন কিছু নেই যা বিধস্ত ছিল না এবং সেই বিধস্ত দেশে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা এবং পিএল-৪৮০ এর অধীনে যে খাদ্য সহায়তা ছিল সেটাও যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরিয়ে নিয়েছিল তখন আমাদের জন্য বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে বড় কঠিন ছিল। আমরা যদি ওই সময়কার অবস্থাটি দেখি তাহলে দেখব শিক্ষার হার শতকরা ২০ ভাগের মতো, মাথাপিছু আয় ৭০ ডলারের মতো আর ৭২-৭৩ সালে ৭৮৬ কোটি টাকা ছিল বার্ষিক বাজেট। এরকম যদি বিবরণ দিতে চাই তাহলে সবগুলোই অবিশ্বাস্য বা হাস্যকর মনে হতে পারে। ভাবা যায় যে এটা কি একটা দেশের অবস্থা হতে পারে?
অন্যদিকে আজকে যখন আমরা বলছি আমাদের কৃষি খাতে অবদান জিডিপিতে শতকরা মাত্র ১৬ ভাগ তখন কিন্তু আমরা হিসাব করতাম কৃষির অবদান শতকরা একেবারে ৯৮ ভাগ। সেই দেশটাকে প্রাথমিকভাবে বলব এই অর্থে জামান ভাই যে তথ্যটা দিয়েছেন প্রিন্টিং মেশিনের এটাতে আমি একটু কারেকশন করছি। ১৪৫৪ সালে জার্মানিতে প্রিন্টিং মেশিন আবিষ্কৃত হয় এবং গুটেনবার্গ সেই আবিষ্কারটা করেন। আর আমাদের হুগলিতে বই ছাপার জন্য ওই প্রিন্টিং মেশিনটি এসেছে ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে। তার মানে ৩২৪ বছর লেগেছে জার্মানি থেকে মুদ্রণ প্রযুক্তি হুগলি পর্যন্ত আসতে। এই যে ৩২৪ বছর পিছিয়ে পড়া জাতি এই জাতি কি দেখেছে বাষ্পীয় ইঞ্জিনভিত্তিক প্রথম শিল্পযুগ? দেখেনি।
যদি দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের হাতিয়ার বিদ্যুতের কথা বলেন এই বিদ্যুতের দশা কি ছিল আমাদের এখানে যারা বয়স্ক লোক আছেন আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি তারা স্মৃতিচারণ করে দুঃখের কথা স্মরণ করতে পারবেন। এমন অনেকেই হয়তো আছেন যারা আমার মতো কুপি বাতি দিয়ে অথবা হারিকেন দিয়ে পড়াশোনা করেছি। আমাদের ছেলেমেয়েরা এখন হারিকেন কুপিবাতি নাও চিনতে পারে- তবে আমাদের ঘর আলোকিত করতো কুপি, হ্যাজাক বা হারিকেন। আমি শহরেই বিদ্যুৎ পেতাম নাÑ গ্রাম তো দূরের কথা।
তার মানে প্রথম ও দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবে শরিক হওয়ার কোনো প্রশ্নই ছিল না। যদি একটু খোঁজ করেন তাহলে বাহাত্তর সালে বঙ্গবন্ধুকে কি করতে হয়েছে তা স্মরণ করুন। বঙ্গবন্ধু যে কল-কারখানাগুলো পেয়েছিলেন এগুলোর মালিকরা সব পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে সেক্টর করপোরেশন বানিয়ে সেই কল-কারখানাগুলোকে রক্ষা করতে হয়েছিল। আমাদের এমন কোনো খাত ছিল না যে খাতে আমরা সম্পূর্ণভাবে আমদানিনির্ভর ছিলাম না।
আমার স্পষ্ট মনে আছে ’৭৪-’৭৫ সালেও আমরা চিন্তাই করতে পারতাম না যে একমাত্র তাঁতের শাড়ি বা তাঁতের কাপড় ছাড়া কাপড়চোপড় বাংলাদেশে প্রস্তুত হতে পারে অথবা তিব্বত সাবান ছাড়া অন্য কিছু বাংলাদেশে পাওয়া যেতে পারে। এই যে অবস্থাটা ছিল সেই অবস্থাটা থেকে বাংলাদেশকে গড়ে তোলা কত বড় দুঃসাহসী কাজ ছিল সেটি কল্পনা করুন।
আরেকটা জিনিস আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে হত্যা করার পর বাংলাদেশটাকে একনাগাড়ে পঁচাত্তর থেকে ছিয়ানব্বই পর্যন্ত এর পায়ের পাতাটা উল্টাদিকে ঘুরিয়ে দিয়ে এটাকে পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আমি এ প্রসঙ্গটা আলোচনা করতে চাই না কিন্তু আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই বাংলাদেশ যতটুকু সাড়ে তিন বছরে বঙ্গবন্ধুর আমলে সামনে গিয়েছিল সেটা পেছানো তো বটেই তার চেয়ে আরও কত পেছানো যায় সেই ব্যবস্থাটা কিন্তু আমাদের হয়েছে।
আপনাদের আমি শুধু প্রযুক্তির বিষয়টা বলব যে, কোনোভাবেই আমরা যাতে কোনো প্রযুক্তির দিকে যেতে না পারি সেই প্রচেষ্টাটা কিন্তু স্পষ্টভাবে ছিল। একটা দৃষ্টান্ত দিতে পারি। ১৯৯২ সালে আমাদের জন্য বিনামূল্যে সাবমেরিন ক্যাবল পেয়েছিলাম এবং সেই বিনামূল্যের সাবমেরিন কেবল আমাদের তৎকালীন সরকার শুধু প্রত্যাখ্যানই করেনি এ অভিযোগও করেছে যে, এটার ফলে বাংলাদেশের সমস্ত তথ্য পাচার হয়ে যাবে। সেই সাবমেরিনকে পেতে আমাদের ২০০৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। সাবমেরিন ক্যাবলই আমাদের ১৪ বছর পিছিয়ে দিয়েছে।
অনেকেই এ ইতিহাস তো জানেন না যে, ১৯৯৭ সালে আমাদের আজকের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাদের সাবমেরিন ক্যাবলে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। চট্টগ্রাম থেকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত কানেটিভিটি হওয়ার কথা ছিল। এর সমস্ত কিছু ঠিকঠাক করার পরও ২০০১ সালে যখন আবার সরকার বদল হয় তখন সেই প্রকল্প বাতিল করা হয়। একই সঙ্গে ১৯৯৭ সালে তিনি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা করেছিলেন। এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের ভিত্তি বঙ্গবন্ধু রচনা করেছিলেন বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন করে এবং সেটার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ১৯৯৭ সালে স্যাটেলাইট খুঁজে পাওয়ার স্কোপটা পেতাম।
২০০১ সালে যখন সরকার বদল হলো তখন একেবারে টিউলিপ কম্পিউটার বাতিল করার মতো এ প্রকল্পগুলোকে সম্পূর্ণরূপে বাতিল করে দেয়া হয়। অতএব আমাদের সামনে যাওয়ার জায়গাটার ক্ষেত্রে এই যে পেছনে টেনে রাখাটা এটাকে আমরা যদি বিবেচনায় না নেই তাহলে আমাদের অগ্রগণ্য বিষয়টাকে মূল্যায়ন করতে পারব না। আমি যেটা বলি যে, আমরা দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব পর্যন্ত যেটুকু মিস করেছি সেইটুকুর সঙ্গে তৃতীয় শিল্প বিপ্লবে আমাদের প্রতিষ্ঠিত করার কাজটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করেছেন ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সময়কালের মধ্যে। আমাদের জামান ভাই জানেন ১৯৯৮-৯৯ সালে যদি কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ভ্যাট প্রত্যাহার না করা হতো, যদি জেআরসি কমিটি গঠিত না হতো যদি ১০ হাজার প্রোগ্রামার করার ঘোষণা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী না দিতেন এবং সবাই ক্ষেত্রে কম্পিউটারাইজেশনের যে উদ্যোগগুলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিয়েছিলেন সেই সময়কালে সেটা যদি না নেয়া হতো তাহলে বাংলাদেশ তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের ঢেউ কাকে বলে এটাও জানতে পারতো না। সেই কারণে আমি বলি যে, আজকে যখন কথা বলতে হবে তখন আমরা অতীতকে দেখে এসে তারপর যেন বলি।
ঢাকা। ২২ এপ্রিল, ২০২২। আপডেট ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩।
[লেখক : ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক]