বাড়ছে সুপেয় পানির সংকট

তারিক আহম্মদ

পৃথিবীতে ৪৫টির মতো দেশ রয়েছে, যাদের নিজস্ব সমুদ্রবন্দর বা নদী নেই। এই স্থলবেষ্টিত দেশগুলোয় সুপেয় পানির পাশাপাশি রয়েছে জলপথের তীব্র সংকট। রাজধানী ঢাকা এ সংকট থেকে মুক্ত নয়। পৃথিবীর মোট পানির ৯৭.৫ শতাংশ পান করার অযোগ্য। মিষ্টি পানির পরিমাণ মাত্র আড়াই শতাংশ, তার মধ্যে ০.৩ ভাগ পানি থাকে নদ-নদী, খাল-বিল ও পুকুরে। পৃথিবীতে এত পানি থাকতেও পানি যেন আমাদের জন্য ক্রমেই দুর্লভ ও ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। দক্ষিণ আফ্রিকার অধিকাংশ দেশে পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। মরক্কোর নারীরা প্রতিদিন প্রায় তিন ঘণ্টার পথ অতিক্রম করে পানি সংগ্রহ করে চাহিদা পূরণ করছে। সেখানে কুয়াশাকে কাজে লাগিয়ে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে শুকিয়ে আসছে ফোরাত নদী, আড়ল হ্রদ এবং চাঁদ হ্রদ। একদিকে, সুপেয় পানি কমে আসছে, অন্যদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে চাহিদা বাড়ছে।

ধারণা করা হচ্ছে, বিশ্বে পানি সংকট সমাধান না করতে ব্যর্থ হলে সুপেয় পানির জন্য তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ বাধার আশঙ্কা রয়েছে। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলেছে, নদীমাতৃক দেশ বলে খ্যাত বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৩৩ শতাংশ সুপেয় পানির জন্য হাহাকার করছে। সুপেয় পানি হতে বঞ্চিত তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। পরিবেশবাদী সংগঠন বাপার গবেষণায় উঠে এসেছে, ঢাকায় পানির স্তর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭০ ফুট নিচে নেমে গেছে। রাজশাহীতে ১৮ থেকে ১৯ ফুট। মহানগরীতে ২ কোটি লোকের বসবাস এবং চাহিদামতো প্রতিদিন প্রায় ২৩৫ কোটি লিটার পানির প্রয়োজন। কিন্তু চাহিদা অনুসারে তা উৎপাদন হচ্ছে না। প্রতিদিন ঢাকা মহানগরে ২০০০ জনসংখ্যা যোগ হচ্ছে। যে কারণে প্রতিদিন ২০ কোটি লিটার পানির ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গড়ে একজন মানুষ প্রতিদিন ২ থেকে ৪ লিটার পানি পান করে। প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার ছাড়াও ঢাকা শহরে প্রায় ৩০ কোটি লিটার পানি অপচয় করা হয়। ফলে ভাটির দেশ বাংলাদেশে অসংখ্য নদী পানির অভাবে মারা গেছে। অন্যদিকে রাজধানীর চারপাশে থাকা বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু চারটি নদীই দূষণ ও দখলের শিকার। দেশে নব্বই দশকে ৮০ শতাংশ সেচের উৎস ছিল নদ-নদী, যা বর্তমানে ২০ শতাংশ এসে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্বের মোট পানির মাত্র ১% সুপেয় পানি, যার ৯৯% আসে ভূ-গর্ভস্থ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা থেকে। মনুষ্যসৃষ্ট বিবিধ কারণে বিশ্ব আজ মারাত্মক সুপেয় পানির সংকটে। জাতিসংঘের সহযোগী বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডাব্লিউএমও) ‘স্টেট অব গ্লোবাল ওয়াটার রিসোর্সেস-২০২১’ প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩৬০ কোটি মানুষ সুপেয় পানির সংকটে ভুগছে। তারা বছরে অন্তত এক মাস এ ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। এ প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০৫০ সাল নাগাদ পানি সংকটে ভুগতে পারে বিশ্বের ৫০০ কোটি মানুষ। জার্মানির বন শহরে অনুষ্ঠিত ‘গ্লোবাল ওয়াটার সিস্টেম প্রজেক্ট’ শীর্ষক এক বৈঠকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ৫০০ বিজ্ঞানীর এক যৌথ ঘোষণাপত্র অনুযায়ী মানুষের কর্মকা- (যেমন ভূমিধস, দূষণ, নদী খনন ইত্যাদি) বিশুদ্ধ পানির সরবরাহে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।

নদীর পাশাপাশি ভূ-গর্ভস্থ স্তরের পানিও মানবসৃষ্ট কারণে দূষিত হচ্ছে। এ যৌথ ঘোষণাপত্রে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করেছেন, আগামী এক বা দুই প্রজন্মের মধ্যেই বিশ্বের ৯০০ কোটি মানুষের অধিকংশই বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটের মধ্যে জীবনযাপন করবে। ডাব্লিওএইচও এবং ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে ৭৮৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ মৌলিক অধিকার হিসেবে পানি সেবা পায় না এবং ৮৮৪ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ নিরাপদ পানি পান করতে পারছে না। এ প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রায় ১.৬ বিলিয়ন মানুষকে নিরাপদ পানি ছাড়াই জীবনযাপন করতে হবে।

পানিতে আর্সেনিকের আধিক্য পানির প্রাপ্যতাকে আরও দুর্লভ করেছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৬১টি জেলার নলকূপের পানিতে আর্সেনিক রয়েছে। বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ২৯ মিলিয়ন মানুষ আর্সেনিকের ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের খুলনা-বাগেরহাট উপকূলীয় এলাকার ৭৩ শতাংশ মানুষের কাছে নিরাপদ খাবার পানি পৌঁছায় না। এই এলাকার মানুষ প্রতি লিটার পানির সঙ্গে গড়ে ১৪২৭-২৪০৬ মিলিগ্রাম লবণাক্ত পানি গ্রহণ করছে, যেখানে গ্রহণযোগ্য মাত্রা প্রতি লিটারে ১০০০ মিলিগ্রাম।

বিশুদ্ধ পানি প্রপ্তির ক্ষেত্রে স্যানিটেশন সুবিধা না থাকাও একটি বড় সমস্যা। বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক গবেষণা মতে, দেশের পাইপলাইনের পানির ৮০ ভাগেই ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া রয়েছে। পুকুরের পানিতেও একই মাত্রায় এ ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ৩৮ শতাংশ টিউবওয়েলের পানিতেও এ ক্ষতিকর অণুজীবের অস্তিত্ব মিলেছে। ঢাকায় মাত্র ২০ ভাগ পৃথক সুয়ারেজ পাইপলাইন রয়েছে আর বাকিটা খোলা। সারাদেশে পয়ঃবর্জ্যরে মাত্র ২ ভাগ ট্রিটমেন্ট করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে বাকি বর্জ্য মূলত পানিতেই মিশে যাচ্ছে। গৃহস্থালির অপরিশোধিত পয়ঃবর্জ্য ছাড়াও ঢাকার নদীগুলোতে প্রতিদিন ৬০ মিলিয়ন লিটার অপরিশোধিত শিল্প বর্জ্য নদীর পানি দূষিত করছে।

সরকার পানিবিষয়ক বিভিন্ন সমস্যা যথাÑ বন্যা, অতিবন্যা, আকস্মিক বন্যা, নদী ভাঙন, নাব্য হ্রাস, শুকনো মৌসুমে পানির দু®প্রাপ্যতা, খরা, সুপেয় পানির আধার ভরাট, অবৈধ দখল ও দূষণ, জলাবদ্ধতা, ভূ-গর্ভস্থ পানির আশঙ্কাজনক হ্রাস ও দূষণ, সুপেয় পানির দু®প্রাপ্যতা এবং অর্থনীতি ও জনসংখ্যার কারণে পানির ঊর্ধ্বমুখী চাহিদা ইত্যাদির আলোকে জাতীয় পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা হালনাগাদকরণ ও বাস্তবায়ন করা দরকার।

জলাশয়ের প্রতিবেশ ব্যবস্থা রক্ষার্থে পানির সর্বনিম্ন প্রবাহমাত্রা এবং মানমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। জলাশয়ের প্রবাহে বাধার সৃষ্টি করে এমন সব প্রকল্প পরিহার ও বাধা সৃষ্টিকারী স্থাপনা অপসারণ করা দরকার। পানি দূষণের উৎস চিহ্নিত করা ও তা নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। হাওর, বাঁওড়, বিল ইত্যাদি বৈচিত্র্যময় জলাশয় রক্ষায় গৃহীত পরিকল্পনা সময়োপযোগীকরণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।

পানি সরবরাহে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমানো এবং বিশেষত পানি সংকটাপন্ন এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ পানি আহরণের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা দরকার। সীমিত পানি সম্পদের সংরক্ষণ ও সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করিতে প্রয়োজনীয় গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা এবং গবেষণালব্ধ ফলের ভিত্তিতে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। আর্সেনিক দূষণের বিস্তার এবং লবণাক্ততারোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সব ক্ষেত্রে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে পানি বিষয়ে জনগণের প্রথাগত অধিকার এবং ন্যূনতম পানি প্রাপ্যতার অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে। পানি সংকট নিরসনে রাষ্ট্রীয়, আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক সম্মিলিত প্রচেষ্টার পাশাপাশি পানি সংরক্ষণ এবং অপচয় রোধ জরুরি। ভবিষ্যৎ প্রজš§কে পানি সংকট হুমকি থেকে রক্ষায় জনসচেতনতা সৃষ্টির বিকল্প নেই। প্রত্যেককে নিজ অবস্থান থেকে পানি অপচয় রোধে এগিয়ে আসতে হবে।

[লেখক: প্রাবন্ধিক]

মঙ্গলবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ , ৫ আশ্বিন ১৪৩০, ০৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫

বাড়ছে সুপেয় পানির সংকট

তারিক আহম্মদ

পৃথিবীতে ৪৫টির মতো দেশ রয়েছে, যাদের নিজস্ব সমুদ্রবন্দর বা নদী নেই। এই স্থলবেষ্টিত দেশগুলোয় সুপেয় পানির পাশাপাশি রয়েছে জলপথের তীব্র সংকট। রাজধানী ঢাকা এ সংকট থেকে মুক্ত নয়। পৃথিবীর মোট পানির ৯৭.৫ শতাংশ পান করার অযোগ্য। মিষ্টি পানির পরিমাণ মাত্র আড়াই শতাংশ, তার মধ্যে ০.৩ ভাগ পানি থাকে নদ-নদী, খাল-বিল ও পুকুরে। পৃথিবীতে এত পানি থাকতেও পানি যেন আমাদের জন্য ক্রমেই দুর্লভ ও ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। দক্ষিণ আফ্রিকার অধিকাংশ দেশে পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। মরক্কোর নারীরা প্রতিদিন প্রায় তিন ঘণ্টার পথ অতিক্রম করে পানি সংগ্রহ করে চাহিদা পূরণ করছে। সেখানে কুয়াশাকে কাজে লাগিয়ে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে শুকিয়ে আসছে ফোরাত নদী, আড়ল হ্রদ এবং চাঁদ হ্রদ। একদিকে, সুপেয় পানি কমে আসছে, অন্যদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে চাহিদা বাড়ছে।

ধারণা করা হচ্ছে, বিশ্বে পানি সংকট সমাধান না করতে ব্যর্থ হলে সুপেয় পানির জন্য তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ বাধার আশঙ্কা রয়েছে। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলেছে, নদীমাতৃক দেশ বলে খ্যাত বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৩৩ শতাংশ সুপেয় পানির জন্য হাহাকার করছে। সুপেয় পানি হতে বঞ্চিত তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। পরিবেশবাদী সংগঠন বাপার গবেষণায় উঠে এসেছে, ঢাকায় পানির স্তর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭০ ফুট নিচে নেমে গেছে। রাজশাহীতে ১৮ থেকে ১৯ ফুট। মহানগরীতে ২ কোটি লোকের বসবাস এবং চাহিদামতো প্রতিদিন প্রায় ২৩৫ কোটি লিটার পানির প্রয়োজন। কিন্তু চাহিদা অনুসারে তা উৎপাদন হচ্ছে না। প্রতিদিন ঢাকা মহানগরে ২০০০ জনসংখ্যা যোগ হচ্ছে। যে কারণে প্রতিদিন ২০ কোটি লিটার পানির ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গড়ে একজন মানুষ প্রতিদিন ২ থেকে ৪ লিটার পানি পান করে। প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার ছাড়াও ঢাকা শহরে প্রায় ৩০ কোটি লিটার পানি অপচয় করা হয়। ফলে ভাটির দেশ বাংলাদেশে অসংখ্য নদী পানির অভাবে মারা গেছে। অন্যদিকে রাজধানীর চারপাশে থাকা বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু চারটি নদীই দূষণ ও দখলের শিকার। দেশে নব্বই দশকে ৮০ শতাংশ সেচের উৎস ছিল নদ-নদী, যা বর্তমানে ২০ শতাংশ এসে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্বের মোট পানির মাত্র ১% সুপেয় পানি, যার ৯৯% আসে ভূ-গর্ভস্থ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা থেকে। মনুষ্যসৃষ্ট বিবিধ কারণে বিশ্ব আজ মারাত্মক সুপেয় পানির সংকটে। জাতিসংঘের সহযোগী বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডাব্লিউএমও) ‘স্টেট অব গ্লোবাল ওয়াটার রিসোর্সেস-২০২১’ প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩৬০ কোটি মানুষ সুপেয় পানির সংকটে ভুগছে। তারা বছরে অন্তত এক মাস এ ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। এ প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০৫০ সাল নাগাদ পানি সংকটে ভুগতে পারে বিশ্বের ৫০০ কোটি মানুষ। জার্মানির বন শহরে অনুষ্ঠিত ‘গ্লোবাল ওয়াটার সিস্টেম প্রজেক্ট’ শীর্ষক এক বৈঠকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ৫০০ বিজ্ঞানীর এক যৌথ ঘোষণাপত্র অনুযায়ী মানুষের কর্মকা- (যেমন ভূমিধস, দূষণ, নদী খনন ইত্যাদি) বিশুদ্ধ পানির সরবরাহে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।

নদীর পাশাপাশি ভূ-গর্ভস্থ স্তরের পানিও মানবসৃষ্ট কারণে দূষিত হচ্ছে। এ যৌথ ঘোষণাপত্রে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করেছেন, আগামী এক বা দুই প্রজন্মের মধ্যেই বিশ্বের ৯০০ কোটি মানুষের অধিকংশই বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটের মধ্যে জীবনযাপন করবে। ডাব্লিওএইচও এবং ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে ৭৮৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ মৌলিক অধিকার হিসেবে পানি সেবা পায় না এবং ৮৮৪ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ নিরাপদ পানি পান করতে পারছে না। এ প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রায় ১.৬ বিলিয়ন মানুষকে নিরাপদ পানি ছাড়াই জীবনযাপন করতে হবে।

পানিতে আর্সেনিকের আধিক্য পানির প্রাপ্যতাকে আরও দুর্লভ করেছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৬১টি জেলার নলকূপের পানিতে আর্সেনিক রয়েছে। বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ২৯ মিলিয়ন মানুষ আর্সেনিকের ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের খুলনা-বাগেরহাট উপকূলীয় এলাকার ৭৩ শতাংশ মানুষের কাছে নিরাপদ খাবার পানি পৌঁছায় না। এই এলাকার মানুষ প্রতি লিটার পানির সঙ্গে গড়ে ১৪২৭-২৪০৬ মিলিগ্রাম লবণাক্ত পানি গ্রহণ করছে, যেখানে গ্রহণযোগ্য মাত্রা প্রতি লিটারে ১০০০ মিলিগ্রাম।

বিশুদ্ধ পানি প্রপ্তির ক্ষেত্রে স্যানিটেশন সুবিধা না থাকাও একটি বড় সমস্যা। বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক গবেষণা মতে, দেশের পাইপলাইনের পানির ৮০ ভাগেই ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া রয়েছে। পুকুরের পানিতেও একই মাত্রায় এ ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ৩৮ শতাংশ টিউবওয়েলের পানিতেও এ ক্ষতিকর অণুজীবের অস্তিত্ব মিলেছে। ঢাকায় মাত্র ২০ ভাগ পৃথক সুয়ারেজ পাইপলাইন রয়েছে আর বাকিটা খোলা। সারাদেশে পয়ঃবর্জ্যরে মাত্র ২ ভাগ ট্রিটমেন্ট করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে বাকি বর্জ্য মূলত পানিতেই মিশে যাচ্ছে। গৃহস্থালির অপরিশোধিত পয়ঃবর্জ্য ছাড়াও ঢাকার নদীগুলোতে প্রতিদিন ৬০ মিলিয়ন লিটার অপরিশোধিত শিল্প বর্জ্য নদীর পানি দূষিত করছে।

সরকার পানিবিষয়ক বিভিন্ন সমস্যা যথাÑ বন্যা, অতিবন্যা, আকস্মিক বন্যা, নদী ভাঙন, নাব্য হ্রাস, শুকনো মৌসুমে পানির দু®প্রাপ্যতা, খরা, সুপেয় পানির আধার ভরাট, অবৈধ দখল ও দূষণ, জলাবদ্ধতা, ভূ-গর্ভস্থ পানির আশঙ্কাজনক হ্রাস ও দূষণ, সুপেয় পানির দু®প্রাপ্যতা এবং অর্থনীতি ও জনসংখ্যার কারণে পানির ঊর্ধ্বমুখী চাহিদা ইত্যাদির আলোকে জাতীয় পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা হালনাগাদকরণ ও বাস্তবায়ন করা দরকার।

জলাশয়ের প্রতিবেশ ব্যবস্থা রক্ষার্থে পানির সর্বনিম্ন প্রবাহমাত্রা এবং মানমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। জলাশয়ের প্রবাহে বাধার সৃষ্টি করে এমন সব প্রকল্প পরিহার ও বাধা সৃষ্টিকারী স্থাপনা অপসারণ করা দরকার। পানি দূষণের উৎস চিহ্নিত করা ও তা নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। হাওর, বাঁওড়, বিল ইত্যাদি বৈচিত্র্যময় জলাশয় রক্ষায় গৃহীত পরিকল্পনা সময়োপযোগীকরণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।

পানি সরবরাহে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমানো এবং বিশেষত পানি সংকটাপন্ন এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ পানি আহরণের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা দরকার। সীমিত পানি সম্পদের সংরক্ষণ ও সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করিতে প্রয়োজনীয় গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা এবং গবেষণালব্ধ ফলের ভিত্তিতে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। আর্সেনিক দূষণের বিস্তার এবং লবণাক্ততারোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সব ক্ষেত্রে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে পানি বিষয়ে জনগণের প্রথাগত অধিকার এবং ন্যূনতম পানি প্রাপ্যতার অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে। পানি সংকট নিরসনে রাষ্ট্রীয়, আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক সম্মিলিত প্রচেষ্টার পাশাপাশি পানি সংরক্ষণ এবং অপচয় রোধ জরুরি। ভবিষ্যৎ প্রজš§কে পানি সংকট হুমকি থেকে রক্ষায় জনসচেতনতা সৃষ্টির বিকল্প নেই। প্রত্যেককে নিজ অবস্থান থেকে পানি অপচয় রোধে এগিয়ে আসতে হবে।

[লেখক: প্রাবন্ধিক]