সর্পদংশন সচেতনতা দিবস

খন রঞ্জন রায়

সারা বিশ্বে প্রতি চার মিনিটে একজনের মৃত্যু হয় সাপের কামড়ে। বড় অদ্ভুত এই তথ্য। জীবনের সঙ্গে গোপনীয় সুড়ঙ্গ তৈরি করে রেখেছে এই তথ্য। এই বেদনাকে ফুটিয়ে তুলতে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে গবেষণা চালিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে সারা বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৫০ লাখ মানুষ সাপের বিষে আক্রান্ত হয়; মারা যায় ১ লাখ থেকে দেড় লাখ মানুষ।

বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৮ লক্ষাধিক মানুষ সর্পদংশনে আক্রান্ত হয়। বেদনার বড় রূপক হিসাবে ৬ হাজারের বেশি মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বিষধর ৭ প্রজাতির সাপ তাদের বিষক্রিয়ার প্রতিভার অমোখ বিচ্ছুরণ ঘটায়। তিরস্কার ভর্ৎসনার মুখোমুখি হয়ে আরো ৮০ প্রজাতির সাপ বাংলাদেশের আনাচে-কানাছে ঘুরে বেড়ায়। সাপের প্রতি আবেগের তোড়ে দিশাহারা হয়ে আরো ১৩-১৪ প্রজাতির সরিসৃপকে মানুষ সাপ বলে বিশ্বাস করে। ছোট ছোট প্লটে জীবনের প্রতিচ্ছবি জমিয়ে আরো ২৩ প্রজাতির সাপ বাংলাদেশের সমুদ্রসীমাকে সাপঙ্কিত করেছে। এরা সব ভয়ঙ্কর-বিষাক্ত-বিষধর হিসাবে চিহ্নিত।

বাংলাদেশে সাপ প্রজাতিতে ‘রেড কোরাল কুকরি সাপ’ সর্বশেষ সংযোজন হলেও এক চতুর্থাংশ সাপই সম্পূর্ণ নির্বিষ। এর মধ্যে মানুষের কোন ক্ষতি হয় না এমন কিছু মৃদু বিষধর বা অবিষধর অনিন্দসুন্দর সাপ দাঁড়াশ। বাংলাদেশের সর্বত্র পাওয়া যাওয়া খুবই নিরীহ এই সাপ সম্পর্কে সমাজ বেশ ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে। গায়ের রঙের সঙ্গে আকারে-প্রকারে কিছুটা মিল থাকায় অনেকে গোখরা ভেবে ভুল করে। পিটিয়ে মারে। দেহ সরু ও লেজের প্রান্ত ভাগ সুচালো বলে সম্পূর্ণ অবাস্তব একটি ধারণা কাজ করে যে এই সাপের লেজের কাটা লাগলে সেই জায়গা পচন ধরে। মিথ্যা এই ধারণা লালন করে কৃষকের মাঠের ইঁদুর খাওয়া এই সাপ সহানুভূতি ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়।

কৃষি পরিসংখ্যানের তথ্যে জানা যায় দেশে প্রতি বছর এক হাজার কোটি টাকার ফসল নষ্ট করে ইঁদুর। প্রাকৃতিকভাবে এই দাঁড়াশের বংশবিস্তার করা গেলে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে রক্ষা করা যেত। সাপ স্বেচ্ছায় মানুষকে দংশন করে না। কেবলমাত্র আত্মরক্ষার তাগিদে কিংবা উত্যক্ত করলে কামড়ে দেয়। সাপের কাছে না ঘেঁষাই বাঞ্ছনীয়। একান্তই যদি হৃদয়ের উত্তাপ নিয়ে কামড় বসিয়ে দেয় তাতেও ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। বেশির ভাগ সাপ অবিষধর; তাৎক্ষণিকভাবে দুঃখ মোচনে কিছু প্রয়োজনীয় কাজ করতে হবে। দংশিত অঙ্গ বিশ্রামে রাখতে হয়। পায়ে হলে হাঁটাহাঁটি নিষেধ। হাতে হলে নাড়াচাড়া বন্ধ। রক্তপাত বন্ধে স্বাভাবিক ভাঙার মতো, কাঠ ব্যান্ডেজ দিয়ে হালকা বাঁধা। সুঁই ফোটানো কিংবা মলম, ছাই, লতাপাতার প্রলেপ না দেয়া। ওঝা-বৈদ্য, ঝাড়ফুঁক পরিহার করে দ্রুততম সময়ে নিকটস্থ হাসপাতালে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা।

সাধারণভাবে কিছু নির্দেশনা ও লক্ষ্মণ জানা থাকলে মানুষের অজ্ঞতা দূর করতে সাহায্য করে। বিষাক্ত সর্পদংশনের বিশেষ কিছু লক্ষ্মণ থাকে। দংশিত স্থানের চামড়ার রঙ পরিবর্তন, কালচে হওয়া, ব্যথা, দ্রুত ফুলে যাওয়া, ফোস্কা পড়া, ক্রমাগত রক্তপাত হতে পারে। চোখের উপরের পাতা ভারী হয়ে ঘুম ঘুম ভাব হলে, অস্বাভাবিক দুর্বলতা বোধ করলে, চোখে ঝাপসা ও একজিনিস একাধিক দেখা গেলে, চোখ নাড়াচাড়া করতে না পারা, জিহবা জড়িয়ে আসা, ঢোক গিলতে অসুবিধা, হাত-পা অবশ হয়ে হাঁটতে অসুবিধা লাগা। শ্বাস-প্রশ্বাস আটকে যাওয়া, কখনো শরীর নীল হয়ে যাওয়া, প্র¯্রাবের রঙ কালো হলে বুঝতে হবে বিষাক্ত সাপের ছোবলে পড়েছে। সৎকিঞ্চিত কালবিলম্ব না করে নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে প্রেরণ করতে হবে। কবিরাজি, বনাজী, হোমিওপ্যাথি কিংবা অ্যান্টিহিস্টামিন, স্টেরয়েড, সিডেটিভ, অ্যাসপিরিন, কিংবা ব্যথা নিরাময়কারী নানা ওষুধের রঙিন চক্রজালে আটকা রাখা যাবে না।

গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে সাপের কামড়ে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ চিকিৎসকের দ্বারস্থ হয়। বাকিরা ছোটে ওঝার কাছে। বিষ-নির্বিষ নির্বিশেষে একই পরিণতি। বেশির ভাগ সাপই নির্বিষ থাকায় ক্ষেত্র বিশেষে ওঝার কেরামতি বলে ভারা হয়। বিষধর সাপের কামড় হলে গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট করলে রোগীর স্নায়ুতন্ত্রের বিষক্রিয়া শুরু হয়। কখনো বা দুঃখজনকভাবে অনন্তলোকের এক অনিঃশেষ যাত্রার সাথী হয়। অথচ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন দিতে পারলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগী সুস্থ জীবনে ফিরে যেতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মোতাবেক অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে অ্যান্টিভেনম তৈরির কাজ এগিয়ে চলেছে। ২০১৮ সালে গৃহীত এই প্রকল্প ৫ বছর মেয়াদি হলেও পরবর্তীতে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োমেডিক্যাল টেকনোলজি বিভাগ এই কাজে সম্পৃক্ত হয়। আশা করা হচ্ছে বিশাল এই গবেষণাকা-ের ফলে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রায় গৃহীত ২০৩০ সালের মধ্যে সাপে কাটা রোগী অর্ধেকে কমিয়ে আনার অঙ্গীকার যথাযথভাবে পূরণ করা যাবে। এরপরও সাপের কামড় থেকে রক্ষা পাওয়া জন্য নিজেরা সচেতন হতে হবে। সাবধানী হতে হবে। বিশেষ করে গ্রামীণ সাপ উপদ্রত এলাকার জনসাধারণকে সাপের কামড়ের ব্যাপারে চিন্তার ঐক্য দেখাতে হবে। বসতবাড়ি, শোবার ঘরে সাপের আকর্ষণ বেশি হয়। বিশেষ করে ইঁদুর, তেলাপোকা, ঘাসফড়িংয়ের উৎপাত বন্ধ করতে হবে। ঝোপঝাড়ের ভেতর হাঁটতে সাবধানে-সচেতনে হাঁটতে হবে। কোন গর্তে হাত ঢোকানো যাবে না। বাড়ি-ঘর, উঠান, জঙ্গলে জমানো লাকড়ি, খড় ইত্যাদি সাবধানে নাড়াচাড়া করতে হবে। মাছ ধরার চাঁই বা জালের মধ্যে নিশ্চিত হয়ে হাত ঢোকানো। বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার করা আর চাষের জমির মধ্যে দূরত্ব রাখা। ময়লা-আবর্জনা সাপের বসবাসে উপযুক্ত স্থান; তা পরিহার করে পরিচ্ছন্ন করতে হবে।

বেশির ভাগ সাপ রাতে খাদ্য সংগ্রহে চলফেরা করে। পর্যাপ্ত আলো জ্বালিয়ে জোড়া পায়ের শব্দ করে চলাফেরা করা প্রয়োজন। সাপ বায়বীয় শব্দে বধির কিন্তু ভূ-গর্ভস্থ কম্পনের প্রতি অধিক সংবেদনশীল। এই বিষয়টিও মাথায় রাখা বাঞ্ছনীয়। সাপ নিয়ে মানুষের ভীতি, আতঙ্ক, উচ্ছ্বাস, কৌতূহল গোটা জগৎজুড়ে। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে নাগ-নাগিনির কাহিনী, গল্প, সাহিত্য-সিনেমায়, শ্রুতিকথায় মানুষের মন-মননে সাপাতঙ্ক গেঁড়ে বসে থাকে। সাপে মানুষে যেন পারস্পরিক বোঝাপড়ায় সম্পর্ক তৈরি হয় সেই লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে।

সাপের কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা কৌশল জানার জন্যই আন্তর্জাতিকভাবে পালন করা হয় সর্পদংশন সচেতনতা দিবস। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশে মার্তৃমৃত্যু অপেক্ষা সাপে কামড়ে মৃত্যুর হার বেশি। এই উদ্বেগজনক তথ্য নিয়ে ২০১৮ সাল থেকে পালন শুরু করা হয় এই দিবস। সর্পদংশনের সচেতনতা বোধোদয়ের মধ্য দিয়ে অবহেলিত এই ট্যাপিক্যাল রোগের প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে উঠবে। এই দিবসের রঙিন আলোকছটায় নতুন করে জীবনোপলব্ধি ঘটবে-এমন প্রত্যাশার অনন্ত হিসাব করছি।

[লেখক: সমাজকর্মী]

মঙ্গলবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ , ৫ আশ্বিন ১৪৩০, ০৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫

সর্পদংশন সচেতনতা দিবস

খন রঞ্জন রায়

সারা বিশ্বে প্রতি চার মিনিটে একজনের মৃত্যু হয় সাপের কামড়ে। বড় অদ্ভুত এই তথ্য। জীবনের সঙ্গে গোপনীয় সুড়ঙ্গ তৈরি করে রেখেছে এই তথ্য। এই বেদনাকে ফুটিয়ে তুলতে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে গবেষণা চালিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে সারা বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৫০ লাখ মানুষ সাপের বিষে আক্রান্ত হয়; মারা যায় ১ লাখ থেকে দেড় লাখ মানুষ।

বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৮ লক্ষাধিক মানুষ সর্পদংশনে আক্রান্ত হয়। বেদনার বড় রূপক হিসাবে ৬ হাজারের বেশি মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বিষধর ৭ প্রজাতির সাপ তাদের বিষক্রিয়ার প্রতিভার অমোখ বিচ্ছুরণ ঘটায়। তিরস্কার ভর্ৎসনার মুখোমুখি হয়ে আরো ৮০ প্রজাতির সাপ বাংলাদেশের আনাচে-কানাছে ঘুরে বেড়ায়। সাপের প্রতি আবেগের তোড়ে দিশাহারা হয়ে আরো ১৩-১৪ প্রজাতির সরিসৃপকে মানুষ সাপ বলে বিশ্বাস করে। ছোট ছোট প্লটে জীবনের প্রতিচ্ছবি জমিয়ে আরো ২৩ প্রজাতির সাপ বাংলাদেশের সমুদ্রসীমাকে সাপঙ্কিত করেছে। এরা সব ভয়ঙ্কর-বিষাক্ত-বিষধর হিসাবে চিহ্নিত।

বাংলাদেশে সাপ প্রজাতিতে ‘রেড কোরাল কুকরি সাপ’ সর্বশেষ সংযোজন হলেও এক চতুর্থাংশ সাপই সম্পূর্ণ নির্বিষ। এর মধ্যে মানুষের কোন ক্ষতি হয় না এমন কিছু মৃদু বিষধর বা অবিষধর অনিন্দসুন্দর সাপ দাঁড়াশ। বাংলাদেশের সর্বত্র পাওয়া যাওয়া খুবই নিরীহ এই সাপ সম্পর্কে সমাজ বেশ ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে। গায়ের রঙের সঙ্গে আকারে-প্রকারে কিছুটা মিল থাকায় অনেকে গোখরা ভেবে ভুল করে। পিটিয়ে মারে। দেহ সরু ও লেজের প্রান্ত ভাগ সুচালো বলে সম্পূর্ণ অবাস্তব একটি ধারণা কাজ করে যে এই সাপের লেজের কাটা লাগলে সেই জায়গা পচন ধরে। মিথ্যা এই ধারণা লালন করে কৃষকের মাঠের ইঁদুর খাওয়া এই সাপ সহানুভূতি ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়।

কৃষি পরিসংখ্যানের তথ্যে জানা যায় দেশে প্রতি বছর এক হাজার কোটি টাকার ফসল নষ্ট করে ইঁদুর। প্রাকৃতিকভাবে এই দাঁড়াশের বংশবিস্তার করা গেলে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে রক্ষা করা যেত। সাপ স্বেচ্ছায় মানুষকে দংশন করে না। কেবলমাত্র আত্মরক্ষার তাগিদে কিংবা উত্যক্ত করলে কামড়ে দেয়। সাপের কাছে না ঘেঁষাই বাঞ্ছনীয়। একান্তই যদি হৃদয়ের উত্তাপ নিয়ে কামড় বসিয়ে দেয় তাতেও ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। বেশির ভাগ সাপ অবিষধর; তাৎক্ষণিকভাবে দুঃখ মোচনে কিছু প্রয়োজনীয় কাজ করতে হবে। দংশিত অঙ্গ বিশ্রামে রাখতে হয়। পায়ে হলে হাঁটাহাঁটি নিষেধ। হাতে হলে নাড়াচাড়া বন্ধ। রক্তপাত বন্ধে স্বাভাবিক ভাঙার মতো, কাঠ ব্যান্ডেজ দিয়ে হালকা বাঁধা। সুঁই ফোটানো কিংবা মলম, ছাই, লতাপাতার প্রলেপ না দেয়া। ওঝা-বৈদ্য, ঝাড়ফুঁক পরিহার করে দ্রুততম সময়ে নিকটস্থ হাসপাতালে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা।

সাধারণভাবে কিছু নির্দেশনা ও লক্ষ্মণ জানা থাকলে মানুষের অজ্ঞতা দূর করতে সাহায্য করে। বিষাক্ত সর্পদংশনের বিশেষ কিছু লক্ষ্মণ থাকে। দংশিত স্থানের চামড়ার রঙ পরিবর্তন, কালচে হওয়া, ব্যথা, দ্রুত ফুলে যাওয়া, ফোস্কা পড়া, ক্রমাগত রক্তপাত হতে পারে। চোখের উপরের পাতা ভারী হয়ে ঘুম ঘুম ভাব হলে, অস্বাভাবিক দুর্বলতা বোধ করলে, চোখে ঝাপসা ও একজিনিস একাধিক দেখা গেলে, চোখ নাড়াচাড়া করতে না পারা, জিহবা জড়িয়ে আসা, ঢোক গিলতে অসুবিধা, হাত-পা অবশ হয়ে হাঁটতে অসুবিধা লাগা। শ্বাস-প্রশ্বাস আটকে যাওয়া, কখনো শরীর নীল হয়ে যাওয়া, প্র¯্রাবের রঙ কালো হলে বুঝতে হবে বিষাক্ত সাপের ছোবলে পড়েছে। সৎকিঞ্চিত কালবিলম্ব না করে নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে প্রেরণ করতে হবে। কবিরাজি, বনাজী, হোমিওপ্যাথি কিংবা অ্যান্টিহিস্টামিন, স্টেরয়েড, সিডেটিভ, অ্যাসপিরিন, কিংবা ব্যথা নিরাময়কারী নানা ওষুধের রঙিন চক্রজালে আটকা রাখা যাবে না।

গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে সাপের কামড়ে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ চিকিৎসকের দ্বারস্থ হয়। বাকিরা ছোটে ওঝার কাছে। বিষ-নির্বিষ নির্বিশেষে একই পরিণতি। বেশির ভাগ সাপই নির্বিষ থাকায় ক্ষেত্র বিশেষে ওঝার কেরামতি বলে ভারা হয়। বিষধর সাপের কামড় হলে গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট করলে রোগীর স্নায়ুতন্ত্রের বিষক্রিয়া শুরু হয়। কখনো বা দুঃখজনকভাবে অনন্তলোকের এক অনিঃশেষ যাত্রার সাথী হয়। অথচ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন দিতে পারলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগী সুস্থ জীবনে ফিরে যেতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মোতাবেক অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে অ্যান্টিভেনম তৈরির কাজ এগিয়ে চলেছে। ২০১৮ সালে গৃহীত এই প্রকল্প ৫ বছর মেয়াদি হলেও পরবর্তীতে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োমেডিক্যাল টেকনোলজি বিভাগ এই কাজে সম্পৃক্ত হয়। আশা করা হচ্ছে বিশাল এই গবেষণাকা-ের ফলে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রায় গৃহীত ২০৩০ সালের মধ্যে সাপে কাটা রোগী অর্ধেকে কমিয়ে আনার অঙ্গীকার যথাযথভাবে পূরণ করা যাবে। এরপরও সাপের কামড় থেকে রক্ষা পাওয়া জন্য নিজেরা সচেতন হতে হবে। সাবধানী হতে হবে। বিশেষ করে গ্রামীণ সাপ উপদ্রত এলাকার জনসাধারণকে সাপের কামড়ের ব্যাপারে চিন্তার ঐক্য দেখাতে হবে। বসতবাড়ি, শোবার ঘরে সাপের আকর্ষণ বেশি হয়। বিশেষ করে ইঁদুর, তেলাপোকা, ঘাসফড়িংয়ের উৎপাত বন্ধ করতে হবে। ঝোপঝাড়ের ভেতর হাঁটতে সাবধানে-সচেতনে হাঁটতে হবে। কোন গর্তে হাত ঢোকানো যাবে না। বাড়ি-ঘর, উঠান, জঙ্গলে জমানো লাকড়ি, খড় ইত্যাদি সাবধানে নাড়াচাড়া করতে হবে। মাছ ধরার চাঁই বা জালের মধ্যে নিশ্চিত হয়ে হাত ঢোকানো। বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার করা আর চাষের জমির মধ্যে দূরত্ব রাখা। ময়লা-আবর্জনা সাপের বসবাসে উপযুক্ত স্থান; তা পরিহার করে পরিচ্ছন্ন করতে হবে।

বেশির ভাগ সাপ রাতে খাদ্য সংগ্রহে চলফেরা করে। পর্যাপ্ত আলো জ্বালিয়ে জোড়া পায়ের শব্দ করে চলাফেরা করা প্রয়োজন। সাপ বায়বীয় শব্দে বধির কিন্তু ভূ-গর্ভস্থ কম্পনের প্রতি অধিক সংবেদনশীল। এই বিষয়টিও মাথায় রাখা বাঞ্ছনীয়। সাপ নিয়ে মানুষের ভীতি, আতঙ্ক, উচ্ছ্বাস, কৌতূহল গোটা জগৎজুড়ে। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে নাগ-নাগিনির কাহিনী, গল্প, সাহিত্য-সিনেমায়, শ্রুতিকথায় মানুষের মন-মননে সাপাতঙ্ক গেঁড়ে বসে থাকে। সাপে মানুষে যেন পারস্পরিক বোঝাপড়ায় সম্পর্ক তৈরি হয় সেই লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে।

সাপের কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা কৌশল জানার জন্যই আন্তর্জাতিকভাবে পালন করা হয় সর্পদংশন সচেতনতা দিবস। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশে মার্তৃমৃত্যু অপেক্ষা সাপে কামড়ে মৃত্যুর হার বেশি। এই উদ্বেগজনক তথ্য নিয়ে ২০১৮ সাল থেকে পালন শুরু করা হয় এই দিবস। সর্পদংশনের সচেতনতা বোধোদয়ের মধ্য দিয়ে অবহেলিত এই ট্যাপিক্যাল রোগের প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে উঠবে। এই দিবসের রঙিন আলোকছটায় নতুন করে জীবনোপলব্ধি ঘটবে-এমন প্রত্যাশার অনন্ত হিসাব করছি।

[লেখক: সমাজকর্মী]