বিস্মৃতপ্রায় জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন

রকিবুল হাসান

ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন। ১৯৫০ থেকে ১৯৭০-এই সময়কাল বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক। তাঁকে বলা হয় বাংলা সাহিত্যে পঞ্চাশের যুবরাজ। তাঁর উপন্যাস ‘অবাঞ্ছিত’, ‘কি পাইনি’, ‘ঢেউ জাগে’, ‘মোহমুক্তি’, ‘মেঘ বিজলী বাদল’, ‘দুদিনের খেলাঘরে’, ‘নতুন পৃথিবী’, ‘দুষ্টক্ষত’ এবং ‘আভা ও তার প্রথম পুরুষ’। গল্পগ্রন্থ ‘আলোছায়া’। একমাত্র নাটক ‘যৌবনটাই জীবন নয়’।

১৯৪৭-এর দেশভাগের পরে পূর্ববংলায় অর্থাৎ বাংলাদেশে পাঠক তৈরির গুরুত্বপূর্ণ কারিগর ছিলেন ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন। এখানকার পাঠকদের সে-সময়ে পশ্চিমবাংলার লেখকদের বইয়ের প্রতিই বেশি আসক্তি ছিল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো মোহগ্রস্ত হয়ে তারা পশ্চিমবাংলার লেখকদের উপন্যাস পড়তেন। আকবর হোসেনের ‘অবাঞ্ছিত’ উপন্যাস এখানকার পাঠকদের প্রথম সেই মোহচ্যুতি ঘটায়। দেশীয় লেখকদের বইয়ের পাঠকসৃষ্টিতে তিনিই প্রথম অসামান্য কৃতিত্ব দেখাতে সক্ষম হন। তাঁর উপন্যাসগুলো সস্তা বা চটুল ছিল না, প্রত্যেকটি উপন্যাসই সাহিত্যগুণ সমৃদ্ধ। বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষে ক্ষীণকায় আকারের উপন্যাসও সৃষ্টি করেন নি। তিনি সমাজ-সমকাল-রাজনীতি সচেতন ও দায়িত্ববোধ সম্পন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঔপন্যাসিক ছিলেন।

আকবর হোসেনেরপ্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত রচনা নিয়ে তাঁর সাহিত্যকর্ম যদি বিচার-বিশ্লেষণ ও বিবেচনা করা যায় তাহলে নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যে তাঁকে একজন শক্তিমান সব্যসাচী লেখক হিসেবে আবিষ্কার করা সম্ভব। ঔপন্যাসিক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত হলেও তিনি যে একাধারে কবি, গল্পকার, নাট্যকার, গীতিকার, সম্পাদক- তা দীর্ঘসময়েও আবিষ্কৃত হয়নি। তাঁর অপ্রকাশিত রচনাভাণ্ডার প্রকাশ করা সম্ভব হলে আকবর হোসেনের কৃতিত্ব যে আরো অনেক বেড়ে যাবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

আকবর হোসেনের প্রথম উপন্যাস ‘অবাঞ্ছিত’ গত শতকের পঞ্চাশের শুরুতেই প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তখন দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় উপন্যাসটি সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করে পাঠকের দৃষ্টিগোচর করেন। অবশ্য তারও আগে উপন্যাসটি যখন পাইওনিয়র প্রেসে ছাপা হচ্ছিল, তখন খ্যাতিমান-গবেষক অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম প্রিন্টিং প্রেস থেকেই উপন্যাসটি পাঠ করে তার ‘অগত্যা’ পত্রিকায় প্রশংসাসূচক মন্তব্য লেখেন। এতে পাঠকদের উপন্যাসটি সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হয়। দ্রুত সময়ে উপন্যাসটি ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। অশ্চর্যের বিষয়, প্রথমে কেউই উপন্যাসটি প্রকাশ করতে সম্মত হননি। যেকারণে তিনি নিজের বাড়ি বিক্রি করে উপন্যাসটি প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। ‘অবাঞ্ছিত’ প্রায় ঘরে ঘরে পঠিত হওয়ার মর্যাদা লাভ করে। এই উপন্যাস তাঁকে খ্যাতি, ব্যাপক জনপ্রিয়তা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দিয়েছিল। অথচ এই উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল নানা ধরনের নাটকীয়তা। ‘অবাঞ্ছিত’ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি নিয়ে আকবর হোসেন দেখা করেছিলেন সেই সময়ের লব্ধপ্রতিষ্ঠিত অনেক কবি-সাহিত্যকের সঙ্গে। আকবর হোসেনের ‘কিছু কথা’ নামক একটি ব্যক্তিগত নিবন্ধ থেকে জানা যায়, তিনি অবাঞ্ছিত-এর পাণ্ডুলিপি প্রথম নিয়ে যান গোপাল হালদারের কাছে। গোপাল হালদার এক বছর পাণ্ডুলিপিটি নিজের কাছে রেখে দেন। অথচ তিনি তা পড়েও দেখেননি। আজ পড়বো কাল-পড়বো বলে তিনি এই নবীন ঔপন্যাসিককে প্রায় এক বছর ঘুরিয়েছেন। অবশেষে আকবর হোসেন হতাশ হয়ে পাণ্ডুলিপিটি ফেরত নেন। এরপর তিনি এটি নিয়ে বুদ্ধদেব বসু [১৯০৮-১৯৭৪], কাজী আব্দুল ওদুদ [১৮৯৮-১৯৭০], ব্যারিস্টার এস. ওয়াজেদ আলী [১৮৯০-১৯৫১], নারায়ণ গঙ্গোপ্যাধ্যায় [১৯১৮-১৯৭০] ও কবি জসীম উদ্দীন [১৯০৩-১৯৭৬] প্রমুখ প্রখ্যত কবি-সাহিত্যিকদের কাছে ধর্ণা দেন, বইটি সম্পর্কে তাঁদের মতামত গ্রহণের জন্য। দুঃখজনক হলো, তাঁদের কেউই বইটি সম্পর্কে মতামত প্রদান তো দূরে থাক- বইটি পড়েও দেখেননি। আকবর হোসেন তাঁর এই প্রথম লেখাটি প্রকাশিত হবার আগেই এসব খ্যাতিমান লেখকদের মূল্যবান মতামত ও পরামর্শ আশা করেছিলেন। সে-ক্ষেত্রে তিনি সম্পূর্ণভাবে হতাশ হন। খ্যাতিমান সাহিত্যিক ব্যারিস্টার এস. ওয়াজেদ আলী পাণ্ডুলিপিটি না পড়লেও লেখক আকবর হোসেনকে একটি উপদেশ দেন। উপদেশটির অংশবিশেষ উদ্ধৃত হলো: ‘লিখে যাও আরও লিখে যাও। অন্য কারও দ্বারা লেখার মূল্যায়ন করার দরকার হবে না। দীর্ঘদিন ফেলে রেখে হঠাৎ একদিন মনোযোগ দিয়ে নিজের লেখাটি পড়বে। দেখতে পাবে অনেক ভুল-ত্রুটি। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তোমার এগিয়ে যাওয়া মন নিজের লেখার মান বিচার করতে সক্ষম হবে। দু’তিনবার এমনি করে পড়ে নতুনভাবে লিখে নিজেই একদিন সফলতা অর্জন করতে পারবে।’

এস. ওয়াজেদ আলীর এই উপদেশটি ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন তাঁর লেখক জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯৪১ সালে লেখা এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সালে। এই সুদীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে আকবর হোসেন পাণ্ডুলিপিটি অনেকবার পড়েন। সংস্কার করেন দুবার। আর সে কারণেই প্রথম পাণ্ডুলিপির ইন্দ্র, শীলা, মীনাক্ষী ও নরেনকে আমরা ফিরোজ, রোকেয়া, রেখা এবং আমীর হিসেবে পাই। সে-সঙ্গে পরিবর্তন ঘটে কাহিনিরও।

আকবর হোসেন দেশকাল ও সমাজ সচেতন ঔপন্যাসিক ছিলেন। সাহিত্যচর্চায় সামাজিক নানাবিধ সমস্যার পাশাপাশি দেশ-কালও গুরুত্বের সঙ্গে এসেছে। আকবর হোসেনের শিল্পীমানসে ১৯৩৯ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব, ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ, ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ১৯৪৭ সালের দেশ-বিভাগ, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রভাব ফেলে। তাঁর উপন্যাস এসব বিষয় বিভিন্ন আঙ্গিকে নানাভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। গরিব, অসহায়, নির্যাতিত মানুষের কথা তাঁর লেখনিতে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। এদের জীবনযাত্রা, সমস্যা, সংঘাত, প্রেমপ্রণয়, দারিদ্র্য তাঁর উপন্যাসের উপজীব্য হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে। এসব মানুষের মুক্তির উপায় হিসেবে তিনি কখনও সাম্যের কথা বলেছেন, আবার কখনও গণতন্ত্রের কথা বিবেচনা করেছেন। আর এই ‘মুক্তি’ বলতে তিনি একদিকে যেমন শোষকের হাত থেকে শোষিতের মুক্তির কথা বলেছেন, তেমনি বলেছেন অর্থনৈতিক মুক্তির কথাও। আর এ ক্ষেত্রে তিনি আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বড় বাধাস্বরূপ সমস্যাগুলোকেও সূক্ষ্মভাবে চিহ্নিত করেছেন- যা তাঁর প্রকৃত শিল্পীমানসের পরিচয় বহন করে।

আকবর হোসেনগতানুগতিক নামসর্বস্ব লেবাসধারী গণতন্ত্র প্রত্যাশা করেননি। তিনি লক্ষ্য করেছেন, সমাজের একশ্রেণির মানুষ গণতন্ত্রের নামে নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত এবং নিজেদের ‘বিশেষ শ্রেণির’ মানুষ হিসেবে পরিচিত করতে পছন্দ করেন। এ-শ্রেণির মানুষ মুখে সাধারণ মানুষের মুক্তির কথা বললেও বাস্তবেতারা মানসিকভাবে এদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে রাখে। চিন্তাচেতনা-মননে-মানসিকতায় এরা বুর্জোয়া শ্রেণিভুক্ত। সাধারণ মানুষের সঙ্গে এরা কোনোরকম পারিবারিক সম্পর্কের বিষয়টি কল্পনাও করতে পারে না। এদের দম্ভোক্তি ‘আমার অভিজাত রক্তধারায় কোন নিকৃষ্ট রক্ত এসে তরঙ্গ সৃষ্টি করুক তা আমি চাই না’- এ থেকেই তাদের প্রকৃত স্বরূপ নির্ণীত হয়।

অথচ গরিব সাধারণ মানুষের মুক্তির কথা বলে, তাদের বিপদে-আপদে দুর্দিনে পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে, তাদের বন্ধু সেজে এরা ‘নেতা’ হন, উচ্চশ্রেণির মানুষ হন, ক্ষমতাধর ব্যক্তি হন। অভিজাত শ্রেণিভুক্ত হন। আকবর হোসেন ‘ঢেউ জাগে’ ও ‘নতুন পৃথিবী’ উপন্যাসে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে শিল্পিত ভঙ্গিতে ‘নেতা’ নামধারী এসব ভণ্ড ও সুবিধাবাদীদের ছবি এঁকেছেন। তিনি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজমান সমস্যাকে খুঁটে খুঁটে দেখেছেন। নর-নারীর ভালাবাসা এবং শারীরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠা স্বাভাবিক ও প্রকৃতিগত। আমাদের মতো দেশে-সমাজে বিবাহ বহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ক অগ্রহণযোগ্য, অসামাজিক ও অন্যায় হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু অগ্রহণযোগ্য এই সম্পর্ক সমাজচক্ষুর আড়ালে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে, এখনো সে-ধারা অব্যহত। আকবর হোসেন এ বিয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এঁকেছেন ‘অবাঞ্ছিত’ গ্রন্থে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এ সম্পর্কের সবটুকু দায়, লাঞ্ছনা, অপমান নারীকেই গ্রহণ করতে হয়। নারীকেই বহন করতে হয় এ-পাপের চিহ্ন। এ-বিষয়টি আকবর হোসেনের শিল্পীমনকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছিল, ব্যথিত করেছিল। আর এই বোধ থেকেই তিনি ‘অবাঞ্ছিত’ উপন্যাস রচনা করেন। আবার, একই সঙ্গে স্বদেশী আন্দোলনের অসাধারণ চিত্রকল্প আছে উপন্যাসটিতে। চারিত্রিক অধঃপতিত আমিরকে স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত করে আদর্শবান শিক্ষক ও ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে একজন বিপ্লবীতে রূপান্তরিত করে, চারিত্রিক সব ধরনের ত্রুটি থেকে সংশোধিত করে, অনন্য এক চরিত্রে আমীরকে প্রতিষ্ঠিত করে তিনি যে অসামান্য দক্ষতা দেখিয়েছেন তা এককথায় অভিনব। সেই সময়ে বাংলা কথাসাহিত্যে এ ধরনের চরিত্রনির্মাণ করে আকবর হোসেন তাঁর শক্তিমত্তার পরিচয় দেন।যে কারণে সাহিত্যবোদ্ধাদেও কাছে এ উপন্যাস যেমন গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল, একইভাবে পাঠকসমাজেও ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’ ও ‘ঘরে-বাইরে’, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যয়ের ‘পথের দাবী’ ও কাজী নজরুল ইসলামের ‘কুহেলিকা’ উপন্যাসে স্বদেশী আন্দোলনের বার্তা ও কাহিনী বিধৃত আছে। আকবর হোসেন তাঁদের উত্তরসূরি হয়েও তাঁর উপন্যাসে স্বদেশী আন্দোলনের চিত্র উপস্থাপন করেছেন ভিন্নআঙ্গিকে। তখন শুধু স্বদেশী আন্দোলন এমনভাবে বিস্তার ঘটেছিল, সেই আন্দোলনে শুধু যে নীতি-আদর্শবান যুবকরাই যুক্ত হয়েছিল তা নয়। চারিত্রিক স্খলনঘটা তরুণরাও নিজেদেও সংশোধন করে নিয়ে স্বদেশি আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল, ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে। আকবর হোসেনের উপন্যাসে এ ধরনের চরিত্র নির্মাণ প্রথম পরিলক্ষিত হয়।

গ্রামের গরিব মানুষদের সরলতা ও অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির অর্থপিশাচ স্বার্থন্বেষীরা যে প্রভাব বিস্তার করে এবং ‘সে সঙ্গে নগরজীবনের আওতায় উলঙ্গ’ সভ্যতার অনুকরণে শিক্ষিত সমাজ ভ্রান্ত প্রগতিকে ধারণ করে কতটা অধঃপতনের শিকার ‘কি পাইনি’ গ্রন্থের মূল উপজীব্য এটি। জমিদারের অত্যাচারের চিত্রও তিনি তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে এঁকেছেন। ‘অবাঞ্ছিত’ গ্রন্থে জমিদারের অত্যাচারে রোকেয়ার জীবন শুধু দুর্বিসহই হয়ে ওঠেনি, তাকে রাতের অন্ধকারে চিরদিনের জন্যে চলে যেতে হয়েছিল ভিটা-মাটি ত্যাগ করে। ‘ঢেউ জাগে’ গ্রন্থে জমিদার এনায়েত খানের অত্যাচার-নিপীড়ন-নির্যাতনে প্রতিবাদী ওমর মাস্টারের মৃত্যু ঘটে। তার সুন্দরী স্ত্রী রাঙাবউ জমিদার কর্তৃক বিভিন্নবাবে লাঞ্ছিত হয়েছে, অপমানিত হয়েছে। গ্রামের সহজ সরল সুন্দরী নারীরা জমিদারের লোলুপ-লালসার শিকার হয়েছে, সাধারণ মানুষের জীবন এদের নির্মম অত্যাচারে বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছিল- আকবর হোসনে তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে দক্ষ শিল্পীর মতো জমিদারদের প্রকৃতস্বরূপ শিল্পিত আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন। এক্ষেত্রে আকবর হোসেনের মধ্যে সমাজ-সচেতন এক শিল্পীসত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু একটি বিষয় লক্ষ্য করা যায়, আকবর হোসেন তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে জমিদারদের অত্যাচার, দখল-দারিত্ম্য, নারী-লোলুপতা নিয়ে কথা বলেছেন, এদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। কিন্তু তিনি তাঁর কোনো উপন্যাসেই জমিদারি-প্রথা নিয়ে কোনো কথা বলেন নি।

আকবর হোসেন দেশ-কাল সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে এর স্বাক্ষর রয়েছে। আকবর হোসেনের সাহিত্যকাল ছিল মূলত চল্লিশের দশকের শুরু থেকে মধ্য সত্তর দশক পর্যন্ত। তিনি তাঁর বিভিন্ন লেখনীতে এই সময়-কাল ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এই উপমহাদেশে দীর্ঘকাল থেকে চলে আসছে। ১৭৩০ সালের মোগল সম্রাট ফররুখ শিয়রের রাজত্বকালে ছেলেখেলা উপলক্ষে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচুর রক্তক্ষয় হয়েছিল। এই দুই সম্প্রদায়ের দাঙ্গা এরপরও বিভিন্নভাবে সংঘটিত হয়েছে। আকবর হোসেনের মোহমুক্তি উপন্যাসে ১৯৪৬ সালে কলকাতায় সংঘটিত দাঙ্গার ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যায়। বিভাগ-পূর্বকালের একটি উল্লেখযোগ্য প্রসঙ্গ ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষের। দুর্ভিক্ষের ইতিহাস এ উপমহাদেশে অনেক পুরনো। ১১৭৬ বঙ্গব্দের মন্বন্তর থেকে ১৩৫০ সাল পর্যন্ত এই উপমহাদেশে অনেকবার দুর্ভিক্ষ ঘটেছে। প্রতিবারই দুর্ভিক্ষে উপমহাদেশের অসংখ্য লোক মৃত্যুর শিকার হয়েছে। ক্ষুধা-দারিদ্রের শিকার হয়েছে। কিন্তু এসব দুর্ভিক্ষের পুরোটাই প্রকৃতিগত ছিল না, কৃত্রিমভাবেও তৈরি করা হয়েছিল। ধনিকশ্রেণি ও শাসকগোষ্ঠী যোগসাজশে নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে কৃত্রিমভাবে প্রাকৃতিক দুর্ভিক্ষকে আরও ভয়াবহ করে তোলে, মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করে, সাধারণ মানুষের জীবনের থেকে ব্যক্তিস্বার্থ এদের কাছে বড়। যা বর্তমান সময়েও পরিলক্ষিত হয়। ‘ঢেউ জাগে’ উপন্যাসে দুর্ভিক্ষে সন্তান-সন্ততি হারানো অসহায় এক নারী হাসি কৃত্রিমভাবে দুর্ভিক্ষ তৈরিকারী ভণ্ড নেতাদের উদ্দেশে আর্তনাদ করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে, ‘দেশের এ সর্বনাশের জন্য কে দায়ী? লক্ষ লক্ষ মানুষের দুর্গতির মূলে কে? কোন নরাধম মানুষের সংসার জীবনে দিয়েছে বিষকাঁটা ছড়িয়ে?’

১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের মর্মন্তুদ চিত্র ‘মোহমুক্তি’ উপন্যাসে উপস্থাপিত হয়েছে এভাবে: ‘১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ। লক্ষ লক্ষ মানুষ কলকাতার বুকে অনাহারে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। চতুর্দিকে ক্ষীণকণ্ঠের আওয়াজ-অন্ন চাই, বস্ত্র চাই। ...রাসবিহারী এ্যাভিনিউয়ের ফুটপাতের শত শত কঙ্কালসার মানুষ। ওরা যের রাজধানীর বুকে অসংখ্য কেঁচোর মতো কিলবিল করছে।’ বিভূতিভূষণের ‘অশনি সংকেত’; তারাশংকার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মন্বন্তর’; মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নমুনা’, ‘আজকাল পরশুর গল্প’; শওকত ওসমানের ‘বনীআদম’ ও ‘জননী’ গ্রন্থে ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের ছবি অঙ্কিত হয়েছে। এসব উপন্যাসের সঙ্গে আকবর হোসেনের দুর্ভিক্ষভিত্তিক ছবি অঙ্কিত ‘মোহমুক্তি’ ও ‘ঢেউ জাগে’ গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

১৯৪৭ সালে দেশ-বিভাগের পর থেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন। এ ঘোষণায় প্রতিবাদ ওঠে। শুরু হয় বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষার দাবিতে আন্দোলন। এ-আন্দোলনেই মূলত স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়। ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন ১৯৪৭ থেকেই ১৯৭১-এর মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ এই সাড়ে তেইশ বছরের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের সমালোচক ও পর্যবেক্ষক। পাকিস্তানী শাসন-পর্বের নানা অত্যাচার, বৈষম্য ও ভারত বিভক্তি এসব তিনি শিল্পিত আঙ্গিকে তাঁর উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। এ দেশের পঞ্চাশ দশকের বলিষ্ঠ ও গৌরবময় আন্দোলন হচ্ছে ভাষা আন্দোলন। আকবর হোসেনের কাছে এ আন্দোলন শাসক শক্তির আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে।পঞ্চাশ দশকের আইয়ুব খানের সামরিক শাসন বাঙালি পেষণের একটি ঘৃণ্য অধ্যায়। আকবর হোসেনের ‘দুষ্টক্ষত’ উপন্যাসে এ শাসন চিত্রিত হয়েছে এভাবে: ‘ব্যবসা-বাণিজ্য, রাষ্ট্র পরিচালনায়, চাকরিক্ষেত্রে এবং দেশের সার্বিক উন্নতির ক্ষেত্রে বাঙালিরা দেখতে পায় বঞ্চনার সুষ্পষ্ট ছাপ। স্বাধীনতা যুদ্ধে রাজাকার বাহিনী এদেশের মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছে, মা-বোনদের সম্ভ্রম হরণ করেছে সম্পদ লুণ্ঠন করেছে।’ স্বাধীনতা যুদ্ধের ভয়াবহ ও মর্মস্পর্শী চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তাঁর উপন্যাসে।

স্বাধীনতাকে পাওয়ার জন্য এদেশের মানুষ অকাতরে রক্ত-কান্না-সম্ভ্রম-জীবন দান করেছেন। স্বাধীনতাকে ঘিরে এদেশের মানুষের অনেক স্বপ্ন ছিল। ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের ‘নতুন পৃথিবী’ উপন্যাসে তা মুন্সিয়ানার সঙ্গে বাস্তব সম্মতভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হন।

এভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে দেশ-কাল ও সমাজভাবনা আকবর হোসেনের উপন্যাসে গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। তিনি এ একজন সমাজচিন্তক ও কালসচেতন লেখক হিসাবে দক্ষতা দেখিয়েছেন। যে কারণে তাঁর উপন্যাসে একই সঙ্গে সমাজ ও সমকালকে সফলভাবে ধারণ করে কালোত্তীর্ণ সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করতে পেরেছে।

বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ , ১৪ আশ্বিন ১৪৩০, ১২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫

বিস্মৃতপ্রায় জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন

রকিবুল হাসান

image

আকবর হোসেন : জন্ম : ১ অক্টোবর ১৯১৭; মৃত্যু : ২ জুন ১৯৮১

ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন। ১৯৫০ থেকে ১৯৭০-এই সময়কাল বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক। তাঁকে বলা হয় বাংলা সাহিত্যে পঞ্চাশের যুবরাজ। তাঁর উপন্যাস ‘অবাঞ্ছিত’, ‘কি পাইনি’, ‘ঢেউ জাগে’, ‘মোহমুক্তি’, ‘মেঘ বিজলী বাদল’, ‘দুদিনের খেলাঘরে’, ‘নতুন পৃথিবী’, ‘দুষ্টক্ষত’ এবং ‘আভা ও তার প্রথম পুরুষ’। গল্পগ্রন্থ ‘আলোছায়া’। একমাত্র নাটক ‘যৌবনটাই জীবন নয়’।

১৯৪৭-এর দেশভাগের পরে পূর্ববংলায় অর্থাৎ বাংলাদেশে পাঠক তৈরির গুরুত্বপূর্ণ কারিগর ছিলেন ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন। এখানকার পাঠকদের সে-সময়ে পশ্চিমবাংলার লেখকদের বইয়ের প্রতিই বেশি আসক্তি ছিল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো মোহগ্রস্ত হয়ে তারা পশ্চিমবাংলার লেখকদের উপন্যাস পড়তেন। আকবর হোসেনের ‘অবাঞ্ছিত’ উপন্যাস এখানকার পাঠকদের প্রথম সেই মোহচ্যুতি ঘটায়। দেশীয় লেখকদের বইয়ের পাঠকসৃষ্টিতে তিনিই প্রথম অসামান্য কৃতিত্ব দেখাতে সক্ষম হন। তাঁর উপন্যাসগুলো সস্তা বা চটুল ছিল না, প্রত্যেকটি উপন্যাসই সাহিত্যগুণ সমৃদ্ধ। বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষে ক্ষীণকায় আকারের উপন্যাসও সৃষ্টি করেন নি। তিনি সমাজ-সমকাল-রাজনীতি সচেতন ও দায়িত্ববোধ সম্পন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঔপন্যাসিক ছিলেন।

আকবর হোসেনেরপ্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত রচনা নিয়ে তাঁর সাহিত্যকর্ম যদি বিচার-বিশ্লেষণ ও বিবেচনা করা যায় তাহলে নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যে তাঁকে একজন শক্তিমান সব্যসাচী লেখক হিসেবে আবিষ্কার করা সম্ভব। ঔপন্যাসিক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত হলেও তিনি যে একাধারে কবি, গল্পকার, নাট্যকার, গীতিকার, সম্পাদক- তা দীর্ঘসময়েও আবিষ্কৃত হয়নি। তাঁর অপ্রকাশিত রচনাভাণ্ডার প্রকাশ করা সম্ভব হলে আকবর হোসেনের কৃতিত্ব যে আরো অনেক বেড়ে যাবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

আকবর হোসেনের প্রথম উপন্যাস ‘অবাঞ্ছিত’ গত শতকের পঞ্চাশের শুরুতেই প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তখন দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় উপন্যাসটি সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করে পাঠকের দৃষ্টিগোচর করেন। অবশ্য তারও আগে উপন্যাসটি যখন পাইওনিয়র প্রেসে ছাপা হচ্ছিল, তখন খ্যাতিমান-গবেষক অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম প্রিন্টিং প্রেস থেকেই উপন্যাসটি পাঠ করে তার ‘অগত্যা’ পত্রিকায় প্রশংসাসূচক মন্তব্য লেখেন। এতে পাঠকদের উপন্যাসটি সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হয়। দ্রুত সময়ে উপন্যাসটি ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। অশ্চর্যের বিষয়, প্রথমে কেউই উপন্যাসটি প্রকাশ করতে সম্মত হননি। যেকারণে তিনি নিজের বাড়ি বিক্রি করে উপন্যাসটি প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। ‘অবাঞ্ছিত’ প্রায় ঘরে ঘরে পঠিত হওয়ার মর্যাদা লাভ করে। এই উপন্যাস তাঁকে খ্যাতি, ব্যাপক জনপ্রিয়তা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দিয়েছিল। অথচ এই উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল নানা ধরনের নাটকীয়তা। ‘অবাঞ্ছিত’ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি নিয়ে আকবর হোসেন দেখা করেছিলেন সেই সময়ের লব্ধপ্রতিষ্ঠিত অনেক কবি-সাহিত্যকের সঙ্গে। আকবর হোসেনের ‘কিছু কথা’ নামক একটি ব্যক্তিগত নিবন্ধ থেকে জানা যায়, তিনি অবাঞ্ছিত-এর পাণ্ডুলিপি প্রথম নিয়ে যান গোপাল হালদারের কাছে। গোপাল হালদার এক বছর পাণ্ডুলিপিটি নিজের কাছে রেখে দেন। অথচ তিনি তা পড়েও দেখেননি। আজ পড়বো কাল-পড়বো বলে তিনি এই নবীন ঔপন্যাসিককে প্রায় এক বছর ঘুরিয়েছেন। অবশেষে আকবর হোসেন হতাশ হয়ে পাণ্ডুলিপিটি ফেরত নেন। এরপর তিনি এটি নিয়ে বুদ্ধদেব বসু [১৯০৮-১৯৭৪], কাজী আব্দুল ওদুদ [১৮৯৮-১৯৭০], ব্যারিস্টার এস. ওয়াজেদ আলী [১৮৯০-১৯৫১], নারায়ণ গঙ্গোপ্যাধ্যায় [১৯১৮-১৯৭০] ও কবি জসীম উদ্দীন [১৯০৩-১৯৭৬] প্রমুখ প্রখ্যত কবি-সাহিত্যিকদের কাছে ধর্ণা দেন, বইটি সম্পর্কে তাঁদের মতামত গ্রহণের জন্য। দুঃখজনক হলো, তাঁদের কেউই বইটি সম্পর্কে মতামত প্রদান তো দূরে থাক- বইটি পড়েও দেখেননি। আকবর হোসেন তাঁর এই প্রথম লেখাটি প্রকাশিত হবার আগেই এসব খ্যাতিমান লেখকদের মূল্যবান মতামত ও পরামর্শ আশা করেছিলেন। সে-ক্ষেত্রে তিনি সম্পূর্ণভাবে হতাশ হন। খ্যাতিমান সাহিত্যিক ব্যারিস্টার এস. ওয়াজেদ আলী পাণ্ডুলিপিটি না পড়লেও লেখক আকবর হোসেনকে একটি উপদেশ দেন। উপদেশটির অংশবিশেষ উদ্ধৃত হলো: ‘লিখে যাও আরও লিখে যাও। অন্য কারও দ্বারা লেখার মূল্যায়ন করার দরকার হবে না। দীর্ঘদিন ফেলে রেখে হঠাৎ একদিন মনোযোগ দিয়ে নিজের লেখাটি পড়বে। দেখতে পাবে অনেক ভুল-ত্রুটি। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তোমার এগিয়ে যাওয়া মন নিজের লেখার মান বিচার করতে সক্ষম হবে। দু’তিনবার এমনি করে পড়ে নতুনভাবে লিখে নিজেই একদিন সফলতা অর্জন করতে পারবে।’

এস. ওয়াজেদ আলীর এই উপদেশটি ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন তাঁর লেখক জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯৪১ সালে লেখা এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সালে। এই সুদীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে আকবর হোসেন পাণ্ডুলিপিটি অনেকবার পড়েন। সংস্কার করেন দুবার। আর সে কারণেই প্রথম পাণ্ডুলিপির ইন্দ্র, শীলা, মীনাক্ষী ও নরেনকে আমরা ফিরোজ, রোকেয়া, রেখা এবং আমীর হিসেবে পাই। সে-সঙ্গে পরিবর্তন ঘটে কাহিনিরও।

আকবর হোসেন দেশকাল ও সমাজ সচেতন ঔপন্যাসিক ছিলেন। সাহিত্যচর্চায় সামাজিক নানাবিধ সমস্যার পাশাপাশি দেশ-কালও গুরুত্বের সঙ্গে এসেছে। আকবর হোসেনের শিল্পীমানসে ১৯৩৯ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব, ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ, ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ১৯৪৭ সালের দেশ-বিভাগ, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রভাব ফেলে। তাঁর উপন্যাস এসব বিষয় বিভিন্ন আঙ্গিকে নানাভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। গরিব, অসহায়, নির্যাতিত মানুষের কথা তাঁর লেখনিতে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। এদের জীবনযাত্রা, সমস্যা, সংঘাত, প্রেমপ্রণয়, দারিদ্র্য তাঁর উপন্যাসের উপজীব্য হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে। এসব মানুষের মুক্তির উপায় হিসেবে তিনি কখনও সাম্যের কথা বলেছেন, আবার কখনও গণতন্ত্রের কথা বিবেচনা করেছেন। আর এই ‘মুক্তি’ বলতে তিনি একদিকে যেমন শোষকের হাত থেকে শোষিতের মুক্তির কথা বলেছেন, তেমনি বলেছেন অর্থনৈতিক মুক্তির কথাও। আর এ ক্ষেত্রে তিনি আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বড় বাধাস্বরূপ সমস্যাগুলোকেও সূক্ষ্মভাবে চিহ্নিত করেছেন- যা তাঁর প্রকৃত শিল্পীমানসের পরিচয় বহন করে।

আকবর হোসেনগতানুগতিক নামসর্বস্ব লেবাসধারী গণতন্ত্র প্রত্যাশা করেননি। তিনি লক্ষ্য করেছেন, সমাজের একশ্রেণির মানুষ গণতন্ত্রের নামে নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত এবং নিজেদের ‘বিশেষ শ্রেণির’ মানুষ হিসেবে পরিচিত করতে পছন্দ করেন। এ-শ্রেণির মানুষ মুখে সাধারণ মানুষের মুক্তির কথা বললেও বাস্তবেতারা মানসিকভাবে এদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে রাখে। চিন্তাচেতনা-মননে-মানসিকতায় এরা বুর্জোয়া শ্রেণিভুক্ত। সাধারণ মানুষের সঙ্গে এরা কোনোরকম পারিবারিক সম্পর্কের বিষয়টি কল্পনাও করতে পারে না। এদের দম্ভোক্তি ‘আমার অভিজাত রক্তধারায় কোন নিকৃষ্ট রক্ত এসে তরঙ্গ সৃষ্টি করুক তা আমি চাই না’- এ থেকেই তাদের প্রকৃত স্বরূপ নির্ণীত হয়।

অথচ গরিব সাধারণ মানুষের মুক্তির কথা বলে, তাদের বিপদে-আপদে দুর্দিনে পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে, তাদের বন্ধু সেজে এরা ‘নেতা’ হন, উচ্চশ্রেণির মানুষ হন, ক্ষমতাধর ব্যক্তি হন। অভিজাত শ্রেণিভুক্ত হন। আকবর হোসেন ‘ঢেউ জাগে’ ও ‘নতুন পৃথিবী’ উপন্যাসে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে শিল্পিত ভঙ্গিতে ‘নেতা’ নামধারী এসব ভণ্ড ও সুবিধাবাদীদের ছবি এঁকেছেন। তিনি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজমান সমস্যাকে খুঁটে খুঁটে দেখেছেন। নর-নারীর ভালাবাসা এবং শারীরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠা স্বাভাবিক ও প্রকৃতিগত। আমাদের মতো দেশে-সমাজে বিবাহ বহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ক অগ্রহণযোগ্য, অসামাজিক ও অন্যায় হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু অগ্রহণযোগ্য এই সম্পর্ক সমাজচক্ষুর আড়ালে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে, এখনো সে-ধারা অব্যহত। আকবর হোসেন এ বিয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এঁকেছেন ‘অবাঞ্ছিত’ গ্রন্থে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এ সম্পর্কের সবটুকু দায়, লাঞ্ছনা, অপমান নারীকেই গ্রহণ করতে হয়। নারীকেই বহন করতে হয় এ-পাপের চিহ্ন। এ-বিষয়টি আকবর হোসেনের শিল্পীমনকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছিল, ব্যথিত করেছিল। আর এই বোধ থেকেই তিনি ‘অবাঞ্ছিত’ উপন্যাস রচনা করেন। আবার, একই সঙ্গে স্বদেশী আন্দোলনের অসাধারণ চিত্রকল্প আছে উপন্যাসটিতে। চারিত্রিক অধঃপতিত আমিরকে স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত করে আদর্শবান শিক্ষক ও ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে একজন বিপ্লবীতে রূপান্তরিত করে, চারিত্রিক সব ধরনের ত্রুটি থেকে সংশোধিত করে, অনন্য এক চরিত্রে আমীরকে প্রতিষ্ঠিত করে তিনি যে অসামান্য দক্ষতা দেখিয়েছেন তা এককথায় অভিনব। সেই সময়ে বাংলা কথাসাহিত্যে এ ধরনের চরিত্রনির্মাণ করে আকবর হোসেন তাঁর শক্তিমত্তার পরিচয় দেন।যে কারণে সাহিত্যবোদ্ধাদেও কাছে এ উপন্যাস যেমন গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল, একইভাবে পাঠকসমাজেও ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’ ও ‘ঘরে-বাইরে’, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যয়ের ‘পথের দাবী’ ও কাজী নজরুল ইসলামের ‘কুহেলিকা’ উপন্যাসে স্বদেশী আন্দোলনের বার্তা ও কাহিনী বিধৃত আছে। আকবর হোসেন তাঁদের উত্তরসূরি হয়েও তাঁর উপন্যাসে স্বদেশী আন্দোলনের চিত্র উপস্থাপন করেছেন ভিন্নআঙ্গিকে। তখন শুধু স্বদেশী আন্দোলন এমনভাবে বিস্তার ঘটেছিল, সেই আন্দোলনে শুধু যে নীতি-আদর্শবান যুবকরাই যুক্ত হয়েছিল তা নয়। চারিত্রিক স্খলনঘটা তরুণরাও নিজেদেও সংশোধন করে নিয়ে স্বদেশি আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল, ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে। আকবর হোসেনের উপন্যাসে এ ধরনের চরিত্র নির্মাণ প্রথম পরিলক্ষিত হয়।

গ্রামের গরিব মানুষদের সরলতা ও অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির অর্থপিশাচ স্বার্থন্বেষীরা যে প্রভাব বিস্তার করে এবং ‘সে সঙ্গে নগরজীবনের আওতায় উলঙ্গ’ সভ্যতার অনুকরণে শিক্ষিত সমাজ ভ্রান্ত প্রগতিকে ধারণ করে কতটা অধঃপতনের শিকার ‘কি পাইনি’ গ্রন্থের মূল উপজীব্য এটি। জমিদারের অত্যাচারের চিত্রও তিনি তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে এঁকেছেন। ‘অবাঞ্ছিত’ গ্রন্থে জমিদারের অত্যাচারে রোকেয়ার জীবন শুধু দুর্বিসহই হয়ে ওঠেনি, তাকে রাতের অন্ধকারে চিরদিনের জন্যে চলে যেতে হয়েছিল ভিটা-মাটি ত্যাগ করে। ‘ঢেউ জাগে’ গ্রন্থে জমিদার এনায়েত খানের অত্যাচার-নিপীড়ন-নির্যাতনে প্রতিবাদী ওমর মাস্টারের মৃত্যু ঘটে। তার সুন্দরী স্ত্রী রাঙাবউ জমিদার কর্তৃক বিভিন্নবাবে লাঞ্ছিত হয়েছে, অপমানিত হয়েছে। গ্রামের সহজ সরল সুন্দরী নারীরা জমিদারের লোলুপ-লালসার শিকার হয়েছে, সাধারণ মানুষের জীবন এদের নির্মম অত্যাচারে বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছিল- আকবর হোসনে তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে দক্ষ শিল্পীর মতো জমিদারদের প্রকৃতস্বরূপ শিল্পিত আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন। এক্ষেত্রে আকবর হোসেনের মধ্যে সমাজ-সচেতন এক শিল্পীসত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু একটি বিষয় লক্ষ্য করা যায়, আকবর হোসেন তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে জমিদারদের অত্যাচার, দখল-দারিত্ম্য, নারী-লোলুপতা নিয়ে কথা বলেছেন, এদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। কিন্তু তিনি তাঁর কোনো উপন্যাসেই জমিদারি-প্রথা নিয়ে কোনো কথা বলেন নি।

আকবর হোসেন দেশ-কাল সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে এর স্বাক্ষর রয়েছে। আকবর হোসেনের সাহিত্যকাল ছিল মূলত চল্লিশের দশকের শুরু থেকে মধ্য সত্তর দশক পর্যন্ত। তিনি তাঁর বিভিন্ন লেখনীতে এই সময়-কাল ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এই উপমহাদেশে দীর্ঘকাল থেকে চলে আসছে। ১৭৩০ সালের মোগল সম্রাট ফররুখ শিয়রের রাজত্বকালে ছেলেখেলা উপলক্ষে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচুর রক্তক্ষয় হয়েছিল। এই দুই সম্প্রদায়ের দাঙ্গা এরপরও বিভিন্নভাবে সংঘটিত হয়েছে। আকবর হোসেনের মোহমুক্তি উপন্যাসে ১৯৪৬ সালে কলকাতায় সংঘটিত দাঙ্গার ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যায়। বিভাগ-পূর্বকালের একটি উল্লেখযোগ্য প্রসঙ্গ ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষের। দুর্ভিক্ষের ইতিহাস এ উপমহাদেশে অনেক পুরনো। ১১৭৬ বঙ্গব্দের মন্বন্তর থেকে ১৩৫০ সাল পর্যন্ত এই উপমহাদেশে অনেকবার দুর্ভিক্ষ ঘটেছে। প্রতিবারই দুর্ভিক্ষে উপমহাদেশের অসংখ্য লোক মৃত্যুর শিকার হয়েছে। ক্ষুধা-দারিদ্রের শিকার হয়েছে। কিন্তু এসব দুর্ভিক্ষের পুরোটাই প্রকৃতিগত ছিল না, কৃত্রিমভাবেও তৈরি করা হয়েছিল। ধনিকশ্রেণি ও শাসকগোষ্ঠী যোগসাজশে নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে কৃত্রিমভাবে প্রাকৃতিক দুর্ভিক্ষকে আরও ভয়াবহ করে তোলে, মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করে, সাধারণ মানুষের জীবনের থেকে ব্যক্তিস্বার্থ এদের কাছে বড়। যা বর্তমান সময়েও পরিলক্ষিত হয়। ‘ঢেউ জাগে’ উপন্যাসে দুর্ভিক্ষে সন্তান-সন্ততি হারানো অসহায় এক নারী হাসি কৃত্রিমভাবে দুর্ভিক্ষ তৈরিকারী ভণ্ড নেতাদের উদ্দেশে আর্তনাদ করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে, ‘দেশের এ সর্বনাশের জন্য কে দায়ী? লক্ষ লক্ষ মানুষের দুর্গতির মূলে কে? কোন নরাধম মানুষের সংসার জীবনে দিয়েছে বিষকাঁটা ছড়িয়ে?’

১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের মর্মন্তুদ চিত্র ‘মোহমুক্তি’ উপন্যাসে উপস্থাপিত হয়েছে এভাবে: ‘১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ। লক্ষ লক্ষ মানুষ কলকাতার বুকে অনাহারে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। চতুর্দিকে ক্ষীণকণ্ঠের আওয়াজ-অন্ন চাই, বস্ত্র চাই। ...রাসবিহারী এ্যাভিনিউয়ের ফুটপাতের শত শত কঙ্কালসার মানুষ। ওরা যের রাজধানীর বুকে অসংখ্য কেঁচোর মতো কিলবিল করছে।’ বিভূতিভূষণের ‘অশনি সংকেত’; তারাশংকার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মন্বন্তর’; মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নমুনা’, ‘আজকাল পরশুর গল্প’; শওকত ওসমানের ‘বনীআদম’ ও ‘জননী’ গ্রন্থে ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের ছবি অঙ্কিত হয়েছে। এসব উপন্যাসের সঙ্গে আকবর হোসেনের দুর্ভিক্ষভিত্তিক ছবি অঙ্কিত ‘মোহমুক্তি’ ও ‘ঢেউ জাগে’ গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

১৯৪৭ সালে দেশ-বিভাগের পর থেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন। এ ঘোষণায় প্রতিবাদ ওঠে। শুরু হয় বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষার দাবিতে আন্দোলন। এ-আন্দোলনেই মূলত স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়। ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন ১৯৪৭ থেকেই ১৯৭১-এর মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ এই সাড়ে তেইশ বছরের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের সমালোচক ও পর্যবেক্ষক। পাকিস্তানী শাসন-পর্বের নানা অত্যাচার, বৈষম্য ও ভারত বিভক্তি এসব তিনি শিল্পিত আঙ্গিকে তাঁর উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। এ দেশের পঞ্চাশ দশকের বলিষ্ঠ ও গৌরবময় আন্দোলন হচ্ছে ভাষা আন্দোলন। আকবর হোসেনের কাছে এ আন্দোলন শাসক শক্তির আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে।পঞ্চাশ দশকের আইয়ুব খানের সামরিক শাসন বাঙালি পেষণের একটি ঘৃণ্য অধ্যায়। আকবর হোসেনের ‘দুষ্টক্ষত’ উপন্যাসে এ শাসন চিত্রিত হয়েছে এভাবে: ‘ব্যবসা-বাণিজ্য, রাষ্ট্র পরিচালনায়, চাকরিক্ষেত্রে এবং দেশের সার্বিক উন্নতির ক্ষেত্রে বাঙালিরা দেখতে পায় বঞ্চনার সুষ্পষ্ট ছাপ। স্বাধীনতা যুদ্ধে রাজাকার বাহিনী এদেশের মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছে, মা-বোনদের সম্ভ্রম হরণ করেছে সম্পদ লুণ্ঠন করেছে।’ স্বাধীনতা যুদ্ধের ভয়াবহ ও মর্মস্পর্শী চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তাঁর উপন্যাসে।

স্বাধীনতাকে পাওয়ার জন্য এদেশের মানুষ অকাতরে রক্ত-কান্না-সম্ভ্রম-জীবন দান করেছেন। স্বাধীনতাকে ঘিরে এদেশের মানুষের অনেক স্বপ্ন ছিল। ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের ‘নতুন পৃথিবী’ উপন্যাসে তা মুন্সিয়ানার সঙ্গে বাস্তব সম্মতভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হন।

এভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে দেশ-কাল ও সমাজভাবনা আকবর হোসেনের উপন্যাসে গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। তিনি এ একজন সমাজচিন্তক ও কালসচেতন লেখক হিসাবে দক্ষতা দেখিয়েছেন। যে কারণে তাঁর উপন্যাসে একই সঙ্গে সমাজ ও সমকালকে সফলভাবে ধারণ করে কালোত্তীর্ণ সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করতে পেরেছে।