একাত্তরের গণহত্যার খন্ডচিত্র

সাদেকুর রহমান

(গতকালের পর)

আইরখামার গণহত্যা : দিনটি ছিল মঙ্গলবার, ১৯ রমজান। ১৯৭১ সালের ৯ নভেম্বর বর্তমান লালমনিরহাট জেলার সদর উপজেলাধীন বড়বাড়ি ইউনিয়নের আইরখামার গ্রামে কারমাইকেল কলেজছাত্র সংসদের ভিপি মুজিব বাহিনীর অন্যতম নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা খোন্দকার মুখতার ইলাহীসহ ১১৯ জন নিরীহ বাঙালি ও মুক্তিযোদ্ধাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে।

এর আগে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বড় একটি দল লালমনিরহাটের বড়বাড়িতে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে তারা গ্রামের নিরীহ সাধারণ মানুষের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছিল।

রংপুর কারমাইকেল কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি খোন্দকার মুখতার ইলাহীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল বড়বাড়ি দখলে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেন। সেই লক্ষ্যে দলটি বড়বাড়ি ইউনিয়নে অবস্থান নেয়ার আগেই রাজাকারদের মাধ্যমে খবর পায় পাকিস্তানি বাহিনী। ৪০০ জনের মতো পাকিস্তানি সেনা মুক্তিবাহিনীর অবস্থান আইরখামার গ্রাম ঘিরে ফেলে এবং আক্রমণ শুরু করে।

তখন ২ পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে হানাদাররা মুখতার ইলাহী ও এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে ফেলে এবং নির্যাতন চালিয়ে তাদের হত্যা করে। একইসঙ্গে পুরো এলাকাতেই নৃশংস গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। এই গণহত্যায় গ্রামবাসীসহ মোট ১১৯ জন শহীদ হন।

বগুড়ার বাবুর পুকুরের গণহত্যা : ১৯৭১ সালের ১০ নভেম্বর সশস্ত্র দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যদের হাতে বগুড়ার শাহজাহানপুর উপজেলার খরনা ইউনিয়নের বাবুর পুকুরে ১৪ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। শত্রুসেনারা বগুড়া শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নিয়ে যায় বাবুর পুকুরে এবং সেখানে একসঙ্গে তাদের গুলি করে হত্যা করে। বধ্যভূমিতে শহীদদের স্মৃতিরক্ষায় একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হলেও আজো তাদের শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি মেলেনি।

দিনটি ছিল ২০ রমজান। ঘরে ঘরে সেহরি খাওয়ার প্রস্তুতি চলছিল। শান্তি কমিটির সহযোগিতায় কয়েকশ পাকিস্তানি সেনা বগুড়া শহরের ঠনঠনিয়ার শাহপাড়া, মন্ডলপাড়া, তেঁতুলতলা, হাজীপাড়া ও পশারীপাড়ায় হানা দেয়। তারা বিভিন্ন বাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে ২১ জনকে ধরে ট্রাকে করে তুলে। পরে তাদের বগুড়া-রাজশাহী মহাসড়কের পাশে বাবুর পুকুর এলাকায় নিয়ে যায়। তাদের মধ্য থেকে এক এক করে বাছাই করে দুই কিশোর ও ৩ বৃদ্ধসহ মোট ৭ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়। বাদ বাকি ১৪ জনকে হাত ও চোখ বেঁধে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়। ব্রাশফায়ারের ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত-মাংস ছিন্নভিন্ন হয়ে গাছের ডালে ডালে ঝুলতে থাকে। ওই ১৪ জনকে সেখানেই কবর দেয়া হয়।

বাবুর পুকুর পাড়ে শহীদ ১৪ জন হলেন- নূরজাহান, হান্নান পশারী, মান্নান পশারী, ওয়াজেদুর রহমান টুকু, জামাল মন্ডল, মন্টু মন্ডল, আব্দুস সবুর ভোলা মন্ডল, সাইফুল ইসলাম, আলতাফ আলী, বাদশা শেখ, বাচ্চু শেখ, ফজলুল হক খান, আবুল হোসেন এবং অজ্ঞাতনামা একজন।

শহীদ নূরজাহান বেগমের প্রতি পাকিস্তানিদের আক্রোশ ছিল। কারন তিনি বগুড়া টেলিফোন অফিসে অপারেটর পদে চাকরি করতেন। সেই সুবাদে যুদ্ধের দিনগুলোতে পাকিস্তানি সেনাদের আদান-প্রদান করা প্রায় সকল তথ্য তিনি জানতেন এবং সেসব তথ্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য দিচ্ছেন সে খবরটি কোন না কোনভাবে পাকিস্তানি সেনারা জেনে যায়। সেদিন ভোররাত আনুমানিক ৪টার দিকে নূরজাহান বেগমকে জিপে তুলে নিয়ে শত্রুসেনারা অভিযানের জন্য এগিয়ে যায়।

১৯৭৯ সালে বগুড়া প্রেসক্লাবের উদ্যোগে বাবুর পুকুরের কবরগুলো পাকা করে দেয়া হয়। বগুড়া জেলা পরিষদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি সংরক্ষণে ২০১০ সালে সেখানে দৃ’িনন্দন একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে।

পাহাড়তলি গণহত্যা : ১৯৭১ সালের ১০ নভেম্বর চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়তলীর পাঞ্জাবি লেন (বর্তমান শহীদ লেন), ওয়্যারলেস কলোনি এবং বাহাদুর শাহ কলোনির শিশু, যুবক-যুবতী, নারী-পুরুষ, বৃদ্ধদের বাসা থেকে জোরপূর্বক ধরে এনে সিভিল পাইওনিয়ার ফোর্সের লোকজন। অনেককে ‘মিলিটারি অফিসার সাহেব ডাকছে’ বলে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যায়। এভাবে সবাইকে একত্র করে ওয়্যারলেস কলোনির কাছে পাহাড়ের কাছে দলবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হয়। সেখানে ধারালো অস্ত্র ও স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে হত্যাকান্ড চালায়। সকাল থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত এ হত্যাতান্ডব চলে। স্বাধীনতার পর হাজারো নারী-পুরুষের লাশ এখানে পাওয়া যায়। কোথাও কোথাও লাশগুলো একত্র করে পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। আবার কোথাও বাড়িঘর ও লাশ ধ্বংসের জন্য গানপাউডার ব্যবহার করা হয়।

বাঙালি-অধ্যুষিত এলাকা ছিল রেলওয়ে কলোনি পাঞ্জাবি লেন। বীর মুক্তিযোদ্ধারা গোপনে সেখানে একটি ঘাঁটি স্থাপন করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে এই ঘাঁটি থেকে ডা. মাহফুজুর রহমান ও ডা. জাহাঙ্গীর কবীরের নেতৃত্বে সফলভাবে একটি মালগাড়ি লাইনচ্যুত হয়ে ফয়’স লেকের ইলেকট্রিক টাওয়ার ধ্বংস করা হয়। এ ঘটনার পরই এলাকার অবাঙালি ও পাকিস্তানিদের এ দেশীয় দোসরদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

বরইতলা গণহত্যা : সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুর থানার (বর্তমানে উপজেলা) একটি দুর্গম গ্রাম বড়ইতলা। কৌশলগত দিক থেকে এ গ্রামটি ছিল মুক্তিবাহিনীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল। ১৩ নভেম্বর গভীর রাতে বিপুলসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ওই গ্রামের ইব্রাহিম আলীর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। আশ্রয় নিলে গ্রামের শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী সংবাদটি থানায় অবস্থান করা হানাদার বাহিনীর কাছে পৌঁছে দেয়। ভোর রাতে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামের পশ্চিম দিকে অবস্থান নেয়। এ সময় পাহারারত ২ বীর মুক্তিযোদ্ধার হাতে ৩ হানাদার আহত হলে ব্যাপক গুলিবর্ষণ শুরু করে তারা।

এ অবস্থায় কিছুটা অপ্রস্তুত মুক্তিযোদ্ধারা গ্রামের পূর্ব প্রান্তে একটি নালার মধ্যে অবস্থান নিয়ে পাল্টা ফায়ার করতে থাকে। এ সময় হানাদাররা রাজাকারদের সহায়তায় পুরো গ্রামে হামলা চালায়। হানাদারদের হাত থেকে রেহায় পায়নি গ্রামের মসজিদের আশ্রয় নেয়া ইদ্রিস আলী ও করিম বক্স। তারা নামাজ শেষে মসজিদে বসে কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন। শত্রুসেনারা মসজিদে ঢুকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। গুলি করে হত্যা করে অসংখ্য গ্রামবাসীকে। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করায় সন্দেহভাজন ২৭ ব্যক্তিকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়।

এ খবরে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জেলা আওয়ামী লীগের (ভারপ্রাপ্ত) সভাপতি অ্যাডভোকেট কে এম হোসেন আলী হাসানের নেতৃত্বে, কুড়ালিয়া, চিলগাছা, হরিনা বাগবাটি, গজারিয়া- এসব গ্রাম থেকে বিপুলসংখ্যক বীর মুক্তিযোদ্ধা এসে যোগ দেন হানাদার প্রতিরোধে। বেলা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত চলে বিরামহীন যুদ্ধ ।

একসময় বর্বর হানাদাররা পিছু হটতে বাধ্য হলেও ধৃত ২৭ জনকে গুলি করে। এতে ২৬ জন নিরীহ গ্রামবাসী নিহত হন। ইউপি সদস্য আফসার আলী লাশের স্তূপের মধ্যে নিশ্চুপ হয়ে পড়ে থাকায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। অপরদিকে ৬ জন পাকিস্তানি সৈন্য ও একজন রাজাকার মারা যায়। রাতেই গ্রামবাসীরা মিলে নিহতদের দাফন করে।

রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি সৈনিক ও রাজাকার বাহিনী বরইতলা গ্রাম ঘেরাও করে এবং নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে। ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র গর্জে ওঠে। রাতভর যুদ্ধের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অস্ত্র স্তব্ধ হয়ে যায়। দিনভর যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনীর গোলাবারুদ ফুরিয়ে গেলে পিছু হটে। এ সময় বরইগ্রামে গণহত্যার শিকার হয়েছিল মোট ১০৪ জন নারী-পুরুষ। আহত হয়েছিল অনেকেই। যুদ্ধপরবর্তীতে নিহতদের স্মরণে বরইতলায় নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ।

(চলবে)

[লেখক: সমন্বয়ক ও গবেষক, ‘প্রবাসে প্রিয়জন’ অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ টেলিভিশন]

শুক্রবার, ১০ নভেম্বর ২০২৩ , ২৪ কার্তিক ১৪৩০, ২৪ রবিউস সানি ১৪৪৫

একাত্তরের গণহত্যার খন্ডচিত্র

সাদেকুর রহমান

(গতকালের পর)

আইরখামার গণহত্যা : দিনটি ছিল মঙ্গলবার, ১৯ রমজান। ১৯৭১ সালের ৯ নভেম্বর বর্তমান লালমনিরহাট জেলার সদর উপজেলাধীন বড়বাড়ি ইউনিয়নের আইরখামার গ্রামে কারমাইকেল কলেজছাত্র সংসদের ভিপি মুজিব বাহিনীর অন্যতম নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা খোন্দকার মুখতার ইলাহীসহ ১১৯ জন নিরীহ বাঙালি ও মুক্তিযোদ্ধাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে।

এর আগে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বড় একটি দল লালমনিরহাটের বড়বাড়িতে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে তারা গ্রামের নিরীহ সাধারণ মানুষের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছিল।

রংপুর কারমাইকেল কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি খোন্দকার মুখতার ইলাহীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল বড়বাড়ি দখলে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেন। সেই লক্ষ্যে দলটি বড়বাড়ি ইউনিয়নে অবস্থান নেয়ার আগেই রাজাকারদের মাধ্যমে খবর পায় পাকিস্তানি বাহিনী। ৪০০ জনের মতো পাকিস্তানি সেনা মুক্তিবাহিনীর অবস্থান আইরখামার গ্রাম ঘিরে ফেলে এবং আক্রমণ শুরু করে।

তখন ২ পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে হানাদাররা মুখতার ইলাহী ও এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে ফেলে এবং নির্যাতন চালিয়ে তাদের হত্যা করে। একইসঙ্গে পুরো এলাকাতেই নৃশংস গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। এই গণহত্যায় গ্রামবাসীসহ মোট ১১৯ জন শহীদ হন।

বগুড়ার বাবুর পুকুরের গণহত্যা : ১৯৭১ সালের ১০ নভেম্বর সশস্ত্র দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যদের হাতে বগুড়ার শাহজাহানপুর উপজেলার খরনা ইউনিয়নের বাবুর পুকুরে ১৪ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। শত্রুসেনারা বগুড়া শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নিয়ে যায় বাবুর পুকুরে এবং সেখানে একসঙ্গে তাদের গুলি করে হত্যা করে। বধ্যভূমিতে শহীদদের স্মৃতিরক্ষায় একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হলেও আজো তাদের শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি মেলেনি।

দিনটি ছিল ২০ রমজান। ঘরে ঘরে সেহরি খাওয়ার প্রস্তুতি চলছিল। শান্তি কমিটির সহযোগিতায় কয়েকশ পাকিস্তানি সেনা বগুড়া শহরের ঠনঠনিয়ার শাহপাড়া, মন্ডলপাড়া, তেঁতুলতলা, হাজীপাড়া ও পশারীপাড়ায় হানা দেয়। তারা বিভিন্ন বাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে ২১ জনকে ধরে ট্রাকে করে তুলে। পরে তাদের বগুড়া-রাজশাহী মহাসড়কের পাশে বাবুর পুকুর এলাকায় নিয়ে যায়। তাদের মধ্য থেকে এক এক করে বাছাই করে দুই কিশোর ও ৩ বৃদ্ধসহ মোট ৭ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়। বাদ বাকি ১৪ জনকে হাত ও চোখ বেঁধে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়। ব্রাশফায়ারের ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত-মাংস ছিন্নভিন্ন হয়ে গাছের ডালে ডালে ঝুলতে থাকে। ওই ১৪ জনকে সেখানেই কবর দেয়া হয়।

বাবুর পুকুর পাড়ে শহীদ ১৪ জন হলেন- নূরজাহান, হান্নান পশারী, মান্নান পশারী, ওয়াজেদুর রহমান টুকু, জামাল মন্ডল, মন্টু মন্ডল, আব্দুস সবুর ভোলা মন্ডল, সাইফুল ইসলাম, আলতাফ আলী, বাদশা শেখ, বাচ্চু শেখ, ফজলুল হক খান, আবুল হোসেন এবং অজ্ঞাতনামা একজন।

শহীদ নূরজাহান বেগমের প্রতি পাকিস্তানিদের আক্রোশ ছিল। কারন তিনি বগুড়া টেলিফোন অফিসে অপারেটর পদে চাকরি করতেন। সেই সুবাদে যুদ্ধের দিনগুলোতে পাকিস্তানি সেনাদের আদান-প্রদান করা প্রায় সকল তথ্য তিনি জানতেন এবং সেসব তথ্য মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য দিচ্ছেন সে খবরটি কোন না কোনভাবে পাকিস্তানি সেনারা জেনে যায়। সেদিন ভোররাত আনুমানিক ৪টার দিকে নূরজাহান বেগমকে জিপে তুলে নিয়ে শত্রুসেনারা অভিযানের জন্য এগিয়ে যায়।

১৯৭৯ সালে বগুড়া প্রেসক্লাবের উদ্যোগে বাবুর পুকুরের কবরগুলো পাকা করে দেয়া হয়। বগুড়া জেলা পরিষদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি সংরক্ষণে ২০১০ সালে সেখানে দৃ’িনন্দন একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে।

পাহাড়তলি গণহত্যা : ১৯৭১ সালের ১০ নভেম্বর চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়তলীর পাঞ্জাবি লেন (বর্তমান শহীদ লেন), ওয়্যারলেস কলোনি এবং বাহাদুর শাহ কলোনির শিশু, যুবক-যুবতী, নারী-পুরুষ, বৃদ্ধদের বাসা থেকে জোরপূর্বক ধরে এনে সিভিল পাইওনিয়ার ফোর্সের লোকজন। অনেককে ‘মিলিটারি অফিসার সাহেব ডাকছে’ বলে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যায়। এভাবে সবাইকে একত্র করে ওয়্যারলেস কলোনির কাছে পাহাড়ের কাছে দলবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হয়। সেখানে ধারালো অস্ত্র ও স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে হত্যাকান্ড চালায়। সকাল থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত এ হত্যাতান্ডব চলে। স্বাধীনতার পর হাজারো নারী-পুরুষের লাশ এখানে পাওয়া যায়। কোথাও কোথাও লাশগুলো একত্র করে পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। আবার কোথাও বাড়িঘর ও লাশ ধ্বংসের জন্য গানপাউডার ব্যবহার করা হয়।

বাঙালি-অধ্যুষিত এলাকা ছিল রেলওয়ে কলোনি পাঞ্জাবি লেন। বীর মুক্তিযোদ্ধারা গোপনে সেখানে একটি ঘাঁটি স্থাপন করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে এই ঘাঁটি থেকে ডা. মাহফুজুর রহমান ও ডা. জাহাঙ্গীর কবীরের নেতৃত্বে সফলভাবে একটি মালগাড়ি লাইনচ্যুত হয়ে ফয়’স লেকের ইলেকট্রিক টাওয়ার ধ্বংস করা হয়। এ ঘটনার পরই এলাকার অবাঙালি ও পাকিস্তানিদের এ দেশীয় দোসরদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

বরইতলা গণহত্যা : সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুর থানার (বর্তমানে উপজেলা) একটি দুর্গম গ্রাম বড়ইতলা। কৌশলগত দিক থেকে এ গ্রামটি ছিল মুক্তিবাহিনীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল। ১৩ নভেম্বর গভীর রাতে বিপুলসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ওই গ্রামের ইব্রাহিম আলীর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। আশ্রয় নিলে গ্রামের শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী সংবাদটি থানায় অবস্থান করা হানাদার বাহিনীর কাছে পৌঁছে দেয়। ভোর রাতে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামের পশ্চিম দিকে অবস্থান নেয়। এ সময় পাহারারত ২ বীর মুক্তিযোদ্ধার হাতে ৩ হানাদার আহত হলে ব্যাপক গুলিবর্ষণ শুরু করে তারা।

এ অবস্থায় কিছুটা অপ্রস্তুত মুক্তিযোদ্ধারা গ্রামের পূর্ব প্রান্তে একটি নালার মধ্যে অবস্থান নিয়ে পাল্টা ফায়ার করতে থাকে। এ সময় হানাদাররা রাজাকারদের সহায়তায় পুরো গ্রামে হামলা চালায়। হানাদারদের হাত থেকে রেহায় পায়নি গ্রামের মসজিদের আশ্রয় নেয়া ইদ্রিস আলী ও করিম বক্স। তারা নামাজ শেষে মসজিদে বসে কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন। শত্রুসেনারা মসজিদে ঢুকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। গুলি করে হত্যা করে অসংখ্য গ্রামবাসীকে। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করায় সন্দেহভাজন ২৭ ব্যক্তিকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়।

এ খবরে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জেলা আওয়ামী লীগের (ভারপ্রাপ্ত) সভাপতি অ্যাডভোকেট কে এম হোসেন আলী হাসানের নেতৃত্বে, কুড়ালিয়া, চিলগাছা, হরিনা বাগবাটি, গজারিয়া- এসব গ্রাম থেকে বিপুলসংখ্যক বীর মুক্তিযোদ্ধা এসে যোগ দেন হানাদার প্রতিরোধে। বেলা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত চলে বিরামহীন যুদ্ধ ।

একসময় বর্বর হানাদাররা পিছু হটতে বাধ্য হলেও ধৃত ২৭ জনকে গুলি করে। এতে ২৬ জন নিরীহ গ্রামবাসী নিহত হন। ইউপি সদস্য আফসার আলী লাশের স্তূপের মধ্যে নিশ্চুপ হয়ে পড়ে থাকায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। অপরদিকে ৬ জন পাকিস্তানি সৈন্য ও একজন রাজাকার মারা যায়। রাতেই গ্রামবাসীরা মিলে নিহতদের দাফন করে।

রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি সৈনিক ও রাজাকার বাহিনী বরইতলা গ্রাম ঘেরাও করে এবং নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে। ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র গর্জে ওঠে। রাতভর যুদ্ধের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অস্ত্র স্তব্ধ হয়ে যায়। দিনভর যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনীর গোলাবারুদ ফুরিয়ে গেলে পিছু হটে। এ সময় বরইগ্রামে গণহত্যার শিকার হয়েছিল মোট ১০৪ জন নারী-পুরুষ। আহত হয়েছিল অনেকেই। যুদ্ধপরবর্তীতে নিহতদের স্মরণে বরইতলায় নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ।

(চলবে)

[লেখক: সমন্বয়ক ও গবেষক, ‘প্রবাসে প্রিয়জন’ অনুষ্ঠান, বাংলাদেশ টেলিভিশন]