ভয়াল ১২ নভেম্বরে উপকূল ভাবনা

আমীরুল হক পারভেজ

১২ নভেম্বর ১৯৭০। উপকূল জীবন ইতিহাসের এক ভয়াবহ কালরাত। এ দিনে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ১০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। উপকূলীয় দ্বীপচরসহ বহু এলাকার ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে বিরাণ জনপদে পরিণত হয়।

সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে ভোলা এবং তৎকালীন নোয়াখালী (নোয়াখালী- লক্ষ্মীপুর) উপকূলে। রামগতি, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, ভোলা এবং পটুয়াখালী পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় উত্তর মনপুরা ঘুরে ঘূর্ণিঝড়ের বিধ্বংসী ও ধ্বংসাত্মক প্রভাবকে ২৮ ফুট লম্বা মনপুরা ’৭০ একটি শিল্পকর্মে চিত্রিত করেন।

জয়নুল বলেন, ‘মনপুরায় আমরা যখন থার্ড ডে তে নামলাম। সি-প্লেনে আমি আর আমার বন্ধু একা ঘুরতাছি সারাদিন। কয়টা লোক বাঁইচা আছে। দেখলাম। দৌড়ায় আসল। দেখলাম জখমওয়ালা। তারা কানতে আরম্ভ করল। আমরাও কানতে আরম্ভ করলাম। আপনারা বিশ্বাস করেন, আমার পেছনে...সমুদ্র...ঠিক সমুদ্র না, সমুদ্রের খাড়ি, যেখানে যান, খালি গরু-মানুষ শুইয়া রইছে।’

মনপুরা দ্বীপের ৩২ হাজার মানুষের মধ্যে ২০ হাজার মানুষ এ ভয়াল রাতে প্রাণ হারায়। তজুমুদ্দিন উপজেলায় ১ লাখ ৬৭ হাজার মানুষের মধ্যে বেঁচে ছিল মাত্র ৭৭ হাজার। সাগর, নদী, খাল-বিলে ভেসেছিল অসংখ্য লাশ। স্বাভাবিকভাবে মৃত দেহের সৎকার করাও সম্ভব হয়নি। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে গণকবরে মাটি চাপা দেয়া হয়েছিল সব দেহের। ঘরবাড়ি, স্বজন হারিয়ে পথে বসেন উপকূলের লাখ লাখ মানুষ। ওই সময়ে মানুষকে আবহাওয়ার পূর্বাভাস সঠিকভাবে জানানো হয়নি। সেই ঘূর্ণিঝড়ের ৫৩ বছর পূর্ণ হলো আজ।

মনপুরার মফিজা খাতুন (৭২) এ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ভেসে সন্দ¦ীপ থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার হয়ে চট্টগ্রাম হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে দেড় মাস পর মনপুরায় ফিরে আসেন। ময়ফুল বেগম (৭৫) তার পরিবারের ১৯ জন সদস্য হারানোর বেদনায় এখনো কাঁদেন। মনপুরার সাবেক চেয়ারম্যান নজির আহমেদও (৮৩) জলোচ্ছ্বাসের বিবরণ দিতে চোখের জল আটকাতে পারেননি। লক্ষ্মীপুরের আব্দুল হক (৭৭) আজও স্ত্রী-সন্তান হারানোর শোক ভুলতে পারেননি। পটুয়াখালীর সাবের মাঝি (৭১) বাবা, মা, ভাই-বোন হারানোর শোকে বিহ্বল! এরকম অসংখ্য আহাজারি চোখে দেখা যায় সন্দ্বীপ, হাতিয়াসহ উপকূল থেকে উপকূলে। হাজারো স্বজন হারানোর ব্যাকুলতা আজও উপকূলে ভাসে।

তথ্যমতে, ১২ নভেম্বর সন্ধ্যা থেকে ১৩ নভেম্বর ভোর পর্যন্ত বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) উপকূল অঞ্চলে সর্বকালের প্রাণঘাতি ঘূর্ণিঝড়টি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৮৫ কিলোমিটার গতিবেগে আঘাত হানে। ১৫ থেকে ২৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপগুলো প্লাবিত হয়। এ পর্যন্ত রেকর্ডকৃত ঘূর্ণিঝড়সমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ।

জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) বিশ্বের পাঁচ ধরনের ভয়াবহ প্রাণঘাতি আবহাওয়াজনিত ঘটনার শীর্ষ তালিকায় বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ’৭০ এর ভয়াল ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়টিকে পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতি ঘূর্ণিঝড় হিসেবে উল্লেখ করেছে। এই ঘূর্ণিঝড় ল-ভ- করে দেয় উপকূল। কাঁপিয়ে দেয় বিশ্বকে। বিভাজিত করেছিল পাকিস্তানের ভৌগলিক ইতিহাস। সিম্পসন স্কেলে ক্যাটাগরি ৩ মাত্রার এ ঘূর্ণিঝড়টিকে ‘ভোলা সাইক্লোন’ও বলা হয়। আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি পরোক্ষ কারণ হিসেবে ইতিহাসে লেখা রয়েছে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের ১২ নভেম্বর।

ঘূর্ণিঝড়ের বাতাস, জোয়ার-ভাটার বিস্তৃতি ও লবণাক্ততার প্রভাব এই তিনটি নির্দেশকে উপকূলীয় ১৯টি জেলা আওতাভুক্ত; এর মধ্যে ১৬ জেলা প্রত্যক্ষ উপকূল। এগুলো হলোÑ পূর্ব উপকূলের ৬ জেলা কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুর। মধ্য উপকূলে ৭ জেলা ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, শরীয়তপুর এবং পশ্চিম উপকূলে ৩ জেলা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা। পরোক্ষ উপকূলের মধ্যে বাকি ৩ জেলা যশোর, নড়াইল ও গোপালগঞ্জ অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ।

টেকনাফের নাফ নদের মোহনা থেকে সাতক্ষীরা জেলার সীমান্ত নদী রায়মঙ্গল-কালিন্দী পর্যন্ত উপকূল অঞ্চলের দৈর্ঘ্য ৭১৬ কিলোমিটার। উপকূল সুরক্ষায় এসব অঞ্চলে ক্ষেত্রবিশেষ ছয় থেকে সর্বোচ্চ ১০ মিটার পর্যন্ত টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা প্রয়োজন। উপকূলীয় বাঁধগুলো নির্মাণকাজে যথাযথ তদারকি করলে আশা করা যায় দীর্ঘমেয়াদি টেকসই উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।

উপকূলজুড়ে রয়েছে সংকট ও সমস্যা; তেমনি রয়েছে অবারিত সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিকাশের ধারা। জাতীয় অর্থনীতিতে উপকূল জিডিপির কমবেশি প্রায় ২৫ শতাংশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বিপুল সংখ্যক মৎস্যজীবী সমুদ্র-নদীতে মাছ ধরে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন। সেই আহরিত মাছ জাতীয় অর্থনীতির বড় অংশীদার।

অফুরন্ত সম্ভাবনাময় উপকূলের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ বা চরগুলো যথাযথ কাজে লাগিয়ে ‘দ্বীপ উন্নয়ন বোর্ড’ গঠনের মাধ্যমে উপকূলের জনগণকে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় শামিল করা উচিত। আসন্ন নির্বাচনী ইশতেহারে রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘দ্বীপ উন্নয়ন বোর্ড’ গঠন এবং ‘উপকূল দিবস’ ঘোষণার জোর দাবি জানাই।

উপকূলের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ, উপকূলকে প্রাকৃতিক বিপদ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবমুক্ত রাখা, উপকূলের দিকে নীতিনির্ধারণী মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ, উপকূলের মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা, উপকূলের সব সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক বিকাশের ধারা সুগম করা, উপকূলের দিকে দেশি-বিদেশি প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার নজর বাড়ানো, উপকূলের ইস্যুগুলো জাতির সামনে সহজে তুলে ধরাসহ ’৭০ সালের ১২ নভেম্বরের সাইক্লোনে নিহতদের স্মরণে ‘উপকূল দিবস’ ঘোষণা হলে বিষয়গুলোর গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে।

প্রাথমিকভাবে ২০১৫ সালে উপকূল ফাউন্ডেশন ‘উপকূল দিবস’ এর দাবি তোলে। এ দাবির প্রেক্ষাপটে ২০২০ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান ১২ নভেম্বরকে ‘উপকূল দিবস’ হিসেবে কেবিনেটে উপস্থাপন করার আশ্বাস দেন। কিন্তু এর ফলাফল আজও পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি।

স্বাধীনতার ৫৩ বছর অতিক্রান্ত হলেও ভয়াল ১২ নভেম্বর দুর্যোগের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আজও মেলেনি। উপকূলের প্রায় ৫ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত বহুমুখী দুর্যোগের সঙ্গে বাস করেন। ঝড়-ঝঞ্ঝাসহ বিক্ষুব্ধ এক জনপদের নামই উপকূল। বৈরী প্রতিকূলতা, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, লবণাক্ততার প্রভাব নিয়ে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে ফেরে উপকূলের শ্রমজীবী মানুষ। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, ’৭০-এর ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের বিষয়টি সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে। বাংলাদেশে ‘উপকূল দিবস’ পালন শুরু হলেই বিশ্বে প্রথমবারের মতো এ ধরনের একটি দিবস উদযাপন হবে। শুধু বাংলাদেশের নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই এ দিনটি ‘ওয়ার্ল্ড কোস্টাল ডে’ তথা ‘বিশ্ব উপকূল দিবস’ হওয়া উচিত বলে দাবি রাখে।

[লেখক: উপকূল গবেষক ও চেয়ারম্যান, উপকূল ফাউন্ডেশন; পিএইচডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]

রবিবার, ১২ নভেম্বর ২০২৩ , ২৬ কার্তিক ১৪৩০, ২৬ রবিউস সানি ১৪৪৫

ভয়াল ১২ নভেম্বরে উপকূল ভাবনা

আমীরুল হক পারভেজ

image

১২ নভেম্বর ১৯৭০। উপকূল জীবন ইতিহাসের এক ভয়াবহ কালরাত। এ দিনে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ১০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। উপকূলীয় দ্বীপচরসহ বহু এলাকার ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে বিরাণ জনপদে পরিণত হয়।

সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে ভোলা এবং তৎকালীন নোয়াখালী (নোয়াখালী- লক্ষ্মীপুর) উপকূলে। রামগতি, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, ভোলা এবং পটুয়াখালী পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় উত্তর মনপুরা ঘুরে ঘূর্ণিঝড়ের বিধ্বংসী ও ধ্বংসাত্মক প্রভাবকে ২৮ ফুট লম্বা মনপুরা ’৭০ একটি শিল্পকর্মে চিত্রিত করেন।

জয়নুল বলেন, ‘মনপুরায় আমরা যখন থার্ড ডে তে নামলাম। সি-প্লেনে আমি আর আমার বন্ধু একা ঘুরতাছি সারাদিন। কয়টা লোক বাঁইচা আছে। দেখলাম। দৌড়ায় আসল। দেখলাম জখমওয়ালা। তারা কানতে আরম্ভ করল। আমরাও কানতে আরম্ভ করলাম। আপনারা বিশ্বাস করেন, আমার পেছনে...সমুদ্র...ঠিক সমুদ্র না, সমুদ্রের খাড়ি, যেখানে যান, খালি গরু-মানুষ শুইয়া রইছে।’

মনপুরা দ্বীপের ৩২ হাজার মানুষের মধ্যে ২০ হাজার মানুষ এ ভয়াল রাতে প্রাণ হারায়। তজুমুদ্দিন উপজেলায় ১ লাখ ৬৭ হাজার মানুষের মধ্যে বেঁচে ছিল মাত্র ৭৭ হাজার। সাগর, নদী, খাল-বিলে ভেসেছিল অসংখ্য লাশ। স্বাভাবিকভাবে মৃত দেহের সৎকার করাও সম্ভব হয়নি। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে গণকবরে মাটি চাপা দেয়া হয়েছিল সব দেহের। ঘরবাড়ি, স্বজন হারিয়ে পথে বসেন উপকূলের লাখ লাখ মানুষ। ওই সময়ে মানুষকে আবহাওয়ার পূর্বাভাস সঠিকভাবে জানানো হয়নি। সেই ঘূর্ণিঝড়ের ৫৩ বছর পূর্ণ হলো আজ।

মনপুরার মফিজা খাতুন (৭২) এ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ভেসে সন্দ¦ীপ থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার হয়ে চট্টগ্রাম হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে দেড় মাস পর মনপুরায় ফিরে আসেন। ময়ফুল বেগম (৭৫) তার পরিবারের ১৯ জন সদস্য হারানোর বেদনায় এখনো কাঁদেন। মনপুরার সাবেক চেয়ারম্যান নজির আহমেদও (৮৩) জলোচ্ছ্বাসের বিবরণ দিতে চোখের জল আটকাতে পারেননি। লক্ষ্মীপুরের আব্দুল হক (৭৭) আজও স্ত্রী-সন্তান হারানোর শোক ভুলতে পারেননি। পটুয়াখালীর সাবের মাঝি (৭১) বাবা, মা, ভাই-বোন হারানোর শোকে বিহ্বল! এরকম অসংখ্য আহাজারি চোখে দেখা যায় সন্দ্বীপ, হাতিয়াসহ উপকূল থেকে উপকূলে। হাজারো স্বজন হারানোর ব্যাকুলতা আজও উপকূলে ভাসে।

তথ্যমতে, ১২ নভেম্বর সন্ধ্যা থেকে ১৩ নভেম্বর ভোর পর্যন্ত বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) উপকূল অঞ্চলে সর্বকালের প্রাণঘাতি ঘূর্ণিঝড়টি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৮৫ কিলোমিটার গতিবেগে আঘাত হানে। ১৫ থেকে ২৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপগুলো প্লাবিত হয়। এ পর্যন্ত রেকর্ডকৃত ঘূর্ণিঝড়সমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ।

জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) বিশ্বের পাঁচ ধরনের ভয়াবহ প্রাণঘাতি আবহাওয়াজনিত ঘটনার শীর্ষ তালিকায় বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ’৭০ এর ভয়াল ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়টিকে পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতি ঘূর্ণিঝড় হিসেবে উল্লেখ করেছে। এই ঘূর্ণিঝড় ল-ভ- করে দেয় উপকূল। কাঁপিয়ে দেয় বিশ্বকে। বিভাজিত করেছিল পাকিস্তানের ভৌগলিক ইতিহাস। সিম্পসন স্কেলে ক্যাটাগরি ৩ মাত্রার এ ঘূর্ণিঝড়টিকে ‘ভোলা সাইক্লোন’ও বলা হয়। আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি পরোক্ষ কারণ হিসেবে ইতিহাসে লেখা রয়েছে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের ১২ নভেম্বর।

ঘূর্ণিঝড়ের বাতাস, জোয়ার-ভাটার বিস্তৃতি ও লবণাক্ততার প্রভাব এই তিনটি নির্দেশকে উপকূলীয় ১৯টি জেলা আওতাভুক্ত; এর মধ্যে ১৬ জেলা প্রত্যক্ষ উপকূল। এগুলো হলোÑ পূর্ব উপকূলের ৬ জেলা কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুর। মধ্য উপকূলে ৭ জেলা ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, শরীয়তপুর এবং পশ্চিম উপকূলে ৩ জেলা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা। পরোক্ষ উপকূলের মধ্যে বাকি ৩ জেলা যশোর, নড়াইল ও গোপালগঞ্জ অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ।

টেকনাফের নাফ নদের মোহনা থেকে সাতক্ষীরা জেলার সীমান্ত নদী রায়মঙ্গল-কালিন্দী পর্যন্ত উপকূল অঞ্চলের দৈর্ঘ্য ৭১৬ কিলোমিটার। উপকূল সুরক্ষায় এসব অঞ্চলে ক্ষেত্রবিশেষ ছয় থেকে সর্বোচ্চ ১০ মিটার পর্যন্ত টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা প্রয়োজন। উপকূলীয় বাঁধগুলো নির্মাণকাজে যথাযথ তদারকি করলে আশা করা যায় দীর্ঘমেয়াদি টেকসই উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।

উপকূলজুড়ে রয়েছে সংকট ও সমস্যা; তেমনি রয়েছে অবারিত সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিকাশের ধারা। জাতীয় অর্থনীতিতে উপকূল জিডিপির কমবেশি প্রায় ২৫ শতাংশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বিপুল সংখ্যক মৎস্যজীবী সমুদ্র-নদীতে মাছ ধরে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন। সেই আহরিত মাছ জাতীয় অর্থনীতির বড় অংশীদার।

অফুরন্ত সম্ভাবনাময় উপকূলের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ বা চরগুলো যথাযথ কাজে লাগিয়ে ‘দ্বীপ উন্নয়ন বোর্ড’ গঠনের মাধ্যমে উপকূলের জনগণকে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় শামিল করা উচিত। আসন্ন নির্বাচনী ইশতেহারে রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘দ্বীপ উন্নয়ন বোর্ড’ গঠন এবং ‘উপকূল দিবস’ ঘোষণার জোর দাবি জানাই।

উপকূলের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ, উপকূলকে প্রাকৃতিক বিপদ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবমুক্ত রাখা, উপকূলের দিকে নীতিনির্ধারণী মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ, উপকূলের মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা, উপকূলের সব সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক বিকাশের ধারা সুগম করা, উপকূলের দিকে দেশি-বিদেশি প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার নজর বাড়ানো, উপকূলের ইস্যুগুলো জাতির সামনে সহজে তুলে ধরাসহ ’৭০ সালের ১২ নভেম্বরের সাইক্লোনে নিহতদের স্মরণে ‘উপকূল দিবস’ ঘোষণা হলে বিষয়গুলোর গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে।

প্রাথমিকভাবে ২০১৫ সালে উপকূল ফাউন্ডেশন ‘উপকূল দিবস’ এর দাবি তোলে। এ দাবির প্রেক্ষাপটে ২০২০ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান ১২ নভেম্বরকে ‘উপকূল দিবস’ হিসেবে কেবিনেটে উপস্থাপন করার আশ্বাস দেন। কিন্তু এর ফলাফল আজও পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি।

স্বাধীনতার ৫৩ বছর অতিক্রান্ত হলেও ভয়াল ১২ নভেম্বর দুর্যোগের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আজও মেলেনি। উপকূলের প্রায় ৫ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত বহুমুখী দুর্যোগের সঙ্গে বাস করেন। ঝড়-ঝঞ্ঝাসহ বিক্ষুব্ধ এক জনপদের নামই উপকূল। বৈরী প্রতিকূলতা, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, লবণাক্ততার প্রভাব নিয়ে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে ফেরে উপকূলের শ্রমজীবী মানুষ। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, ’৭০-এর ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের বিষয়টি সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে। বাংলাদেশে ‘উপকূল দিবস’ পালন শুরু হলেই বিশ্বে প্রথমবারের মতো এ ধরনের একটি দিবস উদযাপন হবে। শুধু বাংলাদেশের নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই এ দিনটি ‘ওয়ার্ল্ড কোস্টাল ডে’ তথা ‘বিশ্ব উপকূল দিবস’ হওয়া উচিত বলে দাবি রাখে।

[লেখক: উপকূল গবেষক ও চেয়ারম্যান, উপকূল ফাউন্ডেশন; পিএইচডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]