স্ব-সাহিত্যের মুগ্ধপাঠক মলয় রায়চৌধুরী

সাদ কামালী

ঘরের প্রত্যেকটা দেয়ালে মার্মুখী আয়না লাগিয়ে আমি দেখছি / কয়েকটা ন্যাংটো মলয়কে...

ষাটের দশকের প্রথম ভাগে তুমুল ভিন্নতা নিয়ে আসা কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম কবি-ঔপন্যাসিক মলয় রায়চৌধুরী। কথা বলতে পছন্দ করেন- নিজের কথা, প্রচুর সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, বলেছেন নিরবচ্ছিন্ন নিজের কথা, এমনকী তিনি নিজের সাক্ষাৎকার নিজেই নিয়েছেন ‘আত্ম-সাক্ষাৎকার’। আক্ষেপ করেছেন, আমরা তাঁর সাহিত্য পড়ি না, তাঁর কৃতি সম্পর্কে ঠিকঠাক জানি না বলে। কথা সত্য, তার সঙ্গত কারণ আছে, আমরা স্বাধীন পাঠক ও লেখক নতুনত্বের স্বাদপ্রিয়, আমরা ফাল্গুনী, সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবো আচার্য প্রমুখের লেখা বেশি পড়ব বা অন্য কারও, সেই কৈফিয়ত নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। বহু কথার ভিড়ে প্রবেশের আগে প্রয়োজনীয় একটা কথা বলে নেই, মলয় রায়চৌধুরী হাংরি সাহিত্যের প্রথমদিকের অন্যতম হলেও ২৩/২৪ বছরের মলয় ব্যাংকের বাবু, তার পরিবার সামন্ত জমিদারী ঐতিহ্যের অংশী, বড়ভাই সমীর রায়চৌধুরী অত্যন্ত ভদ্রলোক, সজ্জন এবং বুর্জোয় শিল্পরুচি অনুমোদিত ভাল লেখক, সেই মধ্য কুড়ির মলয় তাঁর এই দাদা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মনে হলেও অন্তর্গতভাবে নয়। হাংরি গঠনের শুরুতে সেই ১৯৬১-৬২ সালে মলয়ের সঙ্গে সমীর রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, দেবী রায়, উৎপলকুমার বসু, ফাল্গুনী, সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবো আচার্য প্রমুখ যুক্ত ছিলেন। আমরা দেখব মলয় দাদা সমীর রায়চৌধুরীর সম্পাদিত কাগজেই নিয়মিত গদ্য পদ্য লিখছেন, ওই ‘হাওয়া ৪৯’-এর অনেকে হাংরি লেখকদের মানুষই মনে করত না। তাই দরকারি কথাটা হলো, মলয় রায়চৌধুরী হাংরি সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত থেকেও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার কথা বলেও বুর্জোয়া রুচিবোধকে ঝেড়ে ফেলতে পারেন না, জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞতসারে তার দ্বারা চালিত হন।

প্রথাপ্রিয় ঐতিহ্যপ্রেমিক সামন্ত বুর্জোয়ারুচির লোভি লেখক বা কবিকুল হাংরি সাহিত্যের বিরুদ্ধে যে নিন্দামুখর ছিলেন তার কারণ তো উক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহের বিপরীতে হাংরিদের ভরসা ও ভাষা, শিল্পরুচি ও নৈতিকতা, জীবন থেকে অভিজ্ঞতা থেকে ছেঁকে তোলা সাহিত্যিকর্ম। মনুষ্য সৃষ্ট কোনো শব্দ বা অভিব্যক্তিকেই হাংরি লেখকেরা অচ্ছুত মনে করেননি। ভদ্রলোকের তৎসম, তদ্ভব শব্দের পাশে, ভদ্রলোকি রুচি অনুমোদিত শব্দের পাশে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই যুৎসই যৌনগন্ধী, ইতরলোকের জন্য বরাদ্দ ভাষা শব্দ বসিয়ে হাংরি লেখকরা নতুন এক অভিঘাত সৃষ্টি করলেন যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী, বাংলা কবিতায়, গদ্যে ভিন্ন দ্যোতনা সৃষ্টি করেছিলেন। এই ভূমিকা বাক্যগুলোর আর বিস্তৃতি না ঘটিয়ে রবীন্দ্রনাথকে সাক্ষ্য মেনে হাংরিদের চিন্তার সমার্থক রবীন্দ্রনাথের কিছু মন্তব্য জানিয়ে রাখি, কারণ রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন মানুষের মুখের ভাষার গুরুত্ব প্রতিষ্ঠানের অনুশাসনের চেয়ে কম মূল্যবান নয়। তিনি বলেন, ‘তৎসম শব্দে আমি নমস্যদের নমস্কার জানাব। কিন্তু তদ্ভব শব্দে অপ-িতদের অধিকার প্রবল, অতএব এখনে আমার মতো মানুষেরও কথা চলবে, কিছু কিছু চালাচ্ছিও। যেখানে মিলছি না সেখানে নিরক্ষরদের সাক্ষ্য মানছি। কেননা অক্ষরকৃত অসত্য ভাষণের দ্বারা তাদের মন মোহগ্রস্ত হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান সমিতির চেয়েও তাদের কথার প্রামাণিকতা যে কম, তা আমি বলব না।’ তিনি বলেন, ‘বানানের ছদ্মবেশ ঘুচিয়ে দিলেই দেখা যাবে, বাংলায় তৎসম শব্দ নেই বললেই হয়। এমনকি কোনো নতুন সংস্কৃত শব্দ আমদানি করলে বাংলার নিয়মে তখনই তা প্রাকৃত রূপ ধরবে।’ আরও বলেন, ‘খাঁটি বাংলাকে বাংলা বলেই যেন লজ্জা না করি, প্রাচীন প্রাকৃত ভাষা যেমন সত্য পরিচয় দিতে লজ্জা করেনি।’ তার আরও একটি কথা প্রাসঙ্গিকতার জন্য এড়ানো যাবে না, তিনি বলেন, ‘যেখানে পারি সেখানে বাংলা উচ্চারণে একমাত্র হ্রস্ব ই-কারকেই মানব’।

হাংরির সমালোচকদের আরও একটি বড় অভিযোগ ছিল হাংরি আন্দোলন বিদেশি সাহিত্যান্দোলনের বদহজম জনিত ‘চুকা ঢেউক’, ‘দর্পণ’ পত্রিকা ১৯৬৪ সালেই ঠিকঠাক (!) জেনেবুঝে লিখে দিয়েছিল, কলকাতার ‘বীট’ আর ‘হাংরি’ জেনারেশন এমনই দুটি হুজুগ পশ্বিমী আন্দোলনের অন্ধ ব্যর্থ অনুকরণ দাসসুলভ হীনমম্মতার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। জামাকাপড় সাজসজ্জা দাড়ি গোঁফে সে এক অপরূপ রূপবান। তার সঙ্গে মদ, বেশ্যাপল্লী, বস্তি, বিবিধ যৌন বিকার বিদেশি উত্তরসূরিদেরও টেক্কা দিয়ে চলল। অবশেষে হাংরি বীট দগদগে ঘা হয়ে ফের বেরুল গল্পে কবিতায় নিবন্ধে, যাকে এরা মলমূত্রের শামিল বলেই মনে করে যা আসইে মলমূত্র।’

এমন অভিযোগ, বিশেষ করে বিদেশের চিন্তা আমদানিকৃত অপবাদটির মূল কারণ মলয় রায়চৌধুরী। সেই সাক্ষ্য মলয়য়ের মুদ্রিত কথা থেকেই বলব যথাসময়ে। হাংরির সামলোচকদের সংকীর্ণ বা আনন্দবাজারীয় মানসিকতায় কল্লোল গোষ্ঠীও নাকি বিকারগ্রস্ত ও অশ্লীল। ভাবতে অবাক লাগে কল্লোলের লেখকদের অনেকেই আজ মহাকাল বিজয়ের পথে, তারা ধ্রুব সাহিত্যের উদাহরণ-

কিন্তু এর সমালোচকরা তো সাহিত্য-ইতিহাসের কোনো পৃষ্ঠায় আসন পেল না।

মলয় রায়চৌধুরী আলোচিত কবিতাটি রচনা করেন ১৯৬৩ সালের শেষ দিকে, প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে হাংরি বুলেটিনে। কবিতাটি কবিতার আদর্শে নয়- নানা বাকভঙ্গি, বাঁকবদলের ইঙ্গিত, ভাষার মুক্তি মানে ভদ্রলোকের শৃঙ্খলামুক্ত ভাষার যুৎসই ব্যবহার ইত্যাদি নানা সদর্থক ভূমিকা সত্ত্বেও এর গভীরতার জায়গাটিতে উপরিতলের সুড়সড়ি যেন টিকে থাকল। বলার অপেক্ষা রাখে না কবিতাটি ‘প্রচ- বৈদ্যুতিক ছুতার’ আজ অন্য প্রধান হাংরি কবিতার পাশে নিয়ে পড়তে গেলে বাধা হয়ে দাঁড়ায় মলয়ের গভীর জীবন দর্শনজাত অবস্থার সঙ্গে বিরোধপূর্ণ সংঘাতের কারণে। একটু খোলাসা করি বলি, এক : মলয়-এর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ ‘শয়তানের মুখ’ ১৯৬৩ সালে, যে বৎসর তিনি ‘প্রচ- বৈদ্যুতিক ছুতার’ লেখেন। কিন্তু ‘শয়তানের মুখ’কে প্রকাশ করতে দেন আনন্দ বাগচি ও সুনীল বাবুদের কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে। দুজন লেখকই তখন নামে বেনামে আনন্দবাজার ও দেশের নিয়মিত লেখক। ঠিক একই সময়ে সুনীল কৃত্তিবাসের সম্পাদক হন ও আনন্দবাজারের চাকুরে হন। এ বিষয়ে মলয়কে প্রশ্ন করা হলে আমাদের বিভ্রান্ত করার প্রয়াস পান, মনে রাখতে হবে তখন সুনীল নন, আনন্দবাগচীই ছিলেন কৃত্তিবাসের সম্পাদক। আনন্দ বাবু তো আনন্দেরই সন্তান তা কী-সজ্জ্বল দত্ত প্রশ্নকর্তা জানে না! তরুণ সজ্জ্বল ব্যারাকপুরের স্মার্ট যুবক না জানলেও মলয়ের সতীর্থ সব লেখকই সব জানত, আজকের পাঠক জানে সব। সুনীল বাব কৃত্তিবাসের তখন প্রকাশক ছিলেন অল্প পরেই তিনি সম্পাদকও হন।

দুই : প্রচ- বৈদ্যুতিক ছুতার প্রকাশের কিছু পরে অশ্লীলতা এবং যুবামানসকে বিপদগামী করার রসদ আছে ওই কবিতায়, তাই তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। তখন মলয় রায়চৌধুরী রিজার্ভ ব্যাংকের বাতিল নোট পোড়ানোর তত্ত্বাবধায়কের সরকারি চাকরি করেন। ৩৫ মাস মামলা চলে। সরকারি চাকরি এই ৩৫ মাসেও যায় না, তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল শুধু। তিনি মামলা জিতে যান বলে থাকেন। তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে অশ্লীলতা নৈতিকতার লঙ্ঘন বিপদগামী করার কোনো প্রমাণ পায়নি সরকারি কৌসুলি! প্রকৃত সত্য তিনি নিজেই বলেছেন, আমরাও জানি যে তিনি মুচালেকাতে সই করে বা ‘নাকক্ষত’ দিয়ে জানিয়েছেন হাংরি সাহিত্যের সঙ্গে তার আর সম্পর্ক থাকবে না। তিনি এসব লিখবেনও না এবং দীর্ঘদিন আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি আর লেখেনও নি, সেই ১৯৬৪ থেকে ৩৫ মাস তো মামলাই চলল। তার ভিতরের বুর্জোয়া রুচিবোধ, মানসিকতার প্রকাশ তার সাহিত্যে শুধু নয়, কথায় ও জীবনযাপনে অল্পবিস্তর নয়। যাইহোক লক্ষ করার বিষয়- যার বিরুদ্ধে ঘোরতর অভিযোগ উঠেছিল- তার সরকারি চাকরি ৩৫ মাস টিকে থাকে। মামলা মুক্ত হওয়ার পর সরকারি স্থগিতাদেশ উঠে যায়, উনি আবার সরকারি চাকুরে হন। কিন্তু হাংরি লেখক বা জেনারেশনের পিঠে চুরিকাঘাত করার কারণে তিনি আর বাংলায় নিরাপদ বোধ করেন না। এনজিও-র চাকরি মানে এনআরডিসির গ্রামীণ উন্নয়নের আধিকারিক হয়ে লখনউচলে যান। পরে এই এনআরডিসি’র বিভাগীয় প্রধান হয়ে কালকাতায় এসেছিলেন। লেখকদের সাহিত্য আড্ডা থেকে দূরে দূরে থেকেছেন। পরে অবশ্য ভালো চিকিৎসা পাবেন এই ভরসায় কলকাতা পাটনা ছেড়ে মুম্বাই ফ্ল্যাট কিনে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। অবশ্য ১৯৮৮ সালেই নাকতলায় ফ্ল্যাট বাড়ি কিনেছিলেন। মাঝে মাঝে সেখানে থাকতেন। পিসেমশায় মৃত্যুর পর কলকাতায় তার আর বিশেষ আত্মীয়স্বজন ছিল না। আর গোঁড়া সাবর্ণ রায়চৌধুরীর ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নেয়া কবি মলয়কে তাদের আদি বাড়ি উত্তরপাড়ার জমিদারি খ-হর থাকতে হতো, কিন্তু সেখানে কলকাতা শহরের জল বিদ্যুৎসহ অনেক ব্যবস্থাই ছিল না।

লক্ষ করবার বিষয় এই জীবনযাপন, চাকরি, সুচিকিৎসা, আধুনিক সুযোগ সুবিধায় থাকতে অভ্যস্ত কবি মলয় রায়চৌধুরী না হাংরি, না ক্ষুধার্ত, না কোনো আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত থেকেছেন। শুরুর সেই বাঁক ফেরার নতুন স্বর ভাষা ও কাব্য চিন্তার মুক্তভাবনার প্রচ- বৈদ্যুতিক ছুতার কবিতার মতো!!! কবি সোনালী মিত্র প্রশ্ন করেছিলেন, বিতর্ক হয়েছিল বলে কবিতাটা বিখ্যাত হয়েছিল? নাকি মলয় রায়চৌধুরীর সব প্রতিভা ঢাকা পড়ে গেল ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতারের’ সৌজন্যে? নানা সংশয় ও দ্বিধায় ভরা এই প্রশ্নের উত্তরে মলয় যা বললেন তা এর উত্তর নয়, উত্তরের প্রথম অংশ হলো কবিতাটি প্রকাশের পর মামলা, সরকারি স্থগিতাদেশ, আর্থিক সংকটে থেকে লেখক বন্ধুদের অসহযোগিতা এবং বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়। বন্ধুদের শত্রুতার প্রশ্নে তিনি বহুবার তথ্যহীন প্রমাণহীন একটা একটা খবর রটিয়েছেন- যে শৈলেশ্বর ঘোষ, ফালগুনী রায়, সুভাষ ঘোষ প্রমুখ আদালতের ট্রেজারি থেকে টাকা নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে। সেজন্য শেষদিন পর্যন্ত শৈলেশ্বর তাঁকে ক্ষমা করেননি। এমনকি, মলয় জানাচ্ছেন শৈলেশ্বর মুত্যুর আগে মেয়েকে বলে গিয়েছিলেন মলয়ের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না করতে। প্রকৃত তথ্য হাংরির লেখকগণ শৈলেশ্বর প্রমুখ পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন মলয় রায়চৌধুরী হাংরির কেউ নন, তাঁর সঙ্গে হাংরি সাহিত্যিকদের সম্পর্ক নেই। এই ঘোষণা বা সাক্ষ্য এবং মলয়-এর মুচলেকা সাহায্য করে মামলা থেকে মুক্ত হতে।

তিন : সাক্ষ্যাৎদানে উদার মলয় রায়চৌধুরী বিশেষ করে শেষ জীবনে বহু সাক্ষাৎকারে বলেছেন, লিখিত প্রশ্নের উত্তর লিখে জানিয়েছেন। এমনকী তিনি সম্পাদকের ইচ্ছেমতো নিজের সাক্ষাৎকার নিজেই নিয়েছেন। নিজেই প্রশ্ন করে উত্তর লিখছেন- আত্মপ্রেম বা হাংরির ভাষায় স্বমেহন স্বমৈথুনে তিনি কখনো ক্লান্ত নন।

তরুণ কবি সংস্কৃতি কর্মী সজ্জ্বল দত্ত ব্যারাকপুর স্টেশন কবিতা পত্রিকার পক্ষ থেকে প্রশ্ন লিখে পাঠিয়েছিলেন। সেই প্রশ্নসমূহ পেয়ে মলয় রায়চৌধুরী বলেন, ‘প্রশ্নগুলো পড়ে বুঝতে পারলুম যে তোমরা আমার বইপত্র পড়োনি, কেননা কোনো প্রশ্নই আমার বই পড়ে করা হয়নি। যাইহোক সোনালী মিত্রকেও একই কথা বলেছিলেন। সজ্জ্বল দত্তের একটি বিশেষ প্রাসঙ্গিক প্রশ্নে যাওয়ার আগে মলয় রায়চৌধুরীর সাহিত্য সম্পর্কে আমার ধারণা মতে, একটি প্রয়োজনীয় কথা বলে নিতে চাই- তা হলো- মলয়-এর সাহিত্য পড়ার আগে দুই বা তিনটি বিষয় মন থেকে সম্পূর্ণ সরিয়ে নিতে পারলে সাহিত্যরসের খুব ব্যাঘাত ঘটবে না। মলয়-এর উপন্যাস, কবিতা, নিবন্ধ, নাটক পড়ার সময় ভুলে যেতে হবে তিনি একদা পাটনার ইমলিতলার মুসলিম পল্লীতে অত্যন্ত আর্থিক সংকটের মধ্যে বড় হতে হতে, শূকর পোড়া, ইঁদুর পোড়া মাংস খেয়ে সস্তা লোকাল মদ পান করে যৌবনে সাহিত্য রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। তিনি একদা হাংরি সাহিত্যিকদের সূচনার লেখককুলের একজন। হাংরির সাহিত্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ হলে বা ওই সময়ের তরুণদের সাহিত্য প্রবণতা সম্পর্কে সচেতন না থাকলে তাঁর সাহিত্যের ভিন্নস্বাদ উপভোগ করা যায়। একজন পাঠক হিসেবে মলয়কে আমি উপন্যাস রচয়িতা হিসেবে বেশি নম্বর দেই। উপন্যাস বা বড় গল্প বা নভেলা যাইহোক, ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’, ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ বা তার জীবনীগ্রন্থ ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ উল্লেখ করার মতো। পরে মলয় গর্ব করে বলেন, ছোটোলোকের ছোটোবেলার চারটি মুদ্রণের পর কলকাতার প্রকাশক ‘প্রতিভাস’ প্রকাশ করে ‘ছোটোলোকের জীবন’ এই নতুন নামে। প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান তাঁর বই বের করে না। কেউ তাঁর বই পড়ে না এই অভিযোগ তিনি প্রত্যেক আলাপে জানিয়েছেন বড়ো আক্ষেপের সঙ্গে। কোনো প্রতিষ্ঠানবিরোধীর মনে এমন আক্ষেপ থাকে ভাই!

সজ্জ্বলের নানা প্রশ্নের ভিড় থেকে একটা প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন আমরা দেখে নেব, কারণ এই প্রশ্নের ভিতর মলয় সম্পর্কে প্রশ্ন ও সংশয়গুলো ডুবসাতাঁর করে যাচ্ছে- আরও একটি বৈশিষ্ট্য সজ্জ্বলের প্রশ্ন করার ভাষা ও ধরনের মধ্যে আছে তা হলো- কলকাতার সৃষ্টিশীল তরুণদের ভাঁড়ামিমুক্ত ন্যাকামিমুক্ত সরাসরি জিজ্ঞাসা, এবং বয়স হলেই সাহিত্য বা জীবনবোধের বিবেচনায় সবাই নমস্য, সমালোচনার ঊর্ধ্বে চলে যায় না। মলয় রায়চৌধুরীর মৃত্যুর কয়েকমাস আগে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রশ্নটি এমন- ‘ক্ষুধার্ত মানে প্যাটের না চ্যাটের ক্ষুধা? আপনার সম্পূর্ণ সাহিত্যযাপন অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে অনুসরণ করলে এই প্রশ্ন কিন্তু বহু পাঠকের মনে অবধারিত হয়ে উঠে আসবেই- মলয় দা আপনার কবিতা কি আদৌও বুভুক্ষদের কথা বলে নাকি অহেতুক যৌনক্ষুধাকে গুরুত্ব দ্যায়?’ সজ্জ্বলের এমন সরাসরি ক্ষুরধার প্রশ্নের উত্তরে হতচকিত ম্লান মলয় উত্তরে আক্ষেপবশত কিছু অসত্য বক্তব্য লিখে ফেলেন। তিনি বলেন, হুবহু তুলে ধরছি,- “কী আর বলি, আমার লেখাপত্র তো পড়ো না। পড়লে জানতে হাংরি শব্দটা কোথা থেকে পেয়েছিলুম। আর আন্দোলনের তাত্ত্বিক বনেদ কী ছিল। আমি ‘ক্ষুধা’ শব্দটা ব্যবহার করিনি চিরকাল, হাংরি শব্দটাই ব্যবহার করেছি। হাংরি শব্দটা প্রথম পেয়েছিলুম কবি জিওফ্রে চসারের ‘In swore hungry time’ বাক্যটি থেকে। আর আন্দোলনের তত্ত্ব গড়েছিলুম অসওয়ালড স্পেঙ্গলারের লেখা ‘The Dccline of the west’ বইটি থেকে। স্পেঙ্গলারের তত্ত্বের সারমর্ম হলো...’ ঠিক এই কারণে হাংরি আন্দোলনে বিদেশি তত্ত্বের অনুকরণের অভিযোগ উঠেছিল।

এ ছাড়াও মলয় বলেন, ক্ষুধার্ত শব্দটি আমি কখনো ব্যবহার করিনি, শৈলেশ্বর ও সুভাষ ঘোষ হাংরি শব্দ ব্যবহারে ভয় পেয়ে ক্ষুধার্ত ব্যবহার করত।’ এসব মন্তব্যের মধ্যে অসত্য ও ইতিহাসকে অস্বীকার করা ছাড়াও আমিত্বের আস্ফালন দৃষ্টি এড়ায় না। এ প্রসঙ্গে বহু কথা ভিড় করে আসছে, কিন্তু বন্ধুর কাগজের কলেবরকে গ্রাহ্য করে আর বিস্তৃত না করে বলব, ১৯৬৪ সালেই শৈলেশ্বর লিখেছিলেন, ‘হাংরি জেনারেশনের আন্দোলন’ গ্রন্থের আন্দোলনের নানা গদ্য। সুভাষ ঘোষ লিখেছেন ‘তিন দশকের হাংরি জেনারেশন’ অব্যয় থেকে ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত সমীরণ ঘোষের ‘হাংরি জেনারেশন ও জেনারেশন গ্যাপ’ ইত্যাদি, মানে শৈলেশ্বর প্রমুখ প্রথম থেকেই ‘হাংরি’ শব্দটি ব্যবহার করে আসছেন। তাদের প্রকাশনা সংস্থার নাম ছিল ক্ষুধার্ত। তবে ক্ষুধার্ত বললেই হাংরির বিশিষ্টতা যেমন ক্ষুণ্ণ হয় না, তেমনি ক্ষুধার্ত শব্দের বাঙ্ময়তা, দ্ব্যর্থতা আরও যুৎসই হয়ে ওঠে। মলয় বলেন, কলকাতার কবি লেখক এমনকি লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকরাও হাংরি শব্দ বা মলয় রায়চৌধুরীর নাম করত না ভয়ে। লখনউ বসে এনজিও’র কর্মকর্তা মলয়বাবু হয়তো নিজের বাইরে অন্য কোনো খবর নেবার ফুরসত পাননি, তাই তিনি যেমন সোনালী মিত্রকে বলেছিলেন ‘প্রচ- বৈদ্যুতিক ছুতার’ প্রকাশের পনের বছর পর বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিনগুলো আমার লেখা প্রকাশ করতে থাকেন। ‘মিজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক’ পত্রিকায় মিজানুর রহমান ধারাবাহিকভাবে ‘হাংরি কিংবদন্তি’ প্রকাশ করতে থাকেন। আর কলকাতার লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকরা বাংলাদেশে আমার কবিতা প্রকাশের ১০ বছর পর আমার কবিতা প্রকাশ করতে সাহস করেন। মলয় নিজেই মামলায় নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন তাঁর বিতর্কিত ...ছুতার কবিতা থেকে, তাহলে অন্যদের ভয় তাঁর কবিতা নিয়ে কেন হবে?

মলয় তার সাক্ষাৎকারে আরও একটি বিপজ্জনক মন্তব্য করেন নিঃসংশয়ে। যথারীতি কোনো তথ্য প্রমাণ ছাড়াই। দায়ীত্বহীন মন্তব্যের জন্য কলকাতায় জবাবদিহি চাওয়ার কেউ ছিল না, কিন্তু বাংলাদেশে তাকে কারও না কারও কাছে জবাবদিহি করতেই হতো। তিনি বলেন, মিজানুর রহমান আমার ‘হাংরি কিংবদন্তি’ গ্রন্থাকারে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কৃত্তিবাসের লেখকদের প্রধানত সুনীলের কথায় শামসুর রাহমান নাকি ওই গ্রন্থ প্রকাশে বাধা দিয়েছেন। এমন খবরটির জন্য কিছু প্রমাণ আমরা দেখে নিতে চাইতেই পারি মলয়দা।

সবশেষে দরকারি কথাটি হলো শক্তি চট্টোপাধ্যায়, ‘হাংরি’ এবং ‘ক্ষুধার্ত’ এই দুটি শব্দই আন্দোলনের প্রসঙ্গে ১৯৬২ সালে প্রথম ব্যবহার করেন ‘সম্প্রতি’ কাগজের জন্য বিনয় মজুমদারের কবিতাগ্রন্থ আলোচনা প্রসঙ্গে। শক্তির উদ্ধৃতি বহু জানা, তাই সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ‘এষণা’ পত্রিকায় লেখা থেকে বলি, ‘শক্তি চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত হাংরি জেনারেশনের কোনো মুখপত্র নেই- বস্তুত হাংরি জেনারেশন একটা আইডিয়া- যার বিষয়ে শক্তি গ্রন্থ সমালোচনা করতে গিয়ে প্রথমে কিছু লেখেন। শক্তি খুবই অন্যমনস্ক বা অপ্রাসঙ্গিকভাবে কিছু লেখেন। আমরা বন্ধুরা কেউই জানতাম না শক্তি এরকমই ভাবছে,... পাটনা থেকে মলয় রায়চৌধুরী নামক এক অজ্ঞাত যুবক এর নেতৃত্ব কিছুদিন করেন; কিন্তু হাংরি জেনারেশন এমন এক জিনিস যে কারো হাতেই নেতৃত্ব বেশিদিন থাকে না। শক্তি কখনো কোনোকালেই হাংরি আন্দোলন পরিচালিত করেননি। তিনি শুধু আলোচনায় হাংরি, ক্ষুধার্ত শব্দটি ব্যবহার করেছেন মাত্র। পরে লিখিতভাবে জানিয়েছেন তার সাথে হাংরি আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই। মলয় দাবি করছেন তিনি হাংরির স্রষ্টা। হাংরি জেনারেশনের প্রথম লিফলেটে নভেম্বর ১৯৬ তে বলা হয়েছিল Led reliettiously by Shakti Chattapadhaya. শৈলেশ্বরের ভাষায় ‘চুলকে দেওয়া’ হাংরি জেনারেশনকে হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের সূচনাপর্ব বলা যেতে পারে, যা মূলত ইস্তেহার আন্দোলন। সেই সময়ের ১৯৬১-৬২ থেকে ১৯৬৩ পর্যন্ত ওই অবস্থার পর সত্যিকার সাহিত্য আন্দোলনের আদর্শমুখী প্রচুর লেখা তৈরি হতে থাকে। যদিও তখন ১৯৬৩ সালেই শক্তি বলতে শুরু করেছিলেন, ‘হাংরি জেনারেশন ইজ ডেড’।

দেশ পত্রিকায় ১৯৯৫ সালে শঙ্খ ঘোষ লেখেন ‘হাংরি জেনারেশন তাই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটা সূচনাবিন্দু মাত্র ছুঁয়ে থাকে, তার কবিতার প্রধান শক্তি হতে পারে না সেটা। হাংরি নাম নিয়ে আন্দোলনটি তৈরি হবে অল্পপরের বাংলা কবিতায় ‘বস্তুসমূহের ষড়যন্ত্রময় অবস্থান ভেঙে দিতে চায়’, যে আন্দোলন ‘আধুনিকতার শবদেহের উপর উল্লাসময় নৃত্য’ করতে চায়, যথার্থ সেই হাংরিদের সঙ্গে শক্তির তাই যোগ থাকবে না কিছু, অল্প পরে তাদের কাছেও অগ্রাহ্য হয়ে যাবে তার (শক্তি) লেখা। (“) উদ্ধৃতি চিহ্নের কথাগুলো হাংরি সাহিত্য আন্দোলনের প্রাণপুরুষ কবি শৈলেশ্বর ঘোষের।

বৃহস্পতিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৩ , ৩০ কার্তিক ১৪৩০, ৩০ রবিউস সানি ১৪৪৫

স্ব-সাহিত্যের মুগ্ধপাঠক মলয় রায়চৌধুরী

সাদ কামালী

image

মলয় রায়চৌধুরী / জন্ম : ২৯ অক্টোবর ১৯৩৯; মৃত্যু : ২৬ অক্টোবর ২০২৩

ঘরের প্রত্যেকটা দেয়ালে মার্মুখী আয়না লাগিয়ে আমি দেখছি / কয়েকটা ন্যাংটো মলয়কে...

ষাটের দশকের প্রথম ভাগে তুমুল ভিন্নতা নিয়ে আসা কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম কবি-ঔপন্যাসিক মলয় রায়চৌধুরী। কথা বলতে পছন্দ করেন- নিজের কথা, প্রচুর সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, বলেছেন নিরবচ্ছিন্ন নিজের কথা, এমনকী তিনি নিজের সাক্ষাৎকার নিজেই নিয়েছেন ‘আত্ম-সাক্ষাৎকার’। আক্ষেপ করেছেন, আমরা তাঁর সাহিত্য পড়ি না, তাঁর কৃতি সম্পর্কে ঠিকঠাক জানি না বলে। কথা সত্য, তার সঙ্গত কারণ আছে, আমরা স্বাধীন পাঠক ও লেখক নতুনত্বের স্বাদপ্রিয়, আমরা ফাল্গুনী, সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবো আচার্য প্রমুখের লেখা বেশি পড়ব বা অন্য কারও, সেই কৈফিয়ত নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। বহু কথার ভিড়ে প্রবেশের আগে প্রয়োজনীয় একটা কথা বলে নেই, মলয় রায়চৌধুরী হাংরি সাহিত্যের প্রথমদিকের অন্যতম হলেও ২৩/২৪ বছরের মলয় ব্যাংকের বাবু, তার পরিবার সামন্ত জমিদারী ঐতিহ্যের অংশী, বড়ভাই সমীর রায়চৌধুরী অত্যন্ত ভদ্রলোক, সজ্জন এবং বুর্জোয় শিল্পরুচি অনুমোদিত ভাল লেখক, সেই মধ্য কুড়ির মলয় তাঁর এই দাদা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মনে হলেও অন্তর্গতভাবে নয়। হাংরি গঠনের শুরুতে সেই ১৯৬১-৬২ সালে মলয়ের সঙ্গে সমীর রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, দেবী রায়, উৎপলকুমার বসু, ফাল্গুনী, সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবো আচার্য প্রমুখ যুক্ত ছিলেন। আমরা দেখব মলয় দাদা সমীর রায়চৌধুরীর সম্পাদিত কাগজেই নিয়মিত গদ্য পদ্য লিখছেন, ওই ‘হাওয়া ৪৯’-এর অনেকে হাংরি লেখকদের মানুষই মনে করত না। তাই দরকারি কথাটা হলো, মলয় রায়চৌধুরী হাংরি সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত থেকেও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার কথা বলেও বুর্জোয়া রুচিবোধকে ঝেড়ে ফেলতে পারেন না, জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞতসারে তার দ্বারা চালিত হন।

প্রথাপ্রিয় ঐতিহ্যপ্রেমিক সামন্ত বুর্জোয়ারুচির লোভি লেখক বা কবিকুল হাংরি সাহিত্যের বিরুদ্ধে যে নিন্দামুখর ছিলেন তার কারণ তো উক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহের বিপরীতে হাংরিদের ভরসা ও ভাষা, শিল্পরুচি ও নৈতিকতা, জীবন থেকে অভিজ্ঞতা থেকে ছেঁকে তোলা সাহিত্যিকর্ম। মনুষ্য সৃষ্ট কোনো শব্দ বা অভিব্যক্তিকেই হাংরি লেখকেরা অচ্ছুত মনে করেননি। ভদ্রলোকের তৎসম, তদ্ভব শব্দের পাশে, ভদ্রলোকি রুচি অনুমোদিত শব্দের পাশে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই যুৎসই যৌনগন্ধী, ইতরলোকের জন্য বরাদ্দ ভাষা শব্দ বসিয়ে হাংরি লেখকরা নতুন এক অভিঘাত সৃষ্টি করলেন যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী, বাংলা কবিতায়, গদ্যে ভিন্ন দ্যোতনা সৃষ্টি করেছিলেন। এই ভূমিকা বাক্যগুলোর আর বিস্তৃতি না ঘটিয়ে রবীন্দ্রনাথকে সাক্ষ্য মেনে হাংরিদের চিন্তার সমার্থক রবীন্দ্রনাথের কিছু মন্তব্য জানিয়ে রাখি, কারণ রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন মানুষের মুখের ভাষার গুরুত্ব প্রতিষ্ঠানের অনুশাসনের চেয়ে কম মূল্যবান নয়। তিনি বলেন, ‘তৎসম শব্দে আমি নমস্যদের নমস্কার জানাব। কিন্তু তদ্ভব শব্দে অপ-িতদের অধিকার প্রবল, অতএব এখনে আমার মতো মানুষেরও কথা চলবে, কিছু কিছু চালাচ্ছিও। যেখানে মিলছি না সেখানে নিরক্ষরদের সাক্ষ্য মানছি। কেননা অক্ষরকৃত অসত্য ভাষণের দ্বারা তাদের মন মোহগ্রস্ত হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান সমিতির চেয়েও তাদের কথার প্রামাণিকতা যে কম, তা আমি বলব না।’ তিনি বলেন, ‘বানানের ছদ্মবেশ ঘুচিয়ে দিলেই দেখা যাবে, বাংলায় তৎসম শব্দ নেই বললেই হয়। এমনকি কোনো নতুন সংস্কৃত শব্দ আমদানি করলে বাংলার নিয়মে তখনই তা প্রাকৃত রূপ ধরবে।’ আরও বলেন, ‘খাঁটি বাংলাকে বাংলা বলেই যেন লজ্জা না করি, প্রাচীন প্রাকৃত ভাষা যেমন সত্য পরিচয় দিতে লজ্জা করেনি।’ তার আরও একটি কথা প্রাসঙ্গিকতার জন্য এড়ানো যাবে না, তিনি বলেন, ‘যেখানে পারি সেখানে বাংলা উচ্চারণে একমাত্র হ্রস্ব ই-কারকেই মানব’।

হাংরির সমালোচকদের আরও একটি বড় অভিযোগ ছিল হাংরি আন্দোলন বিদেশি সাহিত্যান্দোলনের বদহজম জনিত ‘চুকা ঢেউক’, ‘দর্পণ’ পত্রিকা ১৯৬৪ সালেই ঠিকঠাক (!) জেনেবুঝে লিখে দিয়েছিল, কলকাতার ‘বীট’ আর ‘হাংরি’ জেনারেশন এমনই দুটি হুজুগ পশ্বিমী আন্দোলনের অন্ধ ব্যর্থ অনুকরণ দাসসুলভ হীনমম্মতার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। জামাকাপড় সাজসজ্জা দাড়ি গোঁফে সে এক অপরূপ রূপবান। তার সঙ্গে মদ, বেশ্যাপল্লী, বস্তি, বিবিধ যৌন বিকার বিদেশি উত্তরসূরিদেরও টেক্কা দিয়ে চলল। অবশেষে হাংরি বীট দগদগে ঘা হয়ে ফের বেরুল গল্পে কবিতায় নিবন্ধে, যাকে এরা মলমূত্রের শামিল বলেই মনে করে যা আসইে মলমূত্র।’

এমন অভিযোগ, বিশেষ করে বিদেশের চিন্তা আমদানিকৃত অপবাদটির মূল কারণ মলয় রায়চৌধুরী। সেই সাক্ষ্য মলয়য়ের মুদ্রিত কথা থেকেই বলব যথাসময়ে। হাংরির সামলোচকদের সংকীর্ণ বা আনন্দবাজারীয় মানসিকতায় কল্লোল গোষ্ঠীও নাকি বিকারগ্রস্ত ও অশ্লীল। ভাবতে অবাক লাগে কল্লোলের লেখকদের অনেকেই আজ মহাকাল বিজয়ের পথে, তারা ধ্রুব সাহিত্যের উদাহরণ-

কিন্তু এর সমালোচকরা তো সাহিত্য-ইতিহাসের কোনো পৃষ্ঠায় আসন পেল না।

মলয় রায়চৌধুরী আলোচিত কবিতাটি রচনা করেন ১৯৬৩ সালের শেষ দিকে, প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে হাংরি বুলেটিনে। কবিতাটি কবিতার আদর্শে নয়- নানা বাকভঙ্গি, বাঁকবদলের ইঙ্গিত, ভাষার মুক্তি মানে ভদ্রলোকের শৃঙ্খলামুক্ত ভাষার যুৎসই ব্যবহার ইত্যাদি নানা সদর্থক ভূমিকা সত্ত্বেও এর গভীরতার জায়গাটিতে উপরিতলের সুড়সড়ি যেন টিকে থাকল। বলার অপেক্ষা রাখে না কবিতাটি ‘প্রচ- বৈদ্যুতিক ছুতার’ আজ অন্য প্রধান হাংরি কবিতার পাশে নিয়ে পড়তে গেলে বাধা হয়ে দাঁড়ায় মলয়ের গভীর জীবন দর্শনজাত অবস্থার সঙ্গে বিরোধপূর্ণ সংঘাতের কারণে। একটু খোলাসা করি বলি, এক : মলয়-এর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ ‘শয়তানের মুখ’ ১৯৬৩ সালে, যে বৎসর তিনি ‘প্রচ- বৈদ্যুতিক ছুতার’ লেখেন। কিন্তু ‘শয়তানের মুখ’কে প্রকাশ করতে দেন আনন্দ বাগচি ও সুনীল বাবুদের কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে। দুজন লেখকই তখন নামে বেনামে আনন্দবাজার ও দেশের নিয়মিত লেখক। ঠিক একই সময়ে সুনীল কৃত্তিবাসের সম্পাদক হন ও আনন্দবাজারের চাকুরে হন। এ বিষয়ে মলয়কে প্রশ্ন করা হলে আমাদের বিভ্রান্ত করার প্রয়াস পান, মনে রাখতে হবে তখন সুনীল নন, আনন্দবাগচীই ছিলেন কৃত্তিবাসের সম্পাদক। আনন্দ বাবু তো আনন্দেরই সন্তান তা কী-সজ্জ্বল দত্ত প্রশ্নকর্তা জানে না! তরুণ সজ্জ্বল ব্যারাকপুরের স্মার্ট যুবক না জানলেও মলয়ের সতীর্থ সব লেখকই সব জানত, আজকের পাঠক জানে সব। সুনীল বাব কৃত্তিবাসের তখন প্রকাশক ছিলেন অল্প পরেই তিনি সম্পাদকও হন।

দুই : প্রচ- বৈদ্যুতিক ছুতার প্রকাশের কিছু পরে অশ্লীলতা এবং যুবামানসকে বিপদগামী করার রসদ আছে ওই কবিতায়, তাই তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। তখন মলয় রায়চৌধুরী রিজার্ভ ব্যাংকের বাতিল নোট পোড়ানোর তত্ত্বাবধায়কের সরকারি চাকরি করেন। ৩৫ মাস মামলা চলে। সরকারি চাকরি এই ৩৫ মাসেও যায় না, তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল শুধু। তিনি মামলা জিতে যান বলে থাকেন। তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে অশ্লীলতা নৈতিকতার লঙ্ঘন বিপদগামী করার কোনো প্রমাণ পায়নি সরকারি কৌসুলি! প্রকৃত সত্য তিনি নিজেই বলেছেন, আমরাও জানি যে তিনি মুচালেকাতে সই করে বা ‘নাকক্ষত’ দিয়ে জানিয়েছেন হাংরি সাহিত্যের সঙ্গে তার আর সম্পর্ক থাকবে না। তিনি এসব লিখবেনও না এবং দীর্ঘদিন আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি আর লেখেনও নি, সেই ১৯৬৪ থেকে ৩৫ মাস তো মামলাই চলল। তার ভিতরের বুর্জোয়া রুচিবোধ, মানসিকতার প্রকাশ তার সাহিত্যে শুধু নয়, কথায় ও জীবনযাপনে অল্পবিস্তর নয়। যাইহোক লক্ষ করার বিষয়- যার বিরুদ্ধে ঘোরতর অভিযোগ উঠেছিল- তার সরকারি চাকরি ৩৫ মাস টিকে থাকে। মামলা মুক্ত হওয়ার পর সরকারি স্থগিতাদেশ উঠে যায়, উনি আবার সরকারি চাকুরে হন। কিন্তু হাংরি লেখক বা জেনারেশনের পিঠে চুরিকাঘাত করার কারণে তিনি আর বাংলায় নিরাপদ বোধ করেন না। এনজিও-র চাকরি মানে এনআরডিসির গ্রামীণ উন্নয়নের আধিকারিক হয়ে লখনউচলে যান। পরে এই এনআরডিসি’র বিভাগীয় প্রধান হয়ে কালকাতায় এসেছিলেন। লেখকদের সাহিত্য আড্ডা থেকে দূরে দূরে থেকেছেন। পরে অবশ্য ভালো চিকিৎসা পাবেন এই ভরসায় কলকাতা পাটনা ছেড়ে মুম্বাই ফ্ল্যাট কিনে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। অবশ্য ১৯৮৮ সালেই নাকতলায় ফ্ল্যাট বাড়ি কিনেছিলেন। মাঝে মাঝে সেখানে থাকতেন। পিসেমশায় মৃত্যুর পর কলকাতায় তার আর বিশেষ আত্মীয়স্বজন ছিল না। আর গোঁড়া সাবর্ণ রায়চৌধুরীর ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নেয়া কবি মলয়কে তাদের আদি বাড়ি উত্তরপাড়ার জমিদারি খ-হর থাকতে হতো, কিন্তু সেখানে কলকাতা শহরের জল বিদ্যুৎসহ অনেক ব্যবস্থাই ছিল না।

লক্ষ করবার বিষয় এই জীবনযাপন, চাকরি, সুচিকিৎসা, আধুনিক সুযোগ সুবিধায় থাকতে অভ্যস্ত কবি মলয় রায়চৌধুরী না হাংরি, না ক্ষুধার্ত, না কোনো আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত থেকেছেন। শুরুর সেই বাঁক ফেরার নতুন স্বর ভাষা ও কাব্য চিন্তার মুক্তভাবনার প্রচ- বৈদ্যুতিক ছুতার কবিতার মতো!!! কবি সোনালী মিত্র প্রশ্ন করেছিলেন, বিতর্ক হয়েছিল বলে কবিতাটা বিখ্যাত হয়েছিল? নাকি মলয় রায়চৌধুরীর সব প্রতিভা ঢাকা পড়ে গেল ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতারের’ সৌজন্যে? নানা সংশয় ও দ্বিধায় ভরা এই প্রশ্নের উত্তরে মলয় যা বললেন তা এর উত্তর নয়, উত্তরের প্রথম অংশ হলো কবিতাটি প্রকাশের পর মামলা, সরকারি স্থগিতাদেশ, আর্থিক সংকটে থেকে লেখক বন্ধুদের অসহযোগিতা এবং বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়। বন্ধুদের শত্রুতার প্রশ্নে তিনি বহুবার তথ্যহীন প্রমাণহীন একটা একটা খবর রটিয়েছেন- যে শৈলেশ্বর ঘোষ, ফালগুনী রায়, সুভাষ ঘোষ প্রমুখ আদালতের ট্রেজারি থেকে টাকা নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছে। সেজন্য শেষদিন পর্যন্ত শৈলেশ্বর তাঁকে ক্ষমা করেননি। এমনকি, মলয় জানাচ্ছেন শৈলেশ্বর মুত্যুর আগে মেয়েকে বলে গিয়েছিলেন মলয়ের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না করতে। প্রকৃত তথ্য হাংরির লেখকগণ শৈলেশ্বর প্রমুখ পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন মলয় রায়চৌধুরী হাংরির কেউ নন, তাঁর সঙ্গে হাংরি সাহিত্যিকদের সম্পর্ক নেই। এই ঘোষণা বা সাক্ষ্য এবং মলয়-এর মুচলেকা সাহায্য করে মামলা থেকে মুক্ত হতে।

তিন : সাক্ষ্যাৎদানে উদার মলয় রায়চৌধুরী বিশেষ করে শেষ জীবনে বহু সাক্ষাৎকারে বলেছেন, লিখিত প্রশ্নের উত্তর লিখে জানিয়েছেন। এমনকী তিনি সম্পাদকের ইচ্ছেমতো নিজের সাক্ষাৎকার নিজেই নিয়েছেন। নিজেই প্রশ্ন করে উত্তর লিখছেন- আত্মপ্রেম বা হাংরির ভাষায় স্বমেহন স্বমৈথুনে তিনি কখনো ক্লান্ত নন।

তরুণ কবি সংস্কৃতি কর্মী সজ্জ্বল দত্ত ব্যারাকপুর স্টেশন কবিতা পত্রিকার পক্ষ থেকে প্রশ্ন লিখে পাঠিয়েছিলেন। সেই প্রশ্নসমূহ পেয়ে মলয় রায়চৌধুরী বলেন, ‘প্রশ্নগুলো পড়ে বুঝতে পারলুম যে তোমরা আমার বইপত্র পড়োনি, কেননা কোনো প্রশ্নই আমার বই পড়ে করা হয়নি। যাইহোক সোনালী মিত্রকেও একই কথা বলেছিলেন। সজ্জ্বল দত্তের একটি বিশেষ প্রাসঙ্গিক প্রশ্নে যাওয়ার আগে মলয় রায়চৌধুরীর সাহিত্য সম্পর্কে আমার ধারণা মতে, একটি প্রয়োজনীয় কথা বলে নিতে চাই- তা হলো- মলয়-এর সাহিত্য পড়ার আগে দুই বা তিনটি বিষয় মন থেকে সম্পূর্ণ সরিয়ে নিতে পারলে সাহিত্যরসের খুব ব্যাঘাত ঘটবে না। মলয়-এর উপন্যাস, কবিতা, নিবন্ধ, নাটক পড়ার সময় ভুলে যেতে হবে তিনি একদা পাটনার ইমলিতলার মুসলিম পল্লীতে অত্যন্ত আর্থিক সংকটের মধ্যে বড় হতে হতে, শূকর পোড়া, ইঁদুর পোড়া মাংস খেয়ে সস্তা লোকাল মদ পান করে যৌবনে সাহিত্য রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। তিনি একদা হাংরি সাহিত্যিকদের সূচনার লেখককুলের একজন। হাংরির সাহিত্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ হলে বা ওই সময়ের তরুণদের সাহিত্য প্রবণতা সম্পর্কে সচেতন না থাকলে তাঁর সাহিত্যের ভিন্নস্বাদ উপভোগ করা যায়। একজন পাঠক হিসেবে মলয়কে আমি উপন্যাস রচয়িতা হিসেবে বেশি নম্বর দেই। উপন্যাস বা বড় গল্প বা নভেলা যাইহোক, ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’, ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ বা তার জীবনীগ্রন্থ ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ উল্লেখ করার মতো। পরে মলয় গর্ব করে বলেন, ছোটোলোকের ছোটোবেলার চারটি মুদ্রণের পর কলকাতার প্রকাশক ‘প্রতিভাস’ প্রকাশ করে ‘ছোটোলোকের জীবন’ এই নতুন নামে। প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান তাঁর বই বের করে না। কেউ তাঁর বই পড়ে না এই অভিযোগ তিনি প্রত্যেক আলাপে জানিয়েছেন বড়ো আক্ষেপের সঙ্গে। কোনো প্রতিষ্ঠানবিরোধীর মনে এমন আক্ষেপ থাকে ভাই!

সজ্জ্বলের নানা প্রশ্নের ভিড় থেকে একটা প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন আমরা দেখে নেব, কারণ এই প্রশ্নের ভিতর মলয় সম্পর্কে প্রশ্ন ও সংশয়গুলো ডুবসাতাঁর করে যাচ্ছে- আরও একটি বৈশিষ্ট্য সজ্জ্বলের প্রশ্ন করার ভাষা ও ধরনের মধ্যে আছে তা হলো- কলকাতার সৃষ্টিশীল তরুণদের ভাঁড়ামিমুক্ত ন্যাকামিমুক্ত সরাসরি জিজ্ঞাসা, এবং বয়স হলেই সাহিত্য বা জীবনবোধের বিবেচনায় সবাই নমস্য, সমালোচনার ঊর্ধ্বে চলে যায় না। মলয় রায়চৌধুরীর মৃত্যুর কয়েকমাস আগে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রশ্নটি এমন- ‘ক্ষুধার্ত মানে প্যাটের না চ্যাটের ক্ষুধা? আপনার সম্পূর্ণ সাহিত্যযাপন অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে অনুসরণ করলে এই প্রশ্ন কিন্তু বহু পাঠকের মনে অবধারিত হয়ে উঠে আসবেই- মলয় দা আপনার কবিতা কি আদৌও বুভুক্ষদের কথা বলে নাকি অহেতুক যৌনক্ষুধাকে গুরুত্ব দ্যায়?’ সজ্জ্বলের এমন সরাসরি ক্ষুরধার প্রশ্নের উত্তরে হতচকিত ম্লান মলয় উত্তরে আক্ষেপবশত কিছু অসত্য বক্তব্য লিখে ফেলেন। তিনি বলেন, হুবহু তুলে ধরছি,- “কী আর বলি, আমার লেখাপত্র তো পড়ো না। পড়লে জানতে হাংরি শব্দটা কোথা থেকে পেয়েছিলুম। আর আন্দোলনের তাত্ত্বিক বনেদ কী ছিল। আমি ‘ক্ষুধা’ শব্দটা ব্যবহার করিনি চিরকাল, হাংরি শব্দটাই ব্যবহার করেছি। হাংরি শব্দটা প্রথম পেয়েছিলুম কবি জিওফ্রে চসারের ‘In swore hungry time’ বাক্যটি থেকে। আর আন্দোলনের তত্ত্ব গড়েছিলুম অসওয়ালড স্পেঙ্গলারের লেখা ‘The Dccline of the west’ বইটি থেকে। স্পেঙ্গলারের তত্ত্বের সারমর্ম হলো...’ ঠিক এই কারণে হাংরি আন্দোলনে বিদেশি তত্ত্বের অনুকরণের অভিযোগ উঠেছিল।

এ ছাড়াও মলয় বলেন, ক্ষুধার্ত শব্দটি আমি কখনো ব্যবহার করিনি, শৈলেশ্বর ও সুভাষ ঘোষ হাংরি শব্দ ব্যবহারে ভয় পেয়ে ক্ষুধার্ত ব্যবহার করত।’ এসব মন্তব্যের মধ্যে অসত্য ও ইতিহাসকে অস্বীকার করা ছাড়াও আমিত্বের আস্ফালন দৃষ্টি এড়ায় না। এ প্রসঙ্গে বহু কথা ভিড় করে আসছে, কিন্তু বন্ধুর কাগজের কলেবরকে গ্রাহ্য করে আর বিস্তৃত না করে বলব, ১৯৬৪ সালেই শৈলেশ্বর লিখেছিলেন, ‘হাংরি জেনারেশনের আন্দোলন’ গ্রন্থের আন্দোলনের নানা গদ্য। সুভাষ ঘোষ লিখেছেন ‘তিন দশকের হাংরি জেনারেশন’ অব্যয় থেকে ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত সমীরণ ঘোষের ‘হাংরি জেনারেশন ও জেনারেশন গ্যাপ’ ইত্যাদি, মানে শৈলেশ্বর প্রমুখ প্রথম থেকেই ‘হাংরি’ শব্দটি ব্যবহার করে আসছেন। তাদের প্রকাশনা সংস্থার নাম ছিল ক্ষুধার্ত। তবে ক্ষুধার্ত বললেই হাংরির বিশিষ্টতা যেমন ক্ষুণ্ণ হয় না, তেমনি ক্ষুধার্ত শব্দের বাঙ্ময়তা, দ্ব্যর্থতা আরও যুৎসই হয়ে ওঠে। মলয় বলেন, কলকাতার কবি লেখক এমনকি লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকরাও হাংরি শব্দ বা মলয় রায়চৌধুরীর নাম করত না ভয়ে। লখনউ বসে এনজিও’র কর্মকর্তা মলয়বাবু হয়তো নিজের বাইরে অন্য কোনো খবর নেবার ফুরসত পাননি, তাই তিনি যেমন সোনালী মিত্রকে বলেছিলেন ‘প্রচ- বৈদ্যুতিক ছুতার’ প্রকাশের পনের বছর পর বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিনগুলো আমার লেখা প্রকাশ করতে থাকেন। ‘মিজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক’ পত্রিকায় মিজানুর রহমান ধারাবাহিকভাবে ‘হাংরি কিংবদন্তি’ প্রকাশ করতে থাকেন। আর কলকাতার লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকরা বাংলাদেশে আমার কবিতা প্রকাশের ১০ বছর পর আমার কবিতা প্রকাশ করতে সাহস করেন। মলয় নিজেই মামলায় নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন তাঁর বিতর্কিত ...ছুতার কবিতা থেকে, তাহলে অন্যদের ভয় তাঁর কবিতা নিয়ে কেন হবে?

মলয় তার সাক্ষাৎকারে আরও একটি বিপজ্জনক মন্তব্য করেন নিঃসংশয়ে। যথারীতি কোনো তথ্য প্রমাণ ছাড়াই। দায়ীত্বহীন মন্তব্যের জন্য কলকাতায় জবাবদিহি চাওয়ার কেউ ছিল না, কিন্তু বাংলাদেশে তাকে কারও না কারও কাছে জবাবদিহি করতেই হতো। তিনি বলেন, মিজানুর রহমান আমার ‘হাংরি কিংবদন্তি’ গ্রন্থাকারে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কৃত্তিবাসের লেখকদের প্রধানত সুনীলের কথায় শামসুর রাহমান নাকি ওই গ্রন্থ প্রকাশে বাধা দিয়েছেন। এমন খবরটির জন্য কিছু প্রমাণ আমরা দেখে নিতে চাইতেই পারি মলয়দা।

সবশেষে দরকারি কথাটি হলো শক্তি চট্টোপাধ্যায়, ‘হাংরি’ এবং ‘ক্ষুধার্ত’ এই দুটি শব্দই আন্দোলনের প্রসঙ্গে ১৯৬২ সালে প্রথম ব্যবহার করেন ‘সম্প্রতি’ কাগজের জন্য বিনয় মজুমদারের কবিতাগ্রন্থ আলোচনা প্রসঙ্গে। শক্তির উদ্ধৃতি বহু জানা, তাই সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ‘এষণা’ পত্রিকায় লেখা থেকে বলি, ‘শক্তি চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত হাংরি জেনারেশনের কোনো মুখপত্র নেই- বস্তুত হাংরি জেনারেশন একটা আইডিয়া- যার বিষয়ে শক্তি গ্রন্থ সমালোচনা করতে গিয়ে প্রথমে কিছু লেখেন। শক্তি খুবই অন্যমনস্ক বা অপ্রাসঙ্গিকভাবে কিছু লেখেন। আমরা বন্ধুরা কেউই জানতাম না শক্তি এরকমই ভাবছে,... পাটনা থেকে মলয় রায়চৌধুরী নামক এক অজ্ঞাত যুবক এর নেতৃত্ব কিছুদিন করেন; কিন্তু হাংরি জেনারেশন এমন এক জিনিস যে কারো হাতেই নেতৃত্ব বেশিদিন থাকে না। শক্তি কখনো কোনোকালেই হাংরি আন্দোলন পরিচালিত করেননি। তিনি শুধু আলোচনায় হাংরি, ক্ষুধার্ত শব্দটি ব্যবহার করেছেন মাত্র। পরে লিখিতভাবে জানিয়েছেন তার সাথে হাংরি আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই। মলয় দাবি করছেন তিনি হাংরির স্রষ্টা। হাংরি জেনারেশনের প্রথম লিফলেটে নভেম্বর ১৯৬ তে বলা হয়েছিল Led reliettiously by Shakti Chattapadhaya. শৈলেশ্বরের ভাষায় ‘চুলকে দেওয়া’ হাংরি জেনারেশনকে হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের সূচনাপর্ব বলা যেতে পারে, যা মূলত ইস্তেহার আন্দোলন। সেই সময়ের ১৯৬১-৬২ থেকে ১৯৬৩ পর্যন্ত ওই অবস্থার পর সত্যিকার সাহিত্য আন্দোলনের আদর্শমুখী প্রচুর লেখা তৈরি হতে থাকে। যদিও তখন ১৯৬৩ সালেই শক্তি বলতে শুরু করেছিলেন, ‘হাংরি জেনারেশন ইজ ডেড’।

দেশ পত্রিকায় ১৯৯৫ সালে শঙ্খ ঘোষ লেখেন ‘হাংরি জেনারেশন তাই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটা সূচনাবিন্দু মাত্র ছুঁয়ে থাকে, তার কবিতার প্রধান শক্তি হতে পারে না সেটা। হাংরি নাম নিয়ে আন্দোলনটি তৈরি হবে অল্পপরের বাংলা কবিতায় ‘বস্তুসমূহের ষড়যন্ত্রময় অবস্থান ভেঙে দিতে চায়’, যে আন্দোলন ‘আধুনিকতার শবদেহের উপর উল্লাসময় নৃত্য’ করতে চায়, যথার্থ সেই হাংরিদের সঙ্গে শক্তির তাই যোগ থাকবে না কিছু, অল্প পরে তাদের কাছেও অগ্রাহ্য হয়ে যাবে তার (শক্তি) লেখা। (“) উদ্ধৃতি চিহ্নের কথাগুলো হাংরি সাহিত্য আন্দোলনের প্রাণপুরুষ কবি শৈলেশ্বর ঘোষের।