‘আমি তো পাহাড় থেকে ঝাঁপ-দেয়া ঝর্নার ফুর্তি’

মলয় রায়চৌধুরী : ক্ষুধার্ত প্রজন্মের ভাষ্যকার

গৌতম গুহ রায়

গালগল্পের ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন- “...বেঁচে থেকে আমরা প্রত্যেকেই একটা ‘আখ্যান’ তৈরি করি আর এই আখ্যান হলো ‘আমরা’। ...শেষ পর্যন্ত আমরা আত্মজীবনীমূলক আখ্যান হয়ে উঠি, যার সিঁড়ি বেয়ে, বেঁচে থাকার মাধ্যমে, জীবনের আকাশের কথা বলি। আমরা বাঁচার মাধ্যমে সময়ের খাতায় লিখে কেটে পড়ি...”। তিনি, মলয় রায়চৌধুরী ৮৪তেও পূর্ণভাবে জীবন্ত থেকেই ‘কেটে পড়লেন’। বরাবর ছটফটে তারুণ্যের ঝাণ্ডা নিয়ে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বয়ানে নিজেকে গড়েছেন, ভেঙ্গেছেন। ক্রমাগত বিতর্ক ও বিরোধিতার হার্ডল পার হতে হতে এই ৮৪তে এসে থেমে গেলেন, তিনি বাংলা কবিতার চিরক্ষুধাকাতর স্রষ্টা। বেশ কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন, কিন্তু তাঁর অজস্র অনুগামীর কেউই ভাবতে পারেননি তিনি সত্যি শেষ বিদায় নিয়ে নেবেন, এই শারদ উৎসবের মাঝেই। ২৬ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার সকালেই চিরশান্তির আশ্রয় নিলেন চির অশান্ত লেখক।

মলয়রায় চৌধুরী, জন্মেছিলেন পাটনা শহরে, ২৯ অক্টোবর, ১৯৩৯। কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, সাংবাদিক, গণবুদ্ধিজীবী এবং সর্বোপরি ১৯৬০-এর দশকের হাংরি আন্দোলন- হাংরিয়ালিজম- তথা বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার জনক হিসাব তাঁকে চিহ্নিত করা হয়।

১৯৬০-এ পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরের ছাত্র, বিষয় ছিলো অর্থনীতি। এই সময়েই তাঁর মাথায় সাহিত্যের ভিন্নপথে পদচারণার নেশা কায়েম হয়। এরপর কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ নিবিড়, হাংরি ইস্তাহার প্রকাশ। এই ষাটের দশক থেকেই ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠীর দৃষ্টি আর্কষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসের এই বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। গতানুগতিক চিন্তাধারা সচেতনভাবে বর্জনের মধ্য দিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যে উত্তর আধুনিকতাবাদ চর্চা এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। এই সম্পর্কে রবীন্দ্র গুহর বয়ান- ‘কবিতায় জীবনের কোনো অর্থ বার করার বিরুদ্ধে আমরা কয়েকজন মিলে একটা আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেম। মলয় তার নাটের গুরু ছিল। মলয় বলেছিল মানুষ, ঈশ্বর, গণতন্ত্র এবং বিজ্ঞান পরাজিত। এখন, এই সময়, ক্ষুধার লালনকর্তা একমাত্র কবিতা। অল্পদিনের মধ্যেই মলয়ের সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। আমি চিৎকার করে ডাকলাম- ম-ল-য়। কেউ দাঁড়ালো না। ফিরে তাকাল না। ঝিম হাওয়া অসহ্য আত্মার ভিতর গড়াল। থামল। তবু, কোনো উত্তর নেই। চতুর্দিক ঘিরে আলো- আলো আধো আন্ধকারে ক্রমাগত ভাষাবদলের খেলা। বুকের পাশ দিয়ে অনেক দালাল, ফড়ে, ফেউ পুলিশ চলে গেল। উপেক্ষা উপহাস করে গেল। উঁকিঝুঁকি দিয়ে যুবতী রমণীরা সরে গেল। হঠাৎ একটু দূরেই মলয়। এক অন্ধ ভিখিরির হাত ধরে হাঁটছে। পায়ের নিচে পথ। হ্যাঁ, রাস্তা নয়, আমি পথই বলব। এই পথই শ্রেষ্ঠ এবং শেষতম কবিতা।’ এই কবিতার প্রথাভাঙ্গা পথেই বাংলা সাহিত্যে যার প্রবেশ ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’-এর মতো। মাত্র ২৪ বছর বয়সে লেখা একটি ৯০ লাইনের কবিতা দিয়েই তিনি বাংলা সাহিত্যে নতুন ও বাঁকবদলের ভিন্নতার ইতিহাস রচনা করেছেন। আর তিনটা দিন পরেই আরেকটা জন্মদিন আসত, তার আগেই চলে গেলেন! আমৃত্যু নানা মাধ্যমে প্রবলভাবে থাকা মলয় রায়চৌধুরীর এই শারীরিক মৃত্যু যেন হঠাৎ লোডশেডিং... চমকালো।

১৯৬৪ সালে “প্রচ- বৈদ্যুতিক ছুতার” কবিতার জন্যে রাষ্ট্রবিরোধী মামলায় গ্রেফতার ও কারাবরণ করেন। এই কবিতার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ ওঠে। ভারতীয় আদালতে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার ভারতীয় দ-বিধির ১২০বি (রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র), ২৯২ (সাহিত্যে অশ্লীলতা) এবং ২৯৪ (তরুণদের বিপথগামী করা) ধারায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। ১৯৬৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর হাংরি আন্দোলনকারী ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং লেখালেখির কারণে স্বাধীন ভারতের সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কারণে উৎপলকুমার বসুকে অধ্যাপকের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। প্রদীপ চৌধুরীকে বিশ্বভারতী থেকে বহিস্কৃত করা হয়। সমীর রায়চৌধুরীকে সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। ৩৫ মাস ধরে এই মামলার শুনানি চলে, তিনি কারান্তরালে থাকেন। সেই সময় তাঁর অনেক স্বজন তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষি দেন, অনেকে পক্ষে। ১৯৬৭তে তিনি উচ্চ আদালতে অভিযোগ মুক্ত হন। এরপর কিছুদিন তিনি স্বেচ্ছায় সাহিত্য জগত থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। আবার ২০০৮ নাগাদ লেখালেখিতে ফিরে আসেন। এবং যথাপূর্ব সেই তীব্র ‘বৈদ্যুতিন’ প্রতিক্রিয়ায় মাতিয়ে দেন এই চিরজাগরূক চিরতরুণ এবং আদ্যন্ত প্রতিবাদী এক কবি।

রক্তের সূত্রে তিনি ছিলেন কলকাতা সুতানটী গোবিন্দপুরের জমিদার সাবর্ণ রায়চৌধুরীর বংশধর। ঠাকুরদা লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরী লাহোরে গিয়ে সেখানে মিউজিয়ামের কিউরেটার জন লকউড ক্লিপার্ডের কাছে ছবি তোলা ও ছবি আঁকার তালিম নেন। উল্লেখ থাকে যে এই লকউড ছিলেন বিখ্যাত রুডিয়ার্ড কিপলিং-এর বাবা। মলয় রায়চৌধুরীর মা ছিলেন পাণিহাটীর নীলামবাটির কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ কন্যা। এই কিশোরীমোহন ছিলেন নোবেল জয়ী ও ম্যালেয়ার

প্রতিশেধক আবিষ্কর্তা রোনাল্ড রসের সহায়ক। ওদিকে লক্ষ্মীনারায়ণ ও তার পুত্র রণজিৎ রায়চৌধুরী পেশা হিসাবে নেন বিভিন্ন রাজা মহারাজার পোর্ট্রটে আঁকার কাজ। এই কাজের সূত্রেই দ্বারভাঙ্গার মহারাজার পোর্ট্রেট আঁকতে পাটনা আসেন। এখানেই লক্ষ্মীনারায়ণের মৃত্যু হয়। এরপর পাটনা শহরেই তিনি একটি ফোটোগ্রাফির দোকান খোলেন ও ছবির কাজ করতে থাকেন। পাটনা মিউজিয়ামের সঙ্গেও জড়িয়ে থাকেন। এখানেই পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে মলয় রায়চৌধুরী অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন। মিউজিয়ামের অন্দরে বেড়ে অঠা মন নতুনত্বের পথ খুঁজে নিতে চাইছিলো ছাত্রকাল থেকেই।

একবরাই, গদ্যের তৎকালীন সমস্ত রেখাচিত্র ভেঙে দিয়ে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন তাঁরা। হাংরি জেনারেশন। বাংলা সাহিত্যে স্থিতাবস্থা ভাঙার আওয়াজ তুলে, ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের যে একমাত্র আন্দোলন হয়েছে, তার নাম হাংরি জেনারেশান। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা শহর থেকে একটি ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং হারাধন ধাড়া ওরফে দেবী রায়। শক্তি, শৈলেশ্বর, সমীরের পর কদিন আগে চলে গেলেন দেবী রায়। এবার মলয় রায়চৌধুরী। ‘হাংরি প্রজন্মকে’ বিদায় জানাচ্ছি আমরা।

ইশতেহার প্রকাশের পর হাংরি আন্দোলন ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিষ্ঠানবিরোধী সেই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল মূলত মলয় রায়চৌধুরীর হাত ধরেই। জিওফ্রে চসারের একটি লেখা থেকে হাংরি শব্দটিকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। মলয়ের দাদা সমীর রায়চৌধুরী, শক্তি, দেবী রায় ছাড়া পরে এই আন্দোলনে যুক্ত হন বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, এরপর সুভাষ ঘোষ, ফালগুনী রায়, অরুণেশ প্রমুখ।

ক্ষুধার্ত প্রজন্মের কবিতা বাংলা কবিতার দিকচিহ্ন শুধু নয় এক উজ্জ্বল স্তম্ভ। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার আওয়াজ তুলে এঁরাই প্রথম বাংলা সংস্কৃতিতে বিকল্প এক রাস্তার সন্ধান দিয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠান বিরোধী বিশ্বাস হলো এটাই- যা সমাজের প্রচলিত সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক নীতির বিরোধিতা করে এবং সামষ্টিক মানুষের শুভবোধের কথা বলে। এই আওয়াজ বহু পরে অন্যান্য দেশে প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন চোখে পড়ে। যেমন প্যারিসের ছাত্র আন্দোলন।

১৯৬১ সালে বাংলা সাহিত্যে হাংরি আন্দোলন শুরু হয়। বলা যায় বাংলা ভাষার সবচেয়ে প্রভাবশালী ও সমালোচিত এই হাংরি আন্দোলন, যার প্রধান স্থপতি অবশ্যই মলয় রায়চৌধুরী। ১৯৬১তে প্রথম লিফলেট প্রকাশ করা হয়, এই আন্দোলনের ‘ক্রিয়েটার’ মলয় রায়চৌধুরীই ১৯৬৪ সালে এর পরিসমাপ্তি ঘোষণা করেছিলেন। ১৯৫৪ সালের হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত তাঁর ‘প্রচ- বৈদ্যুতিক ছুতার’ সংক্রান্ত মামলায় সুভাষ ঘোষ ও শৈলেশ্বর ঘোষ মুচলেকা দেওয়ায় বা অনেক সঙ্গী এই আন্দোলনের সংগে তাঁদের সম্পর্ক অস্বীকার করায় মলয় এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন। মলয় রায়চৌধুরী তাঁর ‘হাংরি প্রতিসন্দর্ভ’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন ‘সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানার উদ্ভব ও বিকাশ ইওরোপীয় আধিবিদ্যাগত মনন বিশ্বের ফসল।’ তিনি মনে করতেন মঙ্গলকাব্যের গুরুত্বের কথা, তার মতে প্রাক ঔপনিবেশিক কালখণ্ডে এই মাইক্রোপরিসরগুলো ছিল গুরুত্বপূর্ণ, তার রচয়িতা নন। রচনাগুলো দিলদরেজে বিলি করে দেওয়া হতো। যে প্রক্রিয়াটি হাংরি আন্দোলনের শুরুর দিকে ফালি কাগজে প্রকাশিত রচনা প্রক্রিয়াটি হাংরি আন্দোলনকে দিয়েছিলো প্রাক-উপনিবেশ সনাতন ভারতীয় নশ্বরতা বোধের গর্ব।

অনেকেই গদ্যকার মলয়কে কবিতার মলয় থেকে এগিয়ে রাখেন। আমি কিছুটা দ্বিমত রাখছি এখানে, কবিতায় তিনি এক বিরাট কাজ করে গেছেন- যা এই ভাষার ইতিহাসে বাঁক পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। কবিতার আধুনিকতাবাদী নির্মাণের চাকচিক্য প্রায়ই নন্দককে আচ্ছন্ন করে এটা মেনেও বলা যায় মলয়ের কবিতায় ভাষা স্বপ্রভ ও আত্মভাষ্যকার হয়ে উঠেছে, পঙ্তিতে পঙ্তিতে। তিনি অস্বীকার করে নতুন পথ দেখিয়েছিলেন যেখানে বাচক ও বাচনের আধুনিকাবাদী ধারণা পুরোপুরি বিনির্মিত হয়েছে। তিনি দেখিয়েছিলেন পঙ্ক্তিতে ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দই হতে পারে স্বতন্ত্র ভাষাবিশ্বের ইঙ্গিতবাহী, নিরবচ্ছিন্ন বহুরৈখিকতায় তার উৎসার। নতুন করে কবিতায় ফিরে এসেও সেই কাজ করে যেতে চেয়েছেন, কবিতা বহুবাচনিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপনের কাজ : “তাকিয়ে পাথর করে দেবার সৌন্দর্যবোধ যে আমার ছিল না / তা কাজরি মাছের জাতীয় সংগীতের ছোট-ছোট ঢেউ নিয়ে বানানো / অচেনা টগবগে মেয়েদের দেখে ভাল্লাগে এমন উড়ূ-উড়ূ দুপুরে / আকাশের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে লতিয়ে ওঠা গাছের ডগায় টের পেলুম / যে আমার শহুরে চাকরানির দোআঁসলা ইশারায় আবডালে বলেছিল / ডাকটিকিট ছাড়া জীবনে আর কিছু চাটা হয়নি নাকি গো দাদাবাবু / পাঁকে হাঁটতে পায়ের আবার কষ্ট কিসের? হ্যাপা তো সব মাথার।...” (কবিতা সাহেব /১ জুলাই ২০০১)। ‘আত্মধ্বংসের সহস্রাব্দ’ নাম কবিতার প্রতিবেদনে মলয় রায়চৌধুরী ভাষার প্রথাগত সীমানা বিনির্মাণে তৎপর বয়ান সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদকে প্রত্যাক্ষান করছে বলে উচ্চকোটি ও নিম্নবর্গীয় অণুবিশ্বের ব্যবধান সঙ্কুচিত করতে চেয়েছে: “আমরা দুই বুড়িবুড়ি অন্ধকার মুড়ি দিয়ে কাঁপছি একটায়। এক ঝিলিক আগে ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়ে নতুন সহ¯্রাব্দ শুরু হলো নাকি? বাইরে আতস আলো আর উদাসীন উল্লাসে উন্মাদ কলকাতা। ঘুটঘুটে ঠাণ্ডা চিরে ছিটকে আসছে মাংস গন্ধ র?্যালা প্রগতি উন্নতি উত্তরণের ছাদ পেটানো গর্জন।

রেনেস্যা রেফর্মেশান এনলাইটেন্মেন্ট শিল্প বিপ্লবের অক্ষর উটগুলো বালির ঝড়ে চাপা পড়ে গেছে। খুন করা ছাড়া মতার্দশ প্রতিষ্ঠার আর কোনো আলো নেই। টাটকা রক্ত আর রক্ত পচা লাশ আর কবর খোঁড়া স্যাঁতস্যাঁতে কঙ্কাল চটা ওঠে গেছে সার্বভৌম রাষ্ট্রে। কাগুজে টাকার উড়ন্ত জুয়ায় ক্ষত বিক্ষত দেশ থেকে ভিন্ন দেশে পালিয়েছে বিদ্যুৎগতি মল। বৈদ্যুতিন মাকড়জালে পি-ি চটকে ঝুলছে স্থানকালের রঙিন ঘাঘরা।” বাংলা সাহিত্যে মলয়ের স্থান নির্ণয়ের প্রশ্নে উৎপলকুমার বসু লিখেছিলেন- ‘বাংলা আধুনিক কবিতার প্রসঙ্গটি নিয়ে যদি ভাবা যায়, তবে দেখব, জীবনানন্দই সেই অঞ্চলের প্রধান পুরুষ। তাঁকে পিছনে ফেলে এগিয়ে না গেলে পরবর্তী এটা নতুন যুগের পত্তন হওয়া সম্ভব ছিলো না। মলয় রায়চৌধুরী ও তাঁর প্রজন্মের লেখকদের ওই পাঠশালাতেই হাতেখড়ি হয়েছিল। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাদের অন্য ধরনের পথসন্ধান শুরু হয়। বাংলা সাহিত্যের প্রধান ধারাটি একপ্রকার স্থিতাবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল। তার বাঁধ ভেঙে দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।’ এই ‘বাঁধ ভাঙ্গার’ উস্কানিদাতা হিসাবে তিনি চিরকাল উচারিত হবেন ভাষা চর্চায়, সাহিত্য আলোচনায়। ১৯৬৩ তে কৃত্তিবাস থেকে বের হয় তাঁর প্রথম কবিতার বই- ‘শয়তানের মুখ’। তবে কবিতার বইয়ের আগে একটি প্রবন্ধের বই বেড়িয়েছিলো, শক্তি চট্টোপাধ্যা-এর উদ্যোগে ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’। এরপর ১৯৬৫তে দীর্ঘ কবিতা ‘জখম’, প্রকাশিত হয় জাব্রা প্রকাশনী থেকে। এটি আমার মতে মলয়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা। এর অনেক দিন পরে ১৯৮৬তে মহাদিগন্ত থেকে বেরহয় তাঁর ‘কবিতা সংকলন’। ২০০৩-এ কবিতা ক্যাম্পসা থেকে ‘কৌনপের লুচিমাংস’। মহাদিগন্ত থেকে প্রকাশিত মলয় রায়চৌধুরীর ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঞুর’ বাংলা কবিতার এক উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। ২০১০ সালে প্রকাশিত ‘মাথা কেটে পাঠাচ্ছি, যত্ন করে রেখো’তে অহেতুক স্টান্টের অভিয়োগ ফেলে দেওয়া যায় না। সব নিয়ে মলয় অনন্য ও দুর্বিনিত বিদ্যুৎ প্রবাহ।

মলয় রায় চৌধুরী লিখেছেন- “কী হয় কবিতা লিখে? এই প্রশ্ন মাঝেমাঝে আমাদের বিভ্রান্ত করে। কিন্তু এ কথা সত্য যে কবিতার চেয়ে ধারালো অস্ত্র পৃথিবীতে আর কিছু নেই।” হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে তা যেমন প্রমাণিত হয়েছে। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন শাসকবিরোধী অবস্থানে কবিদের নেমে আসা আক্রমণ এই সত্যকেই প্রমাণ করে। হাংরি আন্দোলনের কবিদের দলটিকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, কোমরে দড়ি বেঁধে চোর-ডাকাতের সঙ্গে পথে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, লকাপে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল এবং মলয়রায় চৌধুরীর বিরুদ্ধে পঁয়ত্রিশ মাসব্যাপী মামলা চালানো হয়েছিল। এই মামলায় এগারোজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল এবং গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ছয়জন; কিন্তু সবাইকে ছেড়ে দিয়ে কেবল মলয়রায় চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা করে সরকার। শুধু কবিতার জন্য যদি এত অত্যাচার নেমে আসে তাহলে বোঝা যায় কবিতার শক্তিমত্ততা। মলয় রায়চৌধুরীর কবিতার অন্তর্বয়ানে উচ্চারিত হয় ‘শস্যের শাঁসের হেঁসেলে ঢুকে-থাকা পোকার অলস আরামের খোঁজে ছুটোছুটি করা হলো না’। এ আক্ষেপ নয়, একঘেয়ে আর কলাকৈবল্যের শিল্প-সহিত্য চর্চার লীন বাংলা সাহিত্যে মলয় তার ভিন্নতা নতুন চিহ্নায়ন ঘটিয়েছেন। প্রাতিষ্ঠানিক বাংলা সাহিত্যে এই বৈত্যুতিক স্পার্ক কোনোদিনই সহ্য করতে পারেনি। মরমী আর স্লোগানভর্তি, ছিঁচকাঁদুনে আর মাতমকারী বাংলা সাহিত্যের বলয়ে মলয় ছিলেন দীর্ঘস্থায়ী প্রবল ঝঞ্ঝা। আজ মলয় শূন্য ভাষাপৃথিবী আর এক নিঃস্বতার ধূসরতায় চলে গেলো। যেখানে তীব্র বৈত্যুতিক আঘাত মৃতপ্রায়ের দেহে প্রাণ সঞ্চার ঘটাবে না।

বৃহস্পতিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৩ , ৩০ কার্তিক ১৪৩০, ৩০ রবিউস সানি ১৪৪৫

‘আমি তো পাহাড় থেকে ঝাঁপ-দেয়া ঝর্নার ফুর্তি’

মলয় রায়চৌধুরী : ক্ষুধার্ত প্রজন্মের ভাষ্যকার

গৌতম গুহ রায়

image

গালগল্পের ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন- “...বেঁচে থেকে আমরা প্রত্যেকেই একটা ‘আখ্যান’ তৈরি করি আর এই আখ্যান হলো ‘আমরা’। ...শেষ পর্যন্ত আমরা আত্মজীবনীমূলক আখ্যান হয়ে উঠি, যার সিঁড়ি বেয়ে, বেঁচে থাকার মাধ্যমে, জীবনের আকাশের কথা বলি। আমরা বাঁচার মাধ্যমে সময়ের খাতায় লিখে কেটে পড়ি...”। তিনি, মলয় রায়চৌধুরী ৮৪তেও পূর্ণভাবে জীবন্ত থেকেই ‘কেটে পড়লেন’। বরাবর ছটফটে তারুণ্যের ঝাণ্ডা নিয়ে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বয়ানে নিজেকে গড়েছেন, ভেঙ্গেছেন। ক্রমাগত বিতর্ক ও বিরোধিতার হার্ডল পার হতে হতে এই ৮৪তে এসে থেমে গেলেন, তিনি বাংলা কবিতার চিরক্ষুধাকাতর স্রষ্টা। বেশ কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন, কিন্তু তাঁর অজস্র অনুগামীর কেউই ভাবতে পারেননি তিনি সত্যি শেষ বিদায় নিয়ে নেবেন, এই শারদ উৎসবের মাঝেই। ২৬ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার সকালেই চিরশান্তির আশ্রয় নিলেন চির অশান্ত লেখক।

মলয়রায় চৌধুরী, জন্মেছিলেন পাটনা শহরে, ২৯ অক্টোবর, ১৯৩৯। কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, সাংবাদিক, গণবুদ্ধিজীবী এবং সর্বোপরি ১৯৬০-এর দশকের হাংরি আন্দোলন- হাংরিয়ালিজম- তথা বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার জনক হিসাব তাঁকে চিহ্নিত করা হয়।

১৯৬০-এ পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরের ছাত্র, বিষয় ছিলো অর্থনীতি। এই সময়েই তাঁর মাথায় সাহিত্যের ভিন্নপথে পদচারণার নেশা কায়েম হয়। এরপর কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ নিবিড়, হাংরি ইস্তাহার প্রকাশ। এই ষাটের দশক থেকেই ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠীর দৃষ্টি আর্কষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসের এই বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। গতানুগতিক চিন্তাধারা সচেতনভাবে বর্জনের মধ্য দিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যে উত্তর আধুনিকতাবাদ চর্চা এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। এই সম্পর্কে রবীন্দ্র গুহর বয়ান- ‘কবিতায় জীবনের কোনো অর্থ বার করার বিরুদ্ধে আমরা কয়েকজন মিলে একটা আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেম। মলয় তার নাটের গুরু ছিল। মলয় বলেছিল মানুষ, ঈশ্বর, গণতন্ত্র এবং বিজ্ঞান পরাজিত। এখন, এই সময়, ক্ষুধার লালনকর্তা একমাত্র কবিতা। অল্পদিনের মধ্যেই মলয়ের সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। আমি চিৎকার করে ডাকলাম- ম-ল-য়। কেউ দাঁড়ালো না। ফিরে তাকাল না। ঝিম হাওয়া অসহ্য আত্মার ভিতর গড়াল। থামল। তবু, কোনো উত্তর নেই। চতুর্দিক ঘিরে আলো- আলো আধো আন্ধকারে ক্রমাগত ভাষাবদলের খেলা। বুকের পাশ দিয়ে অনেক দালাল, ফড়ে, ফেউ পুলিশ চলে গেল। উপেক্ষা উপহাস করে গেল। উঁকিঝুঁকি দিয়ে যুবতী রমণীরা সরে গেল। হঠাৎ একটু দূরেই মলয়। এক অন্ধ ভিখিরির হাত ধরে হাঁটছে। পায়ের নিচে পথ। হ্যাঁ, রাস্তা নয়, আমি পথই বলব। এই পথই শ্রেষ্ঠ এবং শেষতম কবিতা।’ এই কবিতার প্রথাভাঙ্গা পথেই বাংলা সাহিত্যে যার প্রবেশ ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’-এর মতো। মাত্র ২৪ বছর বয়সে লেখা একটি ৯০ লাইনের কবিতা দিয়েই তিনি বাংলা সাহিত্যে নতুন ও বাঁকবদলের ভিন্নতার ইতিহাস রচনা করেছেন। আর তিনটা দিন পরেই আরেকটা জন্মদিন আসত, তার আগেই চলে গেলেন! আমৃত্যু নানা মাধ্যমে প্রবলভাবে থাকা মলয় রায়চৌধুরীর এই শারীরিক মৃত্যু যেন হঠাৎ লোডশেডিং... চমকালো।

১৯৬৪ সালে “প্রচ- বৈদ্যুতিক ছুতার” কবিতার জন্যে রাষ্ট্রবিরোধী মামলায় গ্রেফতার ও কারাবরণ করেন। এই কবিতার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ ওঠে। ভারতীয় আদালতে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার ভারতীয় দ-বিধির ১২০বি (রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র), ২৯২ (সাহিত্যে অশ্লীলতা) এবং ২৯৪ (তরুণদের বিপথগামী করা) ধারায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। ১৯৬৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর হাংরি আন্দোলনকারী ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং লেখালেখির কারণে স্বাধীন ভারতের সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কারণে উৎপলকুমার বসুকে অধ্যাপকের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। প্রদীপ চৌধুরীকে বিশ্বভারতী থেকে বহিস্কৃত করা হয়। সমীর রায়চৌধুরীকে সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। ৩৫ মাস ধরে এই মামলার শুনানি চলে, তিনি কারান্তরালে থাকেন। সেই সময় তাঁর অনেক স্বজন তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষি দেন, অনেকে পক্ষে। ১৯৬৭তে তিনি উচ্চ আদালতে অভিযোগ মুক্ত হন। এরপর কিছুদিন তিনি স্বেচ্ছায় সাহিত্য জগত থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। আবার ২০০৮ নাগাদ লেখালেখিতে ফিরে আসেন। এবং যথাপূর্ব সেই তীব্র ‘বৈদ্যুতিন’ প্রতিক্রিয়ায় মাতিয়ে দেন এই চিরজাগরূক চিরতরুণ এবং আদ্যন্ত প্রতিবাদী এক কবি।

রক্তের সূত্রে তিনি ছিলেন কলকাতা সুতানটী গোবিন্দপুরের জমিদার সাবর্ণ রায়চৌধুরীর বংশধর। ঠাকুরদা লক্ষ্মীনারায়ণ রায়চৌধুরী লাহোরে গিয়ে সেখানে মিউজিয়ামের কিউরেটার জন লকউড ক্লিপার্ডের কাছে ছবি তোলা ও ছবি আঁকার তালিম নেন। উল্লেখ থাকে যে এই লকউড ছিলেন বিখ্যাত রুডিয়ার্ড কিপলিং-এর বাবা। মলয় রায়চৌধুরীর মা ছিলেন পাণিহাটীর নীলামবাটির কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ কন্যা। এই কিশোরীমোহন ছিলেন নোবেল জয়ী ও ম্যালেয়ার

প্রতিশেধক আবিষ্কর্তা রোনাল্ড রসের সহায়ক। ওদিকে লক্ষ্মীনারায়ণ ও তার পুত্র রণজিৎ রায়চৌধুরী পেশা হিসাবে নেন বিভিন্ন রাজা মহারাজার পোর্ট্রটে আঁকার কাজ। এই কাজের সূত্রেই দ্বারভাঙ্গার মহারাজার পোর্ট্রেট আঁকতে পাটনা আসেন। এখানেই লক্ষ্মীনারায়ণের মৃত্যু হয়। এরপর পাটনা শহরেই তিনি একটি ফোটোগ্রাফির দোকান খোলেন ও ছবির কাজ করতে থাকেন। পাটনা মিউজিয়ামের সঙ্গেও জড়িয়ে থাকেন। এখানেই পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে মলয় রায়চৌধুরী অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন। মিউজিয়ামের অন্দরে বেড়ে অঠা মন নতুনত্বের পথ খুঁজে নিতে চাইছিলো ছাত্রকাল থেকেই।

একবরাই, গদ্যের তৎকালীন সমস্ত রেখাচিত্র ভেঙে দিয়ে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন তাঁরা। হাংরি জেনারেশন। বাংলা সাহিত্যে স্থিতাবস্থা ভাঙার আওয়াজ তুলে, ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের যে একমাত্র আন্দোলন হয়েছে, তার নাম হাংরি জেনারেশান। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা শহর থেকে একটি ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং হারাধন ধাড়া ওরফে দেবী রায়। শক্তি, শৈলেশ্বর, সমীরের পর কদিন আগে চলে গেলেন দেবী রায়। এবার মলয় রায়চৌধুরী। ‘হাংরি প্রজন্মকে’ বিদায় জানাচ্ছি আমরা।

ইশতেহার প্রকাশের পর হাংরি আন্দোলন ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিষ্ঠানবিরোধী সেই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল মূলত মলয় রায়চৌধুরীর হাত ধরেই। জিওফ্রে চসারের একটি লেখা থেকে হাংরি শব্দটিকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। মলয়ের দাদা সমীর রায়চৌধুরী, শক্তি, দেবী রায় ছাড়া পরে এই আন্দোলনে যুক্ত হন বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, এরপর সুভাষ ঘোষ, ফালগুনী রায়, অরুণেশ প্রমুখ।

ক্ষুধার্ত প্রজন্মের কবিতা বাংলা কবিতার দিকচিহ্ন শুধু নয় এক উজ্জ্বল স্তম্ভ। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার আওয়াজ তুলে এঁরাই প্রথম বাংলা সংস্কৃতিতে বিকল্প এক রাস্তার সন্ধান দিয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠান বিরোধী বিশ্বাস হলো এটাই- যা সমাজের প্রচলিত সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক নীতির বিরোধিতা করে এবং সামষ্টিক মানুষের শুভবোধের কথা বলে। এই আওয়াজ বহু পরে অন্যান্য দেশে প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন চোখে পড়ে। যেমন প্যারিসের ছাত্র আন্দোলন।

১৯৬১ সালে বাংলা সাহিত্যে হাংরি আন্দোলন শুরু হয়। বলা যায় বাংলা ভাষার সবচেয়ে প্রভাবশালী ও সমালোচিত এই হাংরি আন্দোলন, যার প্রধান স্থপতি অবশ্যই মলয় রায়চৌধুরী। ১৯৬১তে প্রথম লিফলেট প্রকাশ করা হয়, এই আন্দোলনের ‘ক্রিয়েটার’ মলয় রায়চৌধুরীই ১৯৬৪ সালে এর পরিসমাপ্তি ঘোষণা করেছিলেন। ১৯৫৪ সালের হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত তাঁর ‘প্রচ- বৈদ্যুতিক ছুতার’ সংক্রান্ত মামলায় সুভাষ ঘোষ ও শৈলেশ্বর ঘোষ মুচলেকা দেওয়ায় বা অনেক সঙ্গী এই আন্দোলনের সংগে তাঁদের সম্পর্ক অস্বীকার করায় মলয় এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন। মলয় রায়চৌধুরী তাঁর ‘হাংরি প্রতিসন্দর্ভ’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন ‘সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানার উদ্ভব ও বিকাশ ইওরোপীয় আধিবিদ্যাগত মনন বিশ্বের ফসল।’ তিনি মনে করতেন মঙ্গলকাব্যের গুরুত্বের কথা, তার মতে প্রাক ঔপনিবেশিক কালখণ্ডে এই মাইক্রোপরিসরগুলো ছিল গুরুত্বপূর্ণ, তার রচয়িতা নন। রচনাগুলো দিলদরেজে বিলি করে দেওয়া হতো। যে প্রক্রিয়াটি হাংরি আন্দোলনের শুরুর দিকে ফালি কাগজে প্রকাশিত রচনা প্রক্রিয়াটি হাংরি আন্দোলনকে দিয়েছিলো প্রাক-উপনিবেশ সনাতন ভারতীয় নশ্বরতা বোধের গর্ব।

অনেকেই গদ্যকার মলয়কে কবিতার মলয় থেকে এগিয়ে রাখেন। আমি কিছুটা দ্বিমত রাখছি এখানে, কবিতায় তিনি এক বিরাট কাজ করে গেছেন- যা এই ভাষার ইতিহাসে বাঁক পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। কবিতার আধুনিকতাবাদী নির্মাণের চাকচিক্য প্রায়ই নন্দককে আচ্ছন্ন করে এটা মেনেও বলা যায় মলয়ের কবিতায় ভাষা স্বপ্রভ ও আত্মভাষ্যকার হয়ে উঠেছে, পঙ্তিতে পঙ্তিতে। তিনি অস্বীকার করে নতুন পথ দেখিয়েছিলেন যেখানে বাচক ও বাচনের আধুনিকাবাদী ধারণা পুরোপুরি বিনির্মিত হয়েছে। তিনি দেখিয়েছিলেন পঙ্ক্তিতে ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দই হতে পারে স্বতন্ত্র ভাষাবিশ্বের ইঙ্গিতবাহী, নিরবচ্ছিন্ন বহুরৈখিকতায় তার উৎসার। নতুন করে কবিতায় ফিরে এসেও সেই কাজ করে যেতে চেয়েছেন, কবিতা বহুবাচনিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপনের কাজ : “তাকিয়ে পাথর করে দেবার সৌন্দর্যবোধ যে আমার ছিল না / তা কাজরি মাছের জাতীয় সংগীতের ছোট-ছোট ঢেউ নিয়ে বানানো / অচেনা টগবগে মেয়েদের দেখে ভাল্লাগে এমন উড়ূ-উড়ূ দুপুরে / আকাশের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে লতিয়ে ওঠা গাছের ডগায় টের পেলুম / যে আমার শহুরে চাকরানির দোআঁসলা ইশারায় আবডালে বলেছিল / ডাকটিকিট ছাড়া জীবনে আর কিছু চাটা হয়নি নাকি গো দাদাবাবু / পাঁকে হাঁটতে পায়ের আবার কষ্ট কিসের? হ্যাপা তো সব মাথার।...” (কবিতা সাহেব /১ জুলাই ২০০১)। ‘আত্মধ্বংসের সহস্রাব্দ’ নাম কবিতার প্রতিবেদনে মলয় রায়চৌধুরী ভাষার প্রথাগত সীমানা বিনির্মাণে তৎপর বয়ান সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদকে প্রত্যাক্ষান করছে বলে উচ্চকোটি ও নিম্নবর্গীয় অণুবিশ্বের ব্যবধান সঙ্কুচিত করতে চেয়েছে: “আমরা দুই বুড়িবুড়ি অন্ধকার মুড়ি দিয়ে কাঁপছি একটায়। এক ঝিলিক আগে ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়ে নতুন সহ¯্রাব্দ শুরু হলো নাকি? বাইরে আতস আলো আর উদাসীন উল্লাসে উন্মাদ কলকাতা। ঘুটঘুটে ঠাণ্ডা চিরে ছিটকে আসছে মাংস গন্ধ র?্যালা প্রগতি উন্নতি উত্তরণের ছাদ পেটানো গর্জন।

রেনেস্যা রেফর্মেশান এনলাইটেন্মেন্ট শিল্প বিপ্লবের অক্ষর উটগুলো বালির ঝড়ে চাপা পড়ে গেছে। খুন করা ছাড়া মতার্দশ প্রতিষ্ঠার আর কোনো আলো নেই। টাটকা রক্ত আর রক্ত পচা লাশ আর কবর খোঁড়া স্যাঁতস্যাঁতে কঙ্কাল চটা ওঠে গেছে সার্বভৌম রাষ্ট্রে। কাগুজে টাকার উড়ন্ত জুয়ায় ক্ষত বিক্ষত দেশ থেকে ভিন্ন দেশে পালিয়েছে বিদ্যুৎগতি মল। বৈদ্যুতিন মাকড়জালে পি-ি চটকে ঝুলছে স্থানকালের রঙিন ঘাঘরা।” বাংলা সাহিত্যে মলয়ের স্থান নির্ণয়ের প্রশ্নে উৎপলকুমার বসু লিখেছিলেন- ‘বাংলা আধুনিক কবিতার প্রসঙ্গটি নিয়ে যদি ভাবা যায়, তবে দেখব, জীবনানন্দই সেই অঞ্চলের প্রধান পুরুষ। তাঁকে পিছনে ফেলে এগিয়ে না গেলে পরবর্তী এটা নতুন যুগের পত্তন হওয়া সম্ভব ছিলো না। মলয় রায়চৌধুরী ও তাঁর প্রজন্মের লেখকদের ওই পাঠশালাতেই হাতেখড়ি হয়েছিল। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাদের অন্য ধরনের পথসন্ধান শুরু হয়। বাংলা সাহিত্যের প্রধান ধারাটি একপ্রকার স্থিতাবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল। তার বাঁধ ভেঙে দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।’ এই ‘বাঁধ ভাঙ্গার’ উস্কানিদাতা হিসাবে তিনি চিরকাল উচারিত হবেন ভাষা চর্চায়, সাহিত্য আলোচনায়। ১৯৬৩ তে কৃত্তিবাস থেকে বের হয় তাঁর প্রথম কবিতার বই- ‘শয়তানের মুখ’। তবে কবিতার বইয়ের আগে একটি প্রবন্ধের বই বেড়িয়েছিলো, শক্তি চট্টোপাধ্যা-এর উদ্যোগে ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’। এরপর ১৯৬৫তে দীর্ঘ কবিতা ‘জখম’, প্রকাশিত হয় জাব্রা প্রকাশনী থেকে। এটি আমার মতে মলয়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা। এর অনেক দিন পরে ১৯৮৬তে মহাদিগন্ত থেকে বেরহয় তাঁর ‘কবিতা সংকলন’। ২০০৩-এ কবিতা ক্যাম্পসা থেকে ‘কৌনপের লুচিমাংস’। মহাদিগন্ত থেকে প্রকাশিত মলয় রায়চৌধুরীর ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঞুর’ বাংলা কবিতার এক উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। ২০১০ সালে প্রকাশিত ‘মাথা কেটে পাঠাচ্ছি, যত্ন করে রেখো’তে অহেতুক স্টান্টের অভিয়োগ ফেলে দেওয়া যায় না। সব নিয়ে মলয় অনন্য ও দুর্বিনিত বিদ্যুৎ প্রবাহ।

মলয় রায় চৌধুরী লিখেছেন- “কী হয় কবিতা লিখে? এই প্রশ্ন মাঝেমাঝে আমাদের বিভ্রান্ত করে। কিন্তু এ কথা সত্য যে কবিতার চেয়ে ধারালো অস্ত্র পৃথিবীতে আর কিছু নেই।” হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে তা যেমন প্রমাণিত হয়েছে। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন শাসকবিরোধী অবস্থানে কবিদের নেমে আসা আক্রমণ এই সত্যকেই প্রমাণ করে। হাংরি আন্দোলনের কবিদের দলটিকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, কোমরে দড়ি বেঁধে চোর-ডাকাতের সঙ্গে পথে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, লকাপে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল এবং মলয়রায় চৌধুরীর বিরুদ্ধে পঁয়ত্রিশ মাসব্যাপী মামলা চালানো হয়েছিল। এই মামলায় এগারোজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল এবং গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ছয়জন; কিন্তু সবাইকে ছেড়ে দিয়ে কেবল মলয়রায় চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা করে সরকার। শুধু কবিতার জন্য যদি এত অত্যাচার নেমে আসে তাহলে বোঝা যায় কবিতার শক্তিমত্ততা। মলয় রায়চৌধুরীর কবিতার অন্তর্বয়ানে উচ্চারিত হয় ‘শস্যের শাঁসের হেঁসেলে ঢুকে-থাকা পোকার অলস আরামের খোঁজে ছুটোছুটি করা হলো না’। এ আক্ষেপ নয়, একঘেয়ে আর কলাকৈবল্যের শিল্প-সহিত্য চর্চার লীন বাংলা সাহিত্যে মলয় তার ভিন্নতা নতুন চিহ্নায়ন ঘটিয়েছেন। প্রাতিষ্ঠানিক বাংলা সাহিত্যে এই বৈত্যুতিক স্পার্ক কোনোদিনই সহ্য করতে পারেনি। মরমী আর স্লোগানভর্তি, ছিঁচকাঁদুনে আর মাতমকারী বাংলা সাহিত্যের বলয়ে মলয় ছিলেন দীর্ঘস্থায়ী প্রবল ঝঞ্ঝা। আজ মলয় শূন্য ভাষাপৃথিবী আর এক নিঃস্বতার ধূসরতায় চলে গেলো। যেখানে তীব্র বৈত্যুতিক আঘাত মৃতপ্রায়ের দেহে প্রাণ সঞ্চার ঘটাবে না।