মূল: জেরাল্ড মার্টিন অনুবাদ: সুরাইয়া ফারজানা হাসান
(পূর্ব প্রকাশের পর)
কুবার বিপ্লব এবং যুক্তরাষ্ট্র ১৯৫৯-১৯৬১
মের্সেদেস হোটেল থেকে চলে গেলে তিনি বেশিরভাগ সময় অফিসে কাটিয়েছেন, ক্রমবর্ধমান মানসিক চাপকে সঙ্গী করে সেখানে কৌচে শুয়ে ঘুমিয়ে রাত পার করেছেন। মার্চের ১৩ তারিখ তিনি ওয়াশিংটনের ঐতিহাসিক প্রেস কনফারেন্সে উপস্থিত ছিলেন, যেখানে জন এফ কেনেডি ঘোষণা দেন, তিনি অগ্রগতির জন্য মিত্রদের জোট তৈরি করছেন। এটি একটি সংক্ষিপ্ত সময়ের পূর্বাভাস দেয়, যখন যুক্তরাষ্ট্র লাতিন আমেরিকার স্বৈরশাসকদের যুগ যুগ ধরে সহায়তা করার পর- মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং সহযোগিতার বুলি আওড়ানো শুরু করেন-যাই হোক খুব শিঘ্রই, যুক্তরাষ্ট্র একটি নীতিমালা নিয়ে ফিরে আসবে- ১৯৬৪ সালে ব্রাজিলে- এবং সত্তরের দশকে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবে। গার্সিয়া মার্কেস স্বীকার করবে, কেনেডির ভাষণ ছিল ‘ওল্ড টেস্টামেন্টের নবীজীর মতো মূল্যবান’ তবে মিত্রদের জোটকে তিনি আখ্যা দেন ‘কিউবার বিপ্লবের নতুন হাওয়াকে দূরে সরিয়ে রাখার একটি জরুরি তাপ্পি’ হিসেবে।
আরেকবার, নিউইয়র্ক অফিসের অভ্যন্তরের চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে, গার্সিয়া মার্কেস যেমনটি কুবায় দেখেছিলেন সেই পুরানো ধ্যানধারণার কট্টর কম্যুনিস্ট এবং মাসেত্তি যাদের নিয়োগ দিয়েছেন, লাতিন আমেরিকার সেই নব্য প্রসবকৃত বামপন্থ’ীদের মাঝে। ‘এবং নিউইয়র্ক অফিসে আমাকে মাসেত্তির লোক হিসেবে দেখা হতো।’ দ্রুত সবকিছু অসহ্যকর হয়ে ওঠে এবং গার্সিয়া মার্কেস তাঁর অবস্থা ভেবে দেখা শুরু করেন। অবশেষে তিনি এই সিদ্ধান্ত উপনীত হন যে, তিনি এ থেকে বেরিয়ে যেতে চান। একবার মাঝরাতে,তিনি অফিসে একাকী ছিলেন, এমন সময় টেলিফোনে কারিবীয় অঞ্চলের এক লোকের কন্ঠে হুমকি-ধামকি পান, যে কিনা বলছে, ‘প্রস্তুত হ গাধার বাচ্চা, তোর সময় চলে এসেছে। আমরা এখন তোর জন্য আসছি।’ গার্সিয়া মার্কেস টেলিপ্রিন্টারে একটি বার্তা রেখে যান, যাতে বলা হয়েছে, ‘আমি যদি চলে যাওয়ার আগে এটি বন্ধ না করি, তবে ভেবে নিতে হবে আমাকে হত্যা করা হয়েছে।’ আবানা থেকে রসিকতা করে উত্তর আসে, ‘ঠিক আছে কম্পানিয়েরো, আমরা তোমার সমাধিতে তবে ফুল পাঠাবো।’ তিনি আতঙ্কে সেই রাতে একটায় অফিস থেকে বেরিয়ে যান, তবে যাবার আগে মেশিনটা বন্ধ করার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন। তিনি হোটেলে তাঁর থাকার কক্ষটিতে ভয়ে-আতঙ্কে অস্থির ছিলেন, বৃষ্টি মাথায় করে অতিকায় ধূসর সেন্ট প্যাট্রিক ক্যাথেড্রালটা পার হয়ে যাবার সময়, তিনি নিজের পায়ের আওয়াজে নিজেই ভয় পেয়ে যাচ্ছিলেন এবং হোটেল কক্ষে ফিরে যে কাপড় পরা ছিলেন ওটা পড়েই ঘুমিয়ে পড়েন।
অনেক বছর পূর্বে, আবেগপ্রবণ মাসেত্তি কম্যুনিস্টদের কাছ থেকে ক্রমাগত চাপের কারণে চাকুরি থেকে ইস্তফা দেওয়ার ফাঁদে পড়েছিলেন। এপ্রিল মাসের ৭ তারিখ গার্সিয়া মার্কেস প্লিনিও মেনদোসাকে একটি চিঠি লিখে মাসেত্তির পদত্যাগের কথা জানান এবং বলেন যে তিনি এ মর্মে একটি ফরিয়াদ দাখিল করবেন: তিনি এপ্রিল মাসের শেষে তাঁর নোটিস দিয়েছেন এবং মেনদোসাকে বলেছেন তিনি মেহিকো যাবার পরিকল্পনা করছেন। তবে কাস্ত্রোর ঘোষণার একদিন পর, ‘বে অব পিগস’ আক্রমণের পর ১৭ এপ্রিল, সকলেই যেমনটি সন্দেহ করেছেন, বিপ্লব আসলে সমাজতান্ত্রিক ছিল, এবং কাস্ত্রো নিজেই মাসেত্তিকে তাঁর পদে কাজ করে যেতে এবং টেলিভিশন লাইভে প্রতি-বিপ্লবী বন্দীদের সাক্ষাৎকারে অংশ নিতে বলেন। মাসেত্তি রাজি হন এবং গার্সিয়া মার্কেসও সিদ্ধান্ত নেন যতক্ষণ না পর্যন্ত আক্রমণ-পরবর্তী সমস্যা মিটে না যায় ততদিন কাজটা চালিয়ে যাওয়ার। বস্তুত, তিনি যেহেতু দাবি করেছেন, ওইসব দিনগুলিতে তিনি যা করতে চেয়েছিলেন, তা হলো নিউইয়র্ক থেকে কুবায় ফিরে যাওয়া।
‘বে অব পিগস’-এ কুবার সেই মহান বিজয়ের পর, কাস্ত্রো যেদিন ব্যক্তিগতভাবে দ্বীপটিকে আক্রমণ প্রতিহত করার এবং আক্রমণকারীদের গ্রেপ্তার করার নির্দেশনা দিয়েছেন, সেদিন প্লিনিও মেনদোসা খেয়াল করেন, কোন এক রহস্যময় কারণে, প্রথমবারের মতো, বোগতার টেলিকম অফিস তাঁর প্রেরিত ডাক নিতে প্রত্যাখ্যান করছে এবং তৎক্ষণাৎ তাঁর মনে সন্দেহ জাগে, যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয়ই কলম্বিয়ার কর্তৃপক্ষকে চাপ দিচ্ছে কুবার সেবাসুবিধা বন্ধ করে দেওয়ার। তিনি নিউইয়র্কে গার্সিয়া মার্কেসকে ফোন করেন এবং গার্সিয়া মার্কেস বলেন, ‘একটু ধরো, বাইরে ফিফথ এভিনিউয়ে একটি টেলেক্স অফিস আছে।’ এভাবে দুজন বন্ধু স্পর্ধার সাথে সিআইএকে ঠকিয়েছে প্রতি-বিপ্লবী আক্রমণকারীদের যেদিন পরাস্ত করা হয়, ঠিক সেই দিনটিকে, কুবার লোকজন ‘লাতিন আমেরিকার সীমানায় সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে প্রথম বিজয়’ বলে দাবি করে। তবে এর পরপরই গার্সিয়া মার্কেস হোটেল কক্ষে গিয়ে মাসেত্তিকে নিজ হাতে চিঠি লিখেন- যে জিনিসটি তিনি বলতে গেলে কখনোই করেননি তিনি তাই করে বসেন (চিঠির তারিখ দিয়ে ফেলেন)- মস্কো ঘরানার সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাঁর নালিশ লিখেন এবং যদি কট্টরপন্থী কম্যুনিস্ট প্রথা প্রচলিত হয়ে যায় সেই আশঙ্কার কথা তুলে ধরেন। তিনি চিঠিটা হোটেল কক্ষে রেখে যান, তাঁর চাকরি থেকে অব্যাহতি নেয়াটা যে কতটা অনিবার্য, তা জানানোর অপেক্ষায় রেখে। এটাও ঠিক যে, তিনি ‘বে অব পিগস’-এর যুদ্ধ পর্যন্ত নিউইয়র্কে অবস্থান করেছেন এ কারণে যে, তিনি ঠিক ঘটনার পূর্বে বাইরে চলে গেছেন লোকজন তা জানলে তিনি অবশ্যই মার্কা মারা হয়ে যাবেন, অনেকটা জাহাজডুরি সময় থেকে যাওয়া ইঁদুরের মতো। তিনি বলতে গেলে জানতেনই না যে মাসেত্তি অচিরেই প্রেসনা লাতিনা থেকে চিরতরে চলে যাবেন এবং পরবর্তীতে আর্হেন্তিনায় ফিরে গিয়ে ১৯৬৪ সালের হতাশাজনক বিপ্লবী প্রচারনায় মারা যাবেন।
গার্সিয়া মার্কেসের নিউইয়র্কে থাকার দিন প্রায় শেষ হয়ে এলো। প্লিনিও মেনদোসা আবানায় উড়ে যান মাসেত্তির সাথে পরিস্থিতি আলোচনা করার জন্য এবং গাবো আর মের্সেদেসের সাথে মধ্যাহ্নভোজ করতে করতে তাঁদের কাছে এই খবর এসে যায় যে ‘তারা’ অর্থাৎ কট্টরপন্থী ‘মামেরতোস’রা অবশেষে প্রেসনা লাতিনা অফিস দখলে নিয়ে নিয়েছে, একজন নতুন পরিচালকের অধীনে, যিনি স্পেন দেশীয় ফের্নান্দো রেবুয়েলতাস। যখন মেনদোসা প্যান আমেরিকান ফ্লাইটে চড়ে মে মাসের শেষের দিকে, আবানা থেকে তাঁর বাড়ি যাবার পথে, নিউইয়র্ক আবার এসে পৌঁছান, তখন সিআইএ’র জিজ্ঞাসাবাদের পর মের্সেদেস এবং রদ্রিগোর সাথে তাঁর দেখা হয়। মের্সেদেস তাঁর নিজস্ব সেই চিরচেনা শান্ত মুখে মৃদু হাসলেন, এবং বললেন, ‘তবে তো মামেরতোসরা প্রেলার দ্বায়িত্ব নিয়ে নিল, কমপাদ্রে?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, কোমাদ্রে, তারা তা করেছে বটে।’ যখন তিনি মের্সেদেসকে বললেন যে তিনি নিজ হাতে প্রেসনা লাতিনার প্রধানের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন, যার একটি কপি দেওয়া হয়েছিল রাষ্ট্রপতি দোরতিকোসকে, তখন তিনি মেনদোসাকে জানান গাবোর নিজের পত্রটিও ইতোমধ্যে লেখা হয়ে গিয়েছে এবং কেবল তাঁর আগমনের জন্য তা অপেক্ষা করছে।
গার্সিয়া মার্কেস ১৯৬০ সালের পর এসব সমস্যা নিয়ে কখনো খুব বেশি কিছু বলেননি- এমনকি আন্তোনিও নুনিয়েস খিমেনেসের সাথে তাঁর পরবর্তী আলাপে, যিনি নিজে একজন গোঁড়া কম্যুনিস্ট ভাবেন, তিনি আলোচনার গভীরে না যেয়ে, কেবল বলেছেন যে কম্যুনিস্ট কট্টরপন্থীরা আসলে ‘বিপ্লব-বিরোধী’- যদিও সত্যিটা হলো ১৯৬১ সাল তাঁর ওপর দশ বছরেরও বেশি সময়ে ছায়পাত করবে। কারণটি, পরিষ্কার- তিনি কুবার বিপ্লব ক্রমাগতভাবে দেখে যাচ্ছেন একটি ‘পরিকল্পিত’ মামেরতোসদের মধ্যে অন্তহীন সংগ্রাম, সম্ভবত ওরা ওইসব দিনে কাস্ত্রোর ভাই রাউল তাদের প্রতিনিধিত্ব করেন, এবং সম্ভবত ফিদেলপ্রতিনিধিত্ব করেন অতিশয় অনুভূতিপরায়ন বৈপ্লবিক রোমান্টিকতা। পঁচিশ বছর পর মেনদোসা কুবায় তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলবেন, ১৯৫৭ সালে পূর্ব ইউরাপ ভ্রমণের পর, নিজেকে সমাজতন্ত্র থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে, তিনি এই বলে নিজেকে বুঝ মানান যে, সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা শেষ অব্দি আমলাতান্ত্রিক এবং নিপীড়কে পরিণত হয়, এবং এটি অনিবার্য। এবং তিনি
বেশ জোর দিয়ে বলবেন, ষাটের দশকের শুরুতে যা কিছু ঘটেছিল গার্সিয়া মার্কেস সেসবের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল, যেহেতু তিনি, মেনদোসা ছিলেন এবং ওইসব দিনে তাঁরা একদম একইভাবে জিনিসগুলোকে দেখেছেন।
মেনদোসা কিছুদিনের জন্য নিউইয়র্কে রয়ে গেলেন এই অপেক্ষায় যে বন্ধুর বেতনের টাকা এবং প্লেনের টিকিট প্রেসনা লাতিনা থেকে দেওয়া হবে। তিনি এবং মের্সেদেস একসাথে রদ্রিগোকে নিয়ে দিনের বেলা সেন্ট্রাল পার্কে হেঁটে বেড়াতেন, যখন গার্সিয়া মার্কেস অফিসে তাঁর সম্পর্ক চুকিয়ে নিচ্ছিল। এরপর গার্সিয়া মার্কেস এবং মেনদোসা ফিফথ এভিনিউ, টাইমস্কায়ার এবং গ্রিনউইচ ভিলেজে ঘুরে বেড়িয়েছেন আর নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করছেন- কী কী ঘটেছে, কুবার ভবিষ্যত এবং তাঁদের নিজস্ব অনিশ্চিত পরিকল্পনা। দুটো ভিন্ন আদর্শ, দুটো ভিন্ন পৃথিবীর মাঝে অসহায় হয়ে গেছেন তাঁরা, দুজনের জন্য একটা কঠিন সময় শুরু হতে যাচ্ছে। গার্সিয়া মার্কেস মে মাসের ২৩ তারিখ আলবারো সেপেদার কাছে লিখবেন:
এখন, এক মাস ধরে চলা একটি বাজে রকমের ভয়ানক সঙ্কটের পর, অবশেষে এই সপ্তাহে ব্যাপারটি সামনে এলো, প্রেসনা লাতিনার ভদ্র মার্জিত তরুণ যুবকটি, ব্যাপক সাড়া জাগানো পদত্যাগ পত্র দিয়ে বিদেয় হলো। যদিও জঘন্য বিষয়গুলি আমরা সামনে ভাসা-ভাসাভাবে দেখি এবং আমি কখনো ভাবিনি যে ঘটনাগুলো এতোটা ধ্বংসাত্মক হবে, বরং আমি ভেবেছি এখনো নিউইয়র্কে আমার কয়েক মাস বাকি আছে। যাই হোক, আমার এখানে থাকার শেষ আশাটুকু চিরতরে উবে গেছে আজ সন্ধ্যায় আর আমি মেহিকো যাচ্ছি ১ লা জুন, সড়ক পথে, প্রচণ্ড অরাজক দক্ষিণের ভিতর দিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে। আমি ঠিক জানি না আমি কী করতে যাচ্ছি, তবে আমি কিছু ডলার কলম্বিয়া থেকে উদ্ধার করার চেষ্টায় আছি, যেটি আশা করা যায় আমাকে মেহিকোতে কিছুদিন থাকার অনুমতি দিবে যখন আমি কাজ খুঁজব। কে জানে চোদনটা কীরকম, যেহেতু সাংবাদিকতার হাল আমি ছেড়ে দিয়েছি। হয়তবা একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে।
মেনদোসা নিউইয়র্ক ছাড়ার পরপরই মাসেত্তি গার্সিয়া মার্কেসকে ফোন করেন এবং জানান পরিস্থিতির আবারো উন্নতি হচ্ছে। তিনি রাষ্ট্রপতি দরতিকোসের সাথে কথা বলেছেন এবং তাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছে, যে তিনি এখনো মোটেরওপর ফিদেল কাস্ত্রোর সুনজরে আছেন। তিনি গার্সিয়া মার্কেসকে বলেন তাঁর মেহিকো যাত্রাটা বিলম্বিত করার জন্য, তবে কলম্বীয়রা তাঁর জন্য পরিকল্পনা করে ফেলেছেন এবং কেবলমাত্র তাঁর প্রদেয় অর্থ দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে, যেটি প্রেসনা লাতিনা কর্তৃপক্ষ জরুরী ভিত্তিতে দিতে রাজি হয়েছে। তিনি তাঁকে চাকুরি থেকে ইস্তফা বাবদ কিছু অর্থ এবং মেহিকো যাবার জন্য তাঁর এবং তাঁর পরিবারের জন্য টিকিট দেবার জন্য তাড়া দিচ্ছেন। সুতরাং তিনি মাসেত্তির সনির্বদ্ধ অনুরোধ প্রত্যাখান করলেন। যে বিষয়টি তিনি মেনদোসাকে লেখা একটি চিঠিতে ব্যাখ্যা করেছেন:
আমি জানি মাসেত্তি: যে ব্যক্তিগত সাহায্য শুরুতে চেয়েছেন তা ফিরিয়ে দেওয়া হবে, আমরা যা-ই করার চেষ্টা করি না কেন, বিশাল এবং জটিল প্রতিশ্রুতিতে, আমি ধরা খেয়ে যাবো যতক্ষণ না পর্যন্ত কমরেডরা দেখতে পাবেন গাছের পেয়ারাটি পেকে গেছে এবং তাঁরা একে খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিবেন, ঠিক যেমনটি তাঁরা করেছেন প্রেসনা লাতিনার সাথে। অধিকিন্তু: যদি মাসেত্তি এখন ফাঁদে পড়ে থাকেন এবং বিপদে থাকেন, তুমি যেমনটি বলেছো তিনি তেমনটিই আছেন, আমি আমার পরিকল্পনা পাল্টে তাকে সাহায্য করার জন্য সবকিছুই করতে পারতাম। তবে আমি মনে করি, রাষ্ট্রপতি তাঁর জন্য সবকিছু সঠিকভাবে করার একটি উপায় পেয়েছেন এবং তাঁর আর এই ধরনের জরুরি সাহায্যের প্রয়োজনে নেই।
পরবর্তী সময়ে তিনি বলেছেন, ‘আমি অফিসে এক অচেনা ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছি আমাকে টিমের সবাইকে সবকিছু বিস্তারিত জানাতে হবে। সৌভাগ্যবশত এটি ৪৮ ঘণ্টায় শেষ হয়ে যাবে।’ তিনি ভয় পান, প্রেসনা লাতিনা অফিস তাঁর পরিবারের ফিরে আসার ব্যয়ভার বহন করবে না এবং জানাবে তিনি কেবল তাঁর নামে ২০০ ডলার পাবেন।
ফলশ্রুতিতে, গার্সিয়া মার্কেস পরিবারের আকাশপথে কলম্বিয়া ফিরে যাওয়ার আর কোন উপায় রইল না, তাই তাঁরা সড়কপথে মেহিকোর দিকে রওনা দিলেন। মেহিকোতে তাঁরা বাড়ি ফেরার জন্য দরকারী সাহায্যের তালিকা তৈরি করার চেষ্টা করবেন (যদিও মেনদোসা নিজে বিশ্বাস করেন, মেহিকোতে বর্ধিত সময় থাকাটা গার্সিয়া মার্কেসের অন্যতম সুতীব্র ইচ্ছে; এটা হতে পারে যে, কয়েকবছর ধরে তাঁর গতিবিধি এবং অনুপ্রেরণা নিয়ে অনেক ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে সেই বাস্তব সত্য থেকে, যেটি স্বীকার করতে তিনি কুণ্ঠিত ছিলেন- তা হলো তিনি কলম্বিয়ায় এবং বর্ধিত পরিবারটিতে ফিরতে চান না। অবাক হবার কিছু নেই যে, নিউইয়র্ক অফিস বলেছে, তিনি চাকুরি থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন, তাঁকে মোটেই পদচ্যুতি করা হয়নি- স্পষ্টত তাকে পলাতক হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, যদিও তিনি সত্যিসত্যি একজন প্রতি-বিপ্লবী ‘গুসানো’ নন- এছাড়া তাঁরাও কিন্তু তাঁকে মেহিকো যাবার জন্য টিকেট দেওয়ার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ নয়। পরবর্তীকালে, আবানায় বন্ধুদের প্রশ্নের উত্তরে কম্যুনিস্টরা বলবে, ‘গার্সিয়া মার্কেস প্রতি-বিপ্লবীদের দিকে চলে গেছেন।’ জুনের মাঝামাঝি সময়ে প্রেসনা লাতিনা এবং বিপ্লব থেকে কিছুই না পাওয়ার ব্যাপারটি মাথায় রেখে চাকুরি থেকে ইস্তফা নিয়ে, গার্সিয়া-বার্চা পরিবার নিউ অরিলিনসের উদ্দ্যেশে গ্রেহাউন্ড বাসে উঠে বসেন, যেখানে মেনদোসা আরো ১৫০ ডলার পাঠাবেন বোগোতা থেকে।
আঠারো মাসের শিশু নিয়ে, চৌদ্দ দিনের যাত্রাটি ছিল যথেষ্ট কষ্টসাধ্য, ঘনঘন বাস থামানো নিয়ে পরবর্তী সময়ে তিনি অভিযোগ করবেন, আর ছিল অন্তহীন ‘শক্ত কাগজের ঠোঙ্গার ভিতর হ্যামবার্গার,’ ‘কাঠের গুড়ার হটডগ’ এবং কোকাকোলার প্লাস্টিকের বাকেট। একদম শেষের দিকে তাঁরা রদ্রিগোর প্রসেস করা বেবিফুড খাওয়া শুরু করলেন, বিশেষ করে সেদ্ধ করা ফল। তারা দেখলেন মেরিল্যান্ড, ভার্জিনিয়া, দুই ক্যারোলিনা, জর্জিয়া, অ্যালাবামা এবং মিসিসিপ্পি। গার্সিয়া মার্কেসের নিজের জন্য তার বহুদিনের স্বপ্ন ফকনারের দেশে অবশেষে যাওয়ার সুযোগটা মিলল। অন্যসব বিদেশী দর্শনার্থীর মতো ওইসময়ে, তরুণ দম্পত্তিটি আমেরিকার দক্ষিণে উপর্যুপরি বর্ণবাদের উদাহরণে ভীষণ মর্মাহত, বিশেষ করে এক দশক পরে সিভিল রাইট রিফর্মের আগের জর্জিয়া এবং অ্যালাবামার অবস্থা দেখে। মন্টোগোমারিতে তাঁরা এক রাতটি ঘুমোতে পারেনি কারণ কেউ ‘ডার্টি মেহিকান’দের হোটেল কক্ষ ভাড়া দিবে না। অবশেষে তাঁরা যখন নিউ অরিলিন্সে এসে পৌঁছান, তাঁরা ‘উদরপূর্তি করে খাওয়ার জন্য যথার্থ খাবারের জন্য হন্যে হয়ে উঠেছিলেন এবং মেনদোসার ১৫০ ডলারের কিছুটা ব্যয় করেছেন, যেটা কলম্বিয়ার দূতাবাস অফিসে পাঠানো হয়েছে, উঁচুদরের ফরাসি রেস্তোরাঁ ‘লে ভিউ কারে’ ভালো করে এক বেলার খাবার খাওয়ার জন্য। যাইহোক, যখন টেবিলে নৈশভোজের খাবার এলো, প্রতিটা স্টেকের ওপর ঢাউস সাইজের পিচফল দেখে তাঁরা বেশ আশাহত হয়েছিল। ১৯৮৩ সালে গার্সিয়া মার্কেস তাঁদের সেই বিশাল দুঃসাহসিক অভিযানের কথা স্মরণ করবেন:
বীরোচিত ভ্রমণ যাত্রা শেষে আমরা আবারও সত্য এবং গল্পকাহিনির মধ্যকার সম্পর্কের মুখোমুখি হলাম: তুলার ক্ষেতের মাঝখানে অনিন্দ্য সুন্দর পার্থেনন, কৃষকরা রাস্তার পাশের সরাইখানায় ছাঁইচের নিচে দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রা সেরে নিচ্ছে, কালো মানুষদের কুঁড়েঘর দৈন্যতাকে সাথী করে টিকে আছে, আর আঙ্কেল গাভিন স্টিভেন্সের উত্তরাধিকার সাদারা,মসলিনের পোশাক পরা ক্ষীণকায় নির্জীব নারীদের সাথে দলেবলে রোববারের প্রার্থনাসভায় যোগ দিতে হেঁটে রওনা দিয়েছে; ইয়োকনাপাতাওফা কাউন্টির ভীতিপ্রদ ভুবন, বাসের জানালার ভিতর দিয়ে আমাদের চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল, এবং এ ছিল বুড়ো প-িতের উপন্যাসের মতো সত্যি এবং মানবিক।
দুর্বিষহ যাত্রা শেষ করে তিনি মেনদোসাকে তাঁর প্রথম চিঠিতে বলবেন, ‘আমরা এক দারুণ কৌতূহোলোদ্দীপক ভ্রমণ শেষে অবশেষে, নিরাপদে এবং সুস্থ শরীরে এসে পৌঁছেছি, যেটি একদিকে প্রমাণ করেছে যে, ফকনার এবং বাকিরা তাঁদের দেশের পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে সত্য কথাই বলেছেন এবং অপরদিকে, বলতেই হয়, রদ্রিগো যথার্থই কোলেপিঠে বহনযোগ্য যুবকে পরিণত হয়েছে, যে কিনা যে কোন জরুরি পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
অবশেষে, দুটো দীর্ঘ এবং অবিস্মরণীয় সপ্তাহের পর তারা লারেদো সীমান্তে এসে পৌছান। সেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে বৈপরিত্যে-ঠাসা সীমান্তে, তাঁরা একটা নোংরা, অপরিচ্ছন্ন মফস্বল শহর দেখতে পাবেন যেখানে, তৎসত্ত্বেও তাঁরা অনুভব করেন জীবনটা হঠাৎ করেই বাস্তবের রূপ নিয়েছে। এই প্রথম সস্তা কোনো এক রেস্তোরাঁয় তাঁদের সুস্বাদু খাবার পরিবেশন করে। মের্সেদেস সিদ্ধান্ত নেন, মেহিকোর মতো একটা দেশ, যেখানে তিনি আবিষ্কার করেছেন- এখানকার লোকেরা ভাত এবং অন্য অনেক কিছুরই রান্নার গোপন রেসিপি জানে- সেজন্য এখানে হয়ত তিনি বেঁচেবর্তে থাকতে পারবেন। তাঁরা একটি ট্রেন ধরে ১৯৬১ সালের জুন মাসে মেহিকো শহরে এসে পৌঁছান। তাঁরা একটি বিশাল কিন্তু সামলে সুমলে চলা যাবে এমন একটি শহরের দেখা পেলেন যেখানে বুলেভার্ডগুলো ফুলের সাথে মিল রেখে সারি করে তৈরি করা এবং যেখানে, সে সময়, দূরের আকাশটা স্বচ্ছ, নীলিমায় নীল এবং আপনি এখনো সেখানে আগ্নেয়গিরি দেখতে পাবেন। (সমাপ্ত)
গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেস
আরও খবরবৃহস্পতিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৩ , ৩০ কার্তিক ১৪৩০, ৩০ রবিউস সানি ১৪৪৫
মূল: জেরাল্ড মার্টিন অনুবাদ: সুরাইয়া ফারজানা হাসান
গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেস
(পূর্ব প্রকাশের পর)
কুবার বিপ্লব এবং যুক্তরাষ্ট্র ১৯৫৯-১৯৬১
মের্সেদেস হোটেল থেকে চলে গেলে তিনি বেশিরভাগ সময় অফিসে কাটিয়েছেন, ক্রমবর্ধমান মানসিক চাপকে সঙ্গী করে সেখানে কৌচে শুয়ে ঘুমিয়ে রাত পার করেছেন। মার্চের ১৩ তারিখ তিনি ওয়াশিংটনের ঐতিহাসিক প্রেস কনফারেন্সে উপস্থিত ছিলেন, যেখানে জন এফ কেনেডি ঘোষণা দেন, তিনি অগ্রগতির জন্য মিত্রদের জোট তৈরি করছেন। এটি একটি সংক্ষিপ্ত সময়ের পূর্বাভাস দেয়, যখন যুক্তরাষ্ট্র লাতিন আমেরিকার স্বৈরশাসকদের যুগ যুগ ধরে সহায়তা করার পর- মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং সহযোগিতার বুলি আওড়ানো শুরু করেন-যাই হোক খুব শিঘ্রই, যুক্তরাষ্ট্র একটি নীতিমালা নিয়ে ফিরে আসবে- ১৯৬৪ সালে ব্রাজিলে- এবং সত্তরের দশকে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবে। গার্সিয়া মার্কেস স্বীকার করবে, কেনেডির ভাষণ ছিল ‘ওল্ড টেস্টামেন্টের নবীজীর মতো মূল্যবান’ তবে মিত্রদের জোটকে তিনি আখ্যা দেন ‘কিউবার বিপ্লবের নতুন হাওয়াকে দূরে সরিয়ে রাখার একটি জরুরি তাপ্পি’ হিসেবে।
আরেকবার, নিউইয়র্ক অফিসের অভ্যন্তরের চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে, গার্সিয়া মার্কেস যেমনটি কুবায় দেখেছিলেন সেই পুরানো ধ্যানধারণার কট্টর কম্যুনিস্ট এবং মাসেত্তি যাদের নিয়োগ দিয়েছেন, লাতিন আমেরিকার সেই নব্য প্রসবকৃত বামপন্থ’ীদের মাঝে। ‘এবং নিউইয়র্ক অফিসে আমাকে মাসেত্তির লোক হিসেবে দেখা হতো।’ দ্রুত সবকিছু অসহ্যকর হয়ে ওঠে এবং গার্সিয়া মার্কেস তাঁর অবস্থা ভেবে দেখা শুরু করেন। অবশেষে তিনি এই সিদ্ধান্ত উপনীত হন যে, তিনি এ থেকে বেরিয়ে যেতে চান। একবার মাঝরাতে,তিনি অফিসে একাকী ছিলেন, এমন সময় টেলিফোনে কারিবীয় অঞ্চলের এক লোকের কন্ঠে হুমকি-ধামকি পান, যে কিনা বলছে, ‘প্রস্তুত হ গাধার বাচ্চা, তোর সময় চলে এসেছে। আমরা এখন তোর জন্য আসছি।’ গার্সিয়া মার্কেস টেলিপ্রিন্টারে একটি বার্তা রেখে যান, যাতে বলা হয়েছে, ‘আমি যদি চলে যাওয়ার আগে এটি বন্ধ না করি, তবে ভেবে নিতে হবে আমাকে হত্যা করা হয়েছে।’ আবানা থেকে রসিকতা করে উত্তর আসে, ‘ঠিক আছে কম্পানিয়েরো, আমরা তোমার সমাধিতে তবে ফুল পাঠাবো।’ তিনি আতঙ্কে সেই রাতে একটায় অফিস থেকে বেরিয়ে যান, তবে যাবার আগে মেশিনটা বন্ধ করার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন। তিনি হোটেলে তাঁর থাকার কক্ষটিতে ভয়ে-আতঙ্কে অস্থির ছিলেন, বৃষ্টি মাথায় করে অতিকায় ধূসর সেন্ট প্যাট্রিক ক্যাথেড্রালটা পার হয়ে যাবার সময়, তিনি নিজের পায়ের আওয়াজে নিজেই ভয় পেয়ে যাচ্ছিলেন এবং হোটেল কক্ষে ফিরে যে কাপড় পরা ছিলেন ওটা পড়েই ঘুমিয়ে পড়েন।
অনেক বছর পূর্বে, আবেগপ্রবণ মাসেত্তি কম্যুনিস্টদের কাছ থেকে ক্রমাগত চাপের কারণে চাকুরি থেকে ইস্তফা দেওয়ার ফাঁদে পড়েছিলেন। এপ্রিল মাসের ৭ তারিখ গার্সিয়া মার্কেস প্লিনিও মেনদোসাকে একটি চিঠি লিখে মাসেত্তির পদত্যাগের কথা জানান এবং বলেন যে তিনি এ মর্মে একটি ফরিয়াদ দাখিল করবেন: তিনি এপ্রিল মাসের শেষে তাঁর নোটিস দিয়েছেন এবং মেনদোসাকে বলেছেন তিনি মেহিকো যাবার পরিকল্পনা করছেন। তবে কাস্ত্রোর ঘোষণার একদিন পর, ‘বে অব পিগস’ আক্রমণের পর ১৭ এপ্রিল, সকলেই যেমনটি সন্দেহ করেছেন, বিপ্লব আসলে সমাজতান্ত্রিক ছিল, এবং কাস্ত্রো নিজেই মাসেত্তিকে তাঁর পদে কাজ করে যেতে এবং টেলিভিশন লাইভে প্রতি-বিপ্লবী বন্দীদের সাক্ষাৎকারে অংশ নিতে বলেন। মাসেত্তি রাজি হন এবং গার্সিয়া মার্কেসও সিদ্ধান্ত নেন যতক্ষণ না পর্যন্ত আক্রমণ-পরবর্তী সমস্যা মিটে না যায় ততদিন কাজটা চালিয়ে যাওয়ার। বস্তুত, তিনি যেহেতু দাবি করেছেন, ওইসব দিনগুলিতে তিনি যা করতে চেয়েছিলেন, তা হলো নিউইয়র্ক থেকে কুবায় ফিরে যাওয়া।
‘বে অব পিগস’-এ কুবার সেই মহান বিজয়ের পর, কাস্ত্রো যেদিন ব্যক্তিগতভাবে দ্বীপটিকে আক্রমণ প্রতিহত করার এবং আক্রমণকারীদের গ্রেপ্তার করার নির্দেশনা দিয়েছেন, সেদিন প্লিনিও মেনদোসা খেয়াল করেন, কোন এক রহস্যময় কারণে, প্রথমবারের মতো, বোগতার টেলিকম অফিস তাঁর প্রেরিত ডাক নিতে প্রত্যাখ্যান করছে এবং তৎক্ষণাৎ তাঁর মনে সন্দেহ জাগে, যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয়ই কলম্বিয়ার কর্তৃপক্ষকে চাপ দিচ্ছে কুবার সেবাসুবিধা বন্ধ করে দেওয়ার। তিনি নিউইয়র্কে গার্সিয়া মার্কেসকে ফোন করেন এবং গার্সিয়া মার্কেস বলেন, ‘একটু ধরো, বাইরে ফিফথ এভিনিউয়ে একটি টেলেক্স অফিস আছে।’ এভাবে দুজন বন্ধু স্পর্ধার সাথে সিআইএকে ঠকিয়েছে প্রতি-বিপ্লবী আক্রমণকারীদের যেদিন পরাস্ত করা হয়, ঠিক সেই দিনটিকে, কুবার লোকজন ‘লাতিন আমেরিকার সীমানায় সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে প্রথম বিজয়’ বলে দাবি করে। তবে এর পরপরই গার্সিয়া মার্কেস হোটেল কক্ষে গিয়ে মাসেত্তিকে নিজ হাতে চিঠি লিখেন- যে জিনিসটি তিনি বলতে গেলে কখনোই করেননি তিনি তাই করে বসেন (চিঠির তারিখ দিয়ে ফেলেন)- মস্কো ঘরানার সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাঁর নালিশ লিখেন এবং যদি কট্টরপন্থী কম্যুনিস্ট প্রথা প্রচলিত হয়ে যায় সেই আশঙ্কার কথা তুলে ধরেন। তিনি চিঠিটা হোটেল কক্ষে রেখে যান, তাঁর চাকরি থেকে অব্যাহতি নেয়াটা যে কতটা অনিবার্য, তা জানানোর অপেক্ষায় রেখে। এটাও ঠিক যে, তিনি ‘বে অব পিগস’-এর যুদ্ধ পর্যন্ত নিউইয়র্কে অবস্থান করেছেন এ কারণে যে, তিনি ঠিক ঘটনার পূর্বে বাইরে চলে গেছেন লোকজন তা জানলে তিনি অবশ্যই মার্কা মারা হয়ে যাবেন, অনেকটা জাহাজডুরি সময় থেকে যাওয়া ইঁদুরের মতো। তিনি বলতে গেলে জানতেনই না যে মাসেত্তি অচিরেই প্রেসনা লাতিনা থেকে চিরতরে চলে যাবেন এবং পরবর্তীতে আর্হেন্তিনায় ফিরে গিয়ে ১৯৬৪ সালের হতাশাজনক বিপ্লবী প্রচারনায় মারা যাবেন।
গার্সিয়া মার্কেসের নিউইয়র্কে থাকার দিন প্রায় শেষ হয়ে এলো। প্লিনিও মেনদোসা আবানায় উড়ে যান মাসেত্তির সাথে পরিস্থিতি আলোচনা করার জন্য এবং গাবো আর মের্সেদেসের সাথে মধ্যাহ্নভোজ করতে করতে তাঁদের কাছে এই খবর এসে যায় যে ‘তারা’ অর্থাৎ কট্টরপন্থী ‘মামেরতোস’রা অবশেষে প্রেসনা লাতিনা অফিস দখলে নিয়ে নিয়েছে, একজন নতুন পরিচালকের অধীনে, যিনি স্পেন দেশীয় ফের্নান্দো রেবুয়েলতাস। যখন মেনদোসা প্যান আমেরিকান ফ্লাইটে চড়ে মে মাসের শেষের দিকে, আবানা থেকে তাঁর বাড়ি যাবার পথে, নিউইয়র্ক আবার এসে পৌঁছান, তখন সিআইএ’র জিজ্ঞাসাবাদের পর মের্সেদেস এবং রদ্রিগোর সাথে তাঁর দেখা হয়। মের্সেদেস তাঁর নিজস্ব সেই চিরচেনা শান্ত মুখে মৃদু হাসলেন, এবং বললেন, ‘তবে তো মামেরতোসরা প্রেলার দ্বায়িত্ব নিয়ে নিল, কমপাদ্রে?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, কোমাদ্রে, তারা তা করেছে বটে।’ যখন তিনি মের্সেদেসকে বললেন যে তিনি নিজ হাতে প্রেসনা লাতিনার প্রধানের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন, যার একটি কপি দেওয়া হয়েছিল রাষ্ট্রপতি দোরতিকোসকে, তখন তিনি মেনদোসাকে জানান গাবোর নিজের পত্রটিও ইতোমধ্যে লেখা হয়ে গিয়েছে এবং কেবল তাঁর আগমনের জন্য তা অপেক্ষা করছে।
গার্সিয়া মার্কেস ১৯৬০ সালের পর এসব সমস্যা নিয়ে কখনো খুব বেশি কিছু বলেননি- এমনকি আন্তোনিও নুনিয়েস খিমেনেসের সাথে তাঁর পরবর্তী আলাপে, যিনি নিজে একজন গোঁড়া কম্যুনিস্ট ভাবেন, তিনি আলোচনার গভীরে না যেয়ে, কেবল বলেছেন যে কম্যুনিস্ট কট্টরপন্থীরা আসলে ‘বিপ্লব-বিরোধী’- যদিও সত্যিটা হলো ১৯৬১ সাল তাঁর ওপর দশ বছরেরও বেশি সময়ে ছায়পাত করবে। কারণটি, পরিষ্কার- তিনি কুবার বিপ্লব ক্রমাগতভাবে দেখে যাচ্ছেন একটি ‘পরিকল্পিত’ মামেরতোসদের মধ্যে অন্তহীন সংগ্রাম, সম্ভবত ওরা ওইসব দিনে কাস্ত্রোর ভাই রাউল তাদের প্রতিনিধিত্ব করেন, এবং সম্ভবত ফিদেলপ্রতিনিধিত্ব করেন অতিশয় অনুভূতিপরায়ন বৈপ্লবিক রোমান্টিকতা। পঁচিশ বছর পর মেনদোসা কুবায় তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলবেন, ১৯৫৭ সালে পূর্ব ইউরাপ ভ্রমণের পর, নিজেকে সমাজতন্ত্র থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে, তিনি এই বলে নিজেকে বুঝ মানান যে, সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা শেষ অব্দি আমলাতান্ত্রিক এবং নিপীড়কে পরিণত হয়, এবং এটি অনিবার্য। এবং তিনি
বেশ জোর দিয়ে বলবেন, ষাটের দশকের শুরুতে যা কিছু ঘটেছিল গার্সিয়া মার্কেস সেসবের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল, যেহেতু তিনি, মেনদোসা ছিলেন এবং ওইসব দিনে তাঁরা একদম একইভাবে জিনিসগুলোকে দেখেছেন।
মেনদোসা কিছুদিনের জন্য নিউইয়র্কে রয়ে গেলেন এই অপেক্ষায় যে বন্ধুর বেতনের টাকা এবং প্লেনের টিকিট প্রেসনা লাতিনা থেকে দেওয়া হবে। তিনি এবং মের্সেদেস একসাথে রদ্রিগোকে নিয়ে দিনের বেলা সেন্ট্রাল পার্কে হেঁটে বেড়াতেন, যখন গার্সিয়া মার্কেস অফিসে তাঁর সম্পর্ক চুকিয়ে নিচ্ছিল। এরপর গার্সিয়া মার্কেস এবং মেনদোসা ফিফথ এভিনিউ, টাইমস্কায়ার এবং গ্রিনউইচ ভিলেজে ঘুরে বেড়িয়েছেন আর নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করছেন- কী কী ঘটেছে, কুবার ভবিষ্যত এবং তাঁদের নিজস্ব অনিশ্চিত পরিকল্পনা। দুটো ভিন্ন আদর্শ, দুটো ভিন্ন পৃথিবীর মাঝে অসহায় হয়ে গেছেন তাঁরা, দুজনের জন্য একটা কঠিন সময় শুরু হতে যাচ্ছে। গার্সিয়া মার্কেস মে মাসের ২৩ তারিখ আলবারো সেপেদার কাছে লিখবেন:
এখন, এক মাস ধরে চলা একটি বাজে রকমের ভয়ানক সঙ্কটের পর, অবশেষে এই সপ্তাহে ব্যাপারটি সামনে এলো, প্রেসনা লাতিনার ভদ্র মার্জিত তরুণ যুবকটি, ব্যাপক সাড়া জাগানো পদত্যাগ পত্র দিয়ে বিদেয় হলো। যদিও জঘন্য বিষয়গুলি আমরা সামনে ভাসা-ভাসাভাবে দেখি এবং আমি কখনো ভাবিনি যে ঘটনাগুলো এতোটা ধ্বংসাত্মক হবে, বরং আমি ভেবেছি এখনো নিউইয়র্কে আমার কয়েক মাস বাকি আছে। যাই হোক, আমার এখানে থাকার শেষ আশাটুকু চিরতরে উবে গেছে আজ সন্ধ্যায় আর আমি মেহিকো যাচ্ছি ১ লা জুন, সড়ক পথে, প্রচণ্ড অরাজক দক্ষিণের ভিতর দিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে। আমি ঠিক জানি না আমি কী করতে যাচ্ছি, তবে আমি কিছু ডলার কলম্বিয়া থেকে উদ্ধার করার চেষ্টায় আছি, যেটি আশা করা যায় আমাকে মেহিকোতে কিছুদিন থাকার অনুমতি দিবে যখন আমি কাজ খুঁজব। কে জানে চোদনটা কীরকম, যেহেতু সাংবাদিকতার হাল আমি ছেড়ে দিয়েছি। হয়তবা একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে।
মেনদোসা নিউইয়র্ক ছাড়ার পরপরই মাসেত্তি গার্সিয়া মার্কেসকে ফোন করেন এবং জানান পরিস্থিতির আবারো উন্নতি হচ্ছে। তিনি রাষ্ট্রপতি দরতিকোসের সাথে কথা বলেছেন এবং তাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছে, যে তিনি এখনো মোটেরওপর ফিদেল কাস্ত্রোর সুনজরে আছেন। তিনি গার্সিয়া মার্কেসকে বলেন তাঁর মেহিকো যাত্রাটা বিলম্বিত করার জন্য, তবে কলম্বীয়রা তাঁর জন্য পরিকল্পনা করে ফেলেছেন এবং কেবলমাত্র তাঁর প্রদেয় অর্থ দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে, যেটি প্রেসনা লাতিনা কর্তৃপক্ষ জরুরী ভিত্তিতে দিতে রাজি হয়েছে। তিনি তাঁকে চাকুরি থেকে ইস্তফা বাবদ কিছু অর্থ এবং মেহিকো যাবার জন্য তাঁর এবং তাঁর পরিবারের জন্য টিকিট দেবার জন্য তাড়া দিচ্ছেন। সুতরাং তিনি মাসেত্তির সনির্বদ্ধ অনুরোধ প্রত্যাখান করলেন। যে বিষয়টি তিনি মেনদোসাকে লেখা একটি চিঠিতে ব্যাখ্যা করেছেন:
আমি জানি মাসেত্তি: যে ব্যক্তিগত সাহায্য শুরুতে চেয়েছেন তা ফিরিয়ে দেওয়া হবে, আমরা যা-ই করার চেষ্টা করি না কেন, বিশাল এবং জটিল প্রতিশ্রুতিতে, আমি ধরা খেয়ে যাবো যতক্ষণ না পর্যন্ত কমরেডরা দেখতে পাবেন গাছের পেয়ারাটি পেকে গেছে এবং তাঁরা একে খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিবেন, ঠিক যেমনটি তাঁরা করেছেন প্রেসনা লাতিনার সাথে। অধিকিন্তু: যদি মাসেত্তি এখন ফাঁদে পড়ে থাকেন এবং বিপদে থাকেন, তুমি যেমনটি বলেছো তিনি তেমনটিই আছেন, আমি আমার পরিকল্পনা পাল্টে তাকে সাহায্য করার জন্য সবকিছুই করতে পারতাম। তবে আমি মনে করি, রাষ্ট্রপতি তাঁর জন্য সবকিছু সঠিকভাবে করার একটি উপায় পেয়েছেন এবং তাঁর আর এই ধরনের জরুরি সাহায্যের প্রয়োজনে নেই।
পরবর্তী সময়ে তিনি বলেছেন, ‘আমি অফিসে এক অচেনা ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছি আমাকে টিমের সবাইকে সবকিছু বিস্তারিত জানাতে হবে। সৌভাগ্যবশত এটি ৪৮ ঘণ্টায় শেষ হয়ে যাবে।’ তিনি ভয় পান, প্রেসনা লাতিনা অফিস তাঁর পরিবারের ফিরে আসার ব্যয়ভার বহন করবে না এবং জানাবে তিনি কেবল তাঁর নামে ২০০ ডলার পাবেন।
ফলশ্রুতিতে, গার্সিয়া মার্কেস পরিবারের আকাশপথে কলম্বিয়া ফিরে যাওয়ার আর কোন উপায় রইল না, তাই তাঁরা সড়কপথে মেহিকোর দিকে রওনা দিলেন। মেহিকোতে তাঁরা বাড়ি ফেরার জন্য দরকারী সাহায্যের তালিকা তৈরি করার চেষ্টা করবেন (যদিও মেনদোসা নিজে বিশ্বাস করেন, মেহিকোতে বর্ধিত সময় থাকাটা গার্সিয়া মার্কেসের অন্যতম সুতীব্র ইচ্ছে; এটা হতে পারে যে, কয়েকবছর ধরে তাঁর গতিবিধি এবং অনুপ্রেরণা নিয়ে অনেক ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে সেই বাস্তব সত্য থেকে, যেটি স্বীকার করতে তিনি কুণ্ঠিত ছিলেন- তা হলো তিনি কলম্বিয়ায় এবং বর্ধিত পরিবারটিতে ফিরতে চান না। অবাক হবার কিছু নেই যে, নিউইয়র্ক অফিস বলেছে, তিনি চাকুরি থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন, তাঁকে মোটেই পদচ্যুতি করা হয়নি- স্পষ্টত তাকে পলাতক হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, যদিও তিনি সত্যিসত্যি একজন প্রতি-বিপ্লবী ‘গুসানো’ নন- এছাড়া তাঁরাও কিন্তু তাঁকে মেহিকো যাবার জন্য টিকেট দেওয়ার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ নয়। পরবর্তীকালে, আবানায় বন্ধুদের প্রশ্নের উত্তরে কম্যুনিস্টরা বলবে, ‘গার্সিয়া মার্কেস প্রতি-বিপ্লবীদের দিকে চলে গেছেন।’ জুনের মাঝামাঝি সময়ে প্রেসনা লাতিনা এবং বিপ্লব থেকে কিছুই না পাওয়ার ব্যাপারটি মাথায় রেখে চাকুরি থেকে ইস্তফা নিয়ে, গার্সিয়া-বার্চা পরিবার নিউ অরিলিনসের উদ্দ্যেশে গ্রেহাউন্ড বাসে উঠে বসেন, যেখানে মেনদোসা আরো ১৫০ ডলার পাঠাবেন বোগোতা থেকে।
আঠারো মাসের শিশু নিয়ে, চৌদ্দ দিনের যাত্রাটি ছিল যথেষ্ট কষ্টসাধ্য, ঘনঘন বাস থামানো নিয়ে পরবর্তী সময়ে তিনি অভিযোগ করবেন, আর ছিল অন্তহীন ‘শক্ত কাগজের ঠোঙ্গার ভিতর হ্যামবার্গার,’ ‘কাঠের গুড়ার হটডগ’ এবং কোকাকোলার প্লাস্টিকের বাকেট। একদম শেষের দিকে তাঁরা রদ্রিগোর প্রসেস করা বেবিফুড খাওয়া শুরু করলেন, বিশেষ করে সেদ্ধ করা ফল। তারা দেখলেন মেরিল্যান্ড, ভার্জিনিয়া, দুই ক্যারোলিনা, জর্জিয়া, অ্যালাবামা এবং মিসিসিপ্পি। গার্সিয়া মার্কেসের নিজের জন্য তার বহুদিনের স্বপ্ন ফকনারের দেশে অবশেষে যাওয়ার সুযোগটা মিলল। অন্যসব বিদেশী দর্শনার্থীর মতো ওইসময়ে, তরুণ দম্পত্তিটি আমেরিকার দক্ষিণে উপর্যুপরি বর্ণবাদের উদাহরণে ভীষণ মর্মাহত, বিশেষ করে এক দশক পরে সিভিল রাইট রিফর্মের আগের জর্জিয়া এবং অ্যালাবামার অবস্থা দেখে। মন্টোগোমারিতে তাঁরা এক রাতটি ঘুমোতে পারেনি কারণ কেউ ‘ডার্টি মেহিকান’দের হোটেল কক্ষ ভাড়া দিবে না। অবশেষে তাঁরা যখন নিউ অরিলিন্সে এসে পৌঁছান, তাঁরা ‘উদরপূর্তি করে খাওয়ার জন্য যথার্থ খাবারের জন্য হন্যে হয়ে উঠেছিলেন এবং মেনদোসার ১৫০ ডলারের কিছুটা ব্যয় করেছেন, যেটা কলম্বিয়ার দূতাবাস অফিসে পাঠানো হয়েছে, উঁচুদরের ফরাসি রেস্তোরাঁ ‘লে ভিউ কারে’ ভালো করে এক বেলার খাবার খাওয়ার জন্য। যাইহোক, যখন টেবিলে নৈশভোজের খাবার এলো, প্রতিটা স্টেকের ওপর ঢাউস সাইজের পিচফল দেখে তাঁরা বেশ আশাহত হয়েছিল। ১৯৮৩ সালে গার্সিয়া মার্কেস তাঁদের সেই বিশাল দুঃসাহসিক অভিযানের কথা স্মরণ করবেন:
বীরোচিত ভ্রমণ যাত্রা শেষে আমরা আবারও সত্য এবং গল্পকাহিনির মধ্যকার সম্পর্কের মুখোমুখি হলাম: তুলার ক্ষেতের মাঝখানে অনিন্দ্য সুন্দর পার্থেনন, কৃষকরা রাস্তার পাশের সরাইখানায় ছাঁইচের নিচে দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রা সেরে নিচ্ছে, কালো মানুষদের কুঁড়েঘর দৈন্যতাকে সাথী করে টিকে আছে, আর আঙ্কেল গাভিন স্টিভেন্সের উত্তরাধিকার সাদারা,মসলিনের পোশাক পরা ক্ষীণকায় নির্জীব নারীদের সাথে দলেবলে রোববারের প্রার্থনাসভায় যোগ দিতে হেঁটে রওনা দিয়েছে; ইয়োকনাপাতাওফা কাউন্টির ভীতিপ্রদ ভুবন, বাসের জানালার ভিতর দিয়ে আমাদের চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল, এবং এ ছিল বুড়ো প-িতের উপন্যাসের মতো সত্যি এবং মানবিক।
দুর্বিষহ যাত্রা শেষ করে তিনি মেনদোসাকে তাঁর প্রথম চিঠিতে বলবেন, ‘আমরা এক দারুণ কৌতূহোলোদ্দীপক ভ্রমণ শেষে অবশেষে, নিরাপদে এবং সুস্থ শরীরে এসে পৌঁছেছি, যেটি একদিকে প্রমাণ করেছে যে, ফকনার এবং বাকিরা তাঁদের দেশের পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে সত্য কথাই বলেছেন এবং অপরদিকে, বলতেই হয়, রদ্রিগো যথার্থই কোলেপিঠে বহনযোগ্য যুবকে পরিণত হয়েছে, যে কিনা যে কোন জরুরি পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
অবশেষে, দুটো দীর্ঘ এবং অবিস্মরণীয় সপ্তাহের পর তারা লারেদো সীমান্তে এসে পৌছান। সেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে বৈপরিত্যে-ঠাসা সীমান্তে, তাঁরা একটা নোংরা, অপরিচ্ছন্ন মফস্বল শহর দেখতে পাবেন যেখানে, তৎসত্ত্বেও তাঁরা অনুভব করেন জীবনটা হঠাৎ করেই বাস্তবের রূপ নিয়েছে। এই প্রথম সস্তা কোনো এক রেস্তোরাঁয় তাঁদের সুস্বাদু খাবার পরিবেশন করে। মের্সেদেস সিদ্ধান্ত নেন, মেহিকোর মতো একটা দেশ, যেখানে তিনি আবিষ্কার করেছেন- এখানকার লোকেরা ভাত এবং অন্য অনেক কিছুরই রান্নার গোপন রেসিপি জানে- সেজন্য এখানে হয়ত তিনি বেঁচেবর্তে থাকতে পারবেন। তাঁরা একটি ট্রেন ধরে ১৯৬১ সালের জুন মাসে মেহিকো শহরে এসে পৌঁছান। তাঁরা একটি বিশাল কিন্তু সামলে সুমলে চলা যাবে এমন একটি শহরের দেখা পেলেন যেখানে বুলেভার্ডগুলো ফুলের সাথে মিল রেখে সারি করে তৈরি করা এবং যেখানে, সে সময়, দূরের আকাশটা স্বচ্ছ, নীলিমায় নীল এবং আপনি এখনো সেখানে আগ্নেয়গিরি দেখতে পাবেন। (সমাপ্ত)