একরত্তি গল্প

মুশাররাত

পিও জানালো, স্যারের রুমে গেস্ট আছে; কিন্তু ময়ুখের পদক্ষেপে জিদ ছিলো সেটাই তাকে জোর করে বসের রুমে ঢুকে যেতে বাধ্য করলো। সালাম দিয়ে বসের এটিচ্যুড খেয়াল করলো। দেখলো, এখন না পরে কথা হবে টাইপের এক্সপ্রেশন। বুঝে চট করে বলে ফেললো, ‘স্যার খুব জরুরি একটা বিষয় ছিলো।’

‘একটু পরে আসো, আমি কথা বলছি।’

‘স্যার একজন বাংলাদেশি ওয়ার্কার মারা যাচ্ছে-’

‘কতজনই তো মারা যাচ্ছে প্রতিদিন, মৃত্যু কি আমরা ঠেকাতে পারবো, বললাম আমি কথা বলছি, পরে আসো। এটা এমন কী জরুরি বিষয়! এ নিয়ে আমি পরে তোমার সাথে কথা বলবো।’

সম্পূর্ণ ইগনোর করে গেস্টের দিকে মনোযোগী হলেন স্যার।

হনহন করে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে গেলো ময়ুখ। লেবার উইংয়ের ব্লকের সামনে প্রতিদিনের মতো প্রায় শত মানুষের ভিড়। সবার মুখেই ক্লান্তির থাবা, খেটে খাওয়া মানুষের সজীবতাহীন মুখ। অনেকেই আছে বুকের সামনে বেবি ব্যাগ ঝোলানো- ভিতরে ক্যাঙারুর মতো বাচ্চার মুখ বের হয়ে আছে। হাতে দুধের ফিডার। এদের বেশিরভাগের মা ইন্দোনেশিয়ান। বাংলাদেশি যুবকদের মধ্যে তারা খুব কর্মঠ পুরুষালী একটা আকর্ষণ ফিল করে। ফলাফল, বিয়ে বা দৈহিক সম্পর্ক, পরিণতি- সন্তান।

আবেগী বাংলাদেশি স্বামী যখন বৌ-বাচ্চার প্রতি দিওয়ানা তখনই মহিলাগুলো নিষ্ঠুরতার চরম রূপ দেখায়- নিজের সন্তানকে ফেলে হারিয়ে যায়। হয় নিজ দেশে না হলে অন্য পুরুষের সাথে। ময়ুখ একদিনে চারজন ওয়ার্কারকে পেয়েছে যারা বাচ্চা, ফিডার হাতে ট্রাভেল পাসের জন্য এসেছে- দেশে গিয়ে বাচ্চাকে দাদি বা পরিচিত কারো কাছে রেখে আসবে। কারণ বাচ্চা নিয়ে কাজ করা যায় না। এই বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে ছেলে হয়েও ময়ুখের বুকটা হু হু করে কেঁদে ওঠে। মনে মনে গালি দেয় ‘মা জতির কলংক’ বলে। আর কিছু করতে পারে না। হৃদয়ের দাবির কাছে যুক্তি অচল। শরীরের দাবি তার চেয়েও ভয়াবহ।

ময়ুখ রুমে এসে দ্রুত ফোন করে ডাক্তারকে। ডাক্তার যেন তার ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলেন। মালয়েশিয়ান টানে গড়গড় করে ইংরেজিতে জানায়,

“মি: আহমেদ, উই আর ওয়েটিং ফর ইওর অফিস রিপ্লাই। বিকজ ইফ উই ডোন্ট গো ফর ফারদার অপারেশন রেজাল্ট মাইট বি ভেরি পিটি।”

“ওকে ডক্টর, প্লিজ গিভ মি সাম টাইম। কলিং ইউ ব্যাক সুন”

ময়ুখের হঠাৎ খুব অসহায় লাগে। কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। কলাগাছের মতো ফুলে উঠা বাবলুর পায়ের ছবি বারবার চোখে ভাসছিলো, আর কানে বাজছিলো তার গোঙানির শব্দ। ময়ুখ যখন দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছিল হসপিটালের দিকে তখন ভেবেছিলো পিছনের সিটে ছেলেটা হয়ত ঘুমের মধ্যে নাক ডাকছে। মনির সাহেব পাশের সিটে বসে ডাক্তারের সাথে মালে ভাষায় যোগাযোগ করে যাচ্ছিলেন যেন হসপিটালে পৌঁছানোর সাথে সাথে ভর্তি করে নেয়া যায়। ফরেনারদের জন্য এমব্যাসির চিঠি ছাড়া তারা ভর্তি নেয় না সহজে। কিন্তু চিঠি করার সময় তখন ছিলো না। অফিস টাইমেরও অনেক পরে সন্ধ্যার দিকেই তো ময়ুখ বাবলুর কান্নার আওয়াজ পেয়েছিলো দোতলার রুম থেকে নামার সময়। নিচের ফিংগার প্রিন্ট নেয়ার রুমটাতে কৌতূহলবশত উঁকি দিতেই নাকে মলমূত্রের গন্ধ পায়। দেখে অন্ধকার কোনায় আঁ আঁ করে যে ছেলেটা কাঁদছে সে সকালে ময়ুখের কাছে এসেছিলো ট্রাভেল পাস নিতে। বলেছিলো, স্যার দেশে যাবো চিকিৎসা করাতে পায়ে সমস্যা। ‘কেন? যে কোম্পানিতে কাজ করেন মালিক চিকিৎসার খরচ দেয় না?’ বরাবরের মতোই জানতে চাইলো। মুখটা একমেঘ ছায়ায় ঢেকে সে উত্তর দিয়েছিলো, ভিসা যে কোম্পানির নামে সেখানে কোনো কাজ নাই,ঐ মালিকই সাব এজেন্টের মাধ্যমে কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছে; বিনিময়ে বেতনের একটা অংশ মূল মালিককে দিতে হয়। সে ভিসার মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে প্রায় নয় মাস। সবসময় পুলিশের ভয়ে থাকে। তাই ডাক্তারের কাছেও যেতে পারে না। কিন্তু পায়ের ব্যথা সহ্য করতে না পেরে আজ লুকিয়ে লুকিয়ে কেএলে চলে এসেছে। কখন রওনা দিয়েছেন প্রশ্ন করতে জানালো, গত সন্ধ্যায়। পেনাং থেকে কুয়ালালামপুর পৌনে চার শ’ কিলোমিটারের মতো দূরে। ‘ওখানে কনস্যুলেট তাইলে কী কাজ করে’ সে বিজ্ঞের মতো উত্তর দেয়, স্যার অনারারি কনসাল, ট্রাভেল পাসটাস দেয় না। ময়ুখ এবার ছেলেটার দিকে তাকায়; খেটে খাওয়া সুঠাম শরীর, লম্বাটে মুখে কোঁকড়া চুলগুলো বেশ মানিয়েছে। ঘনশ্যামলা মুখে ক্লান্তির কোনো ছাপ নাই।

সেদিন ইন্টারভিউ নেয়া হলো একশত বাষট্টি জনের। এরপর ফরমগুলো নিচে চলে গেলো টাইপে। তারপর আবার ময়ুখের স্বাক্ষর। রোহিঙ্গা কেউ যেন বাংলাদেশি হিসাবে ট্রাভেল পাস না পায় সেজন্য অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হয় প্রতিটা ইন্টারভিউয়ে। কারণ বাবলুর মতো বেশিরভাগেরই বাড়ি মহেশখালী, সাবরাঙ বা কক্সবাজার। দুপুরে লাঞ্চ করার সময়ও সে পাচ্ছে না এ ক’দিন। তার উপর একেকজনের সাথে কথা বলে যে একেকটা গল্প উঠে আসে সেই মানবিক বিষয়গুলোও ময়ুখকে ক্লান্ত করে তোলে। গত সপ্তাহেই ওয়ার্কারদের কারখানা, আবাসন ভিজিটে গিয়েছিলো- একজায়গায় দেখা গেলো বিছানা কালো তেল চিটচিটে। ধোয়া হয় না কেন জানতে চাইতেই বিছানার এ্যালটি ছেলেটা বললো, স্যার ঘুমানোরই সময় পাই না চাদর বালিশ ধুবো কখন। কথা বলে জানা গেলো মূল ডিউটির পরে ওভারটাইমের লোভে এরা পর্যাপ্ত ঘুম বাদ দিয়ে কাজে চলে যায়। ময়ুখ প্রায়ই তাদের বোঝানোর চেষ্টা করে, আপনার মা-বাবা-বোন কেউ বলে কখনও যে আপনি যেমনে পারেন তেমন রোজগার করে পাঠান পরিবারে! তারা জানে আপনার এই কষ্ট করার কথা! কেন নিজের জীবনের উপর এসব ঝুঁকি নিচ্ছেন? প্রবাসজীবনে অর্থ উপার্জনের পিছনের এই গল্পগুলো শোনার মানুষ তো তারাই- ভাবে ময়ুখ। হা হা শব্দে একাকী হেসে ওঠে পরক্ষণেই। উঠে গিয়ে আয়নায় মুখ দেখে।

বাবলুর পা কাটার ডিশিসান কেউ দিবে না। গ্যাংগ্রিনে পুরো পায়ে পচন ধরেছে। ময়ুখ আর মনির সাহেব যখন বাবলুর বিশাল শরীরটা ধরে ময়ুখের গাড়িতে ওঠাচ্ছিল তার আগেই একটা মাইল্ড স্ট্রোক তার হয়ে গেছে। এডমিন অফিসার তৈয়ব সাহেব নিজে দৌড়ে গিয়েছে বাইরের দোকানে। দোকান থেকে বাবলুর বিষ্ঠা পরিষ্কার করে সদ্য কিনে আনা প্যাম্পাস পরিয়ে দিয়েছে। তারা যখন উইংয়ের বেতনভুক কর্মচারীর ঊর্ধ্বে উঠে এই সেবা দিচ্ছিল, তখন অফিসের গাড়িটা পাশেই ছিলো। ময়ুখ ড্রাইভারকে বললো, স্যারকে বলেন একজন লেবার মরণাপন্ন, হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে, গাড়িটা লাগবে; ড্রাইভার স্যারের কাছে গেলেন; ফিরে এলেন এই বার্তা নিয়ে যে, স্যারকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে এসে রোগীটাকে নিতে পারবে।

ড্রাইভিং সিটে ময়ুখ, পিছনে গোঙাচ্ছিলো বাবলু আর পাশে কল্যাণ সহকারি মনিরকে নিয়ে হসপিটালের দিকে ছুটে চললো ময়ুখের টয়োটা উইশ। হসপিটালের সকল ফরমালিটিজ শেষ করে বাবলুর পকেট থেকে কিছু কাগজপত্র খুঁজে নেয়া হলো সকালে ইস্যু করা ট্রাভেল পারমিটটাসহ। মোবাইলের কনটাক্ট লিস্ট থেকে বের করা হলো মালয়েশিয়ায় তার কাছেরজন একই গ্রামের আজাদেকে। ভাগ্যিস কেএলেই ছিলো। খবরটা দেয়া মাত্র হাসপাতালে আসলেন তিনি। থাকেন কেএল থেকে একশ’ কিলো দূরে। স্বেচ্ছায় বাবলুর কাছে থাকতে রাজি হলেন একই সাথে মহেশখালীতে বাবলুর বাবা-মা’র সাথে যোগোযোগ করা হলো তার শরীরের বিস্তারিত খবরসহ। কেবল এটুকু জানানোর সাহস পাওয়া গেলো না যে, আগামীকাল তাদের সন্তানের পা কেটে ফেলা হবে, কোন উপায় নেই।

ময়ুখ তার ইমিডিয়েট অথরিটিকে বিষয়টা জানালো। গতানুগতিকভাবে কনভারসেশন হলো, একেকটা স্টেপের বর্ণনা দিচ্ছিলো ময়ুখ আর ওপাশ থেকে হাই তুলতে তুলতে প্রতিবারই জবাব আসছিলো ‘গুড, ভেরি গুড’। দায়িত্ব ময়ুখের এটুকুই- রিপোর্টিং। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলো ডাক্তারের সাথে কথা বলে। বাসায় ফিরে আজাদের জন্য রাতের খাবার নিয়ে আসতে হবে।

পরদিন একপায়ে অপারেশনের পর দেখা গেলো তার অন্য পা টাতেও গ্যাংগ্রিন ছড়িয়েছে। কাজেই গুরুতর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এরই মাঝে ময়ুখ দুপুরে একবার এসে খোঁজ নিয়ে গেছে। বাবলু তখন তার দিকে তাকিয়েছিল,চিনেছিলো কিনা বুঝতে পারা যায়নি। সাদা কাপড়ে ঢেকে রাখা তার পা’টা ময়ুখকে আর বাঁধা দিতে পারলো না। মুখটা ঘুরিয়ে দু’চোখ বেয়ে ধেয়ে আসা অশ্রুর ঢলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

বাবলুর জ্বর এসেছে বলে অন্য পায়ের অপারেশানটার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সিনিয়র ডাক্তারও। হার্টের অবস্থাও খুব বেশি সুবিধার না। অক্সিজেন মাস্ক দেয়া হয়েছে।

অফিসে ফিরে এসে মনির সাহেবের সহায়তায় সারাদিন মনিটরিংয়ে থেকেছে ময়ুখ।বিকালে রুটিন মাফিক মনির সাহেবসহ হসপিটালে গেলো। ডাক্তাররা খুব মনোযোগ রাখছেন দেখে ভালো লাগলো। সন্ধ্যা সাতটার দিকে বাংলাদেশী একটা নম্বর থেকে ফোন আসলো, আমি ক্যাবিনেট থেকে বলছি, আচ্ছা শোনেন আমার গ্রামের একটা ছেলে অসুস্থ হয়ে কুয়ালালামপুরে কোনো একটা হসপিটালে ভর্তি আছে। আপনারা একটু খেয়াল রাখবেন, ছেলেটা খুব গরিব। ট্রিটমেন্টটা যেন প্রপারলি হয় দেখবেন।’

ময়ুখ জবাবে বিস্তারিত জানিয়ে দিলো সর্বশেষ আপডেটসহ। সাথে এটা বলতেও ভুললো না যে, স্যার উনার বাবা-মা’র পারমিশন একটু লাগবে আরেকটা পায়ের অপারেশানের জন্য।‘আচ্ছা আমি ওদের বলে দিচ্ছি। যেটা প্রয়োজন হয় আপনারা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিন।’

সবাই বাবলুর পাশে গেলো- ছেলেটাকে তিনদিন ধরে দেখতে দেখতে কেমন মায়া পড়ে গেছে। ময়ুখের ডানহাতটা অজান্তেই বাবলুর কপালে উঠে গেলো। মনে হলো, এখন যদি ছেলেটার বাবা-মা কাছে থাকতো এমন করেই নিশ্চয় হাত বুলিয়ে দিতো, দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিতো। ময়ুখও তাই করল,মনে মনে বললো, পরমকরুণাময়, তুমি যাকে সাহায্য করো তার তো অন্য কোনো সাহায্যকারীর দরকার হয় না। তুমি বিদেশ বিভুঁইয়েপড়ে থাকা এই অসহায় ছেলেটাকে তার মায়ের বুকে পৌঁছে দাও। মোবাইলের শব্দে চমকে ওঠে, বসের কল-

“ময়ুখ, কোথায় তুমি?” খুব কোমল স্বরে, স্নেহ ভরে জানতে চাইলেন।

“স্যার, আমি তো কেএল হসপিটালে স্যার ঐ যে বাবলু নামে একজন লেবার-”

“হ্যাঁ জানি আমি, কেমন আছে সে এখন”

বাবলু সবিস্তার জানালো। মাখনের মতো মোলায়েম তার বলার ধরনে ময়ুখ মনে মনে হেসে নিলো। বললেন, “একটু ভালোভাবে টেক কেয়ার করো হসপিটালের খরচ টরচ লাগলে অবশ্যই জানাবা। তার বাড়ি মনে হয়-”

“জ্বি স্যার বদরুদ্দীন স্যারের এলাকায়”

বসের কথা শেষ করতে না দিয়ে জানায় ময়ুখ। বড় কর্তার ফোন পেয়েই বাবলু এখন ভিআইপি হয়ে গেলো।

আজাদ বেচারা গতরাত থেকে আজ পর্যন্ত টানা হসপিটালেই আছে। বাবলুর বাবা-মাকে টাইমলি সব জানাচ্ছে। এমব্যাসির একজন ডিপ্লেম্যাটনিজে এসেছে বলে হসপিটাল কর্তৃপক্ষও যথেষ্ট কোঅপারেশান দিচ্ছে। মনিরের সাথে নিজ ভাষায় আলাপচারিতা চালায় তারা। আমাদের দেশের মতো না যে, বড় ডাক্তার বলে দূরত্বও বড়। এরা সব রোগীদের সমান চোখে দেখে। তবে অবাক হচ্ছে এই ভেবে যে, এমব্যাসির একজন অফিসার তাদের নিজ দেশের শ্রমিকদের এতো ভালোবাসে! দিনে রাতে নিজে বারবার আসছেন; তাদের তাকানোতে সমীহের একটা ভাব চলে এসেছে। ময়ুখের খুব বিব্রত লাগলো নিজের কাছেই। সে তো তার দায়িত্ব পালন করছে মাত্র।

আজাদ বললো, স্যার বাবলুর মায়ে তো খালি কান্নাকাটি করছে। বলছে, আমার ছেলে যেমন গেছে তেমন ফিরায়েআনো। আপনি একটু বুঝিয়ে বলবেন? ময়ুখ মোবাইল হাতে নিল, হঠাৎ যেন শক্তি ফিরে পেলো তার আবেগ এবং সে সুন্দরভাবে মা’কে কনভিন্স করলো এটা বলে যে, অপারেশানটা করলে বাবলু হয়তো তাতে বেঁচে উঠবে। এইবার ফোন করলো বাবলুর ইমিডিয়েট বস। আগেরজনের মতো একইভাবে মিষ্টি সুরে বাবলুর খোঁজখবর রাখার সফট নির্দেশনা।

“মি: আহমেদ” ময়ুখ মোবাইলটা পকেটে রাখতে রাখতে জবাব দেন “ইয়েস?”

উই নিড ইওর অফিসিয়াল পারমিশন বিফোর গোয়িঙ ফারদার অপারেশান অলসো হিজ হার্ট ইজ নট ফাংশনিং ওয়েল। হি মে নিড লাইফ সাপোর্ট এনিটাইম।”

“প্লিজ ডু ডক্টর, হোয়াট ইজ নেসেসারি ফর হিম টু সারভাইভ”

রাতে বাসায় ফিরে একটু ছেলেমানুষী পেলো ময়ুখের। সে এক পা দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করলো। ছেলেবেলায় দেখা মেয়েদের কুতকুত খেলা হলো, হাঁটা গেলো না। আর দু’পা না থাকলে! ময়ুখ আর ভাবার সাহস পেলো না। সকালে উঠেই প্রথম প্ল্যান পেনাংয়ের কনস্যুলেট করার জন্য সব কিছুর অনুমোদন থাকা সত্ত্বেও কেন তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না! কেন পেনাংয়ের জন্য নিয়োজিত অফিসার, এও, পিও, পিয়ন, ড্রাইভার কুয়ালালামপুরে অফিস করে! কেন সেই গাড়ি শ্রমিকদের কোন কাজে আসে না- এসব ইস্যু নিয়ে মন্ত্রণালয়ে কথা বলবে। আর দৃষ্টান্ত দিবে বাবলুর।

সকাল দশটার দিকে মনির সাহেব ক্যাসকেড কোম্পানির একটা চিঠি নিয়ে আসে। ময়ুখ হাসতে হাসতে হাত বাড়িয়ে দিয়ে চিঠিটা স্বাক্ষরের জন্য নিয়ে বলে ওঠে, ‘আরে এতো সকালে লাশের চিঠি কেন’

তার হাতটা কেঁপে ওঠে প্রথম লাইন পড়তে গিয়ে “এস আই ক্যাসকেড হ্যাজ বিন অথরাইজড টু এমব্লেম এন্ড ট্রান্সপোর্ট দ্য ডেডবডি অফ লেট বাবলু আখতার, পাসপোর্ট নং... দরজায় আজাদ দাঁড়িয়ে আছে কাঁধে লম্বা স্ট্র্যাপ দিয়ে আড়াআড়ি ঝোলানো সেই ছোট ব্যাগ নিয়ে, রাত জাগার ক্লান্তির সাথে আরও কিছু মিশে আছে, একই শার্টটা গায়ে তিন দিন ধরে। আস্তে করে বললো, “স্যার গত রাত আড়াইটার দিকে।”

বৃহস্পতিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৩ , ৩০ কার্তিক ১৪৩০, ৩০ রবিউস সানি ১৪৪৫

একরত্তি গল্প

মুশাররাত

image

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

পিও জানালো, স্যারের রুমে গেস্ট আছে; কিন্তু ময়ুখের পদক্ষেপে জিদ ছিলো সেটাই তাকে জোর করে বসের রুমে ঢুকে যেতে বাধ্য করলো। সালাম দিয়ে বসের এটিচ্যুড খেয়াল করলো। দেখলো, এখন না পরে কথা হবে টাইপের এক্সপ্রেশন। বুঝে চট করে বলে ফেললো, ‘স্যার খুব জরুরি একটা বিষয় ছিলো।’

‘একটু পরে আসো, আমি কথা বলছি।’

‘স্যার একজন বাংলাদেশি ওয়ার্কার মারা যাচ্ছে-’

‘কতজনই তো মারা যাচ্ছে প্রতিদিন, মৃত্যু কি আমরা ঠেকাতে পারবো, বললাম আমি কথা বলছি, পরে আসো। এটা এমন কী জরুরি বিষয়! এ নিয়ে আমি পরে তোমার সাথে কথা বলবো।’

সম্পূর্ণ ইগনোর করে গেস্টের দিকে মনোযোগী হলেন স্যার।

হনহন করে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে গেলো ময়ুখ। লেবার উইংয়ের ব্লকের সামনে প্রতিদিনের মতো প্রায় শত মানুষের ভিড়। সবার মুখেই ক্লান্তির থাবা, খেটে খাওয়া মানুষের সজীবতাহীন মুখ। অনেকেই আছে বুকের সামনে বেবি ব্যাগ ঝোলানো- ভিতরে ক্যাঙারুর মতো বাচ্চার মুখ বের হয়ে আছে। হাতে দুধের ফিডার। এদের বেশিরভাগের মা ইন্দোনেশিয়ান। বাংলাদেশি যুবকদের মধ্যে তারা খুব কর্মঠ পুরুষালী একটা আকর্ষণ ফিল করে। ফলাফল, বিয়ে বা দৈহিক সম্পর্ক, পরিণতি- সন্তান।

আবেগী বাংলাদেশি স্বামী যখন বৌ-বাচ্চার প্রতি দিওয়ানা তখনই মহিলাগুলো নিষ্ঠুরতার চরম রূপ দেখায়- নিজের সন্তানকে ফেলে হারিয়ে যায়। হয় নিজ দেশে না হলে অন্য পুরুষের সাথে। ময়ুখ একদিনে চারজন ওয়ার্কারকে পেয়েছে যারা বাচ্চা, ফিডার হাতে ট্রাভেল পাসের জন্য এসেছে- দেশে গিয়ে বাচ্চাকে দাদি বা পরিচিত কারো কাছে রেখে আসবে। কারণ বাচ্চা নিয়ে কাজ করা যায় না। এই বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে ছেলে হয়েও ময়ুখের বুকটা হু হু করে কেঁদে ওঠে। মনে মনে গালি দেয় ‘মা জতির কলংক’ বলে। আর কিছু করতে পারে না। হৃদয়ের দাবির কাছে যুক্তি অচল। শরীরের দাবি তার চেয়েও ভয়াবহ।

ময়ুখ রুমে এসে দ্রুত ফোন করে ডাক্তারকে। ডাক্তার যেন তার ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলেন। মালয়েশিয়ান টানে গড়গড় করে ইংরেজিতে জানায়,

“মি: আহমেদ, উই আর ওয়েটিং ফর ইওর অফিস রিপ্লাই। বিকজ ইফ উই ডোন্ট গো ফর ফারদার অপারেশন রেজাল্ট মাইট বি ভেরি পিটি।”

“ওকে ডক্টর, প্লিজ গিভ মি সাম টাইম। কলিং ইউ ব্যাক সুন”

ময়ুখের হঠাৎ খুব অসহায় লাগে। কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। কলাগাছের মতো ফুলে উঠা বাবলুর পায়ের ছবি বারবার চোখে ভাসছিলো, আর কানে বাজছিলো তার গোঙানির শব্দ। ময়ুখ যখন দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছিল হসপিটালের দিকে তখন ভেবেছিলো পিছনের সিটে ছেলেটা হয়ত ঘুমের মধ্যে নাক ডাকছে। মনির সাহেব পাশের সিটে বসে ডাক্তারের সাথে মালে ভাষায় যোগাযোগ করে যাচ্ছিলেন যেন হসপিটালে পৌঁছানোর সাথে সাথে ভর্তি করে নেয়া যায়। ফরেনারদের জন্য এমব্যাসির চিঠি ছাড়া তারা ভর্তি নেয় না সহজে। কিন্তু চিঠি করার সময় তখন ছিলো না। অফিস টাইমেরও অনেক পরে সন্ধ্যার দিকেই তো ময়ুখ বাবলুর কান্নার আওয়াজ পেয়েছিলো দোতলার রুম থেকে নামার সময়। নিচের ফিংগার প্রিন্ট নেয়ার রুমটাতে কৌতূহলবশত উঁকি দিতেই নাকে মলমূত্রের গন্ধ পায়। দেখে অন্ধকার কোনায় আঁ আঁ করে যে ছেলেটা কাঁদছে সে সকালে ময়ুখের কাছে এসেছিলো ট্রাভেল পাস নিতে। বলেছিলো, স্যার দেশে যাবো চিকিৎসা করাতে পায়ে সমস্যা। ‘কেন? যে কোম্পানিতে কাজ করেন মালিক চিকিৎসার খরচ দেয় না?’ বরাবরের মতোই জানতে চাইলো। মুখটা একমেঘ ছায়ায় ঢেকে সে উত্তর দিয়েছিলো, ভিসা যে কোম্পানির নামে সেখানে কোনো কাজ নাই,ঐ মালিকই সাব এজেন্টের মাধ্যমে কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছে; বিনিময়ে বেতনের একটা অংশ মূল মালিককে দিতে হয়। সে ভিসার মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে প্রায় নয় মাস। সবসময় পুলিশের ভয়ে থাকে। তাই ডাক্তারের কাছেও যেতে পারে না। কিন্তু পায়ের ব্যথা সহ্য করতে না পেরে আজ লুকিয়ে লুকিয়ে কেএলে চলে এসেছে। কখন রওনা দিয়েছেন প্রশ্ন করতে জানালো, গত সন্ধ্যায়। পেনাং থেকে কুয়ালালামপুর পৌনে চার শ’ কিলোমিটারের মতো দূরে। ‘ওখানে কনস্যুলেট তাইলে কী কাজ করে’ সে বিজ্ঞের মতো উত্তর দেয়, স্যার অনারারি কনসাল, ট্রাভেল পাসটাস দেয় না। ময়ুখ এবার ছেলেটার দিকে তাকায়; খেটে খাওয়া সুঠাম শরীর, লম্বাটে মুখে কোঁকড়া চুলগুলো বেশ মানিয়েছে। ঘনশ্যামলা মুখে ক্লান্তির কোনো ছাপ নাই।

সেদিন ইন্টারভিউ নেয়া হলো একশত বাষট্টি জনের। এরপর ফরমগুলো নিচে চলে গেলো টাইপে। তারপর আবার ময়ুখের স্বাক্ষর। রোহিঙ্গা কেউ যেন বাংলাদেশি হিসাবে ট্রাভেল পাস না পায় সেজন্য অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হয় প্রতিটা ইন্টারভিউয়ে। কারণ বাবলুর মতো বেশিরভাগেরই বাড়ি মহেশখালী, সাবরাঙ বা কক্সবাজার। দুপুরে লাঞ্চ করার সময়ও সে পাচ্ছে না এ ক’দিন। তার উপর একেকজনের সাথে কথা বলে যে একেকটা গল্প উঠে আসে সেই মানবিক বিষয়গুলোও ময়ুখকে ক্লান্ত করে তোলে। গত সপ্তাহেই ওয়ার্কারদের কারখানা, আবাসন ভিজিটে গিয়েছিলো- একজায়গায় দেখা গেলো বিছানা কালো তেল চিটচিটে। ধোয়া হয় না কেন জানতে চাইতেই বিছানার এ্যালটি ছেলেটা বললো, স্যার ঘুমানোরই সময় পাই না চাদর বালিশ ধুবো কখন। কথা বলে জানা গেলো মূল ডিউটির পরে ওভারটাইমের লোভে এরা পর্যাপ্ত ঘুম বাদ দিয়ে কাজে চলে যায়। ময়ুখ প্রায়ই তাদের বোঝানোর চেষ্টা করে, আপনার মা-বাবা-বোন কেউ বলে কখনও যে আপনি যেমনে পারেন তেমন রোজগার করে পাঠান পরিবারে! তারা জানে আপনার এই কষ্ট করার কথা! কেন নিজের জীবনের উপর এসব ঝুঁকি নিচ্ছেন? প্রবাসজীবনে অর্থ উপার্জনের পিছনের এই গল্পগুলো শোনার মানুষ তো তারাই- ভাবে ময়ুখ। হা হা শব্দে একাকী হেসে ওঠে পরক্ষণেই। উঠে গিয়ে আয়নায় মুখ দেখে।

বাবলুর পা কাটার ডিশিসান কেউ দিবে না। গ্যাংগ্রিনে পুরো পায়ে পচন ধরেছে। ময়ুখ আর মনির সাহেব যখন বাবলুর বিশাল শরীরটা ধরে ময়ুখের গাড়িতে ওঠাচ্ছিল তার আগেই একটা মাইল্ড স্ট্রোক তার হয়ে গেছে। এডমিন অফিসার তৈয়ব সাহেব নিজে দৌড়ে গিয়েছে বাইরের দোকানে। দোকান থেকে বাবলুর বিষ্ঠা পরিষ্কার করে সদ্য কিনে আনা প্যাম্পাস পরিয়ে দিয়েছে। তারা যখন উইংয়ের বেতনভুক কর্মচারীর ঊর্ধ্বে উঠে এই সেবা দিচ্ছিল, তখন অফিসের গাড়িটা পাশেই ছিলো। ময়ুখ ড্রাইভারকে বললো, স্যারকে বলেন একজন লেবার মরণাপন্ন, হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে, গাড়িটা লাগবে; ড্রাইভার স্যারের কাছে গেলেন; ফিরে এলেন এই বার্তা নিয়ে যে, স্যারকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে এসে রোগীটাকে নিতে পারবে।

ড্রাইভিং সিটে ময়ুখ, পিছনে গোঙাচ্ছিলো বাবলু আর পাশে কল্যাণ সহকারি মনিরকে নিয়ে হসপিটালের দিকে ছুটে চললো ময়ুখের টয়োটা উইশ। হসপিটালের সকল ফরমালিটিজ শেষ করে বাবলুর পকেট থেকে কিছু কাগজপত্র খুঁজে নেয়া হলো সকালে ইস্যু করা ট্রাভেল পারমিটটাসহ। মোবাইলের কনটাক্ট লিস্ট থেকে বের করা হলো মালয়েশিয়ায় তার কাছেরজন একই গ্রামের আজাদেকে। ভাগ্যিস কেএলেই ছিলো। খবরটা দেয়া মাত্র হাসপাতালে আসলেন তিনি। থাকেন কেএল থেকে একশ’ কিলো দূরে। স্বেচ্ছায় বাবলুর কাছে থাকতে রাজি হলেন একই সাথে মহেশখালীতে বাবলুর বাবা-মা’র সাথে যোগোযোগ করা হলো তার শরীরের বিস্তারিত খবরসহ। কেবল এটুকু জানানোর সাহস পাওয়া গেলো না যে, আগামীকাল তাদের সন্তানের পা কেটে ফেলা হবে, কোন উপায় নেই।

ময়ুখ তার ইমিডিয়েট অথরিটিকে বিষয়টা জানালো। গতানুগতিকভাবে কনভারসেশন হলো, একেকটা স্টেপের বর্ণনা দিচ্ছিলো ময়ুখ আর ওপাশ থেকে হাই তুলতে তুলতে প্রতিবারই জবাব আসছিলো ‘গুড, ভেরি গুড’। দায়িত্ব ময়ুখের এটুকুই- রিপোর্টিং। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলো ডাক্তারের সাথে কথা বলে। বাসায় ফিরে আজাদের জন্য রাতের খাবার নিয়ে আসতে হবে।

পরদিন একপায়ে অপারেশনের পর দেখা গেলো তার অন্য পা টাতেও গ্যাংগ্রিন ছড়িয়েছে। কাজেই গুরুতর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এরই মাঝে ময়ুখ দুপুরে একবার এসে খোঁজ নিয়ে গেছে। বাবলু তখন তার দিকে তাকিয়েছিল,চিনেছিলো কিনা বুঝতে পারা যায়নি। সাদা কাপড়ে ঢেকে রাখা তার পা’টা ময়ুখকে আর বাঁধা দিতে পারলো না। মুখটা ঘুরিয়ে দু’চোখ বেয়ে ধেয়ে আসা অশ্রুর ঢলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

বাবলুর জ্বর এসেছে বলে অন্য পায়ের অপারেশানটার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সিনিয়র ডাক্তারও। হার্টের অবস্থাও খুব বেশি সুবিধার না। অক্সিজেন মাস্ক দেয়া হয়েছে।

অফিসে ফিরে এসে মনির সাহেবের সহায়তায় সারাদিন মনিটরিংয়ে থেকেছে ময়ুখ।বিকালে রুটিন মাফিক মনির সাহেবসহ হসপিটালে গেলো। ডাক্তাররা খুব মনোযোগ রাখছেন দেখে ভালো লাগলো। সন্ধ্যা সাতটার দিকে বাংলাদেশী একটা নম্বর থেকে ফোন আসলো, আমি ক্যাবিনেট থেকে বলছি, আচ্ছা শোনেন আমার গ্রামের একটা ছেলে অসুস্থ হয়ে কুয়ালালামপুরে কোনো একটা হসপিটালে ভর্তি আছে। আপনারা একটু খেয়াল রাখবেন, ছেলেটা খুব গরিব। ট্রিটমেন্টটা যেন প্রপারলি হয় দেখবেন।’

ময়ুখ জবাবে বিস্তারিত জানিয়ে দিলো সর্বশেষ আপডেটসহ। সাথে এটা বলতেও ভুললো না যে, স্যার উনার বাবা-মা’র পারমিশন একটু লাগবে আরেকটা পায়ের অপারেশানের জন্য।‘আচ্ছা আমি ওদের বলে দিচ্ছি। যেটা প্রয়োজন হয় আপনারা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিন।’

সবাই বাবলুর পাশে গেলো- ছেলেটাকে তিনদিন ধরে দেখতে দেখতে কেমন মায়া পড়ে গেছে। ময়ুখের ডানহাতটা অজান্তেই বাবলুর কপালে উঠে গেলো। মনে হলো, এখন যদি ছেলেটার বাবা-মা কাছে থাকতো এমন করেই নিশ্চয় হাত বুলিয়ে দিতো, দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিতো। ময়ুখও তাই করল,মনে মনে বললো, পরমকরুণাময়, তুমি যাকে সাহায্য করো তার তো অন্য কোনো সাহায্যকারীর দরকার হয় না। তুমি বিদেশ বিভুঁইয়েপড়ে থাকা এই অসহায় ছেলেটাকে তার মায়ের বুকে পৌঁছে দাও। মোবাইলের শব্দে চমকে ওঠে, বসের কল-

“ময়ুখ, কোথায় তুমি?” খুব কোমল স্বরে, স্নেহ ভরে জানতে চাইলেন।

“স্যার, আমি তো কেএল হসপিটালে স্যার ঐ যে বাবলু নামে একজন লেবার-”

“হ্যাঁ জানি আমি, কেমন আছে সে এখন”

বাবলু সবিস্তার জানালো। মাখনের মতো মোলায়েম তার বলার ধরনে ময়ুখ মনে মনে হেসে নিলো। বললেন, “একটু ভালোভাবে টেক কেয়ার করো হসপিটালের খরচ টরচ লাগলে অবশ্যই জানাবা। তার বাড়ি মনে হয়-”

“জ্বি স্যার বদরুদ্দীন স্যারের এলাকায়”

বসের কথা শেষ করতে না দিয়ে জানায় ময়ুখ। বড় কর্তার ফোন পেয়েই বাবলু এখন ভিআইপি হয়ে গেলো।

আজাদ বেচারা গতরাত থেকে আজ পর্যন্ত টানা হসপিটালেই আছে। বাবলুর বাবা-মাকে টাইমলি সব জানাচ্ছে। এমব্যাসির একজন ডিপ্লেম্যাটনিজে এসেছে বলে হসপিটাল কর্তৃপক্ষও যথেষ্ট কোঅপারেশান দিচ্ছে। মনিরের সাথে নিজ ভাষায় আলাপচারিতা চালায় তারা। আমাদের দেশের মতো না যে, বড় ডাক্তার বলে দূরত্বও বড়। এরা সব রোগীদের সমান চোখে দেখে। তবে অবাক হচ্ছে এই ভেবে যে, এমব্যাসির একজন অফিসার তাদের নিজ দেশের শ্রমিকদের এতো ভালোবাসে! দিনে রাতে নিজে বারবার আসছেন; তাদের তাকানোতে সমীহের একটা ভাব চলে এসেছে। ময়ুখের খুব বিব্রত লাগলো নিজের কাছেই। সে তো তার দায়িত্ব পালন করছে মাত্র।

আজাদ বললো, স্যার বাবলুর মায়ে তো খালি কান্নাকাটি করছে। বলছে, আমার ছেলে যেমন গেছে তেমন ফিরায়েআনো। আপনি একটু বুঝিয়ে বলবেন? ময়ুখ মোবাইল হাতে নিল, হঠাৎ যেন শক্তি ফিরে পেলো তার আবেগ এবং সে সুন্দরভাবে মা’কে কনভিন্স করলো এটা বলে যে, অপারেশানটা করলে বাবলু হয়তো তাতে বেঁচে উঠবে। এইবার ফোন করলো বাবলুর ইমিডিয়েট বস। আগেরজনের মতো একইভাবে মিষ্টি সুরে বাবলুর খোঁজখবর রাখার সফট নির্দেশনা।

“মি: আহমেদ” ময়ুখ মোবাইলটা পকেটে রাখতে রাখতে জবাব দেন “ইয়েস?”

উই নিড ইওর অফিসিয়াল পারমিশন বিফোর গোয়িঙ ফারদার অপারেশান অলসো হিজ হার্ট ইজ নট ফাংশনিং ওয়েল। হি মে নিড লাইফ সাপোর্ট এনিটাইম।”

“প্লিজ ডু ডক্টর, হোয়াট ইজ নেসেসারি ফর হিম টু সারভাইভ”

রাতে বাসায় ফিরে একটু ছেলেমানুষী পেলো ময়ুখের। সে এক পা দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করলো। ছেলেবেলায় দেখা মেয়েদের কুতকুত খেলা হলো, হাঁটা গেলো না। আর দু’পা না থাকলে! ময়ুখ আর ভাবার সাহস পেলো না। সকালে উঠেই প্রথম প্ল্যান পেনাংয়ের কনস্যুলেট করার জন্য সব কিছুর অনুমোদন থাকা সত্ত্বেও কেন তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না! কেন পেনাংয়ের জন্য নিয়োজিত অফিসার, এও, পিও, পিয়ন, ড্রাইভার কুয়ালালামপুরে অফিস করে! কেন সেই গাড়ি শ্রমিকদের কোন কাজে আসে না- এসব ইস্যু নিয়ে মন্ত্রণালয়ে কথা বলবে। আর দৃষ্টান্ত দিবে বাবলুর।

সকাল দশটার দিকে মনির সাহেব ক্যাসকেড কোম্পানির একটা চিঠি নিয়ে আসে। ময়ুখ হাসতে হাসতে হাত বাড়িয়ে দিয়ে চিঠিটা স্বাক্ষরের জন্য নিয়ে বলে ওঠে, ‘আরে এতো সকালে লাশের চিঠি কেন’

তার হাতটা কেঁপে ওঠে প্রথম লাইন পড়তে গিয়ে “এস আই ক্যাসকেড হ্যাজ বিন অথরাইজড টু এমব্লেম এন্ড ট্রান্সপোর্ট দ্য ডেডবডি অফ লেট বাবলু আখতার, পাসপোর্ট নং... দরজায় আজাদ দাঁড়িয়ে আছে কাঁধে লম্বা স্ট্র্যাপ দিয়ে আড়াআড়ি ঝোলানো সেই ছোট ব্যাগ নিয়ে, রাত জাগার ক্লান্তির সাথে আরও কিছু মিশে আছে, একই শার্টটা গায়ে তিন দিন ধরে। আস্তে করে বললো, “স্যার গত রাত আড়াইটার দিকে।”