এম আবদুল আলীম
তারেক মাহমুদ হঠাৎই না-ফেরার দেশে চলে গেলেন; কতকটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো! বন্ধু-স্বজন-শুভাকাক্সক্ষীরা বুঝতেই পারেননি, এমন করে চলে যাবেন তিনি। কতই-বা বয়স হয়েছিল? পঞ্চাশের কোটাও পার হয়নি। তবু চলে যেতে হলো তাঁকে! এই যাওয়া তো চিরন্তন, কিন্তু তাঁর তো অনেক কাজ বাকি ছিল; বিজ্ঞাপন-নির্মাণ, পত্রিকা-সম্পাদনা, গল্প-কবিতা-উপন্যাস রচনা, অভিনয়-চলচ্চিত্র প্রযোজনা, প্রকাশনা-কত কীই-না একসঙ্গে করে যাচ্ছিলেন। কতক সম্পন্ন হয়েছিল, কতক ছিল চলমান। সাহিত্য-সংস্কৃতিতে নিবেদিতপ্রাণ একজন উদার-আড্ডাপ্রিয়-বন্ধুবৎসল মানুষের এই আকস্মিক চলে যাওয়াকে তাঁর সুহৃদ-স্বজনরা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেননি; তাঁরা যেন তাঁর কবিতার ভাষায়ই তাঁকে খুঁজে ফিরেছেন-‘যে শহরে তুমি নেই/সে শহরে আর কিছু থাকতে পারে না/সে শহর বর্বর, প্রাণহীন, প্রেমহীন।’
তিনি জন্মেছিলেন পৈতৃক নিবাস পাবনা জেলার আটঘরিয়া উপজেলার দেবোত্তর গ্রামে। অল্প বয়সেই স্থির করেছিলেন সাহিত্য-সংস্কৃতিভুবনের বাসিন্দা হবেন; লিখবেন গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ; নির্মাণ করবেন নাটক-চলচ্চিত্র; করেছেনও তাই। শুরুটা সেই শৈশবে। অতঃপর থিতু হন ঢাকায়। সেটা ছিল ১৯৯৩ সালের কথা।জীবিকার তাগিদে সময় সময় পত্রিকায় চাকরি করলেও সাহিত্যচর্চাই ছিল তাঁর প্রধান কাজ। রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেট, পাবলিক লাইব্রেরি, চারুকলা, ছবির হাট, টিএসসি, বাংলা একাডেমি চত্বর এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নবীন-প্রবীণ কবি-সাহিত্যিকের আড্ডায় কাটিয়েছেন যৌবনের উদ্দীপনাভরা দিনগুলো। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি পত্রিকা-সম্পাদনা এবং অভিনয়ের দিকে ঝুঁকেছিলেন। নব্বইয়ের দশকের বাংলা লিটলম্যাগচর্চায় অন্যতম সারথি ছিলেন তিনি। ১৯৯৬ সালে চয়ন নামে একটি লিটল্ম্যাগ সম্পাদনা করেন। একটি সংখ্যার পর এটি আর বেরোয়নি। ১৯৯৭ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন সাহিত্য-সংস্কৃতির কাগজ পথিক। সাহিত্যের বিচিত্র ধারায় ছিল তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ; কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, আত্মজীবনী সব মিলিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থ তিরিশের অধিক। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো-কাব্য : কালার বাঁশি (১৯৯৭), ফিরে যাচ্ছি হৃদয়ের কাছে (১৯৯৯), মেঘেরা ডেকেছিল, যাইনি (২০০০), আকাশ বলে কিছু নেই (২০০১), ভালোবাসি কথাটি যেভাবে বলা দরকার (২০০১), সুবর্ণার চোখ (২০০২), প্রি-পেইড ভালোবাসা (২০০২), সখি আমি তোমার সখাই আছি (২০০২), তোমাকে ভুলে গেছি মনে রাখতে গিয়ে (২০০৩), পেরিয়ে যাচ্ছি সকল দরজা (২০০৪), কাতার সোজা করে দাঁড়াও (২০০৯), কুড়ি বছরের কবিতা (২০১১), ডাক নামে ডেকো (২০১৩), যে শহরে তুমি নেই (২০২২); উপন্যাস : সুমিতার জন্যে (২০০২), ডোরা (২০০৩), তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিল (২০০৯); গল্পগ্রন্থ : জলযোগ রেস্তোরাঁ (২০০৩); আত্মজীবনীমূলক রচনা : বালকবেলা (২০০৪); সাক্ষাৎকারগ্রন্থ : যাদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম (২০০৪), উত্তরপর্ব (২০০৮), আবুল হোসেনের সঙ্গে কথোপকখন (২০১০), একুশের যাত্রী (২০১১), মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র (২০৩); প্রবন্ধ : টেলিভিশন নাটকের স্ক্রিপ্ট ও নির্মাণ (২০১০), টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রথম পাঠ (২০১৫)।
তারেক মাহমুদ রোমান্টিক কবি। প্রেম, নারী, প্রকৃতি তাঁর কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ। প্রকৃতি-অন্তঃপ্রাণ এই কবিকে বোশেখের প্রথম সূর্য জানালায় এসে বলেছে, ‘ওঠো কবি/জাগাও মানুষ’, চৈত্র শেষের নদী এসে মিনতি করেছে ‘আমাকে পূর্ণ করো’, সড়কের পাশের আমগাছের কিশোর মুকুল বলেছে ‘রক্ষা করো এই মউশুমে’। একইভাবে ‘আমার প্রিয়ার মুখ’, ‘আমার শব্দপ্রিয়া’, ‘বধুয়ার চুলে বাঁধবো বসতভিটা’, ‘তোমার মধ্য থেকে বেরুতে পারবোনা’, ‘প্লাবিত হই তোমার মাঝে’, ‘তুমি আমার প্রেমিকা, স্ত্রী নও’, ‘তুমি নেই তাই’, ‘জয়শ্রী সেন’, ‘যে শহরে তুমি নেই’, ‘তোমার চুলের বেণীতে লুকিয়ে ছিলো আমার খুনের রহস্য’, ‘তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি’ ; এসব কবিতায় রোমান্টিকতা তথা প্রেম-নারী প্রকৃতি একাকার হয়ে গেছে। ‘জলহীনা’ কবিতায় লিখেছেন : ‘নদীর সংগে নৌকার ভালোবাসা বোঝো?/তোমাকে আমি নদীর মতো দেখতে চেয়েছি/আমি নৌকা/সারাজীবন ভাসতে চেয়েছি তোমার থৈ থৈ প্রেমে/হায় নদী! তুমি জলহীনা।’ (জলহীনা,মেঘেরা ডেকেছিল, যাইনি) প্রিয়ার বিরহ তাঁর অসহ্য মনে হয়েছে। বৈষ্ণবীয় প্রেম বাংলা কবিতার দীর্ঘ ঐতিহ্যের পথ ধরে তাঁর কবিচিত্তে হানা দিয়েছে। প্রিয়াহীন শহরে নিজেকে উদ্ভ্রান্ত পথিক মনে হয়েছে তাঁর। সেজন্যেই লিখেছেন : ‘ওগো, এই শহরে তুমি নেই বলে/আমি কেবলই উদ্ভ্রান্ত পথিক/আমার দেহ আছে প্রাণ নেই/ভিটে আছে বাড়ি নেই/বৃক্ষ আছে শেকড় নেই/শুধু তুমি নেই বলে/আমার সব আছে/কিন্তু কিছু নেই-কেউ নেই।’ (‘যে শহরে তুমি নেই’, যে শহরে তুমি নেই)
রোমান্টিক কবি হলেও বাস্তবতা-বিমুখ ছিলেন না।জীবনের দগদগে ক্ষত অর্থাৎ-জীবন-বাস্তবতার রূপায়ণ ঘটিয়েছেন অনেক কবিতায়। গ্রাম-শহরকে একসূত্রে গেঁথেছেন। শৈশব-কৈশোরের ফেলে আসা গ্রাম বারবার নস্টালজিক করেছে তাঁকে; লিখেছেন-‘এই শহর আমার ভাল্লাগে না/এর চেয়ে ঢের ভালো ছিলো আমার কয়ড়াবাড়ী গ্রাম/জন্মেই দেখেছি, যৌবনা নদীর বুকের উপর/পত পত করে ভেসে যাচ্ছে পাল তোলা নৌকা/... / হায়! আমার কয়ড়াবাড়ী/আর কী কখনো ফিরিয়ে দেবে/আমার স্বপ্নময় কিশোরবেলাকে।’ (‘আমার কয়ড়াবাড়ী’, মেঘেরা ডেকেছিল, যাইনি) পরবর্তীকালে ঢাকায় বসবাসসূত্রে নাগরিক জীবনের বিচিত্র অভিঘাতে তাঁর বোধ ও উপলব্ধির জগৎ পরিপুষ্ট হয়। তাঁর কবিতায় ঘুরেফিরে এসেছে রাতের সিগনাল বাতি, ট্রাফিক পুলিশের ক্লান্ত চোখ, সোডিয়ামের আলো-এসব প্রসঙ্গ। চোখের সামনে ঢাকা শহরের বদলে যাওয়া দেখেছেন। যেখানে রাস্তায় ময়লা জমা হতো সেখানে তৈরি হয়েছে ঝকঝকে কার্পেটিং রাস্তা, প্রায় প্রতিদিনও খোলা হয়েছে ব্যাংকের নতুন নতুন শাখা, ডলারের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে, নতুন নতুন পত্রিকা-চ্যানেল চালু হয়েছে, ডেভেলপাররা একের পর এক গড়ে তুলেছে হাউজিং কমপ্লেক্স, দামি গাড়ি-কত কিছু। এই ব্যস্ত নগরীতে তারেক মাহমুদ জীবনের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব খুব মেলাতে চাননি, আবার জীবনকে শিশুতোষ কোনো ব্যাপার বলেও হেসে-খেলে উড়িয়ে দিতে চাননি। জীবনের মানে তাঁর কাছে ছিল অনেক কিছু, যাতে আংশিক প্রাপ্তি ঘটে। দীর্ঘজীবী মানুষেরও দেখেছেন অনেক অপ্রাপ্তি। তাই জীবন নিয়ে খেদ করতে চাননি। এক জীবনে যতটুকু পাওয়া যায় পুরোটাকেই তাঁর লাভ বলে মনে হয়েছে। সমকালীন অনেক প্রসঙ্গ, যেমন-যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিতে শাহবাগে গড়ে ওঠা গণ-আন্দোলন এবং বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া অতিমারী করোনা নিয়েও কবিতা রচনা করেছেন। লিখেছেন : ‘শাহবাগ জেগে উঠলে/জেগে ওঠে বাংলাদেশ/কণ্ঠে আছে সাহস স্লোগান/বুকে বাংলাদেশ/... ঐ দেখো চেয়ে দেখো ঐ/আজ শাহবাগ জেগেছে বলে/এই ফাল্গুনে সমস্ত প্রেমিক/বিপ্লবী হয়ে উঠেছে।’ (‘শাহবাগ’, যে শহরে তুমি নেই) করোনা মহামারীতে দেশে দেশে বহু মানুষের প্রাণহানী ঘটে। লকডাউনে সবকিছু স্থবির হয়ে পড়ে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সকলকে গৃহবন্দি থাকতে হয়, মেনে চলতে হয় সামাজিক দূরত্ব। স্বজনের সান্নিধ্য, এমনকি প্রেমিক-প্রেমিকার দেখা-সাক্ষাৎও বন্ধ হয়ে যায়। করোনার সেই বন্দিজীবনে তারেক মাহমুদ লিখেছেন, ‘করোনার কাল শেষ হবে একদিন’, ‘ও পৃথিবী তুমি আবার কবে আগের পৃথিবী হবে?’
তিনি স্বভাবকবি ছিলেন না, আধুনিক কবিতার রূপ-রীতি যথার্থভাবে আত্মস্থ করেছিলেন। কবিতার বিষয় এবং কাব্যিক ভাষায় বৈচিত্র্য আনয়নের পাশাপাশি ছন্দ-অলঙ্কারের বহুমাত্রিক ব্যবহারে কবিতাকে শিল্পসুষমামণ্ডিত করে তুলেছেন। তোমাকে ভুলে গেছি মনে রাখতে গিয়ে, কাতার সোজা করে দাঁড়ান, পেরিয়ে যাচ্ছি সকল দরজা, যে শহরে তুমি নেই-কাব্যের এসব নামকরণ তাঁর স্বকীয়তার দ্যোতক। কবিতার ভাষাকে তিনি বিষয়-উপযোগী করে তুলেছিলেন। আলঙ্কারিক নৈপুণ্যেরও তাতে কোনো ঘাটতি ছিল না। ‘আকাশ থেকে একটি আকাশ ঝরে পড়লো’, ‘রাত গভীর হলে ঝিমিয়ে পড়ে সিগনেল বাতি’, ‘সোডিয়ামের আলোতে মুখ ধুয়ে ফেলি’-এমন অজস্র পঙ্ক্তি তাঁর কবিতায় লক্ষ করা যায়। নিজের ভাবকে গভীর করতে শিল্প-সাহিত্য-পুরাণের নানা অনুষঙ্গ ব্যবহার করেছেন। কখনো বিশ্ববরেণ্য কবি-শিল্পীদের জীবনবোধের মিথস্ক্রিয়ায় কবিতার ভাবরূপ নির্মাণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ও পিকাসোর দৃষ্টিভঙ্গির তুলনামূলক বয়ান হাজির করে লিখেছেন : ‘রবীন্দ্রনাথ এবং পিকাসোর বালিকা প্রীতিতে পার্থক্য রয়েছে/পিকাসো বালিকাদের সঙ্গে খেলতেন জাগতিক খেলা/আর রবীন্দ্রনাথ বালিকাদের গড়ে তুলতেন এক স্নিগ্ধ উপাদান দিয়ে।’ (রবীন্দ্রনাথের বালিকারা’, তোমাকে ভুলে গেছি মনে রাখতে গিয়ে)
তারেক মাহমুদের প্রতিভা ছিল বহুমাত্রিক। কবিতার মতোই উপন্যাসগুলোতে আধুনিক নর-নারীর জীবনের বিচিত্র রূপের চিত্রায়ণ ঘটিয়েছেন। সুমিতার জন্যে, নোরা, তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিলো-উপন্যাসগুলোর নামকরণই বলে দিচ্ছে এগুলোর উপজীব্য প্রেম। তাঁর উপন্যাসের কাব্যিক মাধুর্যপূর্ণ গদ্য পাঠককে ক্লান্ত করে না; দৃশ্যের পর দৃশ্য যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে-‘গ্রাম পেরিয়ে, নদী পেরিয়ে, শহর পেরিয়ে, লোকালয় পেরিয়ে, একদল মানুষের অবাক দৃষ্টি পেরিয়ে একটি ট্রেন এই কটকটে দুপুর বেলা একা একা গড়িয়ে চলছে সাপের মতো। একটি যন্ত্রযান তার পেটের মধ্যে অজস্র মানুষ নিয়ে ছুটে চলছে এক মনে। পেছনে পড়ে থাকছে স্বজনদের মুখ, প্রিয় মানুষের অভিমানী মুখ, আরো কতো কিছু।’ (সুমিতার জন্যে) তাঁর আত্মজীবনীতে বাংলাদেশের চিরায়ত গ্রামীণ জীবনের রূপ ফুটে উঠেছে। টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র নিয়ে তিনি গদ্য লিখেছেন। তত্ত্ব-তথ্যের কচকচানিতে আবদ্ধ না করে নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের কলাকৌশল তুলে ধরেছেন। এ বিষয়ে রচিত তাঁর দুখানি পুস্তিকা হলো-টেলিভিশন নাটকের স্কিপ্ট ও নির্মাণ এবং টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রথম পাঠ। ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী ছাব্বিশজন ভাষাসংগ্রামীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তিনি সম্পাদনা করেন একুশের যাত্রী গ্রন্থটি। মুক্তিযুদ্ধে শব্দসৈনিকদের স্মৃতি অম্লান করে রাখতে সম্পাদনা করেছেন মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নামক গ্রন্থ। ভাষাসংগ্রামী এবং শব্দসৈনিকদের নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণের পাশাপাশি এ গ্রন্থদুটি সম্পাদনায় দেশমাতৃকার প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতার ছাপ স্পষ্ট। নিজেই বলেছেন-‘একটিই উদ্দেশ্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম যেনো তাঁদের কথা শুনতে পায়, তাদের দেখতে পায় এবং নিজেদের মধ্যে মাতৃভাষার প্রতি একটা দরদময় ভালোবাসা তৈরি করতে পারে।’ ছিলেন শক্তিমান অভিনেতা। মঞ্চ, চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশনে অভিনয় করেছেন। এ গুণটি তাঁকে বিনোদন-জগতে বিশেষ পরিচিতি এনে দেয়। সিদ্দিকুর রহমানের গফুরের বিয়ে নাটকের আলতা পাগলা চরিত্রসহ বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করে তিনি দর্শকদের মুগ্ধ করেছেন। নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। ‘ছায়ালোক মিডিয়া স্টেশন’ নামে একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। তবে চটপটি নামে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দিলেও অর্থাভাবে তা সম্পন্ন করতে পারেননি। তিনি ‘ছায়ালোক’ নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা গড়ে তুলেছিলেন।
সবমিলিয়ে তারেক মাহমুদ ছিলেন একের মাঝে বহুর প্রকাশ; কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, সম্পাদক, নির্মাতা, প্রকাশক, অভিনেতা সবক্ষেত্রে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। সর্বোপরি তাঁর ছিল উদার, প্রাণবন্ত, সজীব একটি মন। পছন্দ করতেন প্রাণখোলা আড্ডা দিতে; মশগুল থাকতেন বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে। কিন্তু এর মাঝেও জীবন তাঁর কাছে দুঃসহ মনে হতো। কী যেন এক গভীর বেদনা ও নিঃসঙ্গতা বহন করে বেড়াতেন। সেই নিঃসঙ্গতা থেকেই মৃত্যুকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তবে কিছু কাজ করে মৃত্যুর কাছে নিজেকে সঁপতে চেয়েছিলেন; তাইতো লিখেছিলেন-‘মৃত্যু, তোমাকে নিমন্ত্রণ/তবে কথা আছে, এখনি ছুঁয়োনা আমাকে/.../ ডেস্কের দিকে তাকাও, একটি অসমাপ্ত ছবি দেখতে পাচ্ছো নিশ্চয়ই/চিনতে পারো কি-ওটা তোমার ছবি/ওটা শেষ করতে পৃথিবীর সব জল শুকিয়ে যাবে/হাতে কিছু কবিতার কাঠামো দেখতে পাচ্ছো/এগুলো শেষ করতেও লেগে যাবে ওরকম কিছু সময়/এছাড়াও রয়েছে আমার ব্যক্তিগত কিছু কাজ/মৃত্যু, আমাকে বলো/এখন কী তোমার সাথে যাওয়ার সময় আমার/এ কী মৃত্যু!/কফিটুকু শেষ না করেই উঠলে যে/মৃত্যু তুমি দাঁড়াও ॥ দাঁড়াও প্লিজ/আমার এতো কষ্টের কফিটুকু পান করে যাও।’ (‘মৃত্যু তোমাকে নিমন্ত্রণ, তবে’, মেঘেরা ডেকেছিলো, যাইনি) কিন্তু মৃত্যু তাঁর কথা রাখেনি। তাঁকে প্রার্থিত সময় না দিয়েই নিয়ে গেছে চিরতরে। অর্থাৎ-পূর্ণরূপে বিকশিত হওয়ার পূর্বেই চলে গেছেন। এতে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গন ক্ষতিগ্রস্ত হলো। বস্তুত, নাগরিক জটিলতা আর যান্ত্রিক শহরে তারেক মাহমুদ হাঁপিয়ে উঠেছিলেন, ছুটে যেতে চেয়েছিলেন তাঁর কল্পনার সবুজ-সুন্দর শহরে। যে শহরে পিচঢালা পথে কিষাণ পরিবার গোল হয়ে বসে দুপুরের খাবার খায়, যেখানে নতুন মডেলের গাড়িগুলো ছড়িয়ে দেয় সুবাসিত সবুজ ধোঁয়া, যেখানকার বহুতল দালানগুলো সুন্দরী রমণীর মতো হেসে-খেলে আকাশ ছোঁয়, যে শহরের পাখিরা আশ্চর্যভাবে দেশের গান গায়, যেখানকার মানুষেরা একমাত্র সৌন্দর্য ছাড়া আর কিছুই চায় না; তেমন শহরেই যেতে চেয়েছিলেন তারেক মাহমুদ। স্বপ্নভারনত হয়ে লিখেছিলেন-‘তেমন একটি শহর নিশ্চয়ই কোথাও আছে/আমি সেইখানে চলে যাবো/এই যান্ত্রিক গ্রাম ছেড়ে একেবারে/চলে যাবো সেই সবুজ শহরে।’ (‘যান্ত্রিক গ্রাম ছেড়ে সবুজ শহরে’, মেঘেরা ডেকেছিল, যাইনি) তবে কী নিজের কাক্সিক্ষত সেই সবুজ শহরে চলে গেছেন তিনি!
(জন্ম ৩০ জুন ১৯৭৬; মৃত্যু ২৬ অক্টোবর ২০২৩)
আরও খবরবৃহস্পতিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৩ , ৩০ কার্তিক ১৪৩০, ৩০ রবিউস সানি ১৪৪৫
এম আবদুল আলীম
(জন্ম ৩০ জুন ১৯৭৬; মৃত্যু ২৬ অক্টোবর ২০২৩)
তারেক মাহমুদ হঠাৎই না-ফেরার দেশে চলে গেলেন; কতকটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো! বন্ধু-স্বজন-শুভাকাক্সক্ষীরা বুঝতেই পারেননি, এমন করে চলে যাবেন তিনি। কতই-বা বয়স হয়েছিল? পঞ্চাশের কোটাও পার হয়নি। তবু চলে যেতে হলো তাঁকে! এই যাওয়া তো চিরন্তন, কিন্তু তাঁর তো অনেক কাজ বাকি ছিল; বিজ্ঞাপন-নির্মাণ, পত্রিকা-সম্পাদনা, গল্প-কবিতা-উপন্যাস রচনা, অভিনয়-চলচ্চিত্র প্রযোজনা, প্রকাশনা-কত কীই-না একসঙ্গে করে যাচ্ছিলেন। কতক সম্পন্ন হয়েছিল, কতক ছিল চলমান। সাহিত্য-সংস্কৃতিতে নিবেদিতপ্রাণ একজন উদার-আড্ডাপ্রিয়-বন্ধুবৎসল মানুষের এই আকস্মিক চলে যাওয়াকে তাঁর সুহৃদ-স্বজনরা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেননি; তাঁরা যেন তাঁর কবিতার ভাষায়ই তাঁকে খুঁজে ফিরেছেন-‘যে শহরে তুমি নেই/সে শহরে আর কিছু থাকতে পারে না/সে শহর বর্বর, প্রাণহীন, প্রেমহীন।’
তিনি জন্মেছিলেন পৈতৃক নিবাস পাবনা জেলার আটঘরিয়া উপজেলার দেবোত্তর গ্রামে। অল্প বয়সেই স্থির করেছিলেন সাহিত্য-সংস্কৃতিভুবনের বাসিন্দা হবেন; লিখবেন গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ; নির্মাণ করবেন নাটক-চলচ্চিত্র; করেছেনও তাই। শুরুটা সেই শৈশবে। অতঃপর থিতু হন ঢাকায়। সেটা ছিল ১৯৯৩ সালের কথা।জীবিকার তাগিদে সময় সময় পত্রিকায় চাকরি করলেও সাহিত্যচর্চাই ছিল তাঁর প্রধান কাজ। রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেট, পাবলিক লাইব্রেরি, চারুকলা, ছবির হাট, টিএসসি, বাংলা একাডেমি চত্বর এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নবীন-প্রবীণ কবি-সাহিত্যিকের আড্ডায় কাটিয়েছেন যৌবনের উদ্দীপনাভরা দিনগুলো। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি পত্রিকা-সম্পাদনা এবং অভিনয়ের দিকে ঝুঁকেছিলেন। নব্বইয়ের দশকের বাংলা লিটলম্যাগচর্চায় অন্যতম সারথি ছিলেন তিনি। ১৯৯৬ সালে চয়ন নামে একটি লিটল্ম্যাগ সম্পাদনা করেন। একটি সংখ্যার পর এটি আর বেরোয়নি। ১৯৯৭ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন সাহিত্য-সংস্কৃতির কাগজ পথিক। সাহিত্যের বিচিত্র ধারায় ছিল তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ; কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, আত্মজীবনী সব মিলিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থ তিরিশের অধিক। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো-কাব্য : কালার বাঁশি (১৯৯৭), ফিরে যাচ্ছি হৃদয়ের কাছে (১৯৯৯), মেঘেরা ডেকেছিল, যাইনি (২০০০), আকাশ বলে কিছু নেই (২০০১), ভালোবাসি কথাটি যেভাবে বলা দরকার (২০০১), সুবর্ণার চোখ (২০০২), প্রি-পেইড ভালোবাসা (২০০২), সখি আমি তোমার সখাই আছি (২০০২), তোমাকে ভুলে গেছি মনে রাখতে গিয়ে (২০০৩), পেরিয়ে যাচ্ছি সকল দরজা (২০০৪), কাতার সোজা করে দাঁড়াও (২০০৯), কুড়ি বছরের কবিতা (২০১১), ডাক নামে ডেকো (২০১৩), যে শহরে তুমি নেই (২০২২); উপন্যাস : সুমিতার জন্যে (২০০২), ডোরা (২০০৩), তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিল (২০০৯); গল্পগ্রন্থ : জলযোগ রেস্তোরাঁ (২০০৩); আত্মজীবনীমূলক রচনা : বালকবেলা (২০০৪); সাক্ষাৎকারগ্রন্থ : যাদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম (২০০৪), উত্তরপর্ব (২০০৮), আবুল হোসেনের সঙ্গে কথোপকখন (২০১০), একুশের যাত্রী (২০১১), মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র (২০৩); প্রবন্ধ : টেলিভিশন নাটকের স্ক্রিপ্ট ও নির্মাণ (২০১০), টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রথম পাঠ (২০১৫)।
তারেক মাহমুদ রোমান্টিক কবি। প্রেম, নারী, প্রকৃতি তাঁর কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ। প্রকৃতি-অন্তঃপ্রাণ এই কবিকে বোশেখের প্রথম সূর্য জানালায় এসে বলেছে, ‘ওঠো কবি/জাগাও মানুষ’, চৈত্র শেষের নদী এসে মিনতি করেছে ‘আমাকে পূর্ণ করো’, সড়কের পাশের আমগাছের কিশোর মুকুল বলেছে ‘রক্ষা করো এই মউশুমে’। একইভাবে ‘আমার প্রিয়ার মুখ’, ‘আমার শব্দপ্রিয়া’, ‘বধুয়ার চুলে বাঁধবো বসতভিটা’, ‘তোমার মধ্য থেকে বেরুতে পারবোনা’, ‘প্লাবিত হই তোমার মাঝে’, ‘তুমি আমার প্রেমিকা, স্ত্রী নও’, ‘তুমি নেই তাই’, ‘জয়শ্রী সেন’, ‘যে শহরে তুমি নেই’, ‘তোমার চুলের বেণীতে লুকিয়ে ছিলো আমার খুনের রহস্য’, ‘তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি’ ; এসব কবিতায় রোমান্টিকতা তথা প্রেম-নারী প্রকৃতি একাকার হয়ে গেছে। ‘জলহীনা’ কবিতায় লিখেছেন : ‘নদীর সংগে নৌকার ভালোবাসা বোঝো?/তোমাকে আমি নদীর মতো দেখতে চেয়েছি/আমি নৌকা/সারাজীবন ভাসতে চেয়েছি তোমার থৈ থৈ প্রেমে/হায় নদী! তুমি জলহীনা।’ (জলহীনা,মেঘেরা ডেকেছিল, যাইনি) প্রিয়ার বিরহ তাঁর অসহ্য মনে হয়েছে। বৈষ্ণবীয় প্রেম বাংলা কবিতার দীর্ঘ ঐতিহ্যের পথ ধরে তাঁর কবিচিত্তে হানা দিয়েছে। প্রিয়াহীন শহরে নিজেকে উদ্ভ্রান্ত পথিক মনে হয়েছে তাঁর। সেজন্যেই লিখেছেন : ‘ওগো, এই শহরে তুমি নেই বলে/আমি কেবলই উদ্ভ্রান্ত পথিক/আমার দেহ আছে প্রাণ নেই/ভিটে আছে বাড়ি নেই/বৃক্ষ আছে শেকড় নেই/শুধু তুমি নেই বলে/আমার সব আছে/কিন্তু কিছু নেই-কেউ নেই।’ (‘যে শহরে তুমি নেই’, যে শহরে তুমি নেই)
রোমান্টিক কবি হলেও বাস্তবতা-বিমুখ ছিলেন না।জীবনের দগদগে ক্ষত অর্থাৎ-জীবন-বাস্তবতার রূপায়ণ ঘটিয়েছেন অনেক কবিতায়। গ্রাম-শহরকে একসূত্রে গেঁথেছেন। শৈশব-কৈশোরের ফেলে আসা গ্রাম বারবার নস্টালজিক করেছে তাঁকে; লিখেছেন-‘এই শহর আমার ভাল্লাগে না/এর চেয়ে ঢের ভালো ছিলো আমার কয়ড়াবাড়ী গ্রাম/জন্মেই দেখেছি, যৌবনা নদীর বুকের উপর/পত পত করে ভেসে যাচ্ছে পাল তোলা নৌকা/... / হায়! আমার কয়ড়াবাড়ী/আর কী কখনো ফিরিয়ে দেবে/আমার স্বপ্নময় কিশোরবেলাকে।’ (‘আমার কয়ড়াবাড়ী’, মেঘেরা ডেকেছিল, যাইনি) পরবর্তীকালে ঢাকায় বসবাসসূত্রে নাগরিক জীবনের বিচিত্র অভিঘাতে তাঁর বোধ ও উপলব্ধির জগৎ পরিপুষ্ট হয়। তাঁর কবিতায় ঘুরেফিরে এসেছে রাতের সিগনাল বাতি, ট্রাফিক পুলিশের ক্লান্ত চোখ, সোডিয়ামের আলো-এসব প্রসঙ্গ। চোখের সামনে ঢাকা শহরের বদলে যাওয়া দেখেছেন। যেখানে রাস্তায় ময়লা জমা হতো সেখানে তৈরি হয়েছে ঝকঝকে কার্পেটিং রাস্তা, প্রায় প্রতিদিনও খোলা হয়েছে ব্যাংকের নতুন নতুন শাখা, ডলারের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে, নতুন নতুন পত্রিকা-চ্যানেল চালু হয়েছে, ডেভেলপাররা একের পর এক গড়ে তুলেছে হাউজিং কমপ্লেক্স, দামি গাড়ি-কত কিছু। এই ব্যস্ত নগরীতে তারেক মাহমুদ জীবনের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব খুব মেলাতে চাননি, আবার জীবনকে শিশুতোষ কোনো ব্যাপার বলেও হেসে-খেলে উড়িয়ে দিতে চাননি। জীবনের মানে তাঁর কাছে ছিল অনেক কিছু, যাতে আংশিক প্রাপ্তি ঘটে। দীর্ঘজীবী মানুষেরও দেখেছেন অনেক অপ্রাপ্তি। তাই জীবন নিয়ে খেদ করতে চাননি। এক জীবনে যতটুকু পাওয়া যায় পুরোটাকেই তাঁর লাভ বলে মনে হয়েছে। সমকালীন অনেক প্রসঙ্গ, যেমন-যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিতে শাহবাগে গড়ে ওঠা গণ-আন্দোলন এবং বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া অতিমারী করোনা নিয়েও কবিতা রচনা করেছেন। লিখেছেন : ‘শাহবাগ জেগে উঠলে/জেগে ওঠে বাংলাদেশ/কণ্ঠে আছে সাহস স্লোগান/বুকে বাংলাদেশ/... ঐ দেখো চেয়ে দেখো ঐ/আজ শাহবাগ জেগেছে বলে/এই ফাল্গুনে সমস্ত প্রেমিক/বিপ্লবী হয়ে উঠেছে।’ (‘শাহবাগ’, যে শহরে তুমি নেই) করোনা মহামারীতে দেশে দেশে বহু মানুষের প্রাণহানী ঘটে। লকডাউনে সবকিছু স্থবির হয়ে পড়ে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সকলকে গৃহবন্দি থাকতে হয়, মেনে চলতে হয় সামাজিক দূরত্ব। স্বজনের সান্নিধ্য, এমনকি প্রেমিক-প্রেমিকার দেখা-সাক্ষাৎও বন্ধ হয়ে যায়। করোনার সেই বন্দিজীবনে তারেক মাহমুদ লিখেছেন, ‘করোনার কাল শেষ হবে একদিন’, ‘ও পৃথিবী তুমি আবার কবে আগের পৃথিবী হবে?’
তিনি স্বভাবকবি ছিলেন না, আধুনিক কবিতার রূপ-রীতি যথার্থভাবে আত্মস্থ করেছিলেন। কবিতার বিষয় এবং কাব্যিক ভাষায় বৈচিত্র্য আনয়নের পাশাপাশি ছন্দ-অলঙ্কারের বহুমাত্রিক ব্যবহারে কবিতাকে শিল্পসুষমামণ্ডিত করে তুলেছেন। তোমাকে ভুলে গেছি মনে রাখতে গিয়ে, কাতার সোজা করে দাঁড়ান, পেরিয়ে যাচ্ছি সকল দরজা, যে শহরে তুমি নেই-কাব্যের এসব নামকরণ তাঁর স্বকীয়তার দ্যোতক। কবিতার ভাষাকে তিনি বিষয়-উপযোগী করে তুলেছিলেন। আলঙ্কারিক নৈপুণ্যেরও তাতে কোনো ঘাটতি ছিল না। ‘আকাশ থেকে একটি আকাশ ঝরে পড়লো’, ‘রাত গভীর হলে ঝিমিয়ে পড়ে সিগনেল বাতি’, ‘সোডিয়ামের আলোতে মুখ ধুয়ে ফেলি’-এমন অজস্র পঙ্ক্তি তাঁর কবিতায় লক্ষ করা যায়। নিজের ভাবকে গভীর করতে শিল্প-সাহিত্য-পুরাণের নানা অনুষঙ্গ ব্যবহার করেছেন। কখনো বিশ্ববরেণ্য কবি-শিল্পীদের জীবনবোধের মিথস্ক্রিয়ায় কবিতার ভাবরূপ নির্মাণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ও পিকাসোর দৃষ্টিভঙ্গির তুলনামূলক বয়ান হাজির করে লিখেছেন : ‘রবীন্দ্রনাথ এবং পিকাসোর বালিকা প্রীতিতে পার্থক্য রয়েছে/পিকাসো বালিকাদের সঙ্গে খেলতেন জাগতিক খেলা/আর রবীন্দ্রনাথ বালিকাদের গড়ে তুলতেন এক স্নিগ্ধ উপাদান দিয়ে।’ (রবীন্দ্রনাথের বালিকারা’, তোমাকে ভুলে গেছি মনে রাখতে গিয়ে)
তারেক মাহমুদের প্রতিভা ছিল বহুমাত্রিক। কবিতার মতোই উপন্যাসগুলোতে আধুনিক নর-নারীর জীবনের বিচিত্র রূপের চিত্রায়ণ ঘটিয়েছেন। সুমিতার জন্যে, নোরা, তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিলো-উপন্যাসগুলোর নামকরণই বলে দিচ্ছে এগুলোর উপজীব্য প্রেম। তাঁর উপন্যাসের কাব্যিক মাধুর্যপূর্ণ গদ্য পাঠককে ক্লান্ত করে না; দৃশ্যের পর দৃশ্য যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে-‘গ্রাম পেরিয়ে, নদী পেরিয়ে, শহর পেরিয়ে, লোকালয় পেরিয়ে, একদল মানুষের অবাক দৃষ্টি পেরিয়ে একটি ট্রেন এই কটকটে দুপুর বেলা একা একা গড়িয়ে চলছে সাপের মতো। একটি যন্ত্রযান তার পেটের মধ্যে অজস্র মানুষ নিয়ে ছুটে চলছে এক মনে। পেছনে পড়ে থাকছে স্বজনদের মুখ, প্রিয় মানুষের অভিমানী মুখ, আরো কতো কিছু।’ (সুমিতার জন্যে) তাঁর আত্মজীবনীতে বাংলাদেশের চিরায়ত গ্রামীণ জীবনের রূপ ফুটে উঠেছে। টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র নিয়ে তিনি গদ্য লিখেছেন। তত্ত্ব-তথ্যের কচকচানিতে আবদ্ধ না করে নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের কলাকৌশল তুলে ধরেছেন। এ বিষয়ে রচিত তাঁর দুখানি পুস্তিকা হলো-টেলিভিশন নাটকের স্কিপ্ট ও নির্মাণ এবং টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রথম পাঠ। ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী ছাব্বিশজন ভাষাসংগ্রামীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তিনি সম্পাদনা করেন একুশের যাত্রী গ্রন্থটি। মুক্তিযুদ্ধে শব্দসৈনিকদের স্মৃতি অম্লান করে রাখতে সম্পাদনা করেছেন মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নামক গ্রন্থ। ভাষাসংগ্রামী এবং শব্দসৈনিকদের নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণের পাশাপাশি এ গ্রন্থদুটি সম্পাদনায় দেশমাতৃকার প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতার ছাপ স্পষ্ট। নিজেই বলেছেন-‘একটিই উদ্দেশ্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম যেনো তাঁদের কথা শুনতে পায়, তাদের দেখতে পায় এবং নিজেদের মধ্যে মাতৃভাষার প্রতি একটা দরদময় ভালোবাসা তৈরি করতে পারে।’ ছিলেন শক্তিমান অভিনেতা। মঞ্চ, চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশনে অভিনয় করেছেন। এ গুণটি তাঁকে বিনোদন-জগতে বিশেষ পরিচিতি এনে দেয়। সিদ্দিকুর রহমানের গফুরের বিয়ে নাটকের আলতা পাগলা চরিত্রসহ বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করে তিনি দর্শকদের মুগ্ধ করেছেন। নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। ‘ছায়ালোক মিডিয়া স্টেশন’ নামে একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। তবে চটপটি নামে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দিলেও অর্থাভাবে তা সম্পন্ন করতে পারেননি। তিনি ‘ছায়ালোক’ নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা গড়ে তুলেছিলেন।
সবমিলিয়ে তারেক মাহমুদ ছিলেন একের মাঝে বহুর প্রকাশ; কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, সম্পাদক, নির্মাতা, প্রকাশক, অভিনেতা সবক্ষেত্রে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। সর্বোপরি তাঁর ছিল উদার, প্রাণবন্ত, সজীব একটি মন। পছন্দ করতেন প্রাণখোলা আড্ডা দিতে; মশগুল থাকতেন বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে। কিন্তু এর মাঝেও জীবন তাঁর কাছে দুঃসহ মনে হতো। কী যেন এক গভীর বেদনা ও নিঃসঙ্গতা বহন করে বেড়াতেন। সেই নিঃসঙ্গতা থেকেই মৃত্যুকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তবে কিছু কাজ করে মৃত্যুর কাছে নিজেকে সঁপতে চেয়েছিলেন; তাইতো লিখেছিলেন-‘মৃত্যু, তোমাকে নিমন্ত্রণ/তবে কথা আছে, এখনি ছুঁয়োনা আমাকে/.../ ডেস্কের দিকে তাকাও, একটি অসমাপ্ত ছবি দেখতে পাচ্ছো নিশ্চয়ই/চিনতে পারো কি-ওটা তোমার ছবি/ওটা শেষ করতে পৃথিবীর সব জল শুকিয়ে যাবে/হাতে কিছু কবিতার কাঠামো দেখতে পাচ্ছো/এগুলো শেষ করতেও লেগে যাবে ওরকম কিছু সময়/এছাড়াও রয়েছে আমার ব্যক্তিগত কিছু কাজ/মৃত্যু, আমাকে বলো/এখন কী তোমার সাথে যাওয়ার সময় আমার/এ কী মৃত্যু!/কফিটুকু শেষ না করেই উঠলে যে/মৃত্যু তুমি দাঁড়াও ॥ দাঁড়াও প্লিজ/আমার এতো কষ্টের কফিটুকু পান করে যাও।’ (‘মৃত্যু তোমাকে নিমন্ত্রণ, তবে’, মেঘেরা ডেকেছিলো, যাইনি) কিন্তু মৃত্যু তাঁর কথা রাখেনি। তাঁকে প্রার্থিত সময় না দিয়েই নিয়ে গেছে চিরতরে। অর্থাৎ-পূর্ণরূপে বিকশিত হওয়ার পূর্বেই চলে গেছেন। এতে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গন ক্ষতিগ্রস্ত হলো। বস্তুত, নাগরিক জটিলতা আর যান্ত্রিক শহরে তারেক মাহমুদ হাঁপিয়ে উঠেছিলেন, ছুটে যেতে চেয়েছিলেন তাঁর কল্পনার সবুজ-সুন্দর শহরে। যে শহরে পিচঢালা পথে কিষাণ পরিবার গোল হয়ে বসে দুপুরের খাবার খায়, যেখানে নতুন মডেলের গাড়িগুলো ছড়িয়ে দেয় সুবাসিত সবুজ ধোঁয়া, যেখানকার বহুতল দালানগুলো সুন্দরী রমণীর মতো হেসে-খেলে আকাশ ছোঁয়, যে শহরের পাখিরা আশ্চর্যভাবে দেশের গান গায়, যেখানকার মানুষেরা একমাত্র সৌন্দর্য ছাড়া আর কিছুই চায় না; তেমন শহরেই যেতে চেয়েছিলেন তারেক মাহমুদ। স্বপ্নভারনত হয়ে লিখেছিলেন-‘তেমন একটি শহর নিশ্চয়ই কোথাও আছে/আমি সেইখানে চলে যাবো/এই যান্ত্রিক গ্রাম ছেড়ে একেবারে/চলে যাবো সেই সবুজ শহরে।’ (‘যান্ত্রিক গ্রাম ছেড়ে সবুজ শহরে’, মেঘেরা ডেকেছিল, যাইনি) তবে কী নিজের কাক্সিক্ষত সেই সবুজ শহরে চলে গেছেন তিনি!