শুক্রবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৩, ০১ অগ্রহায়ণ ১৪৩০, ০১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫

সহিংসতা, ট্রেন বাস স্কুলে আগুন

আগামী জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে গাড়ি ও স্থাপনা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ বলছে, ‘বিএনপিসহ তাদের সমর্থিত সমমনা দলের নেতাকর্মীরা’ এসব ‘নাশকতার’ সঙ্গে জড়িত।

গত বুধবার সন্ধ্যায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তফসিল ঘোষণার পর তা বিএনপি ও সমমনা দলগুলো প্রত্যাখ্যান করে। প্রসঙ্গত, সরকারের পদত্যাগসহ বিভিন্ন দাবিতে বিএনপির পঞ্চম দফা অবরোধ কর্মসূচির মধ্যেই ঘোষিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদের তফসিল।

এর প্রতিবাদে আগামী রোববার থেকে আবার দুই দিনের হরতাল আহ্বান করেছে বিএনপি ও সমমনা অন্য দলগুলো। তবে আওয়ামী লীগসহ তাদের সমমান দলগুলো তফসিলকে স্বাগত জানিয়েছে।

এদিকে তফসিল ঘোষণার পর সারাদেশে ‘ব্যাপক’ নিরাপত্তা জোরদার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নাশকতা প্রতিরোধে নামানো হয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবিকেও।

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম, বগুড়া, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইলসহ অনেক এলাকায় ট্রেন, বাস, পণ্যবাহী ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটে। দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনে বাদ যায়নি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। মানিকগঞ্জে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আগুন দেয়া হয়েছে। আগুন দেয়ার ঘটনায় পরিবহন সেক্টরে বাসের চালক, হেলপার এবং যাত্রীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। গতকাল অনেক জেলাতেই দূরপাল্লার বাস যায়নি নাশকতার ভয়ে। ঢাকায় অভ্যন্তরীণ রুটে যানবাহন চললেও দূরপাল্লার পরিবহনগুলোতে যাত্রীর চাপ ছিল কম।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) খ মহিদ উদ্দিন গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় নাশকতার প্রয়াস বেড়েছে। কয়েকটি এলাকায় ককটেল ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে পুলিশি তৎপরতার কারণে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তিনি বলেন, ঢাকার নিরাপত্তার প্রচেষ্টা সুদৃঢ় রাখতে আমরা বদ্ধ পরিকর।

পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, মঙ্গলবার রাত ১২টা থেকে বুধবার তফসিল ঘোষণার পর রাত ১২টা পর্যন্ত বিভিন্ন জেলায় ১৬টি যানবাহনে ভাঙচুর, ১৬টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এরমধ্যে নোয়াখালী ও চাঁদপুরে ৪টি সিএনজি, হবিগঞ্জে ২টি প্রাইভেট করা, এবং চাপাইনবাবগঞ্জ ও হবিগঞ্জে ৪টি কাভার্ডভ্যান, বগুড়ায় ৫টি মোটরসাইকেল, রাজশাহী মেট্রোপলিটনে পুলিশের ১টি গাড়ি, ঢাকা রেলওয়ে থানা এলাকায় মৈত্রী রেলের জানালা ভাঙচুর এবং বগড়ায় একটি স্থাপনা ভাঙচুর করা হয়। একইভাবে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটনে ২টি বাস, ডিএমপিতে একটি পিক্যাপ ভ্যান, ঢাকা জেলা, রাজশাহী, বগুড়া ও ডিএমপিতে ৪টি ট্রাক, নাটোরে ১টি প্রাইভেটকার, ডিএমপিতে ১টি প্রাইভেট কার, নোয়াখালীতে ৩টি মোটরসাইকেল, বগুড়ায় ১টি ট্রাক লরি, সিলেট মেট্রোপলিটের ১টি লেগুনা, কুমিল্লায় ১টি টেম্পু এবং সিরাজগঞ্জে একটি স্থাপনায় আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা।

এছাড়া তিন জেলায় পুলিশের ১৭ সদস্য ‘অবরোধকারীদের’ হামলায় আহত হয়েছে। এছাড়া বগুড়ায় ৫ পুলিশ, রাজশাহী মেট্রোপলিটনে ৪ পুলিশ এবং হবিগঞ্জে ৮ পুলিশ আহত হয়েছে দুর্বৃত্তদের হামলায়।

তফসিল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনা, পরিবহনে আগুনসহ নাশকতার শঙ্কা ছিল আগে থেকেই। নির্বাচন কমিশনের অফিস, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বাসভবনসহ সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তা নেয়া হয়েছিল ব্যাপক। পুলিশ ছাড়াও র‌্যাব, বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছিল।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, তফসিলের পর থেকে ১৬ নভেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত মোট ১১টি আগুন লাগার সংবাদ পেয়েছে ফায়ার সার্ভিস। এ ঘটনায় ১১টি যানবাহনে অগ্নিকান্ড ঘটে। তবে ঢাকা সিটিতে কোনো বাহনে আগুনের সংবাদ পায়নি ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিস জানায়, গত বুধবার সন্ধ্যা ৭টার পর সিলেটের শাহ পরানে একটি লেগুনায় আগুন, বগুড়ায় একটি কাভার্ড ভ্যানে আগুন, দোহারে একটি ট্রাকে এবং চট্টগ্রামের খুলশিতে দুটি বাসে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। বগুড়ার শেরপুরে একটি ট্রাকে, ঝালকাঠির কলেজ মোড়ে একটি লেগুনায়, বগুড়া সদরের জয়বাংলাহাটে একটি ট্রাকে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের ইসরাইলের মোড়ে একটি মিনি ট্রাকে, টাঙ্গাইল সদরে টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনে এবং চাঁদপুরের হাজিগঞ্জে পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের সামনে একটি ট্রাকে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা।

গত বুধবার সন্ধ্যা ৭টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল।

আমাদের টাঙ্গাইল প্রতিনিধি জানান, টাঙ্গাইল রেলওয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা কমিউটার ট্রেনে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। গতকাল ভোর রাতে এ ঘটনা ঘটে। এতে ট্রেনের দুটি বগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে কেউ হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। টাঙ্গাইল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মোহাম্মদ ইদ্রিচ বলেন, রাত সাড়ে ৩টার দিকে খবর পেয়ে স্টেশনে গিয়ে ট্রেনের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনি। ট্রেনের ইঞ্জিনের কাছাকাছি দুটি বগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কমিউটার ট্রেনটি টাঙ্গাইল টু ঢাকা মুখী অভিমুখে স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিল। পুলিশ জানিয়েছে, রাত সাড়ে ৩টায় পঞ্চগড় থেকে ছেড়ে আসা একটি ট্রেন টাঙ্গাইল স্টেশন ত্যাগ করার পর আগুন লাগে। আগুনের সূত্রপাত তদন্ত শেষে জানা যাবে। স্টেশন সূত্রে জানা যায়, ঘারিন্দা রেলস্টেশনে সিসি ক্যামেরা থাকলেও ট্রেনটির যে বগিগুলোতে আগুন লেগেছে সেই অংশে সিসি ক্যামেরার আওতায় বাইরে ছিল। ঘারিন্দা রেল স্টেশন মাস্টার তরিকুল ইসলাম জানান, রাতে কে বা কারা ট্রেনে আগুন ধরিয়েছে সেটা জানা যায়নি।

বিস্ফোরক সরঞ্জামসহ ডিএমপির অভিযানে গ্রেপ্তার ১২

রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে ‘বিস্ফোরক’ সরঞ্জামসহ ১২ জনকে গ্রেপ্তার করার কথা জানিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। গত বুধবার রাতে মহানগরের ভাষানটেক, শাহ আলী ও শাহবাগ এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। ডিএমপির দাবি, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে বিএনপির নেতাসহ অবরোধের সমর্থক ব্যক্তিরা রয়েছেন। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন মাহফুজ হোসেন মুনা (২০), মো. ইয়াছিন (১৯), মো. ফরহাদ (১৯), মো. মাহি (১৮), মো. আউলাদ হোসেন (১৮), মো. নাছিম (১৮), মো. আমজাদ আলী হোসেন (১৮), মো. তানভীর হোসেন (১৮), মো. নিজাম উদ্দিন (জসিম), নূর মোহাম্মদ শিকদার (২৩), মোহাম্মদ বখতিয়ার চৌধুরী শাহীন (২৪) ও মো. রুবেল (২০)। গতকাল মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের তথ্য জানাতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) খ. মহিদ উদ্দিদের দাবি, গত বুধবার রাতে ভাষানটেক এলাকা থেকে আটজন, শাহআলী থেকে একজন ও শাহবাগ এলাকা থেকে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে নিজাম উদ্দিন রূপনগর থানা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। গ্রেপ্তার বাকি ব্যক্তিরাও অবরোধ কর্মসূচির সমর্থক, তবে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। মহিদ উদ্দিদের ভাষ্য, ভাষানটেকে একটি নির্মাণাধীন ভবনে বিস্ফোরক সামগ্রীসহ জমায়েত হওয়া আটজনকে ‘হাতেনাতে’ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে যে পরিমাণ সামগ্রী উদ্ধার করা হয়েছে, সেসব ব্যবহার করতে পারলে নাশকতার ব্যাপকতা আরও বাড়তে পারত।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মহিদ উদ্দিন বলেন, ‘শহরে যে পরিমাণ যানবাহন, সে পরিমাণ পার্কিংয়ের জায়গা নেই। যদি সিকিউরড (নিরাপদ) জায়গায় পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকত, তাহলে এক জায়গায় আমরা নিরাপত্তা দিয়ে রাখতাম। কিন্তু গাড়িগুলো ছড়ানো-ছিটানো থাকে, আর তারা সুযোগটা নেয়।

র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার ৪

এদিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় অভিযান চালিয়ে পেট্রল বোমা ও ককটেল তৈরির সরঞ্জামসহ চারজনকে আটক করার কথা জানিয়েছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-১০)। গতকাল সন্ধ্যায় ‘নাশকতার প্রস্ততির’ সময় তাদেরকে আটক করা হয় বলে র‌্যাবের দাবি। তবে প্রাথমিকভাবে আটকদের বিস্তারিত নাম-পরিচয় জানা যায়নি।

র‌্যাব-১০ এর অধিনায়ক অ্যাডিশনাল ডিআইজি মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন জানান, নাশকতার প্রস্ততির সময় চার জন নাশকতাকারীকে পেট্রল বোমা ও ককটেল তৈরির সরঞ্জামসহ আটক করা হয়েছে।

সারাদেশে ২২৯ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের জেলাসহ সারা দেশে ২২৯ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া পর্যাপ্ত সংখ্যক বিজিবি প্লাটুন স্ট্যান্ডবাই (প্রস্তুত) রয়েছে।

বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম জানান, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঢাকা ও আশপাশের জেলায় ৩২ প্লাটুন এবং সারা দেশে ১৯৭ প্লাটুনসহ মোট ২২৯ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। তবে কোন কোন জেলায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে সেই তথ্য পাওয়া যায়নি বিজিবি থেকে।

ঢাকাসহ সারাদেশে র‌্যাবের ৪৬০ টহল টিম মোতায়েন

র‌্যাব সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, নাশকতা প্রতিরোধে সারাদেশে ৪৬০টি টহল টিম মোয়েতন রয়েছে র‌্যাবের। র‌্যাবের সব ব্যাটেলিটন থেকে এসব টহল টিমের কার্যক্রম মনিটরিং করা হচ্ছে।

র‌্যাব সদর দপ্তর জানিয়েছে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ১৬০টি টহল টিম নিরাপত্তা টহল দিয়ে যাচ্ছে। সারাদেশে ৩শ’র মতো টহল টিম টহল দিচ্ছে। নির্বাচন পর্যন্ত যেকোন ধরনের নাশকতা প্রতিরোধে টহল টিমের নিরাপত্তা জোরদার থাকবে।

শুক্রবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৩ , ০১ অগ্রহায়ণ ১৪৩০, ০১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫

সহিংসতা, ট্রেন বাস স্কুলে আগুন

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

টাঙ্গাইল রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা কমিউটার ট্রেনে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা -সংবাদ

আগামী জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে গাড়ি ও স্থাপনা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ বলছে, ‘বিএনপিসহ তাদের সমর্থিত সমমনা দলের নেতাকর্মীরা’ এসব ‘নাশকতার’ সঙ্গে জড়িত।

গত বুধবার সন্ধ্যায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তফসিল ঘোষণার পর তা বিএনপি ও সমমনা দলগুলো প্রত্যাখ্যান করে। প্রসঙ্গত, সরকারের পদত্যাগসহ বিভিন্ন দাবিতে বিএনপির পঞ্চম দফা অবরোধ কর্মসূচির মধ্যেই ঘোষিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদের তফসিল।

এর প্রতিবাদে আগামী রোববার থেকে আবার দুই দিনের হরতাল আহ্বান করেছে বিএনপি ও সমমনা অন্য দলগুলো। তবে আওয়ামী লীগসহ তাদের সমমান দলগুলো তফসিলকে স্বাগত জানিয়েছে।

এদিকে তফসিল ঘোষণার পর সারাদেশে ‘ব্যাপক’ নিরাপত্তা জোরদার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নাশকতা প্রতিরোধে নামানো হয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবিকেও।

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম, বগুড়া, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইলসহ অনেক এলাকায় ট্রেন, বাস, পণ্যবাহী ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটে। দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনে বাদ যায়নি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। মানিকগঞ্জে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আগুন দেয়া হয়েছে। আগুন দেয়ার ঘটনায় পরিবহন সেক্টরে বাসের চালক, হেলপার এবং যাত্রীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। গতকাল অনেক জেলাতেই দূরপাল্লার বাস যায়নি নাশকতার ভয়ে। ঢাকায় অভ্যন্তরীণ রুটে যানবাহন চললেও দূরপাল্লার পরিবহনগুলোতে যাত্রীর চাপ ছিল কম।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) খ মহিদ উদ্দিন গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় নাশকতার প্রয়াস বেড়েছে। কয়েকটি এলাকায় ককটেল ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে পুলিশি তৎপরতার কারণে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তিনি বলেন, ঢাকার নিরাপত্তার প্রচেষ্টা সুদৃঢ় রাখতে আমরা বদ্ধ পরিকর।

পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, মঙ্গলবার রাত ১২টা থেকে বুধবার তফসিল ঘোষণার পর রাত ১২টা পর্যন্ত বিভিন্ন জেলায় ১৬টি যানবাহনে ভাঙচুর, ১৬টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এরমধ্যে নোয়াখালী ও চাঁদপুরে ৪টি সিএনজি, হবিগঞ্জে ২টি প্রাইভেট করা, এবং চাপাইনবাবগঞ্জ ও হবিগঞ্জে ৪টি কাভার্ডভ্যান, বগুড়ায় ৫টি মোটরসাইকেল, রাজশাহী মেট্রোপলিটনে পুলিশের ১টি গাড়ি, ঢাকা রেলওয়ে থানা এলাকায় মৈত্রী রেলের জানালা ভাঙচুর এবং বগড়ায় একটি স্থাপনা ভাঙচুর করা হয়। একইভাবে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটনে ২টি বাস, ডিএমপিতে একটি পিক্যাপ ভ্যান, ঢাকা জেলা, রাজশাহী, বগুড়া ও ডিএমপিতে ৪টি ট্রাক, নাটোরে ১টি প্রাইভেটকার, ডিএমপিতে ১টি প্রাইভেট কার, নোয়াখালীতে ৩টি মোটরসাইকেল, বগুড়ায় ১টি ট্রাক লরি, সিলেট মেট্রোপলিটের ১টি লেগুনা, কুমিল্লায় ১টি টেম্পু এবং সিরাজগঞ্জে একটি স্থাপনায় আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা।

এছাড়া তিন জেলায় পুলিশের ১৭ সদস্য ‘অবরোধকারীদের’ হামলায় আহত হয়েছে। এছাড়া বগুড়ায় ৫ পুলিশ, রাজশাহী মেট্রোপলিটনে ৪ পুলিশ এবং হবিগঞ্জে ৮ পুলিশ আহত হয়েছে দুর্বৃত্তদের হামলায়।

তফসিল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনা, পরিবহনে আগুনসহ নাশকতার শঙ্কা ছিল আগে থেকেই। নির্বাচন কমিশনের অফিস, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বাসভবনসহ সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তা নেয়া হয়েছিল ব্যাপক। পুলিশ ছাড়াও র‌্যাব, বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছিল।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, তফসিলের পর থেকে ১৬ নভেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত মোট ১১টি আগুন লাগার সংবাদ পেয়েছে ফায়ার সার্ভিস। এ ঘটনায় ১১টি যানবাহনে অগ্নিকান্ড ঘটে। তবে ঢাকা সিটিতে কোনো বাহনে আগুনের সংবাদ পায়নি ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিস জানায়, গত বুধবার সন্ধ্যা ৭টার পর সিলেটের শাহ পরানে একটি লেগুনায় আগুন, বগুড়ায় একটি কাভার্ড ভ্যানে আগুন, দোহারে একটি ট্রাকে এবং চট্টগ্রামের খুলশিতে দুটি বাসে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। বগুড়ার শেরপুরে একটি ট্রাকে, ঝালকাঠির কলেজ মোড়ে একটি লেগুনায়, বগুড়া সদরের জয়বাংলাহাটে একটি ট্রাকে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের ইসরাইলের মোড়ে একটি মিনি ট্রাকে, টাঙ্গাইল সদরে টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনে এবং চাঁদপুরের হাজিগঞ্জে পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের সামনে একটি ট্রাকে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা।

গত বুধবার সন্ধ্যা ৭টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল।

আমাদের টাঙ্গাইল প্রতিনিধি জানান, টাঙ্গাইল রেলওয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা কমিউটার ট্রেনে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। গতকাল ভোর রাতে এ ঘটনা ঘটে। এতে ট্রেনের দুটি বগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে কেউ হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। টাঙ্গাইল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মোহাম্মদ ইদ্রিচ বলেন, রাত সাড়ে ৩টার দিকে খবর পেয়ে স্টেশনে গিয়ে ট্রেনের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনি। ট্রেনের ইঞ্জিনের কাছাকাছি দুটি বগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কমিউটার ট্রেনটি টাঙ্গাইল টু ঢাকা মুখী অভিমুখে স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিল। পুলিশ জানিয়েছে, রাত সাড়ে ৩টায় পঞ্চগড় থেকে ছেড়ে আসা একটি ট্রেন টাঙ্গাইল স্টেশন ত্যাগ করার পর আগুন লাগে। আগুনের সূত্রপাত তদন্ত শেষে জানা যাবে। স্টেশন সূত্রে জানা যায়, ঘারিন্দা রেলস্টেশনে সিসি ক্যামেরা থাকলেও ট্রেনটির যে বগিগুলোতে আগুন লেগেছে সেই অংশে সিসি ক্যামেরার আওতায় বাইরে ছিল। ঘারিন্দা রেল স্টেশন মাস্টার তরিকুল ইসলাম জানান, রাতে কে বা কারা ট্রেনে আগুন ধরিয়েছে সেটা জানা যায়নি।

বিস্ফোরক সরঞ্জামসহ ডিএমপির অভিযানে গ্রেপ্তার ১২

রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে ‘বিস্ফোরক’ সরঞ্জামসহ ১২ জনকে গ্রেপ্তার করার কথা জানিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। গত বুধবার রাতে মহানগরের ভাষানটেক, শাহ আলী ও শাহবাগ এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। ডিএমপির দাবি, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে বিএনপির নেতাসহ অবরোধের সমর্থক ব্যক্তিরা রয়েছেন। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন মাহফুজ হোসেন মুনা (২০), মো. ইয়াছিন (১৯), মো. ফরহাদ (১৯), মো. মাহি (১৮), মো. আউলাদ হোসেন (১৮), মো. নাছিম (১৮), মো. আমজাদ আলী হোসেন (১৮), মো. তানভীর হোসেন (১৮), মো. নিজাম উদ্দিন (জসিম), নূর মোহাম্মদ শিকদার (২৩), মোহাম্মদ বখতিয়ার চৌধুরী শাহীন (২৪) ও মো. রুবেল (২০)। গতকাল মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের তথ্য জানাতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) খ. মহিদ উদ্দিদের দাবি, গত বুধবার রাতে ভাষানটেক এলাকা থেকে আটজন, শাহআলী থেকে একজন ও শাহবাগ এলাকা থেকে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে নিজাম উদ্দিন রূপনগর থানা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। গ্রেপ্তার বাকি ব্যক্তিরাও অবরোধ কর্মসূচির সমর্থক, তবে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। মহিদ উদ্দিদের ভাষ্য, ভাষানটেকে একটি নির্মাণাধীন ভবনে বিস্ফোরক সামগ্রীসহ জমায়েত হওয়া আটজনকে ‘হাতেনাতে’ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে যে পরিমাণ সামগ্রী উদ্ধার করা হয়েছে, সেসব ব্যবহার করতে পারলে নাশকতার ব্যাপকতা আরও বাড়তে পারত।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মহিদ উদ্দিন বলেন, ‘শহরে যে পরিমাণ যানবাহন, সে পরিমাণ পার্কিংয়ের জায়গা নেই। যদি সিকিউরড (নিরাপদ) জায়গায় পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকত, তাহলে এক জায়গায় আমরা নিরাপত্তা দিয়ে রাখতাম। কিন্তু গাড়িগুলো ছড়ানো-ছিটানো থাকে, আর তারা সুযোগটা নেয়।

র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার ৪

এদিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় অভিযান চালিয়ে পেট্রল বোমা ও ককটেল তৈরির সরঞ্জামসহ চারজনকে আটক করার কথা জানিয়েছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-১০)। গতকাল সন্ধ্যায় ‘নাশকতার প্রস্ততির’ সময় তাদেরকে আটক করা হয় বলে র‌্যাবের দাবি। তবে প্রাথমিকভাবে আটকদের বিস্তারিত নাম-পরিচয় জানা যায়নি।

র‌্যাব-১০ এর অধিনায়ক অ্যাডিশনাল ডিআইজি মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন জানান, নাশকতার প্রস্ততির সময় চার জন নাশকতাকারীকে পেট্রল বোমা ও ককটেল তৈরির সরঞ্জামসহ আটক করা হয়েছে।

সারাদেশে ২২৯ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের জেলাসহ সারা দেশে ২২৯ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া পর্যাপ্ত সংখ্যক বিজিবি প্লাটুন স্ট্যান্ডবাই (প্রস্তুত) রয়েছে।

বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম জানান, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঢাকা ও আশপাশের জেলায় ৩২ প্লাটুন এবং সারা দেশে ১৯৭ প্লাটুনসহ মোট ২২৯ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। তবে কোন কোন জেলায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে সেই তথ্য পাওয়া যায়নি বিজিবি থেকে।

ঢাকাসহ সারাদেশে র‌্যাবের ৪৬০ টহল টিম মোতায়েন

র‌্যাব সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, নাশকতা প্রতিরোধে সারাদেশে ৪৬০টি টহল টিম মোয়েতন রয়েছে র‌্যাবের। র‌্যাবের সব ব্যাটেলিটন থেকে এসব টহল টিমের কার্যক্রম মনিটরিং করা হচ্ছে।

র‌্যাব সদর দপ্তর জানিয়েছে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ১৬০টি টহল টিম নিরাপত্তা টহল দিয়ে যাচ্ছে। সারাদেশে ৩শ’র মতো টহল টিম টহল দিচ্ছে। নির্বাচন পর্যন্ত যেকোন ধরনের নাশকতা প্রতিরোধে টহল টিমের নিরাপত্তা জোরদার থাকবে।