প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন ১২ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি

প্রাইভেট টিউশনি ও কোচিং সেন্টার এবং নোট-গাইড বই ব্যবসায়ীদের ‘অদৃশ্য’ বিরোধীতার কারণে ১২ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন। এখন ওই ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে ‘অপপ্রচার’ চালানোর অভিযোগ করেছেন শিক্ষামন্ত্রী।

২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষা আইন করার কথা বলা হয়েছে। এটি না হওয়ায় শিক্ষানীতির অনেক বিষয়ই বাস্তবায়ন হয়নি। আবার প্রাইভেট টিউশন, কোচিং সেন্টার ও নোট-গাইড বই ব্যবসার লাগাম টানার কোনো উদ্যোগও নেয়া হয়নি।

চলতি শিক্ষাবর্ষে নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এই শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন ব্যাহত করতে কোচিং সেন্টার মালিক ও নোট-গাইড বই ব্যবসায়ীরা ‘অপপ্রচার’ চালাচ্ছে বলে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির অভিযোগ।

দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, শিক্ষাবিদ, শিক্ষক-অভিভাবক ও শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা নোট-গাইড বই ও কোচিং বাণিজ্যের লাগাম টানতে চান। শিক্ষা বাণিজ্য স্থায়ীভাবে রোধ করতে চান। তারা শিক্ষার্থীদের শতভাগ সৃজনশীল বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল করাতে চান। খুব কম সংখ্যক কর্মকর্তা ও ব্যক্তিই নোট-গাইড বই ও কোচিং কেন্দ্রীক শিক্ষা চালু রাখার পক্ষে।

এ বিষয়ে ‘শিক্ষানীতি-২০১০’ প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর শেখ ইকরামুল কবির সংবাদকে বলেন, ‘আমরা ছয় মাসে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিলাম। এই নীতির বিভিন্ন বিষয় বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষা আইন জরুরি ছিল। সেটি হলো না ১২ বছরের বেশি সময়েও।’

কোচিং সেন্টারের মালিক ও নোট-গাইড বইয়ের ব্যবসায়ীদের বাধার কারণে আইনটি হয়নি দাবি করে তিনি বলেন, ‘তারা ব্যাপকভাবে টাকা-পয়সা ব্যয় করেছে। এর প্রভাবেই আইন না করে ব্লেইম গেম হয়েছে।’

শিক্ষামন্ত্রী গত ৪ নভেম্বর রাজধানীর ইডেন কলেজে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অপপ্রচার চলছে। নোট-গাইড ও কোচিং ব্যবসায়ীরা তা করছে। তাদের ব্যবসা নষ্ট হওয়ার ভয়ে।’ নির্বাচনকে সামনে রেখে কিছু কিছু রাজনৈতিক দল অপপ্রচারে ইন্ধন যোগাচ্ছে বলেও দাবি শিক্ষামন্ত্রীর।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহসভাপতি শ্যামল পাল সংবাদকে জানান, শিক্ষামন্ত্রীর ওই অভিযোগের (অপপ্রচার) বিষয়ে তারা গত ৬ নভেম্বর মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওই সময় শিক্ষামন্ত্রী তাদের বলেন, ‘মন্ত্রী আমাদের অর্থাৎ প্রকাশকদের নিয়ে কিছু বলেননি। তিনি সারাদেশের যারা জোর করে গাইড বই পড়ান তাদের কথা বলেছেন।’ প্রকাশকরাও শিক্ষা আইন চান- দাবি করে তিনি বলেন, সেটি হওয়া উচিত সর্বস্তরের মানুষের মতামতের ভিত্তিতে। তারা শিক্ষা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন না বলে দাবি শ্যামল পালের।

শিক্ষানীতি প্রণয়নের পর এর আলোকেই শিক্ষা সংক্রান্ত সব আইন, বিধিবিধান ও আদেশ একত্র করে সেটি বাস্তবায়নের জন্য সমন্বিত শিক্ষা আইন করা উদ্যোগ নেয়া হয়। এ লক্ষ্যে ২০১১ সালের শুরুর দিকে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে ২৪টি উপকমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যার মধ্যে অন্যতম ছিল শিক্ষা আইনের খসড়া তৈরি করা।

২০১২ সালে এই আইনের প্রথম খসড়া তৈরি করা হয়। পরে সংযোজন-বিয়োজন শেষে ২০১৩ সালের ৫ আগস্ট জনমত যাচাইয়ের জন্য এই খসড়া মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।

বিভিন্ন অংশীজনের মতামত নিয়ে মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হলে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ দিয়ে সেটি ফেরত পাঠানো হয়। এরপরই আটকে পড়ে খসড়া আইনটি। পাশাপাশি কওমি মাদ্রাসা, নোট-গাইড বই ব্যবসায়ী ও কোচিং ব্যবসায়ীরাও এই আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছে।

এভাবে আইনের খসড়া নিয়ে অসংখ্যবার সভা হয়েছে। খসড়া বারবার কাটাছেঁড়া হয়েছে। অংশীজনের (স্টেকহোল্ডার) মতামত নিয়ে আইনের খসড়া প্রণয়ন করে সেটি বেশ কয়েকবার মন্ত্রিসভার বৈঠকের জন্য পাঠিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

কিন্তু বিভিন্ন রকমের ‘ভুল-ত্রুটি ও প্রশ্ন’ থাকায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ খসড়াটি ফেরত পাঠায়। মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকেও একাধিকবার খসড়া ফেরত এসেছে। এভাবে আলোচনার পর আলোচনা, সংশোধনীর পর সংশোধনী হয়েছে; এরপরও প্রায় ১২ বছরে আলোর মুখ দেখেনি শিক্ষা আইন।

শিক্ষা আইনের সর্বশেষ অবস্থার বিষয়ে গত ৩০ অক্টোবর রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এক প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, ‘চলতি মেয়াদে জাতীয় সংসদের সর্বশেষ অধিবেশন ২ নভেম্বর পর্যন্ত চলবে। কাজেই এই মেয়াদে শিক্ষা আইন তো আর আলোর মুখ দেখছে না। আগামী মেয়াদে যদি দেখে।’

খসড়া নিয়ে শাপ-লুডু খেলা

২০১৬ সালের শেষের ‘ছায়া শিক্ষার’ নামে কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনকে বৈধতা দিয়ে শিক্ষা আইনের খসড়াটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু বিতর্কের মুখে সেটি ফেরত নেয়া হয়। পুনরায় সংশোধনের উদ্যোগ নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

পরের বছর আবার কোচিং ও প্রাইভেট টিউশন এবং সব ধরনের নোট-গাইড, অনুশীলন বা সহায়ক বই নিষিদ্ধের বিধান রেখে আইনের খসড়া করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর ওইসব নিষিদ্ধ ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের তৎপরতা শুরু হয়। এতে সেটিও আটকে যায়।

পরবর্তীতে ২০১৯ সালে বিদ্যমান আইন-কানুন ও বিধি-বিধানের সঙ্গে সমন্বয় করে খসড়া আইনটি চূড়ান্ত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় দু’জন কনসাল্টটেন্ট (পরামর্শক) (একজন সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও একজন সাবেক সচিব) নিয়োগ দেয়া হয়। তাদের খসড়ায়ও ‘নোট-গাইড বই ও সহায়ক এবং কোচিং সেন্টারকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করা হয়।

শিক্ষাবিদরা জানিয়েছেন, জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে শিক্ষা আইনটি করা জরুরি ছিল। কারণ, আইনটি না হওয়ায় শিক্ষা ও শিক্ষানীতির অনেক কিছুই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। শিক্ষা খাতের বিভিন্ন বিষয় জোড়াতালি দিয়ে নির্বাহী আদেশে বা বিচ্ছিন্ন নানা আইনের মাধ্যমে চালাতে হচ্ছে।

নোট-গাইড বা সহায়ক বই ও সেন্টারকেন্দ্রিক কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করা শিক্ষানীতির অন্যতম লক্ষ্য ছিল উল্লেখ করে অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবির বলেন, ‘এসব বাণিজ্য অব্যাহত রাখার সুযোগ দিয়ে আইন করেও কোনো লাভ হবে না। কিন্তু সেই কাজই বারবার করার চেষ্টা হয়েছে। এ কারণে আইনটি আলোর মুখ দেখছে না।’

প্রস্তাবিত আইনের সর্বশেষ খসড়ায়ও একদিকে নোট-গাইড বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে সরকারের অনুমোদন নিয়ে সহায়ক পুস্তক, বাঁধাই, প্রকাশ ও বাজারজাত করার সুযোগ রাখা হয়। যদিও কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সহায়ক পুস্তক কিনতে বা পাঠে বাধ্য করা যাবে না। এসব বই কিনতে বা পাঠে বাধ্য বা উৎসাহ দিলে, তা অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবেÑ এমন বিধান ওই খসড়া আইনে রাখা হয়।

এছাড়া প্রস্তাবিত আইনে নিবন্ধন নিয়ে কোচিং চালানোর সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে কোচিং সেন্টারে কোনো শিক্ষক তার নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে পাঠদান করাতে পারবেন না। এমনকি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে প্রাইভেটও পড়াতে পারবেন না।

মঙ্গলবার, ২১ নভেম্বর ২০২৩ , ৬ অগ্রায়ন ১৪৩০, ৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫

প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন ১২ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি

রাকিব উদ্দিন

প্রাইভেট টিউশনি ও কোচিং সেন্টার এবং নোট-গাইড বই ব্যবসায়ীদের ‘অদৃশ্য’ বিরোধীতার কারণে ১২ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন। এখন ওই ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে ‘অপপ্রচার’ চালানোর অভিযোগ করেছেন শিক্ষামন্ত্রী।

২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষা আইন করার কথা বলা হয়েছে। এটি না হওয়ায় শিক্ষানীতির অনেক বিষয়ই বাস্তবায়ন হয়নি। আবার প্রাইভেট টিউশন, কোচিং সেন্টার ও নোট-গাইড বই ব্যবসার লাগাম টানার কোনো উদ্যোগও নেয়া হয়নি।

চলতি শিক্ষাবর্ষে নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এই শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন ব্যাহত করতে কোচিং সেন্টার মালিক ও নোট-গাইড বই ব্যবসায়ীরা ‘অপপ্রচার’ চালাচ্ছে বলে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির অভিযোগ।

দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, শিক্ষাবিদ, শিক্ষক-অভিভাবক ও শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা নোট-গাইড বই ও কোচিং বাণিজ্যের লাগাম টানতে চান। শিক্ষা বাণিজ্য স্থায়ীভাবে রোধ করতে চান। তারা শিক্ষার্থীদের শতভাগ সৃজনশীল বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল করাতে চান। খুব কম সংখ্যক কর্মকর্তা ও ব্যক্তিই নোট-গাইড বই ও কোচিং কেন্দ্রীক শিক্ষা চালু রাখার পক্ষে।

এ বিষয়ে ‘শিক্ষানীতি-২০১০’ প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর শেখ ইকরামুল কবির সংবাদকে বলেন, ‘আমরা ছয় মাসে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছিলাম। এই নীতির বিভিন্ন বিষয় বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষা আইন জরুরি ছিল। সেটি হলো না ১২ বছরের বেশি সময়েও।’

কোচিং সেন্টারের মালিক ও নোট-গাইড বইয়ের ব্যবসায়ীদের বাধার কারণে আইনটি হয়নি দাবি করে তিনি বলেন, ‘তারা ব্যাপকভাবে টাকা-পয়সা ব্যয় করেছে। এর প্রভাবেই আইন না করে ব্লেইম গেম হয়েছে।’

শিক্ষামন্ত্রী গত ৪ নভেম্বর রাজধানীর ইডেন কলেজে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অপপ্রচার চলছে। নোট-গাইড ও কোচিং ব্যবসায়ীরা তা করছে। তাদের ব্যবসা নষ্ট হওয়ার ভয়ে।’ নির্বাচনকে সামনে রেখে কিছু কিছু রাজনৈতিক দল অপপ্রচারে ইন্ধন যোগাচ্ছে বলেও দাবি শিক্ষামন্ত্রীর।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহসভাপতি শ্যামল পাল সংবাদকে জানান, শিক্ষামন্ত্রীর ওই অভিযোগের (অপপ্রচার) বিষয়ে তারা গত ৬ নভেম্বর মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওই সময় শিক্ষামন্ত্রী তাদের বলেন, ‘মন্ত্রী আমাদের অর্থাৎ প্রকাশকদের নিয়ে কিছু বলেননি। তিনি সারাদেশের যারা জোর করে গাইড বই পড়ান তাদের কথা বলেছেন।’ প্রকাশকরাও শিক্ষা আইন চান- দাবি করে তিনি বলেন, সেটি হওয়া উচিত সর্বস্তরের মানুষের মতামতের ভিত্তিতে। তারা শিক্ষা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন না বলে দাবি শ্যামল পালের।

শিক্ষানীতি প্রণয়নের পর এর আলোকেই শিক্ষা সংক্রান্ত সব আইন, বিধিবিধান ও আদেশ একত্র করে সেটি বাস্তবায়নের জন্য সমন্বিত শিক্ষা আইন করা উদ্যোগ নেয়া হয়। এ লক্ষ্যে ২০১১ সালের শুরুর দিকে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে ২৪টি উপকমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যার মধ্যে অন্যতম ছিল শিক্ষা আইনের খসড়া তৈরি করা।

২০১২ সালে এই আইনের প্রথম খসড়া তৈরি করা হয়। পরে সংযোজন-বিয়োজন শেষে ২০১৩ সালের ৫ আগস্ট জনমত যাচাইয়ের জন্য এই খসড়া মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।

বিভিন্ন অংশীজনের মতামত নিয়ে মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হলে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ দিয়ে সেটি ফেরত পাঠানো হয়। এরপরই আটকে পড়ে খসড়া আইনটি। পাশাপাশি কওমি মাদ্রাসা, নোট-গাইড বই ব্যবসায়ী ও কোচিং ব্যবসায়ীরাও এই আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছে।

এভাবে আইনের খসড়া নিয়ে অসংখ্যবার সভা হয়েছে। খসড়া বারবার কাটাছেঁড়া হয়েছে। অংশীজনের (স্টেকহোল্ডার) মতামত নিয়ে আইনের খসড়া প্রণয়ন করে সেটি বেশ কয়েকবার মন্ত্রিসভার বৈঠকের জন্য পাঠিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

কিন্তু বিভিন্ন রকমের ‘ভুল-ত্রুটি ও প্রশ্ন’ থাকায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ খসড়াটি ফেরত পাঠায়। মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকেও একাধিকবার খসড়া ফেরত এসেছে। এভাবে আলোচনার পর আলোচনা, সংশোধনীর পর সংশোধনী হয়েছে; এরপরও প্রায় ১২ বছরে আলোর মুখ দেখেনি শিক্ষা আইন।

শিক্ষা আইনের সর্বশেষ অবস্থার বিষয়ে গত ৩০ অক্টোবর রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এক প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, ‘চলতি মেয়াদে জাতীয় সংসদের সর্বশেষ অধিবেশন ২ নভেম্বর পর্যন্ত চলবে। কাজেই এই মেয়াদে শিক্ষা আইন তো আর আলোর মুখ দেখছে না। আগামী মেয়াদে যদি দেখে।’

খসড়া নিয়ে শাপ-লুডু খেলা

২০১৬ সালের শেষের ‘ছায়া শিক্ষার’ নামে কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনকে বৈধতা দিয়ে শিক্ষা আইনের খসড়াটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু বিতর্কের মুখে সেটি ফেরত নেয়া হয়। পুনরায় সংশোধনের উদ্যোগ নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

পরের বছর আবার কোচিং ও প্রাইভেট টিউশন এবং সব ধরনের নোট-গাইড, অনুশীলন বা সহায়ক বই নিষিদ্ধের বিধান রেখে আইনের খসড়া করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর ওইসব নিষিদ্ধ ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের তৎপরতা শুরু হয়। এতে সেটিও আটকে যায়।

পরবর্তীতে ২০১৯ সালে বিদ্যমান আইন-কানুন ও বিধি-বিধানের সঙ্গে সমন্বয় করে খসড়া আইনটি চূড়ান্ত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় দু’জন কনসাল্টটেন্ট (পরামর্শক) (একজন সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও একজন সাবেক সচিব) নিয়োগ দেয়া হয়। তাদের খসড়ায়ও ‘নোট-গাইড বই ও সহায়ক এবং কোচিং সেন্টারকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করা হয়।

শিক্ষাবিদরা জানিয়েছেন, জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে শিক্ষা আইনটি করা জরুরি ছিল। কারণ, আইনটি না হওয়ায় শিক্ষা ও শিক্ষানীতির অনেক কিছুই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। শিক্ষা খাতের বিভিন্ন বিষয় জোড়াতালি দিয়ে নির্বাহী আদেশে বা বিচ্ছিন্ন নানা আইনের মাধ্যমে চালাতে হচ্ছে।

নোট-গাইড বা সহায়ক বই ও সেন্টারকেন্দ্রিক কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করা শিক্ষানীতির অন্যতম লক্ষ্য ছিল উল্লেখ করে অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবির বলেন, ‘এসব বাণিজ্য অব্যাহত রাখার সুযোগ দিয়ে আইন করেও কোনো লাভ হবে না। কিন্তু সেই কাজই বারবার করার চেষ্টা হয়েছে। এ কারণে আইনটি আলোর মুখ দেখছে না।’

প্রস্তাবিত আইনের সর্বশেষ খসড়ায়ও একদিকে নোট-গাইড বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে সরকারের অনুমোদন নিয়ে সহায়ক পুস্তক, বাঁধাই, প্রকাশ ও বাজারজাত করার সুযোগ রাখা হয়। যদিও কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সহায়ক পুস্তক কিনতে বা পাঠে বাধ্য করা যাবে না। এসব বই কিনতে বা পাঠে বাধ্য বা উৎসাহ দিলে, তা অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবেÑ এমন বিধান ওই খসড়া আইনে রাখা হয়।

এছাড়া প্রস্তাবিত আইনে নিবন্ধন নিয়ে কোচিং চালানোর সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে কোচিং সেন্টারে কোনো শিক্ষক তার নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে পাঠদান করাতে পারবেন না। এমনকি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে প্রাইভেটও পড়াতে পারবেন না।