যান্ত্রিকীকরণে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে

করোনার সময় কৃষিজীবী স্বামী মারা যাওয়ার পর এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে অভাবে পড়েন রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার কাকলী রাণী। স্বামী জায়গাজমিও রেখে যাননি। আগে কৃষির কাজ করলেও উপার্জনের জন্য বিশেষ কোনো দক্ষতা ছিল না তার। ফলে খুব কষ্টেই চলছিলেন তিনি।

কিন্তু এখন তিনি আশা করছেন সেই পরিস্থিতি পাল্টাবে। কেননা তিনি এখন অনেকগুলো কৃষি যন্ত্রপাতির সঙ্গে পরিচিত। যেমন তিনি এখন জানেন কীভাবে কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে ধান কাটা, ঝাড়াই, মাড়াই ও সংরক্ষণ করা যায়। এমনকি জানেন এসব যন্ত্রপাতির রক্ষণাবেক্ষণের পদ্ধতিও। ফলে তিনি এখন অন্যের জমিতে কাজ করতে পারবেন।

আর এসব তিনি শিখেছেন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে। গাজীপুরে তাদের ২৮ দিনের এ প্রশিক্ষণ হয়েছে। সম্প্রতি তা শেষ হয়।

কাকলী রাণী জানান, এই প্রশিক্ষণে তাকে যুক্ত করেন প্রমীলা ম-ল। প্রমিলা জানান, স্থানীয় এক ব্যক্তির নিকট তিনি কৃষি কাজে ব্যবহৃত এসব যন্ত্রের বিষয়ে প্রথম শোনেন। এরপর তার কাছ থেকে এগুলো ব্যবহারের বিষয়ে ধারণা পাওয়ার পর স্থানীয় আরও জনা তিরিশেক নারীকে সংঘটিত করে যোগাযোগ করেন কৃষিদপ্তরে। তাদের আগ্রহ দেখেই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ওই প্রকল্প থেকে তাদের গাজীপুরে এই প্রশিক্ষণের সুযোগ দেয়া হয়।

প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা আরেকজন সুবর্ণা আক্তার (২৫) বলেন, ২৮ দিনের প্রশিক্ষণে শুধু রাইস হারভেস্টার নয়, আরও অনেক মেশিনই চালানো শিখানো হয়েছে। সেই সঙ্গে মেশিন রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়গুলোও শিখেছি আমরা।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গ্রাজুয়েশন শেষ করে কৃষিতে মনোযোগ দিয়েছেন নেত্রকোণার সুবর্ণা। কৃষক বাবার সন্তান সুবর্ণার স্বপ্ন কৃষি উদ্যোক্তা হওয়ার। সংবাদকে তিনি বলেন, ছোট দুই ভাইকে শেখানোর জন্যই মূলত ট্রেনিংটা তিনি করেছেন। এখন নিজের জন্যই একটি কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন সংগ্রহ করতে চান তিনি। বলেন, ‘কম্বাইন হারভেস্টার পেলে আমার সঙ্গে স্বাবলম্বী হতে পারবে আমার ভাই দুটিও।’ কম্বাইন হারভেস্টার চালিয়ে ধান কাটার অভিজ্ঞতা সুবর্ণা বলেন, ‘এখন ধান কাটা অনেক সহজ। প্রথমে কিছুটা ভয় করলেও পরে আর ভয় লাগেনি।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষি কাজে নারীর অংশগ্রহণ নতুন নয়, কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কৃষি যান্ত্রিকীকরণে নারীর অংশগ্রহণ নতুন। আগামী দুই বছরের মধ্যে দেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের আওতায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৭০০ নারীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে বলে জানান তারা। পাশাপাশি ভর্তুকি মূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতি দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে এই প্রকল্পের অধীনে।

কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের যাতে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও কৃষি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে সেই লক্ষ্যেই এসব পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে জানান প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

প্রকল্প পরিচালক তারিক মাহমুদুল ইসলাম বলেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়নের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলÑ কৃষিতে নারীদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষি যান্ত্রিকীকরণেও নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। শুরুতে নারীদের অংশগ্রহণ খুব একটা না থাকলেও গত বছর থেকে অংশ গ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারীদের অংশগ্রহণে আগ্রহ থেকে নতুন করে প্রতিটি প্রশিক্ষণেই (প্রতি ব্যাচে) ৫-১০ জন নারীদের রাখা হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘রাজবাড়ীর একজন কৃষানি থেকে অনেকজন তৈরি হয়েছে। তাদের ঢাকায় এনে ২৮ দিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তাদের কৃষিকাজ সংশ্লিষ্ট ১২ ধরনের মেশিন পরিচালনা এবং মেরামতের ওপরেও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এখন তারা নিজেরাই এলাকায় কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিতি লাভ করছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। তারা এখন শুধু মেশিন পরিচালনা নয়, মেশিন নষ্ট হলে তা সারাইও করতে পারেন নিজেরা। ঢাকার গাজীপুরের বেশ কয়েকজন কৃষানি আমাকে জানিয়েছেন তারা একটি গ্রুপ করে কৃষি মেশিনারিজের একটি ওয়ার্কশপ চালু করতে চাচ্ছেন।’

দেশের ৬৪টি জেলার ৫০০ উপজেলায় কাজ চলছে প্রকল্পটির। ইতোমধ্যে ৯৯৯০ জন নারী ও পুরুষকে বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ভর্তুকি মূল্যে ১২ ধরনের ৩৫,৩৬০টি কৃষিযন্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮৯১২টি কম্বাইন হারভেস্টার। গত এক বছরে যন্ত্রগুলো ব্যবহারে কৃষকদের উৎপাদন ব্যয়ে অনেক সাশ্রয় হয়েছে বলেও জানান তারিক মাহমুদুল ইসলাম।

মঙ্গলবার, ২১ নভেম্বর ২০২৩ , ৬ অগ্রায়ন ১৪৩০, ৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫

যান্ত্রিকীকরণে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে

শাফিউল ইমরান

image

করোনার সময় কৃষিজীবী স্বামী মারা যাওয়ার পর এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে অভাবে পড়েন রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার কাকলী রাণী। স্বামী জায়গাজমিও রেখে যাননি। আগে কৃষির কাজ করলেও উপার্জনের জন্য বিশেষ কোনো দক্ষতা ছিল না তার। ফলে খুব কষ্টেই চলছিলেন তিনি।

কিন্তু এখন তিনি আশা করছেন সেই পরিস্থিতি পাল্টাবে। কেননা তিনি এখন অনেকগুলো কৃষি যন্ত্রপাতির সঙ্গে পরিচিত। যেমন তিনি এখন জানেন কীভাবে কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে ধান কাটা, ঝাড়াই, মাড়াই ও সংরক্ষণ করা যায়। এমনকি জানেন এসব যন্ত্রপাতির রক্ষণাবেক্ষণের পদ্ধতিও। ফলে তিনি এখন অন্যের জমিতে কাজ করতে পারবেন।

আর এসব তিনি শিখেছেন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে। গাজীপুরে তাদের ২৮ দিনের এ প্রশিক্ষণ হয়েছে। সম্প্রতি তা শেষ হয়।

কাকলী রাণী জানান, এই প্রশিক্ষণে তাকে যুক্ত করেন প্রমীলা ম-ল। প্রমিলা জানান, স্থানীয় এক ব্যক্তির নিকট তিনি কৃষি কাজে ব্যবহৃত এসব যন্ত্রের বিষয়ে প্রথম শোনেন। এরপর তার কাছ থেকে এগুলো ব্যবহারের বিষয়ে ধারণা পাওয়ার পর স্থানীয় আরও জনা তিরিশেক নারীকে সংঘটিত করে যোগাযোগ করেন কৃষিদপ্তরে। তাদের আগ্রহ দেখেই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ওই প্রকল্প থেকে তাদের গাজীপুরে এই প্রশিক্ষণের সুযোগ দেয়া হয়।

প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা আরেকজন সুবর্ণা আক্তার (২৫) বলেন, ২৮ দিনের প্রশিক্ষণে শুধু রাইস হারভেস্টার নয়, আরও অনেক মেশিনই চালানো শিখানো হয়েছে। সেই সঙ্গে মেশিন রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়গুলোও শিখেছি আমরা।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গ্রাজুয়েশন শেষ করে কৃষিতে মনোযোগ দিয়েছেন নেত্রকোণার সুবর্ণা। কৃষক বাবার সন্তান সুবর্ণার স্বপ্ন কৃষি উদ্যোক্তা হওয়ার। সংবাদকে তিনি বলেন, ছোট দুই ভাইকে শেখানোর জন্যই মূলত ট্রেনিংটা তিনি করেছেন। এখন নিজের জন্যই একটি কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন সংগ্রহ করতে চান তিনি। বলেন, ‘কম্বাইন হারভেস্টার পেলে আমার সঙ্গে স্বাবলম্বী হতে পারবে আমার ভাই দুটিও।’ কম্বাইন হারভেস্টার চালিয়ে ধান কাটার অভিজ্ঞতা সুবর্ণা বলেন, ‘এখন ধান কাটা অনেক সহজ। প্রথমে কিছুটা ভয় করলেও পরে আর ভয় লাগেনি।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষি কাজে নারীর অংশগ্রহণ নতুন নয়, কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কৃষি যান্ত্রিকীকরণে নারীর অংশগ্রহণ নতুন। আগামী দুই বছরের মধ্যে দেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের আওতায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৭০০ নারীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে বলে জানান তারা। পাশাপাশি ভর্তুকি মূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতি দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে এই প্রকল্পের অধীনে।

কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের যাতে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও কৃষি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে সেই লক্ষ্যেই এসব পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে জানান প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

প্রকল্প পরিচালক তারিক মাহমুদুল ইসলাম বলেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়নের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলÑ কৃষিতে নারীদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষি যান্ত্রিকীকরণেও নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। শুরুতে নারীদের অংশগ্রহণ খুব একটা না থাকলেও গত বছর থেকে অংশ গ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারীদের অংশগ্রহণে আগ্রহ থেকে নতুন করে প্রতিটি প্রশিক্ষণেই (প্রতি ব্যাচে) ৫-১০ জন নারীদের রাখা হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘রাজবাড়ীর একজন কৃষানি থেকে অনেকজন তৈরি হয়েছে। তাদের ঢাকায় এনে ২৮ দিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তাদের কৃষিকাজ সংশ্লিষ্ট ১২ ধরনের মেশিন পরিচালনা এবং মেরামতের ওপরেও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এখন তারা নিজেরাই এলাকায় কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিতি লাভ করছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। তারা এখন শুধু মেশিন পরিচালনা নয়, মেশিন নষ্ট হলে তা সারাইও করতে পারেন নিজেরা। ঢাকার গাজীপুরের বেশ কয়েকজন কৃষানি আমাকে জানিয়েছেন তারা একটি গ্রুপ করে কৃষি মেশিনারিজের একটি ওয়ার্কশপ চালু করতে চাচ্ছেন।’

দেশের ৬৪টি জেলার ৫০০ উপজেলায় কাজ চলছে প্রকল্পটির। ইতোমধ্যে ৯৯৯০ জন নারী ও পুরুষকে বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ভর্তুকি মূল্যে ১২ ধরনের ৩৫,৩৬০টি কৃষিযন্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮৯১২টি কম্বাইন হারভেস্টার। গত এক বছরে যন্ত্রগুলো ব্যবহারে কৃষকদের উৎপাদন ব্যয়ে অনেক সাশ্রয় হয়েছে বলেও জানান তারিক মাহমুদুল ইসলাম।