অবরোধ-হরতাল : পরিবহনে আগুন-ভাঙচুর ক্ষতি প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা

সরকারের পদত্যাগসহ বিভিন্ন দাবিতে গত ২৯ অক্টোবর থেকে কখনো অবরোধ, কখনো হরতালের কর্মসূচি দিয়ে আসছে বিএনপি। দলটির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোও একই ধরনের কর্মসূচি দিচ্ছে। পৃথকভাবে একই কর্মসূচি পালন করছে জামায়াতও। তাদের কর্মসূচিকে ঘিরে প্রায় প্রতিদিনই যানবাহনে অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া যাচ্ছে।

সরকারের অগ্নিনিরোধক সংস্থা ফায়ার সার্ভিস বলছে, বিএনপির সর্বশেষ দশম দফায় ৪৮ ঘণ্টার অবরোধের প্রথম দিন গতকালও ঢাকাসহ সারাদেশে ৮টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করেছে দুর্বৃত্তরা।

নতুন দফায় অবরোধ শুরুর আগে ১৫৫টি বাস, ৪৩টি ট্রাক, ২১টি কাভার্ড ভ্যান, ৮টি মোটরসাইকেল ও অন্যান্য ২৩টি গাড়িতে আগুনের খবর দেয় ফায়ার সার্ভিস। এ হিসাবে হরতাল-অবরোধকালে মোট ২৫৮টি গাড়িতে আগুনের ঘটনা ঘটেছে বলে সরকারি সংস্থাটির তথ্য।

যদিও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির হিসেবে গাড়িতে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা কিছুটা কম। সমিতির নথিভুক্ত অনুযায়ী গতকাল পর্যন্ত ১৮২টি গাড়িতে আগুনের ঘটনা ঘটেছে।

তবে সমিতি এও বলছে, প্রায় দেড় মাস হরতাল-অবরোধে ২৯০টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। সব মিলিয়ে আগুন ও ভাঙচুরে মোট ৪৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে সমিতির দাবি।

সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচির নামে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা সারাদেশে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে। ভাঙচুর অব্যাহত রয়েছে। তারপরও যান চলাচল স্বাভাবিক রেখেছেন পরিবহন মালিকরা। এতে তারা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। আমাদের হিসাবে (বুধবার) এখন পর্যন্ত ৪৭২টি গাড়িতে আগুন ও ভাঙচুর করা হয়েছে। এতে ৪৬ কোটি টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।’

ঢাকার বিভিন্ন বাসটার্মিনাল ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন কোম্পানির বাসগুলো সাড়ি সাড়ি করে ফেলে রাখা হয়েছে। দীর্ঘসময় গাড়ি পড়ে থাকায় ধুলাবালির আস্তর পড়েছে। তাছাড়া গাড়ি পড়ে থাকায় টায়ার, ব্রেকঅয়েল, বাকেট, গ্যাসকেট, বিয়ারিং, সিট, রংসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।

পরিবহন মালিকরা বলছেন, যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন তারা।

শ্রমিকদের মানবেতর জীবনযাপন

বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিকে ঘিরে সড়কে যানবাহন চলাচল কমিয়ে দিয়েছেন পরিবহন মালিকরা। এতে পরিবহন শ্রমিকরা পড়েছেন বিপাকে।

শ্রমিকরা বলছেন, আয় রোজগার না থাকায় অনেকেরই চলছে মানবেতর জীবনযাপন। কিন্তু অন্য কাজে অভিজ্ঞতা না থাকায় জীবন বাঁচাতে হুট করে পেশা পরির্তন করে অন্য পেশায়ও যেতে পারছেন না।

কিশোরগঞ্জ পাকুন্দিয়া মঠখোলা থেকে ঢাকা পর্যন্ত চলাচল করে ‘মনোহরদী পরিবহন’ নামের একটি কোম্পানির বাস। হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির দিন মনোহরদী পরিবহনের বাস চলাচল বন্ধ থাকছে।

গত শুক্রবার এই প্রতিষ্ঠানের একজন চালক জাকির হোসেন (৪২) সংবাদকে বলেন, ‘গাড়ি প্রায় বন্ধ থাকায় সংসার চালানো কঠিন হয়ে গেছে। কোনোমতে বাঁইছা (বেঁচে) আছি। কিন্তু গাড়ি চালানো ছাড়া কোনো বাও (উপায়) নাই। এই লাইনে যুগ পার হইতাছে। হের লাইগাই এহেকদিন গাড়ি চললেও আইয়া পড়ি।’

একই প্রতিষ্ঠানে হেলপার হিসেবে কাজ করেন সুজন মিয়া (২২)। মা, স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে সুমনের পরিবার। বাস চলাচল প্রায় বন্ধ থাকায় সুজনের আয়-রোজগারেও ভাটা পড়েছে।

গত শুক্রবার তার সঙ্গে কথা হলে সুজন বলেন, ‘আমাগো খবর লইবার মানুষ নাই। সপ্তাহে এহেকদিন গাড়িতে উঠতে পারি। যে টেহা পাই সেইটা রাস্তায় শেষ হই যায়। পরিবার নিয়ে খুব বিপদে আছি। ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে। অন্য কাম ভালা লাগে না। তাই গাড়ির পিছেই দৌড়ি।’

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী সংবাদকে বলেন, ‘হরতাল-অবরোধের নামে মূলত ধ্বাংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত। তাদের জনবিরোধী কর্মকাণ্ডে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন পরিবহন শ্রমিকরা। আয়-রোজগার কমে শ্রমিকদের পেটে যেমন আঘাত পড়ছে, তেমনি আগুনে আহতও হচ্ছেন অনেকে।’

বৃহস্পতিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩ , ২২ অগ্রায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫

অবরোধ-হরতাল : পরিবহনে আগুন-ভাঙচুর ক্ষতি প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

গতকাল রাজধানীর মানিকনগরে একুশে এক্সপ্রেসের তিনটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা -সংবাদ

সরকারের পদত্যাগসহ বিভিন্ন দাবিতে গত ২৯ অক্টোবর থেকে কখনো অবরোধ, কখনো হরতালের কর্মসূচি দিয়ে আসছে বিএনপি। দলটির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোও একই ধরনের কর্মসূচি দিচ্ছে। পৃথকভাবে একই কর্মসূচি পালন করছে জামায়াতও। তাদের কর্মসূচিকে ঘিরে প্রায় প্রতিদিনই যানবাহনে অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া যাচ্ছে।

সরকারের অগ্নিনিরোধক সংস্থা ফায়ার সার্ভিস বলছে, বিএনপির সর্বশেষ দশম দফায় ৪৮ ঘণ্টার অবরোধের প্রথম দিন গতকালও ঢাকাসহ সারাদেশে ৮টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করেছে দুর্বৃত্তরা।

নতুন দফায় অবরোধ শুরুর আগে ১৫৫টি বাস, ৪৩টি ট্রাক, ২১টি কাভার্ড ভ্যান, ৮টি মোটরসাইকেল ও অন্যান্য ২৩টি গাড়িতে আগুনের খবর দেয় ফায়ার সার্ভিস। এ হিসাবে হরতাল-অবরোধকালে মোট ২৫৮টি গাড়িতে আগুনের ঘটনা ঘটেছে বলে সরকারি সংস্থাটির তথ্য।

যদিও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির হিসেবে গাড়িতে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা কিছুটা কম। সমিতির নথিভুক্ত অনুযায়ী গতকাল পর্যন্ত ১৮২টি গাড়িতে আগুনের ঘটনা ঘটেছে।

তবে সমিতি এও বলছে, প্রায় দেড় মাস হরতাল-অবরোধে ২৯০টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। সব মিলিয়ে আগুন ও ভাঙচুরে মোট ৪৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে সমিতির দাবি।

সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচির নামে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা সারাদেশে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে। ভাঙচুর অব্যাহত রয়েছে। তারপরও যান চলাচল স্বাভাবিক রেখেছেন পরিবহন মালিকরা। এতে তারা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। আমাদের হিসাবে (বুধবার) এখন পর্যন্ত ৪৭২টি গাড়িতে আগুন ও ভাঙচুর করা হয়েছে। এতে ৪৬ কোটি টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।’

ঢাকার বিভিন্ন বাসটার্মিনাল ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন কোম্পানির বাসগুলো সাড়ি সাড়ি করে ফেলে রাখা হয়েছে। দীর্ঘসময় গাড়ি পড়ে থাকায় ধুলাবালির আস্তর পড়েছে। তাছাড়া গাড়ি পড়ে থাকায় টায়ার, ব্রেকঅয়েল, বাকেট, গ্যাসকেট, বিয়ারিং, সিট, রংসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।

পরিবহন মালিকরা বলছেন, যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন তারা।

শ্রমিকদের মানবেতর জীবনযাপন

বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিকে ঘিরে সড়কে যানবাহন চলাচল কমিয়ে দিয়েছেন পরিবহন মালিকরা। এতে পরিবহন শ্রমিকরা পড়েছেন বিপাকে।

শ্রমিকরা বলছেন, আয় রোজগার না থাকায় অনেকেরই চলছে মানবেতর জীবনযাপন। কিন্তু অন্য কাজে অভিজ্ঞতা না থাকায় জীবন বাঁচাতে হুট করে পেশা পরির্তন করে অন্য পেশায়ও যেতে পারছেন না।

কিশোরগঞ্জ পাকুন্দিয়া মঠখোলা থেকে ঢাকা পর্যন্ত চলাচল করে ‘মনোহরদী পরিবহন’ নামের একটি কোম্পানির বাস। হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির দিন মনোহরদী পরিবহনের বাস চলাচল বন্ধ থাকছে।

গত শুক্রবার এই প্রতিষ্ঠানের একজন চালক জাকির হোসেন (৪২) সংবাদকে বলেন, ‘গাড়ি প্রায় বন্ধ থাকায় সংসার চালানো কঠিন হয়ে গেছে। কোনোমতে বাঁইছা (বেঁচে) আছি। কিন্তু গাড়ি চালানো ছাড়া কোনো বাও (উপায়) নাই। এই লাইনে যুগ পার হইতাছে। হের লাইগাই এহেকদিন গাড়ি চললেও আইয়া পড়ি।’

একই প্রতিষ্ঠানে হেলপার হিসেবে কাজ করেন সুজন মিয়া (২২)। মা, স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে সুমনের পরিবার। বাস চলাচল প্রায় বন্ধ থাকায় সুজনের আয়-রোজগারেও ভাটা পড়েছে।

গত শুক্রবার তার সঙ্গে কথা হলে সুজন বলেন, ‘আমাগো খবর লইবার মানুষ নাই। সপ্তাহে এহেকদিন গাড়িতে উঠতে পারি। যে টেহা পাই সেইটা রাস্তায় শেষ হই যায়। পরিবার নিয়ে খুব বিপদে আছি। ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে। অন্য কাম ভালা লাগে না। তাই গাড়ির পিছেই দৌড়ি।’

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী সংবাদকে বলেন, ‘হরতাল-অবরোধের নামে মূলত ধ্বাংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত। তাদের জনবিরোধী কর্মকাণ্ডে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন পরিবহন শ্রমিকরা। আয়-রোজগার কমে শ্রমিকদের পেটে যেমন আঘাত পড়ছে, তেমনি আগুনে আহতও হচ্ছেন অনেকে।’