সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা : প্রেক্ষিত করোনা ও ডেঙ্গু

নাজমুল হুদা খান

বৈশ্বিক এবং দেশের গত ২০২০-২০২২ সাল পর্যন্ত করোনা এবং বর্তমান ডেঙ্গু অতিমারির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ১২ ডিসেম্বর পালিত হলো বিশ্ব সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা দিবস-২০২৩।

২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর সবার জন্য সর্বত্র উন্নত ও সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ সাধারণ সভায় নীতিমালা গৃহীত হয়। গত ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখের জাতিসংঘের এক উচ্চপর্যায়ের সভায় জোর দেয়া হয় যে, সুস্বাস্থ্য হচ্ছে সমৃদ্ধ অর্থনীতি ও সুস্থ সমাজ বিনির্মাণের মূল ভিত্তি এবং এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মুখ্য চাবিকাঠি। সভায় জানানো হয়, পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ এখনও দরকারি স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত এবং ২ বিলিয়ন মানুষ চিকিৎসা ব্যয় বহনে অর্থকষ্টে ভুগে থাকে।

বিশ্বব্যাপী এ পর্যন্ত কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৭০ কোটি, মৃতের সংখ্যা ৬৯.৫ লাখ। বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা ২০ লাখের বেশি; মৃত্যু ঘটেছে ২৯ হাজার ৫ শত। অনেকটাই অপরিচিত এ অতিমারির মুখোমুখি হয়ে পৃথিবীর অন্যতম উন্নত দেশগুলোর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। এ অতিমারি মোকাবিলায় হাসপাতালগুলোর দক্ষতা ও সক্ষমতায় ঘাটতি; স্বাস্থ্য কর্মীর অপর্যাপ্ততা, স্বাস্থ্যসেবায় ব্যবহৃত লজিস্টিকস সরবরাহে অপ্রতুলতা ইত্যাদির কারণে সারা বিশ্বকে হিমশিম খেতে হয়েছে। উপরন্তু কোভিড-১৯ যুদ্ধে লিপ্ত থাকা এবং এ খাতে বিশালাকার বাজেট বরাদ্দের আবশ্যকতার কারণে বৈশ্বিক অন্যান্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও অনেকটা অবহেলিত থেকে গেছে। বাংলাদেশের শহর ও গ্রামীণ বহু হাসপাতাল শুধু কোভিড-১৯ রোগীদের সেবায় নিয়োজিত রয়েছে। ফলে অন্যান্য রোগীরা সাধারণ ও অতি প্রয়োজনীয় সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

ডেঙ্গুতে বিশ্বের ৮০টিরও বেশি দেশে এ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৪.৫ মিলিয়ন, মৃত্যু ৪০০০-এরও বেশি। বাংলাদেশে এ বছর রেকর্ড আক্রান্তের সংখ্যা ৩ লাখ ছাড়িয়ে, মৃত্যু দেড় হাজারের বেশি। স্বাস্থ্য খাতের বিশাল বাজেট ব্যায় হচ্ছে এসব অতিমারির চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায়। ফলে ব্যাহত হচ্ছে দেশের মানুষের অন্যান্য সাধারন স্বাস্থ্যসেবা। রাজধানী, বিভাগীয়, জেলা-উপজেলা শহরসহ গ্রামীণ বহু হাসপাতাল শুধুমাত্র কোভিড-১৯ রোগীদের সেবায় নিয়োজিত ছিল। ফলে অন্যান্য রোগীরা সাধারণ ও অতি প্রয়োজনীয় সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনায়ও প্রতিটি হাসপাতালে অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিভাগের ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্য কর্মীর সমন্বয়ে ডেঙ্গু কর্নার/ওয়ার্ডে সেবা প্রদান করছে। এসব হাসপাতালে এ সেবার জন্য অতিরিক্ত জনবল নেই। ফলে সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা যথা-প্রজনন, মা, শিশু ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবা; সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা; অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা ইত্যাদি স্বাভাবিকভাবেই ব্যাহত হচ্ছে।

সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রসঙ্গে আলোচনার পূর্বে বলে রাখা প্রয়োজন যে, ২০০০ সালে ১৮৯টি দেশের নেতারা এমডিজি বা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস, মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়ন এবং এইডস, ম্যালেরিয়া এবং অন্যান্য রোগ প্রতিরোধসহ ৮টি লক্ষ্য নির্ধারণ করে ২০১৫ সালের মধ্যে তা বাস্তবায়নে সূচক নির্ধারণ করে দেয়া হয়। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে জাতিসংঘ সাধারণ সভায় ১৭টি লক্ষ্য নির্বাচন করে ২০৩০ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে স্বাস্থ্য বিষয়ক লক্ষমাত্রাকে বলা হয় SDG-3 : Good health and well-being।

এ কর্মসূচিকে সফল করতে ১৩টি টার্গেটের অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয় সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ কর্মসূচি; যাতে বিশ্ববাসীর আর্থিক ঝুঁকি নিরাময়ের মাধ্যমে সব প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা ; নিরাপদ, কার্যকরী, উন্নত ও সুলভ মূল্যে ঔষধ এবং ভ্যাকসিন নিশ্চিত করার নির্দেশনা রয়েছে। এ সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বিশ্ব নেতাদের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং বিশ্ববাসীর মধ্যে জনসচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াসে জাতিসংঘ ২০১৭ সাল থেকে প্রতিবছর ১২ ডিসেম্বর তারিখে সারা বিশ্বে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা দিবস পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করে।

বাংলাদেশ গত এক যুগব্যাপী স্বাস্থ্যসেবায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধন করেছে। শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস এবং তথ্য প্রযুক্তির সফল ব্যবহারের জন্য ২০১০ সালে জাতিসংঘের ৬৫ তম অধিবেশনে বাংলাদেশ বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। জাতিসংঘের মতে, বাংলাদেশে দক্ষিন এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় শ্রেয়তর স্বাস্থ্য অবকাঠামো রয়েছে, যথা- ৫০০টি উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পাঁচ হাজার ইউনিয়ন সাবসেন্টার এবং ১৩ হাজারের অধিক কমিউনিটি ক্লিনিক মাঠ পর্যায় এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠির সেবা প্রদানে নিয়োজিত রয়েছে। আমাদের দেশের ৫ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, প্রতিষেধক টিকা প্রয়োগের হার বৃদ্ধি এবং যক্ষ্মা ও এইডস রোগ নিয়ন্ত্রণে অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য অর্জন। উপরন্তু আমাদের মাতৃ মৃত্যুর হার ৭৫% হ্রাস পেয়েছে, শিশু মৃত্যুর হার অর্ধেকে নেমে এসেছে এবং গড় আয়ু আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়েও এগিয়ে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বব্যাপী সর্বজীন স্বাস্থ্যসেবাকে সফল করতে ৪টি ক্যাটাগরিতে ১৬টি প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবাকে চিহ্নিত করেছেন। প্রথমত- প্রজনন, মা, শিশু ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবার গ্রুপে-পরিবার পরিকল্পনা, গর্ভবতী ও প্রসব পরবর্তী মায়ের যত্ন, শিশুকে প্রতিষেধক ভ্যাকসিন প্রদান এবং নিউমোনিয়া চিকিৎসা গ্রহণে সচেতন করে তোলা। দ্বিতীয়ত- সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা উপদলে- যক্ষ্মা, এইডস, ম্যালেরিয়া এবং রোগ প্রতিরোধে স্যানিটেশন ব্যবস্থা জোরদার। তৃতীয়ত-অসংক্রামক রোগ শ্রেণীতে- উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, জরায়ুর ক্যান্সার এবং ধূমপানজনিত রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা। চতুর্থত- সেবা সক্ষমতা বৃদ্ধি অধ্যায়ে- হাসপাতালের সেবার পরিধি বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা বাড়ানো, প্রয়োজনীয় ঔষধপত্রের পর্যাপ্ত সরবরাহ এবং আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুযায়ী স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।

কোভিড-১৯ এবং ডেঙ্গুসহ অন্যান্য এন্ডেমিক সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিশ্বের সব দেশের মনোযোগ, এ রোগ প্রতিরোধ চিকিৎসায় বিশাল বাজেট বরাদ্দ ও খরচ এবং জীবনযাত্রার সব পর্যায়ে ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করায় দরিদ্র, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতো বটেই, উন্নত দেশগুলোও সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে হিমশিম খাচ্ছে। বলা যায়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে টেকসই লক্ষ্যমাত্রা মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে বহু দেশে। এ অতিমারি প্রতিরোধ ও চিকিৎসার প্রস্তুতি, দক্ষ জনবল ও সরবরাহ ঘাটতি রয়েছে সারা বিশ্বে। পরবর্তীতে উন্নত বিশ্বে চাহিদামাফিক জনশক্তি, চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা গেলেও অধিকাংশ দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের দেশে বিদ্যমান সম্পদ দিয়ে এ অতিমারিসমূহকে ঠেকাতে পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ঝুঁকির সম্মুখীন হয়।

কোভিড ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পরও ভ্যাকসিন প্রাপ্তি ও সরবরাহ পর্যাপ্ততায় উন্নত দেশের বিপরীতে উন্নয়নশীল দেশসমূহের চিত্রে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। করোনা ও ডেঙ্গু ভাইরাসের ধরন পরিবর্তনের কারণে এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হতে থাকে। ফলে অর্থনীতি, জীবনযাত্রা ও স্বাস্থ্যের অন্যান্য খাতে মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রোধে দীর্ঘ সময় ব্যয় হচ্ছে তাতে সন্দেহ নেই। এর প্রভাব সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তা অনেকটাই নিশ্চিত। তবে সংক্রামক অতিমারিসমূহের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার বহু সংকট ও ঘাটতির মধ্যেও সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা খাতে অনেক ক্ষেত্রে ইতিবাচক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অতিমারি প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, পরিচ্ছন্ন জীবনযাত্রা এবং স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের অভ্যাসের কারণে অন্যান্য সংক্রামক রোগের বিস্তার কমেছে। এ সময় কো-মর্বিডিটির কারণে করোনা রোগের তীব্রতা ও মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ার জন্য অসংক্রামক রোগ-ব্যাধির বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। অতিমারি মোকাবেলায় গৃহীত সব পদক্ষেপের কারণে দেশের স্বাস্থ্য কাঠামো, জনশক্তি ও সংক্রামক রোগ ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়েছে, বহুদিন যাবত ঝিমিয়ে পড়া ভ্যাক্সিন প্রযুক্তি ও উৎপাদন খাত উন্নত ও অগ্রসর হয়েছে।

স্বাস্থ্য খাতে নিয়োজিত সরকারি, বেসরকারি, এনজিওসহ সব সংস্থাগুলো আরও বেশি কার্যকর ও সুসংহত হয়েছে। এসব অগ্রগতি সব দেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনার ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সহায়তা করবে। এ অগ্রগতি সমূহের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবায় সফলতা আনয়নে কাজে লাগাতে হবে। টেকসই উন্নয়নে লক্ষ্যমাত্রায় স্বাস্থ্য বিষয়ক এসডিজি-৩ সুস্থ বিশ্ব বিনির্মাণের পূর্বশর্ত। এর ১৩টি টার্গেটে সফলতা আনয়নে যে সূচক নির্ধারণ করা হয়েছে, তা নিম্ন আয়ের এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য দুরূহ বটে! তবে ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণই উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনের পূর্বশর্ত; এটি সারা বিশ্বের নেতারা নিজ নিজ দেশ এবং সর্বোপরি সুস্থ ও শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গঠনে একমত হয়েছেন।

সুতরাং বৈশ্বিক করোনা অতিমারিসমূহকে পরাস্ত করেও সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব। এজন্য দেশের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালীকরণ, নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোকে আরও বেশি কার্যকর ও জবাবদিহির আওতায় আনা, স্বাস্থ্য খাতে ভূমিকা পালনকারী সব সংস্থার যথাযথ সমন্বয় গঠন, দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্ত ভিতে দাঁড় করানো, সব পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের যথাযথ ব্যবহার, রোগ প্রতিরোধ খাতের কার্যক্রমকে জোরদারকরণ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ পদ্ধতিকে কার্যকরী করা, সবাইকে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে সচেতন করে তোলা, স্বাস্থ্যসেবা খাতে সব পর্যায়ে সামাজিক সম্পদ ও উৎসগুলোকে কাজে লাগানো এবং সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে প্রতিনিয়ত গবেষণা করা এবং গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে দেশের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন এগিয়ে নিতে হবে।

[লেখক : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রেষণে কুয়েতে নিযুক্ত]

বৃহস্পতিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩ , ২৯ অগ্রায়ন ১৪৩০, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫

সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা : প্রেক্ষিত করোনা ও ডেঙ্গু

নাজমুল হুদা খান

বৈশ্বিক এবং দেশের গত ২০২০-২০২২ সাল পর্যন্ত করোনা এবং বর্তমান ডেঙ্গু অতিমারির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ১২ ডিসেম্বর পালিত হলো বিশ্ব সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা দিবস-২০২৩।

২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর সবার জন্য সর্বত্র উন্নত ও সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ সাধারণ সভায় নীতিমালা গৃহীত হয়। গত ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখের জাতিসংঘের এক উচ্চপর্যায়ের সভায় জোর দেয়া হয় যে, সুস্বাস্থ্য হচ্ছে সমৃদ্ধ অর্থনীতি ও সুস্থ সমাজ বিনির্মাণের মূল ভিত্তি এবং এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মুখ্য চাবিকাঠি। সভায় জানানো হয়, পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ এখনও দরকারি স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত এবং ২ বিলিয়ন মানুষ চিকিৎসা ব্যয় বহনে অর্থকষ্টে ভুগে থাকে।

বিশ্বব্যাপী এ পর্যন্ত কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৭০ কোটি, মৃতের সংখ্যা ৬৯.৫ লাখ। বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা ২০ লাখের বেশি; মৃত্যু ঘটেছে ২৯ হাজার ৫ শত। অনেকটাই অপরিচিত এ অতিমারির মুখোমুখি হয়ে পৃথিবীর অন্যতম উন্নত দেশগুলোর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। এ অতিমারি মোকাবিলায় হাসপাতালগুলোর দক্ষতা ও সক্ষমতায় ঘাটতি; স্বাস্থ্য কর্মীর অপর্যাপ্ততা, স্বাস্থ্যসেবায় ব্যবহৃত লজিস্টিকস সরবরাহে অপ্রতুলতা ইত্যাদির কারণে সারা বিশ্বকে হিমশিম খেতে হয়েছে। উপরন্তু কোভিড-১৯ যুদ্ধে লিপ্ত থাকা এবং এ খাতে বিশালাকার বাজেট বরাদ্দের আবশ্যকতার কারণে বৈশ্বিক অন্যান্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও অনেকটা অবহেলিত থেকে গেছে। বাংলাদেশের শহর ও গ্রামীণ বহু হাসপাতাল শুধু কোভিড-১৯ রোগীদের সেবায় নিয়োজিত রয়েছে। ফলে অন্যান্য রোগীরা সাধারণ ও অতি প্রয়োজনীয় সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

ডেঙ্গুতে বিশ্বের ৮০টিরও বেশি দেশে এ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৪.৫ মিলিয়ন, মৃত্যু ৪০০০-এরও বেশি। বাংলাদেশে এ বছর রেকর্ড আক্রান্তের সংখ্যা ৩ লাখ ছাড়িয়ে, মৃত্যু দেড় হাজারের বেশি। স্বাস্থ্য খাতের বিশাল বাজেট ব্যায় হচ্ছে এসব অতিমারির চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায়। ফলে ব্যাহত হচ্ছে দেশের মানুষের অন্যান্য সাধারন স্বাস্থ্যসেবা। রাজধানী, বিভাগীয়, জেলা-উপজেলা শহরসহ গ্রামীণ বহু হাসপাতাল শুধুমাত্র কোভিড-১৯ রোগীদের সেবায় নিয়োজিত ছিল। ফলে অন্যান্য রোগীরা সাধারণ ও অতি প্রয়োজনীয় সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনায়ও প্রতিটি হাসপাতালে অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিভাগের ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্য কর্মীর সমন্বয়ে ডেঙ্গু কর্নার/ওয়ার্ডে সেবা প্রদান করছে। এসব হাসপাতালে এ সেবার জন্য অতিরিক্ত জনবল নেই। ফলে সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা যথা-প্রজনন, মা, শিশু ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবা; সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা; অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা ইত্যাদি স্বাভাবিকভাবেই ব্যাহত হচ্ছে।

সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রসঙ্গে আলোচনার পূর্বে বলে রাখা প্রয়োজন যে, ২০০০ সালে ১৮৯টি দেশের নেতারা এমডিজি বা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস, মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়ন এবং এইডস, ম্যালেরিয়া এবং অন্যান্য রোগ প্রতিরোধসহ ৮টি লক্ষ্য নির্ধারণ করে ২০১৫ সালের মধ্যে তা বাস্তবায়নে সূচক নির্ধারণ করে দেয়া হয়। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে জাতিসংঘ সাধারণ সভায় ১৭টি লক্ষ্য নির্বাচন করে ২০৩০ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে স্বাস্থ্য বিষয়ক লক্ষমাত্রাকে বলা হয় SDG-3 : Good health and well-being।

এ কর্মসূচিকে সফল করতে ১৩টি টার্গেটের অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয় সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ কর্মসূচি; যাতে বিশ্ববাসীর আর্থিক ঝুঁকি নিরাময়ের মাধ্যমে সব প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা ; নিরাপদ, কার্যকরী, উন্নত ও সুলভ মূল্যে ঔষধ এবং ভ্যাকসিন নিশ্চিত করার নির্দেশনা রয়েছে। এ সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বিশ্ব নেতাদের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং বিশ্ববাসীর মধ্যে জনসচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াসে জাতিসংঘ ২০১৭ সাল থেকে প্রতিবছর ১২ ডিসেম্বর তারিখে সারা বিশ্বে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা দিবস পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করে।

বাংলাদেশ গত এক যুগব্যাপী স্বাস্থ্যসেবায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধন করেছে। শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস এবং তথ্য প্রযুক্তির সফল ব্যবহারের জন্য ২০১০ সালে জাতিসংঘের ৬৫ তম অধিবেশনে বাংলাদেশ বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। জাতিসংঘের মতে, বাংলাদেশে দক্ষিন এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় শ্রেয়তর স্বাস্থ্য অবকাঠামো রয়েছে, যথা- ৫০০টি উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পাঁচ হাজার ইউনিয়ন সাবসেন্টার এবং ১৩ হাজারের অধিক কমিউনিটি ক্লিনিক মাঠ পর্যায় এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠির সেবা প্রদানে নিয়োজিত রয়েছে। আমাদের দেশের ৫ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, প্রতিষেধক টিকা প্রয়োগের হার বৃদ্ধি এবং যক্ষ্মা ও এইডস রোগ নিয়ন্ত্রণে অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য অর্জন। উপরন্তু আমাদের মাতৃ মৃত্যুর হার ৭৫% হ্রাস পেয়েছে, শিশু মৃত্যুর হার অর্ধেকে নেমে এসেছে এবং গড় আয়ু আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়েও এগিয়ে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বব্যাপী সর্বজীন স্বাস্থ্যসেবাকে সফল করতে ৪টি ক্যাটাগরিতে ১৬টি প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবাকে চিহ্নিত করেছেন। প্রথমত- প্রজনন, মা, শিশু ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবার গ্রুপে-পরিবার পরিকল্পনা, গর্ভবতী ও প্রসব পরবর্তী মায়ের যত্ন, শিশুকে প্রতিষেধক ভ্যাকসিন প্রদান এবং নিউমোনিয়া চিকিৎসা গ্রহণে সচেতন করে তোলা। দ্বিতীয়ত- সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা উপদলে- যক্ষ্মা, এইডস, ম্যালেরিয়া এবং রোগ প্রতিরোধে স্যানিটেশন ব্যবস্থা জোরদার। তৃতীয়ত-অসংক্রামক রোগ শ্রেণীতে- উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, জরায়ুর ক্যান্সার এবং ধূমপানজনিত রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা। চতুর্থত- সেবা সক্ষমতা বৃদ্ধি অধ্যায়ে- হাসপাতালের সেবার পরিধি বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা বাড়ানো, প্রয়োজনীয় ঔষধপত্রের পর্যাপ্ত সরবরাহ এবং আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুযায়ী স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।

কোভিড-১৯ এবং ডেঙ্গুসহ অন্যান্য এন্ডেমিক সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিশ্বের সব দেশের মনোযোগ, এ রোগ প্রতিরোধ চিকিৎসায় বিশাল বাজেট বরাদ্দ ও খরচ এবং জীবনযাত্রার সব পর্যায়ে ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করায় দরিদ্র, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতো বটেই, উন্নত দেশগুলোও সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে হিমশিম খাচ্ছে। বলা যায়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে টেকসই লক্ষ্যমাত্রা মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে বহু দেশে। এ অতিমারি প্রতিরোধ ও চিকিৎসার প্রস্তুতি, দক্ষ জনবল ও সরবরাহ ঘাটতি রয়েছে সারা বিশ্বে। পরবর্তীতে উন্নত বিশ্বে চাহিদামাফিক জনশক্তি, চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা গেলেও অধিকাংশ দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের দেশে বিদ্যমান সম্পদ দিয়ে এ অতিমারিসমূহকে ঠেকাতে পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ঝুঁকির সম্মুখীন হয়।

কোভিড ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পরও ভ্যাকসিন প্রাপ্তি ও সরবরাহ পর্যাপ্ততায় উন্নত দেশের বিপরীতে উন্নয়নশীল দেশসমূহের চিত্রে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। করোনা ও ডেঙ্গু ভাইরাসের ধরন পরিবর্তনের কারণে এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হতে থাকে। ফলে অর্থনীতি, জীবনযাত্রা ও স্বাস্থ্যের অন্যান্য খাতে মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রোধে দীর্ঘ সময় ব্যয় হচ্ছে তাতে সন্দেহ নেই। এর প্রভাব সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তা অনেকটাই নিশ্চিত। তবে সংক্রামক অতিমারিসমূহের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার বহু সংকট ও ঘাটতির মধ্যেও সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা খাতে অনেক ক্ষেত্রে ইতিবাচক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অতিমারি প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, পরিচ্ছন্ন জীবনযাত্রা এবং স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের অভ্যাসের কারণে অন্যান্য সংক্রামক রোগের বিস্তার কমেছে। এ সময় কো-মর্বিডিটির কারণে করোনা রোগের তীব্রতা ও মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ার জন্য অসংক্রামক রোগ-ব্যাধির বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। অতিমারি মোকাবেলায় গৃহীত সব পদক্ষেপের কারণে দেশের স্বাস্থ্য কাঠামো, জনশক্তি ও সংক্রামক রোগ ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়েছে, বহুদিন যাবত ঝিমিয়ে পড়া ভ্যাক্সিন প্রযুক্তি ও উৎপাদন খাত উন্নত ও অগ্রসর হয়েছে।

স্বাস্থ্য খাতে নিয়োজিত সরকারি, বেসরকারি, এনজিওসহ সব সংস্থাগুলো আরও বেশি কার্যকর ও সুসংহত হয়েছে। এসব অগ্রগতি সব দেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনার ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সহায়তা করবে। এ অগ্রগতি সমূহের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবায় সফলতা আনয়নে কাজে লাগাতে হবে। টেকসই উন্নয়নে লক্ষ্যমাত্রায় স্বাস্থ্য বিষয়ক এসডিজি-৩ সুস্থ বিশ্ব বিনির্মাণের পূর্বশর্ত। এর ১৩টি টার্গেটে সফলতা আনয়নে যে সূচক নির্ধারণ করা হয়েছে, তা নিম্ন আয়ের এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য দুরূহ বটে! তবে ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণই উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনের পূর্বশর্ত; এটি সারা বিশ্বের নেতারা নিজ নিজ দেশ এবং সর্বোপরি সুস্থ ও শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গঠনে একমত হয়েছেন।

সুতরাং বৈশ্বিক করোনা অতিমারিসমূহকে পরাস্ত করেও সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব। এজন্য দেশের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালীকরণ, নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোকে আরও বেশি কার্যকর ও জবাবদিহির আওতায় আনা, স্বাস্থ্য খাতে ভূমিকা পালনকারী সব সংস্থার যথাযথ সমন্বয় গঠন, দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্ত ভিতে দাঁড় করানো, সব পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের যথাযথ ব্যবহার, রোগ প্রতিরোধ খাতের কার্যক্রমকে জোরদারকরণ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ পদ্ধতিকে কার্যকরী করা, সবাইকে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে সচেতন করে তোলা, স্বাস্থ্যসেবা খাতে সব পর্যায়ে সামাজিক সম্পদ ও উৎসগুলোকে কাজে লাগানো এবং সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে প্রতিনিয়ত গবেষণা করা এবং গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে দেশের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন এগিয়ে নিতে হবে।

[লেখক : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রেষণে কুয়েতে নিযুক্ত]