লোরকার খোঁজে গ্রানাদায়

রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী

মে মাসের এক রোদেলা দুপুরে আল হাম্ব্রা-র র্তোরে দে লা বেলা-র (নজর মিনার) চূড়ায় লোরকার সঙ্গে দেখা। ঐ চূড়ায় আমি তখন বসে বসে দুচোখ জুড়িয়ে গ্রানাদার সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। কে যেন আমাকে ডাক দিতেই পাশ ফিরে দেখি সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ফেদেরিকো মানে লোরকা; পরনে সবুজ ডোরাকাটা ফুলহাতা শার্ট, তার সঙ্গে কালো রঙের ঢিলেঢালা প্যান্টালুন। ব্যাকব্রাশ করা মাথাভর্তি এক রাশ কালো চুলের সামনে প্রশস্ত কপাল, যেখানে জমে রয়েছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সব মিলিয়ে মাঝারি উচ্চতার এক সুকান্ত স্প্যানিশ যুবা। আর সব কিছু ছাপিয়ে দৃষ্টি কেড়ে নেয় তাঁর উজ্জ্বল-উচ্ছল স্বাপ্নিক চোখজোড়া। “ওলা! কোমো এস্তাস?” বলে শুরু হয় আলাপের পর্ব। কবির চোখ দিয়ে নতুন করে আমি গ্রানাদার সৌন্দর্য অবলোকনে মগ্ন হই। আমাকে এক এক করে সব বুঝিয়ে দিতে থাকেন লোরকা। চোখের সামনে বেগা বা সবুজ সমতল গ্রামাঞ্চল, এর আলোকিত জলপাইকুঞ্জ এবং এর স্বচ্ছ প্রবহমান জলস্রোত। আকাশের নীল এসে সবুজ সমতলের সীমান্তে মিশেছে। নদীর ধারের পপলার অরণ্য যেন হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকে। সব কিছুতেই এক কাব্যময়তা, স্থানের চমৎকারিত্ব, রঙের আভায় উদ্ভাসিত চারদিক। বেগা বা ঊর্বর সমতলভূমির ভেতর দিয়ে তরতর করে বয়ে যায় হেনিল নামের নদী। নিকটবর্তী সুউচ্চ পর্বত সির্য়েরা নেবাদা-র পায়ের কাছে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকে হেনিল নদী তার শরীর বাঁকিয়ে। উপত্যকার মাঝে এই ঊর্বর সমতলভূমি বা বেগা-র বিস্তার। পাহাড় দিয়ে ঘেরা উপত্যকার ক্যানভাস জুড়ে জলের ছোটাছুটি আর চাষের জমির চিত্র। ঋজু পপলার এবং কমলালেবুর বাগানের ঘন ল্যান্ডস্কেপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য আধা-শহর আর গ্রাম। গ্রানাদা অভিমুখী সকল পথ এসে মিশেছে এই বেগায়। পশ্চিমে, সেবিইয়া আর কোর্দোবা থেকে আসা পথের ধারে ফুয়েন্তে বাকেরোস নামের ছোট্ট একটি গ্রাম, যে গ্রামে জন্মেছিলেন লোরকা। “তে ইনবিতো আ মি কাসা!” বাড়িতে যাওয়ার দাওয়াত দিয়ে সেই যে উধাও হলেন লোরকা আজও কেবলই খুুঁজে বেড়াচ্ছি তাঁকে।

লোরকার নিমন্ত্রণে ৫ই জুন সকালে আলসিনো গ্রায়েল্স্ কোম্পানির বাসে চেপে গ্রানাদা শহর ছাড়িয়ে ১৮ কিঃমিঃ দূরের ফুয়েন্তে বাকেরোস গ্রামে গিয়ে পৌঁছলাম। দিনটি ছিল লোরকার জন্মদিন। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের ৫ই জুন ফেদেরিকো দেল সাগ্রাদো কোরাসোন দে হেসুস্ গার্সিয়া লোরকা জন্মেছিলেন এই গ্রামেই। জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাবার জন্য বহু তালাশ করেও কিন্তু লোরকাকে কোথাও পাওয়া গেল না, যদিও সবাই বলছে যে তিনি আছেন কোথাও। স্কুল শিক্ষয়িত্রী বিসেন্তে লোরকার (কবির বোন) দেখা পেলাম। তিনি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাঁদের বাড়ি দেখালেন, আজ যা একটি জাদুঘরে পরিণত, এস্পানিয়োল ভাষায় যার নাম কাসা-মুসেয়ো ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা। কবির এই বোনের কল্যাণেই বাড়িটি পুনরায় তার আগের রূপ ফিরে পেয়েছে, যার মধ্যে একেবারে সেই সময়ের বেশি কিছু আসবাবও বর্তমান। গোলাঘরটি আজ লোরকার স্মৃতির প্রতি নিবেদিত প্রদর্শনী কক্ষ এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়, আমার মতো হাজারো হাজার জন যা দেখার জন্য সারা বছর ভিড় জমায় গ্রানাদার বেগা-র ছোট্ট এই গ্রামে।

এই গ্রামেই লোরকা প্রথম স্বপ্ন দেখেছিলেন সুদূরের। এই মাটিতেই একদিন তিনি ফুল হয়ে ফুটেছিলেন। এর পথঘাট, মানুষ, লোকাচার, কবিতা, এর শুভ-অশুভ সব কিছুতে ভর দিয়ে লোরকার বেড়ে ওঠা। আশপাশের পপলার গাছের হাসি আর গান, পাখির ডাক, ফলকুড়ানো, খরা-গ্রীষ্মের দিন- সব কিছুতেই জড়িয়ে আছে লোরকার নাম। কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা সড়কের ৪ নং বাড়ির উঠোনের কুয়োর আজও বহমান জলের ধারা লোরকার গান শোনায়, লোরকার ঘরের ব্যালকনি গলিয়ে ঢোকা রাতের আকাশের চাঁদ কানের কাছে এসে বলে “বিয়েনবেনিদো, আমিগো” (তোমায় স্বাগতম, হে বন্ধু)।

লোরকার বাবা ফেদেরিকো গার্সিয়া রোদ্রিগেস ছিলেন অবস্থাপন্ন কৃষক, চিনি উৎপাদন করে সচ্ছলতার মুখ দেখেছিলেন তিনি। আর মা, বিসেন্তে লোরকা রোমেরো (গার্সিয়া রোদ্রিগেসের দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রী) ছিলেন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষয়িত্রী। লোরকার জীবনের প্রথম ১১টি বছর কৃষিনির্ভর এই ফুয়েন্তে বাকেরোস গ্রামেই কাটে। তাঁর পুরো বাল্যকাল জুড়ে কেবলই গ্রাম। গ্রামের সাধারণ মানুষের সঙ্গে এক গভীর বন্ধনে জড়িয়ে ছিল তাঁর হৃদয়। দেখা আর শোনার এক অনন্যসাধারণ জগৎ যেন সে গ্রাম: ক্ষেতে কাজে ব্যস্ত কৃষক, জিপসিদের পাড়া, রাখাল, ফসলের জমি, আকাশ, একাকিত্ব। সংক্ষেপে বলতে হয়: সারল্য। লোরকার কবিতার উৎস খুঁজতে গিয়ে আমি গ্রানাদার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি- ঊর্বর সবুজ সমতলভূমি বেগা আর র্দারো-হেনিল নদীর পাড়ের মানুষ, ক্ষেত-ফসলের জমিতে কাজ করা মানুষ- কিন্তু সকলেই তাঁর কবিতার কথা বলতে গিয়ে কেবলই তার মৃত্যু প্রসঙ্গে এসে যান, আজ থেকে বাষট্টি বছর আগে ঘটে যাওয়া সে মর্মান্তিক কাহিনি কে-ই বা ভুলতে পারে! গ্রানাদা শহরের নিকটবর্তী বিসনার গ্রামে আলফাকার পার্কের ছোট্ট এক সঙ্কীর্ণ উপত্যকায় একনায়ক জেনারেল ফ্রাঙ্কোর ন্যাশনালিস্ট সৈন্যবাহিনীর হাতে কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার করুণ মৃত্যু ঘটে স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধকালে, ১৯৩৬ সালের ১৮ই আগস্ট। কবির মৃতদেহ খুঁড়ে পাওয়া যায়নি আর। এখনো চলছে সে-খোঁজ।

আমি আমার ব্যালকনি বন্ধ করে রেখেছি

কারণ কান্না শুনতে চাই না

তবু ধূসর দেয়ালের পেছন থেকে

কান্না ছাড়া কিছুই যে শোনা যায় না।

গুটিকয়েক দেবদূতই গান গায়,

গুটিকয়েক কুকুরই ঘেউঘেউ করে,

আমার করতলে হাজারটা ভায়োলিন জায়গা করে নেয়।

গ্রানাদার অবস্থান এস্পানিয়ার স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল আন্দালুসিয়ায়। আন্দালুসিয়া পুরোটাই যেন এক প্রতœতাত্ত্বিক স্থান, এর স্তরে স্তরে বিভিন্ন সংস্কৃতি আর সভ্যতা এসে মিশেছে। লোরকা সেটা জানতেন, বিমুগ্ধ বিস্ময়ে এর সৌন্দর্যকে অবলোকন করতেন। এস্পানিয়ায় ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতির শেষ ঘাঁটি গ্রানাদা শহরের সামান্য কয়েক মাইলের মধ্যেই ছিল তাঁর আবাস। ধ্যানমগ্ন মানুষ গ্রানাদায় আসে একটু একা হতে: মধুর গুঞ্জন, পবিত্র মসজিদের ছায়া আর নাইটিঙ্গেলের গানের সুরে মৃদুময় হাওয়ায় গা ভাসিয়ে প্রাচীন

পাহাড়ের কোল ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে দেখা যায় কাছেই জাফরান আর ঘন ধূসর গোলাপি চোষ কাগজের বহ্ন্যুৎসবে মাতোয়ারা আল হাম্ব্রার দেয়ালপ্রাচীর। একা থাকা, একা হয়ে গিয়ে চমৎকার সুন্দর সব কণ্ঠস্বরের কাকলিতে ভরপুর পরিবেশে ধ্যানস্থ হওয়া, গভীর কোনো ধ্যান। কিন্তু, মুসলিমদেরকে হটিয়ে দিয়ে ১৪৯২ সালে গ্রানাদা দখলের পরপরই ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠে ক্যাথলিক খ্রিস্টান এস্পানিয়োল শাসকগোষ্ঠী। আল হাম্ব্রার নাসরিদ প্রাসাদের একাংশ ভেঙে নির্মিত রাজা পঞ্চম কার্লোসের প্রাসাদটি সম্ভবত গ্রানাদার এই দ্বন্দ্বযুদ্ধের জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত।

“গ্রানাদা রক্ত ছাড়া আর কি-ই বা,

মহিমান্বিত স্বর্গের রক্ত,

আহত মাটির রক্ত,

জনস্রোতের সুচে বিদ্ধ।

উষর পাহাড়ের ছিলকা মারা

বাতাসের রক্ত।

গ্রানাদা আমাদের শিরা-ধমনি বাহিত রক্তের

প্রাগৈতিহাসিক বিবরণ।

তিক্ত, কঠিন ফোঁটায়

আটকে পড়া রক্তের ইতিউতি,

হৃদয় আর করোটির

আবছা রূপ।”

গ্রানাদা শহরের অলিগলি, পাহাড়ি পথে হাঁটতে গেলে শোনা যায় ফোয়ারা, পাহাড়ি ঝোরাসহ বিচিত্র উৎসের জলস্রোতের মৃদু ঝঙ্কার। জীবনের পথে হাঁটতে গিয়ে ক্লান্ত পথিকের মনপ্রাণ জলের সে ঝঙ্কারে দুদ- বিশ্রামের সুযোগ পায়। আমাদের জীবনতৃষ্ণা মেটাতে সে জলের কী নিরন্তর ছোটাছুটি!

“শীতল ঝর্ণার ধারে বসে দুদ- বিশ্রাম নেয় আমার হৃদয়।

(তোমার জালে আঁজলা ভরে নাও,

বিস্মৃতির মাকড়সা।)

ঝর্ণার জল তাকে তার গান শুনিয়েছিল।

(তোমার জালে আঁজলা ভরে নাও,

বিস্মৃতির মাকড়সা।)

আমার জাগরিত হৃদয় তার ভালোবাসার গান শুনিয়েছিল।

(নিস্তব্ধতার মাকড়সা,

তোমার রহস্যের জাল বিছাও।)

ঝর্ণার জল বিষণœভাবে শুনেছিল।

(নিস্তব্ধতার মাকড়সা,

তোমার রহস্যের জাল বিছাও।)

শীতল ঝর্ণায় আমার হৃদয় হোঁচট খায়।

(শাদা হাত, দূরে,

জলকে থামিয়ে রাখে।)

আনন্দচিত্তে জল তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

(শাদা হাত, দূরে

জলে কিছুই নেই।)”

ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা এস্পানিয়োল সাহিত্যের সবচেয়ে জটিল এবং মৌলিক কবিদের একজন। এস্পানিয়োল সাহিত্যের ইতিহাসে লোরকা এক পৌরাণিক চরিত্রের নাম। একটা অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, আধুনিক এস্পানিয়োল সাহিত্যের পটভূমিতে লোরকার অবস্থান একেবারেই আলাদা এবং স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত। ১৯২৭ প্রজন্মের কবিদের গোষ্ঠীভুক্ত হয়েও তিনি তাঁর আপন মহিমায় ভাস্বর। সমসাময়িক বা পরবর্তী প্রজন্মের কবিদের মধ্যে লোরকার কোনো প্রভাব লক্ষ্য করা যায় না। এস্পানিয়োল সাহিত্যের ঐতিহ্য এবং আঁভা-গার্দ ধারার সংমিশ্রণে তিনি একাকি এক সংশ্লেষণী কাব্য আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন যা সমসাময়িক সাহিত্য-সংস্কৃতির আলোকে এক কথায় অতুলনীয়। বলা হয়ে থাকে যে, সাহিত্য বিষয়ক খুব একটা পড়াশোনা লোরকার ছিল না, কিন্তু তার সাহিত্যকর্ম পাঠ করতে গিয়ে এস্পানিয়োল সাহিত্যের ঐতিহ্যগত আর বিশ্বসাহিত্যের কিছু উল্লেখযোগ্য প্রাসঙ্গিক উত্থাপন, পরোক্ষোল্লেখ খেয়াল করলে এ কথা মেনে নিতে কষ্ট হয়। যেমন রোমান্সেরো হিতানো বা ‘জিপসি ব্যালাড’ কবিতা পড়তে গিয়ে এস্পানিয়োল সাহিত্যের মধ্যযুগীয় ক্ল্যাসিক কানতার দে মিয়ো সিদ্-এর শ্লোক মনে পড়ে। এ যেন এস্পানিয়োল সাহিত্যিক ঐতিহ্যের সঙ্গে লোরকার সংলাপ স্থাপন। প্রহেলিকাময় এক বিশ্বের সঙ্গে আদি প্রাকৃতিক ধর্মীয় বিষয়বস্তু এবং মৌলিক আদর্শের সম্পর্ক স্থাপন: যৌবনের শক্তি, ত্যাগ, ঊর্বরতা, জীবন-মৃত্যুর সংযোগ আর তার সঙ্গে একইভাবে চাঁদ, ষাড়, রক্ত এবং ছুরি। লোরকার ঝোঁক ধর্মাচরণের প্রতি, অতীতের পৌরাণিক দর্শনের কাব্যিক গঠনের প্রতি। তাঁর জিপসিরা দূর বিশ্বের কোনো অদ্ভুত জীব নয়, প্রাচীন পুরাণের ধারক ও বাহক তারা।

জিপসির আহ্বান

দূর এক দেশ

উঁচু উঁচু কেল্লা

আর রহস্যময় মানুষ।

চিরন্তন, স্থায়ী মানুষের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কবির বিশ্বজাগতিক পরিব্যাপ্তিরই পরিচায়ক। দুনিয়াময় তাঁর যতটা পরিচিতি তা রীতিমত ঈর্ষণীয়। গভীর ঐতিহ্যাশ্রয়ী লোরকার কবিতা আঁভা-গার্দ আন্দোলনের সমস্ত নতুনত্বকে বরণ করে নেয় সহজেই। এক নতুন কাব্যিক ফরংপড়ঁৎংব সৃষ্টিতে লোরকার বাহাদুরি অসামান্য। দুঃসাহসী রূপক-এর চর্চা, চিরন্তন মৌলিক ভাবপ্রকাশক কাব্যসূত্র সৃষ্টিতে বিস্তৃত প্রতীকের ব্যবহার এবং অন্তহীন প্রাণবন্ততা পরোক্ষে জীবনের জয়গানই গায়। লোরকা আমাদের কাছে উপস্থিত হন সকল মানুষের যাবতীয় আদিম তাড়না নিয়ে। পার্থিব বিষয়বস্তুর প্রতি এক দুর্মর আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় তাঁর কবিতায়।

“সবুজ তোমায় ভালোবাসি, সবুজ।”

আধুনিক শহরের বিষয়বস্তুকে এতটা তীক্ষèতা নিয়ে যেমনটা মোকাবিলা করেছেন লোরকা তাঁর পোয়েতা এন নুয়েবা ইয়র্ক (‘পোয়েট ইন নিউইয়র্ক’) কাব্যগ্রন্থে তা এক কথায় অনবদ্য। অস্তিত্ববাদ, যীশুর বাণী সংক্রান্ত খ্রিস্টীয় ধার্মিকতা, সামাজিক এবং এমনকি মার্কসীয় তত্ত্ব লোরকার কাব্যিক ফরংপড়ঁৎংব-এ ঘুরেফিরে আসে, যা সর্বদাই শোষিতের পক্ষে কথা বলে। লোরকা তাই আমাদের জিপসির গান শোনান। শুধু তাই-ই নয়, উপরন্তু নিগ্রো, ইহুদি, সমকামী, বঞ্চিত খেটে খাওয়া মানুষ তথা সমাজের সকল অপদস্থ শ্রেণীর মানুষের কথা শোনান লোরকা। কিন্তু তাঁর রচনাকে ঠিক রাজনৈতিক সমাজতন্ত্র বলা যাবে না, বরং একে সমবেদনশীল সমাজতন্ত্র বলা যেতে পারে। তাঁর বৈশ্বিক ভ্রাতৃত্ববোধ মহাজাগতিকও বটে। ১৯৩০ সালে নিউইয়র্ক নগরী ভ্রমণকালে লেখা পোয়েতা এন নুয়েবা ইয়র্ক-এর কবিতাগুলো তখনকার সমসাময়িক বাস্তবতার নিরিখে রচিত যেখানে অতিমানবীয় স্থাপত্য এবং উন্মত্ত ছন্দ, জ্যামিতি এবং যন্ত্রণাক্লিষ্ট জীবনের ছবি মূর্ত হয়।

“বহু ভ্রƒণের নিচে

এক বিন্দু হাঁসের রক্ত।”

এই মহাজাগতিকতাবোধ, সমাজতান্ত্রিক অবলম্বন, এ কেবল তাঁর একার নয়, এর শিকড় আরও অনেক অতীতে প্রোথিত। লোরকার রচনাকর্মের গাঠনিক বৈচিত্র্য দেখে মুগ্ধ বিস্ময়ে অবাক হতে হয়। একাধারে তিনি ছিলেন কবি, নাট্যকার, সুবক্তা; ছবি আঁকা ছাড়াও চমৎকার পিয়োনো বাজাতেন লোরকা। এক যাদুকরী ঐশ্বরিক চরিত্র ছিলেন তিনি। কবি হিসেবে তাঁর অন্তরঙ্গ কাব্যিকতা এবং তীব্র যন্ত্রণার প্রকাশ দেখি প্রাচ্যকাব্যস্নাত দিবান দেল তামারিত-এর গজলগুলিতে কিংবা সোনেতোস দেল আমোর ওস্কুরো-রকবিতায় অথবা মহাকাব্যিক ‘জিপসি ব্যালাড’-এ। বিশুদ্ধ আন্দালুসিয়ো এক বিশ্বের গাঠনিক চমৎকারিত্ব ও প্রাচীন কাস্তিলিয়ো রোমান্সের রূপরেখায় ‘জিপসি ব্যালাড’ তার কাব্যিকতার পরিচয় দেয়। পোয়েতা এন নুয়েবা ইয়র্ক কাব্যগ্রন্থের মূলত মুক্ত, অদম্য পঙ্ক্তিমালা কবির ব্যক্তিগত মনস্তাপ আর বিশৃংখল শহরের চিৎকার চেঁচামেচির কাব্যিক রক্তে রঞ্জিত। এ প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ করা যায় শিশুদের জন্য লেখা লাবণ্যমাখা, কোমল সুরের কান্সিয়োনেস নামের ছড়া-গান কিংবা পোয়েতা এন নুয়েবা ইয়র্ক এবং ইয়ান্তো পারা ইগনাসিয়ো সাঞ্চেস মেহিয়া শীর্ষক কবিতার সান্ত¡নাহীন মনস্তাপের কথা। হাসি আর কান্না, বিশেষ করে কান্না, লোরকার কবিতার শরীর জুড়ে বর্তমান। লোরকা মূলত শোকগাথামূলক কবিতার কবি। হাসি আর কান্না তাঁর নাটকের দুই খুঁটি। কবিতা, হাসি আর কান্না তাঁর নাটকীয় সৃষ্টিশীলতার উপাদান। তাঁর রূপকল্প বিমুগ্ধপ্রখর বুদ্ধিমত্তার এক অভিনব, মৌলিক রূপ। তাঁর অন্তর্দৃষ্টি বাস্তবিক ও সমসাময়িক যা তার আন্দালুসীয় উৎস ও বিচিত্রমুখী জীবনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। তিনি ভীষণভাবে একজন গীতধর্মী কবি। গীতিকবিতা, কাব্যগাথা এবং নাটক মিলিয়ে লোরকার যে রচনাজগৎ সেখানে পাঠক ঊঁকি দিতে না দিতেই অনুভব করেন এক অদ্ভুত আবহে ক্রমশ তিনি মগ্ন হচ্ছেন। লোকপ্রিয় দৃশ্যাবলি এবং আপাত সাধারণ মনুষ্য পরিবেশের এক জগৎ, খুব সহজেই যেখানে সবাইকে চেনা যায় কিন্তু আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় কালো মেঘে আচ্ছন্ন সে আবহের আকাশ। অশুভ পাখির মত সে আকাশ চিরে চলে যায় কবিতার এক ঝাঁক রূপক। যেমন : গ্রীষ্ম ‘বপন করে বাঘ আর দাবানলের গুজব’। ছায়াচ্ছন্ন মাছের মতো অদ্ভুতভাবে ফোটে ভোরের প্রথম আলো: “শ্বেতশুভ্র তুষারের বিশাল সব তারা / ছায়ার মাছের সাথে এসো / ভোরের আঙিনার আলোয়।” বাতাস যেন “তপ্ত লাল তলোয়ার নিয়ে” কুমারীর পেছনে তাড়া করা এক প্রকা- মানুষ। লোরকার এসব রূপকের কোনো অলঙ্কারিক ব্যবহার নেই; তারা কেবল একটি অর্থের বিস্তার। পৃথিবীর অস্বাভাবিকতা ও রহস্যের ঘোষক এসব রূপক, ভবিতব্যতার আজ্ঞাপত্র বহন করে তারা। প্রখরভাবে আলোকিত এবং একই সঙ্গে হেঁয়ালিভরা এসব মৃত্যুর আভাস। লোরকার সমগ্র রচনাকর্মের শরীর জুড়েই মৃত্যুর ছায়া। কখনো কখনো এমনকি অপ্রত্যাশিত নাটকীয়তায় উপস্থিত হয় মৃত্যু। এক কবিতায় সরাইখানার বর্ণনা দিতে গিয়ে লোরকা লেখেন: “মৃত্যু আসে আর যায় / যায় আর আসে।” শব্দের সামান্য ওলট-পালটে একেবারে সাদামাটা একটি ধারণার পুনরাবৃত্তিতে যেন মৃত্যু ব্যাপারটির ভবিতব্যতা মূর্ত হয়ে ওঠে। এর অনিবার্যতা বোঝাতেই যেন মৃত্যুর এই অবিরাম আসা যাওয়া, ঠিক সরাইখানার সুনির্দিষ্ট স্থানে নয়; বরং মানুষের জীবনে, কবির রচনায়। তাঁর সৃষ্ট কাব্যগাথা বা নাটকের প্রায় সমস্ত চরিত্রেরই গন্তব্য মৃত্যু। তাঁর বিখ্যাত রোমান্সে সোনামবুলো কবিতার প্রেমিকযুগল- ঘোড়সওয়ার এবং তার জন্য অপেক্ষমাণ সবুজ টুপি পরিহিতা সবুজ শরীরের জিপসি মেয়ে পরস্পরের সঙ্গে দেখা করার অভিপ্রায়ে ব্যাকুল। জিপসি মেয়ে তার ঘরে অপেক্ষমাণ। কিন্তু এই অদ্ভুত মেয়ে এবং তার প্রেমিকের প্রত্যাশিত পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাত আর হয় না। শেষ পর্যন্ত ঘোড়সওয়ার প্রেমিকটি তার প্রেমিকার বাড়ির দোরগোড়ায় উপস্থিত হয় ঠিকই, কিন্তু সে তখন মৃত্যুপথযাত্রী, ছোরার আঘাতে বুক চিরে ছোটা রক্তের ফিনকিতে রঞ্জিত তার সারা শরীর। আর প্রেমিকা ঢলে পড়েছে মৃত্যুর কোলে, জলে ভাসমান তার সবুজ শরীর, চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত। প্রেমিকযুগলের মিলন হলো শেষ অবধি, কিন্তু প্রেমে নয়, মৃত্যুতে তারা দুজন দুজনাকে খুঁজে পেল।

(আগামী সংখ্যায় পড়ুন)

বৃহস্পতিবার, ০৬ জুন ২০২৪ , ২৬ জৈষ্ঠ্য ১৪৩১ ২৭ জিলক্বদ ১৪৪৫

লোরকার খোঁজে গ্রানাদায়

রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী

image

মে মাসের এক রোদেলা দুপুরে আল হাম্ব্রা-র র্তোরে দে লা বেলা-র (নজর মিনার) চূড়ায় লোরকার সঙ্গে দেখা। ঐ চূড়ায় আমি তখন বসে বসে দুচোখ জুড়িয়ে গ্রানাদার সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। কে যেন আমাকে ডাক দিতেই পাশ ফিরে দেখি সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ফেদেরিকো মানে লোরকা; পরনে সবুজ ডোরাকাটা ফুলহাতা শার্ট, তার সঙ্গে কালো রঙের ঢিলেঢালা প্যান্টালুন। ব্যাকব্রাশ করা মাথাভর্তি এক রাশ কালো চুলের সামনে প্রশস্ত কপাল, যেখানে জমে রয়েছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সব মিলিয়ে মাঝারি উচ্চতার এক সুকান্ত স্প্যানিশ যুবা। আর সব কিছু ছাপিয়ে দৃষ্টি কেড়ে নেয় তাঁর উজ্জ্বল-উচ্ছল স্বাপ্নিক চোখজোড়া। “ওলা! কোমো এস্তাস?” বলে শুরু হয় আলাপের পর্ব। কবির চোখ দিয়ে নতুন করে আমি গ্রানাদার সৌন্দর্য অবলোকনে মগ্ন হই। আমাকে এক এক করে সব বুঝিয়ে দিতে থাকেন লোরকা। চোখের সামনে বেগা বা সবুজ সমতল গ্রামাঞ্চল, এর আলোকিত জলপাইকুঞ্জ এবং এর স্বচ্ছ প্রবহমান জলস্রোত। আকাশের নীল এসে সবুজ সমতলের সীমান্তে মিশেছে। নদীর ধারের পপলার অরণ্য যেন হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকে। সব কিছুতেই এক কাব্যময়তা, স্থানের চমৎকারিত্ব, রঙের আভায় উদ্ভাসিত চারদিক। বেগা বা ঊর্বর সমতলভূমির ভেতর দিয়ে তরতর করে বয়ে যায় হেনিল নামের নদী। নিকটবর্তী সুউচ্চ পর্বত সির্য়েরা নেবাদা-র পায়ের কাছে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকে হেনিল নদী তার শরীর বাঁকিয়ে। উপত্যকার মাঝে এই ঊর্বর সমতলভূমি বা বেগা-র বিস্তার। পাহাড় দিয়ে ঘেরা উপত্যকার ক্যানভাস জুড়ে জলের ছোটাছুটি আর চাষের জমির চিত্র। ঋজু পপলার এবং কমলালেবুর বাগানের ঘন ল্যান্ডস্কেপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য আধা-শহর আর গ্রাম। গ্রানাদা অভিমুখী সকল পথ এসে মিশেছে এই বেগায়। পশ্চিমে, সেবিইয়া আর কোর্দোবা থেকে আসা পথের ধারে ফুয়েন্তে বাকেরোস নামের ছোট্ট একটি গ্রাম, যে গ্রামে জন্মেছিলেন লোরকা। “তে ইনবিতো আ মি কাসা!” বাড়িতে যাওয়ার দাওয়াত দিয়ে সেই যে উধাও হলেন লোরকা আজও কেবলই খুুঁজে বেড়াচ্ছি তাঁকে।

লোরকার নিমন্ত্রণে ৫ই জুন সকালে আলসিনো গ্রায়েল্স্ কোম্পানির বাসে চেপে গ্রানাদা শহর ছাড়িয়ে ১৮ কিঃমিঃ দূরের ফুয়েন্তে বাকেরোস গ্রামে গিয়ে পৌঁছলাম। দিনটি ছিল লোরকার জন্মদিন। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের ৫ই জুন ফেদেরিকো দেল সাগ্রাদো কোরাসোন দে হেসুস্ গার্সিয়া লোরকা জন্মেছিলেন এই গ্রামেই। জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাবার জন্য বহু তালাশ করেও কিন্তু লোরকাকে কোথাও পাওয়া গেল না, যদিও সবাই বলছে যে তিনি আছেন কোথাও। স্কুল শিক্ষয়িত্রী বিসেন্তে লোরকার (কবির বোন) দেখা পেলাম। তিনি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাঁদের বাড়ি দেখালেন, আজ যা একটি জাদুঘরে পরিণত, এস্পানিয়োল ভাষায় যার নাম কাসা-মুসেয়ো ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা। কবির এই বোনের কল্যাণেই বাড়িটি পুনরায় তার আগের রূপ ফিরে পেয়েছে, যার মধ্যে একেবারে সেই সময়ের বেশি কিছু আসবাবও বর্তমান। গোলাঘরটি আজ লোরকার স্মৃতির প্রতি নিবেদিত প্রদর্শনী কক্ষ এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়, আমার মতো হাজারো হাজার জন যা দেখার জন্য সারা বছর ভিড় জমায় গ্রানাদার বেগা-র ছোট্ট এই গ্রামে।

এই গ্রামেই লোরকা প্রথম স্বপ্ন দেখেছিলেন সুদূরের। এই মাটিতেই একদিন তিনি ফুল হয়ে ফুটেছিলেন। এর পথঘাট, মানুষ, লোকাচার, কবিতা, এর শুভ-অশুভ সব কিছুতে ভর দিয়ে লোরকার বেড়ে ওঠা। আশপাশের পপলার গাছের হাসি আর গান, পাখির ডাক, ফলকুড়ানো, খরা-গ্রীষ্মের দিন- সব কিছুতেই জড়িয়ে আছে লোরকার নাম। কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা সড়কের ৪ নং বাড়ির উঠোনের কুয়োর আজও বহমান জলের ধারা লোরকার গান শোনায়, লোরকার ঘরের ব্যালকনি গলিয়ে ঢোকা রাতের আকাশের চাঁদ কানের কাছে এসে বলে “বিয়েনবেনিদো, আমিগো” (তোমায় স্বাগতম, হে বন্ধু)।

লোরকার বাবা ফেদেরিকো গার্সিয়া রোদ্রিগেস ছিলেন অবস্থাপন্ন কৃষক, চিনি উৎপাদন করে সচ্ছলতার মুখ দেখেছিলেন তিনি। আর মা, বিসেন্তে লোরকা রোমেরো (গার্সিয়া রোদ্রিগেসের দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রী) ছিলেন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষয়িত্রী। লোরকার জীবনের প্রথম ১১টি বছর কৃষিনির্ভর এই ফুয়েন্তে বাকেরোস গ্রামেই কাটে। তাঁর পুরো বাল্যকাল জুড়ে কেবলই গ্রাম। গ্রামের সাধারণ মানুষের সঙ্গে এক গভীর বন্ধনে জড়িয়ে ছিল তাঁর হৃদয়। দেখা আর শোনার এক অনন্যসাধারণ জগৎ যেন সে গ্রাম: ক্ষেতে কাজে ব্যস্ত কৃষক, জিপসিদের পাড়া, রাখাল, ফসলের জমি, আকাশ, একাকিত্ব। সংক্ষেপে বলতে হয়: সারল্য। লোরকার কবিতার উৎস খুঁজতে গিয়ে আমি গ্রানাদার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি- ঊর্বর সবুজ সমতলভূমি বেগা আর র্দারো-হেনিল নদীর পাড়ের মানুষ, ক্ষেত-ফসলের জমিতে কাজ করা মানুষ- কিন্তু সকলেই তাঁর কবিতার কথা বলতে গিয়ে কেবলই তার মৃত্যু প্রসঙ্গে এসে যান, আজ থেকে বাষট্টি বছর আগে ঘটে যাওয়া সে মর্মান্তিক কাহিনি কে-ই বা ভুলতে পারে! গ্রানাদা শহরের নিকটবর্তী বিসনার গ্রামে আলফাকার পার্কের ছোট্ট এক সঙ্কীর্ণ উপত্যকায় একনায়ক জেনারেল ফ্রাঙ্কোর ন্যাশনালিস্ট সৈন্যবাহিনীর হাতে কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার করুণ মৃত্যু ঘটে স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধকালে, ১৯৩৬ সালের ১৮ই আগস্ট। কবির মৃতদেহ খুঁড়ে পাওয়া যায়নি আর। এখনো চলছে সে-খোঁজ।

আমি আমার ব্যালকনি বন্ধ করে রেখেছি

কারণ কান্না শুনতে চাই না

তবু ধূসর দেয়ালের পেছন থেকে

কান্না ছাড়া কিছুই যে শোনা যায় না।

গুটিকয়েক দেবদূতই গান গায়,

গুটিকয়েক কুকুরই ঘেউঘেউ করে,

আমার করতলে হাজারটা ভায়োলিন জায়গা করে নেয়।

গ্রানাদার অবস্থান এস্পানিয়ার স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল আন্দালুসিয়ায়। আন্দালুসিয়া পুরোটাই যেন এক প্রতœতাত্ত্বিক স্থান, এর স্তরে স্তরে বিভিন্ন সংস্কৃতি আর সভ্যতা এসে মিশেছে। লোরকা সেটা জানতেন, বিমুগ্ধ বিস্ময়ে এর সৌন্দর্যকে অবলোকন করতেন। এস্পানিয়ায় ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতির শেষ ঘাঁটি গ্রানাদা শহরের সামান্য কয়েক মাইলের মধ্যেই ছিল তাঁর আবাস। ধ্যানমগ্ন মানুষ গ্রানাদায় আসে একটু একা হতে: মধুর গুঞ্জন, পবিত্র মসজিদের ছায়া আর নাইটিঙ্গেলের গানের সুরে মৃদুময় হাওয়ায় গা ভাসিয়ে প্রাচীন

পাহাড়ের কোল ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে দেখা যায় কাছেই জাফরান আর ঘন ধূসর গোলাপি চোষ কাগজের বহ্ন্যুৎসবে মাতোয়ারা আল হাম্ব্রার দেয়ালপ্রাচীর। একা থাকা, একা হয়ে গিয়ে চমৎকার সুন্দর সব কণ্ঠস্বরের কাকলিতে ভরপুর পরিবেশে ধ্যানস্থ হওয়া, গভীর কোনো ধ্যান। কিন্তু, মুসলিমদেরকে হটিয়ে দিয়ে ১৪৯২ সালে গ্রানাদা দখলের পরপরই ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠে ক্যাথলিক খ্রিস্টান এস্পানিয়োল শাসকগোষ্ঠী। আল হাম্ব্রার নাসরিদ প্রাসাদের একাংশ ভেঙে নির্মিত রাজা পঞ্চম কার্লোসের প্রাসাদটি সম্ভবত গ্রানাদার এই দ্বন্দ্বযুদ্ধের জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত।

“গ্রানাদা রক্ত ছাড়া আর কি-ই বা,

মহিমান্বিত স্বর্গের রক্ত,

আহত মাটির রক্ত,

জনস্রোতের সুচে বিদ্ধ।

উষর পাহাড়ের ছিলকা মারা

বাতাসের রক্ত।

গ্রানাদা আমাদের শিরা-ধমনি বাহিত রক্তের

প্রাগৈতিহাসিক বিবরণ।

তিক্ত, কঠিন ফোঁটায়

আটকে পড়া রক্তের ইতিউতি,

হৃদয় আর করোটির

আবছা রূপ।”

গ্রানাদা শহরের অলিগলি, পাহাড়ি পথে হাঁটতে গেলে শোনা যায় ফোয়ারা, পাহাড়ি ঝোরাসহ বিচিত্র উৎসের জলস্রোতের মৃদু ঝঙ্কার। জীবনের পথে হাঁটতে গিয়ে ক্লান্ত পথিকের মনপ্রাণ জলের সে ঝঙ্কারে দুদ- বিশ্রামের সুযোগ পায়। আমাদের জীবনতৃষ্ণা মেটাতে সে জলের কী নিরন্তর ছোটাছুটি!

“শীতল ঝর্ণার ধারে বসে দুদ- বিশ্রাম নেয় আমার হৃদয়।

(তোমার জালে আঁজলা ভরে নাও,

বিস্মৃতির মাকড়সা।)

ঝর্ণার জল তাকে তার গান শুনিয়েছিল।

(তোমার জালে আঁজলা ভরে নাও,

বিস্মৃতির মাকড়সা।)

আমার জাগরিত হৃদয় তার ভালোবাসার গান শুনিয়েছিল।

(নিস্তব্ধতার মাকড়সা,

তোমার রহস্যের জাল বিছাও।)

ঝর্ণার জল বিষণœভাবে শুনেছিল।

(নিস্তব্ধতার মাকড়সা,

তোমার রহস্যের জাল বিছাও।)

শীতল ঝর্ণায় আমার হৃদয় হোঁচট খায়।

(শাদা হাত, দূরে,

জলকে থামিয়ে রাখে।)

আনন্দচিত্তে জল তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

(শাদা হাত, দূরে

জলে কিছুই নেই।)”

ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা এস্পানিয়োল সাহিত্যের সবচেয়ে জটিল এবং মৌলিক কবিদের একজন। এস্পানিয়োল সাহিত্যের ইতিহাসে লোরকা এক পৌরাণিক চরিত্রের নাম। একটা অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, আধুনিক এস্পানিয়োল সাহিত্যের পটভূমিতে লোরকার অবস্থান একেবারেই আলাদা এবং স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত। ১৯২৭ প্রজন্মের কবিদের গোষ্ঠীভুক্ত হয়েও তিনি তাঁর আপন মহিমায় ভাস্বর। সমসাময়িক বা পরবর্তী প্রজন্মের কবিদের মধ্যে লোরকার কোনো প্রভাব লক্ষ্য করা যায় না। এস্পানিয়োল সাহিত্যের ঐতিহ্য এবং আঁভা-গার্দ ধারার সংমিশ্রণে তিনি একাকি এক সংশ্লেষণী কাব্য আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন যা সমসাময়িক সাহিত্য-সংস্কৃতির আলোকে এক কথায় অতুলনীয়। বলা হয়ে থাকে যে, সাহিত্য বিষয়ক খুব একটা পড়াশোনা লোরকার ছিল না, কিন্তু তার সাহিত্যকর্ম পাঠ করতে গিয়ে এস্পানিয়োল সাহিত্যের ঐতিহ্যগত আর বিশ্বসাহিত্যের কিছু উল্লেখযোগ্য প্রাসঙ্গিক উত্থাপন, পরোক্ষোল্লেখ খেয়াল করলে এ কথা মেনে নিতে কষ্ট হয়। যেমন রোমান্সেরো হিতানো বা ‘জিপসি ব্যালাড’ কবিতা পড়তে গিয়ে এস্পানিয়োল সাহিত্যের মধ্যযুগীয় ক্ল্যাসিক কানতার দে মিয়ো সিদ্-এর শ্লোক মনে পড়ে। এ যেন এস্পানিয়োল সাহিত্যিক ঐতিহ্যের সঙ্গে লোরকার সংলাপ স্থাপন। প্রহেলিকাময় এক বিশ্বের সঙ্গে আদি প্রাকৃতিক ধর্মীয় বিষয়বস্তু এবং মৌলিক আদর্শের সম্পর্ক স্থাপন: যৌবনের শক্তি, ত্যাগ, ঊর্বরতা, জীবন-মৃত্যুর সংযোগ আর তার সঙ্গে একইভাবে চাঁদ, ষাড়, রক্ত এবং ছুরি। লোরকার ঝোঁক ধর্মাচরণের প্রতি, অতীতের পৌরাণিক দর্শনের কাব্যিক গঠনের প্রতি। তাঁর জিপসিরা দূর বিশ্বের কোনো অদ্ভুত জীব নয়, প্রাচীন পুরাণের ধারক ও বাহক তারা।

জিপসির আহ্বান

দূর এক দেশ

উঁচু উঁচু কেল্লা

আর রহস্যময় মানুষ।

চিরন্তন, স্থায়ী মানুষের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কবির বিশ্বজাগতিক পরিব্যাপ্তিরই পরিচায়ক। দুনিয়াময় তাঁর যতটা পরিচিতি তা রীতিমত ঈর্ষণীয়। গভীর ঐতিহ্যাশ্রয়ী লোরকার কবিতা আঁভা-গার্দ আন্দোলনের সমস্ত নতুনত্বকে বরণ করে নেয় সহজেই। এক নতুন কাব্যিক ফরংপড়ঁৎংব সৃষ্টিতে লোরকার বাহাদুরি অসামান্য। দুঃসাহসী রূপক-এর চর্চা, চিরন্তন মৌলিক ভাবপ্রকাশক কাব্যসূত্র সৃষ্টিতে বিস্তৃত প্রতীকের ব্যবহার এবং অন্তহীন প্রাণবন্ততা পরোক্ষে জীবনের জয়গানই গায়। লোরকা আমাদের কাছে উপস্থিত হন সকল মানুষের যাবতীয় আদিম তাড়না নিয়ে। পার্থিব বিষয়বস্তুর প্রতি এক দুর্মর আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় তাঁর কবিতায়।

“সবুজ তোমায় ভালোবাসি, সবুজ।”

আধুনিক শহরের বিষয়বস্তুকে এতটা তীক্ষèতা নিয়ে যেমনটা মোকাবিলা করেছেন লোরকা তাঁর পোয়েতা এন নুয়েবা ইয়র্ক (‘পোয়েট ইন নিউইয়র্ক’) কাব্যগ্রন্থে তা এক কথায় অনবদ্য। অস্তিত্ববাদ, যীশুর বাণী সংক্রান্ত খ্রিস্টীয় ধার্মিকতা, সামাজিক এবং এমনকি মার্কসীয় তত্ত্ব লোরকার কাব্যিক ফরংপড়ঁৎংব-এ ঘুরেফিরে আসে, যা সর্বদাই শোষিতের পক্ষে কথা বলে। লোরকা তাই আমাদের জিপসির গান শোনান। শুধু তাই-ই নয়, উপরন্তু নিগ্রো, ইহুদি, সমকামী, বঞ্চিত খেটে খাওয়া মানুষ তথা সমাজের সকল অপদস্থ শ্রেণীর মানুষের কথা শোনান লোরকা। কিন্তু তাঁর রচনাকে ঠিক রাজনৈতিক সমাজতন্ত্র বলা যাবে না, বরং একে সমবেদনশীল সমাজতন্ত্র বলা যেতে পারে। তাঁর বৈশ্বিক ভ্রাতৃত্ববোধ মহাজাগতিকও বটে। ১৯৩০ সালে নিউইয়র্ক নগরী ভ্রমণকালে লেখা পোয়েতা এন নুয়েবা ইয়র্ক-এর কবিতাগুলো তখনকার সমসাময়িক বাস্তবতার নিরিখে রচিত যেখানে অতিমানবীয় স্থাপত্য এবং উন্মত্ত ছন্দ, জ্যামিতি এবং যন্ত্রণাক্লিষ্ট জীবনের ছবি মূর্ত হয়।

“বহু ভ্রƒণের নিচে

এক বিন্দু হাঁসের রক্ত।”

এই মহাজাগতিকতাবোধ, সমাজতান্ত্রিক অবলম্বন, এ কেবল তাঁর একার নয়, এর শিকড় আরও অনেক অতীতে প্রোথিত। লোরকার রচনাকর্মের গাঠনিক বৈচিত্র্য দেখে মুগ্ধ বিস্ময়ে অবাক হতে হয়। একাধারে তিনি ছিলেন কবি, নাট্যকার, সুবক্তা; ছবি আঁকা ছাড়াও চমৎকার পিয়োনো বাজাতেন লোরকা। এক যাদুকরী ঐশ্বরিক চরিত্র ছিলেন তিনি। কবি হিসেবে তাঁর অন্তরঙ্গ কাব্যিকতা এবং তীব্র যন্ত্রণার প্রকাশ দেখি প্রাচ্যকাব্যস্নাত দিবান দেল তামারিত-এর গজলগুলিতে কিংবা সোনেতোস দেল আমোর ওস্কুরো-রকবিতায় অথবা মহাকাব্যিক ‘জিপসি ব্যালাড’-এ। বিশুদ্ধ আন্দালুসিয়ো এক বিশ্বের গাঠনিক চমৎকারিত্ব ও প্রাচীন কাস্তিলিয়ো রোমান্সের রূপরেখায় ‘জিপসি ব্যালাড’ তার কাব্যিকতার পরিচয় দেয়। পোয়েতা এন নুয়েবা ইয়র্ক কাব্যগ্রন্থের মূলত মুক্ত, অদম্য পঙ্ক্তিমালা কবির ব্যক্তিগত মনস্তাপ আর বিশৃংখল শহরের চিৎকার চেঁচামেচির কাব্যিক রক্তে রঞ্জিত। এ প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ করা যায় শিশুদের জন্য লেখা লাবণ্যমাখা, কোমল সুরের কান্সিয়োনেস নামের ছড়া-গান কিংবা পোয়েতা এন নুয়েবা ইয়র্ক এবং ইয়ান্তো পারা ইগনাসিয়ো সাঞ্চেস মেহিয়া শীর্ষক কবিতার সান্ত¡নাহীন মনস্তাপের কথা। হাসি আর কান্না, বিশেষ করে কান্না, লোরকার কবিতার শরীর জুড়ে বর্তমান। লোরকা মূলত শোকগাথামূলক কবিতার কবি। হাসি আর কান্না তাঁর নাটকের দুই খুঁটি। কবিতা, হাসি আর কান্না তাঁর নাটকীয় সৃষ্টিশীলতার উপাদান। তাঁর রূপকল্প বিমুগ্ধপ্রখর বুদ্ধিমত্তার এক অভিনব, মৌলিক রূপ। তাঁর অন্তর্দৃষ্টি বাস্তবিক ও সমসাময়িক যা তার আন্দালুসীয় উৎস ও বিচিত্রমুখী জীবনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। তিনি ভীষণভাবে একজন গীতধর্মী কবি। গীতিকবিতা, কাব্যগাথা এবং নাটক মিলিয়ে লোরকার যে রচনাজগৎ সেখানে পাঠক ঊঁকি দিতে না দিতেই অনুভব করেন এক অদ্ভুত আবহে ক্রমশ তিনি মগ্ন হচ্ছেন। লোকপ্রিয় দৃশ্যাবলি এবং আপাত সাধারণ মনুষ্য পরিবেশের এক জগৎ, খুব সহজেই যেখানে সবাইকে চেনা যায় কিন্তু আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় কালো মেঘে আচ্ছন্ন সে আবহের আকাশ। অশুভ পাখির মত সে আকাশ চিরে চলে যায় কবিতার এক ঝাঁক রূপক। যেমন : গ্রীষ্ম ‘বপন করে বাঘ আর দাবানলের গুজব’। ছায়াচ্ছন্ন মাছের মতো অদ্ভুতভাবে ফোটে ভোরের প্রথম আলো: “শ্বেতশুভ্র তুষারের বিশাল সব তারা / ছায়ার মাছের সাথে এসো / ভোরের আঙিনার আলোয়।” বাতাস যেন “তপ্ত লাল তলোয়ার নিয়ে” কুমারীর পেছনে তাড়া করা এক প্রকা- মানুষ। লোরকার এসব রূপকের কোনো অলঙ্কারিক ব্যবহার নেই; তারা কেবল একটি অর্থের বিস্তার। পৃথিবীর অস্বাভাবিকতা ও রহস্যের ঘোষক এসব রূপক, ভবিতব্যতার আজ্ঞাপত্র বহন করে তারা। প্রখরভাবে আলোকিত এবং একই সঙ্গে হেঁয়ালিভরা এসব মৃত্যুর আভাস। লোরকার সমগ্র রচনাকর্মের শরীর জুড়েই মৃত্যুর ছায়া। কখনো কখনো এমনকি অপ্রত্যাশিত নাটকীয়তায় উপস্থিত হয় মৃত্যু। এক কবিতায় সরাইখানার বর্ণনা দিতে গিয়ে লোরকা লেখেন: “মৃত্যু আসে আর যায় / যায় আর আসে।” শব্দের সামান্য ওলট-পালটে একেবারে সাদামাটা একটি ধারণার পুনরাবৃত্তিতে যেন মৃত্যু ব্যাপারটির ভবিতব্যতা মূর্ত হয়ে ওঠে। এর অনিবার্যতা বোঝাতেই যেন মৃত্যুর এই অবিরাম আসা যাওয়া, ঠিক সরাইখানার সুনির্দিষ্ট স্থানে নয়; বরং মানুষের জীবনে, কবির রচনায়। তাঁর সৃষ্ট কাব্যগাথা বা নাটকের প্রায় সমস্ত চরিত্রেরই গন্তব্য মৃত্যু। তাঁর বিখ্যাত রোমান্সে সোনামবুলো কবিতার প্রেমিকযুগল- ঘোড়সওয়ার এবং তার জন্য অপেক্ষমাণ সবুজ টুপি পরিহিতা সবুজ শরীরের জিপসি মেয়ে পরস্পরের সঙ্গে দেখা করার অভিপ্রায়ে ব্যাকুল। জিপসি মেয়ে তার ঘরে অপেক্ষমাণ। কিন্তু এই অদ্ভুত মেয়ে এবং তার প্রেমিকের প্রত্যাশিত পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাত আর হয় না। শেষ পর্যন্ত ঘোড়সওয়ার প্রেমিকটি তার প্রেমিকার বাড়ির দোরগোড়ায় উপস্থিত হয় ঠিকই, কিন্তু সে তখন মৃত্যুপথযাত্রী, ছোরার আঘাতে বুক চিরে ছোটা রক্তের ফিনকিতে রঞ্জিত তার সারা শরীর। আর প্রেমিকা ঢলে পড়েছে মৃত্যুর কোলে, জলে ভাসমান তার সবুজ শরীর, চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত। প্রেমিকযুগলের মিলন হলো শেষ অবধি, কিন্তু প্রেমে নয়, মৃত্যুতে তারা দুজন দুজনাকে খুঁজে পেল।

(আগামী সংখ্যায় পড়ুন)