লোরকার কবিতা, কাব্যনাট্য

সরকার মাসুদ

দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানের বিশটি বছর ইউরোপের শিল্প-সাহিত্যের জন্য অত্যন্ত ফলবান একটি সময়। এই স্বল্পপরিসরের মধ্যে প্রকাশিত হয় এলিয়টের ভুবনকাঁপানো দীর্ঘ কবিতা। The Waste Land(১৯২২), বের্টল্ট ব্রেখটের সমাজভাবনাদীপিত উচ্চাঙ্গের নাটকগুলো, চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমা, ইয়েটসের কাব্যগ্রন্থ The wild Swans at coole(১৯১৯), এজরা পাউন্ডের মহাকাব্যিক রচনা Cantos(১৯২৫) জেসম জয়েসের হতবাক করে দেয়া বিশাল উপন্যাস Ulysses (১৯২২) আলডুস হাক্সলির ফ্যান্টাসিময় উপন্যাস Brave New World(১৯৩২) এবং আরো অসংখ্য উল্লেখযোগ্য কাজ। স্পেনের বিশ্বজয়ী কবি ও নাট্যজন ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার উত্থান, বিকাশ এবং অন্তর্ধান ঘটে এই সময় পরিসরের ভেতরেই।

লোরকার বিপুল খ্যাতির পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে যেমন লোককথার উপাদান, জিপসি জীবনাচার, স্বভাব কবির বাকভঙ্গি, তেমনি কাজ করেছে তাঁর মর্মন্তুদ অকাল মৃত্যুর ঘটনাটিও। মৃত্যুচেতনা লোরকার কবিতার পুনরাবৃত্ত বিষয়গুলোর মধ্যে একটি। মৃত্যুর প্রসঙ্গ তার কাব্যে এতবার এসেছে যে, মনে হয় তিনি নিজের মৃত্যু নিজেই দেখতে পেতেন। বোধ হয় তার মন বলতো, আমি সুদীর্ঘকাল পৃথিবীতে থাকব না। ‘বিদায়’ কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘যদি আমি মরে যাই, জানালাটা খোলা রেখো।’ ‘ঘোড়সওয়ারের গান’ কবিতায় লিখেছেন ‘মৃত্যু আমাকে চোখে চোখে রাখছে/ কর্ডোভার মিনারগুলো থেকে।’ এবার আমি ‘ইগনাসিও স্যানেচেজ মেজিয়াস-এর জন্য বিষাদ গীতি’ থেকে উদ্ধৃত করব কয়েকটি পঙ্ক্তি: ‘মৃত্যু ক্ষতের ভেতর ডিম পাড়তে লাগল/বিকেল পাঁচটায়।/ বিকেল পাঁচটায়/ ঠিক বিখেল পাঁচটায়।/ চাকায় চাপানো একটি কফিন/ হলো তার শয্যা/ বিকেল পাঁচটায়/ হাড়ভাঙার শব্দ আর বাঁশির ধ্বনি বেজে উঠল তার কানে/বিকেল পাঁচটায়। (অনুবাদ: অমিতাভ দাশগুপ্ত)

লোরকা বড় মাপের স্বভাব কবি যার মধ্যে এসে মিশে ছিল লোক কবি ও আধুনিক শিল্পীর নানা বৈশিষ্ট্য। আরব সভ্যতার সুবাদে গ্রানাডার চারপাশে ছিল আরবি কবিতার পরিবেশ। গীতপ্রিয় জিপসিদের ভ্রাম্যমাণ জীবন ও নানান বিচিত্র কর্মকা- যুক্ত হয়েছিল তার সঙ্গে। লোরকা আন্দালুসিয়ার সাংস্কৃতিক বহুমুখিতা অনুধাবনের গরজে লোকগীতি সংগ্রহ করেছেন। বিভিন্ন সময়ে ছিলেন জিপসিদের দীর্ঘ সান্নিধ্যে। তার একেবারে প্রথম দিকের কবিতা হচ্ছে সহজসরল, অদীক্ষিত কবির রচনা। কিছুকাল পরই তার লেখায় এসে যায় লোককথা ও লোকগীতির উপাদান। আরবি কাসিদা এবং দিওয়ান-এর আঙ্গিকও প্রযুক্ত হয় কোনো কোনো কবিতায়। কিন্তু সুরবিয়্যালিস্ট কবিকল্পনার নিজত্বম-িত প্রবল উপস্থিতি তাঁর কবিতাকে আন্তর্জাতিক পরিম-লে সুপরিচিত ও প্রশস্ত করে তোলে।

১৯২৯ সালে আমেরিকা ভ্রমণের আগ পর্যন্ত রচিত লোরকার কবিতা একান্তভাবেই স্পেনের গ্রামসংস্কৃতিচিহ্নিত। মার্কিন দেশে এক বছরের ভ্রমণ তাঁর কাব্যে বিরাট পরিবর্তন এনেছিল। পরিবর্তিত ভাব ও ভাষায় দীপ্ত সেই সব কবিতা ‘নিউইয়র্কে কবি’ নামে প্রকাশিত হয় লেখকের মৃত্যুর পর। এই বইয়ে নিউইয়র্ক সিটি চিত্রিত হয়েছে ‘অতিমানবিক স্থাপত্য, জটিল জ্যামিতি, অপ্রেমের এবং যন্ত্রণার শহর’ রূপে। কবির এ যাবৎকালের কবিতায় আন্দালুসিয়ার গ্রাম-প্রকৃতির যে প্রাণবন্ত ছবি আমরা দেখতে পাই, এখানে তার সুস্পষ্ট ব্যতিক্রম লক্ষণীয়। লোরকার মার্কিনি কবিতাগুলো বরং তুলে ধরেছে ইট-কাঠ-পেরেক নির্মিত মর্মবেদনার এক নতুন পরাবাস্তব পৃথিবী। এই পৃথিবী স্পেনের জলপাই আর কমলাবাগান, মৃত্যুচিহ্নিত চাঁদ, টিলাভূমি, ম্যাটাডর ও জিপসিদের থেকে বহুদূরে। অসাধারণ লিপি কুশলতার গুণে লেখক এখানে চিত্রিত করেছেন নগরসভ্যতার জৌলুস, অন্তর্বিষ, হিংস্রতা, দ্বন্দ্বময়তা।

দেয়ালগুলো প্রেতনৃত্য করছে সবুজ প্রান্তর জুড়ে। আর আমেরিকা যন্ত্র আর অশ্রুর বন্যায় ডুবন্ত। আমি চাই/ গভীর রাত্রির উদ্দাম বাতাস এসে নিয়ে যাক ফুলগুলো/নিয়ে যাক তোমার সমাধিগাত্রে, উৎকীর্ণ শব্দমালা/নিয়ে যাক সেই কৃষ্ণ বালকের মূর্তি... (কবিতা: ওয়াল্ট হুইটম্যানের প্রতি)

মৃত্যুবোধ লোরকার যেমন কবিতার তেমনি কাব্যনাটকসমূহেরও ভাবনা-দর্শনভূমিটিকে যথেষ্ট আলোকিত ও লক্ষযোগ্য করে তুলেছে। লেখকের কাব্যনাট্যের আলোচনায় প্রবেশের আগে, তাই ‘দুয়েন্দের তত্ত্ব ও প্রয়োগ’ নামের তাঁর বিশ্ববিশ্রুত লেকচারটি সম্বন্ধে দু’কথা বলা প্রাসঙ্গিক মনে করছি। লোরকা এখানে বলেছেন, ‘সব দেশে সব কালে মৃত্যু একটা চূড়ান্ত ঘটনা। মৃত্যু এলে জানালার পর্দা নামিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু স্পেনে তেমন নয়। স্পেনে মৃত্য এলে জানালার পর্দা তুলে দেয়া হয়...। এদেশে একজন মৃত ব্যক্তি মৃত্যুর পর আরো বেশি জীবিত...’ আরেক জায়গায় বলেছেন, ‘দুয়েন্দে ততক্ষণ আসবে না যতক্ষণ পর্যন্ত সে দেখবে না মৃত্যুর ঘনিয়ে আসার সম্ভাবনা।

দুয়েন্দের তত্ত্ব দাঁড়িয়ে আছে বাস্তবের পাটাতনের ওপর কিন্তু এর মধ্যে একটা মরমী ভাব নিহিত আছে। স্পেনের ঐতিহ্যবাহী ‘বুল ফাইট’-এর ভেতর তিনি ফুটে উঠতে দেখেছেন দুয়েন্দেকে। সংগ্রামশীলতার মধ্য দিয়ে যে রক্তাক্ত মৃত্যু হাজির হয় দুয়েন্দে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে ঠিক সেখানেই। ‘তারপর উঁচু স্তম্ভ বেয়ে ওঠে দুই বন্ধু, পেছনে রক্তের দাগ টেনে। পেছনে অশ্রুর দাগ.../ ছাদের ওপর কাঁপে/ছোট ছোট টিনের লণ্ঠন।/সকালের চোখে-মুখে বিঁধে যায়/ এক হাজার কাচের খঞ্জনি।’

এবার কাব্যনাটকের প্রসঙ্গ। নাটকের কাঠামো দাঁড়িয়ে থাকে তার ডায়ালগের ওপর। ডায়ালগ শক্তিমন্ত না হলে সেই নাটক মুখ থুবড়ে পড়বেই। লোরকার কাব্যনাটক আদ্যোপান্ত পড়ার পর আমার মনে হয়েছে, এই কবি কবিতা না লিখে যদি শুধুই কাব্যনাট্য রচনা করে যেতেন, তাহলেও সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে খুব বিশিষ্ট একটি জায়গা তাঁর থাকতো। উত্তরকালে লোরকা যে কাব্যনাটকের দিকে ঝুঁকে পড়বেন, তার পূর্বাবাস আমরা পাই তাঁর ডায়ালগধর্মী কবিতাগুলোর মধ্যে। আমেরিকা থেকে ঘুরে আসার পর কেবল তার কবিতাই বদলে যায়নি, সৃজনইচ্ছাও রীতিমতো বাঁক নিয়েছিল। কেননা এ সময়ই কাব্যনাটক লেখার কাজে প্রবলভাবে লিপ্ত হন তিনি। ১৯২৯-৩০ সালে রচিত হয় ‘যদি পাঁচ বছর কেটে যায়’ শিরোনামের একটি নাটক। এখানে আমরা এক যুবকের জীবনের শেষ পাঁচ মিনিটে তার অবচেতন মনে জেগে-ওঠা ঘটনাসমূহ দেখতে পাই। বিষয়টি পরিবেশিত হয়েছে পরাবাস্তববাদী ভঙ্গিতে। তিন অঙ্কের এই নাটক এক কথায় নিরীক্ষাধর্মী। ঘটনাবলী, পাত্র-পাত্রী সবই নায়কের ভাবনা-কল্পনার সম্প্রসারিত রূপ। সময় বলে কিছু নেই এখানে। সব কিছু ঘটেছে কালের স্বাভাবিক বৃত্তের বাইরে। ফলে একাকার হয়ে গেছে অতীত বর্তমান-ভবিষ্যৎ। ১৯৩২ সালে লোরকা ‘জুতা নির্মাতার আজব স্ত্রী’ নামে একটি কমেডি লিখেছিলেন। নাটকটি স্পেনের লোকজীবন ভিত্তিক এবং জনসংস্কৃতিই এর প্রাণ। নাটকে দেখা যায়, জুতা নির্মাতা মোটামুটি বয়স্ক ব্যক্তি। তার স্ত্রীর বয়স কম। সে প্রাণবন্ত, সদাউচ্ছল। স্ত্রীর সার্বক্ষণিক অভিযোগ আধবুড়ো স্বামীর প্রতি। সেই তরুণী স্ত্রী পরপুরুষের সঙ্গে চুটল আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে স্বামী বেচারা একদিন বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। তারপর স্ত্রীটিকে কেন্দ্র করে লতিয়ে ওঠে পাড়া-প্রতিবেশীদের মুখরোচক কেচ্ছা-কাহিনী। জুতা নির্মাতা একদিন ফিরে আসে। প্রধান উদ্দেশ্য, তার অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রী কেমন জীবন কাটিয়েছে সেই খোঁজখবর নেয়া। কিন্তু কেমন বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করে যে, তার স্ত্রী সবিশ্বাসঘাতকতা করেনি। স্ত্রীও অনুপস্থিতির সূত্রে সচেতন হয়ে উঠেছে স্বামীর গুণাবলী সম্পর্কে। সে উপলব্ধি করে যে, স্বামীর প্রতি তার অভিযোগসমূহ ছিল রীতিমতো অন্যায়। স্বামী-স্ত্রীর মিলনের ভেতর দিয়ে ইতিবাচক সমাপ্তি ঘটে নাটকটির। কমেডি, প্রহসন, ট্র্যাজেডি- ইত্যাকার নানা ধরনের নাটক লিখলেও লোরকার নাট্যখ্যাতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে প্রধানত তিনটি ট্র্যাজেডির অভাবনীয় সাফল্যের দরুন। আন্দালুসিয়ার গ্রামীণ জীবন ভিত্তিক এই ট্রিলজির প্রথমটি হচ্ছে ‘রক্তস্নাত বিবাহ’ (১৯৩৩)। একটি ঐতিহ্যপুষ্ট সমাজ কাঠামোর মধ্যে কামনা প্রেম ঈর্ষা প্রতিশোধস্পৃহা এবং সেই স্পৃহা থেকে নরহত্যা- এই হচ্ছে ‘রক্তস্নাত বিবাহ’র থিম। নাটকের গল্প সংক্ষেপে এমন, মা বিধবা মহিলা। তার স্বামী ও বড় ছেলে প্রতিবেশী ফেলিক্স পরিবারের সঙ্গে দ্বন্দ্বে প্রাণ হারায়। মা এখন তার একমাত্র ছেলের বিয়ে দিতে চাইছে। মা আশা করে, ছেলের বউ তাকে অনেকগুলো নাতি-নাতনি উপহার দেবে। কিন্তু ফেলিক্স পরিবারের সন্তান লিওনার্দোর সঙ্গে ভাবী বধূর ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। যদিও লিওনার্দো বিবাহিত তথাপি তারা দু’জন দু’জনের প্রতি এখনো আসক্ত। মা-ছেলে যখন কনের বাড়িতে যায়, ছেলের মা এটা লক্ষ্য করে যে, আসন্ন বিয়ের ব্যাপারে মেয়েটি একদম উদাসীন। পরে একজন গৃহভৃত্যের মাধ্যমে জানা যায় যে, লিওনার্দো ইতোমধ্যে মেয়েটির সঙ্গে দেখা করে গেছে।

বিয়ের দিন লিওনার্দো কনের বাড়িতে আসে। সে জানায়, সে তাকে আগের মতোই ভালোবাসে। এতে মেয়েটি বিহ্বল হয়ে পড়ে। কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। এক সময় ভাবে, প্রেমিককে ফিরিয়ে দিয়ে নিজের বাগদত্ত পুরুষকেই বিয়ে করবে। আর ভালোবাসবে স্বামীকেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে তার সংকল্পে অটল থাকতে পারে না। বিয়ের দিনই বধূ লিওনার্দোর সঙ্গে পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে বর তার বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে পলাতকদের খোঁজে পথে নামে। মৃত্যু ভিখারিনীর ছদ্মবেশে পলাতকদের পথ দেখিয়ে দেয়। বর ও তার সাথীদেরও নিয়ে যায় বনের ভেতর। অরণ্য পরিবেশে চাঁদের সঙ্গে এক সংলাপে মৃত্যু জানায় যে, অল্প সময়ের মধ্যেই লিওনার্দো ও বর দু’জনেই মারা যাবে। ঘটেও তাই। নাটকের শেষ দৃশ্যে বধূ মায়ের কাছে ফিরে এসে জানায়, তার ছেলে মারা গেলেও মর্যাদা হারায়নি সে। লিওনার্দোও বাঁচতে পারেনি। এবং বধূর সম্মান ও রক্ষিত হয়েছে তার কুমারিত্ব হরণ করতে পারেনি কেউ।

এক বিধবা নারীর বেদনার সঙ্গে যুক্ত হয় আরেক সদ্য বিধবার (লিওনার্দোর স্ত্রীর) মনোকষ্ট। অন্যদিকে আরেকজন স্ত্রী হয়ে ওঠার আগেই অনুভব করে জীবনসঙ্গী হারানোর মর্মযাতনা। তিন নারীর শোকের মাধ্যমে এক ধরনের ঐক্য তৈরি হয়, কেননা সমবেদনায় সিক্ত হয় সকলেই। জীবনের ট্র্যাজিক পরিণতি চূড়ান্ত নিঃসঙ্গ করে তোলো প্রত্যেককেই।

প্রথম অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যের গোড়াতেই আমরা শুনি একটি ঘুমপাড়ানিয়া গান। তার পর দেখতে পাই, লিওনার্দো ঘোড়া ছুটিয়ে যাচ্ছে প্রিয়তমার কাছে। লোরকার এই উপস্থাপনরীতির মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে প্রত্যক্ষ অ্যাকশন। আবার ঘুমপাড়ানিয়া গীতের ভেতর দিয়ে আমরা লোকজীবনের একটা স্নিগ্ধ পরিম-লের স্বাদ পাচ্ছি। মনে পড়ছে বিয়ের উৎসবের সেই অসাধারণ দৃশ্যটি যেখানে গান গেয়ে কনেকে ঘুম থেকে জাগানো হচ্ছে। অতিথিবর্গ এসে পৌঁছেছে। তাদের অনেকেই যোগ দিয়েছে এই সমবেত সঙ্গীতে। এই প্রথা সমাজের স্বীকৃত প্যাটার্ন তুলে ধরছে। অন্যদিকে কনের ব্যক্তিক রুচি-অভিরুচি এবং দেহমনের আকাক্সক্ষা প্রতিভাত হয়েছে স্বপ্নময় চিত্রকল্পের ভেতর দিয়ে। এই দুটি বিষয় নাটককে দিয়েছে কাক্সিক্ষত স্বতঃস্ফূর্ততা এবং গতি।

পরবর্তী বিখ্যাত নাটক ‘ইয়ারমা’ (১৯৩৪)-এরও ভূমি স্পেনের পল্লী জীবন। এটা তিন অঙ্কের ট্র্যাজেডি। ‘রক্তস্নাত বিবাহ’ এবং ‘ইয়ারমা’ দুটিরই উপজীব্য নারী জীবনের ট্র্যাজেডি। পার্থক্য হচ্ছে, প্রথমটি গড়ে উঠেছে ব্যক্তির বিশ্বাস, আকাক্সক্ষা ও সমাজে বিদ্যামান প্রথার দ্বন্দ্ব নিয়ে। ‘ইয়ারমা’র বিষয়বস্তু সমাজ কতৃক ব্যক্তির খ-িতকরণ। এখানে আমরা দেখতে পাই বিরাজমান সমাজব্যবস্থা কীভাবে একজন ব্যক্তির আকাক্সক্ষাকে খর্ব করে, কীভাবে তাকে নিষ্ফলা ও নিষ্প্রাণ মানুষে পরিণত করে।

কেন্দ্রীয় চরিত্র ইয়ারমা মা হতে চায়। কিন্তু তার এই ইচ্ছা পূরণে অক্ষম সে। এক বন্ধ্যা, বিবাহিত জীবনেরও ঘেরাটোপে সে বন্দি। সেজন্য অবশ্য সে নিজে দায়ী নয়, দায়ী তার স্বামীর বীর্যহীনতা এবং নির্মম স্বার্থপরতা। স্বাভাবিকভাবেই সে তার স্বামীকে ভালোবাসতে পারে না। ভিকটর নামের এক মেষপালকের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হয় সে। আবার নৈতিকতার প্রতি আনুগত্যবশত বিবাহবহির্ভূত কারো মাধ্যমে গর্ভবতী হওয়ার কথা ভাবতেও পারে না। অথচ সে মা হতে চায় তীব্রভাবে। নিষ্ফলা ইয়ারমার আর্তির গভীরতা ও তাৎপর্য বোঝা যায় যখন সে বলে- ‘ওহ শৃঙ্খলিত শোণিতের কী যন্ত্রণা/ আমার পিঠে ফুটিয়ে দিচ্ছে বোলতার হুল।/ কিন্তু তোমাকে আসতেই হবে মানিক। আসতেই হবে খোকন আমার/ কারণ জল দেয় লবণ, পৃথিবী দেয় ফল/ আর আমাদের গর্ভে সুরক্ষিত রাখে আমাদের প্রিয় বাচ্চাদের।

ইয়ারমা একটা পর্যায়ে তার দীর্ঘদিনের স্বপ্নপূরণের চেষ্টা হিসেবে এক তীর্থযাত্রায় যোগ দেয়। পাহাড়ের ওপর গাছগাছালিঘেরা সেই তীর্থে রমণীরা আসে সন্তান লাভের আশায়। এখানে তারা নানা ধরনের আচার-অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। সন্তান লাভের জন্য প্রার্থনা করে। এ এক দারুণ আগ্রহসঞ্চারী স্থান। পাঠক ভিন্ন ধরনের প্রথার সঙ্গে পরিচিত হবেন। রমণীরা এখানে মুখোশ পরে থাকে; পুরুষরাও। সারাক্ষণ নাচ চলে। এর ভেতর প্রার্থনাও চলে। যেখানে নাচ হয় তার পাশেই যুবকদের দল নারীসঙ্গ’র অপেক্ষায় থাকে। পুরো ব্যাপারটা বেশ মৃত্তিকা সংলগ্ন এবং মনোগ্রাহী মনে হয়।

দেখা যায়, ইয়ারমার স্বামীও এই তীর্থে হাজির হয়েছে। স্ত্রীকে সে বিশ্বাস করে না। সে বুঝতে পেরেছে এই মেয়ে তাকে ভালোবাসে না। তাই সে বুঝতে চেয়েছে, নাকি তার অন্য কোনো ধান্দা আছে। ঈর্ষায় ও ক্রোধে ফেটে পড়ে সে। স্ত্রীর মুখোমুখি হওয়ামাত্র ক্ষিপ্ত হয়ে বলে, তাদের বাচ্চা-কাচ্চা নেই সেজন্য তার দুঃখ নেই। সে বরং খুশি। সে এও বলে, সন্তান না হওয়ার জন্য তারা কেউ দায়ী নয়।

অন্যদিকে ইয়ারমা একসময় উপলব্ধি করে যে তার মা হওয়ার আর কোনো সম্ভাবনাই নেই। স্বামী এ ব্যাপারে পুরোপুরি অক্ষম ও অনাগ্রহী। তখন তার মন বিষিয়ে ওঠে। বিবাহিত জীবন অর্থহীন মনে হয় তার। ইয়ারমার বিলাপ শুনে ভাববিহ্বল স্বামীটি স্ত্রীর দিকে এগিয়ে যায়। তাকে আলিঙ্গন করে। কিন্তু ইয়ারমার মনজুড়ে তখন টগবগ করছে হতাশা, ঘৃণা ও ক্রোধ। মনের চরম দিশাহারা অবস্থায় মেয়েটি তার স্বামীকে খুন করে বসে।

ট্রিলজির তৃতীয় ট্র্যাজেডি বার্নার্ডা অ্যালবার বাড়ি-তেও পূর্বে উল্লিখিত নাটক দুটির মতো অপ্রাপ্তি, ঈর্ষা, মানস যন্ত্রণা, মৃত্যু (হত্যাকা-) এসব প্রত্যক্ষ করি আমরা। মূল সুর মোটামুটি অক্ষুণœ আছে। কিন্তু স্বপ্নকল্পনা, রূপক বা পরাবাস্তবতা এখানে অনুপস্থিত। স্পেনের গ্রামাঞ্চলের নারীদের নিয়ে রচিত এই নাটক সর্বার্থেই বাস্তববাদী। ফর্ম, ভাষা ও সংলাপ নিয়ে নানারকম নিরীক্ষার পর লোরকা সাদামাটা ধরনের বাস্তববাদী নাটক লিখলেন, এটা বেশ প্রশ্নোদ্দীপক একটা ব্যাপার। হতে পারে লেখক সহজ হতে চেয়েছিলেন। সব অলংকার গা থেকে নামিয়ে শিল্পের নিরাভরণ সুষমা দেখাতে চেয়েছিলেন পাঠককে।

তিন অঙ্কের এই নাটকে অনুভূতিকে ভীষণ মূল্য দেয়া হয়েছে। বার্নার্ডা অ্যালবার পরিবারে আছে অ্যালবা নিজে এবং তার পাঁচ কুমারী মেয়ে। মেয়েদের বয়স বিশ থেকে ঊনচল্লিশের মধ্যে। বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ নেই। মা তার সমাজসম্মত ধ্যান-ধারণার ও মূল্যবোধের নিগড়ে বন্দি। স্পেনে, সেকালে, উঠতি বয়সী মেয়েদের যৌনাকাক্সক্ষা কঠোরভাবে অবদমন করা হতো। আর এটাকেই তারা স্বাভাবিক মনে করতো। এই সমস্যার এক নিখুঁত বাস্তবধর্মী চিত্র অঙ্কিত আছে নাটকটিতে। স্বামী মারা যাওয়ার পর বার্নার্ডা অ্যালবা তার পাঁচ কুমারী কন্যার ওপর ষোলআনা আধিপত্য বিস্তার করে। বিয়ের ক্ষেত্রে মা কঠিন শর্ত আরোপ করে অনুঢ়া মেয়েদের ওপর। তাদের বিয়ে করতে হবে এমন কাউকে যাতে পরিবারের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করা যায়। আর সেই বিয়ে হবে ঐতিহ্য ও প্রথা মেনে, তাদের বাবার মৃত্যুর আট বছর পূর্তির পর, শোক পালন শেষে।

এ এক নিষ্ঠুর রীতি যা জৈব প্রয়োজন বা জীবনের ধর্মকে অস্বীকার করে। এর ফলে আমরা অ্যালবার যুবতী কন্যাদের মনে ক্ষোভ সঞ্চিত হতে দেখি। অবশ্য আপাতদৃষ্টিতে মেয়েদের কাউকে কাউকে মায়ের প্রতি ভয়মিশ্রিত আনুগত্য প্রকাশ করতে দেখা যায়। কিন্তু ভেতরে ভেতরে বিদ্রোহী সকলেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাঁচ কন্যার পাঁচ রকম মনোভাব। বার্নার্ডা অ্যালবার বড় মেয়ে অগাস্টার বয়স ৩৯। পঁচিশ বছরের যুবক পেপের বাগদত্তা সে। এই ছেলে অগাস্টাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে যৌতুকের লোভে। সবচেয়ে ছোট বোন অ্যাদেলা। পেপের প্রেমে পড়ে। পেপেও আকৃষ্ট হয় তার প্রতি। অ্যাদেলা একদিন প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করার জন্য আস্তাবলে যায়। তখন আরেক বোন মাতিরিও (সে শারীরিক প্রতিবন্ধী) তার মাকে অ্যাদেলার অভিসারের বিষয়টি জানিয়ে দেয়। সে এটা করে ঈর্ষাবশত। কেননা সেও দুর্বল ছিল পেপের প্রতি। বার্নার্ডা অ্যালবা বন্দুক নিয়ে আস্তাবলে চলে যায়। আবছা অন্ধকারে পেছন থেকে পেপের পিঠে গুলি করে। পেপে মারা গেছে এটা নিশ্চিত হওয়ার পর অ্যাদেলা নিজের ঘরে ছুটে যায়। দরজা লাগিয়ে দেয়। তারপর গলায় দড়ি দেয়। এভাবে সে অত্যাচারী মায়ের নির্যাতন ও যৌন অবদমনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পায়।

অ্যাদেলার মৃত্যুর পর বাকি চার বোন এবং তাদের নিষ্ঠুর মা একটা ঘরে একত্রিত হয়। মা তখন বলে, ‘আমার কুমারী মেয়ে, অক্ষতযোনি, প্রাণ দিয়েছে। তাকে অন্য ঘরে নিয়ে যাও। তাকে সাজাও কুমারী কন্যার বেশে। আর শোনো, এ নিয়ে কেউ অন্য কথা বলবে না কোনো...।’

পাঠক, লক্ষ করুন, রক্ষণশীলা বার্নার্ডা অ্যালবা তার মেয়েকে অক্ষতযোনি ভাবতে পছন্দ করছেন। অথচ এই মেয়ে ছিল প্রেমে উন্মত্ত। এবং সে প্রেমিকের সঙ্গে গোপনে মেলামেশা করেছে। ঈর্ষিত মাতিরিও কিন্তু ছোট বোনের নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তার মতো সুখী আর কে, যে হাজারবার পেয়েছে ওই যুবককে।’

লোরকার সৃজনপ্রতিভার সবটুকু বুঝতে হলে তার কবিতার পাশাপাশি তাঁর কাব্যনাটকেরও নিবিড় পাঠ জরুরি। শোকগাথামূলক কবিতার প্রতি তাঁর প্রবল ঝোঁক লক্ষণীয়। এর প্রভাব পড়েছে কাব্যনাট্যেও। কাব্যনাটকগুলোতে, বিশেষভাবে ‘রক্তস্নাত বিবাহ’-তে, সংলাপের ভেতর কবিতার রূপ ও মেজাজ ধরা পড়েছে। আবার দেখুন, বিয়ের উৎসবে লোকগীতি ব্যবহৃত হয়েছে দক্ষতার সঙ্গে। লোরকার সবচেয়ে সাড়া জাগানো এবং প্রভাবসম্পাতী কাব্যগ্রন্থের নাম ‘জিপসি ব্যালাডস’। এই বইয়ের কবিতার ভাষার সঙ্গে ‘রক্তস্নাত বিবাহ’-এর নাট্যভাষার চমৎকার মিল লক্ষ্য করি আমরা। চিত্রকল্প আধুনিক কবিতার বিরাট সম্পদ। লোরকার কাব্যনাটকে অ্যাকশনের এবং সংলাপের বিচিত্র ভঙ্গির সঙ্গে চিত্রকল্প একীভূত হয়ে গেছে। এবং এই মিশ্রণ সুফল বয়ে এনেছে।

লোরকা স্পেনের ঐতিহ্যে নিমজ্জিত একজন সৃষ্টিশীল মানুষ। তাই তাঁর কাব্যে এবং কাব্যনাট্যে আন্দালুসীয় অঞ্চলের মানুষের আনন্দ-বেদনা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, হিংসা-প্রতিশোধ, উজ্জ্বলতা-নৈঃশব্দ্য সঠিক আবেগ ও সঠিক শব্দের প্রয়োগের মাধ্যমে জায়গা করে নিয়েছে। ঐতিহ্যলালিত বিশেষ এক জনগোষ্ঠী তাদের কৃষিজীবন ধারা থেকে উপাদান এবং শক্তি সংগ্রহ করে নিলেও লোরকার রচনাকর্ম তাঁর স্বদেশের সীমানার ভেতর আবদ্ধ নয়। তা সারা বিশ্বের সম্পদে পরিণত হয়েছে। কেননা তাঁর লেখায় যে মানবিক সঙ্কটের রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি তা সর্বদেশীয় ও সর্বজনীন।

বৃহস্পতিবার, ০৬ জুন ২০২৪ , ২৬ জৈষ্ঠ্য ১৪৩১ ২৭ জিলক্বদ ১৪৪৫

লোরকার কবিতা, কাব্যনাট্য

সরকার মাসুদ

image

টষুংংবং ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা

দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানের বিশটি বছর ইউরোপের শিল্প-সাহিত্যের জন্য অত্যন্ত ফলবান একটি সময়। এই স্বল্পপরিসরের মধ্যে প্রকাশিত হয় এলিয়টের ভুবনকাঁপানো দীর্ঘ কবিতা। The Waste Land(১৯২২), বের্টল্ট ব্রেখটের সমাজভাবনাদীপিত উচ্চাঙ্গের নাটকগুলো, চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমা, ইয়েটসের কাব্যগ্রন্থ The wild Swans at coole(১৯১৯), এজরা পাউন্ডের মহাকাব্যিক রচনা Cantos(১৯২৫) জেসম জয়েসের হতবাক করে দেয়া বিশাল উপন্যাস Ulysses (১৯২২) আলডুস হাক্সলির ফ্যান্টাসিময় উপন্যাস Brave New World(১৯৩২) এবং আরো অসংখ্য উল্লেখযোগ্য কাজ। স্পেনের বিশ্বজয়ী কবি ও নাট্যজন ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার উত্থান, বিকাশ এবং অন্তর্ধান ঘটে এই সময় পরিসরের ভেতরেই।

লোরকার বিপুল খ্যাতির পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে যেমন লোককথার উপাদান, জিপসি জীবনাচার, স্বভাব কবির বাকভঙ্গি, তেমনি কাজ করেছে তাঁর মর্মন্তুদ অকাল মৃত্যুর ঘটনাটিও। মৃত্যুচেতনা লোরকার কবিতার পুনরাবৃত্ত বিষয়গুলোর মধ্যে একটি। মৃত্যুর প্রসঙ্গ তার কাব্যে এতবার এসেছে যে, মনে হয় তিনি নিজের মৃত্যু নিজেই দেখতে পেতেন। বোধ হয় তার মন বলতো, আমি সুদীর্ঘকাল পৃথিবীতে থাকব না। ‘বিদায়’ কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘যদি আমি মরে যাই, জানালাটা খোলা রেখো।’ ‘ঘোড়সওয়ারের গান’ কবিতায় লিখেছেন ‘মৃত্যু আমাকে চোখে চোখে রাখছে/ কর্ডোভার মিনারগুলো থেকে।’ এবার আমি ‘ইগনাসিও স্যানেচেজ মেজিয়াস-এর জন্য বিষাদ গীতি’ থেকে উদ্ধৃত করব কয়েকটি পঙ্ক্তি: ‘মৃত্যু ক্ষতের ভেতর ডিম পাড়তে লাগল/বিকেল পাঁচটায়।/ বিকেল পাঁচটায়/ ঠিক বিখেল পাঁচটায়।/ চাকায় চাপানো একটি কফিন/ হলো তার শয্যা/ বিকেল পাঁচটায়/ হাড়ভাঙার শব্দ আর বাঁশির ধ্বনি বেজে উঠল তার কানে/বিকেল পাঁচটায়। (অনুবাদ: অমিতাভ দাশগুপ্ত)

লোরকা বড় মাপের স্বভাব কবি যার মধ্যে এসে মিশে ছিল লোক কবি ও আধুনিক শিল্পীর নানা বৈশিষ্ট্য। আরব সভ্যতার সুবাদে গ্রানাডার চারপাশে ছিল আরবি কবিতার পরিবেশ। গীতপ্রিয় জিপসিদের ভ্রাম্যমাণ জীবন ও নানান বিচিত্র কর্মকা- যুক্ত হয়েছিল তার সঙ্গে। লোরকা আন্দালুসিয়ার সাংস্কৃতিক বহুমুখিতা অনুধাবনের গরজে লোকগীতি সংগ্রহ করেছেন। বিভিন্ন সময়ে ছিলেন জিপসিদের দীর্ঘ সান্নিধ্যে। তার একেবারে প্রথম দিকের কবিতা হচ্ছে সহজসরল, অদীক্ষিত কবির রচনা। কিছুকাল পরই তার লেখায় এসে যায় লোককথা ও লোকগীতির উপাদান। আরবি কাসিদা এবং দিওয়ান-এর আঙ্গিকও প্রযুক্ত হয় কোনো কোনো কবিতায়। কিন্তু সুরবিয়্যালিস্ট কবিকল্পনার নিজত্বম-িত প্রবল উপস্থিতি তাঁর কবিতাকে আন্তর্জাতিক পরিম-লে সুপরিচিত ও প্রশস্ত করে তোলে।

১৯২৯ সালে আমেরিকা ভ্রমণের আগ পর্যন্ত রচিত লোরকার কবিতা একান্তভাবেই স্পেনের গ্রামসংস্কৃতিচিহ্নিত। মার্কিন দেশে এক বছরের ভ্রমণ তাঁর কাব্যে বিরাট পরিবর্তন এনেছিল। পরিবর্তিত ভাব ও ভাষায় দীপ্ত সেই সব কবিতা ‘নিউইয়র্কে কবি’ নামে প্রকাশিত হয় লেখকের মৃত্যুর পর। এই বইয়ে নিউইয়র্ক সিটি চিত্রিত হয়েছে ‘অতিমানবিক স্থাপত্য, জটিল জ্যামিতি, অপ্রেমের এবং যন্ত্রণার শহর’ রূপে। কবির এ যাবৎকালের কবিতায় আন্দালুসিয়ার গ্রাম-প্রকৃতির যে প্রাণবন্ত ছবি আমরা দেখতে পাই, এখানে তার সুস্পষ্ট ব্যতিক্রম লক্ষণীয়। লোরকার মার্কিনি কবিতাগুলো বরং তুলে ধরেছে ইট-কাঠ-পেরেক নির্মিত মর্মবেদনার এক নতুন পরাবাস্তব পৃথিবী। এই পৃথিবী স্পেনের জলপাই আর কমলাবাগান, মৃত্যুচিহ্নিত চাঁদ, টিলাভূমি, ম্যাটাডর ও জিপসিদের থেকে বহুদূরে। অসাধারণ লিপি কুশলতার গুণে লেখক এখানে চিত্রিত করেছেন নগরসভ্যতার জৌলুস, অন্তর্বিষ, হিংস্রতা, দ্বন্দ্বময়তা।

দেয়ালগুলো প্রেতনৃত্য করছে সবুজ প্রান্তর জুড়ে। আর আমেরিকা যন্ত্র আর অশ্রুর বন্যায় ডুবন্ত। আমি চাই/ গভীর রাত্রির উদ্দাম বাতাস এসে নিয়ে যাক ফুলগুলো/নিয়ে যাক তোমার সমাধিগাত্রে, উৎকীর্ণ শব্দমালা/নিয়ে যাক সেই কৃষ্ণ বালকের মূর্তি... (কবিতা: ওয়াল্ট হুইটম্যানের প্রতি)

মৃত্যুবোধ লোরকার যেমন কবিতার তেমনি কাব্যনাটকসমূহেরও ভাবনা-দর্শনভূমিটিকে যথেষ্ট আলোকিত ও লক্ষযোগ্য করে তুলেছে। লেখকের কাব্যনাট্যের আলোচনায় প্রবেশের আগে, তাই ‘দুয়েন্দের তত্ত্ব ও প্রয়োগ’ নামের তাঁর বিশ্ববিশ্রুত লেকচারটি সম্বন্ধে দু’কথা বলা প্রাসঙ্গিক মনে করছি। লোরকা এখানে বলেছেন, ‘সব দেশে সব কালে মৃত্যু একটা চূড়ান্ত ঘটনা। মৃত্যু এলে জানালার পর্দা নামিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু স্পেনে তেমন নয়। স্পেনে মৃত্য এলে জানালার পর্দা তুলে দেয়া হয়...। এদেশে একজন মৃত ব্যক্তি মৃত্যুর পর আরো বেশি জীবিত...’ আরেক জায়গায় বলেছেন, ‘দুয়েন্দে ততক্ষণ আসবে না যতক্ষণ পর্যন্ত সে দেখবে না মৃত্যুর ঘনিয়ে আসার সম্ভাবনা।

দুয়েন্দের তত্ত্ব দাঁড়িয়ে আছে বাস্তবের পাটাতনের ওপর কিন্তু এর মধ্যে একটা মরমী ভাব নিহিত আছে। স্পেনের ঐতিহ্যবাহী ‘বুল ফাইট’-এর ভেতর তিনি ফুটে উঠতে দেখেছেন দুয়েন্দেকে। সংগ্রামশীলতার মধ্য দিয়ে যে রক্তাক্ত মৃত্যু হাজির হয় দুয়েন্দে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে ঠিক সেখানেই। ‘তারপর উঁচু স্তম্ভ বেয়ে ওঠে দুই বন্ধু, পেছনে রক্তের দাগ টেনে। পেছনে অশ্রুর দাগ.../ ছাদের ওপর কাঁপে/ছোট ছোট টিনের লণ্ঠন।/সকালের চোখে-মুখে বিঁধে যায়/ এক হাজার কাচের খঞ্জনি।’

এবার কাব্যনাটকের প্রসঙ্গ। নাটকের কাঠামো দাঁড়িয়ে থাকে তার ডায়ালগের ওপর। ডায়ালগ শক্তিমন্ত না হলে সেই নাটক মুখ থুবড়ে পড়বেই। লোরকার কাব্যনাটক আদ্যোপান্ত পড়ার পর আমার মনে হয়েছে, এই কবি কবিতা না লিখে যদি শুধুই কাব্যনাট্য রচনা করে যেতেন, তাহলেও সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে খুব বিশিষ্ট একটি জায়গা তাঁর থাকতো। উত্তরকালে লোরকা যে কাব্যনাটকের দিকে ঝুঁকে পড়বেন, তার পূর্বাবাস আমরা পাই তাঁর ডায়ালগধর্মী কবিতাগুলোর মধ্যে। আমেরিকা থেকে ঘুরে আসার পর কেবল তার কবিতাই বদলে যায়নি, সৃজনইচ্ছাও রীতিমতো বাঁক নিয়েছিল। কেননা এ সময়ই কাব্যনাটক লেখার কাজে প্রবলভাবে লিপ্ত হন তিনি। ১৯২৯-৩০ সালে রচিত হয় ‘যদি পাঁচ বছর কেটে যায়’ শিরোনামের একটি নাটক। এখানে আমরা এক যুবকের জীবনের শেষ পাঁচ মিনিটে তার অবচেতন মনে জেগে-ওঠা ঘটনাসমূহ দেখতে পাই। বিষয়টি পরিবেশিত হয়েছে পরাবাস্তববাদী ভঙ্গিতে। তিন অঙ্কের এই নাটক এক কথায় নিরীক্ষাধর্মী। ঘটনাবলী, পাত্র-পাত্রী সবই নায়কের ভাবনা-কল্পনার সম্প্রসারিত রূপ। সময় বলে কিছু নেই এখানে। সব কিছু ঘটেছে কালের স্বাভাবিক বৃত্তের বাইরে। ফলে একাকার হয়ে গেছে অতীত বর্তমান-ভবিষ্যৎ। ১৯৩২ সালে লোরকা ‘জুতা নির্মাতার আজব স্ত্রী’ নামে একটি কমেডি লিখেছিলেন। নাটকটি স্পেনের লোকজীবন ভিত্তিক এবং জনসংস্কৃতিই এর প্রাণ। নাটকে দেখা যায়, জুতা নির্মাতা মোটামুটি বয়স্ক ব্যক্তি। তার স্ত্রীর বয়স কম। সে প্রাণবন্ত, সদাউচ্ছল। স্ত্রীর সার্বক্ষণিক অভিযোগ আধবুড়ো স্বামীর প্রতি। সেই তরুণী স্ত্রী পরপুরুষের সঙ্গে চুটল আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে স্বামী বেচারা একদিন বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। তারপর স্ত্রীটিকে কেন্দ্র করে লতিয়ে ওঠে পাড়া-প্রতিবেশীদের মুখরোচক কেচ্ছা-কাহিনী। জুতা নির্মাতা একদিন ফিরে আসে। প্রধান উদ্দেশ্য, তার অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রী কেমন জীবন কাটিয়েছে সেই খোঁজখবর নেয়া। কিন্তু কেমন বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করে যে, তার স্ত্রী সবিশ্বাসঘাতকতা করেনি। স্ত্রীও অনুপস্থিতির সূত্রে সচেতন হয়ে উঠেছে স্বামীর গুণাবলী সম্পর্কে। সে উপলব্ধি করে যে, স্বামীর প্রতি তার অভিযোগসমূহ ছিল রীতিমতো অন্যায়। স্বামী-স্ত্রীর মিলনের ভেতর দিয়ে ইতিবাচক সমাপ্তি ঘটে নাটকটির। কমেডি, প্রহসন, ট্র্যাজেডি- ইত্যাকার নানা ধরনের নাটক লিখলেও লোরকার নাট্যখ্যাতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে প্রধানত তিনটি ট্র্যাজেডির অভাবনীয় সাফল্যের দরুন। আন্দালুসিয়ার গ্রামীণ জীবন ভিত্তিক এই ট্রিলজির প্রথমটি হচ্ছে ‘রক্তস্নাত বিবাহ’ (১৯৩৩)। একটি ঐতিহ্যপুষ্ট সমাজ কাঠামোর মধ্যে কামনা প্রেম ঈর্ষা প্রতিশোধস্পৃহা এবং সেই স্পৃহা থেকে নরহত্যা- এই হচ্ছে ‘রক্তস্নাত বিবাহ’র থিম। নাটকের গল্প সংক্ষেপে এমন, মা বিধবা মহিলা। তার স্বামী ও বড় ছেলে প্রতিবেশী ফেলিক্স পরিবারের সঙ্গে দ্বন্দ্বে প্রাণ হারায়। মা এখন তার একমাত্র ছেলের বিয়ে দিতে চাইছে। মা আশা করে, ছেলের বউ তাকে অনেকগুলো নাতি-নাতনি উপহার দেবে। কিন্তু ফেলিক্স পরিবারের সন্তান লিওনার্দোর সঙ্গে ভাবী বধূর ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। যদিও লিওনার্দো বিবাহিত তথাপি তারা দু’জন দু’জনের প্রতি এখনো আসক্ত। মা-ছেলে যখন কনের বাড়িতে যায়, ছেলের মা এটা লক্ষ্য করে যে, আসন্ন বিয়ের ব্যাপারে মেয়েটি একদম উদাসীন। পরে একজন গৃহভৃত্যের মাধ্যমে জানা যায় যে, লিওনার্দো ইতোমধ্যে মেয়েটির সঙ্গে দেখা করে গেছে।

বিয়ের দিন লিওনার্দো কনের বাড়িতে আসে। সে জানায়, সে তাকে আগের মতোই ভালোবাসে। এতে মেয়েটি বিহ্বল হয়ে পড়ে। কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। এক সময় ভাবে, প্রেমিককে ফিরিয়ে দিয়ে নিজের বাগদত্ত পুরুষকেই বিয়ে করবে। আর ভালোবাসবে স্বামীকেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে তার সংকল্পে অটল থাকতে পারে না। বিয়ের দিনই বধূ লিওনার্দোর সঙ্গে পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে বর তার বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে পলাতকদের খোঁজে পথে নামে। মৃত্যু ভিখারিনীর ছদ্মবেশে পলাতকদের পথ দেখিয়ে দেয়। বর ও তার সাথীদেরও নিয়ে যায় বনের ভেতর। অরণ্য পরিবেশে চাঁদের সঙ্গে এক সংলাপে মৃত্যু জানায় যে, অল্প সময়ের মধ্যেই লিওনার্দো ও বর দু’জনেই মারা যাবে। ঘটেও তাই। নাটকের শেষ দৃশ্যে বধূ মায়ের কাছে ফিরে এসে জানায়, তার ছেলে মারা গেলেও মর্যাদা হারায়নি সে। লিওনার্দোও বাঁচতে পারেনি। এবং বধূর সম্মান ও রক্ষিত হয়েছে তার কুমারিত্ব হরণ করতে পারেনি কেউ।

এক বিধবা নারীর বেদনার সঙ্গে যুক্ত হয় আরেক সদ্য বিধবার (লিওনার্দোর স্ত্রীর) মনোকষ্ট। অন্যদিকে আরেকজন স্ত্রী হয়ে ওঠার আগেই অনুভব করে জীবনসঙ্গী হারানোর মর্মযাতনা। তিন নারীর শোকের মাধ্যমে এক ধরনের ঐক্য তৈরি হয়, কেননা সমবেদনায় সিক্ত হয় সকলেই। জীবনের ট্র্যাজিক পরিণতি চূড়ান্ত নিঃসঙ্গ করে তোলো প্রত্যেককেই।

প্রথম অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যের গোড়াতেই আমরা শুনি একটি ঘুমপাড়ানিয়া গান। তার পর দেখতে পাই, লিওনার্দো ঘোড়া ছুটিয়ে যাচ্ছে প্রিয়তমার কাছে। লোরকার এই উপস্থাপনরীতির মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে প্রত্যক্ষ অ্যাকশন। আবার ঘুমপাড়ানিয়া গীতের ভেতর দিয়ে আমরা লোকজীবনের একটা স্নিগ্ধ পরিম-লের স্বাদ পাচ্ছি। মনে পড়ছে বিয়ের উৎসবের সেই অসাধারণ দৃশ্যটি যেখানে গান গেয়ে কনেকে ঘুম থেকে জাগানো হচ্ছে। অতিথিবর্গ এসে পৌঁছেছে। তাদের অনেকেই যোগ দিয়েছে এই সমবেত সঙ্গীতে। এই প্রথা সমাজের স্বীকৃত প্যাটার্ন তুলে ধরছে। অন্যদিকে কনের ব্যক্তিক রুচি-অভিরুচি এবং দেহমনের আকাক্সক্ষা প্রতিভাত হয়েছে স্বপ্নময় চিত্রকল্পের ভেতর দিয়ে। এই দুটি বিষয় নাটককে দিয়েছে কাক্সিক্ষত স্বতঃস্ফূর্ততা এবং গতি।

পরবর্তী বিখ্যাত নাটক ‘ইয়ারমা’ (১৯৩৪)-এরও ভূমি স্পেনের পল্লী জীবন। এটা তিন অঙ্কের ট্র্যাজেডি। ‘রক্তস্নাত বিবাহ’ এবং ‘ইয়ারমা’ দুটিরই উপজীব্য নারী জীবনের ট্র্যাজেডি। পার্থক্য হচ্ছে, প্রথমটি গড়ে উঠেছে ব্যক্তির বিশ্বাস, আকাক্সক্ষা ও সমাজে বিদ্যামান প্রথার দ্বন্দ্ব নিয়ে। ‘ইয়ারমা’র বিষয়বস্তু সমাজ কতৃক ব্যক্তির খ-িতকরণ। এখানে আমরা দেখতে পাই বিরাজমান সমাজব্যবস্থা কীভাবে একজন ব্যক্তির আকাক্সক্ষাকে খর্ব করে, কীভাবে তাকে নিষ্ফলা ও নিষ্প্রাণ মানুষে পরিণত করে।

কেন্দ্রীয় চরিত্র ইয়ারমা মা হতে চায়। কিন্তু তার এই ইচ্ছা পূরণে অক্ষম সে। এক বন্ধ্যা, বিবাহিত জীবনেরও ঘেরাটোপে সে বন্দি। সেজন্য অবশ্য সে নিজে দায়ী নয়, দায়ী তার স্বামীর বীর্যহীনতা এবং নির্মম স্বার্থপরতা। স্বাভাবিকভাবেই সে তার স্বামীকে ভালোবাসতে পারে না। ভিকটর নামের এক মেষপালকের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হয় সে। আবার নৈতিকতার প্রতি আনুগত্যবশত বিবাহবহির্ভূত কারো মাধ্যমে গর্ভবতী হওয়ার কথা ভাবতেও পারে না। অথচ সে মা হতে চায় তীব্রভাবে। নিষ্ফলা ইয়ারমার আর্তির গভীরতা ও তাৎপর্য বোঝা যায় যখন সে বলে- ‘ওহ শৃঙ্খলিত শোণিতের কী যন্ত্রণা/ আমার পিঠে ফুটিয়ে দিচ্ছে বোলতার হুল।/ কিন্তু তোমাকে আসতেই হবে মানিক। আসতেই হবে খোকন আমার/ কারণ জল দেয় লবণ, পৃথিবী দেয় ফল/ আর আমাদের গর্ভে সুরক্ষিত রাখে আমাদের প্রিয় বাচ্চাদের।

ইয়ারমা একটা পর্যায়ে তার দীর্ঘদিনের স্বপ্নপূরণের চেষ্টা হিসেবে এক তীর্থযাত্রায় যোগ দেয়। পাহাড়ের ওপর গাছগাছালিঘেরা সেই তীর্থে রমণীরা আসে সন্তান লাভের আশায়। এখানে তারা নানা ধরনের আচার-অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। সন্তান লাভের জন্য প্রার্থনা করে। এ এক দারুণ আগ্রহসঞ্চারী স্থান। পাঠক ভিন্ন ধরনের প্রথার সঙ্গে পরিচিত হবেন। রমণীরা এখানে মুখোশ পরে থাকে; পুরুষরাও। সারাক্ষণ নাচ চলে। এর ভেতর প্রার্থনাও চলে। যেখানে নাচ হয় তার পাশেই যুবকদের দল নারীসঙ্গ’র অপেক্ষায় থাকে। পুরো ব্যাপারটা বেশ মৃত্তিকা সংলগ্ন এবং মনোগ্রাহী মনে হয়।

দেখা যায়, ইয়ারমার স্বামীও এই তীর্থে হাজির হয়েছে। স্ত্রীকে সে বিশ্বাস করে না। সে বুঝতে পেরেছে এই মেয়ে তাকে ভালোবাসে না। তাই সে বুঝতে চেয়েছে, নাকি তার অন্য কোনো ধান্দা আছে। ঈর্ষায় ও ক্রোধে ফেটে পড়ে সে। স্ত্রীর মুখোমুখি হওয়ামাত্র ক্ষিপ্ত হয়ে বলে, তাদের বাচ্চা-কাচ্চা নেই সেজন্য তার দুঃখ নেই। সে বরং খুশি। সে এও বলে, সন্তান না হওয়ার জন্য তারা কেউ দায়ী নয়।

অন্যদিকে ইয়ারমা একসময় উপলব্ধি করে যে তার মা হওয়ার আর কোনো সম্ভাবনাই নেই। স্বামী এ ব্যাপারে পুরোপুরি অক্ষম ও অনাগ্রহী। তখন তার মন বিষিয়ে ওঠে। বিবাহিত জীবন অর্থহীন মনে হয় তার। ইয়ারমার বিলাপ শুনে ভাববিহ্বল স্বামীটি স্ত্রীর দিকে এগিয়ে যায়। তাকে আলিঙ্গন করে। কিন্তু ইয়ারমার মনজুড়ে তখন টগবগ করছে হতাশা, ঘৃণা ও ক্রোধ। মনের চরম দিশাহারা অবস্থায় মেয়েটি তার স্বামীকে খুন করে বসে।

ট্রিলজির তৃতীয় ট্র্যাজেডি বার্নার্ডা অ্যালবার বাড়ি-তেও পূর্বে উল্লিখিত নাটক দুটির মতো অপ্রাপ্তি, ঈর্ষা, মানস যন্ত্রণা, মৃত্যু (হত্যাকা-) এসব প্রত্যক্ষ করি আমরা। মূল সুর মোটামুটি অক্ষুণœ আছে। কিন্তু স্বপ্নকল্পনা, রূপক বা পরাবাস্তবতা এখানে অনুপস্থিত। স্পেনের গ্রামাঞ্চলের নারীদের নিয়ে রচিত এই নাটক সর্বার্থেই বাস্তববাদী। ফর্ম, ভাষা ও সংলাপ নিয়ে নানারকম নিরীক্ষার পর লোরকা সাদামাটা ধরনের বাস্তববাদী নাটক লিখলেন, এটা বেশ প্রশ্নোদ্দীপক একটা ব্যাপার। হতে পারে লেখক সহজ হতে চেয়েছিলেন। সব অলংকার গা থেকে নামিয়ে শিল্পের নিরাভরণ সুষমা দেখাতে চেয়েছিলেন পাঠককে।

তিন অঙ্কের এই নাটকে অনুভূতিকে ভীষণ মূল্য দেয়া হয়েছে। বার্নার্ডা অ্যালবার পরিবারে আছে অ্যালবা নিজে এবং তার পাঁচ কুমারী মেয়ে। মেয়েদের বয়স বিশ থেকে ঊনচল্লিশের মধ্যে। বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ নেই। মা তার সমাজসম্মত ধ্যান-ধারণার ও মূল্যবোধের নিগড়ে বন্দি। স্পেনে, সেকালে, উঠতি বয়সী মেয়েদের যৌনাকাক্সক্ষা কঠোরভাবে অবদমন করা হতো। আর এটাকেই তারা স্বাভাবিক মনে করতো। এই সমস্যার এক নিখুঁত বাস্তবধর্মী চিত্র অঙ্কিত আছে নাটকটিতে। স্বামী মারা যাওয়ার পর বার্নার্ডা অ্যালবা তার পাঁচ কুমারী কন্যার ওপর ষোলআনা আধিপত্য বিস্তার করে। বিয়ের ক্ষেত্রে মা কঠিন শর্ত আরোপ করে অনুঢ়া মেয়েদের ওপর। তাদের বিয়ে করতে হবে এমন কাউকে যাতে পরিবারের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করা যায়। আর সেই বিয়ে হবে ঐতিহ্য ও প্রথা মেনে, তাদের বাবার মৃত্যুর আট বছর পূর্তির পর, শোক পালন শেষে।

এ এক নিষ্ঠুর রীতি যা জৈব প্রয়োজন বা জীবনের ধর্মকে অস্বীকার করে। এর ফলে আমরা অ্যালবার যুবতী কন্যাদের মনে ক্ষোভ সঞ্চিত হতে দেখি। অবশ্য আপাতদৃষ্টিতে মেয়েদের কাউকে কাউকে মায়ের প্রতি ভয়মিশ্রিত আনুগত্য প্রকাশ করতে দেখা যায়। কিন্তু ভেতরে ভেতরে বিদ্রোহী সকলেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাঁচ কন্যার পাঁচ রকম মনোভাব। বার্নার্ডা অ্যালবার বড় মেয়ে অগাস্টার বয়স ৩৯। পঁচিশ বছরের যুবক পেপের বাগদত্তা সে। এই ছেলে অগাস্টাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে যৌতুকের লোভে। সবচেয়ে ছোট বোন অ্যাদেলা। পেপের প্রেমে পড়ে। পেপেও আকৃষ্ট হয় তার প্রতি। অ্যাদেলা একদিন প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করার জন্য আস্তাবলে যায়। তখন আরেক বোন মাতিরিও (সে শারীরিক প্রতিবন্ধী) তার মাকে অ্যাদেলার অভিসারের বিষয়টি জানিয়ে দেয়। সে এটা করে ঈর্ষাবশত। কেননা সেও দুর্বল ছিল পেপের প্রতি। বার্নার্ডা অ্যালবা বন্দুক নিয়ে আস্তাবলে চলে যায়। আবছা অন্ধকারে পেছন থেকে পেপের পিঠে গুলি করে। পেপে মারা গেছে এটা নিশ্চিত হওয়ার পর অ্যাদেলা নিজের ঘরে ছুটে যায়। দরজা লাগিয়ে দেয়। তারপর গলায় দড়ি দেয়। এভাবে সে অত্যাচারী মায়ের নির্যাতন ও যৌন অবদমনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পায়।

অ্যাদেলার মৃত্যুর পর বাকি চার বোন এবং তাদের নিষ্ঠুর মা একটা ঘরে একত্রিত হয়। মা তখন বলে, ‘আমার কুমারী মেয়ে, অক্ষতযোনি, প্রাণ দিয়েছে। তাকে অন্য ঘরে নিয়ে যাও। তাকে সাজাও কুমারী কন্যার বেশে। আর শোনো, এ নিয়ে কেউ অন্য কথা বলবে না কোনো...।’

পাঠক, লক্ষ করুন, রক্ষণশীলা বার্নার্ডা অ্যালবা তার মেয়েকে অক্ষতযোনি ভাবতে পছন্দ করছেন। অথচ এই মেয়ে ছিল প্রেমে উন্মত্ত। এবং সে প্রেমিকের সঙ্গে গোপনে মেলামেশা করেছে। ঈর্ষিত মাতিরিও কিন্তু ছোট বোনের নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তার মতো সুখী আর কে, যে হাজারবার পেয়েছে ওই যুবককে।’

লোরকার সৃজনপ্রতিভার সবটুকু বুঝতে হলে তার কবিতার পাশাপাশি তাঁর কাব্যনাটকেরও নিবিড় পাঠ জরুরি। শোকগাথামূলক কবিতার প্রতি তাঁর প্রবল ঝোঁক লক্ষণীয়। এর প্রভাব পড়েছে কাব্যনাট্যেও। কাব্যনাটকগুলোতে, বিশেষভাবে ‘রক্তস্নাত বিবাহ’-তে, সংলাপের ভেতর কবিতার রূপ ও মেজাজ ধরা পড়েছে। আবার দেখুন, বিয়ের উৎসবে লোকগীতি ব্যবহৃত হয়েছে দক্ষতার সঙ্গে। লোরকার সবচেয়ে সাড়া জাগানো এবং প্রভাবসম্পাতী কাব্যগ্রন্থের নাম ‘জিপসি ব্যালাডস’। এই বইয়ের কবিতার ভাষার সঙ্গে ‘রক্তস্নাত বিবাহ’-এর নাট্যভাষার চমৎকার মিল লক্ষ্য করি আমরা। চিত্রকল্প আধুনিক কবিতার বিরাট সম্পদ। লোরকার কাব্যনাটকে অ্যাকশনের এবং সংলাপের বিচিত্র ভঙ্গির সঙ্গে চিত্রকল্প একীভূত হয়ে গেছে। এবং এই মিশ্রণ সুফল বয়ে এনেছে।

লোরকা স্পেনের ঐতিহ্যে নিমজ্জিত একজন সৃষ্টিশীল মানুষ। তাই তাঁর কাব্যে এবং কাব্যনাট্যে আন্দালুসীয় অঞ্চলের মানুষের আনন্দ-বেদনা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, হিংসা-প্রতিশোধ, উজ্জ্বলতা-নৈঃশব্দ্য সঠিক আবেগ ও সঠিক শব্দের প্রয়োগের মাধ্যমে জায়গা করে নিয়েছে। ঐতিহ্যলালিত বিশেষ এক জনগোষ্ঠী তাদের কৃষিজীবন ধারা থেকে উপাদান এবং শক্তি সংগ্রহ করে নিলেও লোরকার রচনাকর্ম তাঁর স্বদেশের সীমানার ভেতর আবদ্ধ নয়। তা সারা বিশ্বের সম্পদে পরিণত হয়েছে। কেননা তাঁর লেখায় যে মানবিক সঙ্কটের রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি তা সর্বদেশীয় ও সর্বজনীন।