জীবনানন্দ দাশের কবিতায় স্বরবৃত্ত

রাকিবুল রকি

কেউ যাহা জানে নাই- কোনো এক বাণী-

আমি বহে আনি;

একদিন শুনেছ যে-সুর-

ফুরায়েছে, - পুরানো তা- কোনো এক নতুন-কিছুর

আছে প্রয়োজন,

তাই আমি আসিয়াছি,- আমার মতন

আর নাই কেউ!

[কয়েকটি লাইন : ধূসর পা-ুলিপি]

প্রিয় দীপাবলি,

আর দুয়েক দিন পরেই মাঘসংক্রান্তি। কুয়াশার চাদর জড়ানো জবুথবু রাত অনেক আগেই প্রথম প্রহর পেরিয়ে এসেছে। তীব্র শীত জানি না কেন একাকীত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়? হঠাৎ করেই মনে করিয়ে দেয় কবি জীবনানন্দ দাশের কথা! কেন? জানি না। হয়তো সেও অনেকের মাঝে থেকেও নিজের মুদ্রাদোষে একা হয়ে গিয়েছিল বলে। হয়তো তিনি লিখেছিলেন, ‘এইসব শীতের রাত আমার হৃদয়ে মৃত্যু ডেকে আনে।’ হয়তো এজন্যই তাকে মনে পড়ছে। কিংবা অন্য কোনো কারণে। থাক না কিছু কথা অজানা। সুজিত সরকারের পঙ্ক্তি ধার করে বলতে পারি, ‘অজানায় শুরু, না জানায় শেষ।’ কিংবা তারও আগে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত লিখে গেছেন, ‘অনুমানে শুরু, সমাধা অনিশ্চয়ে।’

আসলেই তো আমরা অনুমান করতে পারি। সমাধান কি আমাদের হাতে? যেমন সমাধান নেই তোমার চাহনির, কাছে এসে কেন দূরে যাও? অথবা যাবেই যদি কেন কাছে আসো? কী উত্তর আছে এ প্রশ্নের? কী উত্তর দেবে তুমি, বলো? যেমন সমাধান নেই কোনো কবি কেন একেক কবিতায় একেক ছন্দ ব্যবহার করেন। তিনি কীভাবে বোঝেন, এই কবিতার জন্য এই ছন্দই ঠিক?

০২.

কিছুদিন আগেই তোমার সাথে কবিতার ছন্দ নিয়ে কথা হচ্ছিল। কথা হচ্ছিল নানান কবিদের নিয়ে। নানান কবিতার ছন্দ নিয়ে। তুমি জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় স্বরবৃত্ত ছন্দের ব্যবহার নিয়ে জানতে চাচ্ছিলে। চিঠির উদ্ধৃতাংশে জীবনানন্দ দাশের এই লাইনগুলো পড়েছে নিশ্চয়। অবশ্যই তা বহুবার পড়া তোমার। জানি। তবে জানো, কাজী নজরুল ইসলাম যেমন ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতার নিজের পরিচয় দিয়েছেন, ‘কয়েকটি লাইন’ও আমার কাছে জীবনানন্দের পরিচয়মূলক কবিতা মনে হয়। মনে হয় তিনি কবিতার নাম ‘কয়েকটি লাইন’ না রেখে অনায়াসে ‘আমার পরিচয়’ রাখতে পারতেন।

তবে কবিতার নাম যা-ই হোক, এটা তাঁর আত্মপরিচয়মূলক কবিতা-ই। তিনি সত্যি তো বাংলা কবিতায় এক অনাস্বাদিত স্বাদ এনে দিয়েছেন। নির্মাণ করেছেন এক স্বতন্ত্র জগৎ। তাঁর মতো আর কেউ নেই। তিনি এক। শুধু কবিতার জগৎ, অবয়ব, শব্দ চয়নে তিনি স্বাতন্ত্র্যিকতার পরিচয় দেননি। ছন্দ নির্মাণে তিনি নিজের স্মারক রেখে গেছেন। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের এলানো ঢঙটা তো এখন জীবনানন্দের নামেই পরিচিত। ভাবতে অবাক লাগে, স্বরবৃত্ত ছন্দের চপল ঘোড়াকেও তিনি শেষপর্যন্ত নিজস্ব মুদ্রায় হাঁটিয়ে ছেড়েছেন। যদিও জীবনানন্দ দাশের কবিতায় স্বরবৃত্ত ছন্দের ব্যবহার খুব বেশি নেই। বিশেষ করে তাঁর সমসাময়িক কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার তুলনায় তাঁর স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা কবিতার সংখ্যা খুবই কম। আবদুল মান্নান সৈয়দকৃত জীবনানন্দ দাশের স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা কবিতাগুলোর তালিকা দিচ্ছি তোমাকে, ‘ঝরা পালক- এর সাতটি কবিতা (‘সাগর-বলাকা’, ‘বনের চাতক-মনের চাতক’, ‘চলছি উধাও’, ‘ছায়া-প্রিয়া’, ‘মিশর’, ‘মরুবালু’, ‘স্মৃতি’); বেলা অবেলা কালবেলার-র দশটি কবিতা (‘তোমাকে’, ‘সময়’, ‘সেতুপথে’, ‘যতিহীন’, ‘শতাব্দী’, ‘প্রয়াণপটভূমি’, ‘নারীসবিতা’, ‘গভীর এরিয়েলে’, ‘পটভূমির’, ‘যদিও দিন’, ‘আজকে রাতে’); শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থার্গত দুটি কবিতা (‘তোমাকে ভালোবেসে’, ‘অনন্দা’); জীবনানন্দ দাশের কবিতা গ্রন্থর্ভূত এগারোটি কবিতা (‘হৃদয়, তুমি’, ‘পটভূমি’, ১১-সংখ্যক কবিতা, ১২-সংখ্যক কবিতা, ১৬-সংখ্যক কবিতা, ‘মনকে আমি নিজে’, ‘রাত্রি, মন, মানবপৃথিবী’, ‘জার্মানির রাত্রিপথে : ১৯৪৫’ ‘সূর্যকরোজ্জ্বলা’, ‘চেতনা-লিখন’, ‘ভোরের কবি জ্যোতির কবি’); সুদর্শনা গ্রন্থর্ভূত পনেরোটি কবিতা (‘তোমায় আমি’, ‘এসো’, ‘অনেক রক্তে’, ‘পৃথিবী, জীবন, সময়’, ‘এখন ওরা’, ‘স্বাতীতারা’, ‘আলোকপাত’, ‘ তোমাকে’, ‘শান্তি ভাল’); মনবিহঙ্গম গ্রন্থর্ভূত দুটি কবিতা (‘জীবন ভালোবেসে’, ‘শতাব্দীর মানবকে’)। [ছন্দ]

এখানে উল্লেখ করা যায় যে, আবদুল মান্নান সৈয়দ ‘ঝরা পালক’-এর ‘সাগরবলাকা’ কবিতাটিকে স্বরবৃত্তে লেখা বললেও মুজিবুল হক কবীর তাতে দ্বিমন পোষণ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আসলে কবিতাটির (সাগরবলাকা) ২০ পঙ্ক্তি স্বরবৃত্তে রচিত, শেষাংশটুকু মাত্রাবৃত্তে রচিত।’

জীবনানন্দ দাশ তাঁর প্রথম কাব্য ‘ঝরা পালক’-এ স্বরবৃত্ত ছন্দের ব্যবহার করলেও ‘ধূসর পা-ুলিপি’, ‘রূপসী বাংলা’, ‘বনলতা সেন’, ‘মহাপৃথিবী’ কিংবা ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যে স্বরবৃত্ত ছন্দের কোনো কবিতা নেই।

‘ঝরা পালক’ কাব্যে জীবনানন্দ তখনও নিজস্ব স্বর খুঁজে পাননি। মোহিতলাল মজুমদার, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, কাজী নজরুল ইসলামের প্রভাব রয়েছে কবিতাগুলোতে। স্বরবৃত্ত ছন্দের চালেও তাঁদের প্রভাব পরিদৃষ্ট হয়।

চলো, ‘ঝরা পালক’ কাব্যে স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা একটি কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি পাঠ করি-

‘বনের চাতক/ বাঁধল বাসা/ মেঘের কিনা/রায়,-

মনের চাতক/ হারিয়ে গেল/ দূরের দুরা/শায়।

ফুঁপিয়ে ওঠে/ কাতর আকাশ/ সেই হতাশার/ ক্ষোভে,-

সে কোন্ বোঁটের/ ফুলের ঠোঁটের/ মিঠা মদের/ লোভে

বনের চাতক/- মনের চাতক/ কাঁদছে অবে/লায়।

(বনের চাতক- মনের চাতক)

পাঁচ স্তবকে বিন্যস্ত কবিতার প্রতি স্তবকে রয়েছে পাঁচটি করে পঙ্ক্তি। পর্ব বিন্যাস হলো

৪ + ৪ + ৪ + ১

৪ + ৪ + ৪ + ১

৪ + ৪ + ৪ + ২

৪ + ৪ + ৪ + ২

৪ + ৪ + ৪ + ১

প্রতি পঙ্ক্তিতে তিনটি করে পূর্ণ পর্ব এবং একটি অপূর্ণ পর্ব রয়েছে। পূর্ণ পর্ব চার মাত্রার, অপূর্ণ পর্ব এক এবং দুই মাত্রার। তবে প্রথম স্তবক বাদে সব স্তবকেই অপূর্ণ পর্ব দুই মাত্রার।

তোমাকে পূর্বেই বলেছি, ‘ঝরা পালক’-এর পরে জীবনানন্দ দাশের ‘ বেলা অবেলা কালবেলা’- তে গিয়ে আবার স্বরবৃত্ত ছন্দের কবিতা পাই। প্রসঙ্গত বলা যায়, ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ কাব্য কবির মৃত্যুর পর ১৯৬১ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ জীবনানন্দ জীবিত অবস্থায় তাঁর কোনো কাব্যে স্বরবৃত্ত ছন্দের কবিতা ঠাঁই পায়নি। চলো, পরবর্তী জীবনে লেখা স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা আরও কিছু পঙ্ক্তি পাঠ করি।

ক.

‘প্রতিটি প্রাণ অন্ধকারে নিজের আত্মবোধের দ্বীপের মতো-

কী এক বিরাট অবক্ষয়ের মানব-সাগরে।

তবুও তোমায় জেনেছি, নারি, ইতিহাসের শেষে এসে; মানবপ্রতিভার

রূঢ়তা ও নিষ্ফলতার অধম অন্ধকারে

মানবকে নয়, নারি, শুধু তোমাকে ভালোবেসে

বুঝেছি নিখিল বিষ কী রকম মধুর হতে পারে।’

( তোমাকে, বেলা অবেলা কালবেলা)

খ.

‘পুরাণপুরুষ, গণমানুষ, নারীপুরুষ, মানবতা, অসংখ্য বিপ্লব

অর্থবিহীন হয়ে গেলে, - তবু আরেক নবীনতর ভোরে

সার্থকতা পাওয়া যাবে ভেবে মানুষ সঞ্চারিত হয়ে

পথে পথে সবের শুভ নিকেতনের সমাজ বানিয়ে

তবুও কেবল দ্বীপ বানাল যে যার নিজের অবক্ষয়ের জলে।’

( যতিহীন, বেলা অবেলা কালবেলা)

গ.

‘যে যার দেহ আত্মা ভালোবেসে অমল জলকণার মতন সমুদ্রকে এক মুঠে

ধ’রে আছে?

ভালো ক’রে বেঁচে থাকার বিশদ নির্দেশে

সূর্যকরোজ্জ্বল প্রভাতে এসে

হিংসা গ্লানি মৃত্যুকে শেষ ক’রে

জেগে আছে?’

(অনন্দা, শ্রেষ্ঠ কবিতা)

ঘ.

মাঝে মাঝে আমার দেশের শিপ্রা, পদ্মা, রেবা, ঝিলম জলশ্রীকে আমি

সর্পীবোনের মতন কোথাও পাহাড় অবধি

অথবা নীল ভূকল্লোলে সাগর সুভাষিত

ক’রতে গিয়ে শুনেছিলাম রাইনের মতো নদী

কি এক গভীর হ্বাইমারী মেঘ সূর্য বাতাস নিয়ে

নর- নারী নগর গ্রামীণতায় ব্যাপ্ত রীতি

লক্ষ্য ক’রে সবিতাসাধ জানিয়েছিল; - তিন দশকের পরে

এ-সব স্বপ্নমিশেল কি এক শূন্য অনুমিতি।

(জার্মানীর রাত্রিপথে : ১৯৪৫)

উদ্ধৃত পঙ্ক্তি নিয়ে কথা বলার আগে আরও কিছু কবির স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা কিছু পঙ্ক্তির পাঠ নেই-

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:

‘হঠাৎ উঠে ঝেঁকে

যায় সে ছুটে কী রাঙা রঙ দেখে

অদৃশ্য কোনও দূর দিগন্ত পারে;

আবছায়া কোন্ সন্ধ্যা আলোয় শিশুরমতো তাকায় অনুমানে,

তাহার ব্যাকুলতা

স্বপ্নে সত্যে মিশিয়ে রচে বিচিত্র রূপকথা।

(অবুঝ মন, পরিশেষ)

কাজী নজরুল ইসলাম:

‘দ্বাদশ রবির বহ্নি জ¦ালা ভয়াল তাহার নয়ন কটায়

দিগন্তরের কাঁদন-লুটায় পিঙ্গল তার ত্রস্ত জটায়।’

(প্রলয়োল্লাস, অগ্নিবীণা)

বুদ্ধদেব বসু:

‘ডালে-ডালে কোকিল- দোয়েল বুকের ব্যথা ঝরায় গানের সুরে

দেখেছিলাম তারে অনেক দূরে।

(অরূপ, মর্ম্মবাণী)

সুুধীন্দ্রনাথ দত্ত:

মানসী আজ সম্মুখে মোর বসি

চায় যদি মোর মুখে

নয়নে তার সজল মেঘের মসি

সমবেদন বুকে;

(বর্ষার দিনে, তন্বী)

পাশাপাশি কবিতাগুলো রেখে পড়লে বুঝা যায়, জীবনানন্দের স্বরবৃত্ত ছন্দের গতি অন্যরকম। আলাদা। তিনি যে প্রকৃত অর্থেই আলাদা ছিলেন, এখানেই তার প্রতিবিম্ব ধরা পড়ে।

স্বরবৃত্ত ছন্দকে সাধারণত লঘু চপল ছন্দ বলা হয়। ভাষার গাম্ভীর্য এখানে থাকে না। টাট্টু ঘোড়ার মতো সে ছুটে চলে। লাফিয়ে চলে। কিন্তু জীবনানন্দ দাশের কবিতার উদাহরণগুলো লক্ষ্য করলে এ মন্তব্যের সীমাবদ্ধতা চোখে পড়ে। তিনি ভাষার মৌখিক রূপকেই এখানে চিত্রায়িত করেছেন।

বাংলা কবিতায় স্বরবৃত্ত ছন্দের ব্যবহার পরবর্তী সময়ে নানান কবির হাতে নানান ব্যঞ্জনা লাভ করেছে। আবদুল কাদির স্বরবৃত্ত ছন্দকে ‘বাংলা ভাষার স্বাভাবিক ছন্দ’ বলে যে অভিহিত করেছেন, তা ঠিকই।

হয়তো জরিপ করলে দেখা যাবে, মানুষের স্মৃতিতে সযতেœ রক্ষিত কবিতাগুলোর মধ্যে স্বরবৃত্ত ছন্দের কবিতাই বেশি। এজন্যই হয়তো জীবনানন্দ দাশ শেষ জীবনে তাঁর লেখায় কবিতায় স্বরবৃত্ত ছন্দকে প্রবল ভাবে ফিরিয়ে এনেছেন। যদিও তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘বর্ষ-আবাহন’ কিন্তু স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা।

০৩.

রাত ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে দীপাবলি। জেগে উঠছে পৃথিবী একটি নতুন দিনের সম্ভাবনা নিয়ে। আজকের লেখা এখানে শেষ করি। শুধু পরিশেষে একটি কথা বলা যায়, একজন প্রকৃত যোদ্ধাকে যেমন সব ধরনের অস্ত্র পরিচালনায় সিদ্ধহস্ত থাকতে হয়, তেমনি একজন বড় কবিকেও প্রতিটি ছন্দেই সুনিপুণ দখল থাকতে হয়। আবারও বলি, জীবনানন্দ দাশে নামের সাথে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের নাম আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে। কিন্তু তাঁর সমগ্র কাব্য পর্যালোচনা করলে মাত্রাবৃত্ত বা স্বরবৃত্ত ছন্দের উজ্জ্বল, শক্তিশালী কবিতা খুব সহজেই চোখে পড়বে। ছন্দ কবিতার প্রাণ। মহৎকবিরা যুগে যুগে সেই প্রাণই প্রতিষ্ঠা করে গেছেন কবিতায়।

বৃহস্পতিবার, ০৬ জুন ২০২৪ , ২৬ জৈষ্ঠ্য ১৪৩১ ২৭ জিলক্বদ ১৪৪৫

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় স্বরবৃত্ত

রাকিবুল রকি

image

কেউ যাহা জানে নাই- কোনো এক বাণী-

আমি বহে আনি;

একদিন শুনেছ যে-সুর-

ফুরায়েছে, - পুরানো তা- কোনো এক নতুন-কিছুর

আছে প্রয়োজন,

তাই আমি আসিয়াছি,- আমার মতন

আর নাই কেউ!

[কয়েকটি লাইন : ধূসর পা-ুলিপি]

প্রিয় দীপাবলি,

আর দুয়েক দিন পরেই মাঘসংক্রান্তি। কুয়াশার চাদর জড়ানো জবুথবু রাত অনেক আগেই প্রথম প্রহর পেরিয়ে এসেছে। তীব্র শীত জানি না কেন একাকীত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়? হঠাৎ করেই মনে করিয়ে দেয় কবি জীবনানন্দ দাশের কথা! কেন? জানি না। হয়তো সেও অনেকের মাঝে থেকেও নিজের মুদ্রাদোষে একা হয়ে গিয়েছিল বলে। হয়তো তিনি লিখেছিলেন, ‘এইসব শীতের রাত আমার হৃদয়ে মৃত্যু ডেকে আনে।’ হয়তো এজন্যই তাকে মনে পড়ছে। কিংবা অন্য কোনো কারণে। থাক না কিছু কথা অজানা। সুজিত সরকারের পঙ্ক্তি ধার করে বলতে পারি, ‘অজানায় শুরু, না জানায় শেষ।’ কিংবা তারও আগে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত লিখে গেছেন, ‘অনুমানে শুরু, সমাধা অনিশ্চয়ে।’

আসলেই তো আমরা অনুমান করতে পারি। সমাধান কি আমাদের হাতে? যেমন সমাধান নেই তোমার চাহনির, কাছে এসে কেন দূরে যাও? অথবা যাবেই যদি কেন কাছে আসো? কী উত্তর আছে এ প্রশ্নের? কী উত্তর দেবে তুমি, বলো? যেমন সমাধান নেই কোনো কবি কেন একেক কবিতায় একেক ছন্দ ব্যবহার করেন। তিনি কীভাবে বোঝেন, এই কবিতার জন্য এই ছন্দই ঠিক?

০২.

কিছুদিন আগেই তোমার সাথে কবিতার ছন্দ নিয়ে কথা হচ্ছিল। কথা হচ্ছিল নানান কবিদের নিয়ে। নানান কবিতার ছন্দ নিয়ে। তুমি জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় স্বরবৃত্ত ছন্দের ব্যবহার নিয়ে জানতে চাচ্ছিলে। চিঠির উদ্ধৃতাংশে জীবনানন্দ দাশের এই লাইনগুলো পড়েছে নিশ্চয়। অবশ্যই তা বহুবার পড়া তোমার। জানি। তবে জানো, কাজী নজরুল ইসলাম যেমন ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতার নিজের পরিচয় দিয়েছেন, ‘কয়েকটি লাইন’ও আমার কাছে জীবনানন্দের পরিচয়মূলক কবিতা মনে হয়। মনে হয় তিনি কবিতার নাম ‘কয়েকটি লাইন’ না রেখে অনায়াসে ‘আমার পরিচয়’ রাখতে পারতেন।

তবে কবিতার নাম যা-ই হোক, এটা তাঁর আত্মপরিচয়মূলক কবিতা-ই। তিনি সত্যি তো বাংলা কবিতায় এক অনাস্বাদিত স্বাদ এনে দিয়েছেন। নির্মাণ করেছেন এক স্বতন্ত্র জগৎ। তাঁর মতো আর কেউ নেই। তিনি এক। শুধু কবিতার জগৎ, অবয়ব, শব্দ চয়নে তিনি স্বাতন্ত্র্যিকতার পরিচয় দেননি। ছন্দ নির্মাণে তিনি নিজের স্মারক রেখে গেছেন। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের এলানো ঢঙটা তো এখন জীবনানন্দের নামেই পরিচিত। ভাবতে অবাক লাগে, স্বরবৃত্ত ছন্দের চপল ঘোড়াকেও তিনি শেষপর্যন্ত নিজস্ব মুদ্রায় হাঁটিয়ে ছেড়েছেন। যদিও জীবনানন্দ দাশের কবিতায় স্বরবৃত্ত ছন্দের ব্যবহার খুব বেশি নেই। বিশেষ করে তাঁর সমসাময়িক কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার তুলনায় তাঁর স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা কবিতার সংখ্যা খুবই কম। আবদুল মান্নান সৈয়দকৃত জীবনানন্দ দাশের স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা কবিতাগুলোর তালিকা দিচ্ছি তোমাকে, ‘ঝরা পালক- এর সাতটি কবিতা (‘সাগর-বলাকা’, ‘বনের চাতক-মনের চাতক’, ‘চলছি উধাও’, ‘ছায়া-প্রিয়া’, ‘মিশর’, ‘মরুবালু’, ‘স্মৃতি’); বেলা অবেলা কালবেলার-র দশটি কবিতা (‘তোমাকে’, ‘সময়’, ‘সেতুপথে’, ‘যতিহীন’, ‘শতাব্দী’, ‘প্রয়াণপটভূমি’, ‘নারীসবিতা’, ‘গভীর এরিয়েলে’, ‘পটভূমির’, ‘যদিও দিন’, ‘আজকে রাতে’); শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থার্গত দুটি কবিতা (‘তোমাকে ভালোবেসে’, ‘অনন্দা’); জীবনানন্দ দাশের কবিতা গ্রন্থর্ভূত এগারোটি কবিতা (‘হৃদয়, তুমি’, ‘পটভূমি’, ১১-সংখ্যক কবিতা, ১২-সংখ্যক কবিতা, ১৬-সংখ্যক কবিতা, ‘মনকে আমি নিজে’, ‘রাত্রি, মন, মানবপৃথিবী’, ‘জার্মানির রাত্রিপথে : ১৯৪৫’ ‘সূর্যকরোজ্জ্বলা’, ‘চেতনা-লিখন’, ‘ভোরের কবি জ্যোতির কবি’); সুদর্শনা গ্রন্থর্ভূত পনেরোটি কবিতা (‘তোমায় আমি’, ‘এসো’, ‘অনেক রক্তে’, ‘পৃথিবী, জীবন, সময়’, ‘এখন ওরা’, ‘স্বাতীতারা’, ‘আলোকপাত’, ‘ তোমাকে’, ‘শান্তি ভাল’); মনবিহঙ্গম গ্রন্থর্ভূত দুটি কবিতা (‘জীবন ভালোবেসে’, ‘শতাব্দীর মানবকে’)। [ছন্দ]

এখানে উল্লেখ করা যায় যে, আবদুল মান্নান সৈয়দ ‘ঝরা পালক’-এর ‘সাগরবলাকা’ কবিতাটিকে স্বরবৃত্তে লেখা বললেও মুজিবুল হক কবীর তাতে দ্বিমন পোষণ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আসলে কবিতাটির (সাগরবলাকা) ২০ পঙ্ক্তি স্বরবৃত্তে রচিত, শেষাংশটুকু মাত্রাবৃত্তে রচিত।’

জীবনানন্দ দাশ তাঁর প্রথম কাব্য ‘ঝরা পালক’-এ স্বরবৃত্ত ছন্দের ব্যবহার করলেও ‘ধূসর পা-ুলিপি’, ‘রূপসী বাংলা’, ‘বনলতা সেন’, ‘মহাপৃথিবী’ কিংবা ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যে স্বরবৃত্ত ছন্দের কোনো কবিতা নেই।

‘ঝরা পালক’ কাব্যে জীবনানন্দ তখনও নিজস্ব স্বর খুঁজে পাননি। মোহিতলাল মজুমদার, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, কাজী নজরুল ইসলামের প্রভাব রয়েছে কবিতাগুলোতে। স্বরবৃত্ত ছন্দের চালেও তাঁদের প্রভাব পরিদৃষ্ট হয়।

চলো, ‘ঝরা পালক’ কাব্যে স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা একটি কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি পাঠ করি-

‘বনের চাতক/ বাঁধল বাসা/ মেঘের কিনা/রায়,-

মনের চাতক/ হারিয়ে গেল/ দূরের দুরা/শায়।

ফুঁপিয়ে ওঠে/ কাতর আকাশ/ সেই হতাশার/ ক্ষোভে,-

সে কোন্ বোঁটের/ ফুলের ঠোঁটের/ মিঠা মদের/ লোভে

বনের চাতক/- মনের চাতক/ কাঁদছে অবে/লায়।

(বনের চাতক- মনের চাতক)

পাঁচ স্তবকে বিন্যস্ত কবিতার প্রতি স্তবকে রয়েছে পাঁচটি করে পঙ্ক্তি। পর্ব বিন্যাস হলো

৪ + ৪ + ৪ + ১

৪ + ৪ + ৪ + ১

৪ + ৪ + ৪ + ২

৪ + ৪ + ৪ + ২

৪ + ৪ + ৪ + ১

প্রতি পঙ্ক্তিতে তিনটি করে পূর্ণ পর্ব এবং একটি অপূর্ণ পর্ব রয়েছে। পূর্ণ পর্ব চার মাত্রার, অপূর্ণ পর্ব এক এবং দুই মাত্রার। তবে প্রথম স্তবক বাদে সব স্তবকেই অপূর্ণ পর্ব দুই মাত্রার।

তোমাকে পূর্বেই বলেছি, ‘ঝরা পালক’-এর পরে জীবনানন্দ দাশের ‘ বেলা অবেলা কালবেলা’- তে গিয়ে আবার স্বরবৃত্ত ছন্দের কবিতা পাই। প্রসঙ্গত বলা যায়, ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ কাব্য কবির মৃত্যুর পর ১৯৬১ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ জীবনানন্দ জীবিত অবস্থায় তাঁর কোনো কাব্যে স্বরবৃত্ত ছন্দের কবিতা ঠাঁই পায়নি। চলো, পরবর্তী জীবনে লেখা স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা আরও কিছু পঙ্ক্তি পাঠ করি।

ক.

‘প্রতিটি প্রাণ অন্ধকারে নিজের আত্মবোধের দ্বীপের মতো-

কী এক বিরাট অবক্ষয়ের মানব-সাগরে।

তবুও তোমায় জেনেছি, নারি, ইতিহাসের শেষে এসে; মানবপ্রতিভার

রূঢ়তা ও নিষ্ফলতার অধম অন্ধকারে

মানবকে নয়, নারি, শুধু তোমাকে ভালোবেসে

বুঝেছি নিখিল বিষ কী রকম মধুর হতে পারে।’

( তোমাকে, বেলা অবেলা কালবেলা)

খ.

‘পুরাণপুরুষ, গণমানুষ, নারীপুরুষ, মানবতা, অসংখ্য বিপ্লব

অর্থবিহীন হয়ে গেলে, - তবু আরেক নবীনতর ভোরে

সার্থকতা পাওয়া যাবে ভেবে মানুষ সঞ্চারিত হয়ে

পথে পথে সবের শুভ নিকেতনের সমাজ বানিয়ে

তবুও কেবল দ্বীপ বানাল যে যার নিজের অবক্ষয়ের জলে।’

( যতিহীন, বেলা অবেলা কালবেলা)

গ.

‘যে যার দেহ আত্মা ভালোবেসে অমল জলকণার মতন সমুদ্রকে এক মুঠে

ধ’রে আছে?

ভালো ক’রে বেঁচে থাকার বিশদ নির্দেশে

সূর্যকরোজ্জ্বল প্রভাতে এসে

হিংসা গ্লানি মৃত্যুকে শেষ ক’রে

জেগে আছে?’

(অনন্দা, শ্রেষ্ঠ কবিতা)

ঘ.

মাঝে মাঝে আমার দেশের শিপ্রা, পদ্মা, রেবা, ঝিলম জলশ্রীকে আমি

সর্পীবোনের মতন কোথাও পাহাড় অবধি

অথবা নীল ভূকল্লোলে সাগর সুভাষিত

ক’রতে গিয়ে শুনেছিলাম রাইনের মতো নদী

কি এক গভীর হ্বাইমারী মেঘ সূর্য বাতাস নিয়ে

নর- নারী নগর গ্রামীণতায় ব্যাপ্ত রীতি

লক্ষ্য ক’রে সবিতাসাধ জানিয়েছিল; - তিন দশকের পরে

এ-সব স্বপ্নমিশেল কি এক শূন্য অনুমিতি।

(জার্মানীর রাত্রিপথে : ১৯৪৫)

উদ্ধৃত পঙ্ক্তি নিয়ে কথা বলার আগে আরও কিছু কবির স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা কিছু পঙ্ক্তির পাঠ নেই-

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:

‘হঠাৎ উঠে ঝেঁকে

যায় সে ছুটে কী রাঙা রঙ দেখে

অদৃশ্য কোনও দূর দিগন্ত পারে;

আবছায়া কোন্ সন্ধ্যা আলোয় শিশুরমতো তাকায় অনুমানে,

তাহার ব্যাকুলতা

স্বপ্নে সত্যে মিশিয়ে রচে বিচিত্র রূপকথা।

(অবুঝ মন, পরিশেষ)

কাজী নজরুল ইসলাম:

‘দ্বাদশ রবির বহ্নি জ¦ালা ভয়াল তাহার নয়ন কটায়

দিগন্তরের কাঁদন-লুটায় পিঙ্গল তার ত্রস্ত জটায়।’

(প্রলয়োল্লাস, অগ্নিবীণা)

বুদ্ধদেব বসু:

‘ডালে-ডালে কোকিল- দোয়েল বুকের ব্যথা ঝরায় গানের সুরে

দেখেছিলাম তারে অনেক দূরে।

(অরূপ, মর্ম্মবাণী)

সুুধীন্দ্রনাথ দত্ত:

মানসী আজ সম্মুখে মোর বসি

চায় যদি মোর মুখে

নয়নে তার সজল মেঘের মসি

সমবেদন বুকে;

(বর্ষার দিনে, তন্বী)

পাশাপাশি কবিতাগুলো রেখে পড়লে বুঝা যায়, জীবনানন্দের স্বরবৃত্ত ছন্দের গতি অন্যরকম। আলাদা। তিনি যে প্রকৃত অর্থেই আলাদা ছিলেন, এখানেই তার প্রতিবিম্ব ধরা পড়ে।

স্বরবৃত্ত ছন্দকে সাধারণত লঘু চপল ছন্দ বলা হয়। ভাষার গাম্ভীর্য এখানে থাকে না। টাট্টু ঘোড়ার মতো সে ছুটে চলে। লাফিয়ে চলে। কিন্তু জীবনানন্দ দাশের কবিতার উদাহরণগুলো লক্ষ্য করলে এ মন্তব্যের সীমাবদ্ধতা চোখে পড়ে। তিনি ভাষার মৌখিক রূপকেই এখানে চিত্রায়িত করেছেন।

বাংলা কবিতায় স্বরবৃত্ত ছন্দের ব্যবহার পরবর্তী সময়ে নানান কবির হাতে নানান ব্যঞ্জনা লাভ করেছে। আবদুল কাদির স্বরবৃত্ত ছন্দকে ‘বাংলা ভাষার স্বাভাবিক ছন্দ’ বলে যে অভিহিত করেছেন, তা ঠিকই।

হয়তো জরিপ করলে দেখা যাবে, মানুষের স্মৃতিতে সযতেœ রক্ষিত কবিতাগুলোর মধ্যে স্বরবৃত্ত ছন্দের কবিতাই বেশি। এজন্যই হয়তো জীবনানন্দ দাশ শেষ জীবনে তাঁর লেখায় কবিতায় স্বরবৃত্ত ছন্দকে প্রবল ভাবে ফিরিয়ে এনেছেন। যদিও তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘বর্ষ-আবাহন’ কিন্তু স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা।

০৩.

রাত ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে দীপাবলি। জেগে উঠছে পৃথিবী একটি নতুন দিনের সম্ভাবনা নিয়ে। আজকের লেখা এখানে শেষ করি। শুধু পরিশেষে একটি কথা বলা যায়, একজন প্রকৃত যোদ্ধাকে যেমন সব ধরনের অস্ত্র পরিচালনায় সিদ্ধহস্ত থাকতে হয়, তেমনি একজন বড় কবিকেও প্রতিটি ছন্দেই সুনিপুণ দখল থাকতে হয়। আবারও বলি, জীবনানন্দ দাশে নামের সাথে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের নাম আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে। কিন্তু তাঁর সমগ্র কাব্য পর্যালোচনা করলে মাত্রাবৃত্ত বা স্বরবৃত্ত ছন্দের উজ্জ্বল, শক্তিশালী কবিতা খুব সহজেই চোখে পড়বে। ছন্দ কবিতার প্রাণ। মহৎকবিরা যুগে যুগে সেই প্রাণই প্রতিষ্ঠা করে গেছেন কবিতায়।