সিন্ডিকেট থেকে রেহাই পেতে এক প্রতিষ্ঠানকেই কাজ দেয়া হচ্ছে

কাজ ব্যাহত করতে মরিয়া ১৭ প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেট

একাদশ শ্রেণীর বাধ্যতামূলক তিনটি বই মুদ্রণ ও প্রকাশ নিয়ে এবারও নোট-গাইড ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কবলে পড়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। নোট-গাইড বইয়ের ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে সরকারের বই ছেপে বাজারজাত করতে অনীহা দেখাচ্ছে। চক্রটি মূলত সরকারের ‘রয়্যালিটি’ ফাঁকি দিতেই এই কাজ থেকে বিরত থাকার সিন্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি নকল বই ছাপার প্রস্তুতিও নিচ্ছে চক্রটি। এতে একদিকে এনসিটিবি মোটা অঙ্কের টাকার ‘রয়্যালিটি’ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে; অপরদিকে সিন্ডিকেট থেকে রক্ষা পেতে একটি প্রতিষ্ঠানকে তিনটি বই ছাপার পুরো কাজ দিতে বাধ্য হচ্ছে।

এ ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা সংবাদকে বলেছেন, ‘কোন সিন্ডিকেটেই কাজ ব্যাহত হবে না। আমরা বিধি-বিধান অনুযায়ী অগ্রণী প্রিন্টার্সকে পুরো কাজ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাদের সক্ষমতাও রয়েছে। তারা ১ জুলাইয়ের আগে এক সপ্তাহেই ১৬ লাখ কপি বই ছেপে বাজারে বিতরণ করতে পারবে। শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত মূল্যে নতুন বই কিনতে পারবে।’

আগামী ১ জুলাই উচ্চমাধ্যমিকের প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক বাংলা, বাংলা সহপাঠ ও ইংরেজি বই মুদ্রণ ও প্রকাশের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে পারেনি এনসিটিবি। কারণ যে প্রতিষ্ঠানকে বই ছাপার কাজ দেয়া হয়েছে, তারা গতকাল পর্যন্ত ‘রয়্যালিটি’ পরিশোধ করেনি। তিনটি বই মুদ্রণকারীদের কাছে মুদ্রণের স্বত্ব দিয়ে নির্ধারিত অংকের টাকার রয়্যালিটি আদায় করে। এসব বই ছেপে সরকার অনুমোদিত মূল্যে খোলাবাজারে বিক্রি করতে এনসিটিবি ইতোমধ্যে দরপত্র আহ্বান করলেও প্রকাশকরা সঙ্গবদ্ধভাবে তা বর্জন করেছে। এতে বেশ বেকায়দায় পড়েছে এনসিটিবি; কারণ দরপত্র প্রতিযোগিতামূলক হয়নি। এই সুযোগে এক শ্রেণীর অসাধু প্রকাশক নকল বই ছেপে বাজার দখলের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনসিটিবির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে নোট-গাইড বই ব্যবসায়ীদের একটি সিন্ডিকেট (১৭টি প্রতিষ্ঠান) একাদশ শ্রেণীর বইয়ের একচেটিয়া বাণিজ্য করে আসছিল। তারা রয়্যালিটি ফাঁকি দেয়ার লক্ষ্যে ১৫/১৬ লাখ কপি বই বিক্রি করে এনসিটিবি’কে জানাতো ৫/৬ লাখ কপি বই বিক্রি হয়েছে, বাকি বই বিক্রি হয়নি। বইপ্রতি সরকারকে ১৭ পার্সেন্ট টাকা দিতে হয়। এবারও ওইসব প্রতিষ্ঠান একই অপকর্ম করতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা ব্যর্থ হচ্ছে।’

ওই ১৭ প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেট সরকারের কাজ ব্যাহত করার চেষ্টা চালাচ্ছে অভিযোগ করে এনসিটিবির ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘এনসিটিবির কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তার সহায়তায় ওই চক্রটি এবার বই ছাপার দরপত্র বর্জন করলেও চারটি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নেয়। এর মধ্যে ওই ১৭ প্রতিষ্ঠানের অদৃশ্য চাপে দরপত্রে অংশ নিয়েও তিনটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা না দিয়ে কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করে। এতে এনসিটিবি অপর প্রতিষ্ঠানকে (অগ্রণী প্রিন্টার্স, চৌমুহনী, নোয়াখালী ও ঢাকা) এককভাবে তিনটি বইয়ের প্রায় ১৫ লাখ কপি মুদ্রণ ও বাজারজাতকরণের কার্যাদেশ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’

এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, মোট ২৪টি লটে বই ছাপা হচ্ছে। প্রথম পর্যায়ে ১৫ লাখ কপি বই মুদ্রণ ও বাজারজাতকরণের কার্যাদেশ দিয়ে এনসিটিবি তিন কোটি টাকারও বেশি ‘রয়্যালিটি’ পাচ্ছে। অগ্রণী প্রিন্টার্স ১ জুলাইয়ের মধ্যে ১৫ লাখ কপি বই মুদ্রণ ও বাজারজাতকরণ করবে। পরবর্তীতে চাহিদা অনুযায়ী আরও বই মুদ্রণ করলে ১৭ শতাংশ হারে সরকারকে আগাম ‘রয়্যালিটি’ দেবে।

জানা গেছে, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের উচ্চমাধ্যমিকের বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা (বাণিজ্য) ও মানবিক শাখার শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক বাংলা, বাংলা সহপাঠ ও ইংরেজি বই ছাপা ও বিতরণ-বিক্রয়ের জন্য যথাসময়েই টেন্ডার (দরপত্র) আহ্বান করে এনসিটিবি। নোট-গাইড বইয়ের ব্যবসায়ীরা সঙ্গবন্ধভাবে এই দরপত্র বর্জন করে। সারা দেশের মাত্র চারটি মুদ্রণ ও বিপণন প্রতিষ্ঠান তাতে অংশ নেয়। ২১টি প্যাকেজে প্রায় ৩০ লাখ কপি বই মুদ্রণের জন্য দরপত্র জমা দেয়া তিনটি প্রতিষ্ঠান নানা অজুহাত দেখিয়ে কাজ করতে অপরাগতা প্রকাশ করে দরপত্র জমা দেয়নি। একমাত্র অগ্রণী প্রিন্টার্স দরপত্র জমা দেয়।

এ ব্যাপারে এনসিটিবির অপর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে বলেন, ‘যারা সিন্ডিকেট করে এনসিটিবিকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছে আগামীতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপার কাজেও ওইসব প্রতিষ্ঠানকে বিরত রাখার চেষ্টা করা হবে।’

রবিবার, ০৯ জুন ২০১৯ , ২৬ জৈষ্ঠ্য ১৪২৫, ৫ শাওয়াল ১৪৪০

একাদশ শ্রেণীর বই মুদ্রণ ও বিপণন

সিন্ডিকেট থেকে রেহাই পেতে এক প্রতিষ্ঠানকেই কাজ দেয়া হচ্ছে

কাজ ব্যাহত করতে মরিয়া ১৭ প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেট

রাকিব উদ্দিন

একাদশ শ্রেণীর বাধ্যতামূলক তিনটি বই মুদ্রণ ও প্রকাশ নিয়ে এবারও নোট-গাইড ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কবলে পড়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। নোট-গাইড বইয়ের ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে সরকারের বই ছেপে বাজারজাত করতে অনীহা দেখাচ্ছে। চক্রটি মূলত সরকারের ‘রয়্যালিটি’ ফাঁকি দিতেই এই কাজ থেকে বিরত থাকার সিন্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি নকল বই ছাপার প্রস্তুতিও নিচ্ছে চক্রটি। এতে একদিকে এনসিটিবি মোটা অঙ্কের টাকার ‘রয়্যালিটি’ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে; অপরদিকে সিন্ডিকেট থেকে রক্ষা পেতে একটি প্রতিষ্ঠানকে তিনটি বই ছাপার পুরো কাজ দিতে বাধ্য হচ্ছে।

এ ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা সংবাদকে বলেছেন, ‘কোন সিন্ডিকেটেই কাজ ব্যাহত হবে না। আমরা বিধি-বিধান অনুযায়ী অগ্রণী প্রিন্টার্সকে পুরো কাজ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাদের সক্ষমতাও রয়েছে। তারা ১ জুলাইয়ের আগে এক সপ্তাহেই ১৬ লাখ কপি বই ছেপে বাজারে বিতরণ করতে পারবে। শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত মূল্যে নতুন বই কিনতে পারবে।’

আগামী ১ জুলাই উচ্চমাধ্যমিকের প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক বাংলা, বাংলা সহপাঠ ও ইংরেজি বই মুদ্রণ ও প্রকাশের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে পারেনি এনসিটিবি। কারণ যে প্রতিষ্ঠানকে বই ছাপার কাজ দেয়া হয়েছে, তারা গতকাল পর্যন্ত ‘রয়্যালিটি’ পরিশোধ করেনি। তিনটি বই মুদ্রণকারীদের কাছে মুদ্রণের স্বত্ব দিয়ে নির্ধারিত অংকের টাকার রয়্যালিটি আদায় করে। এসব বই ছেপে সরকার অনুমোদিত মূল্যে খোলাবাজারে বিক্রি করতে এনসিটিবি ইতোমধ্যে দরপত্র আহ্বান করলেও প্রকাশকরা সঙ্গবদ্ধভাবে তা বর্জন করেছে। এতে বেশ বেকায়দায় পড়েছে এনসিটিবি; কারণ দরপত্র প্রতিযোগিতামূলক হয়নি। এই সুযোগে এক শ্রেণীর অসাধু প্রকাশক নকল বই ছেপে বাজার দখলের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনসিটিবির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে নোট-গাইড বই ব্যবসায়ীদের একটি সিন্ডিকেট (১৭টি প্রতিষ্ঠান) একাদশ শ্রেণীর বইয়ের একচেটিয়া বাণিজ্য করে আসছিল। তারা রয়্যালিটি ফাঁকি দেয়ার লক্ষ্যে ১৫/১৬ লাখ কপি বই বিক্রি করে এনসিটিবি’কে জানাতো ৫/৬ লাখ কপি বই বিক্রি হয়েছে, বাকি বই বিক্রি হয়নি। বইপ্রতি সরকারকে ১৭ পার্সেন্ট টাকা দিতে হয়। এবারও ওইসব প্রতিষ্ঠান একই অপকর্ম করতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা ব্যর্থ হচ্ছে।’

ওই ১৭ প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেট সরকারের কাজ ব্যাহত করার চেষ্টা চালাচ্ছে অভিযোগ করে এনসিটিবির ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘এনসিটিবির কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তার সহায়তায় ওই চক্রটি এবার বই ছাপার দরপত্র বর্জন করলেও চারটি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নেয়। এর মধ্যে ওই ১৭ প্রতিষ্ঠানের অদৃশ্য চাপে দরপত্রে অংশ নিয়েও তিনটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা না দিয়ে কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করে। এতে এনসিটিবি অপর প্রতিষ্ঠানকে (অগ্রণী প্রিন্টার্স, চৌমুহনী, নোয়াখালী ও ঢাকা) এককভাবে তিনটি বইয়ের প্রায় ১৫ লাখ কপি মুদ্রণ ও বাজারজাতকরণের কার্যাদেশ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’

এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, মোট ২৪টি লটে বই ছাপা হচ্ছে। প্রথম পর্যায়ে ১৫ লাখ কপি বই মুদ্রণ ও বাজারজাতকরণের কার্যাদেশ দিয়ে এনসিটিবি তিন কোটি টাকারও বেশি ‘রয়্যালিটি’ পাচ্ছে। অগ্রণী প্রিন্টার্স ১ জুলাইয়ের মধ্যে ১৫ লাখ কপি বই মুদ্রণ ও বাজারজাতকরণ করবে। পরবর্তীতে চাহিদা অনুযায়ী আরও বই মুদ্রণ করলে ১৭ শতাংশ হারে সরকারকে আগাম ‘রয়্যালিটি’ দেবে।

জানা গেছে, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের উচ্চমাধ্যমিকের বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা (বাণিজ্য) ও মানবিক শাখার শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক বাংলা, বাংলা সহপাঠ ও ইংরেজি বই ছাপা ও বিতরণ-বিক্রয়ের জন্য যথাসময়েই টেন্ডার (দরপত্র) আহ্বান করে এনসিটিবি। নোট-গাইড বইয়ের ব্যবসায়ীরা সঙ্গবন্ধভাবে এই দরপত্র বর্জন করে। সারা দেশের মাত্র চারটি মুদ্রণ ও বিপণন প্রতিষ্ঠান তাতে অংশ নেয়। ২১টি প্যাকেজে প্রায় ৩০ লাখ কপি বই মুদ্রণের জন্য দরপত্র জমা দেয়া তিনটি প্রতিষ্ঠান নানা অজুহাত দেখিয়ে কাজ করতে অপরাগতা প্রকাশ করে দরপত্র জমা দেয়নি। একমাত্র অগ্রণী প্রিন্টার্স দরপত্র জমা দেয়।

এ ব্যাপারে এনসিটিবির অপর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে বলেন, ‘যারা সিন্ডিকেট করে এনসিটিবিকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছে আগামীতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপার কাজেও ওইসব প্রতিষ্ঠানকে বিরত রাখার চেষ্টা করা হবে।’