প্রবৃদ্ধি অর্জন নির্ভর করছে সরকারি ও ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের ওপর

এবারের বাজেট গতানুগতিক ও চমকহীন। বাজেটের আকার ৫ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা। তাই অনেকে বলছেন, এই বাজেট অনেক বড় বা ইতিহাসে এমন বাজেট আর হয়নি। এটা রেকর্ড! বিষয়টি এমন নয়। কারণ এই বাজেট জিডিপির প্রায় ১৮ শতাংশ বা একদম ঠিক বললে ১৮.১ শতাংশ। এই অনুপাতটি নির্ণয় করা হয়েছে ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮.২ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা ঠিক ধরে। অর্থাৎ আগামী প্রবৃদ্ধি যদি ৮.২ শতাংশ হয়, তাহলে এই বাজেট অনুপাতটি ঠিক আছে। তবে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ যারা মধ্যম আয়ের দেশ হতে যাচ্ছে, সেসব দেশে এর চেয়েও বড় বাজেট হয়। যেমন- অনেক দেশে জিডিপির প্রায় ২৫ বা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত আকারের সরকারি ব্যয় হয়। ওই হিসাবে আমরা এখনও সঠিক আয়তনের বাজেটই করতে পারছি না। তাই বাজেট অনেক বড় হয়েছে, এমন যুক্তি ধোপে টেকে না। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আগামী বছরে প্রবৃদ্ধি যে ৮.২ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, তা বাস্তবায়িত হবে কি না। এটা দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে। এক. সরকারি বিনিয়োগ এবং দুই. ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ দীর্ঘদিন ধরে জিডিপির ২৪ শতাংশই আছে। বাড়ছে না। তাই ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ যদি এবারও তেমন না বাড়ে, তাহলে এই খাতে বাড়তি কোন উদ্যোগ দেখতে পাব না। আর সরকারি বিনিয়োগ উন্নয়ন বাজেটে ২ লাখ কোটি টাকার উপরে ধরা হয়েছে। এটাও নির্ভর করবে সরকারের প্রস্তাবিত বাজেটে যে ঘাটতি রয়েছে, তা পূরণ হচ্ছে, কি হচ্ছে না- এর ওপর। কোন কোন অর্থনীতিবিদ মনে করেন, বাজেটে যে ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে, তা পূরণ সম্ভব হবে না।

বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ঘাটতির ৪৮ শতাংশ বা প্রায় অর্ধেক বিদেশি ঋণের মাধ্যেমে পূরণ করা হবে। এই ৪৮ শতাংশ পূরণের বিষয়টি নির্ভর করবে বর্তমানে পাইপলাইনে যে বিদেশি সাহায্য জমা হয়ে আছে, তা অবমুক্ত হবে, কী হবে নাÑ এর ওপর। যেহেতু পাইপলাইনে আছে, সেহেতু ধরে নিতে পারি, আমরা সেটি পাব। তবে এখানে কথা হলো, সেটি সময়মতো পাব, কী পাব না। কারণ প্রতিটি বৈদেশিক সাহায্যের সঙ্গে একটা মনিটরিং ব্যবস্থা আছে, কয়েকটি তথ্য আদান-প্রদানের বিষয় আছে, ‘দর কষাকষির’ (ঘবমড়ঃরধঃরড়হ) বিষয় আছে। এগুলোয় যদি কোন সমস্যা তৈরি হয়, তাহলে বিদেশি দাতারা এখন আর ঋণ অবমুক্ত করতে রাজি হন না। এখানে সরকারের নোগোশিয়েশনের দক্ষতার ওপর নির্ভর করবে, ওই সাহায্যটি পাবে, কী পাবে না। যেহেতু এটি দক্ষতার সঙ্গে নেগোশিয়েশনের ওপর নির্ভর করবে, সেহেতু আমরা আশঙ্কা করছিÑ ঘাটতির ৪৮ শতাংশ বিদেশি ঋণের কতটা পাব তা অনিশ্চিত। আর নতুন সাহায্যের কথা যদি বলি, তাহলে সেটিও অনেক কঠিন। কারণ তাদের কাছে নতুন সাহায্য চাইলে তারা বলবেন, পাইপলাইনে যেটি আছেÑ সেটি আগে নাও, তারপর নতুন সাহায্য দেয়া হবে। তাই বৈদেশিক সাহায্য দিয়ে ঘাটতি পূরণের বিষয়টি অনিশ্চিতই রয়ে গেল। তাছাড়া বাংলাদেশের উন্নয়ন স্টেটাস উপরে উঠে যাওয়ায় বিদেশিরা এখন বাংলাদেশের বদলে আফ্রিকার দেশগুলোকে বেশি পছন্দ করছেন।

দ্বিতীয় যে খাত থেকে ঘাটতি পূরণের কথা বলা হয়েছে, তা হলো ব্যাংকিং খাত। এই খাত থেকে ৩৩ শতাংশ ঘাটতি পূরণ করা হবে। সরকার নির্ধারণ করেছে, এই খাত থেকে ৪৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেবে। এখন প্রশ্ন হলো সরকার যে ৪৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেবে, তা দেশের ব্যাংকি খাতের দেয়ার ক্ষমতা আছে কি না। সরকার হয়তো ধরেই নিয়েছে, ব্যাংকের ওই ক্ষমতা আছে। কিন্তু ব্যাংকের মালিকরা বলছে, সরকার যদি ব্যাংক থেকে এই পরিমাণ ঋণ নেয়, তাহলে ব্যাংকেররই ঋণ দেয়ার আর ক্ষমতা থাকবে না। আর এমনিতেই ব্যাংক খাতের যে অবস্থা, এতে সরকার যদি ঋণ নেয়- তাহলে তারল্য সংকট আরও প্রকট হবে, ইংরেজিতে যেটিকে বলে ‘ক্রাউডিং ইফেক্ট’ (Crowding Effect), সেটি ত্বরান্বিত হবে। তখন ব্যাংকগুলো আর কাউকেই ঋণ দিতে পারবে না। অর্থাৎ সরকারের প্রস্তাবিত ঋণ নেয়ার প্রধান যে দুটি উৎস, ওই দুটি উৎসই অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে।

তৃতীয় যে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে সরকার অর্থ নিতে চাচ্ছে, তা হলো সঞ্চয়পত্র বিক্রি। সম্প্রতি সঞ্চয়পত্রের সুদের হার সরকার কমিয়েছে এবং সঞ্চয়পত্রের আয়ের ওপর করের হারও বাড়িয়েছে। তাই সঞ্চয়পত্র থেকে টাকা ধার করলে এর যে পরিব্যয় ছিল, তা কিছুটা কমেছে। ফলে এই খাত থেকে সরকার ঋণ/অর্থ নিতে বা সংগ্রহ করতে পারে। কিন্তু যতই চাপ কম হোক- অতীতের যে ঋণ ভার, তা আরও বেড়ে যাবে। কারণ দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছর অতীতের ঋণের সুদ পরিশোধ করতেই বাজেটের প্রায় ১১ থেকে ১৪ শতাংশ চলে যায়। তাহলে বাজেট তো ৫ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা থাকল না। প্রস্তাবেই স্বীকার করে নেয়া হয়েছে, ৫৭ হাজার ৭০ কোটি টাকা সুদ দিতে হবে সরকারকে। এ জন্য ঘাটতি পূরণের এই চ্যালেঞ্জগুলো আছে। সরকার এ চ্যালেঞ্জগুলো কীভাবে মোকাবিলা করে, সেটি দেখার বিষয়।

বাজেটে আরেকটি নতুন জটিলতা আছে। তা হলো, প্রতিবারই সরকারের আয়ের প্রধান উৎস থাকে অপ্রত্যক্ষ কর থেকে। এবারও তা রয়েছে। আগে অপ্রত্যক্ষ করের অনুপাত ধরা হয়েছিল ৬৭ শতাংশ। এবার ১ শতাংশ কমিয়ে ধরা হয়েছে ৬৬ শতাংশ। তা আসবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে এনবিআর থেকে। আর হয়তো ৩০-৩৩ শতাংশ আসবে আয়কর ও সম্পদ কর থেকে। কিন্তু মৌলিকভাবে এ অনুপাতটিই অন্যায়। কারণ সরকার ধনীদের কাছ থেকে প্রত্যক্ষভাবে নিচ্ছে ৩০-৩৩ শতাংশ আর যারা প্রধানত অধনী মানুষ, তাদের কাছ থেকে নিচ্ছে ৬৬ শতাংশ। অর্থাৎ সরকার তার আয়ের জন্য নির্ভর করছে প্রধানত অধনীদের ওপর। এরপরও বেশি সুবিধা দিচ্ছে ধনীদের।

এখন আমরা এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে যদি বলি, যে সরকার সাধারণ মানুষের কাছে থেকে যে টাকাটা নিচ্ছে, তা দিয়ে অনেক মেগাপ্রকল্প করছে। সেগুলোয় তো সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে। হ্যাঁ, হবে। কিন্তু তা হবে আজ থেকে প্রায় ১০-১৫ বছর পর। তবে আজ সাধারণ মানুষ যে টাকাটা দিচ্ছে, তা তো যাচ্ছে মেগাপ্রকল্পের কন্ট্রাক্টরের পকেটে। তাও যদি তারা এ টাকাটা দক্ষতার সঙ্গে ব্যয় করতেন, তাহলে আমরা বলতে পারতাম- এখন না উপকার পেলেও আমরা তা যথাযথ মাত্রায় পরে পাব। কিন্তু জনগণের কষ্টের টাকা দক্ষতার সঙ্গে ব্যয় হচ্ছে না। এ টাকার একটা ভাগাভাগি আছে। মেগাপ্রকল্পগুলোয় যারা দায়িত্বে আছেন, (সামরিক, বেসামরিক, প্রশাসন) তারা কিছুটা পাচ্ছেন। আর কিছু পাচ্ছেন দেশি কন্ট্রাক্টররা আর বৈদেশিক কন্ট্রাক্টররা। এটিকে আমরা সরল ভাষায় বলি আংশিক দুর্নীতি। আর কিছুটা অপচয় হচ্ছে অদক্ষতার কারণে। যারা দায়িত্বে আছেন, তারা বুঝতেই পারছে না এই ব্যয় কীভাবে বাড়ছে। ফলাফল দেখে আমরা তা বুঝতে পারছি না। আমরা দেখছি, উন্নত বিশ্বসহ ভারতে, চীনে যে ব্যয়- এর চেয়ে আমাদের দেশের রাস্তা তৈরির খরচ তিনগুণ বেশি। যুক্তি দেখানো হচ্ছে, আমাদের দেশে জমি অধিগ্রহণে বেশি ব্যয় হয়। এই যুক্তি হয়তো মেনেই নিলাম। কিন্তু সময়ও তো বেশি লাগছে। ব্যয় যদি ন্যায়সঙ্গত হয়, তাহলে সময়টা এত বেশি লাগছে কেন! যদি আমি ঠিকমতো ব্যয় করি, তাহলে ঠিকমতোই কাজটি হওয়ার কথা। সময় বেশি লাগলে যে সমস্যাটা হয়- প্রতি বছর তো মুদ্রাস্ফ্রীতি হচ্ছে। ফলে একই জিনিসে এমনিতেই বেশি দাম দিতে হচ্ছে। এর ফল হিসেবে আমরা দেখছি, সময় বেশি লাগছে অদক্ষতার জন্য আর ব্যয় বাড়ছে অংশত অদক্ষতা ও অংশত দুর্নীতির কারণে। ইংরেজিতে যেটিকে বলা হয়, কস্ট ওভাররান (Cost Overrun) ও টাইম ওভাররান (Time Overrun)। সরকার বলবে, সাধারণ জনগণের জন্য মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প দিয়ে, পদ্মা সেতু দিয়ে, মেট্রোরেল দিয়ে তা জনগণকেই ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। হ্যাঁ, সেটি ফিরিয়ে দিচ্ছে সরকার। তবে অনেক দেরিতে, অনেক বেশি ব্যয়ে এবং তা থেকে টোল আদায় করবেও বেশি, বিদ্যুতের বিল তো বাড়াবেই। অন্যদিকে ধনীরা বলছেন, আমাদের আরও সুবিধা দিতে হবে, শুল্ক রেয়াত দিতে হবে, কর রেয়াত দিতে হবে, নগদ প্রণোদোনা দিতে হবে এবং সরকার সেগুলো দিচ্ছেও। যেমন পোশাক শিল্পে নগদ সহায়তা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই নগদ সহায়তা শ্রমিকরা পাচ্ছেন কি?

সরকার বলেছে, শ্রমিক কল্যাণ ফান্ড আছে। এর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক-অআনুষ্ঠানিক সব খাতের কোটি কোটি শ্রমিককে নগদ সাহায্য দেয়া হবে। এই শ্রমিক কল্যাণ ফান্ডে মুনাফা থেকে শ্রমিকদের জন্য মালিকদের অর্থ দেয়ার বিধান আছে। সাধারণত যদি ১০০ ডলার রপ্তানি হয়, তাহলে মাত্র ১ থেকে ৩ সেন্ট শ্রমিক কল্যাণ ফান্ডে জমা হয়। এটা খুবই নগণ্য অ্যামাউন্ট। এই নগণ্য অ্যামাউন্টের কারণে এই ফান্ড থেকে ব্যয়ও হয় খুবই কম। অর্থমন্ত্রী এবার নিজেই বাজেট বক্তৃতায় (পৃ.-৩৬) বলেছেন, ২০১২ সালের পর থেকে ৬ হাজার শ্রমিককে আমরা মাত্র ২৮ কোটি টাকা দিয়েছি। কিন্তু তারা যে অবদান রেখেছেন, এর থেকে এটা খুবই কম নয় কি? একইভাবে কৃষকরাও বলতে পারেন, এবার ধানে আমাদের যে লোকসান হলো, কীভাবে আমাদের তা পুষিয়ে দেবেন। এই লোকসানের জন্য তো আমরা দায়ী নই। আপনার নীতি দায়ী। আপনি ঠিক করেছেন, আপনি চাল কিনবেন মিল মালিকদের কাছে থেকে। আর মিল মালিকরা কৃষকদের বলেছেন, তোমার ধান ভালোমতো শুকানো নয়, ধানে অর্ধেক পানি আছে। তাই সেটি আমরা অর্ধেক দামে কিনব। কিন্তু সরকার যদি সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনত, তাহলে সঠিক সময় সঠিক দামে সরকারও কিনতে পারত আর কৃষকরাও সঠিক দামে বিক্রি করতে পারতেন। ভারতে এমন সিস্টেম আছে। সেখানে স্বসাহায্যকারী একটি গ্রুপ থাকবে, যেখানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কয়েক কৃষক তাদের ধানগুলো সংগ্রহ করে সরকারকে বলবেÑ আমরা ধান সংগ্রহ করেছি, আপনি কিনতে পারেন। প্রত্যেক কৃষকের ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকবে। ওই অ্যাকাউন্টে সরকার দাম হিসাব করে অগ্রিম টাকা পাঠিয়ে দেবে। যেমনটি ন্যাশানাল ব্যাংকের মাধ্যমে স্বপ্ন চেইন স্টোর ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশেও শুরু করেছে। এটা হলে যে গোষ্ঠী কৃষকের অসহায় সময় কম টাকা দিয়ে ধান কেনে, তারা তা পারবে না। এবার কৃষক যেভাবে লোকসান করেছেন, পরের বছর তো তারা ধান চাষ নাও করতে পারেন। সরকার যদি কৃষকদের জন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থা করত, তাহলে বলা যেতÑ সরকার যাদের কাছে থেকে টাকা নিচ্ছে, তাদের ফেরত সেবা দিচ্ছে। কিন্তু সরকার তাদের দিকে নজর না দিয়ে যারা ধনী বা পাওয়ারফুল, তাদের সুবিধার দিকে বেশি নজর দিচ্ছে।

ব্যবসায়ীদের কথায় ভ্যাট আইনে কত মারপ্যাঁচ করতে অবশেষে বাধ্য হলো সরকার। যেমনÑ পাওয়ারফুলদের দাবি ছিল, ভ্যাটটিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে দিতে হবে। নতুন আইনে তা করাও হয়েছে। এটা করার ফলে এখন প্রশ্ন আসবে, কার কত টার্নওভার থাকলে কী পরিমাণ ভ্যাট দেবেন বা কোন কোম্পানির কোন পণ্যে কত ভ্যাট দেবেন? এখন কত টার্নওয়ার বা কোন পণ্য, সেটি ঠিক করতে হবে এনবিআরকে। এটা একটা জটিল প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে অনেক পাওয়ারফুল ভ্যাট ফাঁকি দেবে। কিন্তু একটা রেট থাকলে এই সমস্যাগুলো থাকত না। তবে এক রেট থাকলে সবার প্রতি ন্যায়বিচার প্রয়োগে কিছুটা সমস্যা হতো। তবে সেটি তেমন বড় ধরনেন সমস্যা হতো না, বরং এখনই ওই আইন প্রয়োগ করতে সমস্যা হবে বেশি। তখন ভ্যাট থেকে আয় কমেও যেতে পারে এবং বাজেটে ঘাটতি পূরণ তখন হবে না।

সরকার ঋণখেলাপিদের বিষয়ে বলেছে, দুই ধরনের ঋণখেলাপিকে চিহ্নিত করা হবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ও অইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। এখন কোনটা ইচ্ছাকৃত আর কোনটা অনিচ্ছাকৃত, সেটি কে চিহ্নিত করবেন। আমরা অতীতে দেখেছি, এটি চিহ্নিত করা খুবই কঠিন। যারা ১০০ কোটি টাকা ঋণখেলাপি করেছেন, তারা যদি ২ শতাংশ পরিশোধ করেন, তাদের ঋণখিলাপির অপবাদ থেকে রেহাই দেয়া হয়Ñ তাহলে ঋণখেলাপি আসলে কমবে না। আর বৈধ টাকায় যে পরিমাণ কর আর কালো টাকাতেও যদি সমান কর দেয়, তাহলেও দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন হবে না। এ জন্য বাজেটের ন্যায়-নীতি নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।

বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী জানান, কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ দেয়ার কারণ হলো, যাদের কাছে কালো টাকা আছেÑ তা যেন বের করে। তাহলে অন্তত টাকাটা কাগজ-কলম বা হিসাবে আসবে। নয়তো এই টাকা তারা বিদেশে পাচার করে দেবে। প্রধানমন্ত্রীর যুক্তি অনুযায়ী সত্যিই কি কালো টাকার মালিকরা সাড়া দেবে? কালো টাকার অতীত ইতিহাস বলে, এই সুযোগেও কালো টাকা বের করা হয়নি। একমাত্র ২০০৭ সালে যখন ফখরুদ্দীন-মঈন উদ্দীন সরকার এলো তখনই কালো টাকাগুলো কিছুটা বের হয়েছিল। এছাড়া অন্য কোন সরকারের সময় কালো টাকা তেমন একটা বের হয়নি। এর মানে হচ্ছে, সুবিধা দিলেই কালো টাকা বের হবে না। এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে হবেÑ যেন কালো টাকা বের করতে তারা বাধ্য হন। কালো টাকার মালিকরা যেন বুঝতে পারেন, আমি যদি কালো টাকা বের না করিÑ তাহলে আমার ঘাঁড় ধরে কালো টাকা বের করে নেয়া হবে। আমার মার্সিডিজ ব্র্যান্ডের গাড়ি যদি কালো টাকায় কিনে থাকি, তাহলে আমি যেন ওই গাড়ি রাস্তায় নামাতে না পারি। রাস্তায় নামলেই যেন ওই গাড়ি ধরা পড়ে। তাহলেই কালো টাকার মালিকরা বাধ্য হয়েই গাড়ি ফেলে পালাবেন বা যার কাছে যত টাকা আছে, তা বের করে দেবেন। প্রধানমন্ত্রী যদি ওই সুযোগের সঙ্গে এই হুমকিটাও দিতেনÑ এটিই শেষ সুুযোগ। এরপরও যদি কেউ কালো টাকা বের না করেন, তাহলে পরে আর সুযোগ পাবেন না এবং কালো টাকা ধরা পড়লে শায়েস্তা করা হবে, তাহলে এটাকে সমর্থন করতাম এবং অপেক্ষায় থাকতাম দেখার জন্য কতজন রাঘববোয়ালকে তিনি অবশেষে ধরলেন? কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস ও করুন পরিণতি থেকে দেখা যায়, কঠোর হতে বেশি দেরি করলে শত্রুরা আগে ছোবল মারতে দ্বিধা করে না।

অনেকে বলেন, ব্যবসায়ীদের মূল দাবি ছিল, করপোরেট ট্যাক্স কমানো। কিন্তু বাজেটে তা কমানো হয়নি। এই প্রসঙ্গে আমার মত হচ্ছে, বাজেটে কোথাও ধনীদের সুবিধা দেয়া হয়েছে, কোথাও গরিবদের সুবিধা দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাজেটের সামগ্রিক চেহারা যে ধনী মুখাপেক্ষী, তা পরিবর্তন হয়নি। যেমনÑ সাধারণ অধনী জনগণকে ৬৬ শতাংশ কর দিতে হয় আর ধনীদের দিতে হয় মাত্র ৩২-৩৩ শতাংশ। এতে তো কোন পরিবর্তন হয়নি। কারণ আমাদের বেসিক স্ট্রাকচারে যে বৈষম্য আছে, তা পরিবর্তন হয়নি।

এসডিজির ১০ নম্বর অভীষ্টের প্রথম ধারায় বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে আয়ের দিক থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে অবস্থানকারী ৪০ শতাংশ জনসংখ্যার আয়ের প্রবৃদ্ধি হার পর্যায়ক্রমে জাতীয় গড় আয়ের চেয়ে বেশি অর্জন করতে হবে এবং এই ধারা অব্যহত রাখতে হবে। এই অভীষ্ট পূরণের জন্য বাজেট কতটা প্রাসঙ্গিকÑ এই বিষয়ে তিনি বলেন, দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্য হ্রাস হচ্ছে। হয়তো একটা সময় দারিদ্র্য নিমূল হবে। এটা নিয়ে আমার বিতর্ক নেই। এ ধরনের বাজেটেই সেটি হবে। অতীতেও হয়েছে। কিন্তু আয়বৈষম্য কমবে কি না, সেটিই দেখার বিষয়। এসডিজিতে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে, দরিদ্রদের আয় বৃদ্ধির হার ধনীদের চেয়ে বেশি হবে। তাই এ ধরনের বাজেটে এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়।

প্রস্তাবিত বাজেট প্রস্তুতকরণে সরকার প্রভাবশালী কোন পক্ষের চাপ অনুভব করেছিল কি না- এমন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা অনেকখানি নির্ভর করে সরকার কাদের ওপর নির্ভর করে দেশ চালাচ্ছে, এর ওপর। সরকার তো বর্তমান সংসদের ওপর নির্ভর করে চলছে। আর এবারের সংসদে যারা আছেন বা এসেছেন, তাদের ৬৫ শতাংশই ব্যবসায়ী। আওয়ামী লীগ দলের অতীত গণচরিত্র ও বর্তমান চরিত্র এক নয়। তাছাড়া সংসদে যেহেতু ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বেশি আছে, সেহেতু বাজেট তৈরিতে তাদের প্রভাব বেশি থাকবেÑ এটিই স্বাভাবিক।

সোমবার, ১৭ জুন ২০১৯ , ৩ আষাঢ় ১৪২৫, ১৩ শাওয়াল ১৪৪০

বাজেট পর্যালোচনা

প্রবৃদ্ধি অর্জন নির্ভর করছে সরকারি ও ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের ওপর

এম.এম আকাশ

এবারের বাজেট গতানুগতিক ও চমকহীন। বাজেটের আকার ৫ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা। তাই অনেকে বলছেন, এই বাজেট অনেক বড় বা ইতিহাসে এমন বাজেট আর হয়নি। এটা রেকর্ড! বিষয়টি এমন নয়। কারণ এই বাজেট জিডিপির প্রায় ১৮ শতাংশ বা একদম ঠিক বললে ১৮.১ শতাংশ। এই অনুপাতটি নির্ণয় করা হয়েছে ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮.২ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা ঠিক ধরে। অর্থাৎ আগামী প্রবৃদ্ধি যদি ৮.২ শতাংশ হয়, তাহলে এই বাজেট অনুপাতটি ঠিক আছে। তবে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ যারা মধ্যম আয়ের দেশ হতে যাচ্ছে, সেসব দেশে এর চেয়েও বড় বাজেট হয়। যেমন- অনেক দেশে জিডিপির প্রায় ২৫ বা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত আকারের সরকারি ব্যয় হয়। ওই হিসাবে আমরা এখনও সঠিক আয়তনের বাজেটই করতে পারছি না। তাই বাজেট অনেক বড় হয়েছে, এমন যুক্তি ধোপে টেকে না। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আগামী বছরে প্রবৃদ্ধি যে ৮.২ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, তা বাস্তবায়িত হবে কি না। এটা দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে। এক. সরকারি বিনিয়োগ এবং দুই. ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ দীর্ঘদিন ধরে জিডিপির ২৪ শতাংশই আছে। বাড়ছে না। তাই ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ যদি এবারও তেমন না বাড়ে, তাহলে এই খাতে বাড়তি কোন উদ্যোগ দেখতে পাব না। আর সরকারি বিনিয়োগ উন্নয়ন বাজেটে ২ লাখ কোটি টাকার উপরে ধরা হয়েছে। এটাও নির্ভর করবে সরকারের প্রস্তাবিত বাজেটে যে ঘাটতি রয়েছে, তা পূরণ হচ্ছে, কি হচ্ছে না- এর ওপর। কোন কোন অর্থনীতিবিদ মনে করেন, বাজেটে যে ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে, তা পূরণ সম্ভব হবে না।

বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ঘাটতির ৪৮ শতাংশ বা প্রায় অর্ধেক বিদেশি ঋণের মাধ্যেমে পূরণ করা হবে। এই ৪৮ শতাংশ পূরণের বিষয়টি নির্ভর করবে বর্তমানে পাইপলাইনে যে বিদেশি সাহায্য জমা হয়ে আছে, তা অবমুক্ত হবে, কী হবে নাÑ এর ওপর। যেহেতু পাইপলাইনে আছে, সেহেতু ধরে নিতে পারি, আমরা সেটি পাব। তবে এখানে কথা হলো, সেটি সময়মতো পাব, কী পাব না। কারণ প্রতিটি বৈদেশিক সাহায্যের সঙ্গে একটা মনিটরিং ব্যবস্থা আছে, কয়েকটি তথ্য আদান-প্রদানের বিষয় আছে, ‘দর কষাকষির’ (ঘবমড়ঃরধঃরড়হ) বিষয় আছে। এগুলোয় যদি কোন সমস্যা তৈরি হয়, তাহলে বিদেশি দাতারা এখন আর ঋণ অবমুক্ত করতে রাজি হন না। এখানে সরকারের নোগোশিয়েশনের দক্ষতার ওপর নির্ভর করবে, ওই সাহায্যটি পাবে, কী পাবে না। যেহেতু এটি দক্ষতার সঙ্গে নেগোশিয়েশনের ওপর নির্ভর করবে, সেহেতু আমরা আশঙ্কা করছিÑ ঘাটতির ৪৮ শতাংশ বিদেশি ঋণের কতটা পাব তা অনিশ্চিত। আর নতুন সাহায্যের কথা যদি বলি, তাহলে সেটিও অনেক কঠিন। কারণ তাদের কাছে নতুন সাহায্য চাইলে তারা বলবেন, পাইপলাইনে যেটি আছেÑ সেটি আগে নাও, তারপর নতুন সাহায্য দেয়া হবে। তাই বৈদেশিক সাহায্য দিয়ে ঘাটতি পূরণের বিষয়টি অনিশ্চিতই রয়ে গেল। তাছাড়া বাংলাদেশের উন্নয়ন স্টেটাস উপরে উঠে যাওয়ায় বিদেশিরা এখন বাংলাদেশের বদলে আফ্রিকার দেশগুলোকে বেশি পছন্দ করছেন।

দ্বিতীয় যে খাত থেকে ঘাটতি পূরণের কথা বলা হয়েছে, তা হলো ব্যাংকিং খাত। এই খাত থেকে ৩৩ শতাংশ ঘাটতি পূরণ করা হবে। সরকার নির্ধারণ করেছে, এই খাত থেকে ৪৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেবে। এখন প্রশ্ন হলো সরকার যে ৪৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেবে, তা দেশের ব্যাংকি খাতের দেয়ার ক্ষমতা আছে কি না। সরকার হয়তো ধরেই নিয়েছে, ব্যাংকের ওই ক্ষমতা আছে। কিন্তু ব্যাংকের মালিকরা বলছে, সরকার যদি ব্যাংক থেকে এই পরিমাণ ঋণ নেয়, তাহলে ব্যাংকেররই ঋণ দেয়ার আর ক্ষমতা থাকবে না। আর এমনিতেই ব্যাংক খাতের যে অবস্থা, এতে সরকার যদি ঋণ নেয়- তাহলে তারল্য সংকট আরও প্রকট হবে, ইংরেজিতে যেটিকে বলে ‘ক্রাউডিং ইফেক্ট’ (Crowding Effect), সেটি ত্বরান্বিত হবে। তখন ব্যাংকগুলো আর কাউকেই ঋণ দিতে পারবে না। অর্থাৎ সরকারের প্রস্তাবিত ঋণ নেয়ার প্রধান যে দুটি উৎস, ওই দুটি উৎসই অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে।

তৃতীয় যে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে সরকার অর্থ নিতে চাচ্ছে, তা হলো সঞ্চয়পত্র বিক্রি। সম্প্রতি সঞ্চয়পত্রের সুদের হার সরকার কমিয়েছে এবং সঞ্চয়পত্রের আয়ের ওপর করের হারও বাড়িয়েছে। তাই সঞ্চয়পত্র থেকে টাকা ধার করলে এর যে পরিব্যয় ছিল, তা কিছুটা কমেছে। ফলে এই খাত থেকে সরকার ঋণ/অর্থ নিতে বা সংগ্রহ করতে পারে। কিন্তু যতই চাপ কম হোক- অতীতের যে ঋণ ভার, তা আরও বেড়ে যাবে। কারণ দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছর অতীতের ঋণের সুদ পরিশোধ করতেই বাজেটের প্রায় ১১ থেকে ১৪ শতাংশ চলে যায়। তাহলে বাজেট তো ৫ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা থাকল না। প্রস্তাবেই স্বীকার করে নেয়া হয়েছে, ৫৭ হাজার ৭০ কোটি টাকা সুদ দিতে হবে সরকারকে। এ জন্য ঘাটতি পূরণের এই চ্যালেঞ্জগুলো আছে। সরকার এ চ্যালেঞ্জগুলো কীভাবে মোকাবিলা করে, সেটি দেখার বিষয়।

বাজেটে আরেকটি নতুন জটিলতা আছে। তা হলো, প্রতিবারই সরকারের আয়ের প্রধান উৎস থাকে অপ্রত্যক্ষ কর থেকে। এবারও তা রয়েছে। আগে অপ্রত্যক্ষ করের অনুপাত ধরা হয়েছিল ৬৭ শতাংশ। এবার ১ শতাংশ কমিয়ে ধরা হয়েছে ৬৬ শতাংশ। তা আসবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে এনবিআর থেকে। আর হয়তো ৩০-৩৩ শতাংশ আসবে আয়কর ও সম্পদ কর থেকে। কিন্তু মৌলিকভাবে এ অনুপাতটিই অন্যায়। কারণ সরকার ধনীদের কাছ থেকে প্রত্যক্ষভাবে নিচ্ছে ৩০-৩৩ শতাংশ আর যারা প্রধানত অধনী মানুষ, তাদের কাছ থেকে নিচ্ছে ৬৬ শতাংশ। অর্থাৎ সরকার তার আয়ের জন্য নির্ভর করছে প্রধানত অধনীদের ওপর। এরপরও বেশি সুবিধা দিচ্ছে ধনীদের।

এখন আমরা এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে যদি বলি, যে সরকার সাধারণ মানুষের কাছে থেকে যে টাকাটা নিচ্ছে, তা দিয়ে অনেক মেগাপ্রকল্প করছে। সেগুলোয় তো সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে। হ্যাঁ, হবে। কিন্তু তা হবে আজ থেকে প্রায় ১০-১৫ বছর পর। তবে আজ সাধারণ মানুষ যে টাকাটা দিচ্ছে, তা তো যাচ্ছে মেগাপ্রকল্পের কন্ট্রাক্টরের পকেটে। তাও যদি তারা এ টাকাটা দক্ষতার সঙ্গে ব্যয় করতেন, তাহলে আমরা বলতে পারতাম- এখন না উপকার পেলেও আমরা তা যথাযথ মাত্রায় পরে পাব। কিন্তু জনগণের কষ্টের টাকা দক্ষতার সঙ্গে ব্যয় হচ্ছে না। এ টাকার একটা ভাগাভাগি আছে। মেগাপ্রকল্পগুলোয় যারা দায়িত্বে আছেন, (সামরিক, বেসামরিক, প্রশাসন) তারা কিছুটা পাচ্ছেন। আর কিছু পাচ্ছেন দেশি কন্ট্রাক্টররা আর বৈদেশিক কন্ট্রাক্টররা। এটিকে আমরা সরল ভাষায় বলি আংশিক দুর্নীতি। আর কিছুটা অপচয় হচ্ছে অদক্ষতার কারণে। যারা দায়িত্বে আছেন, তারা বুঝতেই পারছে না এই ব্যয় কীভাবে বাড়ছে। ফলাফল দেখে আমরা তা বুঝতে পারছি না। আমরা দেখছি, উন্নত বিশ্বসহ ভারতে, চীনে যে ব্যয়- এর চেয়ে আমাদের দেশের রাস্তা তৈরির খরচ তিনগুণ বেশি। যুক্তি দেখানো হচ্ছে, আমাদের দেশে জমি অধিগ্রহণে বেশি ব্যয় হয়। এই যুক্তি হয়তো মেনেই নিলাম। কিন্তু সময়ও তো বেশি লাগছে। ব্যয় যদি ন্যায়সঙ্গত হয়, তাহলে সময়টা এত বেশি লাগছে কেন! যদি আমি ঠিকমতো ব্যয় করি, তাহলে ঠিকমতোই কাজটি হওয়ার কথা। সময় বেশি লাগলে যে সমস্যাটা হয়- প্রতি বছর তো মুদ্রাস্ফ্রীতি হচ্ছে। ফলে একই জিনিসে এমনিতেই বেশি দাম দিতে হচ্ছে। এর ফল হিসেবে আমরা দেখছি, সময় বেশি লাগছে অদক্ষতার জন্য আর ব্যয় বাড়ছে অংশত অদক্ষতা ও অংশত দুর্নীতির কারণে। ইংরেজিতে যেটিকে বলা হয়, কস্ট ওভাররান (Cost Overrun) ও টাইম ওভাররান (Time Overrun)। সরকার বলবে, সাধারণ জনগণের জন্য মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প দিয়ে, পদ্মা সেতু দিয়ে, মেট্রোরেল দিয়ে তা জনগণকেই ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। হ্যাঁ, সেটি ফিরিয়ে দিচ্ছে সরকার। তবে অনেক দেরিতে, অনেক বেশি ব্যয়ে এবং তা থেকে টোল আদায় করবেও বেশি, বিদ্যুতের বিল তো বাড়াবেই। অন্যদিকে ধনীরা বলছেন, আমাদের আরও সুবিধা দিতে হবে, শুল্ক রেয়াত দিতে হবে, কর রেয়াত দিতে হবে, নগদ প্রণোদোনা দিতে হবে এবং সরকার সেগুলো দিচ্ছেও। যেমন পোশাক শিল্পে নগদ সহায়তা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই নগদ সহায়তা শ্রমিকরা পাচ্ছেন কি?

সরকার বলেছে, শ্রমিক কল্যাণ ফান্ড আছে। এর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক-অআনুষ্ঠানিক সব খাতের কোটি কোটি শ্রমিককে নগদ সাহায্য দেয়া হবে। এই শ্রমিক কল্যাণ ফান্ডে মুনাফা থেকে শ্রমিকদের জন্য মালিকদের অর্থ দেয়ার বিধান আছে। সাধারণত যদি ১০০ ডলার রপ্তানি হয়, তাহলে মাত্র ১ থেকে ৩ সেন্ট শ্রমিক কল্যাণ ফান্ডে জমা হয়। এটা খুবই নগণ্য অ্যামাউন্ট। এই নগণ্য অ্যামাউন্টের কারণে এই ফান্ড থেকে ব্যয়ও হয় খুবই কম। অর্থমন্ত্রী এবার নিজেই বাজেট বক্তৃতায় (পৃ.-৩৬) বলেছেন, ২০১২ সালের পর থেকে ৬ হাজার শ্রমিককে আমরা মাত্র ২৮ কোটি টাকা দিয়েছি। কিন্তু তারা যে অবদান রেখেছেন, এর থেকে এটা খুবই কম নয় কি? একইভাবে কৃষকরাও বলতে পারেন, এবার ধানে আমাদের যে লোকসান হলো, কীভাবে আমাদের তা পুষিয়ে দেবেন। এই লোকসানের জন্য তো আমরা দায়ী নই। আপনার নীতি দায়ী। আপনি ঠিক করেছেন, আপনি চাল কিনবেন মিল মালিকদের কাছে থেকে। আর মিল মালিকরা কৃষকদের বলেছেন, তোমার ধান ভালোমতো শুকানো নয়, ধানে অর্ধেক পানি আছে। তাই সেটি আমরা অর্ধেক দামে কিনব। কিন্তু সরকার যদি সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনত, তাহলে সঠিক সময় সঠিক দামে সরকারও কিনতে পারত আর কৃষকরাও সঠিক দামে বিক্রি করতে পারতেন। ভারতে এমন সিস্টেম আছে। সেখানে স্বসাহায্যকারী একটি গ্রুপ থাকবে, যেখানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কয়েক কৃষক তাদের ধানগুলো সংগ্রহ করে সরকারকে বলবেÑ আমরা ধান সংগ্রহ করেছি, আপনি কিনতে পারেন। প্রত্যেক কৃষকের ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকবে। ওই অ্যাকাউন্টে সরকার দাম হিসাব করে অগ্রিম টাকা পাঠিয়ে দেবে। যেমনটি ন্যাশানাল ব্যাংকের মাধ্যমে স্বপ্ন চেইন স্টোর ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশেও শুরু করেছে। এটা হলে যে গোষ্ঠী কৃষকের অসহায় সময় কম টাকা দিয়ে ধান কেনে, তারা তা পারবে না। এবার কৃষক যেভাবে লোকসান করেছেন, পরের বছর তো তারা ধান চাষ নাও করতে পারেন। সরকার যদি কৃষকদের জন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থা করত, তাহলে বলা যেতÑ সরকার যাদের কাছে থেকে টাকা নিচ্ছে, তাদের ফেরত সেবা দিচ্ছে। কিন্তু সরকার তাদের দিকে নজর না দিয়ে যারা ধনী বা পাওয়ারফুল, তাদের সুবিধার দিকে বেশি নজর দিচ্ছে।

ব্যবসায়ীদের কথায় ভ্যাট আইনে কত মারপ্যাঁচ করতে অবশেষে বাধ্য হলো সরকার। যেমনÑ পাওয়ারফুলদের দাবি ছিল, ভ্যাটটিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে দিতে হবে। নতুন আইনে তা করাও হয়েছে। এটা করার ফলে এখন প্রশ্ন আসবে, কার কত টার্নওভার থাকলে কী পরিমাণ ভ্যাট দেবেন বা কোন কোম্পানির কোন পণ্যে কত ভ্যাট দেবেন? এখন কত টার্নওয়ার বা কোন পণ্য, সেটি ঠিক করতে হবে এনবিআরকে। এটা একটা জটিল প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে অনেক পাওয়ারফুল ভ্যাট ফাঁকি দেবে। কিন্তু একটা রেট থাকলে এই সমস্যাগুলো থাকত না। তবে এক রেট থাকলে সবার প্রতি ন্যায়বিচার প্রয়োগে কিছুটা সমস্যা হতো। তবে সেটি তেমন বড় ধরনেন সমস্যা হতো না, বরং এখনই ওই আইন প্রয়োগ করতে সমস্যা হবে বেশি। তখন ভ্যাট থেকে আয় কমেও যেতে পারে এবং বাজেটে ঘাটতি পূরণ তখন হবে না।

সরকার ঋণখেলাপিদের বিষয়ে বলেছে, দুই ধরনের ঋণখেলাপিকে চিহ্নিত করা হবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ও অইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। এখন কোনটা ইচ্ছাকৃত আর কোনটা অনিচ্ছাকৃত, সেটি কে চিহ্নিত করবেন। আমরা অতীতে দেখেছি, এটি চিহ্নিত করা খুবই কঠিন। যারা ১০০ কোটি টাকা ঋণখেলাপি করেছেন, তারা যদি ২ শতাংশ পরিশোধ করেন, তাদের ঋণখিলাপির অপবাদ থেকে রেহাই দেয়া হয়Ñ তাহলে ঋণখেলাপি আসলে কমবে না। আর বৈধ টাকায় যে পরিমাণ কর আর কালো টাকাতেও যদি সমান কর দেয়, তাহলেও দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন হবে না। এ জন্য বাজেটের ন্যায়-নীতি নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।

বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী জানান, কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ দেয়ার কারণ হলো, যাদের কাছে কালো টাকা আছেÑ তা যেন বের করে। তাহলে অন্তত টাকাটা কাগজ-কলম বা হিসাবে আসবে। নয়তো এই টাকা তারা বিদেশে পাচার করে দেবে। প্রধানমন্ত্রীর যুক্তি অনুযায়ী সত্যিই কি কালো টাকার মালিকরা সাড়া দেবে? কালো টাকার অতীত ইতিহাস বলে, এই সুযোগেও কালো টাকা বের করা হয়নি। একমাত্র ২০০৭ সালে যখন ফখরুদ্দীন-মঈন উদ্দীন সরকার এলো তখনই কালো টাকাগুলো কিছুটা বের হয়েছিল। এছাড়া অন্য কোন সরকারের সময় কালো টাকা তেমন একটা বের হয়নি। এর মানে হচ্ছে, সুবিধা দিলেই কালো টাকা বের হবে না। এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে হবেÑ যেন কালো টাকা বের করতে তারা বাধ্য হন। কালো টাকার মালিকরা যেন বুঝতে পারেন, আমি যদি কালো টাকা বের না করিÑ তাহলে আমার ঘাঁড় ধরে কালো টাকা বের করে নেয়া হবে। আমার মার্সিডিজ ব্র্যান্ডের গাড়ি যদি কালো টাকায় কিনে থাকি, তাহলে আমি যেন ওই গাড়ি রাস্তায় নামাতে না পারি। রাস্তায় নামলেই যেন ওই গাড়ি ধরা পড়ে। তাহলেই কালো টাকার মালিকরা বাধ্য হয়েই গাড়ি ফেলে পালাবেন বা যার কাছে যত টাকা আছে, তা বের করে দেবেন। প্রধানমন্ত্রী যদি ওই সুযোগের সঙ্গে এই হুমকিটাও দিতেনÑ এটিই শেষ সুুযোগ। এরপরও যদি কেউ কালো টাকা বের না করেন, তাহলে পরে আর সুযোগ পাবেন না এবং কালো টাকা ধরা পড়লে শায়েস্তা করা হবে, তাহলে এটাকে সমর্থন করতাম এবং অপেক্ষায় থাকতাম দেখার জন্য কতজন রাঘববোয়ালকে তিনি অবশেষে ধরলেন? কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস ও করুন পরিণতি থেকে দেখা যায়, কঠোর হতে বেশি দেরি করলে শত্রুরা আগে ছোবল মারতে দ্বিধা করে না।

অনেকে বলেন, ব্যবসায়ীদের মূল দাবি ছিল, করপোরেট ট্যাক্স কমানো। কিন্তু বাজেটে তা কমানো হয়নি। এই প্রসঙ্গে আমার মত হচ্ছে, বাজেটে কোথাও ধনীদের সুবিধা দেয়া হয়েছে, কোথাও গরিবদের সুবিধা দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাজেটের সামগ্রিক চেহারা যে ধনী মুখাপেক্ষী, তা পরিবর্তন হয়নি। যেমনÑ সাধারণ অধনী জনগণকে ৬৬ শতাংশ কর দিতে হয় আর ধনীদের দিতে হয় মাত্র ৩২-৩৩ শতাংশ। এতে তো কোন পরিবর্তন হয়নি। কারণ আমাদের বেসিক স্ট্রাকচারে যে বৈষম্য আছে, তা পরিবর্তন হয়নি।

এসডিজির ১০ নম্বর অভীষ্টের প্রথম ধারায় বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে আয়ের দিক থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে অবস্থানকারী ৪০ শতাংশ জনসংখ্যার আয়ের প্রবৃদ্ধি হার পর্যায়ক্রমে জাতীয় গড় আয়ের চেয়ে বেশি অর্জন করতে হবে এবং এই ধারা অব্যহত রাখতে হবে। এই অভীষ্ট পূরণের জন্য বাজেট কতটা প্রাসঙ্গিকÑ এই বিষয়ে তিনি বলেন, দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্য হ্রাস হচ্ছে। হয়তো একটা সময় দারিদ্র্য নিমূল হবে। এটা নিয়ে আমার বিতর্ক নেই। এ ধরনের বাজেটেই সেটি হবে। অতীতেও হয়েছে। কিন্তু আয়বৈষম্য কমবে কি না, সেটিই দেখার বিষয়। এসডিজিতে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে, দরিদ্রদের আয় বৃদ্ধির হার ধনীদের চেয়ে বেশি হবে। তাই এ ধরনের বাজেটে এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়।

প্রস্তাবিত বাজেট প্রস্তুতকরণে সরকার প্রভাবশালী কোন পক্ষের চাপ অনুভব করেছিল কি না- এমন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা অনেকখানি নির্ভর করে সরকার কাদের ওপর নির্ভর করে দেশ চালাচ্ছে, এর ওপর। সরকার তো বর্তমান সংসদের ওপর নির্ভর করে চলছে। আর এবারের সংসদে যারা আছেন বা এসেছেন, তাদের ৬৫ শতাংশই ব্যবসায়ী। আওয়ামী লীগ দলের অতীত গণচরিত্র ও বর্তমান চরিত্র এক নয়। তাছাড়া সংসদে যেহেতু ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বেশি আছে, সেহেতু বাজেট তৈরিতে তাদের প্রভাব বেশি থাকবেÑ এটিই স্বাভাবিক।