বাংলাদেশের স্বপ্নভঙ্গ সেমিতে ভারত

২০১৯ সালের বিশ্বকাপে ভারতের কাছে পরাজয়টা অনেকদিন হয়তো পোড়াবে তামিম ইকবালকে। ফিল্ডিংয়ে নেমে তিনি ক্যাচ ছেড়েছেন রোহিত শর্মার। ভারতের এই ওপেনার জীবন পেয়ে ঝড়োগতিতে শতরানের ইনিংস খেলে থামেন, জেতেন ম্যাচ সেরার পুরস্কার। মূলত রোহিতের শতরানের ইনিংসে ভর করেই এজবাস্টনে গতকাল অনুষ্ঠিত ক্রিকেট বিশ্বকাপের ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে ভারত পায় ৩১৪ রানের পুঁজি। জয়ের জন্য ৩১৫ রানের লক্ষ্যে এগোতে হলে তামিমের কাছ থেকেই শুরুতে প্রয়োজন ছিল বড় ইনিংস। সেই কাজে আবারও ব্যর্থ হয়েছেন এবারের বিশ্বকাপে নিজেকে হারিয়ে খুঁজতে থাকা দেশসেরা ওপেনার। বাংলাদেশের ইনিংস বরাবরের মতোই গতকাল এজবাস্টনেও বেশ কিছুটা সময় টেনেছেন বিশ্বসেরা অল রাউন্ডার সাকিব আল হাসান। যোগ্য সঙ্গীর অভাবে একটা সময়ে সাকিবও আর পারেননি। শেষদিকে সাইফুদ্দিন ঝড়োগতির একটা হাফ সেঞ্চুরির ইনিংস খেলেছেন। দুই ওভার বাকি থাকতে বাংলাদেশ থেমেছে ২৮৬ রানে। এর মধ্য দিয়ে টাইগারদের সেমিতে খেলার সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে হয়ে গেল ক্ষীণতর। অন্যদিকে ২৮ রানের জয়ে নিশ্চিত হলো ভারতের সেমিফাইনাল।

বড় টার্গেট তাড়ায় নেমে দেখেশুনেই শুরু করেছিলেন তামিম ইকবাল ও সৌম্য সরকার। দ্বিতীয় ওভারে ভুবনেশ্বরকে দুটি বাউন্ডারি মেরে হাত খোলেন তামিম। মঙ্গলবারের ম্যাচে একটু ভিন্নরূপে বেশ ধীরগতিতেই শুরু করেছিলেন সৌম্য। ওপেনিং পার্টনারশিপটা ৩৯ রানে পৌঁছতেই ভারতের হয়ে এবারের বিশ্বকাপে সবচেয়ে সফল বোলার মোহাম্মদ শামির আঘাতে প্লেইড অন যান ৩১ বলে ২২ রান করা তামিম ইকবাল। বলের লাইন লেন্থ কোনোটাই বুঝতে না পেরে নিজের দিকে বলটাকে টেনে এনেছিলেন টাইগার ওপেনার। ব্যাটে লেগে বল আঘাত হানে স্ট্যাম্পে। শামির করা ১২তম ওভারে সৌম্য সরকারের বিপক্ষে লেগ বিফোর উইকেটের আবেদন হয়। ফিল্ড আম্পায়ার নাকচ করলে রিভিউ নেয় ভারত। রিভিউটি নষ্ট হলে আম্পায়ারের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন অধিনায়ক বিরাট কোহলি। এরপর সৌম্য বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। হার্দিক পান্ডিয়ার বলে বিরাট কোহলির তালুবন্দি হয়ে ৩৮ বলে ৩৩ রানে ফেরেন তিনি। তার বিদায়ের পর সাকিব-মুশফিকের ক্ল্যাসিক জুটি দেখার অপেক্ষায় ছিলেন টাইগার ভক্তরা। ঠিক তখনই ছন্দপতন। যুজবেন্দ্র চাহালের বলে মোহাম্মদ শামির তালুবন্দি হন মুশফিকুর রহিম (২৪)।

সাকিব একাকীই টানছিলেন বাংলাদেশের ইনিংস। বিশ্বসেরা অল-রাউন্ডার ৫৮ বলে চলতি বিশ্বকাপে নিজের চতুর্থ হাফ সেঞ্চুরিটাও পূর্ণ করেছিলেন। মুশফিকের বিদায়ের পর উইন্ডিজের বিপক্ষে জয়ের পথে সাকিবের সঙ্গী লিটন নেমেছিলেন ক্রিজে। তিনি নিজের ছন্দে থাকলেও জুটিটা বড় করতে পারেননি। ত্রিশতম ওভারে ভুবনেশ্বর কুমারকে ছক্কা মারার এক বল পরেই ক্যাচ তুলে দেন দিনেশ কার্তিকের হাতে। ১৬২ রানে ৪ উইকেট হারায় বাংলাদেশ। স্কোরবোর্ডে আর মাত্র ১১ রান যোগ হতেই মোসাদ্দেক (৩) স্ট্যাম্প খোয়ান বুমরাহর বলে। হার্দিক পান্ডিয়া ৭৪ বলে ছয় বাউন্ডারিতে ৬৬ রান করা সাকিবকে প্যাভিলিয়নের পথ ধরালে ওখানেই আসলে থমকে যায় বাংলাদেশের জয়ের স্বপ্ন।

তারপরও সাব্বির-সাইফুদ্দিনের জুটিতে রান আসছিল। এদের ৬৬ রানের জুটিটা ভাঙেন বুমরাহ। বোল্ড হন ৩৬ বলে ৩৬ রান করা সাব্বির। মাশরাফিকে (৩) উইকেটের পেছনে ধোনির গ্লাভসে বল জমা দিয়ে ফিরতে হয় ভুবনেশ্বরের বলে।

আটচল্লিশতম ওভারের শেষ দুই বলে জসপ্রিত বুমরাহর নিখুত ইয়র্কারে রুবেল হোসেন (৯) ও মোস্তাফিজুর রহমান (০) ফিরলে দুই ওভার হাতে রেখে ২৮৬ রানে অল আউট হয় বাংলাদেশ। আর হ্যাঁ, ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ওডিআই হাফ সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে ৩৮ বলে ৯ বাউন্ডারিতে ৫১ রানে অপরাজিত থাকেন সাইফুদ্দিন।

মুস্তাফিজের বলে রোহিত শর্মার দেয়া ক্যাচ ডিপ স্কয়ার লেগ থেকে দৌড়ে এসেও তালুবন্দী করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন তামিম ইকবাল। এজবাস্টনে বাংলাদেশ- ভারতের মধ্যকার বিশ্বকাপের ম্যাচে ধারাভাষ্য কক্ষে তখন সাবেক ক্যারিবিয়ান পেস বোলার মাইকেল হোল্ডিং ও সাবেক ভারতীয় অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি। দুজনেই বলছিলেন সর্বোচ্চ পর্যায়ে এই ক্যাচটা ছিল অতি সাধারণ, আর ওটা ফেললেন বাংলাদেশের অভিজ্ঞ এক ক্রিকেটার। এই ক্যাচ মিসের চরম মূল্য বাংলাদেশের দিতে হবে বলে তখনই দুইজন শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। অন্যথা হয়নি। রোহিত শর্মা টাইগার বোলারদের তুলোধুনো করে ক্যারিয়ারের ২৬তম এবং চলতি বিশ্বকাপের চতুর্থ সেঞ্চুরিটা তুলে নিয়েছে, হাফ সেঞ্চুরির ইনিংস খেলেছেন আরেক ওপেনার লোকেশ রাহুলও। পার্টটাইম বোলার সৌম্য সরকারের হাত ধরে রোহিতকে ফিরিয়ে প্রথম ব্রেকথ্রু পাওয়ার পর মুস্তাফিজের পাঁচ উইকেট শিকার এবং বাকি বোলারদের চেষ্টাতেও ভারতীয়দের স্কোর তিনশ’র নিচে রাখা সম্ভব হয়নি। টস জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া ভারতের সংগ্রহটা নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৯ উইকেটে ঠেকেছে ৩১৪ রানে। ফলে সেমির স্বপ্ন টিকিয়ে রাখার বাঁচা-মরার লড়াইয়ে জয়ের জন্য ৩১৫ রানের টার্গেট পেয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।

নিজেদের ইনিংসে শুরু থেকেই সাবধানি ছিলেন ভারতীয় ওপেনার লোকেশ রাহুল। রোহিতও খেলছিলেন রয়ে সয়ে। ম্যাচের তখন পঞ্চম ওভার। চতুর্থ বলটি একটু খাটো লেংথে করেছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। আয়েশ করে পুল করতে গিয়ে টাইমিংয়ে গড়বড় করে ফেলেন রোহিত শর্মা। ডিপ স্কয়ার লেগে ফিল্ডিং করছিলেন তামিম ইকবাল। বল বাতাসে ভেসে সেদিকে যাওয়ায় রোহিতের নিশ্চিত আউট নিয়ে গ্যালারিতে থাকা ভারতীয় দর্শকদের মধ্যে যখন হতাশা, তখনই সেখানে ‘প্রাণ’ ফেরালেন তামিম ইকবাল। সহজ ক্যাচটা ফেলে দিলেন বাংলাদেশের অভিজ্ঞ এই ক্রিকেটার। ব্যক্তিগত ৯ রানে জীবন পেলেন রোহিত। যে জুটি ভেঙে যেতে পারত মাত্র ২০ রানে, বড় রকমের ধাক্কা দিয়ে মনোবল নষ্ট করা সম্ভব ছিল ভারতের, সেই উদ্বোধনী জুটি দলকে টিম ইন্ডিয়াকে নিয়ে গেল ১৮০ রান পর্যন্ত।

টাইগার অধিনায়ক মাশরাফি মর্তুজা থেকে শুরু করে মুস্তাফিজ সাকিবসহ ছয়জন বোলার ব্যবহার করেও আটকানো যাচ্ছিল না লোকেশ-রোহিতকে। সাফল্য এল পার্টটাইম বোলার সৌম্য সরকারের হাত ধরে। অফ কাটারে এক্সট্রা কাভারের ওপর দিয়ে হাঁকাতে গিয়ে লিটন কুমার দাসের হাতে ধরা পড়লেন রোহিত। ততক্ষণে ভারতীয় ওপেনারের সংগ্রহ ৯২ বলে সাত বাউন্ডারি ও পাঁচ ছক্কায় ১০৪। জীবন পেয়ে রোহিত সাবধানি হলেও রানের চাকা ধীর হতে দেননি। প্রথম ৫০ রানে পৌঁছতে ৪৫ বল খেলার পর সেঞ্চুরি পূরণ করতে আরও ৪৫ বল মোকাবেলা করেন তিনি। বিশ্বকাপে রোহিতের এটা টানা দ্বিতীয় শতরানের ইনিংস। বাংলাদেশের আগে ইংল্যান্ডের কাছে হেরে যাওয়া ম্যাচেও সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন ভারতীয় ওপেনার।

লোকেশ রাহুলও ফিরেছেন হাফ সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে। তার সঙ্গে যোগ দেয়া বিরাট কোহলির জুটিটা হয় মাত্র ১৫ রানের। লোকেশ ৯২ বলে ছয় বাউন্ডারি ও এক ছক্কায় ৭৭ রান করে রুবেল হোসেনকে খোঁচা মেরে ধরা পড়েন মুশফিকের গ্লাভসে।

কোহলি-পান্ট জুটি জেঁকে বসার আগেই জোড়া আঘাত করে টাইগারদের লড়াইয়ে ফিরিয়েছেন মুস্তাফিজুর রহমান। তৃতীয় উইকেটে ৪২ রান উঠতেই কাটার মাস্টারের আঘাতে প্যাভিলিয়নে ফেরেন বিরাট কোহলি (২৬)। মিডউইকেটে রুবেল হোসেনের হাতে ক্যাচ দেন ভারতীয় অধিনায়ক। ৩৯তম ওভারের দ্বিতীয় বলে বিরাটকে ফেরানোর এক বল পরই ঝড় তোলার আগেই হার্দিক পান্ডিয়াকে (০) ফেরান মুস্তাফিজ।

টাইগার বোলারদের ওপর চড়াও হতে থাকা ঋষভ পান্টকে (৪৮) ক্রিজছাড়া করেন সাকিব আল হাসান। ভারতের ইনিংসে এরপর একে একে দীনেশ কার্তিক (৮), মহেন্দ্র সিং ধোনি (৩৫) ও মোহাম্মদ শামিকে (১) ফিরিয়ে এক ইনিংসে পাঁচ উইকেট শিকারের কৃতিত্ব দেখান মুস্তাফিজ। ভুবনেশ্বর কুমারের রান আউটটাও ছিল মুস্তাফিজের করা পঞ্চাশতম ওভারের শেষ বলে।

উল্লেখ করা যেতে পারে, ভারতের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচে ঢাকার মাঠে পাঁচ উইকেট শিকারের মধ্য দিয়েই বিশ্বমঞ্চে নিজের আগমন বার্তা জানান দিয়েছিলেন কাটার মাস্টার মুস্তাফিজ। ভারতের বিপক্ষে পরের ম্যাচেই তিনি শিকার করেছিলেন ছয় উইকেট। এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেন ২০১৯ সালের বিশ্বকাপের ম্যাচেও।

সংক্ষিপ্ত স্কোর: ভারত ৩১৪/৯ (রাহুল ৭৭, রোহিত ১০৪, কোহলি ২৬, পান্ত ৪৮, পান্ডিয়া ০, ধোনি ৩৫, কার্তিক ৮, ভুবনেশ্বর ২, সামি ১, বুমরাহ ০*; মাশরাফি ৫-০-৩৬-০, সাইফ ৭-০-৫৯-০, মুস্তাফিজ ১০-১-৫৯-৫, সাকিব ১০-০-৪১-১, মোসাদ্দেক ৪-০-৩২-০, রুবেল ৮-০-৪৮-১, সৌম্য ৬-০-৩৩-১)।

বুধবার, ০৩ জুলাই ২০১৯ , ১৯ আষাঢ় ১৪২৫, ২৯ শাওয়াল ১৪৪০

বাংলাদেশের স্বপ্নভঙ্গ সেমিতে ভারত

বিশেষ প্রতিনিধি

image

সাকিব আল হাসান গতকাল ৬৬ রানের ইনিংস খেলে এবারের বিশ্বকাপে ৫০০ রান অতিক্রম করেন

২০১৯ সালের বিশ্বকাপে ভারতের কাছে পরাজয়টা অনেকদিন হয়তো পোড়াবে তামিম ইকবালকে। ফিল্ডিংয়ে নেমে তিনি ক্যাচ ছেড়েছেন রোহিত শর্মার। ভারতের এই ওপেনার জীবন পেয়ে ঝড়োগতিতে শতরানের ইনিংস খেলে থামেন, জেতেন ম্যাচ সেরার পুরস্কার। মূলত রোহিতের শতরানের ইনিংসে ভর করেই এজবাস্টনে গতকাল অনুষ্ঠিত ক্রিকেট বিশ্বকাপের ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে ভারত পায় ৩১৪ রানের পুঁজি। জয়ের জন্য ৩১৫ রানের লক্ষ্যে এগোতে হলে তামিমের কাছ থেকেই শুরুতে প্রয়োজন ছিল বড় ইনিংস। সেই কাজে আবারও ব্যর্থ হয়েছেন এবারের বিশ্বকাপে নিজেকে হারিয়ে খুঁজতে থাকা দেশসেরা ওপেনার। বাংলাদেশের ইনিংস বরাবরের মতোই গতকাল এজবাস্টনেও বেশ কিছুটা সময় টেনেছেন বিশ্বসেরা অল রাউন্ডার সাকিব আল হাসান। যোগ্য সঙ্গীর অভাবে একটা সময়ে সাকিবও আর পারেননি। শেষদিকে সাইফুদ্দিন ঝড়োগতির একটা হাফ সেঞ্চুরির ইনিংস খেলেছেন। দুই ওভার বাকি থাকতে বাংলাদেশ থেমেছে ২৮৬ রানে। এর মধ্য দিয়ে টাইগারদের সেমিতে খেলার সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে হয়ে গেল ক্ষীণতর। অন্যদিকে ২৮ রানের জয়ে নিশ্চিত হলো ভারতের সেমিফাইনাল।

বড় টার্গেট তাড়ায় নেমে দেখেশুনেই শুরু করেছিলেন তামিম ইকবাল ও সৌম্য সরকার। দ্বিতীয় ওভারে ভুবনেশ্বরকে দুটি বাউন্ডারি মেরে হাত খোলেন তামিম। মঙ্গলবারের ম্যাচে একটু ভিন্নরূপে বেশ ধীরগতিতেই শুরু করেছিলেন সৌম্য। ওপেনিং পার্টনারশিপটা ৩৯ রানে পৌঁছতেই ভারতের হয়ে এবারের বিশ্বকাপে সবচেয়ে সফল বোলার মোহাম্মদ শামির আঘাতে প্লেইড অন যান ৩১ বলে ২২ রান করা তামিম ইকবাল। বলের লাইন লেন্থ কোনোটাই বুঝতে না পেরে নিজের দিকে বলটাকে টেনে এনেছিলেন টাইগার ওপেনার। ব্যাটে লেগে বল আঘাত হানে স্ট্যাম্পে। শামির করা ১২তম ওভারে সৌম্য সরকারের বিপক্ষে লেগ বিফোর উইকেটের আবেদন হয়। ফিল্ড আম্পায়ার নাকচ করলে রিভিউ নেয় ভারত। রিভিউটি নষ্ট হলে আম্পায়ারের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন অধিনায়ক বিরাট কোহলি। এরপর সৌম্য বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। হার্দিক পান্ডিয়ার বলে বিরাট কোহলির তালুবন্দি হয়ে ৩৮ বলে ৩৩ রানে ফেরেন তিনি। তার বিদায়ের পর সাকিব-মুশফিকের ক্ল্যাসিক জুটি দেখার অপেক্ষায় ছিলেন টাইগার ভক্তরা। ঠিক তখনই ছন্দপতন। যুজবেন্দ্র চাহালের বলে মোহাম্মদ শামির তালুবন্দি হন মুশফিকুর রহিম (২৪)।

সাকিব একাকীই টানছিলেন বাংলাদেশের ইনিংস। বিশ্বসেরা অল-রাউন্ডার ৫৮ বলে চলতি বিশ্বকাপে নিজের চতুর্থ হাফ সেঞ্চুরিটাও পূর্ণ করেছিলেন। মুশফিকের বিদায়ের পর উইন্ডিজের বিপক্ষে জয়ের পথে সাকিবের সঙ্গী লিটন নেমেছিলেন ক্রিজে। তিনি নিজের ছন্দে থাকলেও জুটিটা বড় করতে পারেননি। ত্রিশতম ওভারে ভুবনেশ্বর কুমারকে ছক্কা মারার এক বল পরেই ক্যাচ তুলে দেন দিনেশ কার্তিকের হাতে। ১৬২ রানে ৪ উইকেট হারায় বাংলাদেশ। স্কোরবোর্ডে আর মাত্র ১১ রান যোগ হতেই মোসাদ্দেক (৩) স্ট্যাম্প খোয়ান বুমরাহর বলে। হার্দিক পান্ডিয়া ৭৪ বলে ছয় বাউন্ডারিতে ৬৬ রান করা সাকিবকে প্যাভিলিয়নের পথ ধরালে ওখানেই আসলে থমকে যায় বাংলাদেশের জয়ের স্বপ্ন।

তারপরও সাব্বির-সাইফুদ্দিনের জুটিতে রান আসছিল। এদের ৬৬ রানের জুটিটা ভাঙেন বুমরাহ। বোল্ড হন ৩৬ বলে ৩৬ রান করা সাব্বির। মাশরাফিকে (৩) উইকেটের পেছনে ধোনির গ্লাভসে বল জমা দিয়ে ফিরতে হয় ভুবনেশ্বরের বলে।

আটচল্লিশতম ওভারের শেষ দুই বলে জসপ্রিত বুমরাহর নিখুত ইয়র্কারে রুবেল হোসেন (৯) ও মোস্তাফিজুর রহমান (০) ফিরলে দুই ওভার হাতে রেখে ২৮৬ রানে অল আউট হয় বাংলাদেশ। আর হ্যাঁ, ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ওডিআই হাফ সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে ৩৮ বলে ৯ বাউন্ডারিতে ৫১ রানে অপরাজিত থাকেন সাইফুদ্দিন।

মুস্তাফিজের বলে রোহিত শর্মার দেয়া ক্যাচ ডিপ স্কয়ার লেগ থেকে দৌড়ে এসেও তালুবন্দী করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন তামিম ইকবাল। এজবাস্টনে বাংলাদেশ- ভারতের মধ্যকার বিশ্বকাপের ম্যাচে ধারাভাষ্য কক্ষে তখন সাবেক ক্যারিবিয়ান পেস বোলার মাইকেল হোল্ডিং ও সাবেক ভারতীয় অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি। দুজনেই বলছিলেন সর্বোচ্চ পর্যায়ে এই ক্যাচটা ছিল অতি সাধারণ, আর ওটা ফেললেন বাংলাদেশের অভিজ্ঞ এক ক্রিকেটার। এই ক্যাচ মিসের চরম মূল্য বাংলাদেশের দিতে হবে বলে তখনই দুইজন শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। অন্যথা হয়নি। রোহিত শর্মা টাইগার বোলারদের তুলোধুনো করে ক্যারিয়ারের ২৬তম এবং চলতি বিশ্বকাপের চতুর্থ সেঞ্চুরিটা তুলে নিয়েছে, হাফ সেঞ্চুরির ইনিংস খেলেছেন আরেক ওপেনার লোকেশ রাহুলও। পার্টটাইম বোলার সৌম্য সরকারের হাত ধরে রোহিতকে ফিরিয়ে প্রথম ব্রেকথ্রু পাওয়ার পর মুস্তাফিজের পাঁচ উইকেট শিকার এবং বাকি বোলারদের চেষ্টাতেও ভারতীয়দের স্কোর তিনশ’র নিচে রাখা সম্ভব হয়নি। টস জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া ভারতের সংগ্রহটা নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৯ উইকেটে ঠেকেছে ৩১৪ রানে। ফলে সেমির স্বপ্ন টিকিয়ে রাখার বাঁচা-মরার লড়াইয়ে জয়ের জন্য ৩১৫ রানের টার্গেট পেয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।

নিজেদের ইনিংসে শুরু থেকেই সাবধানি ছিলেন ভারতীয় ওপেনার লোকেশ রাহুল। রোহিতও খেলছিলেন রয়ে সয়ে। ম্যাচের তখন পঞ্চম ওভার। চতুর্থ বলটি একটু খাটো লেংথে করেছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। আয়েশ করে পুল করতে গিয়ে টাইমিংয়ে গড়বড় করে ফেলেন রোহিত শর্মা। ডিপ স্কয়ার লেগে ফিল্ডিং করছিলেন তামিম ইকবাল। বল বাতাসে ভেসে সেদিকে যাওয়ায় রোহিতের নিশ্চিত আউট নিয়ে গ্যালারিতে থাকা ভারতীয় দর্শকদের মধ্যে যখন হতাশা, তখনই সেখানে ‘প্রাণ’ ফেরালেন তামিম ইকবাল। সহজ ক্যাচটা ফেলে দিলেন বাংলাদেশের অভিজ্ঞ এই ক্রিকেটার। ব্যক্তিগত ৯ রানে জীবন পেলেন রোহিত। যে জুটি ভেঙে যেতে পারত মাত্র ২০ রানে, বড় রকমের ধাক্কা দিয়ে মনোবল নষ্ট করা সম্ভব ছিল ভারতের, সেই উদ্বোধনী জুটি দলকে টিম ইন্ডিয়াকে নিয়ে গেল ১৮০ রান পর্যন্ত।

টাইগার অধিনায়ক মাশরাফি মর্তুজা থেকে শুরু করে মুস্তাফিজ সাকিবসহ ছয়জন বোলার ব্যবহার করেও আটকানো যাচ্ছিল না লোকেশ-রোহিতকে। সাফল্য এল পার্টটাইম বোলার সৌম্য সরকারের হাত ধরে। অফ কাটারে এক্সট্রা কাভারের ওপর দিয়ে হাঁকাতে গিয়ে লিটন কুমার দাসের হাতে ধরা পড়লেন রোহিত। ততক্ষণে ভারতীয় ওপেনারের সংগ্রহ ৯২ বলে সাত বাউন্ডারি ও পাঁচ ছক্কায় ১০৪। জীবন পেয়ে রোহিত সাবধানি হলেও রানের চাকা ধীর হতে দেননি। প্রথম ৫০ রানে পৌঁছতে ৪৫ বল খেলার পর সেঞ্চুরি পূরণ করতে আরও ৪৫ বল মোকাবেলা করেন তিনি। বিশ্বকাপে রোহিতের এটা টানা দ্বিতীয় শতরানের ইনিংস। বাংলাদেশের আগে ইংল্যান্ডের কাছে হেরে যাওয়া ম্যাচেও সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন ভারতীয় ওপেনার।

লোকেশ রাহুলও ফিরেছেন হাফ সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে। তার সঙ্গে যোগ দেয়া বিরাট কোহলির জুটিটা হয় মাত্র ১৫ রানের। লোকেশ ৯২ বলে ছয় বাউন্ডারি ও এক ছক্কায় ৭৭ রান করে রুবেল হোসেনকে খোঁচা মেরে ধরা পড়েন মুশফিকের গ্লাভসে।

কোহলি-পান্ট জুটি জেঁকে বসার আগেই জোড়া আঘাত করে টাইগারদের লড়াইয়ে ফিরিয়েছেন মুস্তাফিজুর রহমান। তৃতীয় উইকেটে ৪২ রান উঠতেই কাটার মাস্টারের আঘাতে প্যাভিলিয়নে ফেরেন বিরাট কোহলি (২৬)। মিডউইকেটে রুবেল হোসেনের হাতে ক্যাচ দেন ভারতীয় অধিনায়ক। ৩৯তম ওভারের দ্বিতীয় বলে বিরাটকে ফেরানোর এক বল পরই ঝড় তোলার আগেই হার্দিক পান্ডিয়াকে (০) ফেরান মুস্তাফিজ।

টাইগার বোলারদের ওপর চড়াও হতে থাকা ঋষভ পান্টকে (৪৮) ক্রিজছাড়া করেন সাকিব আল হাসান। ভারতের ইনিংসে এরপর একে একে দীনেশ কার্তিক (৮), মহেন্দ্র সিং ধোনি (৩৫) ও মোহাম্মদ শামিকে (১) ফিরিয়ে এক ইনিংসে পাঁচ উইকেট শিকারের কৃতিত্ব দেখান মুস্তাফিজ। ভুবনেশ্বর কুমারের রান আউটটাও ছিল মুস্তাফিজের করা পঞ্চাশতম ওভারের শেষ বলে।

উল্লেখ করা যেতে পারে, ভারতের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচে ঢাকার মাঠে পাঁচ উইকেট শিকারের মধ্য দিয়েই বিশ্বমঞ্চে নিজের আগমন বার্তা জানান দিয়েছিলেন কাটার মাস্টার মুস্তাফিজ। ভারতের বিপক্ষে পরের ম্যাচেই তিনি শিকার করেছিলেন ছয় উইকেট। এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেন ২০১৯ সালের বিশ্বকাপের ম্যাচেও।

সংক্ষিপ্ত স্কোর: ভারত ৩১৪/৯ (রাহুল ৭৭, রোহিত ১০৪, কোহলি ২৬, পান্ত ৪৮, পান্ডিয়া ০, ধোনি ৩৫, কার্তিক ৮, ভুবনেশ্বর ২, সামি ১, বুমরাহ ০*; মাশরাফি ৫-০-৩৬-০, সাইফ ৭-০-৫৯-০, মুস্তাফিজ ১০-১-৫৯-৫, সাকিব ১০-০-৪১-১, মোসাদ্দেক ৪-০-৩২-০, রুবেল ৮-০-৪৮-১, সৌম্য ৬-০-৩৩-১)।