হত্যার তদন্তে নিরপেক্ষতা ও পুলিশের ভূমিকার প্রশ্নে

নিহত রিফাত ও মিন্নির পরিবার পরস্পরের বিরুদ্ধে অবস্থান

  • চলছে পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন
  • মূল ঘটনা আড়াল করতে চলছে নানা কৌশল : অভিযোগ

বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যার তদন্তে নিরপেক্ষতা ও পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নে দুই পরিবার পরস্পরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এর নেপথ্যে ভূমিকা পালনকারীদের এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। রিফাত শরীফের স্ত্রী ও হত্যা মামলার প্রধান সাক্ষী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি গ্রেফতার হওয়ার পর দুই পরিবারের বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। রিফাত শরীফের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ পুত্রবধূ মিন্নিকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করার পর গ্রেফতার করে পুলিশ। এবার তিনি মিন্নির মা-বাবাকেও গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন। গত শুক্রবার সংবাদ সম্মেলন করে হত্যা মামলার বাদী দুলাল শরীফের এমন দাবির পেছনে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন দেখছে মিন্নির পরিবার ও বরগুনার সাধারণ মানুষ। ওই তৃতীয় পক্ষকে লাভবান করাতে প্রধান ভূমিকায় বরগুনা জেলা পুলিশ রয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। মূল তথ্য আড়াল, ঘাতকদের অতীত তথ্য ধামাচাপা দেয়া ও ঘাতকদের কারও কারও সঙ্গে পুলিশ এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সখ্যের বিষয়টি আড়াল করতে রিফাত শরীফের বাবাকে দিয়ে একের পর এক নতুন ইস্যু সামনে আনা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে।

এদিকে নিহত রিফাত শরীফের এক সময় নয়ন বন্ডের সঙ্গে সখ্য ছিল বলে তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। ছিঁচকে চুরি ও মাদক ব্যবসার অভিযোগও রয়েছে নিহত রিফাতের বিরুদ্ধে।

সম্প্রতি পুলিশের বিরুদ্ধে মিন্নির বাবার সংবাদ সম্মেলন ও মামলার তদন্ত পিবিআইয়ে হস্তান্তরের দাবির পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন দুলাল শরীফ। তার ভাষ্য- ‘বাবা হিসেবে রিফাত হত্যা মামলার বাদী আমি। মামলার তদন্ত কাজ ঠিকভাবে চলছে। এখানে অন্য কোন সংস্থার কাছে মামলা প্রেরণের কোন দাবি নেই। মোজাম্মেল হক কিশোর এক আসামির বাবা। তার মেয়ে মিন্নি হত্যাকান্ডে জড়িত। তাই পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তাদের কোন পরামর্শ থাকতে পারে না। রিফাত হত্যা হয়েছে নারীর কারণে। সে মিন্নি। মিন্নি একই সঙ্গে দু’জনকে বিয়ে করে তার ছেলের করুণ পরিণতি ডেকে এনেছে। তিনি বলেন, মিন্নির বাবা কুখ্যাত সুদখোর। মিন্নির সঙ্গে নয়ন বন্ডের বিয়েটি লুকিয়ে রেখে রিফাতের সঙ্গে আবার বিয়ে দিয়েছিলেন। এটি প্রতারণার বিয়ে। এ প্রতারণার বিরুদ্ধে আমি মামলা করব।’

মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হক কিশোর টেলিফোনে সংবাদকে জানান, তার মেয়ে মিন্নি স্বামী রিফাতকে বাঁচানোর যে চেষ্টা করেছিলেন, ওই ঘটনা দেশবাসী ভিডিওতে দেখেছে। জামাতার এমন নৃশংস হত্যাকান্ডে তার মেয়েসহ সবাই শোকাহত। পুলিশ যেখানে খুনিদের গ্রেফতার করবে, সেখানে হঠাৎ করেই তার মেয়েকে গ্রেফতার করেছে। রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছে। এখন তাদের পরিবারকে নিয়ে টানাটানি শুরু করেছে। ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে রিফাতের বাবাকে একটি মহল মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলাচ্ছে। তিনি এখন বাড়ি থেকে বের হতে পারছেন না। তার ছেলেমেয়ে স্কুলে কলেজে যেতে পারছে না। তাদের পরিবারের সবার জীবন এখন হুমকির মধ্যে পড়েছে। ক্ষুব্ধকণ্ঠে তিনি বলেন, অনেক কিছু ভয়ে বলতে পারি না। পুলিশ আমাদের পুরো পরিবারকে নজরদারির মধ্যে রেখেছে। একটি বিশেষ মহল ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে এখন রিফাতের বাবা দুলাল শরীফকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। তার ছেলের সঙ্গে আমার মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইনি। কয়েক ব্যক্তির কথায় তার ছেলের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ের বিষয়ে রাজি হই। বিয়ের ১৫ দিন পরই রিফাত মাদক মামলায় গ্রেফতার হয়ে জেলে যায়। অনেকেই আমাকে বলেছেন, রিফাত খারাপ প্রকৃতির ছেলে। তাও কিছু বলিনি। নয়ন বন্ডের সঙ্গে রিফাতের এক সময় ঘনিষ্ঠতা ছিল। নয়ন ভন্ডের সঙ্গে রিফাতের ছবি আছে। তাও আমাকে এক সাংবাদিক দেখিয়েছেন।

যে কারণে পুলিশের বিরুদ্ধে তদন্তের নিরেপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন : বরগুনায় রিফাত হত্যায় জড়িতরা ছিল শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ও ছিঁচকে সন্ত্রাসী। স্থানীয় এমপি, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের আস্তাভাজন ছিল এসব সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ীরা। ‘এসব কারণ’-এ পুলিশ বিষয়টি জানলেও ওই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। রিফাত হত্যার মূল আসামি নয়ন বন্ড জেলা পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করত। নয়ন বন্ডের বাসায় পুলিশের কয়েক কর্মকর্তার নিয়মিত যাতায়াতও ছিল। পুলিশ সোর্স পরিচয়ে বরগুনায় মাদক ব্যবসা ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালাত সে। আর এ গ্রুপেরই সক্রিয় সদস্য ছিল খুন হওয়া রিফাত। তার (রিফাত শরীফ) বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা রয়েছে বরগুনা থানায়। নয়ন বন্ড পুলিশের হাতে একবার গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে জামিনে ছাড়িয়ে আনেন জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। অন্যদিকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের স্ত্রীর সঙ্গে বাসার গেটের সামনে মোটরসাইকেল রাখা নিয়ে তর্কবিতর্কের পর মাদক মামলায় জেল খাটেন রিফাত শরীফ।

নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজী ও রিশাদ ফরাজীর হাতে রিফাত খুন হওয়ার পর অনেক বিষয় সামনে চলে আসে। পুলিশের দাবি অনুযায়ী একবার শতাধিক পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ গ্রেফতার হন রিফাত শরীফ। ওই দৃশ্য নয়ন বন্ড মোবাইল ফোনে ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ইউটিউবে ছড়িয়ে দেয়। এ নিয়ে নয়ন বন্ডের সঙ্গে রিফাত শরীফের বিরোধ তৈরি হয়। এসব কারণে রিফাত শরীফকে যখন শায়েস্তা করার পরিকল্পনা নেয় নয়ন বন্ড, তখন ওই পরিকল্পনায় যুক্ত হয় জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের ভায়রার দুই ছেলে রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজী। রিফাত শরীফকে কলেজ থেকে ধরে আনে রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজী। রাস্তায় এনে ধারালো অস্ত্র দিয়ে রিফাত শরীফকে প্রথম আঘাত করে রিফাত ও রিশান ফরাজী। অথচ হত্যাকারীরা সবাই এক সময় রিফাত শরীফের ঘনিষ্ঠ ছিল। ওই সম্পর্ক কেন ভাঙল এবং ঘনিষ্ঠদের হাতে রিফাত কেন খুন হলেন- এসব প্রশ্নের উত্তরে পুলিশ নিশ্চুপ। নয়ন বন্ড গ্রুপকে স্থানীয় এমপি, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিভিন্ন সময় শেল্টার দিয়েছে, অর্থ দিয়ে লালন করেছেন। সবশেষ স্থানীয় এমপির ছেলের সঙ্গেও নয়ন বন্ডের ঘনিষ্ঠতা ছিল। এসব বিষয়ে তদন্ত না করে পুলিশের ‘নিশ্চুপ’ থাকা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। এর মধ্যে বরগুনায় ০০৭ গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকদের মুখোশ উন্মোচন; রিফাতকে হত্যার মূল কারণ আড়াল করার চেষ্টা; নয়ন বন্ড, রিফাত ও রিশান ফরাজী গংয়ের সঙ্গে স্থানীয় রাজনীতিকদের সখ্য; স্থানীয় এমপির ছেলের সখ্য; নয়ন বন্ডের সঙ্গে মিন্নির বৈবাহিত সম্পর্কের তথ্য ফাঁসের পর মিন্নির নগ্ন ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ার ঘটনায় মামলার তদন্তে নিরেপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়ে পুলিশ। পরিস্থিতি সামাল দিতেই হঠাৎ হত্যা মামলার প্রধান আসামি মিন্নিকে ঘাতক হিসেবে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে বলে মনে করছে বরগুনার সাধারণ মানুষ। আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার তথ্য প্রকাশে পুলিশের অনীহা, হত্যাকারীদের শেল্টারদাতাদের খুঁজে বের করার বিষয়ে পুলিশের নীরবতায় এসব প্রশ্ন উঠেছে। এসব কারণে মামলার তদন্ত বরগুনা থানার পুলিশ থেকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) হস্তান্তরের দাবি ওঠে।

আমাদের বরগুনা প্রতিনিধি জানান, মিন্নির সঙ্গে গতকাল সকালে কারাগারে দেখা করেছেন তার মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যরা। এ সময় মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন অনেকটা ক্ষুব্ধ ছিলেন। ক্ষোভ নিয়ে তিনি জানান, তার মেয়ে ভালো নেই, বিনা চিকিৎসায় মারা যাবেন। সাদা পোশাকধারী পুলিশ সদস্যরা তাদের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রেখেছেন। তারা কোন কথা বলতে পারেন না, কোথাও যেতে পারেন না। মিন্নির সঙ্গেও সময় নিয়ে দেখা করতে পারেন না। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গেলেও কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকে পুলিশের লোকজন।

শুক্রবার দুপুরে বরগুনা প্রেসক্লাবে রিফাত শরীফের বাবা দুলাল শরীফ সংবাদ সম্মেলন করে মিন্নির বাবাকে দোষারোপ করার পর শনিবার বিকেলে বরগুনা প্রেসক্লাবে আসেন মোজাম্মেল হক। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, রিফাত হত্যার সঠিক তদন্ত হলে রিফাতের বাবার ক্ষতি কী? এ তদন্তে যদি মিন্নি দোষী হয়, তাহলে কারও আপত্তি থাকবে না। আসামিদের সঙ্গে তার যোগসাজোশ রয়েছে। তাদের বাঁচাতে চান তিনি। না হলে এ ধরনের বক্তব্য কেউ দেন?

নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজীর মায়ের বৈঠক : টান টান উত্তেজনার মধ্যে গতকাল সন্ধ্যায় নয়ন বন্ডের মা শাহিদা বেগমের সঙ্গে রিফাত ও রিশান ফরাজীর মা রেশমা বেগমের একটি বৈঠক হয়েছে নয়ন বন্ডের ধানসিঁড়ির বাসায়। নয়ন বন্ডের বাসার পাশের এক নারী জানান, প্রায় ১ ঘণ্টা বৈঠকে তারা ছেলেদের পক্ষে সাফাই গান এবং একে অপরের সন্তানদের বিষয় খোঁজখবর করে দুঃখ প্রকাশ করে সান্তনা দেন।

রবিবার, ২৮ জুলাই ২০১৯ , ১৩ শ্রাবন ১৪২৫, ২৪ জিলকদ ১৪৪০

হত্যার তদন্তে নিরপেক্ষতা ও পুলিশের ভূমিকার প্রশ্নে

নিহত রিফাত ও মিন্নির পরিবার পরস্পরের বিরুদ্ধে অবস্থান

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক/ প্রতিনিধি, বরগুনা

image

  • চলছে পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন
  • মূল ঘটনা আড়াল করতে চলছে নানা কৌশল : অভিযোগ

বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যার তদন্তে নিরপেক্ষতা ও পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নে দুই পরিবার পরস্পরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এর নেপথ্যে ভূমিকা পালনকারীদের এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। রিফাত শরীফের স্ত্রী ও হত্যা মামলার প্রধান সাক্ষী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি গ্রেফতার হওয়ার পর দুই পরিবারের বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। রিফাত শরীফের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ পুত্রবধূ মিন্নিকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করার পর গ্রেফতার করে পুলিশ। এবার তিনি মিন্নির মা-বাবাকেও গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন। গত শুক্রবার সংবাদ সম্মেলন করে হত্যা মামলার বাদী দুলাল শরীফের এমন দাবির পেছনে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন দেখছে মিন্নির পরিবার ও বরগুনার সাধারণ মানুষ। ওই তৃতীয় পক্ষকে লাভবান করাতে প্রধান ভূমিকায় বরগুনা জেলা পুলিশ রয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। মূল তথ্য আড়াল, ঘাতকদের অতীত তথ্য ধামাচাপা দেয়া ও ঘাতকদের কারও কারও সঙ্গে পুলিশ এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সখ্যের বিষয়টি আড়াল করতে রিফাত শরীফের বাবাকে দিয়ে একের পর এক নতুন ইস্যু সামনে আনা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে।

এদিকে নিহত রিফাত শরীফের এক সময় নয়ন বন্ডের সঙ্গে সখ্য ছিল বলে তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। ছিঁচকে চুরি ও মাদক ব্যবসার অভিযোগও রয়েছে নিহত রিফাতের বিরুদ্ধে।

সম্প্রতি পুলিশের বিরুদ্ধে মিন্নির বাবার সংবাদ সম্মেলন ও মামলার তদন্ত পিবিআইয়ে হস্তান্তরের দাবির পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন দুলাল শরীফ। তার ভাষ্য- ‘বাবা হিসেবে রিফাত হত্যা মামলার বাদী আমি। মামলার তদন্ত কাজ ঠিকভাবে চলছে। এখানে অন্য কোন সংস্থার কাছে মামলা প্রেরণের কোন দাবি নেই। মোজাম্মেল হক কিশোর এক আসামির বাবা। তার মেয়ে মিন্নি হত্যাকান্ডে জড়িত। তাই পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তাদের কোন পরামর্শ থাকতে পারে না। রিফাত হত্যা হয়েছে নারীর কারণে। সে মিন্নি। মিন্নি একই সঙ্গে দু’জনকে বিয়ে করে তার ছেলের করুণ পরিণতি ডেকে এনেছে। তিনি বলেন, মিন্নির বাবা কুখ্যাত সুদখোর। মিন্নির সঙ্গে নয়ন বন্ডের বিয়েটি লুকিয়ে রেখে রিফাতের সঙ্গে আবার বিয়ে দিয়েছিলেন। এটি প্রতারণার বিয়ে। এ প্রতারণার বিরুদ্ধে আমি মামলা করব।’

মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হক কিশোর টেলিফোনে সংবাদকে জানান, তার মেয়ে মিন্নি স্বামী রিফাতকে বাঁচানোর যে চেষ্টা করেছিলেন, ওই ঘটনা দেশবাসী ভিডিওতে দেখেছে। জামাতার এমন নৃশংস হত্যাকান্ডে তার মেয়েসহ সবাই শোকাহত। পুলিশ যেখানে খুনিদের গ্রেফতার করবে, সেখানে হঠাৎ করেই তার মেয়েকে গ্রেফতার করেছে। রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছে। এখন তাদের পরিবারকে নিয়ে টানাটানি শুরু করেছে। ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে রিফাতের বাবাকে একটি মহল মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলাচ্ছে। তিনি এখন বাড়ি থেকে বের হতে পারছেন না। তার ছেলেমেয়ে স্কুলে কলেজে যেতে পারছে না। তাদের পরিবারের সবার জীবন এখন হুমকির মধ্যে পড়েছে। ক্ষুব্ধকণ্ঠে তিনি বলেন, অনেক কিছু ভয়ে বলতে পারি না। পুলিশ আমাদের পুরো পরিবারকে নজরদারির মধ্যে রেখেছে। একটি বিশেষ মহল ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে এখন রিফাতের বাবা দুলাল শরীফকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। তার ছেলের সঙ্গে আমার মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইনি। কয়েক ব্যক্তির কথায় তার ছেলের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ের বিষয়ে রাজি হই। বিয়ের ১৫ দিন পরই রিফাত মাদক মামলায় গ্রেফতার হয়ে জেলে যায়। অনেকেই আমাকে বলেছেন, রিফাত খারাপ প্রকৃতির ছেলে। তাও কিছু বলিনি। নয়ন বন্ডের সঙ্গে রিফাতের এক সময় ঘনিষ্ঠতা ছিল। নয়ন ভন্ডের সঙ্গে রিফাতের ছবি আছে। তাও আমাকে এক সাংবাদিক দেখিয়েছেন।

যে কারণে পুলিশের বিরুদ্ধে তদন্তের নিরেপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন : বরগুনায় রিফাত হত্যায় জড়িতরা ছিল শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ও ছিঁচকে সন্ত্রাসী। স্থানীয় এমপি, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের আস্তাভাজন ছিল এসব সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ীরা। ‘এসব কারণ’-এ পুলিশ বিষয়টি জানলেও ওই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। রিফাত হত্যার মূল আসামি নয়ন বন্ড জেলা পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করত। নয়ন বন্ডের বাসায় পুলিশের কয়েক কর্মকর্তার নিয়মিত যাতায়াতও ছিল। পুলিশ সোর্স পরিচয়ে বরগুনায় মাদক ব্যবসা ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালাত সে। আর এ গ্রুপেরই সক্রিয় সদস্য ছিল খুন হওয়া রিফাত। তার (রিফাত শরীফ) বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা রয়েছে বরগুনা থানায়। নয়ন বন্ড পুলিশের হাতে একবার গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে জামিনে ছাড়িয়ে আনেন জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। অন্যদিকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের স্ত্রীর সঙ্গে বাসার গেটের সামনে মোটরসাইকেল রাখা নিয়ে তর্কবিতর্কের পর মাদক মামলায় জেল খাটেন রিফাত শরীফ।

নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজী ও রিশাদ ফরাজীর হাতে রিফাত খুন হওয়ার পর অনেক বিষয় সামনে চলে আসে। পুলিশের দাবি অনুযায়ী একবার শতাধিক পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ গ্রেফতার হন রিফাত শরীফ। ওই দৃশ্য নয়ন বন্ড মোবাইল ফোনে ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ইউটিউবে ছড়িয়ে দেয়। এ নিয়ে নয়ন বন্ডের সঙ্গে রিফাত শরীফের বিরোধ তৈরি হয়। এসব কারণে রিফাত শরীফকে যখন শায়েস্তা করার পরিকল্পনা নেয় নয়ন বন্ড, তখন ওই পরিকল্পনায় যুক্ত হয় জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের ভায়রার দুই ছেলে রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজী। রিফাত শরীফকে কলেজ থেকে ধরে আনে রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজী। রাস্তায় এনে ধারালো অস্ত্র দিয়ে রিফাত শরীফকে প্রথম আঘাত করে রিফাত ও রিশান ফরাজী। অথচ হত্যাকারীরা সবাই এক সময় রিফাত শরীফের ঘনিষ্ঠ ছিল। ওই সম্পর্ক কেন ভাঙল এবং ঘনিষ্ঠদের হাতে রিফাত কেন খুন হলেন- এসব প্রশ্নের উত্তরে পুলিশ নিশ্চুপ। নয়ন বন্ড গ্রুপকে স্থানীয় এমপি, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিভিন্ন সময় শেল্টার দিয়েছে, অর্থ দিয়ে লালন করেছেন। সবশেষ স্থানীয় এমপির ছেলের সঙ্গেও নয়ন বন্ডের ঘনিষ্ঠতা ছিল। এসব বিষয়ে তদন্ত না করে পুলিশের ‘নিশ্চুপ’ থাকা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। এর মধ্যে বরগুনায় ০০৭ গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকদের মুখোশ উন্মোচন; রিফাতকে হত্যার মূল কারণ আড়াল করার চেষ্টা; নয়ন বন্ড, রিফাত ও রিশান ফরাজী গংয়ের সঙ্গে স্থানীয় রাজনীতিকদের সখ্য; স্থানীয় এমপির ছেলের সখ্য; নয়ন বন্ডের সঙ্গে মিন্নির বৈবাহিত সম্পর্কের তথ্য ফাঁসের পর মিন্নির নগ্ন ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ার ঘটনায় মামলার তদন্তে নিরেপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়ে পুলিশ। পরিস্থিতি সামাল দিতেই হঠাৎ হত্যা মামলার প্রধান আসামি মিন্নিকে ঘাতক হিসেবে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে বলে মনে করছে বরগুনার সাধারণ মানুষ। আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার তথ্য প্রকাশে পুলিশের অনীহা, হত্যাকারীদের শেল্টারদাতাদের খুঁজে বের করার বিষয়ে পুলিশের নীরবতায় এসব প্রশ্ন উঠেছে। এসব কারণে মামলার তদন্ত বরগুনা থানার পুলিশ থেকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) হস্তান্তরের দাবি ওঠে।

আমাদের বরগুনা প্রতিনিধি জানান, মিন্নির সঙ্গে গতকাল সকালে কারাগারে দেখা করেছেন তার মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যরা। এ সময় মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন অনেকটা ক্ষুব্ধ ছিলেন। ক্ষোভ নিয়ে তিনি জানান, তার মেয়ে ভালো নেই, বিনা চিকিৎসায় মারা যাবেন। সাদা পোশাকধারী পুলিশ সদস্যরা তাদের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রেখেছেন। তারা কোন কথা বলতে পারেন না, কোথাও যেতে পারেন না। মিন্নির সঙ্গেও সময় নিয়ে দেখা করতে পারেন না। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গেলেও কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকে পুলিশের লোকজন।

শুক্রবার দুপুরে বরগুনা প্রেসক্লাবে রিফাত শরীফের বাবা দুলাল শরীফ সংবাদ সম্মেলন করে মিন্নির বাবাকে দোষারোপ করার পর শনিবার বিকেলে বরগুনা প্রেসক্লাবে আসেন মোজাম্মেল হক। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, রিফাত হত্যার সঠিক তদন্ত হলে রিফাতের বাবার ক্ষতি কী? এ তদন্তে যদি মিন্নি দোষী হয়, তাহলে কারও আপত্তি থাকবে না। আসামিদের সঙ্গে তার যোগসাজোশ রয়েছে। তাদের বাঁচাতে চান তিনি। না হলে এ ধরনের বক্তব্য কেউ দেন?

নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজীর মায়ের বৈঠক : টান টান উত্তেজনার মধ্যে গতকাল সন্ধ্যায় নয়ন বন্ডের মা শাহিদা বেগমের সঙ্গে রিফাত ও রিশান ফরাজীর মা রেশমা বেগমের একটি বৈঠক হয়েছে নয়ন বন্ডের ধানসিঁড়ির বাসায়। নয়ন বন্ডের বাসার পাশের এক নারী জানান, প্রায় ১ ঘণ্টা বৈঠকে তারা ছেলেদের পক্ষে সাফাই গান এবং একে অপরের সন্তানদের বিষয় খোঁজখবর করে দুঃখ প্রকাশ করে সান্তনা দেন।