ধর্ষণের বিরুদ্ধে চাই প্রতিরোধ

খন্দকার মুনতাসীর মামুন

বাংলাদেশে ধর্ষণ বাড়ছে, বাড়ছে ধর্ষণের পর হত্যা। একই সঙ্গে বাড়ছে নিষ্ঠুরতা। একের পর এক ধর্ষণের ঘটনায় আমরা বিস্মিত হই; কিন্তু আমাদের এ বিস্ময়ের পরিধি প্রতিনিয়ত বেড়েই চলে। এক এলাকায় ধর্ষণের ঘটনার রেষ কাটতে না কাটতেই গণমাধ্যম কেঁপে ওঠে নতুন আরেক খবরে।

যৌনতা মানুষের জীবনের একটি অংশ। তবে এই যৌনতাকে বিকৃত করে উপস্থাপনই হচ্ছে ধর্ষণ। ধর্ষণের সঙ্গে যৌনতার চেয়েও ক্ষমতার বিষয়টি বেশি সম্পর্কিত। নারীকে দমিয়ে রাখার পুরুষের যে ডমিনেটিং মনোভাব, এর কারণে ধর্ষণ বাড়ছে। অথচ একজন যৌনকর্মীরও অধিকার আছে তিনি কার সঙ্গে যৌনকাজ করবেন আর কার সঙ্গে করবেন না সেটা নির্ধারণ করার। একজন যৌনকর্মী যদি ‘না’ করেন, তা মানা না হলে তা হবে ধর্ষণ। একইভাবে একজন স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে সহবাস করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করতেই পারেন। স্ত্রীর ইচ্ছার সম্মান না দিয়ে জোর করে সহবাস করা হলেও সেটি হবে ধর্ষণ। কিন্তু এ বিষয়গুলো সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়নি বলেই ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। ধর্ষকের হাত থেকে তিন বছরের শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না।

ধর্ষণের বীভৎস রূপ এখন আমরা দেখছি। মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব আর অবশিষ্ট থাকছে কিনা এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যেভাবে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে, ঘটছে প্রতিনিয়তই, তাতে পরিষ্কার যে, মানুষের মধ্যে পশু-প্রবৃত্তি প্রবল হয়ে উঠছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনে অবাধ, লুটপাটের লাইসেন্স পেয়ে যাচ্ছে সহজে। ফলে মানুষের মানবিকতা হারাচ্ছে। অমানবিক মানুষেরাই সমাজে পুরস্কৃত হচ্ছে। কিন্তু মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন মানুষ অবমূল্যায়িত হচ্ছে। ভালো কাজের স্বীকৃতি পাচ্ছেন না তারা। যে কারণে সমাজে বিকৃত রুচির মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।

ধর্ষণের ঘটনার খুব অল্পসংখ্যকই জানা যায়। বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হওয়ায় ধর্ষণের শিকার ও তাদের পরিবার ঘটনাগুলো প্রকাশ করতে চায় না। সাধারণত দরিদ্র ও দুর্বল ঘরের মেয়েরাই ধর্ষণের শিকার হয়। দীর্ঘমেয়াদে মামলা চালানোর মতো অর্থ ও সময় তাদের পরিবার দিতে পারে না। সামাজিকভাবেও তাদের অবস্থান শক্তিশালী নয়। বিপরীত দিকে অর্থবিত্ত বা সামাজিকভাবে প্রভাবশালীরা বা তাদের মদদপুষ্টরাই ধর্ষণের মতো অপরাধ করে। ফলে এসব ক্ষেত্রে পুলিশ মামলা নিতে গড়িমসি করে, মামলা নিলেও তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে টালবাহানা করে, অপরাধীদের বাঁচিয়ে প্রতিবেদন দেয় কিংবা অপরাধী প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাদের দেখতে পায় না। এরকম অভিযোগ অজস্র। একদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানের এই ভূমিকা, অন্যদিকে সামাজিক প্রতিরোধও জোরালো নয়। এখনো কোথাও কোথাও গ্রাম্যসালিশে ধর্ষিতাকেও সমান দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তির ফতোয়া দেয়া হয়।

আইনে দুর্বলতার কারণে ধর্ষণের মামলায় অনেক অভিযুক্ত পার পেয়ে যাচ্ছে বলে মানবাধিকার কর্মীরা অভিযোগ করছেন দীর্ঘদিন ধরেই। তারা বলছেন- আইনের মধ্যে এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যেগুলো ধর্ষিতার বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে দেখা দিচ্ছে।

বেসরকারি সংস্থা নারীপক্ষ বলছে, তারা এক গবেষণার অংশ হিসেবে ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত ছয়টি জেলায় (ঢাকা, ঝিনাইদহ, জামালপুর, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, নোয়াখালী) ধর্ষণের মামলা পর্যবেক্ষণ করেছে। এ গবেষণাটির পরিচালক এবং নারীপক্ষের প্রকল্প পরিচালক রওশন আরা বলেন, এ সময়ে ৪৩৭২টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে, কিন্তু সাজা হয়েছে মাত্র পাঁচজনের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তদন্তে অবহেলা, গাফিলতি আর অদক্ষতার কারণে পার পেয়ে যায় অপরাধীরা। অনেক সময় আদালতে সাক্ষী আনা আর সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপনে পুলিশ আর পিপিদের অযত্ন ও গাফিলতি থাকে। অনেক সময় টাকা খেয়ে মামলা ঘুরিয়ে দেয়ার অভিযোগ শোনা যায়। তাছাড়া রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশকে প্রভাবিত করেও ধর্ষকরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। তাদের বিচার নিশ্চিত না হওয়ায় ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও সামাজিক হয়রানির ভয়ে ধর্ষণের শিকার নারী ও তাদের স্বজনেরা কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে চাচ্ছেন না।

স্বীকার করতেই হবে যে, ধর্ষকরাও আমাদের সমাজেরই কোনো না কোনো পরিবারের সদস্য। তাদের বখে যাওয়ার দায় রয়েছে পরিবার-সমাজেরও। তরুণদের সুস্থ-সুন্দর মন ও মূল্যবোধসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে না, এটাও স্পষ্ট। মাদকের ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গেও এরকম অপরাধের হার বৃদ্ধির যোগসূত্র আছে বলে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ যে মাত্রায় বেড়েছে, লাগাম টেনে না ধরা গেলে তা সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নেবে।

আইনে দুর্বলতার কারণে ধর্ষণের মামলায় অনেক অভিযুক্ত পার পেয়ে যাচ্ছে বলে মানবাধিকার কর্মীরা অভিযোগ করছেন দীর্ঘদিন ধরেই। তারা বলছেন-আইনের মধ্যে এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যেগুলো ধর্ষিতার বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে দেখা দিচ্ছে

রাজনৈতিক কমিটমেন্ট ছাড়া এই ধর্ষণ, নারীর প্রতি সহিংসতা কমবে না। আমরা বারবার বলেছি, ধর্ষণ প্রতিরোধে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মনিটরিং কমিটি করার জন্য, কিন্তু তা করা হচ্ছে না। একটা ঘটনা ঘটে, তারপর গণমাধ্যমসহ সব জায়গায় তুমুল আলোচনা হয়, তারপর এক সময় থেমে যায় সবকিছু। এ সময়ের মধ্যে তালিকায় আরও একটি ঘটনা যোগ হয়। ঘটনা যাতে ঘটতেই না পারে, সেজন্য একটি সামাজিক আন্দোলন খুব জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে। ধর্ষণ প্রতিরোধে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি, তা থেকে বের হতে হবে। ধর্ষককে দৃষ্টান্তমূলক সাজার আওতায় আনতে হবে। ২০০৩ সালে সংশোধিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের বিচারে যে সময় নির্ধারণ করা আছে, সেই সময়ের মধ্যেই তা শেষ করতে হবে। এ আইনের বিধিমালা প্রণয়ন করাও জরুরি। দেশে এখন পর্যন্ত ভিকটিম ও সাক্ষীর সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়নি। এটি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।

ধর্ষণ, যৌন নির্যাতনসহ নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা বন্ধ করার জন্য কঠোর আইন যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন সেই আইনের যথাযথ প্রয়োগ। ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের খবর যত বেশি পাওয়া যায়, এসব অপরাধের দায়ে অপরাধীদের শাস্তির দৃষ্টান্ত তার চেয়ে অনেক কম। অপরাধ করে পার পাওয়া যায়- এ ধরনের বিশ্বাস থেকে অপরাধীরা অপরাধকর্মে লিপ্ত হয়। এটা শুধু পেশাদার অপরাধীদের ক্ষেত্রে নয়, যেকোনো সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। তাই ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংস অপরাধের রাশ টেনে ধরার জন্য প্রথম কর্তব্য এসব অপরাধের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগে গতি সঞ্চার করা। অপরাধ সংঘটনের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে হবে। একটার পর একটা ধর্ষণের খবরের সমান্তরালে যদি একটার পর একটা শাস্তির খবরও নিশ্চিত করা যায়, তাহলে ধর্ষণপ্রবণতা হ্রাস পাবে।

আমাদের লেখাপড়ায় সমাজ নিয়ে এবং নারী-পুরুষ সম্পর্কের স্বাভাবিক বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা দরকার। এটা নিয়ে একাডেমিক পর্যায়েও কাজ হতে পারে। আর যারা উচ্চশিক্ষা নিতে পারছে না কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে অন্তত পড়াশোনা করছে, সেখানে নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে শিক্ষা দেয়া যেতে পারে। পরিবার ব্যবস্থাকে জোরালোভাবে ভূমিকা পালনের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। অভিভাবকদের খোঁজ রাখতে হবে তাদের সন্তান কাদের সঙ্গে মিশছে। তাদের অগোচরে কোন ধরনের বিনোদন উপকরণগুলো ভোগ করছে। এগুলো যদি নিশ্চিত করতে পারি, তবে ধর্ষণের সংখ্যা কমবে এবং যেভাবে বিকৃতভাবে ধর্ষণ বাড়ছে, ধর্ষণ হচ্ছে-সেটাও কমে আসবে। একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটার পর বিভিন্ন গণমাধ্যম এমনভাবে খবরটা প্রকাশ বা প্রচার করছে, তাতে বিষয়টিতে অন্যদের আরও বেশি করে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এ প্রবণতা থেকে বের হতে হবে।

নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র, ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে নারীর মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটা শুধু রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সম্ভব নয়। এজন্য সামাজিক শক্তিগুলোকেও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ধর্ষণের প্রতি জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে শুধু সরকারকে নয়, গোটা সমাজকে। ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংস আচরণের বিরুদ্ধে ব্যক্তি, পরিবার, পাড়া-মহল্লাসহ গোটা সমাজকে সোচ্চার হতে হবে।

রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৯ , ১৪ পৌষ ১৪২৬, ১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

ধর্ষণের বিরুদ্ধে চাই প্রতিরোধ

খন্দকার মুনতাসীর মামুন

বাংলাদেশে ধর্ষণ বাড়ছে, বাড়ছে ধর্ষণের পর হত্যা। একই সঙ্গে বাড়ছে নিষ্ঠুরতা। একের পর এক ধর্ষণের ঘটনায় আমরা বিস্মিত হই; কিন্তু আমাদের এ বিস্ময়ের পরিধি প্রতিনিয়ত বেড়েই চলে। এক এলাকায় ধর্ষণের ঘটনার রেষ কাটতে না কাটতেই গণমাধ্যম কেঁপে ওঠে নতুন আরেক খবরে।

যৌনতা মানুষের জীবনের একটি অংশ। তবে এই যৌনতাকে বিকৃত করে উপস্থাপনই হচ্ছে ধর্ষণ। ধর্ষণের সঙ্গে যৌনতার চেয়েও ক্ষমতার বিষয়টি বেশি সম্পর্কিত। নারীকে দমিয়ে রাখার পুরুষের যে ডমিনেটিং মনোভাব, এর কারণে ধর্ষণ বাড়ছে। অথচ একজন যৌনকর্মীরও অধিকার আছে তিনি কার সঙ্গে যৌনকাজ করবেন আর কার সঙ্গে করবেন না সেটা নির্ধারণ করার। একজন যৌনকর্মী যদি ‘না’ করেন, তা মানা না হলে তা হবে ধর্ষণ। একইভাবে একজন স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে সহবাস করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করতেই পারেন। স্ত্রীর ইচ্ছার সম্মান না দিয়ে জোর করে সহবাস করা হলেও সেটি হবে ধর্ষণ। কিন্তু এ বিষয়গুলো সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়নি বলেই ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। ধর্ষকের হাত থেকে তিন বছরের শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না।

ধর্ষণের বীভৎস রূপ এখন আমরা দেখছি। মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব আর অবশিষ্ট থাকছে কিনা এ নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যেভাবে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে, ঘটছে প্রতিনিয়তই, তাতে পরিষ্কার যে, মানুষের মধ্যে পশু-প্রবৃত্তি প্রবল হয়ে উঠছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনে অবাধ, লুটপাটের লাইসেন্স পেয়ে যাচ্ছে সহজে। ফলে মানুষের মানবিকতা হারাচ্ছে। অমানবিক মানুষেরাই সমাজে পুরস্কৃত হচ্ছে। কিন্তু মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন মানুষ অবমূল্যায়িত হচ্ছে। ভালো কাজের স্বীকৃতি পাচ্ছেন না তারা। যে কারণে সমাজে বিকৃত রুচির মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।

ধর্ষণের ঘটনার খুব অল্পসংখ্যকই জানা যায়। বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হওয়ায় ধর্ষণের শিকার ও তাদের পরিবার ঘটনাগুলো প্রকাশ করতে চায় না। সাধারণত দরিদ্র ও দুর্বল ঘরের মেয়েরাই ধর্ষণের শিকার হয়। দীর্ঘমেয়াদে মামলা চালানোর মতো অর্থ ও সময় তাদের পরিবার দিতে পারে না। সামাজিকভাবেও তাদের অবস্থান শক্তিশালী নয়। বিপরীত দিকে অর্থবিত্ত বা সামাজিকভাবে প্রভাবশালীরা বা তাদের মদদপুষ্টরাই ধর্ষণের মতো অপরাধ করে। ফলে এসব ক্ষেত্রে পুলিশ মামলা নিতে গড়িমসি করে, মামলা নিলেও তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে টালবাহানা করে, অপরাধীদের বাঁচিয়ে প্রতিবেদন দেয় কিংবা অপরাধী প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাদের দেখতে পায় না। এরকম অভিযোগ অজস্র। একদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানের এই ভূমিকা, অন্যদিকে সামাজিক প্রতিরোধও জোরালো নয়। এখনো কোথাও কোথাও গ্রাম্যসালিশে ধর্ষিতাকেও সমান দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তির ফতোয়া দেয়া হয়।

আইনে দুর্বলতার কারণে ধর্ষণের মামলায় অনেক অভিযুক্ত পার পেয়ে যাচ্ছে বলে মানবাধিকার কর্মীরা অভিযোগ করছেন দীর্ঘদিন ধরেই। তারা বলছেন- আইনের মধ্যে এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যেগুলো ধর্ষিতার বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে দেখা দিচ্ছে।

বেসরকারি সংস্থা নারীপক্ষ বলছে, তারা এক গবেষণার অংশ হিসেবে ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত ছয়টি জেলায় (ঢাকা, ঝিনাইদহ, জামালপুর, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, নোয়াখালী) ধর্ষণের মামলা পর্যবেক্ষণ করেছে। এ গবেষণাটির পরিচালক এবং নারীপক্ষের প্রকল্প পরিচালক রওশন আরা বলেন, এ সময়ে ৪৩৭২টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে, কিন্তু সাজা হয়েছে মাত্র পাঁচজনের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তদন্তে অবহেলা, গাফিলতি আর অদক্ষতার কারণে পার পেয়ে যায় অপরাধীরা। অনেক সময় আদালতে সাক্ষী আনা আর সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপনে পুলিশ আর পিপিদের অযত্ন ও গাফিলতি থাকে। অনেক সময় টাকা খেয়ে মামলা ঘুরিয়ে দেয়ার অভিযোগ শোনা যায়। তাছাড়া রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশকে প্রভাবিত করেও ধর্ষকরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। তাদের বিচার নিশ্চিত না হওয়ায় ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও সামাজিক হয়রানির ভয়ে ধর্ষণের শিকার নারী ও তাদের স্বজনেরা কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে চাচ্ছেন না।

স্বীকার করতেই হবে যে, ধর্ষকরাও আমাদের সমাজেরই কোনো না কোনো পরিবারের সদস্য। তাদের বখে যাওয়ার দায় রয়েছে পরিবার-সমাজেরও। তরুণদের সুস্থ-সুন্দর মন ও মূল্যবোধসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে না, এটাও স্পষ্ট। মাদকের ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গেও এরকম অপরাধের হার বৃদ্ধির যোগসূত্র আছে বলে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ যে মাত্রায় বেড়েছে, লাগাম টেনে না ধরা গেলে তা সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নেবে।

আইনে দুর্বলতার কারণে ধর্ষণের মামলায় অনেক অভিযুক্ত পার পেয়ে যাচ্ছে বলে মানবাধিকার কর্মীরা অভিযোগ করছেন দীর্ঘদিন ধরেই। তারা বলছেন-আইনের মধ্যে এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যেগুলো ধর্ষিতার বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে দেখা দিচ্ছে

রাজনৈতিক কমিটমেন্ট ছাড়া এই ধর্ষণ, নারীর প্রতি সহিংসতা কমবে না। আমরা বারবার বলেছি, ধর্ষণ প্রতিরোধে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মনিটরিং কমিটি করার জন্য, কিন্তু তা করা হচ্ছে না। একটা ঘটনা ঘটে, তারপর গণমাধ্যমসহ সব জায়গায় তুমুল আলোচনা হয়, তারপর এক সময় থেমে যায় সবকিছু। এ সময়ের মধ্যে তালিকায় আরও একটি ঘটনা যোগ হয়। ঘটনা যাতে ঘটতেই না পারে, সেজন্য একটি সামাজিক আন্দোলন খুব জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে। ধর্ষণ প্রতিরোধে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি, তা থেকে বের হতে হবে। ধর্ষককে দৃষ্টান্তমূলক সাজার আওতায় আনতে হবে। ২০০৩ সালে সংশোধিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের বিচারে যে সময় নির্ধারণ করা আছে, সেই সময়ের মধ্যেই তা শেষ করতে হবে। এ আইনের বিধিমালা প্রণয়ন করাও জরুরি। দেশে এখন পর্যন্ত ভিকটিম ও সাক্ষীর সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়নি। এটি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।

ধর্ষণ, যৌন নির্যাতনসহ নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা বন্ধ করার জন্য কঠোর আইন যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন সেই আইনের যথাযথ প্রয়োগ। ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের খবর যত বেশি পাওয়া যায়, এসব অপরাধের দায়ে অপরাধীদের শাস্তির দৃষ্টান্ত তার চেয়ে অনেক কম। অপরাধ করে পার পাওয়া যায়- এ ধরনের বিশ্বাস থেকে অপরাধীরা অপরাধকর্মে লিপ্ত হয়। এটা শুধু পেশাদার অপরাধীদের ক্ষেত্রে নয়, যেকোনো সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। তাই ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংস অপরাধের রাশ টেনে ধরার জন্য প্রথম কর্তব্য এসব অপরাধের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগে গতি সঞ্চার করা। অপরাধ সংঘটনের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে হবে। একটার পর একটা ধর্ষণের খবরের সমান্তরালে যদি একটার পর একটা শাস্তির খবরও নিশ্চিত করা যায়, তাহলে ধর্ষণপ্রবণতা হ্রাস পাবে।

আমাদের লেখাপড়ায় সমাজ নিয়ে এবং নারী-পুরুষ সম্পর্কের স্বাভাবিক বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা দরকার। এটা নিয়ে একাডেমিক পর্যায়েও কাজ হতে পারে। আর যারা উচ্চশিক্ষা নিতে পারছে না কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে অন্তত পড়াশোনা করছে, সেখানে নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে শিক্ষা দেয়া যেতে পারে। পরিবার ব্যবস্থাকে জোরালোভাবে ভূমিকা পালনের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। অভিভাবকদের খোঁজ রাখতে হবে তাদের সন্তান কাদের সঙ্গে মিশছে। তাদের অগোচরে কোন ধরনের বিনোদন উপকরণগুলো ভোগ করছে। এগুলো যদি নিশ্চিত করতে পারি, তবে ধর্ষণের সংখ্যা কমবে এবং যেভাবে বিকৃতভাবে ধর্ষণ বাড়ছে, ধর্ষণ হচ্ছে-সেটাও কমে আসবে। একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটার পর বিভিন্ন গণমাধ্যম এমনভাবে খবরটা প্রকাশ বা প্রচার করছে, তাতে বিষয়টিতে অন্যদের আরও বেশি করে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এ প্রবণতা থেকে বের হতে হবে।

নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র, ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে নারীর মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটা শুধু রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সম্ভব নয়। এজন্য সামাজিক শক্তিগুলোকেও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ধর্ষণের প্রতি জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে শুধু সরকারকে নয়, গোটা সমাজকে। ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংস আচরণের বিরুদ্ধে ব্যক্তি, পরিবার, পাড়া-মহল্লাসহ গোটা সমাজকে সোচ্চার হতে হবে।