নারী শ্রমিকের সন্তানদের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র এবং নারীর ক্ষমতায়ন

মো. জাহাঙ্গীর আলম

ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার আশুলিয়ায় শাহানা আক্তার ও বাবুল মিয়া দম্পত্তির একমাত্র মেয়ে সোহানা, বয়স দুই বছর। এই দম্পত্তি দুই জনেই গার্মেন্টস কারখানায় চাকরি করে। তাদের মেয়েটিকে পাশের একটি ডে-কেয়ার সেন্টার (শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র)-এ রেখে তারা গার্মেন্ট চাকরিতে যায়। গত এক বছর যাবৎ তারা মেয়েকে সকালে ডে-কেয়ার সেন্টারে রেখে আসে এবং সন্ধ্যায় নিয়ে আসে। শাহানা ও বাবুল দম্পত্তি পাঁচ বছর ধরে গার্মেন্টে চাকরি করে। সন্তান জন্ম নেয়ার পর শাহানা প্রায় এক বছর চাকরি ছেড়ে বাসায় সন্তানটিকে লালন-পালন করতেন। তিনি ভেবেছিলেন তার আর চাকরি করা হবে না। প্রতিবেশী রেবেকা নামের একজন গার্মেন্ট কর্মীর মাধ্যমে জানতে পারে, তারা যে এলাকায় থাকেন সেখানে সরকারিভাবে পরিচালিত একটি ডে-কেয়ার সেন্টার রয়েছে। সেখানে মেয়ে রেখে সে গার্মেন্ট এ কাজ করতে পারবে। সেই থেকে শাহানা আক্তার তার মেয়েকে ওই ডে-কেয়ার সেন্টারে রেখে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরি করছেন। দুই জনেই চাকরি করায় সংসারে আগের তুলনায় বেশি স্বচ্ছলতা এসেছে।

শাহানা-বাবুল দম্পতির মতো অনেকই ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ সারা দেশে অনেক নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত দম্পতিই এইভাবে সন্তানকে ডে-কেয়ার সেন্টার এ রেখে চাকরি করছেন। কর্মজীবী বাবা-মায়ের শিশু সন্তানদের লালন-পালনে ডে-কেয়ার সেন্টারে রেখে আসাই এক মাত্র ভরসা।

গত এক দশকে দেশে নারী কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে হার প্রায় ৩৬ শতাংশ। যদিও নারীদের আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের তুলনায় অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের হার বেশি। দেশে দিনে দিনে একক পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন নগর অঞ্চলে একক পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে পরিবারের স্বামী-স্ত্রী উভয় কর্মসংস্থানে যুক্ত হওয়াতে তাদের ব্যস্তময় জীবনে শিশু সন্তানদের লালন-পালনে ডে-কেয়ার সেন্টার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ব্যস্ত বা কর্মজীবী বাবা-মায়েদের সন্তানদের বেড়ে ওঠা এবং মানসিক বিকাশ, লেখাপড়া এবং সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে বর্তমানে ডে-কেয়ার সেন্টার পরিবারের দায়িত্বের কাজ করছে। ব্যস্তময় নগর জীবনে শিশুর মানসিক বিকাশের ওপর গুরুত্ব দিয়ে এই সব দিবাযত্ন কেন্দ্রসমূহে গড়ে উঠেছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা এ সব দিবাযত্ন কেন্দ্রে ওপর নির্ভর করে পরিবারের স্বামী-স্ত্রী উভয় নিশ্চিতে চাকরি করেছেন। শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রে যে শুধু শিশুকে কিছু সময় রেখে দেয়া হয় তা নয়, শিশুকে খাওয়ানো, খেলাধুলা, আঁকা, গান শেখানোসহ অন্যান্য নানা কর্মকাণ্ডে যুক্ত করানো হয়। শিশুরা অন্য শিশুদের সঙ্গে সারা সময় হেসে, খেলে, দুষ্টুমি করে কাটায় এ সকল শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রে। এখানকার গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে শিশু একা নিঃসঙ্গ বোধ করে না। একক পরিবারের ক্ষেত্রে শিশুর সামাজিকীকরণ ও সামাজিক দক্ষতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এই সব শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভূমিকা পালন করছে।

নারী-পুরুষের সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নে অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কর্মসংস্থান অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয়। বাংলাদেশে কর্মজীবী নারীরা বিবাহ অথবা সন্তান জন্মদানে পর প্রায় নারীরা কর্মসংস্থান ছেড়ে পরিবারকে সময় দেয় এবং শিশু সন্তান লালন-পালনে ব্যস্ত হয়ে পরে। স্বামীরা একাই সংসারের খরচ সংগ্রহের দায়িত্ব নেয়; আর স্ত্রীরা সংসারের রান্না-বান্না, পানি আনা, ঘর গোছানো, সন্তান লালন-পালনসহ অন্যান্য সব কর্ম করে থাকে। পুরুষই শুধু ব্রেডউইনার এবং নারী হোম-মেকার বা হাউজ-ওয়াইফ হবে, এই প্রচলিত ধারণা থেকে সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে। দেশের দুই-তৃতীয়াংশ নারীকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে নারীর ক্ষমতায়ন এবং দেশকে উন্নত দেশে রূপান্তর করা সম্ভব নয়। তাছাড়া এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা-৫ নারী-পুরুষের সমতা অর্জন করাও সম্ভব নয়। নারীর শতভাগ ক্ষমতায়নে নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে হবে। আর নারীকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্ত নিশ্চিত করতে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সন্তান জন্মদানের পর একটা র্দীঘ সময় নারীকে সন্তান লালন-পালন কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় তার জন্য তাকে কর্মসংস্থান ছাড়তে বাধ্য হয়। এ ক্ষেত্রে শিশুদের লালন-পালনের জন্য সুষ্ঠু সুন্দর নিরাপদ পরিবেশ চান সকাল অভিভাবক। ডে-কেয়ার সেন্টার বা শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান/জায়গা সেখানে কর্মজীবী বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানকে রেখে নিশ্চিতে কর্মস্থলে যেতে পারে পারেন।

সংবিধানে নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় কারণে নারীরা পুরুষের সমান অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বা বৈষম্যের এ অবস্থা থেকে উত্তরনের জন্য সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ এর সংশোধনীতে ৯৮ ধারায় শিশু-কক্ষবিষয়ক আইন যুক্ত করা হয়। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, একটি অফিসে ৪০ জন বা এর অধিক নারী কর্মরত থাকলে এবং তাদের ছয় বছরের কম বয়সী শিশু সন্তান থাকলে তাদের সুবিধার্থে কর্মক্ষেত্রে একটি শিশু-কক্ষ স্থাপন করতে হবে। বড় বড় শহরের উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত কর্মজীবী মায়েরা সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিশুর যতে্ন ডে-কেয়ার সেন্টারের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। তবে নি¤্নবিত্ত কর্মজীবী বাবা-মায়ের সন্তানদের লালন-পালন সুযোগ বেশ কম। সরকারি উদ্যোগে বর্তমান সরকারে একটি প্রকল্পের ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত নিম্নবিত্তদের জন্য সাতটি এবং মধ্যবিত্তদের চারটিসহ মোট ১১টি ডে-কেয়ার সেন্টার চালু করে এবং পরবর্তীতে এ কর্মসূচি চলমান রয়েছে। সরকারি উদ্যোগে গার্মেন্টস কারখানায় নারী শ্রমিকদের শিশুদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার চলমান রয়েছে, বর্তমানে এ কর্মসূচির ২য় পর্যায় চলমান রয়েছে। জাতীয় মহিলা সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন উপজেলায় মোট ১৫টি স্থানে এ সকল ডে-কেয়ার সেন্টার চলমান রয়েছে। প্রায় দেড় হাজার শিশুকে দিবাযত্ন কেন্দ্রে দিবাকালিন সেবা দেওয়া হচ্ছে।

সরকারি এ কর্মসূচির উদ্দেশ্য হলো : গার্মেন্ট ও কারখানার মহিলা শ্রমিকেরা দুঃশ্চিন্তা ও অসুবিধা হতে দুরে থেকে যাতে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে পারে সেজন্য তাদের কর্মস্থলের আশে পাশে ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন তাদের শিশুদের নিরাপদ পরিবেশে সযতে্ন দেখা শোনার সুযোগ সৃষ্টি করা; তাদের এক থেকে ছয় বছর সন্তানদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার করা; শিশুদের সুস্থ শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ, স্বাস্থ্য সেবা প্রদান, অক্ষরজ্ঞান দান, অভ্যন্তরীন খেলাধুলা ও অন্যান্য বিনোদনমূলক কার্যক্রম গ্রহণ এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গার্মেন্টস শিল্পের অবদান অসামান্য। এ খাতে প্রায় ১৬ লাখের অধিক নারী কর্মী প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। পারিবারিক প্রয়োজন ও জীবিকা নির্বাহের জন্য দেশে স্বল্প শিক্ষিতি ও দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা গার্মেন্ট কারখানায় কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে হিসেবে বেছে নেয়। পরবর্তীতে এসকল নারীরা বিয়ের পর এবং সন্তান জন্মদানে পর গার্মেন্টস কারখানার চাকুরি ছেড়ে দেয় এবং শিশু সন্তান লালন-পালন ও পরিবারের ঘর ঘর-সংসার গোছানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পরে। শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপনে তারা শিশু সন্তানদের রেখে নিশ্চিত চাকুরি করতে পারচ্ছে। যদিও গার্মেন্ট কারখানার নারী শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় চাহিদার তুলনায় এ শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র অপ্রতুল। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে কিছু ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন হচ্ছে। নারী-পুরুষের সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন এবং গার্মেন্টস কারখানার নারী শ্রমিকের কর্মসংস্থানকে নিরাপদ ও নিশ্চিত করতে অধিক সংখ্যক শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন অত্যন্ত জরুরি। নারী ও উন্নয়নকে এক সূতায় গেঁথে দেশকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে হলে, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের মত জরুরি প্রয়োজনীয় বিষয়কে মূলধারার পরিকল্পনা নীতিমালা গুরুত্বসহকারের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সরকার এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা তাদের কর্মসূচিতে আরও অগ্রাধিকার দিয়ে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন ও বাস্তবায়ন পরিকল্পনা করতে হবে।

(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম ফিচার)

মঙ্গলবার, ০৭ জানুয়ারী ২০২০ , ২৪ পৌষ ১৪২৬, ১০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪১

নারী শ্রমিকের সন্তানদের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র এবং নারীর ক্ষমতায়ন

মো. জাহাঙ্গীর আলম

ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার আশুলিয়ায় শাহানা আক্তার ও বাবুল মিয়া দম্পত্তির একমাত্র মেয়ে সোহানা, বয়স দুই বছর। এই দম্পত্তি দুই জনেই গার্মেন্টস কারখানায় চাকরি করে। তাদের মেয়েটিকে পাশের একটি ডে-কেয়ার সেন্টার (শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র)-এ রেখে তারা গার্মেন্ট চাকরিতে যায়। গত এক বছর যাবৎ তারা মেয়েকে সকালে ডে-কেয়ার সেন্টারে রেখে আসে এবং সন্ধ্যায় নিয়ে আসে। শাহানা ও বাবুল দম্পত্তি পাঁচ বছর ধরে গার্মেন্টে চাকরি করে। সন্তান জন্ম নেয়ার পর শাহানা প্রায় এক বছর চাকরি ছেড়ে বাসায় সন্তানটিকে লালন-পালন করতেন। তিনি ভেবেছিলেন তার আর চাকরি করা হবে না। প্রতিবেশী রেবেকা নামের একজন গার্মেন্ট কর্মীর মাধ্যমে জানতে পারে, তারা যে এলাকায় থাকেন সেখানে সরকারিভাবে পরিচালিত একটি ডে-কেয়ার সেন্টার রয়েছে। সেখানে মেয়ে রেখে সে গার্মেন্ট এ কাজ করতে পারবে। সেই থেকে শাহানা আক্তার তার মেয়েকে ওই ডে-কেয়ার সেন্টারে রেখে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরি করছেন। দুই জনেই চাকরি করায় সংসারে আগের তুলনায় বেশি স্বচ্ছলতা এসেছে।

শাহানা-বাবুল দম্পতির মতো অনেকই ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ সারা দেশে অনেক নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত দম্পতিই এইভাবে সন্তানকে ডে-কেয়ার সেন্টার এ রেখে চাকরি করছেন। কর্মজীবী বাবা-মায়ের শিশু সন্তানদের লালন-পালনে ডে-কেয়ার সেন্টারে রেখে আসাই এক মাত্র ভরসা।

গত এক দশকে দেশে নারী কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে হার প্রায় ৩৬ শতাংশ। যদিও নারীদের আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের তুলনায় অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের হার বেশি। দেশে দিনে দিনে একক পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন নগর অঞ্চলে একক পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে পরিবারের স্বামী-স্ত্রী উভয় কর্মসংস্থানে যুক্ত হওয়াতে তাদের ব্যস্তময় জীবনে শিশু সন্তানদের লালন-পালনে ডে-কেয়ার সেন্টার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ব্যস্ত বা কর্মজীবী বাবা-মায়েদের সন্তানদের বেড়ে ওঠা এবং মানসিক বিকাশ, লেখাপড়া এবং সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে বর্তমানে ডে-কেয়ার সেন্টার পরিবারের দায়িত্বের কাজ করছে। ব্যস্তময় নগর জীবনে শিশুর মানসিক বিকাশের ওপর গুরুত্ব দিয়ে এই সব দিবাযত্ন কেন্দ্রসমূহে গড়ে উঠেছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা এ সব দিবাযত্ন কেন্দ্রে ওপর নির্ভর করে পরিবারের স্বামী-স্ত্রী উভয় নিশ্চিতে চাকরি করেছেন। শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রে যে শুধু শিশুকে কিছু সময় রেখে দেয়া হয় তা নয়, শিশুকে খাওয়ানো, খেলাধুলা, আঁকা, গান শেখানোসহ অন্যান্য নানা কর্মকাণ্ডে যুক্ত করানো হয়। শিশুরা অন্য শিশুদের সঙ্গে সারা সময় হেসে, খেলে, দুষ্টুমি করে কাটায় এ সকল শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রে। এখানকার গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে শিশু একা নিঃসঙ্গ বোধ করে না। একক পরিবারের ক্ষেত্রে শিশুর সামাজিকীকরণ ও সামাজিক দক্ষতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এই সব শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভূমিকা পালন করছে।

নারী-পুরুষের সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নে অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কর্মসংস্থান অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয়। বাংলাদেশে কর্মজীবী নারীরা বিবাহ অথবা সন্তান জন্মদানে পর প্রায় নারীরা কর্মসংস্থান ছেড়ে পরিবারকে সময় দেয় এবং শিশু সন্তান লালন-পালনে ব্যস্ত হয়ে পরে। স্বামীরা একাই সংসারের খরচ সংগ্রহের দায়িত্ব নেয়; আর স্ত্রীরা সংসারের রান্না-বান্না, পানি আনা, ঘর গোছানো, সন্তান লালন-পালনসহ অন্যান্য সব কর্ম করে থাকে। পুরুষই শুধু ব্রেডউইনার এবং নারী হোম-মেকার বা হাউজ-ওয়াইফ হবে, এই প্রচলিত ধারণা থেকে সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে। দেশের দুই-তৃতীয়াংশ নারীকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে নারীর ক্ষমতায়ন এবং দেশকে উন্নত দেশে রূপান্তর করা সম্ভব নয়। তাছাড়া এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা-৫ নারী-পুরুষের সমতা অর্জন করাও সম্ভব নয়। নারীর শতভাগ ক্ষমতায়নে নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে হবে। আর নারীকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্ত নিশ্চিত করতে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সন্তান জন্মদানের পর একটা র্দীঘ সময় নারীকে সন্তান লালন-পালন কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় তার জন্য তাকে কর্মসংস্থান ছাড়তে বাধ্য হয়। এ ক্ষেত্রে শিশুদের লালন-পালনের জন্য সুষ্ঠু সুন্দর নিরাপদ পরিবেশ চান সকাল অভিভাবক। ডে-কেয়ার সেন্টার বা শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান/জায়গা সেখানে কর্মজীবী বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানকে রেখে নিশ্চিতে কর্মস্থলে যেতে পারে পারেন।

সংবিধানে নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় কারণে নারীরা পুরুষের সমান অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বা বৈষম্যের এ অবস্থা থেকে উত্তরনের জন্য সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ এর সংশোধনীতে ৯৮ ধারায় শিশু-কক্ষবিষয়ক আইন যুক্ত করা হয়। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, একটি অফিসে ৪০ জন বা এর অধিক নারী কর্মরত থাকলে এবং তাদের ছয় বছরের কম বয়সী শিশু সন্তান থাকলে তাদের সুবিধার্থে কর্মক্ষেত্রে একটি শিশু-কক্ষ স্থাপন করতে হবে। বড় বড় শহরের উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত কর্মজীবী মায়েরা সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিশুর যতে্ন ডে-কেয়ার সেন্টারের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। তবে নি¤্নবিত্ত কর্মজীবী বাবা-মায়ের সন্তানদের লালন-পালন সুযোগ বেশ কম। সরকারি উদ্যোগে বর্তমান সরকারে একটি প্রকল্পের ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত নিম্নবিত্তদের জন্য সাতটি এবং মধ্যবিত্তদের চারটিসহ মোট ১১টি ডে-কেয়ার সেন্টার চালু করে এবং পরবর্তীতে এ কর্মসূচি চলমান রয়েছে। সরকারি উদ্যোগে গার্মেন্টস কারখানায় নারী শ্রমিকদের শিশুদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার চলমান রয়েছে, বর্তমানে এ কর্মসূচির ২য় পর্যায় চলমান রয়েছে। জাতীয় মহিলা সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন উপজেলায় মোট ১৫টি স্থানে এ সকল ডে-কেয়ার সেন্টার চলমান রয়েছে। প্রায় দেড় হাজার শিশুকে দিবাযত্ন কেন্দ্রে দিবাকালিন সেবা দেওয়া হচ্ছে।

সরকারি এ কর্মসূচির উদ্দেশ্য হলো : গার্মেন্ট ও কারখানার মহিলা শ্রমিকেরা দুঃশ্চিন্তা ও অসুবিধা হতে দুরে থেকে যাতে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে পারে সেজন্য তাদের কর্মস্থলের আশে পাশে ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন তাদের শিশুদের নিরাপদ পরিবেশে সযতে্ন দেখা শোনার সুযোগ সৃষ্টি করা; তাদের এক থেকে ছয় বছর সন্তানদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার করা; শিশুদের সুস্থ শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ, স্বাস্থ্য সেবা প্রদান, অক্ষরজ্ঞান দান, অভ্যন্তরীন খেলাধুলা ও অন্যান্য বিনোদনমূলক কার্যক্রম গ্রহণ এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গার্মেন্টস শিল্পের অবদান অসামান্য। এ খাতে প্রায় ১৬ লাখের অধিক নারী কর্মী প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। পারিবারিক প্রয়োজন ও জীবিকা নির্বাহের জন্য দেশে স্বল্প শিক্ষিতি ও দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা গার্মেন্ট কারখানায় কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে হিসেবে বেছে নেয়। পরবর্তীতে এসকল নারীরা বিয়ের পর এবং সন্তান জন্মদানে পর গার্মেন্টস কারখানার চাকুরি ছেড়ে দেয় এবং শিশু সন্তান লালন-পালন ও পরিবারের ঘর ঘর-সংসার গোছানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পরে। শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপনে তারা শিশু সন্তানদের রেখে নিশ্চিত চাকুরি করতে পারচ্ছে। যদিও গার্মেন্ট কারখানার নারী শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় চাহিদার তুলনায় এ শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র অপ্রতুল। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে কিছু ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন হচ্ছে। নারী-পুরুষের সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন এবং গার্মেন্টস কারখানার নারী শ্রমিকের কর্মসংস্থানকে নিরাপদ ও নিশ্চিত করতে অধিক সংখ্যক শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন অত্যন্ত জরুরি। নারী ও উন্নয়নকে এক সূতায় গেঁথে দেশকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে হলে, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের মত জরুরি প্রয়োজনীয় বিষয়কে মূলধারার পরিকল্পনা নীতিমালা গুরুত্বসহকারের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সরকার এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা তাদের কর্মসূচিতে আরও অগ্রাধিকার দিয়ে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন ও বাস্তবায়ন পরিকল্পনা করতে হবে।

(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম ফিচার)